Logo Sponsored by Chowdhury and Hossain, Advanced Publications

Ekusher Golpo read

একুশের গল্প
জহির রায়হান

লেখক পরিচিতি
জীবনমুখী সমাজসচেতন কথাসাহিত্যিক জহির রায়হান ছিলেন একাধারে সাহিত্যাশিল্পী, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী ও চলচ্চিত্রকার। তাঁর আসল নাম মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ।
পরবর্তী জীবনে চলচ্চিত্রকারের অসামান্য খ্যাতি অর্জন করলেও তাঁর খ্যাতির সূচনা গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে। সমাজ জীবনের নানা বৈষম্য অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছিলেন শিল্পীর দায়িত্ববোধ থেকে। জহির রায়হানের জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে : ‘হাজার বছর ধরে', ‘আরেক ফাল্গুন', ‘বরফ গলা নদী', ‘আর কতদিন'। তাঁর লেখা গল্প সংকলিত হয়েছে ‘জহির রায়হানের গল্প সংগ্রহ' গ্রন্থে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর ‘জীবন থেকে নেয়া', ‘স্টপ জেনোসাইড', ‘লেট দেয়ার বি লাইট' ইত্যাদি চলচ্চিত্রের জন্য।
জহির রায়হানের জন্ম ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় লাভের অব্যবহিত পরে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে জানুয়ারি তিনি নিখোঁজ হন। তাঁর আর কোনো সন্ধান মেলেনি।

তপুকে আবার ফিরে পাবো, একথা ভুলেও ভাবি নি কোনদিন। তবু সে আবার ফিরে এসেছে আমাদের মাঝে। ভাবতে অবাক লাগে, চার বছর আগে যাকে হাইকোর্টের মোড়ে শেষবারের মতো দেখেছিলাম, যাকে জীবনে আর দেখবো বলে স্বপ্নেও কল্পনা করিনি-সেই তপু ফিরে এসেছে। ও ফিরে আসার পর থেকে আমরা সবাই যেন কেমন একটু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। রাতে ভালো ঘুম হয় না। যদিও একটু আধটু তন্দ্রা আসে, তবু অন্ধকারে হঠাৎ ওর দিকে চোখ পড়লে গা হাত পা শিউরে ওঠে। ভয়ে জড়সড় হয়ে যাই। লেপের নিচে দেহটা ঠক্ঠক্ করে কাঁপে।  
দিনের বেলা ওকে ঘিরে আমরা ছোটখাটো জটলা পাকাই। খবর পেয়ে অনেকেই দেখতে আসে ওকে। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে ওরা। আমরা যে অবাক হই না তা নয়। আমাদের চোখেও বিস্ময় জাগে। দুবছর ও আমাদের সাথে ছিলো। ওর শ্বাসপ্রশ্বাসের খবরও আমরা রাখতাম। সত্যি কি অবাক কান্ড দেখ তো, কে বলবে যে এ তপু। ওকে চেনাই যায় না। ওর মাকে ডাকো, আমি হলপ করে বলতে পারি, ওর মা-ও চিনতে পারবে না ওকে।
চিনকে কী করে? জটলার একপাশ থেকে রাহাত নিজের মত বলে চেনার কোন উপায় থাকলে তো চিনবে। এ অবস্থায় কেউ কাউকে চিনতে পারে না। বলে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
আমরাও কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়ি ক্ষণেকের জন্য। অনেক কষ্টে ঠিকানা যোগাড় করে কাল সকালে রাহাতকে পাঠিয়েছিলাম, তপুর মা আর বউকে খবর দেবার জন্য। 
সারাদিন এখানে সেখানে পইপই করে ঘুরে বিকেলে যখন রাহাত ফিরে এসে খবর দিলো, ওদের কাউকে পাওয়া যায় নি। তখন রীতিমতো ভাবনায় পড়লাম আমরা। এখন কি করা যায় বল তো, ওদের এক জনকেও পাওয়া গেল না? আমি চোখ তুলে তাকালাম রাহাতের দিকে। 
বিছানার ওপর ধপাস করে বসে পড়ে রাহাত বললো, ওর মা মারা-গেছে।
মারা গেছে? আহা সেবার এখানে গড়াগড়ি দিয়ে কী কান্নাকাটিই না তপুর জন্যে কেঁদেছিলেন তিনি। ওঁর কান্না দেখে আমার নিজের চোখের পানি এসে গিয়েছিলো।
বউটার খবর?
ওর কথা বলো না আর। রাহাত মুখ বাঁকালো। অন্য আর এক জায়গায় বিয়ে করেছে। সেকি! এর মধ্যে বিয়ে করে ফেললো মেয়েটা? তপু ওকে কত ভালবাসতো। নাজিম বিড়বিড় করে বলে উঠলো চাপা স্বরে। সানু বললো, বিয়ে করবে না তো কি সারা জীবন বিধবা হয়ে থাকবে নাকি মেয়েটা। বলে তপুর দিকে তাকালো সানু।
আমরাও দৃষ্টি ফিরিয়ে আনলাম ওর ওপর।
সত্যি, কে বলবে এ চার বছর আগেকার সেই তপু, যার মুখে এক ঝলক হাসি আঠার মতো লেগে থাকতো সব সময়, তার দিকে তাকাতে ভয়ে আমার রক্ত হিম হয়ে আসে কেন?
দু'বছর সে আমাদের সাথে ছিলো।
আমরা ছিলাম তিন জন।
আমি, তপু আর রাহাত।
তপু ছিলো আমাদের মাঝে সবার চাইতে বয়সে ছোট। কিন্তু বয়সে ছোট হলে কী হবে, ও-ই ছিলো একমাত্র বিবাহিত।
কলেজে ভর্তি হবার বছরখানেক পরে রেণুকে বিয়ে করে তপু। সম্পর্কে মেয়েটা আত্মীয়া হতো ওর। দোহারা গড়ন, ছিপছিপে কটি, আপেল রঙের মেয়েটা প্রায়ই ওর সাথে দেখা করতে আসতো এখানে। ও এলে আমরা চাঁদা তুলে চা আর মিষ্টি এনে খেতাম। আর গল্পগুজবে মেতে উঠতাম রীতিমতো। তপু ছিল গল্পের রাজা। যেমন হাসতে পারতো ছেলেটা, তেমনি গল্প করার ব্যাপারেও ছিল ওস্তাদ।
যখন ও গল্প করতে শুরু করতো, তখন কাউকে কথা বলার সুযোগ দিতো না। সেই যে লোকটার কথা তোমাদের বলেছিলাম না সেদিন। সেই হোঁৎকা মোটা লোকটা, ক্যাপিটালে যার সাথে আলাপ হয়েছিল, ওই যে, লোকটা বলছিল সে বার্নাড শ হবে, পরশু রাতে মারা গেছে একটা ছ্যাকড়া গাড়ির তলায় পড়ে। ... আর সেই মেয়েটা, যে ওকে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়েছিলো ... ও মারা যাবার পরের দিন এক বিলেতি সাহেবের সাথে পালিয়ে গেছে ... রুণী মেয়েটার খবর জানতো। সে কী, রুণীকে চিনতে পারছো না? শহরের সেরা নাচিয়ে ছিলো, আজকাল অবশ্য রাজনীতি করছে। সেদিন দেখা হল রাস্তায়। আগে তো পাটকাঠি ছিলো। এখন বেশ মোটাসোটা হয়েছে। দেখা হতেই রেস্তোরাঁয় নিয়ে খাওয়ালো। বিয়ে করেছি শুনে জিজ্ঞেস করলো, বউ দেখতে কেমন।
হয়েছে, এবার তুমি এসো। উঃ, কথা বলতে শুরু করলে যেন আর ফুরোতে চান না; রাহাত থামিয়ে দিতে চেষ্টা করতো ওকে।
রেণু বলতো, আর বলবেন না, এত বক্তে পারে-।
বলে বিরক্তিতে না লজ্জায় লাল হয়ে উঠতো সে।
তবু থামতো না তপু। এক গাল হাসি ছড়িয়ে আবার পরম্পরাহীন কথার তুবড়ি ছোটাত সে, থাকগে অন্যের কথা যখন তোমরা শুনতে চাও না নিজের কথাই বলি। ভাবছি, ডাক্তারিটা পাশ করতে পারলে এ শহরে আর থাকবো না, গাঁয়ে চলে যাবো। ছোট্ট একটা ঘর বাঁধবো সেখানে। আর, তোমরা দেখো, আমার ঘরে কোন জাঁকজমক থাকবে না। একেবারে সাধারণ, হাঁ, একটা ছোট্ট ডিসপেনসারি, আর কিছু না। মাঝে মাঝে এমনি স্বপ্ন দেখায় অভ্যস্ত ছিল তপু।
এককালে মিলিটারিতে যাবার সখ ছিল ওর।
কিন্তু বরাত মন্দ। ছিলো জন্মখোঁড়া। ডান পা থেকে বাঁ পাটা ইঞ্চি দুয়েক ছোট ছিল ওর। তবে বাঁ জুতোর হিলটা একটু উঁচু করে তৈরি করায় দূর থেকে ওর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলাটা চোখে পড়তো না সবার। আমাদের জীবনটা ছিলো যান্ত্রিক।
কাক-ডাকা ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠতাম আমরা। তপু উঠতো সবার আগে। ও জাগাতো আমাদের দুজনকে, ওঠো, ভোর হয়ে গেছে দেখছো না? অমন মোষের মতো ঘুমোচ্ছা কেন, ওঠো। গায়ের উপর থেকে লেপটা টেনে ফেলে দিয়ে জোর করে আমাদের ঘুম ভাঙাতো তপু। মাথার কাছে জানালাটা খুলে দিয়ে বলতো, দেখ বাইরে কেমন মিষ্টি রোদ উঠেছে। আর ঘুমিয়ো না, ওঠো।
আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে, নিজ হাতে চা তৈরি করতো তপু। চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে আমরা বই খুলে বসতাম। তারপর দশটা নাগাদ স্নানাহার সেরে ক্লাশে যেতাম আমরা।
বিকেলটা কাটতো বেশ আমোদ-ফুর্তিতে। কোনদিন ইস্কাটনে বেড়াতে যেতাম আমরা। কোনদিন বুড়িগঙ্গার ওপারে। আর যেদিন রেণু আমাদের সাথে থাকতো, সেদিন আজিমপুরের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দূর গাঁয়ের ভেতর হারিয়ে যেতাম আমরা।
রেণু মাঝে মাঝে আমাদের জন্য ডালমুট ভেজে আনতো বাসা থেকে। গেঁয়ো পথে হাঁটতে হাঁটতে মুড়মুড় করে ডালমুট চিবোতাম আমরা। তপু বলতো, দেখো, রাহাত, আমার মাঝে মাঝে কি মনে হয় জান?
কী?
এই যে আঁকাবাঁকা লালমাটির পথ, এ পথের যদি শেষ না হতো কোনদিন। অনন্তকাল ধরে যদি এমনি চলতে পারতাম আমরা।
একি, তুমি আবার কবি হলে কবে থেকে? ভ্রু জোড়া কুঁচকে হঠাৎ প্রশ্ন করতো রাহাত।
না, না, কবি হতে যাব কেন। ইতস্তত করে বলতো তপু। তবু কেন যেন মনে হয় ...।
স্বপ্নালু চোখে স্বপ্ন নাবতো তার।
আমরা ছিলাম তিন জন।
আমি, তপু আর রাহাত।
দিনগুলো বেশ কাটছিলো আমাদের। কিন্তু অকস্মাৎ ছেদ পড়লো। হোস্টেলের বাইরে, সবুজ ছড়ানো মাঠটাতে অগুণিত লোকের ভীড় জমেছিলো সেদিন। ভোর হতে ক্রুদ্ধ ছেলেবুড়োরা এসে জমায়েত হয়েছিলো সেখানে। কারো হাতে প্ল্যাকার্ড, কারো হাতে স্লোগান দেবার চুঙ্গো, আবার কারো হাতে লম্বা লাঠিটায় ঝোলানো কয়েকটা রক্তাক্ত জামা। তর্জনী দিয়ে ওরা জামাগুলো দেখাচ্ছিলো, আর শুকনো, ঠোঁট নেড়ে এলোমেলো কী যেন বলছিলো নিজেদের মধ্যে। তপু হাত ধরে টান দিলো আমায়, এসো।
কোথায়?
কেন, ওদের সাথে।
চেয়ে দেখি, সমুদ্রগভীর জনতা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে।
এসো।
চলো।
আমরা মিছিলে পা বাড়ালাম।
একটু পরে পেছন ফিরে দেখি, রেণু হাঁপাতে হাঁপাতে আমাদের দিকে ছুটে আসছে। যা ভেবেছিলাম, দৌড়ে এসে তপুর হাত চেপে ধরলো রেণু। কোথায় যাচ্ছ তুমি। বাড়ি চলো। পাগল নাকি, তপু হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। তারপর বললো, তুমিও চলো না আমাদের সাথে। না, আমি যাবো না, বাড়ি চলো। রেণু আবার হাত ধরলো ওর। কী বাজে বকছেন। রাহাত রেগে উঠলো এবার। বাড়ি যেতে হয় আপনি যান। ও যাবে না।
মুখটা ঘুরিয়ে রাহাতের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে এক পলক তাকালো রেণু। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, দোহাই তোমার বাড়ি চলো। মা কাঁদছেন।
বললাম তো যেতে পারবো না, যাও। হাতটা আবার ছাড়িয়ে নিলো তপু।
রেণুর করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হলো। বললাম, কী ব্যাপার আপনি এমন করছেন কেন, ভয়ের কিছু নেই, আপনি বাড়ি যান।
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে টলটলে চোখ নিয়ে ফিরে গেলো রেণু। মিছিলটা তখন মেডিকেলের গেট পেরিয়ে কার্জন হলের কাছাকাছি এসে গেছে।
তিনজন আমরা পাশাপাশি হাঁটছিলাম।
রাহাত স্লোগান দিচ্ছিলো।
আর তপুর হাতে ছিলো একটি মস্ত প্ল্যাকার্ড। তার ওপর লাল কালিতে লেখা ছিলো, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। মিছিলটা হাইকোর্টের মোড়ে পৌঁছুতে অকস্মাৎ আমাদের সামনের লোকগুলো চিৎকার করে পালাতে লাগলো চারপাশে। ব্যাপার কী বুঝবার আগেই চেয়ে দেখি, প্ল্যাকার্ডসহ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে তপু। কপালের ঠিক মাঝখানটায় গোল একটা গর্ত। আর সে গর্ত দিয়ে নির্ঝরের মতো রক্ত ঝরছে তার।
তপু! রাহাত আর্তনাদ করে উঠলো।
আমি তখন বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম।
দুজন মিলিটারি ছুটে এসে তপুর মৃতদেহটা তুলে নিয়ে গেলো আমাদের সামনে থেকে। আমরা এতটুকুও নড়লাম না, বাধা দিতে পারলাম না। দেহটা যেন বরফের মতো জমে গিয়েছিলো, তারপর আমিও ফিরে আসতে আসতে চিৎকার করে উঠলাম, রাহাত পালাও।
কোথায়? হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো রাহাত।
তারপর উভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিলাম আমরা ইউনিভার্সিটির দিকে। সে রাতে তপুর মা এসে গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছিলেন এখানে। রেণুও এসেছিলো, পলকহীন চোখজোড়া দিয়ে অশ্রুর ফোয়ারা নেমেছিলো তার। কিন্তু আমাদের দিকে একবারও তাকায় নি সে। একটা কথাও আমাদের সাথে বলেনি রেণু। রাহাত শুধু আমার কানে ফিসফিস করে বলেছিলো, তপু না মরে আমি মরলেই ভালো হতো। কী অবাক কান্ড দেখ তো, পাশাপাশি ছিলাম আমরা। অথচ আমাদের কিছু হলো না, গুলি লাগলো কিনা তপুর কপালে কী অবাক কান্ড দেখ তো।
তারপর চারটে বছর কেটে গেছে। চার বছর পর তপুকে ফিরে পাবো, একথা ভুলেও ভাবি নি কোনদিন।
তপু মারা যাবার পর রেণু এসে একদিন মালপত্রগুলো সব নিয়ে গেলো ওর। দুটো স্যুটকেস, একটা বইয়ের ট্রাঙ্ক, আর একটা বেডিং। সেদিনও মুখ ভার করে ছিলো রেণু।
কথা বলেনি আমাদের সাথে। শুধু রাহাতের দিকে একপলক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো, ওর একটা গরম কোট ছিলো না, কোটটা কোথায়? ও, ওটা আমার স্যুটকেসে। ধীরে কোটটা বের করে দিয়েছিলো রাহাত।
এরপর দিন কয়েক তপুর সিটটা খালি পড়ে ছিলো। মাঝে মাঝে রাত শেষ হয়ে এলে আমাদের মনে হতো, কে যেন গায়ে হাত দিয়ে ডাকছে আমাদের।
ওঠো, আর ঘুমিও না, ওঠো। 
চোখ মেলে কাউকে দেখতে পেতাম না, শুধু ওর শূন্য বিছানার দিকে তাকিয়ে মনটা ব্যথায় ভরে উঠতো।
তারপর একদিন তপুর সিটে নতুন ছেলে এলো একটা। সে ছেলেটা বছর তিনেক ছিলো।
তারপর এলো আর একজন। আমাদের নতুন রুমমেট। বেশ হাসিখুশি ভরা মুখ। 
সেদিন সকালে বিছানায় বসে, ‘এনাটমি'র পাতা উল্টাচ্ছিলো সে। তার চৌকির নিচে একটা ঝুড়িতে রাখা ‘স্কেলিটনের' ‘স্কাল'টা বের করে দিখছিলো আর বইয়ের সাথে মিলিয়ে পড়ছিলো সে। তারপর এক সময় হঠাৎ রাহাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, রাহাত সাহেব, একটু দেখুন তো, আমার স্কালের কপালের মাঝখানটায় একটা গর্ত কেন? কী বললে? চমকে উঠে উভয়েই তাকালাম ওর দিকে।
রাহাত উঠে গিয়ে স্কালটা তুলে নিলো হাতে। ঝুঁকে পড়ে সে দেখতে লাগলো অবাক হয়ে। হাঁ, কপালের মাঝখানটায় গোল একটা ফুটো, রাহাত তাকালো আমার দিকে, ওর চোখের ভাষা বুঝতে ভুল হলো না আমার। বিড়বিড় করে বললাম, বাঁ পায়ের হাড়টা দু'ইঞ্চি ছোট ছিলো ওর।
কথাটা শেষ না হতেই ঝুড়ি থেকে হাড়গুলো তুলে নিলো রাহাত। হাতজোড়া ঠক্ঠক্ করে কাঁপছিলো ওর। একটু পরে উত্তেজিত গলায় চিৎকার করে বললো, বাঁ পায়ের টিবিয়া ফেবুলাটা দু'ইঞ্চি ছোট।  
দেখো, দেখো।
উত্তেজনায় আমিও কাঁপছিলাম।
ক্ষণকাল পরে স্কালটা দুহাতে তুলে ধরে রাহাত বললো, তপু।
বলতে গিয়ে গলাটা ধরে এলো ওর।

শব্দার্থ ও টীকা
দোহারা                          -           মোটাও নয় রোগাও নয়।
কটি                               -           কোমর।
বার্নার্ড শ                         -           জর্জ বার্নার্ড শ (১৮৫৬-১৯৫০)। ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক ও নাট্যকার। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। ‘ম্যান অ্যান্ড সুপার ম্যান', ‘সেন্ট জোয়ান' ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত নাটক।
ছ্যাকড়া গাড়ি                    -           নিকৃষ্টমানের ঘোড়ার গাড়ি। ছক্কড় মার্কা গাড়ি।
পরম্পরাহীন                     -           ধারাবাহিকতাবিহীন।
তুবড়ি                             -           অনেক ওপরে পর্যন্ত আগুনের ফুলকির ফোয়ারা ওঠে এমন এক ধরনের বাজি।
কথার তুবড়ি                     -           অনর্গল কথা।
ডিসপেনসারি                    -           ঔষুধের দোকান।
সমুদ্র-গভীর জনতা              -           উত্তাল জনতার সমুদ্র।
প্ল্যাকার্ড                          -           প্রকাশ্যে প্রদর্শনের জন্য প্রাচীর পত্র বা পোস্টার।
এনাটমি                          -           শরীরবিদ্যা, অঙ্গ ব্যবচ্ছেদবিদ্যা, ইভর্টমবহ।
স্কেলিটন                          -           কঙ্কাল, ওপণফর্ণমভ।
স্কাল                              -           মাথার খুলি, ওপলফফ।
টিবিয়া ফেবুলা                   -           জঙ্ঘাস্থি ও অনুজঙ্ঘাস্থি, কধঠধট-তধঠলফট।
উৎস ও পরিচিতি
জহির রায়হানের ‘একুশের গল্প' চয়িত হয়েছে ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত জহির রায়হান রচনাবলীর দ্বিতীয় খন্ড থেকে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা এই গল্পে লেখক এঁকেছেন মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত এক প্রাণবন্ত, উদ্দাম, হৃদয়বান সহপাঠীর ছবি যে শহীদ হয় ভাষা আন্দোলনে। লাশ ছিনতাই হয়ে যায় মিলিটারির হাতে। মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে নর-কঙ্কালের সঙ্গে মিলিয়ে শরীরবিদ্যা পড়ার সময়ে আবিষ্কৃত হয় এ কঙ্কাল সেই শহীদ সহপাঠীর।
অনুশীলনমূলক কাজ
সাহিত্যবোধ q বাস্তব সত্য ও শিল্পসত্য
লেখক সত্যি বা ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে যে সাহিত্য তৈরি করেন তাকে কিন্তু সব সময় পুরোপুরি ইতিহাস বা সত্য ঘটনা বলা চলে না। কারণ লেখক এখানে কল্পনার আশ্রয় নিয়ে নতুনভাবে কাহিনী, ঘটনা, চরিত্র ইত্যাদি সৃষ্টি করে থাকেন।
লেখক সাহিত্যের যে চরিত্র সৃষ্টি করেন তার বৈশিষ্ট্য, ক্রিয়াকলাপ যতটা গল্পের কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে থাকে, বাস্তবের সঙ্গে ততটা নয়।
তবে সাহিত্যের সত্য হুবহু সত্য না হলেও লেখক সাহিত্যে এক ধরনের সত্যকে তুলে ধরেন। তাকে বলা হয় শিল্প-সত্য বা কাব্য-সত্য। সব মহৎ সাহিত্য ন্যায্য ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে এই ধরনের শিল্প-সত্য। খুঁটিয়ে দেখলে যে কোনো সার্থক সাহিত্যকর্মে আমরা দু'ধরনের অর্থের দেখা পাই। একটি হচ্ছে আক্ষরিক অর্থ, অন্যটি প্রতীকী তাৎপর্য। আক্ষরিক অর্থ আমাদের আক্ষরিক সত্যের ধারণা দেয় এবং প্রতীকী তাৎপর্য দেয় প্রতীকী সত্যের মহিমা, যা শিল্প-সত্যেরই নামান্তর। লেখক আক্ষরিক সত্যকে ব্যবহার করেন শিল্প-সত্যের মহিমা ফুটিয়ে তুলতে। আক্ষরিক সত্য স্থানীয়, কালিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু শিল্পসত্য স্থান ও কালের গন্ডি পেরিয়ে সর্বজনীন হয়ে যায়।
‘একুশের গল্পে' বর্ণিত তপু চরিত্রটি এই গল্পে চরিত্র হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় নয়। তার চরিত্র ফুটে উঠেছে বর্ণনাকারীর বিবরণের মাধ্যমে। কিন্তু সেই বর্ণনার মধ্যেও ঐ চরিত্রের একটা ছবি বা ভাবমূর্তি আমাদের মনের মধ্যে তৈরি হয়। আমাদের মনের ছবিতে আমরা তাকে সক্রিয় হতে দেখি দৈনন্দিন জীবনে, মিছিলে, আন্দোলনে। দেখি, গুলি খেয়ে তাকে রাজপথে লুটিয়ে পড়তে। দেখি পুলিশের হাতে তার লাশ ছিনতাই হতে। এমনকি গল্পের শেষে যখন দেখা যায়, মেডিকেলের ছাত্রের হাতে মাথার খুলির মাঝখানে গর্ত এবং পায়ের হাড় দু'ইঞ্চি ছোট তখনও আমাদের মনের পর্দায় ভেসে ওঠে ভাষা আন্দোলনের নিহত মৃত তপুর ছবি।
লেখক আমাদের মনের পর্দায় যে তপুর ছবি তৈরি করে দেন সে তপু বাস্তবের কোনো তপু নয়, কিন্তু এই তপুর মধ্যে দিয়ে ভাষা আন্দোলনের নাম না-জানা শহীদের প্রতীক ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। এভাবে প্রতীকী তাৎপর্যের মাধ্যমে লেখক আমাদের সামনে শিল্প-সত্য তুলে ধরেন।
দ্বিতীয়ত, কল্পিত এই চরিত্র ভাষা আন্দোলনের স্থানিক ও কালিক মহিমা অতিক্রম করে যায়। এই গল্প দেশে কিংবা দেশের বাইরে যেখানেই কিংবা যতদিন পরেই পঠিত হোক না কেন পাঠকের মনের পর্দায় তপু জীবন্ত হয়ে ওঠে ভাষার জন্যে আত্মদান করেছে এমন একটি সর্বজনীন চরিত্রের প্রতীক হিসেবে।
বাস্তবের সত্য থেকে শিল্প-সত্য যে আলাদা সেটা আরও বোঝা যায় এভাবে দেখলে : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ঘটনার যে বিবরণ আমরা পড়ি তা বাস্তব সত্য। কিন্তু তাতে তপুর মতো কোনো চরিত্র আমাদের মনে ফুটে ওঠে না। কিন্তু গল্পের তপু আমাদের মনের পর্দায় জীবন্ত হয়ে বাস্তব সত্যকেও ছাড়িয়ে যায়।
ভাষা অনুশীলন q অনুসর্গ
বাক্যের কোনো কোনো শব্দ পদের পরে বসে ঐ পদের বিভক্তির কাজ করে- এদের বলা হয় অনুসর্গ। এগুলোকে বিভক্তি হিসেবে ব্যবহৃত পদ বলা চলে। যেমন :
তপুর আবার ফিরে এসেছে আমাদের মাঝে।
অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে ওরা।
হাসি দিয়ে ঘরটাকে ভরিয়ে রাখতো সে।
বছরখানেক পরে রেণুকে বিয়ে করে তপু।
ক্যাপিটালে তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।
ভোর হতে ছেলেবুড়ো এসে জমায়েত হল।

দীর্ঘ-উত্তর প্রশ্ন
১.     ‘একুশের গল্পে’ সহপাঠীর চোখে তপুর যে চরিত্র-পরিচয় ফুটে উঠেছে তার বিবরণ দাও।
২.     বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে ‘একুশের গল্পে’ জহির রায়হান যে শিল্প-সত্য ফুটিয়ে তুলেছেন তা  আলোচনা  কর।
৩.     ছোটগল্প কাকে বলে? ‘একুশের গল্প’ ছোটগল্প হিসেবে কতটুকু সার্থক বিচার কর।

বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১.     ‘তপুকে ফিরে পাবো, এ কথা ভুলেও ভাবি নি কোনো দিন। তপু যে আবার ফিরে এসেছে আমাদের মাঝে’- কী ভাবে? ‘একুশের গল্পে’ এই সূচনার সঙ্গে পরিসমাপ্তির কী সম্পর্ক রয়েছে? 
২.     চার বছর পর যে তপু ফিরে এসেছে তাকে নিয়ে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছে সহপাঠী মহলে? কেন?
৩.     তপু ফিরে এসেছে- এ কথাটা জানাতে গিয়ে ওর মা ও স্ত্রী সম্পর্কে কী সংবাদ জানা গেল?
৪.     সহপাঠী হিসেবে তপু কেমন ছিল?
৫.     গল্পকথক, তপু ও রাহাতের জীবনের স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দতায় ছেদ পড়লো কীভাবে?
৬.     কোন ঘটনায় কীভাবে তপু চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল?
৭.     তপু তার হোস্টেলের কামরায় কীভাবে আবিষ্কৃত হল?
৮.     রেণু কে? কোন দুঃসহ বেদনায় সে নিথর হয়ে গিয়েছিল?
৯.     ‘একুশের গল্পে’ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঘটনা কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে?
ভাষাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১.     নেতিবাচক বাক্যকে অস্তিবাচক বাক্যে রূপান্তর কর :
        (ক) ওকে চেনাই যায় না।
        (খ) এ অবস্থায় কেউ কাউকে চিনতে পারে না।
        (গ) এ কথা ভুলেও ভাবি নি কোনদিন।
        (ঘ) ওদের কাউকে পাওয়া যায় নি। 
        (ঙ) আমরা বাধা দিতে পারলাম না।
        (চ) আমরা নড়লাম না।
২.     সংযোজনের মাধ্যমে একটি বাক্যে পরিণত কর :
        (ক) চার বছর আগে তাকে হাইকোর্টের মোড়ে দেখেছিলাম। শেষবারের মতো তাকে দেখেছিলাম আমি। তাকে জীবনে আর দেখবো বলে স্বপ্নেও কল্পনা করি নি। সেই তপু ফিরে এসেছে।
        (খ) সারাদিন এখানে সেখানে পইপই করে ঘুরল। তারপর বিকেলে রাহাত ফিরে এল। খবর দিল, ওদের কাউকে পাওয়া যায়নি। তখন রীতিমত ভাবনায় পড়লাম আমরা।
৩.     সাধুভাষায় রূপান্তর কর :
        (ক) খবর পেয়ে ............. পারবে না ওকে।
        (খ) কলেজে ভর্তি হবার ............. ওস্তাদ।
        (গ) কাক-ডাকা ভোরে ............. ঘুমিও না, ওঠো।  
        (ঘ) দিনগুলো বেশ ............. নিজেদের মধ্যে।       
        (ঙ) তারপর উভয়ে ............. কান্ড দেখ তো।        
        (চ) সেদিন সকালে ............. ওর দিকে।              
৪.     চিকিৎসা শাস্ত্রে ব্যবহৃত হয় এমন কয়েকটি শব্দ লেখ যেগুলো ‘একুশের গল্পে’ ব্যবহৃত হয়েছে। শব্দগুলোর অর্থ লেখ। এই গল্পে এসব শব্দ ব্যবহারের পেছনে লেখকের কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য কাজ করেছে কি?
৫.     অনুসর্গ কাকে বলে? পাঁচটি বাক্যে অনুসর্গের প্রয়োগ দেখাও।

ব্যাখ্যা
সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা
১.     সে হাসি কোথায় গেল তপুর?
২.     সমুদ্র-গভীর জনতা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে।
৩.     পলকহীন চোখজোড়া দিয়ে অশ্রুর ফোয়ারা নেমেছিল তার।
 

View Foundation Digital Talking Library is developed and maintained by Sigma Enterprise.
Theme designed by Imtiaz
All rights are reserved. Any kind of reproduction of any mp3 files and text files is prohibited. If any organization or any person is found copying or reproducing any of the material will be punished under copy right law.