Logo Sponsored by Chowdhury and Hossain, Advanced Publications

Ekti Tulsi Gacher Kahini read

একটি তুলসী গাছের কাহিনী
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
লেখক পরিচিতি
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার। তিনি সমাজসচেতন সাহিত্যশিল্পী। জীবন সন্ধানী সমাজসচেতন এই শিল্পী ব্যক্তিজীবন ও সমাজ সমস্যাকে করেছেন তাঁর সৃজনকর্মের প্রধান উপজীব্য। আর তাঁর রচনায় উজ্জ্বলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার, মূল্যবোধের অবক্ষয়, ‘মানব মনের অন্তর্দ্বনদ্ব ইত্যাদি। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার পথিকৃৎ তিনি।
কলকাতার একটি বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু। এরপর চাকরি করেছেন ঢাকা ও করাচি বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগে। পরে পাকিস্তান সরকারের বৈদেশিক বিভাগে। কর্মসূত্রে নয়াদিল্লী, সিডনি, জাকার্তা ও লন্ডনে দায়িত্ব পালন শেষে দীর্ঘদিন প্যারিসে কর্মরত ছিলেন। সেখানে অবস্থানকালে ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘লাল সালু' (১৯৪৮) ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। এ উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে : চাঁদের অমাবস্যা' (১৯৬৪) ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো' (১৯৬৮) ও ‘সুড়ঙ্গ' (১৯৬৪) নাটক।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র জন্ম চট্টগ্রামে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ এর ১০ই অক্টোবর তিনি প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন।

ধনুকের মতো বাঁকা কংক্রিটের পুলটির পরেই বাড়িটা। দোতলা, উঁচু এবং প্রকান্ড বাড়ি। তবে রাস্তা থেকেই সরাসরি দন্ডায়মান। এদেশে ফুটপাত নাই বলে বাড়িটারও একটু জমি ছাড়ার ভদ্রতার বালাই নাই। তবে সেটা কিন্তু বাইরের চেহারা। কারণ, পেছনে অনেক জায়গা। প্রথমত প্রশস্ত উঠান। তারপর পায়খানা-গোসলখানার পরে আম-জাম-কাঁঠাল গাছে ভরা জঙ্গলের মতো জায়গা। সেখানে কড়া সূর্যালোকেও সূর্যাস্তের ম্লান অন্ধকার এবং আগাছায় আবৃত মাটিতে ভাপসা গন্ধ।
অত জায়গা যখন তখন সামনে কিছু ছেড়ে একটা বাগান করলে কী দোষ হতো?
সে-কথাই এরা ভাবে। বিশেষ করে মতিন। তার বাগানের বড় শখ, যদিও আজ পর্যন্ত তা কল্পনাতেই পুত হয়েছে। সে ভাবে, একটু জমি পেলে সে নিজেই বাগানের মতো করে নিতো। যত্ন করে লাগাতো মৌসুমি ফুল, গন্ধরাজ-বকুল-হাস্নাহেনা, দু-চারটে গোলাপও। তারপর সন্ধ্যার পর আপিস ফিরে সেখানে বসতো। একটু আরাম করে বসবার জন্যে হাল্কা বেতের চেয়ার বা ক্যানভাসের ডেকচেয়ারই কিনে নিতো। তারপর গা ঢেলে বসে গল্প-গুজব করতো। আমজাদের হুকার অভ্যাস। বাগানের সম্মান বজায় রেখে সে না হয় একটা মানানসই নলওয়ালা সুদৃশ্য গুড়গুড়ি কিনে নিতো। কাদের গল্প-প্রেমিক। ফুরফুরে হাওয়ায় তার কণ্ঠ কাহিনীময় হয়ে উঠতেত। কিংবা পুষ্পসৌরভে মদির জ্যোৎস্নারাতে গল্প না করলেই বা কী এসে যেতো? এমনিতে চোখ বুজে বসেই নীরবে সান্ধ্যকালীন স্নিগ্ধতা উপভোগ করতো তারা।
আপিস থেকে শ্রান্ত হয়ে ফিরে প্রায় রাস্তা থেকেই চড়তে থাকা দোতলায় যাবার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে মতিনের মনে জাগে এসব কথা।
বাড়িটা তারা দখল করেছে। অবশ্য লড়াই না করেই; তাদের সামরিক শক্তি অনুমান করে বাড়ির মালিক যে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছিল, তা নয়। দেশভঙ্গের হুজুগে এ শহরে এসে তারা যেমন তেমন একটা ডেরার সন্ধানে উদয়াস্ত ঘুরছে, তখন একদিন দেখতে পায় বাড়িটা। সদর দরজায় মস্ত তালা, কিন্তু সামান্য পর্যবেক্ষণের পর বুঝতে পারে বাড়িতে জনমানব নাই এবং তার মালিক দেশপলাতক। পরিত্যক্ত বাড়ি চিনতে দেরি হল না। কিন্তু এমন বাড়ি পাওয়া নিতান্ত সৌভাগ্যের কথা। সৌভাগ্যের আকস্মিক আবির্ভাবে প্রথমে তাদের মনে ভয়ই উপস্থিত হয়। সে ভয় কাটতে দেরি হয় না। সেদিন সন্ধ্যায় তারা সদলবলে এসে দরজার তালা ভেঙে রৈ-রৈ আওয়াজ তুলে বাড়িটায় প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে তখন বৈশাখের আম-কুড়ানো ক্ষিপ্র উন্মাদনা বলে ব্যাপারটা তাদের কাছে দিন-দুপুরে ডাকাতির মতো মনে হয় না। কোন অপরাধের চেতনা যদি বা মনে জাগার প্রয়াস পায় তা বিজয়ের উল্লাসে নিমেষে তুলোধুনো হয়ে উড়ে যায়। 
পরদিন শহরে খবরটা ছড়িয়ে পড়লে অনাশ্রিতদের আগমন শুরু হয়। মাথার ওপর একটা ছাদ পাবার আশায় তারা দলে-দলে আসে।
বিজয়ের উল্লাসটা ঢেকে এরা বলে, কী দেখছেন? জায়গা নাই কোথাও। সব ঘরেই বিছানা পড়েছে। এই যে ছোট্ট ঘরটি, তাতেও চার-চারটে বিছানা পড়েছে। এখন তো শুধু বিছানা মাত্র। পরে ছ-ফুট বাই আড়াই-ফুট চারটি চৌকি এবং দু-একটা চেয়ার-টেবিল এলে পা ফেলার জায়গা থাকবে না। 
একজন সমবেদনার কণ্ঠে বলে,
আপনাদের তক্লিফ আমরা কি বুঝি না? একদিন আমরা কি কম কষ্ট পেয়েছি? তবে আপনাদের কপাল মন্দ। সেই হচ্ছে আসল কথা।
যারা হতাশ হয় তাদের মুখ কালো হয়ে ওঠে সমবেদনা ভরা উক্তিতে।
ঐ ঘরটা?
নিচের তলার রাস্তার ধারে ঘরটা অবশ্য খালিই মনে হয়।
খালি দেখালেও খালি নয়। ভাল করে চেয়ে দেখুন। দেয়ালের পাশে সতরঞ্জিতে বাঁধা দুটি বেডিং। শেষ জায়গাটাও দু-ঘণ্টা হল অ্যাকাউন্টস এর মোটা বদরুদ্দিন নিয়ে নিয়েছে। শালার কাছ থেকে বিছানাপত্তর আনতে গেছে। শালাও আবার তার এক দোস্তের বাড়ির বারান্দায় আস্তানা গেড়েছে। পরিবার না থাকলে শালাটিও এসে হাজির হত।
নেহাত কপালের কথা। আবার একজনের কণ্ঠ সমবেদনায় খলখল করে ওঠে। যদি ঘণ্টা দুয়েক আগে আসতেন তবে বদরুদ্দিনকে কলা দেখাতে পারতেন। ঘরটায় তেমন আলো নেই বটে কিন্তু দেখুন জানালার পাশেই সরকারি আলো। রাতে কোনদিন ইলেকট্রিসিটি ফেল করলে সে-আলোতেই দিব্যি চলে যাবে।
বা কিপ্পনতা যদি করতে চায়-
অবশ্য এ-সব পরাহত বাড়ি-সন্ধানীদের কানে বিষবৎ মনে হয়।
যথাসময়ে বেআইনি বাড়ি দখলের ব্যাপারটা তদারক করাবার জন্যে পুলিশ আসে। সেটা স্বাভাবিক। দেশেময় একটা ঘোর পরিবর্তনের আলোড়ন বটে কিন্তু কোথাও যে রীতিমত মগের মুলুক পড়েছে তা নয়। পুলিশ দেখে তারা ভাবে, পলাতক গৃহকর্তা কি বাড়ি উদ্ধারের জন্যে সরকারের কাছে আবেদন করেছে? তবে সে-কথা বিশ্বাস হয় না দু-দিনের মধ্যে বাড়িটা খালি করে দিয়ে যে দেশ থেকে উধাও হয়ে গেছে বর্তমানে তার অন্যান্য গভীর সমস্যার কথা ভাববার আছে। সন্দেহ থাকে না যে, পুলিশকে খবর দিয়েছে তারাই যারা সময় মতো এখানে না এসে শহরের অন্য কোন প্রান্তে নিষ্ফলভাবে বাড়ি দখলের ফিকিরে ছিল। মন্দভাগ্যের কথা মানা যায় কিন্তু সহ্য করা যায় না। ন্যায্য অধিকারস্বত্ব এক কথা, অন্যায়ের ওপর ভাগ্য লাভ অন্য কথা।
হিংসাটা ন্যায়সঙ্গত-তো মনে হয়-ই, কর্তব্য বলেও মনে হয়।
এরা রূখে দাঁড়ায়।
আমরা দরিদ্র কেরানি মানুষ বটে কিন্তু সবাই ভদ্র ঘরের ছেলে। বাড়ি দখল করেছি বটে কিন্তু জানালা-দরজা ভাঙি নাই, ইট-পাথর খসিয়ে চোরাবাজারেও চালান করে দিই নাই। 
আমরাও আইন-কানুন বুঝি। কে নালিশ করেছে? বাড়িওয়ালা নয়। তবে নালিশটাও যথাযথ নয়।
কাদের কেবল কাতর রব তোলে। যাবো কোথায়? শখ করে কি এখানে এসে উঠেছি? সদলবলে সাব ইনস্পেক্টর ফিরে গিয়ে না-হক না বেহক না-ভালো না-মন্দ গোছের ঘোর-ঘোরালো রিপোর্ট দেয় যার মর্মার্থ উদ্ধারের ভয়েই হয়তো ওপরওয়ালা তা ফাইল চাপা দেয়া শ্রেয় মনে করে। অথবা বুঝতে পারে, এই হুজুগের সময় অন্যায়ভাবে বাড়ি দখলের বিষয়ে সরকারি আইনটা যেন তেমন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।
কাদের চোখ টিপে বলে, সত্য কথা বলতে দোষ কী? সাব-ইনস্পেক্টরের দ্বিতীয় বউ আমার এক রকম আত্মীয়া। বলো না কাউকে কিন্তু।
কথাটা অবশ্য কারোরই বিশ্বাস হয় না। তবে অসত্যটির গোড়ায় যে কেবল একটা নির্মল আনন্দের উস্কানি, তা বুঝে কাদেরকে ক্ষমা করতে দ্বিধা হয় না।
উৎফুল্ল কণ্ঠে কেউ প্রস্তাব করে, কী হে, চা-মিষ্টিটা হয়ে যাক।
রাতারাতি সরগরম হয়ে ওঠে প্রকান্ড বাড়িটা। আস্তানা একটি পেয়েছে এবং সে আস্তানাটি কেউ হাত থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।-শুধু এ বিশ্বাসই তার কারণ নয়। খোলা-মেলা ঝরঝরে তকতকে এ বাড়ি তাদের মধ্যে একটা নতুন জীবন-সঞ্চার করেছে যেন। এদের অনেকেই কলকাতায় ব্লকম্যান লেন-এ খালাসি পট্টিতে, বৈঠকখানায় দফতরিদের পাড়ায় সৈয়দ সালেহ লেন-এ তামাক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বা কমরু খানসামা লেন-এ অকথ্য দুর্গন্ধ নোংরার মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। তুলনায় এ বাড়ির বড় বড় কামরা, নীলকুঠি দালানের ফ্যাশানে মস্ত মস্ত জানালা, খোলামেলা উঠান, আরো পেছনে বনজঙ্গলের মতো আম-জাম-কাঁঠালের বাগান-এসব একটি ভিন্ন দুনিয়া যেন। এরা লাটবেলাটের মতো এক খানা ঘর দখল করে নাই সত্য, তবু এত আলো বাতাস কখনো তারা উপভোগ করে নাই। তাদের জীবনে সবুজ তৃণ গজাবে ধমনীতে সবল সতেজ রক্ত আসবে, হাজার-দুহাজার ওয়ালাদের মতো মুখে ধন-স্বাস্থ্যের জৌলুস আসবে, দেহও ম্যালেরিয়া-কালাজ্বর-ক্ষয় ব্যাধিমুক্ত হবে। রোগাপট্কা ইউনুস ইতিমধ্যে তার স্বাস্থ্যের পরিবর্তন দেখতে পায়। সে থাকতো ম্যাকলিওড স্ট্রিটে। গলিটা যেন সকালবেলার আবর্জনা ভরা ডাস্টবিন। সে গলিতেই নড়বড়ে ধরনের একটা কাঠের দোতলা বাড়িতে রান্নাঘরের পাশে স্যাঁৎসেতে একটি কামরায় কচ্ছদেশীয় চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চার বছর সে বাস করেছে। পাড়াটি চামড়ার উৎকট গন্ধে সর্বক্ষণ এমন ভরপুর হয়ে থাকতো যে রাস্তার ড্রেনের পচা দুর্গন্ধ নাকে পৌঁছতো না, ঘরের কোণে ইঁদুর বেড়াল মরে পচে থাকলেও তার খবর পাওয়া দুষ্কর ছিল। ইউনুসের জ্বরজ্বারি লেগেই থাকতো, থেকে থেকে শেষরাতে কাশির ধমক উঠতো। তবু পাড়াটি ছাড়ে নি এক কারণে। কে তাকে বলেছিল, চামড়ার গন্ধ নাকি যক্ষ্মার জীবাণু ধ্বংস করে। দুর্গন্ধটা তাই সে অম্লানবদনে সহ্য তো করতোই, সময় সময় আপিস থেকে ফিরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির নিছিদ্র দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বুকভরে নিশ্বাস নিতো। তাতে অবশ্য তার স্বাস্থ্যের কোন উন্নতি দেখা যায় নাই।
খানাদানা না হলে বাড়ি সরগরম হয় না। তাই এক সপ্তাহ ধরে মুঘলাই কায়দায় তারা খানাদানা করে। রান্নার ব্যাপারে সকলেরই গুপ্ত কেরামতি প্রকাশ পায় সহসা। নানির হাতে শেখা বিশেষ পিঠা তৈরির কৌশলটি শেষ পর্যন্ত অখাদ্য বস্তুতে পরিণত হলেও তারিফ প্রশংসায় তা মুখরোচক হয়ে ওঠে। গানের আসরও বসে কোন কোন সন্ধ্যায়। হাবিবুল্লা কোত্থেকে একটা বেসুরো হারমনিয়াম নিয়ে এসে তার সাহায্যে নিজের গলার বলিষ্ঠতার ওপর ভর করে নিশীথ রাত পর্যন্ত একটি অবক্তব্য সঙ্গীতসমস্যা সৃষ্টি করে।
এ সময়ে একদিন উঠানের প্রান্তে রান্নাঘরের পেছনে চৌকোণা আধ হাত উঁচু ইটের তৈরি একটি মঞ্চের ওপর তুলসী গাছটি তাদের দৃষ্টিগত হয়।
সেদিন রোববার সকাল। নিমের ডাল দিয়ে মেছোয়াক করতে করতে মোদাবেবর উঠানে পায়চারি করছিল, হঠাৎ সে তারস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। লোকটি এমনিতেই হুজুগে মানুষ। সামান্য কথাতেই প্রাণ-শীতল-করা রৈ-রৈ আওয়াজ তোলার অভ্যাস তার। তবু সে আওয়াজ উপেক্ষা করা সহজ নয়। শীঘ্রই কেউ কেউ ছুটে আসে উঠানে।
কী ব্যাপার!
চোখ খুলে দেখ!
কী? কী দেখবো?
সাপখোপ দেখবে আশা করেছিল বলে প্রথমে তুলসী গাছটা নজরে পড়ে না তাদের। দেখছো না? এমন বেকায়দা আসনাধীন তুলসী গাছটা দেখতে পাচ্ছো না? উপড়ে ফেলতে হবে ওটা। আমরা যখন এ বাড়িতে এসে উঠেছি তখন এখানে কোন হিন্দুয়ানির চিহ্ন আর সহ্য করা হবে না। 
একটু হতাশ হয়ে তারা তুলসী গাছটির দিকে তাকায়। গাছটি কেমন যেন মরে আছে। গাঢ় সবুজ রঙের পাতায় খয়েরি রং ধরেছে। নিচে আগাছাও গজিয়েছে। হয়তো বহুদিন তাতে পানি পড়েনি।
কী দেখছো? মোদাবেবর হুঙ্কার দিয়ে ওঠে। বলছি না, উপড়ে ফেল! 
এরা কেমন স্তব্ধ হয়ে যায়। আকস্মিক এ আবিষ্কারে তারা যেন কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়েছে। যে বাড়ি এত শূন্য মনে হয়েছিল, ছাদে যাওয়ার সিঁড়ির দেয়ালে কাঁচা হাতে লেখা ক-টা নাম থাকা সত্ত্বেও যে বাড়িটা এমন বেওয়ারিশ ঠেকেছিল, সে বাড়ির চেহারা যেন হঠাৎ বদলে গেছে। আচমকা ধরা পড়ে গিয়ে শুষ্কপ্রায় মৃতপ্রায় নগণ্য তুলসী গাছটি হঠাৎ সে বাড়ির অন্দরের কথা প্রকাশ করেছে যেন।
এদের অহেতুক স্তব্ধতা লক্ষ করে মোদাবেবর আবার হুঙ্কার ছাড়ে।
ভাবছো কী অত? উপড়ে ফেলো বলছি।
কেউ নড়ে না। হিন্দু রীতিনীতি এদের তেমন ভাল করে জানা নাই। তবুও কোথাও শুনেছে যে, হিন্দুবাড়িতে প্রতি দিনান্তে গৃহকর্ত্রী তুলসী গাছের তলে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালায়, গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করে। আজ যে তুলসী গাছের তলে ঘাস গজিয়ে উঠেছে, সে পরিত্যক্ত তুলসী গাছের তলেও প্রতিসন্ধ্যায় কেউ প্রদীপ দিতো। আকাশে যখন সন্ধ্যাতারা বলিষ্ঠ একাকিত্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠতো, তখন ঘনায়মান ছায়ার মধ্যে আনত সিঁদুরের নীরব রক্তাক্ত স্পর্শে একটা শান্ত-শীতল প্রদীপ জ্বলে উঠতো প্রতিদিন। ঘরে দুর্দিনের ঝড় এসেছে, হয়তো কারো জীবন প্রদীপ নিভে গেছে, আবার হাসি-আনন্দের ফোয়ারাও ছুটেছে সুখ-সময়ে, কিন্তু এ প্রদীপ দেওয়া অনুষ্ঠান একদিনের জন্যও বন্ধ থাকে নাই। 
যে-গৃহকর্ত্রী বছরের পর বছর এ তুলসী গাছের তলে প্রদীপ দিয়েছে সে আজ কোথায়? মতিন এক সময়ে রেলওয়েতে কাজ করতো। অকারণে তার চোখের সামনে বিভিন্ন রেলওয়ে-পট্টির ছবি ভেসে ওঠে। ভাবে, হয়তো আসানসোল, বৈদ্যবাটি, লিলুয়া বা হাওড়ায় রেলওয়ে-পট্টিতে সে মহিলা কোন আত্মীয়ের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। বিশাল ইয়ার্ডের পাশে রোদে শুকোতে-থাকা লাল পাড়ের একটি মসৃণ কালো শাড়ি সে যেন দেখতে পায়। হয়তো সে শাড়িটি গৃহকর্ত্রীরই। কেমন বিষণ্ণভাবে সে শাড়িটি দোলে স্বপ্ন হাওয়ায়। অথবা মহিলাটি কোন চলতি ট্রেনের জানালার পাশে যেন বসে। তার দৃষ্টি বাইরের দিকে। সে দৃষ্টি খোঁজে কিছু দূরে, দিগন্তের ওপারে। হয়তো তার যাত্রা এখনো শেষ হয় নাই। কিন্তু যেখানেই সে থাকুক এবং তার যাত্রা এখনো শেষ হয়েছে কি হয় নাই, আকাশে যখন দিনান্তের ছায়া ঘনিয়ে ওঠে তখন প্রতিদিন এ তুলসী তলার কথা মনে হয় বলে তার চোখ হয়তো ছলছল করে ওঠে।
গতকাল থেকে ইউনুসের সর্দি-সর্দি ভাব। সে বলে,
থাক না ওটা। আমরা তো তা পূজা করতে যাচ্ছি না। বরঞ্চ ঘরে তুলসী গাছ থাকা ভাল। সর্দি-কফে তার পাতার রস বড়ই উপকারী।
মোদাবেবর অন্যদের দিকে তাকায়। মনে হয়, সবারই যেন তাই মত। গাছটি উপড়ানোর জন্যে কারো হাত এগিয়ে আসে না। ওদের মধ্যে এনায়েত একটু মৌলভি ধরনের মানুষ। মুখে দাড়ি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও আছে, সকালে নিয়মিত ভাবে কুরআন-তেলাওয়াত করে। সে পর্যন্ত চুপ। প্রতি সন্ধ্যায় গৃহকর্ত্রীর সজল চোখের দৃশ্যটি তার মনেও জাগে কি?
অক্ষত দেহে তুলসী গাছটি বিরাজ করতে থাকে।
তবে এদের হাত থেকে রেহাই পেলেও এরা যে তার সম্বন্ধে পর মুহূর্তেই অসচেতনায় নিমজ্জিত হয় তা নয়। বরঞ্চ কেমন একটা দুর্বলতার ভাব, কর্তব্যের সম্মুখে পিছ-পা হলে যেমন একটা অস্বচ্ছন্দতা আসে তেমন একটা অস্বচ্ছন্দতা তাদের মনে জেগে থাকে। তারই ফলে সেদিন সান্ধ্য আড্ডায় তর্ক ওঠে। তারা বাকবিতন্ডার স্রোতে মনের সে দুর্বলতা অস্বচ্ছন্দতা ভাসিয়ে দিতে চায় যেন। আজ অন্যান্য দিনের মতো রাষ্ট্রনৈতিক-অর্থনৈতিক আলোচনার বদলে সাম্প্রদায়িকতাই তাদের প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।
- ওরাই তো সবকিছুর মূলে, মোদাবেবর বলে। উলঙ্গ বালব্-এর আলোয় তার সযত্নে মেছোয়াক করা দাঁত ঝকঝক করে। তাদের নীচতা হীনতা গোঁড়ামির জন্যেই তো দেশটা ভাগ হলো।
কথাটা নতুন নয়। তবু আজ সে উক্তিতে নতুন একটা ঝাঁঝ। তার সমর্থনে এবার হিন্দুদের অবিচার-অত্যাচারের অশেষ দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে এদের রক্ত গরম হয়ে ওঠে, শ্বাস-প্রশ্বাস সংকীর্ণ হয়ে আসে।
দলের মধ্যে বামপন্থী বলে স্বীকৃত মকসুদ প্রতিবাদ করে। বলে, বড় বাড়াবাড়ি হচ্ছে না কী? মোদাবেবরের ঝকঝকে দাঁত ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
বাড়াবাড়ি মানে?
বামপন্থী মকসুদ আজ একা। তাই হয়তো তার বিশ্বাসের কাঁটা নড়ে। সংশয়ে দুলে দুলে কাঁটাটি ডান দিকে হেলে থেমে যায়।
কয়েকদিন পরে রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় তুলসী গাছটা মোদাবেবরের নজরে পড়ে। সে একটু বিস্মিত না হয়ে পারে না। তার তলে যে আগাছা জন্মেছিল সে আগাছা অদৃশ্য হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়। যে গাঢ় সবুজ পাতাগুলি পানির অভাবে শুকিয়ে খয়েরি রং ধরেছিল, সে পাতাগুলি কেমন সতেজ হয়ে উঠেছে। সন্দেহ থাকে না যে তুলসী গাছটির যত্ন নিচ্ছে কেউ। খোলাখুলিভাবে না হলেও লুকিয়ে লুকিয়ে তার গোড়ায় কেউ পানি দিচ্ছে। মোদাবেবরের হাতে তখন একটি কঞ্চি। সেটি সাঁ করে কচুকাটার কায়দায় সে তুলসী গাছের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেয়। কিন্তু ওপর দিয়েই। তুলসীগাছটি অক্ষত দেহেই থাকে।
অবশ্য তুলসী গাছের কথা কেউ উল্লেখ করে না। ইউনুসের সর্দি-সর্দি ভাবটা পরদিন কেটে গিয়েছিল। তুলসী পাতার রসের প্রয়োজন হয় নাই তার।
তারা ভেবেছিল ম্যাকলিওড স্ট্রিট খানসামা লেন ব্লকম্যানের জীবন সত্যিই পেছনে ফেলে এসে প্রচুর আলো হাওয়ার মধ্যে নতুন জীবন শুরু করেছে। কিন্তু তাদের ভুলটা ভাঙতে দেরি হয় না। তবে শুধু ততখানিই দেরি হয় যতখানি দরকার, সে বিশ্বাস দৃঢ় প্রমাণিত হবার জন্যে। ফলে আচম্বিত আঘাতটা প্রথমে নিদারুণই মনে হয়!
সেদিন তারা আপিস থেকে সরাসরি বাড়ি ফিরে সকালের পরিকল্পনা মোতাবেক খিচুড়ি রান্নার আয়োজন শুরু করেছে এমন সময় বাইরে সিঁড়িতে ভারি জুতার মচমচ আওয়াজ শোনা যায়। বাইরে একবার উঁকি দিয়ে মোদাবেবর ক্ষিপ্রপদে ভেতরে আসে।
পুলিশ এসেছে আবার। সে ফিসফিস করে বলে।
পুলিশ? আবার কেন পুলিশ? ইউনুস ভাবে, হয়তো রাস্তা থেকে ছ্যাঁচড়া চোর পালিয়ে এসে বাড়িতে ঢুকেছে এবং তারই সন্ধানে পুলিশের আগমন হয়েছে। কথাটা মনে হতেই নিজের কাছেই তা খরগোশের গল্পের মতো ঠেকে। শিকারির সামনে আর পালাবার পথ না পেয়ে হঠাৎ চোখ বুঝে বসে পড়ে খরগোশ ভাবে, কেউ তাকে আর দেখতে পাচ্ছে না। আসলে তারাই কি চোর নয়? সব জেনেও তারাই কি সত্য কথাটা স্বীকার না করে এ বাড়িতে একটি অবিশ্বাস্য মনোরম জীবন সৃষ্টি করেছে নিজেদের জন্য? 
পুলিশ দলের নেতা সাবেকি আমলের মানুষ। হ্যাট বগলে চেপে তখন সে দাগ-পড়া কপাল থেকে ঘাম মুছছে। কেমন একটা নিরীহ ভাব। তার পশ্চাতে বন্দুকধারী কনেস্টবল দুটিকেও মস্ত গোঁফ থাকা সত্ত্বেও নিরীহ মনে হয়। তাদের দৃষ্টি ওপরের দিকে। তারা যেন কড়িকাঠ গোণে। ওপরের ঝিলিমিলির খোপে একজোড়া কবুতর বাসা বেঁধেছে। হয়তো সে কবুতর দুটিকেই দেখে চেয়ে। হাতে বন্দুক থাকলে নিরীহ মানুষেরও দৃষ্টি পড়ে পশু-পক্ষীর দিকে।
সবিনয়ে মতিন প্রশ্ন করে, কাকে দরকার?
আপনাদের সবাইকে। পুলিশদের নেতা একটু খনখনে গলায় ঝট করে উত্তর দেয়। আপনারা বেআইনীভাবে এ বাড়িটা কব্জা করেছেন।
কথাটা না মেনে উপায় নাই। ওরা প্রতিবাদ না করে সরল চোখে সামান্য কৌতূহল জাগিয়ে পুলিশদের নেতার দিক চেয়ে থাকে।
চবিবশ ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি ছাড়তে হবে। সরকারের হুকুম।
এরা নীরবে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। অবশেষে মোদাবেবর গলা সাফ করে প্রশ্ন করে, কেন, বাড়িওয়ালা নালিশ করেছে নাকি?
অ্যাকাউন্টস আপিসের মোটা বদরুদ্দিন গলা বাড়িয়ে কনেস্টবল দুটির পেছনে একবার তাকিয়ে দেখে বাড়িওয়ালার সন্ধানে। সেখানে কেউ নেই। তবে রাস্তায় কিছু লোক জড়ো হয়েছে। অন্যের অপমান দেখার নেশা বড় নেশা।
কোথায় বাড়িওয়ালা? না হেসেই গলায় হাসি তোলে পুলিশ দলের নেতা।
এদের একজনও হেসে ওঠে। একটা আশার সঞ্চার হয় যেন।
তবে?
গভর্নমেন্ট বাড়িটা রিকুইজশন করেছে।
এবার হাসি জাগে না। বস্তুত অনেকক্ষণ যেন কারো মুখে কোন কথা সরে না। তারপর মকসুদ গলা বাড়ায়। আমরা কি গভর্নমেন্টের লোক নই?
এবার কনেস্টবল দুটির দৃষ্টিও কবুতর কড়িকাঠ ছেড়ে মকসুদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হয়।
তাদের দৃষ্টিতে সামান্য বিস্ময়ের ভাব। মানুষের নির্বুদ্ধিতায় এখনো তারা চমকিত হয়।
তারপর প্রকান্ড সে বাড়িতে অপর্যাপ্ত আলোবাতাস থাকলেও একটা গভীর ছায়া নেমে আসে। প্রথমে অবশ্য তাদের মাথায় খুন চড়ে। নানারকম বিদ্রোহী ঘোষণা শোনা যায়। তারা যাবে না কোথাও, ঘরের খুঁটি ধরে পড়ে থাকবে; যাবে তো লাশ হয়ে যাবে। তবে মাথা শীতল হতে দেরি হয় না। তখন গভীর ছায়া নেবে আসে সর্বত্র। কোথায় যাবে তারা?
পরদিন মোদাবেবর যখন এসে বলে তাদের মেয়াদ চবিবশ ঘণ্টা থেকে সাতদিন হয়েছে তখন তারা একটা গভীর স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেও সে-ঘন ছায়াটা নিবিড় হয়েই থাকে। এবার মোদাবেবর পুলিশ সাব-ইনস্পেক্টরে দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে তার আত্মীয়তার কথা বলে না। তবু না বলা কথাটা সবাই মেনে নেয়।
তারপর দশম দিনে তারা সদলবলে বাড়ি ত্যাগ করে চলে যায়। যেমনি ঝড়ের মতো এসেছিল, তেমনি ঝড়ের মতোই উধাও হয়ে যায়। শূন্য বাড়িতে তাদের সাময়িক বসবাসের চিহ্নস্বরূপ এখানে-সেখানে ছিটিয়ে থাকে খবর কাগজের ছেঁড়া পাতা, কাপড় ঝোলাবার একটা পুরোন দড়ি, বিড়ি-সিগারেটের টুকরো, একটা ছেঁড়া জুতোর গোড়ালি।
উঠানের শেষে তুলসী গাছটা আবার শুকিয়ে উঠেছে। তার পাতায় খয়েরি রং। সেদিন পুলিশ আসার পর থেকে কেউ তার গোড়ায় পানি দেয় নি। সেদিন থেকে গৃহকর্ত্রীর ছলছল চোখের কথাও আর কারো মনে পড়ে নি।
কেন পড়েনি সে কথা তুলসী গাছের জানবার কথা নয়, মানুষেরই জানবার কথা।

শব্দার্থ ও টীকা
কংক্রিটের পুল                      -     চুন-বালি-সিমেন্ট ও চুনা পাথরের মিশ্রণে তৈরি পাকা সেতু।
ক্যানভাস                            -     মজবুত মোটা কাপড় বিশেষ।
ডেক চেয়ার                         -     ঘরের বাইরে ব্যবহারের জন্য কাঠ বা ধাতুর কাঠামোর ওপর ক্যানভাস দিয়ে তৈরি সংকোচনযোগ্য আসন। 
গুড়গুড়ি                              -     আলবোলা, ফরাশ।
মদির                                -     মত্ততা জাগায় বা সৃষ্টি করে এমন।
দেশভঙ্গের হুজুগে                  -     ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় আবেগবশত।
ডেরা                                 -     অস্থায়ী বাসস্থান, আস্তানা।
পরাহত                              -     ব্যাহত, বাধাগ্রস্ত, পরাজিত।
ফিকির                              -     ফন্দি, মতলব, উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপায়।
না-হক                               -     ন্যায়সঙ্গত নয় এমন।
না-বেহক                            -     অন্যায় নয় এমন।
ঘোর-ঘোরালো                     -     খুবই জটিল, অত্যন্ত প্যাঁচালো।
রিপোর্ট                              -     প্রতিবেদন।
আস্তানা                              -     বাসস্থান। আড্ডা।
লাটবেলাট                          -     গভর্নর বা অনুরূপ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ।
জৌলুস                               -     জেল্লা, চাকচিক্য, ঔজ্জ্বল্য, জাঁকজমক।
কচ্ছদেশীয়                          -     গুজরাটের উত্তরে অবস্থিত সমুদ্রতীরবর্তী স্থানের।
ইয়ার্ড                                -     স্টেশন সংলগ্ন চত্বর।
সাম্প্রদায়িকতা                     -     সম্প্রদায়গত ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন মানসিকতা ও ক্রিয়াকলাপ।
বামপন্থী                             -     সাম্যবাদী, প্রগতিবাদী, বিপ্লবী রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী।
রিকুইজিশন                         -     কোন কিছু চেয়ে লিখিত ফরমাশ। তলব করা।
কড়িকাঠ                            -     ছাদের তলায় দেয়া আড়াআড়ি লম্বা কাঠ।
বাগ্ধারা, প্রবাদ-প্রবচন
ভদ্রতার বালাই                     -     সাধারণ সৌজন্যবোধ।
পৃষ্ঠপ্রদর্শন                           -     পালানো।
দিনে দুপুরে ডাকাতি               -     প্রকাশ্য প্রতারণা ও মিথ্যাচার। ডাকাতির মতো। দুঃসাহসিক কাজ।
তুলোধুনো হওয়া                   -     ধুনা তুলোর মতো ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়া।
কলা দেখানো                       -     (আলংকারিক) ফাঁকি দেওয়া।
মগের মুলুক                         -     (আলংকারিক ব্যাঙ্গ)- অরাজক দেশ বা রাজ্য।

উৎস ও পরিচিতি :
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী' গল্পটি ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প' নামক গল্পগ্রন্থ থেকে সঙ্কলিত। গল্পের সীমিত পরিসরে জীবনের গভীর কোন তাৎপর্যকে ইঙ্গিতময় ও ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ করে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মুন্সিয়ানা রয়েছে। ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী'তেও এ গুণটি লক্ষ করা যায়।
দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরপরই ঢাকার একটি পরিত্যক্ত বাড়ি দখল করে কলকাতা থেকে আগত কয়েকজন উদ্বাস্তু কর্মচারী। কলকাতার ঘিঞ্জি এলাকায় কোন রকমে মাথা গুঁজে দুর্বিষহ জীবনযাপন করলেও নিরাশ্রিত উদ্বাস্তু জীবনের যে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা এতদিন তাদের গ্রাস করেছিল কলকাতার তুলনায় অনেক খোলামেলা বাড়ি পেয়ে তারা কেবল যে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল তা নয়, বরং বাড়িখানাকে তাদের কাছে মনে হলো বেহেশত। অচিরেই বাড়ির উঠানে আগাছার মধ্যে তারা আবিষ্কার করল একটি তুলসী গাছ। অন্য আর কোন চিহ্ন না থাকলেও এই একটি নিদর্শন থেকেই সবাই বুঝলো এ বাড়িটি আসলে একটি পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়ি। সবাই প্রথমে গাছটাকে উপড়ে ফেলার জন্যে হই-চই করলেও সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা দ্বিধাও জাগে এবং শেষ পর্যন্ত বেঁচে যায় তুলসী গাছটা। দেখা গেল সকলের অজান্তে কেউ একজন তার পরিচর্যা করতে শুরু করেছে। তারপর একদিন সরকারি নির্দেশে বেআইনি দখল থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হলো। শূন্য বাড়িটাতে রইল কেবল ছড়ানো ছিটানো পরিত্যক্ত আবর্জনা আর সেই তুলসী গাছটা। পানির অভাবে তুলসী গাছটা অচিরেই আবার শুষ্কপ্রায় হয়ে উঠল। যে রাজনৈকি ঘূর্ণাবর্তের শিকার হয়েছে অসংখ্য মানুষের শান্ত জীবন তুলসী গাছটাও যে তারই শিকার অসহায় গাছটা তা জানবে কী করে।
অনুশীলনীমূলক কাজ
সাহিত্যেবোধ q ছোটগল্পের সার্থকতা
কী হলে ছোটগল্প চমৎকার ও সার্থক হয় তার জন্য নির্দিষ্ট কোনো ছকবাঁধা পন্থা বা পদ্ধতি বা মানদন্ড নেই। ভাগ্যিস তা নেই, তা না হলে একই ধরনের গল্প পড়তে গিয়ে আমরা একঘেয়েমিতে ভুগতাম। আসলে প্রতিটি সার্থক ছোটগল্পই অন্য যে কোনো গল্পের চেয়ে একেবারে আলাদা এবং সাহিত্যরসমন্ডিত হয়ে থাকে।
ছোটগল্পে কোনো পাঠক চান বিনোদন, কেউ চান চমৎকার ভাববস্তু, কেউ চান অসাধারণ ও আকর্ষণীয় চরিত্র, কেউ চমকপ্রদ ঘটনা, কেউ চান কাহিনী, আবার কেউ চান উৎকণ্ঠা। এসব প্রত্যাশা স্বাভাবিক। এবং তার কোনোটিকেই অযৌক্তিকও বলা যাবে না। কিন্তু ধরা যাক, কেউ হয়তো খুব চমকপ্রদ ঘটনার প্রত্যাশা নিয়ে একটা ছোটগল্প পড়লেন এবং শেষে দেখলে তেমন কিছুই তাতে তবে কি ঐ ছোটগল্প টিকে সার্থক হয়নি বলতে হবে? এ ধরনের সিদ্ধান্ত টানা মুশকিল।
তাহলে ছোটগল্পের সার্থকতা আমরা কোন মানদন্ডে বিচার করব?
কোনো নির্দিষ্ট গল্পের সার্থকতার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই বিচার করতে পারি গল্পের ব্যবহৃত উপাদানগুলো গল্পের পরিণতির সাথে যথাযথভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না। গল্পে কাহিনী, চরিত্র, বিষয়বস্তু ইত্যাদির ব্যবহার কতটা সার্থক তা নির্ভর করবে এর ওপর। যে কোনো দক্ষ ও সৃজনশীল ছোটগল্পকার গল্পের প্রত্যাশিত সমাপ্তি উপযোগী করে গল্পের উপাদান ব্যবহার করে থাকেন। তাই যে কোনো ছোটগল্পের সার্থকতা বিচারে প্রথমেই প্রশ্ন উঠবে : গল্পটি বর্ণনারীতিতে কতটা সার্থক? বিষয়বস্তু ও নির্মাণরীতির মেলবদ্ধনে গল্পটি সাহিত্যকর্ম হয়ে উঠেছে কি না? এ সংকলনে সন্নিবেশিত গল্পগুলোর এক একটি এক এক ভঙ্গিতে বর্ণনা করা হয়েছে। এক একটি গল্পের গঠনরীতি এক এক রকম। এগুলোর বিষয়বস্তুও ভিন্ন ভিন্ন। আর সবচেয়ে বড় কথা এক একভাবে সেগুলো জীবনসত্যকে তুরে ধরেছে।
ভাষা অনুশীলন ্য সমাসবদ্ধ পদ
গল্পপ্রেমিক                                  :             গল্প প্রেমিক যে                                        -                কর্মধারয়।
পুষ্পসৌরভ                                  :             পুষ্পের সৌরভ                                        -                ষষ্ঠী তৎপুরুষ।
জ্যোৎস্নারাত                                :             জ্যোৎস্না-শোভিত রাত                              -                মধ্যপদলোপী কর্মধারয়।
পৃষ্ঠপ্রদর্শন                                   :             পৃষ্ঠকে প্রদর্শন                                        -                দ্বিতীয়া তৎপুরুষ।
দেশভঙ্গ                                     :             দেশকে ভঙ্গ                                           -                দ্বিতীয়া তৎপুরুষ।
জনমানব                                    ;            জন ও মানব                                          -                দ্বনদ্ব।
দেশপলাতক                                :             দেশ থেকে পলাতক                                 -                পঞ্চমী তৎপুরুষ।
আম-কুড়ানো                               :             আমকে কুড়ানো                                     -                দ্বিতীয়া তৎপুরুষ।
অনাশ্রিত                                    ;            নয় আশ্রিত যে                                        -                বহুব্রীহি।
সমবেদনা-ভরা                            :             সমবেদনা দিয়ে ভরা                                -                তৃতীয়া তৎপুরুষ।
মন্দভাগ্য                                     :             মন্দ যে ভাগ্য                                          -                কর্মধারয়।
                                                              মন্দ ভাগ্য যার                                        -                বহুব্রীহি। 
ন্যায়সঙ্গত                                  :             ন্যায় দ্বারা সঙ্গত                                    -                তৃতীয়া তৎপুরুষ।
জীবনসঞ্চার                                :             জীবনের সঞ্চার                                      -                ষষ্ঠী তৎপুরুষ।
আবর্জনা-ভরা                              :             আবর্জনা দ্বারা ভরা                                  -                তৃতীয়া তৎপুরুষ।
গানের আসর                               :             গানের আসর                                         -                অলুক ষষ্ঠী তৎপুরুষ।
রান্নাঘর                                      :             রান্না করার ঘর                                       -                মধ্যপদলোপী বর্মধারয়।
                                                              রান্নার নিমিত্তি ঘর                                   -                চতুর্থী তৎপুরুষ।
বেওয়ারিশ                                  :             বে(নেই) ওয়ারিশ যার                              -                নঞর্থক বহুব্রীহি।
সন্ধ্যাপ্রদীপ                                  :             সন্ধ্যার প্রদীপ                                         -                ষষ্ঠী তৎপুরুষ।  
জীবনপ্রদীপ                                 :             জীবন রূপ প্রদীপ                                     -                রূপক কর্মধারয়।
সুখসময়                                     :             সুখের সময়                                           -                ষষ্ঠা তৎপুরুষ।    
গৃহকর্ত্রী                                      :             গৃহের কর্ত্রী                                            -                ষষ্ঠী তৎপুরুষ।    
বাকবিতন্ডা                                 :             বাক দ্বারা বিতন্ডা                                    -                তৃতীয়া তৎপুরুষ।
অত্যাচার-অবিচার                        :             অত্যাচার ও অবিচার                               -                দ্বনদ্ব।               
শ্বাস-প্রশ্বাস                                 :             শ্বাস ও প্রশ্বাস                                        -                দ্বনদ্ব।
কচুকাটা                                     :             কচুর মত কাটা                                      -                উপমান কর্মধারয়।
অক্ষত                                        :             নয় ক্ষত                                                -                নঞ তৎপুরুষ।
অবিশ্বাস্য                                    :             নয় বিশ্বাস্য                                            -                নঞ তৎপুরুষ।    
বেআইনি                                     :             বে (নয়) আইনি                                      -                নঞ তৎপুরুষ।    
অপর্যাপ্ত                                      :             নয় পর্যাপ্ত                                              -                নঞ তৎপুরুষ।
বাক্যান্তর q অস্তি থেকে নেতি
অস্তি                                          :             সে কথাই এরা ভাবে।
নেতি                                         :             সে কথাই এরা না ভেবে পারে না।
অস্তি                                          :             বাড়িটা তারা দখল করেছে।      
নেতি                                         :             বাড়িটা তারা দখল না করে ছাড়ে না।
অস্তি                                          :             কথাটায় তার বিশ্বাস হয়।             
নেতি                                         :             কথাটায় তার অবিশ্বাস হয় না।      
অস্তি                                          :             তবে নালিশটা অযৌক্তিক।          
নেতি                                         :             তবে নালিশটা যৌক্তিক নয়।
অস্তি                                          :             সে তারস্বরে আর্তনাদ করে।  
নেতি                                         :             সে তারস্বরে আর্তনাদ না করে পারে না।

নেতি থেকে অস্তি
নেতি                                         :             তারা যাবে না কোথাও।
অস্তি                                          :             তারা এখানেই থাকবে।
নেতি                                         :             কারো মুখে কোন কথা সরে না। 
অস্তি                                          :             প্রত্যেকেই নীরব হয়ে থাকে।       
নেতি                                         :             সেখানে কেউ নেই।                   
অস্তি                                          :             জায়গাটা নির্জন।
নেতি                                         :             কথাটা না মেনে উপায় নেই। 
অস্তি                                          :             কথাটা মানতেই হয়।          
নেতি                                         :             তাদের ভুলটা ভাঙতে দেরি হয় না।
অস্তি                                          :             অচিরেই তাদের ভুল ভাঙে।

অনুশীলনমূলক কাজ
দীর্ঘ-উত্তর প্রশ্ন
১.     ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ গল্পে একের পর এক যে সব নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে সংক্ষেপে তার বর্ণনা দাও।
২.     ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ গল্পে সমকালীন সমাজবাস্তবতার যে ছবি ফুটে উঠেছে সে  বিষয়ে আলোকপাত কর।
৩.     ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ গল্পের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা কর।
৪.     ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ ছোটগল্প হিসেবে কতটুকু সার্থক? লেখ।
বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১.     ইউনুস আগে কোথায় থাকত? সে বাসস্থানের সঙ্গে তার বর্তমান বাসস্থানের তুলনা কর।
২.     মতিন সাহেব ও তাঁর সঙ্গীরা কেমন করে বাড়িটি দখল করল? এ বাড়ি শেষ পর্যন্ত তাদের ছাড়তে হল কেন?    
৩.     তুলসী গাছটি প্রথমে কার চোখে পড়েছিল? গাছটি নিয়ে সকলের মধ্যে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?           
৪.     বাড়ির বাসিন্দা পরিবর্তনের ঘটনা তুলসী গাছটার জীবনে কী ধরনের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল সংক্ষেপে লেখ।
৫.     এই গল্পে যে সব চরিত্রের দেখা পাওয়া যায় তাদের নাম লেখ এবং যে কোনো দুটি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
ভাষাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন।
১.     নিচের বাগধারা ও বিশিষ্টার্থক অর্থসহ বাক্যে প্রয়োগ দেখাও :
        ভদ্রতার বালাই, পৃষ্ঠপ্রদর্শন, দিনে দুপুরে ডাকাতি, কলা দেখানো, মগের মুলুক, মুঘলাই কায়দা, মাথায় খুন চড়া, কড়িকাঠ গোনা, চোখ টেপা।
২.     নেতিবাচক বাক্যকে অস্তিবাচক বাক্যে রূপান্তর কর :
        ক) সন্দেহ থাকে না যে তুলসী গাছটির যত্ন নিচ্ছে কেউ।
        খ) সে একটু বিস্মিত না হয়ে পারে না।  
        গ) গাছটি উপড়ানোর জন্যে কারো হাত এগিয়ে আসে না।
        ঘ) হয়তো তার যাত্রা শেষ হয় নাই।
        ঙ) হিন্দু রীতিনীতি এদের তেমন ভাল জানা নেই।
৩.     ব্যাসবাক্যসহ সমাজের নাম লেখ :
        পুষ্পসৌরভ, জ্যোৎস্নারাত, জনমানব, অনাশ্রিত, মন্দভাগ্য, জীবনসঞ্চার, রান্নাঘর, সন্ধ্যাপ্রদীপ, জীবনপ্রদীপ, গৃহকর্ত্রী, বাকবিতন্ডা, অবিশ্বাস্য, বেআইনি।
৪.     সাধু ভাষায় রূপান্তর কর :
        ক)    বাড়িটা তারা দখল করেছে। অবশ্য লড়াই না করেই; তাদের সামরিক শক্তি অনুমান করে বাড়ির মালিক যে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছিল, তা নয়।
        খ) একটু হতাশ হয়ে তারা তুলসীগাছটার দিকে তাকায়। গাছটি কেমন যেন মরে আছে। গাঢ় সবুজ রঙের পাতায় খয়েরি রং ধরেছে, নিচে আগাছাও গজিয়েছে। হয়তো বহুদিন তাতে পানি পড়েনি।
        গ) উঠানের শেষে তুলসী গাছটা আবার শুকিয়ে উঠেছে। তার পাতায় খয়েরি রং। সেদিন পুলিশ আসার পর থেকে কেউ তার গোড়ায় পানি দেয়নি। সেদিন থেকে গৃহকর্ত্রীর ছলছল চোখের কথাও আর কারো মনে পড়েনি।
ব্যাখ্যা
সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা লেখ :
      ক) আচমকা ধরা পড়ে গিয়ে শুষ্কপ্রায় মৃতপ্রায় নগণ্য তুলসী গাছটি হঠাৎ সে বাড়ির অন্দরের কথা প্রকাশ করেছে যেন।
        খ) হাতে বন্দুক থাকলে নিরীহ মানুষেরও দৃষ্টি পড়ে পশু-পক্ষীর দিকে।
 

View Foundation Digital Talking Library is developed and maintained by Sigma Enterprise.
Theme designed by Imtiaz
All rights are reserved. Any kind of reproduction of any mp3 files and text files is prohibited. If any organization or any person is found copying or reproducing any of the material will be punished under copy right law.