Logo Sponsored by Chowdhury and Hossain, Advanced Publications

Durniti unnoyoner ontoray read


দুর্নীতি, উন্নয়নের অন্তরায় ও উত্তরণের পথ
গণতন্ত্র ও সুশাসন একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম অপরিহার্য উপাদান। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সকল নারী ও পুরুষের সমান সুযোগ প্রদান, তথ্যের অবাধ প্রবাহের মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, জনগণের প্রয়োজনে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতাই হল সুশাসনের বৈশিষ্ট্য। অন্যদিকে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য রাষ্ট্র জনগণের পক্ষে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও নীতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করে। এ লক্ষ্যে জনগণ প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচিত করে। রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য এই প্রশাসন জনগণের দেওয়া করের বিপরীতে নৈতিকতা ও দক্ষতার সাথে রাষ্ট্রীয় কাজে সহায়তার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। এদের আন্তরিক উপস্থিতি, সুস্থ ও সৎ চর্চার ওপর নির্ভর করে কোনো একটি দেশের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন। সুতরাং গণতন্ত্র ও সুশাসন পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা হলেই দেশের সকল নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দারিদ্র্য দূরীভূত হবে। দুর্নীতি এই সামগ্রিক সুষ্ঠু পরিস্থির পরিপন্থী।
দুর্নীতি কী
প্রকৃতি গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান অন্তরায় দুর্নীতি। দুর্নীতি বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষতিকর সামাজিক ব্যাধিগুলোর অন্যতম। দুর্নীতি শব্দটি ল্যাটিন corruptus থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘ধ্বংস বা ক্ষতি সাধন'। জাতিসংঘ প্রনীত ম্যানুয়াল অন আ্যৃন্টি-করাপশন পলিসি (Manual on Anti-Corruption Policy) অনুযায়ী ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করাই হল দুর্নীতি। এই ক্ষমতার অপব্যহার সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
বাংলাদেশেশ দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ধারা ২ (৩) অনুযায়ী দুর্নীতি বলতে ‘ঘুষ গ্রহণ ও ঘুষ প্রদান, সরকারি কর্মচারীকে অপরাধে সহায়তা করা, সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী কর্তৃক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে মূল্যবান বস্তু বিনামূল্যে গ্রহণ, কোনো সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী কর্তৃক বেআইনিভাবে কোনো পক্ষপাতমূলক আচরণ প্রদর্শন, কোনো সরকারি কর্মচারী কর্তৃক বে-আইনিভাবে কোনো ব্যবসায়ৈ সম্পৃক্ত হওয়া, কোনো শাস্তি বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত থেকে বাঁচানোর জন্য সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী কর্তৃক আইন অমান্য, অসৎ উদ্দেশ্যে ভুল নথিপত্র প্রস্তুত, অসাধু উদ্দেশ্যে সম্পত্তি বিকৃতকরণমূলক কর্মকান্ড এবং দুর্নীতিতে সহায়তা প্রদান' - কে বোঝায়।  
দুর্নীতি কেন হয়
দুর্নীতি সংঘটনে বেশ কিছু কারণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। ব্যক্তিগত কারণের পাশাপাশি পদ্ধতিগত কিছু কারণ দুর্নীতির বিস্তার ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে সাধারণভাবে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে দুর্নীতির মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যেমন ঃ
আইনগত ও প্রশাসনিক কারণ -
১. জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অকার্যকারিতা : গণতন্ত্র ও জাতীয় সততা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন : জাতীয় সংসদ, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ইত্যাদির অন্যতম প্রধান ভূমিকা হচ্ছে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করা। এসব প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত না হলে দুর্নীতির মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
২. রাজনৈতিক প্রভাব : বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রশাসনে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষণীয়। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা নিজেদের স্বার্থে রাজননিতক দলের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দুর্নীতিগ্রস্ত এবং জনপ্রশাসনে এর যথেচ্ছ প্রভাবে থাকার কারণে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়।
৩. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব : সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি বিস্তারের একটি অন্যতম কারণ হল প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব। বাংলাদেশের প্রশাসন ঔপনিবেশিক আমলের প্রশাসনিক কাঠামোরই উত্তরাধিকার, যেখানে জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া অনুপস্থিত।
৪. দায়িত্বে অবহেলা : নির্দিষ্ট দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব পালনে অবহেলাও দুর্নীতির অন্যতম কারণ।
৫. তথ্যে অধিকারের অভাব : বিভিন্ন সেবা সংক্রান্ত এবং রাষ্ট্রীয় তথ্যে সাধারণ জনগণের অধিকার না থাকার কারণে দুর্নীতি করার সুযোগ বেড়ে যায়।
আর্থ-সামাজিক কারণ -
১. ক্রমবর্ধমান ভোগবাদী প্রবণতা ও নৈতিক মুল্যবোধের অবক্ষয় : বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের মধ্যে ভোগবাদী প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে এবং এর ফলে মানুষের লোভ-লালসা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে মানুষ বৃহৎ স্বার্থের কথা ভুলে যায় বলে দুর্নীতি বিস্তৃত হচ্ছে।
২. আয়-ব্যয়ের অসামঞ্জস্যতা : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে তাদের স্বাভাবিক আয়ে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এটিকে অনেকে দুর্নীতির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। তবে এটাও সত্যি, গুটিকতক দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি ছাড়া বেশিরভাগ মানুষই তাদের বিভিন্ন চাহিদা উপেক্ষা করে সৎভাবে জীবন-যাপন করে থাকেন।   
দুর্নীতির প্রভাব
রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিজের স্বার্থে ব্যবহার, সরকারি ক্রয়ে অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, ঘুষ বা কমিশনের বিনিময়ে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে অর্থ উপার্জন, বরাদ্দকৃত অর্থের পূর্ণ ব্যবহার না করে আত্মসাৎ বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, যেমন, সরকারি বরাদ্দ ও অনুদানের অর্থ ও দ্রব্য আত্মসাৎ, খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণে ভেজাল দ্রব্য মেশানো এবং বিভিন্ন সরকারি কাজে দালালদের দৌরাত্মসহ সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে।
১. অর্খনৈতিক প্রভাব
দুর্নীতির ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে, উন্নয়ন ব্যহৃত হয় ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হয়। কৃষি ও শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যাহত হয়। একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিগত ৩৫ বছরে বাংলাদেশে ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে১। বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সেবা খাতে দুর্নীতির দরুণ বছরে প্রায় ৮-১০ হাজার কোটি টাকা জাতয়ি আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
দুর্নীতির ফলে সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় আরো কমে যায়, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার ফলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ফলে জনগণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ন্যায়বিচার ও অন্যান্য

১. অডিটর জেনারেল বাংরাদেশ (এজিবি) এর অডিট প্রতিবেদন।
মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়। একটি জরিপের ফলাফল অনুযায়ী বাংলাদেশের ৯টি খাতে ২৫টি সেবা নিতে প্রায় ৭৪ শতাংশ ঘুষ প্রদান করে২। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতে বাংলাদেশের অবৈধ আয়ের পরিমাণই মোট জাতীয় আয়ের শতকরা ৩০-৩৪ ভাগ।
২. রাজনৈতিক প্রভাব
দুর্নীতির কারণে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নীতি-নির্ধারণ পদ্ধতিতে জনগণের স্বার্থ রক্ষিত হয় না, ফলে সরকার ও রাষ্ট্রের ওপর জনগণেল আস্থা নষ্ট হয় এবং জাতি ক্রমান্বয়ে দিক-নির্দেশনাহীন ও নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে।
৩. সামাজিক প্রভাব
দুর্নীতির ফলে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়। ক্ষমতাবান শ্রেণীর মানুষেরা দুর্নীতির কারণে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে এবং অন্যদিকে দরিদ্র-শ্রেণীর মানুষের আয় না বাড়ার ফলে ধনী-দরিদ্রের আয়ের বৈষম্য বেড়ে যায়।
দুর্নীতির অবাধ বিস্তারে মানব উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয় এবং সাধারণ জনগণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের মতো মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চিত হয়। দেশের সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে নারী, শিশু ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ন্যায় যারা সমাজে সুবিধা-বঞ্চিত তারাই দুর্নীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং সুযোগ সীমিত হওয়ার কারণে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে।
দুর্নীতি কিভাবে রোধ করা যায়
বিশ্বের সব দেশেই কম-বেশি দুর্নীতি আছে। দুর্নীতিকে সমাজ থেকে পুরোপুরি নির্মূল করা না গেলেও সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব। উন্নয়নশীল দেশে রাষ্ট্রের একার পক্ষে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব নয়। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব। দুর্নীতি রোধ করতে নিচের কার্যক্রমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
১. রাজতৈকি সদিচ্ছা
দুর্নীতি রোধের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি অর্জন করতে হলে প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলই সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সুতরাং রাজনৈতিক মূল্যবোধ থেকে তারা যদি সৎ ও আন্তরিক হয় তাহলে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব। দুর্নীতি প্রতিরোধে সদিচ্ছা প্রমাণ করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে (ক) দুর্নীতিবাজদের সদস্যপদ না দেওয়া, (খ) অব্যাহত গণতান্ত্রিক চর্চা, (গ) প্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা।, (ঘ) সংগঠনের ভেতর জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, (ঙ) সৎ ও যোগ্য প্রাথীকে নির্বাচনে মনোনয়ন প্রদান, এবং (চ) অসৎ উৎস হতে তহবিল সংগ্রহ না করা নিশ্চিত করতে হবে।
২. কার্যকর সংসদ
সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন কার্যকর সংসদ। সংসদীয় পদ্ধতিতে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্যেও গতিশীল সংসদের প্রয়োজন। সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্ব, মনোযোগ আকর্ষণ, জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা, বিভিন্ন বিধিতে বক্তব্য প্রদান, শক্তিশালী কমিটি ব্যবস্থার বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। এসব উপায় অবলম্বন করে প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়। বিশেষ করে সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি দুর্নীতি রোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
২. ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ কর্তৃক পরিচালিত ‘‘দুনীতির খানা জরিপ ২০০৫।


৩. স্বাধীন বিচার বিভাগ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা
দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে দুর্নীতি হ্রাস পাবে। এর জন্য প্রয়োজন স্বাধীন বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগকে প্রশাসন ও সংসদের প্রভাব মুক্ত হতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়- সমাজে তা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তাহলে দেখা যাবে আইনের যথাযথ প্রয়োগের ফলে মানুষ দুর্নীতি পরিহার করছে।
৪. সক্রিয় দুর্নীতি দমন কমিশন
দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য দলনিরপেক্ষ, স্বাধীন ও সক্রিয় দুর্নীতি দমন কমিশন প্রয়োজন। দুর্নীতি দমন কমিশনের যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা বজায় রেখে দুর্নীতি রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করাই কমিশনের অন্যতম কাজ। সরকার এই কমিশনকে নিঃশর্তভাবে আর্থিক, কারিগরি ও প্রশাসনিক সহায়তা দেবে। দুর্নীতিবিরোধী হটলাইন রাজধানী থেকে থানা পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং কমিশনের মাঝে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, দ্রুত বিশেষ টিমের সমন্বয়ে সকল সরকারি সংস্থার আয়-ব্যায়ের পুরো তদন্ত সম্পাদন, তদন্ত কার্যক্রমে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে পর্যাপ্ত ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা ও কর্মীদের জবাদিহিতা এবং ভালো কাজের জন্য পুরস্কারের বিধান রাখতে হবে।
৫. সুষম বেতন কাঠামো ও পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক নির্ধারণ
সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য বাজার মূল্যের সাথে সমন্বয় করে সুষম বেতন কাঠামো এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক নির্ধারণ করতে হবে। জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদির সমন্বয় সাধন করতে হবে।  
৬. দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করা
সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির ফলে ক্ষতির শিকার হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে নাগরিক সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। স্থানীয় পর্যায়ের নাগরিক সংগঠগুলো যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে তৎপর হয় তাহলে দুর্নীতি রোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা সহজ হবে।
৭. গণমাধ্যমের কার্যকর ভূমিকা
দুর্নীতি রোধ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে স্বাধীন গণমাধ্যম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সমাজে দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য অনুসন্ধান এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করে গণমাধ্যম দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগ
দুর্নীতি প্রতিরোধে বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১৯৪৭ সালে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যাতে ঘুষ ও দুর্নীতিতে জড়িত হতে না পারে তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ আইনটি করা হয়। ১৯৫৭ সালে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির আয় ও ব্যয়ের অসঙ্গতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২০০৩ সালে গৃহীত দুর্নীতি আইনের ওপর ভিত্তি করে ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশণ (দুদক) প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন পুনগঠন ও বিধিমালা প্রণয়নসহ ব্যাপক সংস্কারের ফলে কমিশনের লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
দুর্নীতির আন্তর্জাতিক প্রভাব উপলব্ধি করে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেনে ঘুষ ও দুর্নীতিবিরোধী জাতিসংঘ ঘোষণা গ্রহণ করে। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির বিস্তার রোধের লক্ষ্যে ২০০৩ সালের ৩১ শে অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ দুর্নীতিবিরোধী সনদ প্রণয়ন করে, যা ২০০৩ সালের ৯ই ডিসেম্বর মেক্সিকোর মেরিডাতে স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এ কারণে ৯ই ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই সনদে প্রায় ১৫০টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। সরকার কর্তৃক এ সনদে অনুস্বাক্ষরের ফলে ২০০৭ সালের ২৭ শে ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশ এই গুরুত্বপূর্ণ জানিসংঘ সনদের অংশীদার দেশ (state party) হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যাধি। তাই দুর্নীতি প্রতিকারের জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের স্বতঃর্স্ফুত প্রতিরোধ। দুর্নীতি প্রতিরোধে নাগরিক সমাজ, বিশেষ করে যুব সমাজকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা, ১১ দফা হয়ে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থার-সকল পর্যায়েই বঞ্চিত, নিপীড়িত জাতিকে মুক্তির আলো দেখিয়েছে এ দেশের যুব সমাজ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই দেশ বিশ্বের ইতিহাসে সৃষ্টি করেছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এ দেশের যুব সমাজ বারবার প্রমাণ করেছে আমরা হারি নি, আমরা পেরেছি আমরা পারবো। দেশের প্রতি তরুণদের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে দুর্নীতিবিরোধী এই সামাজিক আন্দোলনকে।  


শব্দার্থ ও টীকা
গণতন্ত্র                        -         Democracy শব্দটির গ্রিক শব্দ Demos (জনগণ) এবং Kartos (ক্ষমতা) থেকে উদ্ভুত। গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী দেশ শাসন। আব্রাহাম লিংকনের মতে জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, জনগণের সরকারই হল গণতান্ত্রিক সরকার। সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও আইনের শাসনের অধীনে জনগণের সব ধরনের স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিত করাই গণতন্ত্রের মূলনীতি।  
দুর্নীতি                               -         Corruption শব্দটি ল্যাটিন corruptus থেকে এসেছে যার অর্থ ধ্বংস বা ক্ষতি সাধন। জাতিসংঘ প্রণীত ‘ম্যানুয়াল অন অ্যান্টি করাপশন পলিসি' অনুযায়ী ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহারই দুর্নীতি। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন (২০০৪) অনুযায়ী দুর্নীতি বলতে ঘুশ গ্রহণ ও ঘুষ প্রদান, সরকারি কর্মচারীকে অপরাধে সহায়তা করা, সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী কর্তৃক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে মূল্যবান বস্তু, বিনামূল্যে গ্রহণ, বে-আইনিভাবে পক্ষপাতমুলক আচরণ প্রদর্শন, সরকারি কর্মচারী কর্তৃক বে-আইনিভাবে কোনো ব্যবসায়ে সম্পৃক্ত হওয়া, কোনা ব্যক্তির শাস্তি বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত থেকে বাঁচানোর জন্য সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী কর্তৃক আইন অমান্য, অসৎ উদ্দেশ্যে ভুল নথিপত্র প্রস্তুত, অসাধু উদ্দেশ্যে সম্পত্তি আত্মসাৎকরণ, দুর্নীতিতে সহায়তা করা ইত্যাদি দুর্নীতি হিসেবে চিহ্নিত।
সুশাসন                       -         রাষ্ট্রে পরিচালনায় সর্বত্র আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার নামই সুশাসন। এই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে ব্যক্তিগত স্বার্থ, দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও নানা পক্ষপাত ও লাভালাভের পথ পরিহার করে একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক অবস্থান গ্রহণ করতে হয়। এভাবে রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্তর্গত প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার নামই সুশাসন।
তথ্যের অবাধ প্রবাহ        -         বর্তমান যুগকে বলা হয় তথ্যবিপ্লবের যুগ। এ সময়ের প্রধান সম্পদের একটি হচ্ছে তথ্য। এই তথ্যকে অবাধ, সহজপ্রাপ্য ও সর্বত্রগামী করার জন্য আন্তর্জাতিক কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেট এবং কমিউনিকেশন সেটেলাইট বিস্ময়কর ভূমিকা রেখে এসেছে। কিন্তু আমাদের দেশের অফিস-আদালতগুলো থেকে কোনো তথ্যই সহজে পাওয়া যায় না। এখানে তথ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থাও মান্ধাতার আমলের। ফলে অংশীজনেরা (Stakeholder) সহজভাবে কোনো তথ্যই পায় না। তথ্য পাওয়া না-পাওয়ার সঙ্গে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসনের বিষয়টিও জড়িত। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তথ্যের অবাধ প্রবাহও নিশ্চিত করতে হয়।  
স্বচছতা                              -         স্বচ্ছতা (Transparency) শব্দের আভিধানিক অর্থ নির্ভুলতা, সন্দেহাতীতভাবে সঠিকভাবে ও সহজবোধ্যতা। রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় বিধি-বিধানে ও আইন-কানুনে স্বচ্ছতা যেমন থাকা দরকার তেমনি তা প্রয়োগেও স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন। আলোকভেদী স্বচ্ছ কাগজের মতো রাষ্ট্রের সকল কর্মকান্ড দৃষ্টিগ্রাহ্য, বোধগম্য হওয়া বোঝাতেই এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এর সঙ্গে নির্ভরযোগ্যতা (reliablility) ও যথার্থতা (validity) জড়িত।
জবাবদিহিতা                     -         জবাবদিহিতা বলতে বোঝায় দায়বদ্ধতার প্রতিশ্রুতি ও দায়-দায়িত্বের স্বীকারোক্তি। একমাত্র একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার বিষয় থাকে না। কিন্তু একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা থাকা অপরিহার্য। জবাবদিহিতা থাকলে দুর্নীতি হ্রাস পায়। জবাবদিহিতা দক্ষতা ও সততাকে উৎসাহিত করে। জবাবদিহিতা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে যথার্থতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়।
জনপ্রশাসন -                                (Public administration) রাষ্ট্রের যে প্রশাসন-ব্যবস্থা জনগণের সেবার প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে যায় তা-ই জনপ্রশাসন। সুনির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি, আইন-কানুন ও বিধিবিধানের আওতায় জনপ্রশাসন রাষ্ট্রযন্ত্র্রের মধ্যে থেকে দায়দায়িত্ব পালন করে। আধিপত্য পরম্পরা (hierarchy) অনুসরণ করে যথাযথভাবে প্রজাতন্ত্রের সেবা প্রদানই জনপ্রশাসনের কাজ। অর্থাৎ নিম্নতম থেকে উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত ক্রমবিভক্ত কর্তৃত্বের ভিত্তিতে সংগঠিত জনপ্রশাসন একটি রাষ্ট্রযন্ত্রের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। সকল স্তরের সরকারি কর্মচারী/কর্মকর্তাগণ জনপ্রশাসনের সদস্য।
মৌলিক অধিকার               -         কোনো রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের বাঁচার অধিকার, জীবিকার অধিকার, ধর্মের অধিকার, সংস্কৃতির অধিকার, শিক্ষা লাভের অধিকার, চিকিৎসা লাভের অধিকার মতামত ও সংগঠনের অধিকার, নির্বাচিত করা ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, চুক্তির অধিকার, বিয়ের অধিকার, আইনের অধিকার ইত্যাকার অধিকারকে মৌলিক অধিকার বলে। আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগটি অর্থাৎ ২৬তম ধারা থেকে ৪৭ ক ধারা পর্যন্ত বিধি-বিধানগুলো নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার প্রদান করে। যেমন ২৭ ধারায় বর্ণিত হয়েছে ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।'
সুশীল সমাজ                     -         জনগণের অধিকার ও রাষ্ট্রের শুভাশুভ নিয়ে ভাবিত শুভ বুদিদ্ধ সম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকই সুশীল সমাজের সদস্য। অর্থাৎ একটি দেশের যে সচেতন ও দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠী রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারকে যৌক্তিক সমালোচনা করে কিংবা উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে সহযোগিতা করে সেই জনগোষ্ঠীকেই বলে সুশীল সমাজ। শুধু সরকারকেই নয় - দেশের সর্বস্তরের কর্মকান্ড নিয়েই এরা কথা বলেন ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। এরা জাতির বিবেক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ফলে দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রব্যবস্থায় সুশীল সমাজ সংগ্রামী ভূমিকা পালন করে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারের রোষানলে পতিত হয়।
ভোগবাদ                            -         গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরাস (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪১-২৭০) ভোগবাদ (Epicurism) - এর প্রবক্তা। এই মতবাদ অনুসারে মানুষের মৌল আকাঙ্ক্ষা যেহেতু সুখ লাভ সেহেতু এ দর্শনের প্রধান কাজই হল দুঃখ পরিহারে করে মানুষ কী করে অধিক সুখের সন্ধান পেতে পারে তা দেখিয়ে দেওয়া। এপিকিউরাস বলেছিলেন সকল প্রকার সুখ ভোগ্য নয়। তাঁর মতে ব্যক্তিগত ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সুখ নয়-মানসিক শান্তি লাভই মানব-সমাজের অন্বিষ্ট হওয়া উচিত। কিন্তু তাঁর কিছু শিষ্য দুর্নীতির মা্যধমে পাপমূলক সুখের পথ বেছে নেয়। এপিকিউরাস এদের ত্যাগ করেন। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ ও ক্ষমতা নামক সুখ ভোগের প্রবণতা বিপুলভাবে লক্ষ করা যায়। আদর্শ, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও ন্যায়-অন্যায়বোধ পরিহার করে সমাজের কিছু ব্যক্তি দুর্নীতির মাধ্যমে ভোগবাদী জীবন বেছে নিয়েছে। এরা প্রকৃত পক্ষে সুখী মানুষ নয় - ভোগবাদী মানুষ।
সিন্ডিকেট                    -         আভিধানিক দিক থেকে ‘সিন্ডিকেট' অর্থ হল, ‘সাময়িকপত্রে প্রবন্ধ-নিবন্ধন ব্যঙ্গচিত্র ইত্যাদি সরবরাহকারী বাণিজ্যিক সমিতি; সংবাদ-সমিতি।' কিন্তু বর্তমানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শব্দটির অর্থের নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। অর্থাৎ এখন সিন্ডিকেট বলতে বোঝায় সেই অশুভ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে যারা সমবেতভাবে কোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় কিংবা দাম বাড়ানোর জন্য কোনো পণ্যের কৃত্রিম সংংকট সৃষ্টি করে। এই সব দুর্নীতি সঙ্গে বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা/কর্মচারী জড়িত থাকে।  
প্রেক্ষাপট পরিচিতি
বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশ দুর্নীতির অভিযোগে বিপুলভাবে সমালোচিত হয়ে এসেছে। বলা হচ্ছিল দুর্নীতিপরায়ণ লোক এখন আর সমাজের অসম্মানিত নয় এবং দুর্নীতিকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতাও দিন দিন লোপ পাচ্ছে। দুর্নীতির জন্য শাস্তির অপ্রতুলতা ও সামাজিকভাবে নিন্দা করার প্রবণতা হ্রাস পাওয়ায় আমাদের দেশে দুর্নীতি প্রায় অলিখিত বৈধতার পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থা নিঃসন্দেহে কারো কাম্য নয়। তাই শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুর্নীতির স্বরূপচারিত্র্য উন্মোচন করা প্রয়োজন। ব্যক্তি মানুষ থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য দুর্নীতি কীভাবে অভিশাপ হয়ে উঠতে পারে- শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেই সচেতনতা তৈরির জন্য ‘দুর্নীতি, উন্নয়নের অন্তরায় ও উত্তরণের পথ' শীর্ষক প্রবন্ধটি পাঠ্যভুক্ত করা হয়েছে। এ প্রবন্ধটি পাঠে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুর্নীতি বিরোধী মনোভাব তৈরি হবে এবং তারা দুর্নীতির কারণ ও প্রতিরোধের পথগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারবে।
ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়িয়ে দিয়ে দুর্নীতি যে শূধু অর্থনীতিতেই বিরূপ প্রভাব ফেলে তা নয়, অধিকিন্তু সমাজের নৈতিক ও আদর্শিক মূল্যবোধ শিথিল করে দিয়ে সামাজিক বিশৃক্মখলাও সৃষ্টি করে। পরিশ্রম করে এবং মেধা ও বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে অর্থোপার্জনের মধ্যে যে সুস্থিরতা ও সুস্থতা নিহিত থাকে দুর্নীতি সেই সুস্থতার মূল্যবোধের পরিপন্থী। রাতারাতি বিত্তশালী হওয়ার ছিন্নমূল মানসিকতা থেকে যে দুর্নীতির উদ্ভব, তা কারো জন্যই মঙ্গলজনক হতে পারে না। সুতরাং সময়ের দাবি থেকেই শিক্ষার্থীদের জানা প্রয়োজন দুর্নীতি কী, দুর্নীতি কেন হয়, দুর্নীতির প্রভাব এবং দুর্নীতি প্রতিরোধের উপায় ও পদ্ধতি। কেননা দুর্নীতিমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক দেশ গড়তে বর্তমান শিক্ষার্থীরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবর্তীণ হবে।

অনুশীলনমূলক কাজ
ভাষা অনুশীলন q উপসর্গযোগে শব্দ গঠন
যেসব বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি শব্দের পূর্বে বসে অর্থ বা কাজের পরিবর্তন ঘটায় তাকে উপসর্গ বলে। ‘প্র' - তেমনি একটি উপসর্গ। নিম্নে উক্ত উপসর্গের ব্যবহার দেখানো হল :
প্র -       বিশেষভাবে অর্থে                      : প্রশাসন, প্রচেষ্টা, প্রমাণ, প্রদান, প্রভাব।
            সামনের দিকে অর্থে                  : প্রগতি, প্রসার, প্রাগ্রসর।  
            সম্যক উৎকৃষ্ট অর্থে                   : প্রগতি, প্রমূর্ত, প্রমোদ, প্রকৃষ্ট, প্রযত্ন।     
            আধিক্য অর্থে                           : প্রলয়, প্রবল, প্রতাপ, প্রকোপ, প্রসার, প্রগাঢ়, প্রচার, প্রকল্প।
বানান সতর্কতা  q য-লা/য-লা আ-কার (্য/্য/া)
ব্যবসা, ব্যবহার, ব্যবস্থা, ব্যয়, ব্যাধি, ব্যাপক, ব্যাহত।
দীর্ঘ-উত্তর প্রশ্ন
১.   দুর্নীতি বলতে কী বোঝায়? কোন কোন প্রবণতা দুর্নীতি বুঝতে সহায়তা করে?
২.   ‘প্রকৃত গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান অন্তরায় দুর্নীতি।’- এ উক্তির যথার্থতা বিচার কর।
৩.   দুর্নীতির আইনগত, প্রশাসনিক ও আর্থসামাজিক কারণ ব্যাখ্যা কর।
৪.   একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দুর্নীতির প্রভাব তুলে ধর।
৫.   দুর্নীতি প্রতিরোধের ব্যবস্থাসমূহ সবিস্তারে আলোচনা কর।

বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১.   ‘শাস্তির অপ্রতুলতা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে।’- ব্যাখ্যা কর।
২.   ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে দুর্নীতি উৎসাহিত হয়।’- আলোচনা কর।
৩.   বর্তমান সময়ে দুর্নীতিবাজদের সামাজিক অবস্থান ব্যাখ্যা কর।
৪.   দুর্নীতির সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি কীভাবে জড়িত বলে তুমি মনে কর। তোমার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন কর।
৫.   দুর্নীতির সঙ্গে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কীভাবে জড়িত?- আলোচনা কর।
৬.   কী কী কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দুর্নীতির পরিমাণ বেশি?- তোমার মতামত তুলে ধর।
৭.   কার্যকর সংসদ কীভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে?- আলোচনা কর। 
৮.   ‘স্বাধীন বিচারব্যবস্থা দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা রাখতে পারে।’- আলোচনা কর।
৯.   ‘সক্রিয় দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা বজায় রেখে দুর্নীতি রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।’- আলোচনা কর।
১০. দুর্নীতি রোধে গণমাধ্যমের ভূমিকা তুলে ধর।
১১.  দুর্নীতি রোধে সুশীল সমাজের ভূমিকা পর্যালোচনা কর।
১২. টীকা লেখ
      গণতন্ত্র, দুর্নীতি, সুশাসন, তথ্যের অবাধ প্রবাহ, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, জনপ্রশাসন, মৌলিক অধিকার, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি দমন কমিশন, ঘুষ, বিচারব্যবস্থা, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, ভোগবাদ, সিন্ডিকেট, অপচয়, মানব উন্নয়ন, ন্যায়বিচার, সংখ্যালঘু শ্রেণী, উন্নয়নশীল দেশ, রাজনৈতিক মূল্যবোধ, জবাবদিহিতা।
ভাষাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১.   প্রবন্ধটি থেকে উপসর্গবদ্ধ শব্দগুলো খুঁজে বের কর এবং একই উপসর্গের ব্যবহারে শব্দের অর্থগত পার্থক্যের আলোকে সাজিয়ে লেখ।
২.   প্রতিটি শব্দের ণত্ব-বিধান চিহ্নিত কর
      গ্রহণ, জনগণ, কারণ, গুরুত্বপূর্ণ, সাধারণ, লক্ষণীয়, প্রবণতা, চিহ্নিত, সিন্ডিকেট, নির্ধারণ, প্রমাণ, আকর্ষণ। 

View Foundation Digital Talking Library is developed and maintained by Sigma Enterprise.
Theme designed by Imtiaz
All rights are reserved. Any kind of reproduction of any mp3 files and text files is prohibited. If any organization or any person is found copying or reproducing any of the material will be punished under copy right law.