অধ্যাঙ্গী
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
লেখক-পরিচিতি
বাঙালি মুসলিম সমাজে নারী-জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া অন্তঃপুরবাসিনী জীবনে শুরু করলে সামাজিক সীমাদ্ধতার বেড়াজাল অতিক্রম করে বরণীয় স্মরণীয় হয়ে আছেন বিদ্যাচর্চায়, শিক্ষা-সংগঠনে ও সামাজিক অগ্রগতি সাধনে। অবরোধবাহিনীদের উন্মুক্ত বিশ্বে পদার্পণ করার যে আহবান জানিয়েছিলেন তিনি বিরাট ঝুঁকি নিয়ে, তা আমাদের সমাজীবনে আজ সার্থকতা লাভ করেছে। মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা তাঁর সাধারণ কীর্তি। সমস্ত প্রতিকূলতার ভিতরে আপন উদ্যম ও প্রচেষ্টার বেগম রোকেয়া ইংরেজি ও বাংলায় যেয দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তা বিস্ময়কর।
সমাজসেবা ব্রত হলেও রোকেযঅ কলম ধরেছিলেন সমাজকে জাগানোর লক্ষ্যে এবং এভাবেই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠাতা করেছেন, তীক্ষ্ণ, ঋজু গদ্যলেখক এবং সমাজসচেতন সাহসী সাহিত্যিক হিসেবে। ঠিক বেগম রোকেয়ার তুল্য লেখক সমকালীন হিন্দু বা মুসলমান, নারী বা পুরুষ কেউ ছিলেন না- বেগম রোকেয়া এমনই এক অদ্বিতীয় রচনারীতির অধিকারী ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে : ‘পদ্মরাগ’, ‘অবরোধবাসিনী’, ‘মতিচুর’, ‘সুলতানার স্বপ্ন’ ইত্যাদি। ইংরেজি গ্রন্থ ‘Sultana's Dream’ ও তার রচনা। বেগম রোকেয়া লেখা প্রকাশিত হয় মিসেস আর.এস.হোসেন’ নামে।
বেগম রোগেয়া জন্ম ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে। তাঁর মৃত্যু ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে।
------------------------------------
কোনো রোগীর চিকিৎসা করিতে হইলে প্রথমে রোগের অবস্থা জানা আবশ্যক। তাই অবলাজাতির উন্নতির পথ আবিষ্কার করিবার পূর্বে তাহাদের অবনতির চিত্র দেখাইতে হয়। আমি ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ শীর্ষক প্রবন্ধে ভগিনীদিগকে জানাইয়াছি যে, আমাদের একটা রোগ আছে-দাসত্ব। সে রোগের কারণ এবং অবস্থা কতক পরিমাণে ইতোপূর্বে বর্ণনা করা হইয়াছে। এক্ষণে আমরা দেখাইতে চেষ্টা করিব, সেই রোগ হওয়ায় আমাদের সামাজিক অবস্থা কেমন বিকৃত হইয়াছে। ঔষধ পথ্যের বিধান স্থানান্তর দেওয়া হইবে।
এইখানে গোঁড়া পর্দাপ্রিয় ভগ্নীদের অবগতির জন্য দু’একটা কথা বলিয়া রাখা আবশ্যক বোধ করি। আমি অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হই নাই। কেহ যদি আমার ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধে পর্দা-বিদ্বেষ ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্যে দেখিতে না পান, তবে আমাকে মনে করিতে হইবে, আমি নিজের মনোভাব উত্তমরূপে ব্যক্ত করিতে পারি নাই, অথবা তিনি প্রবন্ধটি মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন নাই।
সে প্রবন্ধে প্রায় সমগ্র নারীজাতির উল্লেখ আছে। সকল সমাজের মহিলাগণই কি অবরোধে বন্দিনী থাকেন? অথবা তাঁহারা পর্দানশীন নহেন বলিয়া কি আমি তাঁহাদিগকে সম্পূর্ণ উন্নত বলিয়াছি? আমি মানসিক দাসত্বের (enslaved মনের) আলোচনা করিয়াছি।
কোনো একটা নতুন কাজ করিতে গেলে সমাজ প্রতমত গোলযোগ উপস্থিত করে এবং&পরে সেই নূতন চালচলন সহিয়া লয়, তাহারাই দৃষ্টান্তস্বরূপ পার্সি মহিলাদের পরিবর্তিত অবস্থায় উল্লেখ করিয়াছি। পূর্বে তাঁহারা ছত্র ব্যবহারেরও অধিকারিণী ছিলেন না, তারপর তাঁহাদের বাড়াবাড়িটা সীমা ল্ঙ্ঘন করিয়াছে, তবু তো পৃথিবী ধ্বংস হয় নাই এখন পার্সি মহিলাদের পর্দা মোচন হইয়াছে সত্য, কিন্তু মানসিক দাসত্ব মোচন হইয়াছে কি? অব্যশই হয় নাই। আর ঐ যে পর্দা ছাড়িয়েছেন, তাহা দ্বারা তাঁহাদের স্বকীয় বুদ্ধি-বিবেচনার তো কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। পার্সি পুরুষগণ কেবল অন্ধভাবে বিলাতী সভ্যতার অনুকরণ করিতে যাইয়া স্ত্রীদিগকে পর্দার বাহিরে আনিয়েছে, ইহাতে অবলাদের জীবনীশক্তির তো কিছু পরিচয় পাওয়া যায় না-তাঁহারা যে জড়পদার্থ, সেই জড়পদার্থই আছেন। পুরুষ যখন তাঁহাদিগকে অন্তঃপুরে রাখিতেন, তাঁহারা তখন সেইখানে থাকিতেন। আবার পুরুষ যখন তাঁহাদের ‘নাকের দড়ি’ ধরিয়া টানিয়া তাঁহাদিগকে মাঠে বাহির করিয়াছেন, তখনই তাঁহারা পর্দার বাহির হইয়াছেন। ইহাতে রমণীকূলের বাহাদুরী কী? ঐরূপ পর্দা-বিরোধ কখনই প্রশংসনীয় নহে।
কলম্বস যখন আমেরিকা আবিষ্কার করিতে কৃতসংকল্প হন, তখন লোকে তাঁহাকে বাতুল বলে নাই কি? নারী আপন স্বত্ন স্বামিত্ব বুঝিয়া আপনাকে নরের ন্যায় শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করিতে চাহে, ইহাও বাতুলতা বই আর কী?
পুরুষগণ স্ত্রীজাতির প্রতি যতটুকু সম্মান প্রদর্শন করেন, তাহাতে আমরা সম্পূর্ণ তৃপ্ত হইতে পারি না। লোকে কালী, শীতলা প্রভৃতি রাক্ষস-প্রকৃতির দেবীকে ভয় করে, পূজা করে, সত্য। কিন্তু সেইরূপ বাঘিনী, নাগিনী, সিংহী প্রভৃতি ‘দেবী’ও কি ভয় ও পূজা লাভ করে না? তবেই দেখা যায় পূজাটা কে পাইতেছেন-রমণী কালী, তনা রাক্ষসী নৃমুন্ডমালিনী?
নারীকে শিক্ষার দিবার জন্য গুরুলোকে সীতা দেবীকে আদর্শরূপে দেখাইয়া থাকেন। সীতা অবশ্যই পর্দানশীন ছিলেন না। তিনি রামচন্দ্রের অর্ধাঙ্গী, রানী, প্রণয়িনী এবং সহচরী। আর রামচন্দ্র প্রেমিক, ধার্মিক-সবই।
কিন্তু রাম সীতার প্রতি যে ব্যবহার করিয়াছেন, তাহাতে প্রকাশ পায় যে,& কেটি পুতুলের সঙ্গে কোনো বালকের যে সম্বন্ধ, সীতার সঙ্গে রামের সম্বন্ধেও প্রায় সেইরূপ। বালক ইচ্ছা করিলে পুতুলকে প্রাণপনে ভালোবাসিতে পারে; পুতুল হারাইয়া বিরহে অধীর হইতে পারে; পুতুলের ভাবনায় অনিদ্রায় রজনীযাপন করিতে পারে; পুতুলটা যে ব্যীক্ত চুরি করিয়াছিল,ত তাহার প্রতি খড়গহস্ত হইতে পারে; হারানো পুতুল ফিরিয়া পাইলে আহলাদে আটখানা হইতে পারে; আবার বিনা কারণে রাগ করিয়াও পুতুলটা কাদায় ফেলিয়া দিতে পারে, কিন্তু পুতুল বালকের কিছুই করিতে পারে না, কারণ, হস্তপদ থাকা সত্ত্বেও পুত্তলিকা অচেতন পদার্থ। বালক তাহার পুতুল স্বেচ্ছায় অনলে উৎসর্গ করিতে পারে, পুতুল পুড়িয়া গেল দেখিয়া ভূমে লুটাইয়া ধূলি-ধূসরিত হইয়া উচ্চেঃস্বরে কাঁদিতে পারে।
রামচন্দ্র ‘স্বামিত্বের’ ষোল আনা পরিচয় দিয়েছেন। আর সীতা? কেবর প্রভু রামের সহিত বনযাত্রার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া দেখাইয়াছেন যে, তাঁহারও ইচ্ছা প্রকাশের শক্তি আছে। রাম বেচারা অবোধ বালক, সীতার অনুভব শক্তি আছে, ইহা তিনি বুঝিতে চাহেন নাই, কেননা, বুঝিয়া কার্য করিতে গেলে স্বামিত্বটা পূর্ণমাত্রায় খাটান যাইত না; -সীতার অমন পবিত্র হৃদয়খানি অবিশ্বাসের পদাঘাতে দলিত ও চূর্ণ করিতে পারা যাইত না! আচ্ছা, দেশ কালের নিয়মানুসারে কবির ভাষায় সুর মিলাইয়া না হয় মানিয়া লই যে, আমার স্বামীর দাসী নহি-অর্ধাঙ্গী। আমরা তাঁহাদের গৃহে গৃহিণী, মরণে (না হয়, অন্তত তাঁহাদের চাকুরি উপলক্ষে যথাতথা) অনুগামিনী, সুখ-দুঃখ সমভাগিনী, ছায়াতুল্যা সহচরী ইত্যাদি।
কিন্তু কলিযুগে আমাদের ন্যায় অর্ধাঙ্গী লইয়া পুরুষগণ কীরূপ বিকলাঙ্গ হইয়াছেন, তা কি কেহ একটু চিন্তাচক্ষে দেখিয়াছেন। আক্ষেপের (অথবা প্রভু দের সৌভাগ্যের) বিষয় যে, আমি চিত্রকর নহি-নতুবা এই নারীরূপ অর্ধাঙ্গ লইয়া তাঁহাদের কেমন অপরূপ মূর্তি হইয়াছে, তাহা অাঁকিয়া দেখাইতাম।
শুক্লকেশ বুদ্ধিমানগণ বলেন যে, আমাদের সাংসারিক জীবনটা দ্বিচক্র শকটের ন্যায়-এ শকটের এক চক্র-পতি, অপরটি পত্নী। তাই ইংরেজি ভাষায় কথায় কথায় স্ত্রীকে অংশিনী (partner) উত্তমার্ধ (better half) ইত্যাদি বলে। জীবনের কর্তব্য অতি গুরুতর, সহজ নহে-
‘সুকঠিন গার্হস্থ্য ব্যাপার
সুশঙ্খলে কে পারে চালাতে?
রাজ্যশাসনের রীতিনীতি
সুক্ষ্মভাবে রয়েছে ইহাতে।’
বোধ হয় এই গার্হস্থ্য ব্যাপারটাকে মস্তকস্বরূপ কল্পনা করিয়া শাস্ত্রকারগণ পতি ও পত্নীকে তাহার অঙ্গস্বরূপ বলিয়াছেন। তবে দেখা যাউক বর্তমান যুগে সমাজের মূর্তিটা কেমন।
মনে করুন, কোনো স্থানে পূর্বদিকে একটি বৃহৎ দর্পণ আছে, যাহাতে আপনি আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিতে পারেন। আপনার দক্ষিণাঙ্গভাগ পুরুষ এবং বামাঙ্গভাগ স্ত্রী। এই দর্পণের সম্মুকে দাঁড়াইয়া দেখুন-
আপনার দক্ষিণ বাহু দীর্ঘ (ত্রিশ ইঞ্চি) এবং স্থূল, বাম বাহু দৈর্ঘ্যে চবিবশ ইঞ্চি এবং ক্ষীণ। দক্ষিণ চরণ দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চি, বাম চরণ অতিশয় ক্ষুদ্র । দক্ষিণ স্কন্ধ উচ্চতার পাঁচ ফিট, বাম স্কন্ধ উচ্চতায় চারি ফিট। (তবেই মাথাটা সোজা থাকিতে পারে না, বামদিকে ঝুঁকিয়ে পড়িতেছে। কিন্তু আবার দক্ষিণ কর্ণভারে বিপরীত দিকেও একটু ঝুকিয়েছে।) দক্ষিণ কর্ণ হস্তিকর্ণের ন্যায় বৃহৎ, বাম কর্ণ রাসভকর্ণের ন্যায় দীর্ঘ। দেখুন! ভাল করিয়া দেখুন, আপনারা মূর্তিটা কেমন!! যদি এ মূর্তিটা অনেকের মনোমত না হয়, তবে দ্বিচক্র শকটের গতি দেখাই। সে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না- সে কেবল একই স্থানেত (গৃহকোণেই) ঘুরিতে থাকিবে। তাই ভারতবাসীক উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না।
সমাজের বিধি-ব্যবস্থার আমাদিগতে তাঁহাদের অবস্থা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক রাখিয়াছে, তাঁহাদের সুখ-দুঃখ এক প্রকার, আমাদের সুখ-দুঃখ অন্য প্রকার। এস্থলে বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘‘নবদম্পতির প্রেমালাপ’ কবিতার দুই চারি ছত্র উদ্ধৃত করিতে বাধ্য হইলাম :
‘বর। কেন সখি কোণে কাঁদিছ বসিয়া?
কনে। পুষি মেনিটিরে ফেলিয়া এসেছি ঘরে।
বর। কী করিছ বনে কুঞ্জভবনে?
কনে। খেতেছি বসিয়া টোপা কুল।
বর। জগৎ ছানিয়া, কী দিব আনিয়া জীবন করি ক্ষয়?
তোমা তরে সখি, বল করিব কী?
কনে। আরো কুল পাড় গোটা ছয়।
* * *
বর। বিরহের বেলা কেমনে কাটিবে?
কনে। দেব পুতুলের বিয়ে!’
সুতরাং দেখা যায় কন্যাকে এরূপ শিক্ষা দেওয়া হয় না, যাহাতে সে স্বামীর ছায়াতুল্য সহচরী হইতে পারে।
প্রভুদের বিদ্যার গতির সীমা নাই, স্ত্রীদের বিদ্যার দৌড় সচরাচর ‘বোধোদয়’ পর্যন্ত।
স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য প্রস্থ (সেলাই করিবার জন্য) মাপেন ! স্বামী যখন কল্পনা-সাহায্যে সুদূর আকাশে গ্রহণক্ষত্রমালা-বেষ্টিত সৌরজগতে বিচরণ করেন, সূর্যমন্ডলের ঘনফল তুলাদন্ডে ওজন করেন এবং ধূমকেতুর গতি নির্ণয় করেন, স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাউল ডাউল ওজন করেন এবং রাঁধুনির গতি নির্ণয় করেন। বলি জ্যোতির্বেত্তা মহাশয়, আপনার পার্শ্বে আপনার সহধর্মিনী কই? বোধ হয়, গৃহিণী যদি আপনার সঙ্গে সূর্যমন্ডলে যান, তবে তথায় পুঁহুছিবার পূর্বেই পথিমধ্যে উত্তাপে বাষ্পীভূত হইয়া যাইবেন। তবে সেখানে গৃহিণীর না যাওয়াই ভাল!!
অনেকে বলেন, স্ত্রীলোকদের উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন নাই। মেয়েরা চব্যচোষ্য রাঁধিতে পারে, বিবিধ প্রকার সেলাই করিতে পারে, দুই-চারখানা উপন্যাস পাঠ করিতে পারে, ইহাই যথেষ্ট। আর বেশি আবশ্যক নাই। কিন্তু ডাক্তার বলেন যে, আবশ্যক আছে, যেহেতু মাতার দোষ-গুণ লইয়া পুত্রগণ ধরাধামে অবতীর্ণ হয়। এইজন্য দেখা যায় যে, আমাদের দেশে অনেক বালক শিক্ষকের বেত্রতাড়নায় কণ্ঠস্থ বিদ্যার জোরে এফ.এ.,বি.এ পাস হয় বটে; কিন্তু বালকের মনটা তাহার মাতার সহিত রান্নাঘরেই ঘুরিতে থাকে। তাহাদের বিদ্যা পরীক্ষায় এ কথায় সত্যতার উপলব্ধি হইতে পারে।
আমার জনৈক বন্ধু তাঁহার ছাত্রকে উত্তর-দক্ষিণ প্রভৃতি দিকনির্ণয়ের কথা (cardinal points) বুঝাইতেছিলেন। শেষে তিনি প্রশ্নত করিলেন, ‘যদি তোমার দক্ষিণহস্ত পশ্চিমে এবং বামহস্ত পূর্বে থাকে, তবে তোমার মুখ কোন দিকে যাইবো? ’ উত্তর পাইলেন, ‘আমার পশ্চাৎ দিকে।’
যাঁহারা কন্যার ব্যায়াম করা অনাবশ্যক মনে করে, তাঁহারা দৌহিত্রকে হৃষ্টপুষ্ট ‘পাহুল-ওয়ান’ দেখিতে চাহেন কি না? তাঁহাদের দৌহিত্র ঘুষিটা খাইয়া থাপড়টা মারিতে পারে, এরূপ ইচ্ছা করেন কিনা? যদি সেরূপ ইচ্ছা করেন, তবে বোধ হয়, তাঁহারা সুকুমারী গোলাপ লতিকায় কাঁঠাল ফলাইতে চাহেন!! আর যদি তাঁহারা ইচ্ছা করেন যে দৌহিত্রও বলিষ্ঠ হয়, এবং পয়জার পেটা হইয়া নত মস্তকে উচ্চেঃস্বরে বলে, ‘মাৎ মারো! চোট লাগতা হায়!!’ এবং পয়জার লাভ শেষ হইলে দূরে গিয়া প্রহারকর্তাকে শাসাইয়া বলে যে, ‘কায় মারতা থা? হাম নালিশ করেগা?ত তাহা হইলে আমি তাঁহাদিগকে আমার বক্তব্য বুঝাইতে অক্ষম।
খ্রিষ্টিয়ান সমাজে যদিও স্ত্রীশিক্ষার যথেষ্ট সুবিধা আছে, তবু রমণী আপন স্বত্ব ষোল আনা ভোগ করিতে পায় না। তাহাদের মন দাসত্ব হইতে মুক্তি পায় না। স্বামীক ও স্ত্রী কতক পরিমাণে জীবনের পথে পাশাপাশি চলিয়া থাকেন বটে; কিন্তু প্রত্যেকের উত্তমার্ধই (Better half) তাঁহার অংশীদার (Partner) এর জীবনে জীবন মিলাইয়া তন্মায়ী হইয়া যান না। স্বামী যখন ঋণজালে জড়িত হইয়া ভাবিয়া ভাবিয়া মরমে মরিতেছেন, স্ত্রী তখন একটা নূতন টুপির (bennet এর ) চিন্তা করিতেছেন। কারণ তাঁহাকে কেবল মূর্তিমতী কবিতা হইতে শি্ক্ষা দেওয়া হইয়াছে-তাই তিনি মনোরমা কবিতা সাজিয়া থাকিতে চাহেন। ঋণদায়রূপ গদ্য (prosaic) অবস্থা তিনি বুঝিতে অক্ষম।
এখন মুসলামান সমাজে প্রবেশ করা যাউক, মুসলমানের মতো আমরা পুরুষের ‘অর্ধেক’, অর্থাৎ দুইজন নারী একজন নরের সমতুল্য। অথবা দুইটি ভ্রাতা ও একটি ভগিনী একত্র হইলে আমরা ‘আড়াইজন’ হই। আপনারা ‘মহম্মদীয় আইনে’ দেখিতে পাইবেন যে বিধান আছে, ‘পৈতৃক সম্পত্তির কন্যা পুত্রের অর্ধেক ভাগ পাইবে। এ নিয়মটি কিন্তু পুস্তকেই সীমাবদ্ধ। যদি আপনারা একটু পরিশ্রম স্বীকার করিয়া কোনো ধনবান মুসলমানের সম্পত্তি বিভাগ করা দেখেন, কিংবা জমিদতারী পরিদর্শন করিতে যান, তবে দেখিবেন, কার্যত কন্যার ভাগে শূন্য (০) কিংবা যৎসামান্য পড়িতেছে।
আমি এখন অপার্থিব সম্পত্তির কথা বলিব। পিতার স্নেহ, যত্ন ইত্যাদি অপার্থিব সম্পত্তি। এখানেও পক্ষপাতিতার মাত্রা বেশি। ঐ যত্ন, স্নেহ, হিতৈষিতার অর্ধেকই আমরা পাই কই? যিনি পুত্রের সুশিক্ষার জন্য চারিজন শিক্ষক নিযুক্ত করেন, তিনি কন্যার জন্য দুইজন শিক্ষায়িত্রী নিযুক্ত করেন কি? যেখানে পুত্র তিনটা (বি.এ পর্যন্ত)পাস করে, সেখানে কন্যা দেড়টা পাস (এন্ট্রান্স পাস ও এফ.এ. ফেল) করে কি? পুত্রদের ওলামা’’ সে স্থলে ভগিনী ‘‘নজম উল-ওলামা’’ হইয়াছেন কি? তাঁহাদের অন্তঃপুর গগনে অসংখ্য ‘‘নজমন্নেসা’’ ‘‘শামসন্নেসা’’ শোভা পাইতেছেন বটে। কিন্তু আমার সাহিত্যের গগনে ‘‘নজম-উল-ওলামা’’ দেখিতে চাই।
আমাদের জন্য এদেশের শিক্ষার বন্দোবস্ত সচরাচর এইরূপ-প্রথমে আরবীয় বর্ণমালা, অতঃপর কুরআন শরীফ পাঠ । কিন্তু শব্দগুলিরর অর্থ বুঝাইয়া দেওয়া হয় না, কেবল স্মরণশক্তির সাহায্যে টিয়াপাকির মত আবৃত্তি কর। কোনো পিতার হিতৈষণার মাত্রা বৃদ্ধি হইলে, তিনি দুহিতাকে ‘‘হাফেজা’’ করিতে চেষ্টা করেন। সমুদয় কুরআনখানি যাঁহার কণ্ঠস্থ থাকে, তিনিই ‘‘হাফেজ’’। আমাদের আরবি শিক্ষা ঐ পর্যন্ত। পারস্য এবং উর্দু শিখিতে্হইলে, প্রথমে ‘‘করিমা ববখশা বরহালে মা’’ এবং একেবারে (উর্দু) ‘‘বানাতন্ নাস’’ পড়। একে আকার ইকার নাই, তাতে আবার আর কোনো সহজা পাঠ্যপুস্তক পূর্বে পড়া হয় নাই, সুতরাং পাঠের গতি দ্রুতগামী হয় না। অনেকেরে ঐ কয়খানি পুস্তক পাঠ শেষ হওয়ার পূর্বেই কন্যা-জীবন শেষ হয়। বিবাহ হইলে বালিকাভাবে, ‘‘যাহা হোক, পড়া হইতে রক্ষা পাওয়া গেল।’’ কোনো কোনো বালিকা রন্ধন ও সূচীকর্মে সুনিপুণা হয। বঙ্গদেশেও বালিকাদিগকে রীতিমত বঙ্গভাষা শিক্ষা দেওয়া হয় না। কেহ কেহ উর্দু পড়িতে শেখে, কিন্তু কলম ধরিতে শেখে না। ইহাদের উন্নতির চরমসীমা সলমা চুমকির কারুকার্য, উলের জুতা-মোজা ইত্যাদি প্রস্ত্তত করিতে শিক্ষা পর্যন্ত।
যদি ধর্মগুরু হযরত মুহাম্মদ (স) আপনাদের হিসাব-নিকাশ লয়েন যে, ‘‘তোমরা কন্যার প্রতি কীরূপ ন্যায় ব্যবাহর করিয়াছ?’’ তবে আপনারা কী বলিবেন?
পয়গম্বরদের ইতিহাসে শোনা যায়, জগতে যখন মানুষ বেশি অত্যাচার-অনাচার করিয়াছে, তখনই এক-একজন পয়গম্বর আসিয়া দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করিয়াছেন। আরবে স্ত্রীজাতির প্রতি অধিক অত্যাচার হইতেছিল; আরববাসিগণ কন্যা হত্যা করিতেছিল, তখন হযরত মুহাম্মাদ (স) কন্যাকুলের রক্ষকস্বরূপ দন্ডায়মান হইয়াছিলেন। তিনি কেবল বিবিধ ব্যবস্থা দিয়াই ক্ষান্ত থাকেন নাই, স্বয়ং কন্যা পালন করিয়া আদর্শ দেখাইয়াছেন। তাঁহার জীবন ফাতেমাময় করিয়া দেখাইয়াছেন কন্যা কীরূপ আদরণীয়া। সে আদর, সে স্নেহ জগতে অতুল।
আহা! তিনি নাই বলিয়া আমাদের এ দুদর্শা। তবে ভাই ভগিনীগণ! আমরা সকলে সমন্বয়ে বলি :
‘‘করিম ববখশা-এ বরহালে মা।’’ করিম (ঈশ্বর) অবশ্যই কৃপা করিবেন। যেহেতু ‘‘সাধনায় সিদ্ধি।’’ আমরা ‘‘করিমের’’ অনুগ্রহ লাভের জন্য যত্ন করিলে অবশ্যই তাঁহার করুণা লাভ করিব। আমরা ঈশ্বর ও মাতার নিকট ভ্রাতাদের ‘‘অর্ধেক’’ নহি। তাহা হইলে এইরূপ স্বাভাবিক বন্দোবস্ত হইত যে পুত্র যেখানে দশ মাস স্থান পাইবে, দুহিতা সেখানে পাঁচ মাস! পুত্রের জন্য যতখানি দুগ্ধ আমদানি হয়, কন্যার জন্য তাহার অর্ধেক। সেরূপ তো নিয়ম নাই! আমরা জননীর স্নেহ মমতা ভ্রাতার সমানই ভোগ করি। মাতৃ-হৃদয়ে পক্ষপাতিতা নাই। তবে কেমন করিয়া বলিব, ঈশ্বর পক্ষপাতী? তিনি কি মাতা অপেক্ষা অধিক করুণাময় নহেন?
আমি এার রন্ধন ও সূচীকার্য সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, তাহাতে আবার যেন কেহ মনে না করেন যে আমি সূচীকর্ম ও রন্ধনশিক্ষার বিরোধী। জীবনের প্রধান প্রয়োজনীয় বস্ত্ত অন্নবস্ত্র। সুতরাং রন্ধন ও সেলাই অবশ্যই শিক্ষণীয়। কিন্তু তাই বলিয়া জীবনটাকে শুধু রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নহে।
স্বীকার করি যে, শারীরিক দুর্বলতাবশত নারী জাতি অপর জাতির সাহায্যে নির্ভর করে। তাই বলিয়া পুরুষ ‘‘প্রভু’’ হইতে পারে না। কারণ জগতে, দেখিতে পাই, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের নিকট কোনো না কোনো প্রকার সাহায্য প্রার্থনা করে, যেন একে অপরের সাহায্য ব্যতীত চলিতে পারে না। তরুলতা যেমন বৃষ্টির সাহায্যপ্রার্থী, মেগও সেইরূপ তরুর সাহায্য চায়। জল বৃদ্ধির নিমিত্ত নদী বর্ষার সাহায্য পায়, মেঘ আবার নদীর নিকট ঋণী। তবে তরঙ্গিণী কাদম্বিনীর ‘‘স্বামী’’, না কাদম্বিনী ‘‘স্বামী’’? এ স্বাভাবিদক নিয়মের কথা ছাড়িয়া কেবল সামাজিক নিয়মে দৃষ্টিপাত করিলেও আমরা তাহাই দেখি।
কেহ সূত্রধর, কেহ তন্তুবায় ইত্যাদি। একজন ব্যারিস্টার ডাক্তারের সাহায্যপ্রার্থী, আবার ডাক্তারও ব্যারিস্টারের সাহায্য চাহেন। তবে ডাক্তারকে ব্যারিস্টারের স্বামী বলিব, না ব্যারিস্টার ডাক্তারের স্বামী? যদি ইহাদের কেহ কাহাকে ‘‘স্বামী’’ বলিয়া স্বীকার না করেন, তবে শ্রীমতীগণ জীবনের চিরসঙ্গী শ্রীমানদিগকে ‘‘স্বামী’’ ভাবিবেন কেন?
আমরা উত্তমার্ধ (better halves), তাঁহারা নিকৃষ্টার্ধ (worse halves), আমরা অর্ধাঙ্গী, তাঁহারা অর্ধাঙ্গ। অবলার হাতেও সমাজের জীবন-মরণের কাঠি আছে, যেহেতু ‘না জাগিলে সব ভারত-ললনা’’ এ ভারত আর জাগিতে পারিবে না। প্রভুদের ভীরুতা কিংবা তেজস্বিতা জননীর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তবে কেবল শারীরিক বলের দোহাই দিয়া অদূরদর্শী ভ্রাতৃ মহোদয়গণ যেন শ্রেষ্ঠত্বের দাবি না করেন।
আমরা পুরুষের ন্যায় সুশিক্ষা অনুশীলনের সম্যক সুবিধা না পাওয়ায় পশ্চাতে পড়িয়া আছি। সমান সুবিধা পাইলে আমরাও কি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিতে পারতাম না? আশৈশব আত্মনিন্দা শুনতেছি, তাই এখন আমরা অন্ধকারভাবে পুরুষের শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করি এবং নিজেকে অতি তু্চ্ছ মনে করি। অনেক সময় ‘‘হাজার হোক ব্যাটা ছেলে’’ বলিয়া ব্যাটা ছেলেদেরে দোষ ক্ষমা করিয়া অন্যায় প্রশংসা করি। এটাই তো ভুল।
আমি ভগিনীদের কল্যাণ কামনা করি, তাঁহাদের ধর্মবন্ধন বা সমাজবন্ধন ছিন্ন তাঁহাদিগকে একটা উন্মুক্ত প্রান্তরেক বাহির করিতে চাহি না। মানসিক উন্নতি করিতে হইলে হিন্দুত্ব বা খ্রিষ্টানকে খিষ্টানি ছাড়িয়ে হইবে, এমন কোনো কথা নাই। আপন আপন সম্প্রদায়ের পার্থক্য রক্ষা করিয়া ও মনটাকে স্বাধীনতা দেওয়া যায়। আমরা যে কেবল্উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে অবনত হইয়াছি নাই বুঝিতে ও বুঝাইতে চাই।
অনেকে হয়তো ভয় পাইয়ছেন যে, বোধ হয় একটা পত্নী বিদ্রোহের আয়োজন করা হইতেছে। অথবা ললনাগণ দলে দলে উপস্থিত হইয়া বিপক্ষকে রাজকীয় কার্যক্ষেত্রে হইতে তাড়াইয়া দিয়া সেই পদগুলি অধিকার করিবেন-শামলা, চোগা, আইন-কানুনের পাঁজি পুঁথি লুঠিয়া লইবেন। অথবা সদলবলে কৃষিক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়া কৃষকগুলিকে তাড়াইয়া দিয়া তাহাদের শস্যক্ষেত্র দখল করিবেন, হাল গুরু কড়িয়া লইবেন, তবে তাঁহাদের অভয় দিয়া বলিতে হইবে-নিশ্চিন্ত থাকুন।
পুরুষগণ আমাদিগকে সুশিক্ষা হইতে পশ্চাদপদ রাখিয়াছেন বলিয়া আমরা অকর্মণ্য হইয়া গিয়াছি। ভারতে ভিক্ষু ও ধনবান এই দুই লোক অলস; এবং ভদ্রমহিলাদের দল কর্তব্য অপেক্ষা অল্প কাজ করে। আমাদের আরাম-প্রিয়তা খুব বাড়িয়েছে। আমাদের হস্ত, মন, পদ, চক্ষু ইত্যাদির সদ্ব্যবহার করা হয় না। দশজন রমণীরত্ব একত্র হইলে ইহার উহার-বিশেষত আপন আপন অর্ধাঙ্গের নিন্দা কিংবা প্রশংসা করিয়া বাকপটুতা দেখায়। আবশ্যক হইলে কোন্দলও চলে।
আশা করি এখন ‘‘স্বামী’র স্থলে ‘‘অর্ধাঙ্গ’’ শব্দ প্রচলিত হইবে।
শব্দার্থ ও টীকা
অবলা জাতি - বলহীনা। এখানে নারীসমাজ অর্থে ব্যবহৃত।
অবরোধ প্রথা - অন্তঃপুরে লোকচক্ষুর আড়ালে মেয়েদের আটক রাখার নিয়ম।
পার্সি - পারস্য দেশের অর্থাৎ ইরানি।
ছত্র - ছাতা।
বিলাতি সভ্যতা - পাশ্চাত্য সভ্যতা।
নাকের দড়ি - নাকাল ও বাধ্য করার অস্ত্র।
কলম্বস - ক্রিস্টোফার কলম্বস (১৪৪৭-১৫০৬) প্রসিদ্ধ ইতালীর নাবিক এবং আমেরিকা মহাদেশের আবিষ্কর্তা। স্পেনের রাজদম্পত্তি ফার্ডিনান্ড ও ইজাবেলার পৃষ্ঠপোষকতায় ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সমুদ্র যাত্রা করেন। প্রথমে তিনি কিউবা, বাহামা প্রভৃতি দ্বীপ এবং ক্রমে জামাইকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ত্রিনিদাদ প্রভৃতি আবিষ্কার করেন।
বাতুল - পাগল, উন্মাদ।
স্বত্ব-স্বামিত্ব - অধিকার ও মালিকানা।
বাতুলতা - পাগলামি।
সীতা - রামায়ণে বর্ণিত মিতিলরাজ জনকের কন্যা ও রামচন্দ্রের পত্নী।
রামচন্দ্র - রামায়ণে বর্ণিত দশরথ ও কৌশল্যার পুত্র এবং সীতার স্বামী।
ধূলি-ধূসরিত - ধুলো লেগে মলিন।
অর্ধাঙ্গী - স্বামী-স্ত্রীকে পুরো পরিবারের একক হিসেবে কল্পনা করে স্ত্রীকে অর্ধাঙ্গী গণ্য করা হয়।
শুক্লকেশ - শুভ্র বা সাদা চুল বিশিষ্ট, পক্বকেশ।
শকট - গাড়ি, যান।
শাস্ত্রকার - শাস্ত্র-রচয়িতা, প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ-প্রণেতা।
রাসভকর্ণ - গাধার কান।
‘বোধোদয়’ - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত শিশুশিক্ষা তৃতীয় ভাগ বইয়ের নাম। ‘বোধেদয়’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে।
ওয়াড় - লেপ-বালিশ ইত্যাদির আবরণ।
তুলাদন্ড - দাঁড়িপাল্লা
চর্ব্যচোষ্য - চিবিয়ে ও চুষে খেতে হয় এমন।
এফ.এ/ - First Arts। বর্তমান উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়।
পাইল-ওয়ান - পালোয়ান, কুস্তিগির।
পয়জার - জুতো, পাদুকা।
মাৎ মারো - মেরো না।
চোট লাগতা হ্যায় - ব্যথা লাগছে।
কায় মারতা থা?
হাম নালিশ করে গা! - কে মারছিলে? আমি নালিশ করব।
তন্ময় - তাতে একান্তভাবে নিমগ্ন; তাছাড়া অন্য কোনো চিন্তা বা অনুভূতি নেই এমন।
অপার্থিব - অবস্ত্তগত।
হিতৈষিতা - হিতকামনা, কল্যাণসাধনের ইচ্ছা।
এন্ট্রান্স - প্রবেশিকা, বর্তমান মাধ্যমিক বা এসএসসি।
শমস-উল-ওলামা - জ্ঞানী ব্যক্তিদের উপাধি। এই উপাধির অর্থ ওলামা বা জ্ঞানীদের মধ্যে সুর্য।
নজম-উল-ওলামা - জ্ঞানীদের মধ্যে নক্ষত্র।
হিতৈষণা - কল্যাণ ইচ্ছা।
হাফেজ - সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ যাঁর মুখস্থ এমন।
করিমা ববখশা এ
বরহালে মা - করিম বা আল্লাহ্ আমাদের এ অবস্থা দিয়েছেন।
সলমা চুমকি - সোনা বা রূপার চকচকে পাকানো তীর বা বুট দানা।
তরঙ্গিনী - নদী।
কাদম্বিনী - মেঘমালা।
সূত্রধর - ছুতার, কাঠের মিস্ত্রি।
তন্তুুবায় - তন্তু বয়ন করে যে, তাঁতি, যে কাপড় বোনে।
শামলা - শালের এক রকম পাগড়ি, উকিলের পরিধেয় পাগড়ি।
চোগা - লম্বা ঢিলা বুক-খোলা এক ধরনের জামা যা চাপকানের উপরে পরা হয়।
উৎস ও পরিচিতি
এই রচনায় উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ায় ভারতবর্ষে পুরুসশাসিত সমাজ জীবনের সবক্ষেত্রে নারী, বিশেষ করে মুসলমান নারীসমাজের পশ্চাদপদতা, দুর্বহ জীবন ও অদিকারীহীনতাকে দেখা হয়েছে পুরুষের নিদারূরন স্বার্থপরতা, আধিপত্যকামী মানসিকতার প্রেক্ষাপটে। অত্যন্ত ব্যথিত হৃদয়ে রোকেয়া আবেগধর্মী যুক্তিপ্রধান এই রচনায় নারীসমাজকে জ্ঞানাচর্চা ও কর্মব্রত, অধিকার সচেতনতা ও মুক্তি আকাঙ্ক্ষায় প্রবুদ্ধ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, সমাজ যে পূর্ণ ও স্বাভাবিক গতিতে অগ্রসর হতে পারছে না তার কারণ পরিবার ও সমাজজীবনের অপরিহার্য অর্ধেক শক্তি নারীসমাজের দুর্বল, অবনত অবস্থা। এ জন্য পুরুষসমাজের দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতাকে দায়ী করেছেন তিনি।
এই রচনায় নারীজাগরণের পক্ষে যে সুচিন্তিত, দৃঢ় ও বলিষ্ঠ মতামত তিনি ব্যক্ত করেছেন তাতে তাঁর মন্তব্যে আছে আবেগের গাঢ়তা আর যু&&ক্ততে আছে ধারালো তীক্ষ্ণতা।
তিনি দেখাতে চেয়েছেন, সামজ জীবনের অগ্রগতি ও কল্যাণ সাধনের জন্য নারী জাগরণ এবং সেই সঙ্গে পুরুষসমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের বিকল্প নেই।
অনুশীলনমুলক কাজ
গদ্যরীতি * যুক্তি প্রদর্শন
কোনো কোনো লেখায় লেখক তাঁর নিজস্ব মতামতকে প্রতিষ্ঠা করতে চান। এ ধরনের লেখার তাঁর লক্ষ্য থাকে বক্তব্য বিষয়ে পাঠকের প্রত্যয় ও বিশ্বাস জাগানো। কখনো কখনো লেখক পাঠককে তাঁর (লেখকের) মতের পক্ষে টেনে আনতেও প্রবুদ্ধ করে থাকেন। এ ধরনের লেখার মূল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে যুক্তি প্রদর্শন।
লেখক তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে যে সব যুক্তি হাজির করেন তার মধ্যে থাকে (ক) মুল বা প্রধান যুক্তি এবং (খ) আনুষঙ্গিক বা সহায়ক যুক্তি। লেখক এগুলো প্রদর্শন করেন অত্যন্ত স্পষ্ট জোরালো ও তীক্ষ্ণভাবে। আর সেই সঙ্গে তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে হাজির করেন প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি, পরিসংখ্যান ও তথ্যা প্রমাণ-ইত্যাদি।
যুক্তিপ্রয়োগধর্মী লেখায় প্রয়োজন মতো তুলনা, বর্ণনা, বিশ্লেষণ কার্যকারণ সম্পর্ক নিরূপণূ ইত্যাদি যে কোনো গদ্যকৌশল কাজে লাগাতে পারেন। তবে তিনি সাধারণত সেই কৌশল অবলম্বন করেন যাতে তাঁর যুক্তি জোরালোভাবে তুলে ধরা যায়। এ ধরনের গদ্য রচনার আলাদা কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে।
১. আবেগধর্মী যুক্তিতর্কমুলক রচনা হলেও মৌলিক তর্ক-বিতর্কের মতো নয়। কারণ, মৌলিক, তক-বিতর্ক অনেক সময় যুক্তি ছেড়ে মাথা গরম হওয়া জগড়ায় শেষ হয়। পক্ষান্তরে এ ধরনের লেকায় মূল বিষয়টি সব সময় মনে রাখতে হয়। সেই হারানো চলে না। লেখক হয়তো বিশেষতক পদক্ষেপ গ্রহণের পক্ষে বলেন, (‘প্রচলিত পরীক্ষা) পদ্ধতি যুযোপযোগী করা দরকার’) কিংবা হয়তো তিনি কোনো ব্যাপারের সভ্যতা প্রতিপন্ন করতে চান (‘শিক্ষার খাতে ব্যয় বাড়ালেই শিক্ষার মান বাড়ে না’) . প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাকে যথাযথ, জোরালো ও অকাট্য যুক্তি প্রদর্শন করতে হয়। তা করতে গিয়ে বিপক্ষের মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদিকে আক্রমণ বা পাল্টা আক্রমণ তিনি করতে পারেন কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রমণ আদৌ সঙ্গত নয়।
২. বক্তব্যকে যুক্তিযুক্তভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে প্রথম ও সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব হবে মূল প্রস্তাবনার ওপরে। কারণ সেটাই হল তার প্রতিপন্ন করার বিষয় এবং বিতর্কের ভিত্তি। সেটি উপস্থাপনা ও ব্যাখ্যার পরেই আসবে মুর প্রস্তাবকে জোরালো করার পক্ষে সহায়ক ও আনুষঙ্গিক যুক্তি এবং প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ ইত্যাদি।
৩. নিজেদের পক্ষে যুক্তি দেয়া ছাড়াও বিপক্ষের যুক্তি খন্ডনের দিকটিও দেখতে হয়। লেখার শুরুতে কিংবা মাঝামাঝি যুক্তি খন্ডনের কাজটি লেখককে সেরে নিতে হয়।
৪. কোনো যুক্তি বা মতামতের ভুল ব্যাখ্যা হবার আশংকা থাকলে প্রাসঙ্গিক জায়গায় লেখক তা উল্লেখ করে থাকেন।
৫. মূল বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ সহ যুক্তি প্রদান ও বিপক্ষের যুক্তি খন্ডন না করে অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য, বিপক্ষের প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণ, যুক্তিহীন বিভ্রান্তিকর মতামত প্রদান ও মাত্রাতিরিক্ত আবেগ এ ধরনের লেখাকে ও লেখার উদ্দেশ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে।
ভাষা অনুশীলন * বানান
-ইনী প্রত্যয় যোগে স্ত্রীবাচক শব্দ গঠিত হয়। এর ফলে শব্দের বানানে পরিবর্তন হয়ে থাকে। পুরুষবাচক শব্দ ও স্ত্রীবাচক শব্দের বানান লক্ষ কর :
বন্দী - বন্দিনী
অদিকারী - অধিকারিণী
প্রণয়ী - প্রণয়িনী
গৃহী - গৃহিণী
অনুগামী- - অনুগামিনী
সমভাগী - সমভাগিনী।
বানান সতর্কতা
আবিষ্কার, বাষ্পীভূত, নিরীক্ষণ, ক্ষীণ, শীর্ষক, সুক্ষ্ম, দিঙনির্ণয়, শিক্ষনীয়, শারীরিক, শ্রীমতি, ভগিনী, ভগ্নী, বন্দিনী, অধিকারিণী, প্রণয়িনী, গৃহিনী, অনুগামিনী, সমভাগিনী, কর্ণ, বর্ণনা, রমণী, সহচরী, অর্ধাঙ্গী, পত্নী, দর্পণ, গোঁড়া, বিদ্বেষ, উদ্দেশ্য, ধ্বংস , স্বত্ব-স্বামিত্ব, ব্যক্ত, অন্তঃপুর, জ্যোতির্বেত্তা।
-ইত প্রত্যয় যোগে গঠিত বিশেষণ শব্দ
বিকার > বিকৃত : বিকৃত চেহারা
পরিবর্তন > পরিবর্তিত: পরিবর্তিত অবস্থা
ধূসর > ধূসরিত : ধূসরিত চেহারা
শোভা > শোভিত : শোভিত পতাকা
শি্ক্ষা > শিক্ষিকা : শিক্ষিকা লোক
প্রচলন > প্রচলিত : প্রচলিত শিক্ষা।
দীঘৃ-উত্তর প্রশ্ন
১. ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের মূল বক্তব্য নিজের ভাষায় লেখ।
২. ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে লেখিকার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কি?
সমস্যা স্বরূপ, কারণ ও সমাধান প্রসঙ্গে তাঁর মতামত গুছিয়ে লেখ।
বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১. ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের শুরুতে লেখিকা গোঁড়া পর্দাপ্রিয় ভগ্নীদের কাছে কোন বিষয়টি পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করেছেন? কেন?
২. ‘মানসিক দাসত্ব’ বলতে বেগম রোকেয়া কী বুঝিয়েছেন? বিশদভাবে বুঝিয়ে দাও।
৩. নারীর প্রতি পুরুষের যে দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে সমালোচনা করা হয়েছে তার পরিচয় দাও।
৪. নিজেকে অর্ধেক ডান অংশ ও স্ত্রীকে অর্ধেক নাম অংশ কল্পনা করে আয়নায় চেহারা দেখার জন্য রোকেয়া যে পুরুষকে আহবান জানিয়েছেন তার মাধ্যমে তিনি কী প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন?
৫. শিক্ষা ও কর্মজীবনে নারীর পশ্চদপদতার সমস্যা রোকেয়া কীভাবে তুলে ধরেছেন।
৬. খ্রিস্টান ও মুসলমান সমাজে নারীর অধিকার প্রসঙ্গে রোকেয়া কী ধরনের মতামত ও মন্তব্য করেছেন?
৭. ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধ পড়ে ঐ সময়কার নারীশিক্ষা সম্পর্কে তোমার যে ধারণা জন্মেছে তা নিজের ভাষায় লেখ।
৮. নারীসমাজের অগ্রগতির স্বার্থে রোকেয়া কী ধরনের পদক্ষেপের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছিলেন।
ভাষাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১. প্রশ্নসূচক শিষ্টচলিত বাক্যে রূপান্তর কর :
ক) পুত্রদের বিদ্যালয়ের সংখ্যা করা যায় না।
খ) বালিকাদের বিদ্যালয় সংখ্যা পাওয়াই যায় না।
গ) আমাদের মানসিক দাসত্ব মোচন হয় নাই।
ঘ) সীতা অবশ্যই পর্দানশীন ছিলেন না।
ঙ) সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না।
২. -ইনী প্রত্যয় যোগে পুরুষবাচক পাঁচটি শব্দকে স্ত্রীবাচক শব্দে রূপান্তরিত করা।
৩. -ইত প্রত্যয় যোগে পাঁচটি বিশেষণ শব্দ লিখে বাক্যে প্রয়োগ দেখাও।
ব্যাখ্যা
১. প্রভুদের বিদ্যায় গতি..........‘বোধোদয়’ পর্যন্ত।
২. জীবনটাকে শুধু রান্নাঘরে..........উচিত নহে।
৩. তরুলতা যেমন...........তরুর সাহায্য চায়।
৪. অবলার হাতেও..........কাঠি আছে।