যৌবনের গান
কাজী নজরুল ইসলাম
_____________________________________________________________
লেখক পরিচিতি
কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে মে, ১৩০৬ সনের ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুড়ুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় তিনি লেটো গানের দলে যোগ দেন। পরে বর্ধমান ও ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯১৭ সালে তিনি সেনাবাহিনীর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে করাচি যান। সেখানেই তাঁর সাহিত্য জীবনের সূচনা ঘটে। তাঁর লেখায় তিনি সামাজিক অবিচার ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। এজন্য তাঁকে ‘বিদ্রোহী কবি’ বলা হয়। বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁর আবির্ভাব এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে কবি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অসুস্থ কবিকে ঢাকায় আনা হয় এবং পরে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানকরা হয়।তাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবি’র মর্যাদার ভূষিত করা হয়। তাঁর রচিত কাব্যগুলোর মধ্যে ‘অগ্নিবীা’, ‘বিশেষ বাঁশি’, ‘ছায়ানট’, ‘প্রলয়-শিখা’, ‘চক্রবাক’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘শিউলিমালা’, ‘মৃত্যু ক্ষুধা’, ‘ইত্যাদি তাঁর রচিত গল্প ও উপন্যাস। ‘যুগ্ম-বাণী’, ‘দুর্দিনের যাত্রী’ ‘রুদ্র্-মঙ্গল’ ও রাজবন্দলি জবানবন্দী’ তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট কবি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ সংলগ্ন প্রাঙ্গণে তাঁকে পরিপূর্ণ সাময়িক মর্যদার সমাহিত করা হয়।
আমার বলিতে দ্বিধা নাই যে, আমি আজচ তাঁহাদেরই দলে, যাঁহারা কর্মী নন ধ্যানী। যাঁহারা মানব জাতির কল্যাণ সাধন করেন সেবা দিয়া, কর্ম দিয়া, তাঁরারা মহৎ যদি না-ই হন, অন্তত ক্ষুদ্র নন। ইহারা থাকেন শক্তির পেচনে রুধির ধারা মতো গোপন , ফুলের মাঝে মাটির মমতা-রসের মতো অলক্ষ্যে।
আমি কবি-বনের পাখির মতো স্বভাব আমার গান করার। কাহারও ভালো লাগিলেও গাই, ভালো না লাগিলেও গাহিয়া যাই। বায়স ভিঙে যখন বেচারা গানের পাখিকে তাড়া করে, তীক্ষ্ণ চঞ্চু দ্বারা আঘাত করে, তখনও সে এক গাছ হইতে উড়িয়া আন গাছে গিয়া গান ধরে। তাহার হাসিতে গান, তাহার কান্নায় গান। সে গান করে আপন মনোর আনন্দে-যদি তাহাতে কাহারও অলস-তন্দ্রা, মোহ-নিন্দ্রা টুটিয়ে যায়, তাহার একান্ত্র গান তারুণ্যের ভরা-ভাদরে যদি আমরা গান জোয়ার অনিয়া থাকে, তাহা আমার আগোচরে; যে চাঁদা সাগরে জোয়ার জাগায়, সে য়হত তাহার শক্তির সম্বন্ধে আজ ও না-ওয়াকিফ।
আমি বক্তাও নহি। আমি কমরবক্তার দলে। বক্তৃতায় যাঁহারা দিগ্বিজয়ী, বক্তিয়ায় খিলজি, তাঁহাদের বাক্যের সৈন্য সামন্ত অত দ্রুতবেগে কোথা হইতে কেমন করিয়া আসে বলিতে পারি না। তাহা দেখিয়া লক্ষ্ণণ সেন আপেক্ষা ও আমার বেশি অভিভূত হইয়া পড়ি। তাঁহাদের বাণী আসে বৃষ্টিধারায় মতো অবিরল ধারায়। আমাদের কবিদের বাণী বহে ক্ষীর্ণ ভীরু ঝরনাধারায় মতো। ছন্দের দুকূল প্রাণপণে আঁকড়িয়া ধরিয়া সে সঙ্গীত গুঞ্জন করিতে করিতে বহিয়া যায়। পদ্মা ভাগীরথীর মতো খরস্রোতা যাঁহাদের বাণী, আমি তাঁহাদের বহু পশ্চাতে। আমার একমাত্র সম্বল-আপনাদের তরুণদের প্রতি আমার অপরিসীম ভালোবাসা, প্রাণের টান। তারুণ্যকে, যৌবনকে, আমি যেদিন হইতে গান গাহিতে শিখিয়াছি, সেদিন হইতে বারে বারে সালাম করিয়াছি, সশ্রদ্ধ নমস্কার নিবেদন করিয়াছি, জবাকুসুমসঙ্ককাশ তরুণ অরুণকে দেখিয়া প্রথম মানব মেযন করিয়া সশ্রদ্ধ নমস্কার করিয়াছিলেন, আমার প্রথম জাগরণ প্রভাবে তেমন সশ্রদ্ধ বিস্ময় লইয়া যৌবনকে অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়াছি, তাহার স্তবগনা গায়িহাছি। তরুণ অরুণের মতোই যে তারুণ্য তিমিরি বিদারী, সে যে আলোর দেবতা। রঙের খেলা খেলিতে খেলিতে তাহার উদয়, রং ছড়াইতে ছড়াইতে তাহার অস্ত। যৌবন সূর্য যথায় অস্তমিত, দুঃখের তিমির কুন্তলা নিশীথিনীর সেই তো লীলভূমি।
আমি যৌবনের পূজারী কবি বলিয়াই যদি আমার আপনারা আপনাদের মালার মধ্যমণি করিয়া থাকেন, তাহা হইলে আমার অভিযোগ করিবার কিছুই নাই। আপনাদের মহাদান আমি সানন্দে শির নত করিয়া গ্রহণ করিলাম। আপনাদের দলপতি হইয়া নয়, আপনাদের দলভুক্ত হইয়া, সহযাত্রী হইয়া। আমাদের দলে কেহ দলপতি নাই, আজ আমরা শত দিক হইতে শত শত তরুণ মিলিয়ে তারুন্যের শতদল ফুটাইয়া তুলিয়াছি। আমার সকলে মিলিয়া এক সিদ্ধি, এক ধ্যানের মৃগাণ ধরিয়া বিকশিত তহইতে চাই।
বার্ধক্য তাহাই-যাহা পুরাতনকে, মিথ্যাকে, মৃত্যুকে আঁকড়িয়া পড়িয়া থাকে, বৃদ্ধ তাহারাই-যাহারা মায়াচ্ছন্ন নব মানবের অভিনব জয় যাত্রার শুধু বোঝা নয়, বিঘ্ন; শতাব্দীর নব যাত্রীর চলার ছন্দে ছন্দ মিলাইয়া যাহারা কুচকাওয়াজ করিতে জানে না, পারে না; যাহারা জীব হইয়াও জড় ; যাহারা্অটল সংস্কারের পাষাণস্তূপ আঁকড়িয়া পড়িয়া আছে। বৃদ্ধ তাহারাই যাহারা নব অরুণোদয় দেখিয়া নিদ্রাভঙ্গের ভয়ে দ্বার রুদ্ধ করিয়া পড়িয়া থাকে। আলোক পিয়াসী প্রাণ চঞ্চল শিশুদের কল কোলাহলে যাহারা বিরক্ত তহইয়া অভিসম্পাত করিতে থাকে জীর্ণ পুঁতি চাপা পড়িয়া যাহাদের নাভিশ্বাস বহিতেছে, অতি জ্ঞানের অগ্নিমান্দ্যে যাহারা আজ কঙ্ককালসার বৃদ্ধ তাহরাই। ইহাদের ধর্মই বার্ধক্য। বার্ধককে সব সময় বয়সের ফ্রেমে বার্ধা যায় না। বহু যুবককে দেখিয়াছি যাহাদের যৌবনের উর্দির নিচে বার্ধক্যের কঙ্কাল মূর্তি। আবার বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি- যাঁহাদের বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের মতো প্রদীপ্ত যৌবন। তরুণ নামের জয়-মুকুট শুধু তাহারই যাহার শক্তি অপরিমাণ, গতিবেগ ঝঞ্ঝার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ় মধ্যাহ্নের মার্তন্ডপ্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, বিরাট যাহার ঔদার্য, অফুরন্ত যাহার প্রাণ, অটল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে। তারুণ্য দেখিয়াছি আরবের বেদুইনদের মাঝে, তারুণ্য দেখিয়াছি মহাসমরে সৈনিকের মুখে, কালাপাহাড়ের অসিতে, কামাল-করিম-মুসোলিনি-সানইয়াৎ লেনিনের শক্তিতে। যৌবন দেখিয়াছি তাহাদের মাঝে- যাহারা বৈমানিকরূপে অনন্ত আকাশের সীমা খুঁজিতে গিয়া প্রাণ হারায়, আবিষ্কারকরূপে নব-পৃথিবীর সন্ধানে গিয়া আর ফিরে না, গৌরীশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষদেশ অধিকার করিতে গিয়া যাহারা তুষার-ঢাকা পড়ে, অতল সমুদ্রের নীল মঞ্জুষার মণি আহরণ করিতে গিয়া সলিলসমাধি লাভ করে, মঙ্গলগ্রহে, চন্দ্রলোকে যাইবার পথ আবিষ্কার করিতে গিয়া নিরুদ্দেশ হইয়া যায়। পবন-গতিকে পশ্চাতে ফেলিয়া যাহারা উড়িয়া যাইতে চায়, নব নব গ্রহ-নক্ষত্রের সন্ধান করিতে করিতে যাহাদের নয়ন-মণি নিভিয়া যায়- যৌবন দেখিয়াছি সেই দুরন্তদের মাঝে। যৌবনের মাতৃরূপ দেখিয়াছি- শব বহন করিয়া যখন সে যায় শ্মশানঘাটে, গোরস্থানে, অনাহারে থাকিয়া যখন সে অন্ন পরিবেশন করে দুর্ভিক্ষ বন্যা-পীড়িতদের মুখে, বন্ধুহীন রোগীর শয্যাপার্শ্বে যখন সে রাত্রির পর রাত্রি জাগিয়া পরিচর্যা করে, যখন সে পথে পথে গান গাহিয়া ভিখারী সাজিয়া দুর্দশাগ্রস্তদের জন্য ভিক্ষা করে, যখন দুর্বলের পাশে বল হইয়া দাঁড়ায়, হতাশের বুকে আশা জাগায়।
ইহাই যৌবন, এই ধর্ম যাহাদের তাহারাই তরুণ। তাহাদের দেশ নাই, জাতি নাই, অন্য ধর্ম নাই। দেশ-কাল-জাতি-ধর্মের সীমার ঊর্ধ্বে ইহাদের সেনানিবাস। আজ আমরা- মুসলিম তরুণেরা- যেন অকুণ্ঠিত চিত্তে মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি- ধর্ম আমাদের ইসলাম, কিন্তু প্রাণের ধর্ম আমাদের তারুণ্য, যৌবন। আমরা সকল দেশের, সকল জাতির, সকল ধর্মের, সকল কালের। আমরা মুরিদ যৌবনের। এই জাতি-ধর্ম-কালকে অতিক্রম করিতে পারিয়াছে যাঁহাদের যৌবন, তাঁহারাই আজ মহামানব, মহাত্মা, মহাবীর। তাহাদিগকে সকল দেশের সকল ধর্মের সকল লোক সমান শ্রদ্ধা করে।
পথ-পার্শ্বের ধর্ম-অট্টালিকা আজ পড় পড় হইয়াছে, তাহাকে ভাঙিয়া ফেলিয়া দেওয়াই আমাদের ধর্ম, ঐ জীর্ণ অট্টালিকা চাপা পড়িয়া বহু মানবের মৃত্যুর কারণ হইতে পারে। যে-ঘর আমাদের আশ্রয় দান করিয়াছে, তাহা যদি সংস্কারাতীত হইয়া আমাদেরই মাথায় পড়িবার উপক্রম করে, তাহাকে ভাঙিয়া নতুন করিয়া গড়িবার দুঃসাহস আছে একা তরুণেরই। খোদার দেওয়া এই পৃথিবীর নিয়ামত হইতে যে নিজেকে বঞ্চিত রাখিল, সে যত মোনাজাতই করুক, খোদা তাহা কবুল করিবেন না। খোদা হাত দিয়াছেন বেহেশত ও বেহেশতি চিজ অর্জন করিয়া লইবার জন্য, ভিখারীর মতো হাত তুলিয়া ভিক্ষা করিবার জন্য নয়। আমাদের পৃথিবী আমরা আমাদের মনের মতো করিয়া গড়িয়া লইব। ইহাই হউক তরুণের সাধনা।
শব্দার্থ ও টীকা
দ্বিধা - সংকোচ, সংশয়, কুণ্ঠা।
রুধির ধারা - রক্ত প্রবাহ।
অলক্ষ্যে - দৃষ্টির অগোচরে।
বায়স - কাক।
বেচারা গানের পাখিকে - কোকিলকে।
চঞ্চু - ঠোঁট।
অলসতন্দ্রা - আলস্য থেকে সৃষ্ট ঘুমের ভাব।
মোহনিন্দ্রা - আসক্তি বা মোহরূপ নিদ্রা, অচেতনতা, জড়তা।
দৈব - আকস্মিক।
পরিক্রমণ - পরিভ্রমণ, প্রদক্ষিণ।
ভরা-ভাদরে - পরিপূর্ণ ভাদ্রে। পরিপূর্ণ অবস্থায়। ভাদ্র মাসে নদীনালা বর্ষার জলে যেমন কানায় কানায় ভরে ওঠে তেমনি।
অগোচরে - অলক্ষে, দৃষ্টির বাইরে।
না-ওয়াকিফ - অনভিজ্ঞ, অজ্ঞাত।
কমবক্তা - অল্পভাষী, যিনি কম কথা বলেন।
বক্তিয়ার খিলজি - মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি ছিলেন ইতিহাসখ্যাত আফগান সেনানায়ক যিনি মাত্র সতেরো জন সৈন্য নিয়ে অতর্কিত আক্রমণে নদীয়া দখল করেন। রাজা লক্ষ্মণ সেন ভয়ে পলায়ন করলে বখতিয়ার খিলজি বাংলাদেশে প্রথম মুসলমান রাজত্ব বিস্তার করেন (১২০৩)। এখানে কৌতুকভরে বক্তৃতাদানকারীকে ‘বক্তিয়ার খিলজি' বলা হয়েছে।
লক্ষ্মণ সেন - বাংলার সেন বংশের শেষ রাজা। অতর্কিত আক্রমণে বখতিয়ার খিলজি মাত্র সতেরো জন সৈন্য নিয়ে রাজধানী দখল করে নিলে রাজা লক্ষ্মণ সেন পেছনের দুয়ার দিয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। এভাবে বাংলায় সেন বংশের পতন এবং মুসলমান রাজত্বের সূচনা হয়।
অভিভূত - ভাবাবেগে বিহবল, ভাবাবিষ্ট।
ছন্দের দুকূল - ভাব ও ভাষা বোঝাতে ব্যবহৃত।
জবাকুসুমসঙ্কাশ - জবাফুলের মতো।
প্রথম জাগরণ-প্রভাতে - সচেতনতার সূচনালগ্নে।
তিমিরবিদারী - অন্ধকার বিদীর্ণ করে যা, সূর্য।
আলোর দেবতা - সূর্য।
তিমিরকুন্তলা - অন্ধকার যার চুল, রাত্রি।
লীলাভূমি - বিচরণস্থান, ক্রীড়াক্ষেত্র।
জীর্ণ পুঁথি চাপা পড়িয়া - সংস্কার ও প্রথাবদ্ধতার চাপে পিষ্ট হয়ে।
নাভিশ্বাস - মৃত্যুকালীন শ্বাসকষ্ট। মরণাপন্ন অবস্থা।
অগ্নিমান্দ্য - খাদ্যদ্রব্য পাকস্থলীতে হজম না হওয়ার রোগ, অজীর্ণতা, ক্ষুধামান্দ্য।
উর্দি - কর্মচারীদের জন্য নির্দিষ্ট বিশেষ পোশাক।
জীর্ণাবরণ - জরাজীর্ণ আচ্ছাদন।
মার্তন্ডপ্রায় - সূর্যের মতো।
কালাপাহাড় - ব্রাহ্মণ থেকে মুসলমানে ধর্মান্তরিত বিখ্যাত মুসলিম যোদ্ধা। সুলেমান ও দায়ুদ কররানির সেনাপতি, ওরফে রাজু। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর প্রচন্ড হিন্দু বিদ্বেষী হন। ১৫৬৮ খ্রিষ্টাব্দে পুরী আক্রমণ করে বহু মন্দির ও দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করেন। ইতিহাসে তিনি বিকট, ভয়ঙ্কর ও প্রলয়ঙ্কর ধ্বংসের প্রতীক হয়ে আছেন।
কামাল - মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক পাশা (১৮৮১-১৯৩৮)। আধুনিক তুরস্কের জনক ও তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি। তাঁর পরিচালনা ও নেতৃত্বে তুরস্ক আসন্ন পতনের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং সত্যিকার উন্নতির পথে অগ্রসর হয়। ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা সবক্ষেত্রেই তিনি আমূল ও বৈপ্লবিক সংস্কার সাধন করেন। আইন-কানুন সংস্কার, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন, নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, পর্দা প্রথার উচ্ছেদ, স্বাধীন অর্থনৈতিক বিকাশ, নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি আধুনিক তুরস্কের ভিত্তি স্থাপন করেন। দেশবাসী কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে তাঁকে ‘আতাতুর্ক' বা ‘তুরস্কের জনক' উপাধিতে ভূষিত করেন।
মুসোলিনী - সিনর বেনিতো মুসোলিনি (১৮৮৩-১৯৪৫) ইতালির একনায়ক এবং সেখানকার ফ্যাসিবাদী দলের নেতা ছিলেন। উগ্র জাত্যাভিমান থেকে তিনি ইতালিকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন। সমগ্র জাতীয় জীবনে কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং আগ্রাসী বৈদেশিক নীতির অনুসারী মুসোলিনি ১৯৩৫ সালে আবিসিনিয়া আক্রমণ করেন। এই ঘটনার সূত্রে ফ্যাসিবাদী হিটলারের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। ১৯৪০ সালে জার্মানির মিত্র হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে ইতালি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। যুদ্ধে ইতালির পরাজয় হলে তিনি পদচ্যুত ও বন্দী হন। পরে মুক্তি পেলেও আততায়ীর হাতে নিহত হন।
সানইয়াত - সান-ইয়াত-সেন (১৮৬৭-১৯২৫) চীনের জননন্দিত বিপ্লবী রাজনীতিবিদ ও নব্য চীনের জন্মদাতা। উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের গোড়ায় চীনের মাঞ্চু সম্রাটদের শাসন-শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু বিপ্লবী আন্দোলন হয়। সান-ইয়াত-সেন এগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯১২ সালের বিপ্লবে মাঞ্চু সাম্রাজ্যের পতন হলে তিনি নানকিং প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ায় তাঁকে নির্বাসনে যেতে হয়। পরে দেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি বিভক্ত চীনের দক্ষিণ চীন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি হন। সাম্যবাদ ও বিপ্লবে সুগভীর আস্থা, চীনের জাতীয় কর্মসূচি প্রণয়ন, মাঞ্চু রাজতন্ত্রের বিরোধিতা এবং সংস্কার নীতির জন্য চীনের ইতিহাসে তাঁর নাম অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।
লেনিন - ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানোফ (১৮৭০-১৯২৪) বিপ্লবী কাজে জড়িত থাকা কালে ‘লেনিন' ছদ্মনাম নেন। তিনি রুশ বিপ্লবের সংগঠক, পরিকল্পক ও নেতা। তাঁর নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের সাফল্যে জারের রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আমৃত্যু তিনি ছিলেন সোভিয়েত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান। ব্যাংক ও সম্পত্তি জাতীয়করণ, দরিদ্র জনগণের মধ্যে ভূমি বণ্টন, গণশিক্ষার প্রসার, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মূল ভিত্তি রচনার মাধ্যমে তিনি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপকার হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি ছিলেন প্রথম সফল মার্কসবাদী বিপ্লবী, মার্কসবাদী দর্শনের প্রথম কাতারের তাত্ত্বিক। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলি ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞান ও বিশ্লেষণ-শক্তির পরিচয়বহ হয়ে আছে।
নীল মঞ্জুষার মণি - সমুদ্রের এক রকম মূল্যবান রত্নপাথর।
যৌবনের মাতৃরূপ - যৌবনের কোমল সেবাপরায়ণ দিক।
মুরিদ - শিষ্য।
সংস্কারাতীত - সংস্কার বা মেরামত করা সম্ভব নয় এমন।
নেয়ামত - ধন-সম্পদ, অনুগ্রহ।
উৎস ও পরিচিতি
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সিরাজগঞ্জে মুসলিম যুব সমাজের অভিনন্দনের উত্তরে তাদের উদ্দেশ্যে কাজী নজরুল ইসলাম যে প্রাণোচ্ছবল ভাষণ দিয়েছিলেন, ‘যৌবনের গান' রচনাটি তারই পরিমার্জিত লিখিত রূপ।
এই অভিভাষণে কবি দুরন্ত-দুর্বার যৌবনের প্রশস্তি উচ্চারণ করেছেন। কারণ যৌবন হচ্ছে অফুরন্ত প্রাণশক্তির আধার। তা মানুষের জীবনকে করে গতিশীল ও প্রত্যাশাময়। দুর্বার উদ্দীপনা, ক্লান্তিহীন উদ্যম, অপরিসীম ঔদার্য, অফুরন্ত প্রাণচঞ্চলতা ও অটল সাধনার প্রতীক যৌবন মৃত্যুকে তুচ্ছ করে সংস্কারের বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন করে সকল বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যায় সমাজ-প্রগতি ও নতুন স্বপ্নময় মুক্তজীবনের পথে। আর বিপন্ন মানবতার পাশে সে দাঁড়ায় সেবাব্রতী ভূমিকা নিয়ে।
পক্ষান্তরে রক্ষণশীলতা, জড়তা, সংস্কারাচ্ছন্নতা ও পশ্চাৎপদতাময় বার্ধক্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় জীবনের প্রাণবন্ত অগ্রগতির পথে। তাই স্বভাব-বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে যে যৌবন দেশ-জাতি-কাল ও ধর্মের বাঁধন মানে না সেই যৌবন-শক্তিকে কবি উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন সমস্ত জীর্ণ পুরনো সংস্কারকে ধ্বংস করে মনের মতো নতুন জগৎ রচনার সাধনায় অগ্রসর হতে।
অনুশীলনমূলক কাজ
ভাষা অনুশীলন q উপমা
কোনো জিনিসের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলার জন্য অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা বা সাদৃশ্য কল্পনা করা হলে তাকে বলা হয় উপমা। সাধারণত উপমা বোঝাতে মতো, ন্যায় ইত্যাদি সাদৃশ্যবাচক শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ‘যৌবনের গান' রচনায় প্রচুর উপমা ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন :
১. ইহারা থাকেন শক্তির পেছনে রুধির ধারার মতো গোপন ফুলের মাঝে মাটির মমতা-রসের মতো অলক্ষে।
২. আমি কবি- বনের পাখির মতো স্বভাব আমার গান করার।
৩. তাঁহাদের বাণী আসে বৃষ্টিধারার মতো অবিরল ধারায়। আমাদের বাণী বহে ক্ষীণ ভীরু ঝরনাধারার মতো।
ছেদ চিহ্ন : সেমিকোলন
সেমিকোলন বা অর্ধচ্ছেদ হচ্ছে বাক্যের মধ্যে ব্যবহৃত এক ধরনের বাক্যান্তর্গত চিহ্ন, যা ব্যবহৃত হয়:
১. একাধিক স্বাধীন বাক্যকে একটি বাক্যে লিখলে সেগুলোর মাঝখানে :
(ক) তিনি শুধু তামাশা দেখিতেছিলেন; কোথাকার জল কোথায় গিয়া পড়ে। (বিলাসী)
(খ) শিক্ষা একেবারেই পুরা হইয়া আছে; এখন শুধু ইংরাজকে কষিয়া গালিগালাজ করিতে পারিলে দেশটা উদ্ধার হইয়া যায়। (বিলাসী)
২. বক্তব্য স্পষ্ট করার জন্য সমজাতীয় বাক্য পাশাপাশি প্রতিস্থাপন করলে :
বৃদ্ধ তাহারাই- যাহারা মায়াচ্ছন্ন নব মানবের অভিনব জয়যাত্রার শুধু বোঝা নয়, বিঘ্ন; শতাব্দীর নব যাত্রীর চলার ছন্দে ছন্দ মিলাইয়া যাহারা কুচকাওয়াজ করিতে জানে না, পারে না; যাহারা জীব হইয়াও জড়; যাহারা অটল সংস্কারের পাষাণ-স্তূপ অাঁকড়িয়া পড়িয়া আছে।
ড্যাশ চিহ্ন
ড্যাশ চিহ্ন প্রধানত বাক্যের মধ্যে এবং নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় :
১. কোনো কথার দৃষ্টান্ত বা বিস্তার বোঝাতে :
(ক) আমার একমাত্র সম্বল- আপনাদের তরুণদের প্রতি আমার অপরিসীম ভালোবাসা, প্রাণের টান।
(খ) বার্ধক্য তাহাই- যাহা পুরাতনকে, মিথ্যাকে, মৃত্যুকে অাঁকড়িয়া পড়িয়া থাকে।
২. বাক্য অসম্পূর্ণ থাকলে বাক্যের শেষে :
(ক) ‘‘বেহাই, আমি তো কিছু বলিতে পারি না। একবার তাহলে বাড়ির মধ্যে- ‘‘(হৈমন্তী)
(খ) বাবা গর্জিয়া উঠিলেন, ‘‘বটে রে-’’ (হৈমন্তী)
৩. গল্পে উপন্যাসে প্রসঙ্গে পরিবর্তন বা ব্যাখ্যায় :
(ক) শিশির- না, এ নামটা আর ব্যবহার করা চলিল না। (হৈমন্তী)
(খ) অ্যাঁ- এ হইল কী, কলি কি সত্যই উল্টাইতে বসিল? (বিলাসী)
৪. নাটক বা গল্প-উপন্যাসে সংলাপের আগে :
(ক) - হ গীত না তর মাথা। (পদ্মনদীর মাঝি)
(খ) -অপরাধ স্বীকার করলে?
-হ্যাঁ। প্রথম অপরাধ। তাই ছেড়ে দিলাম। (সৌদামিনী মালো)
সমাসমবদ্ধ শব্দ
মমতারস, অলসতন্দ্রা, মোহনিদ্রা, সৈন্যসামন্ত, সঙ্গীতগুঞ্জন, ঝরনাধারা, জবাকুসুমসঙ্কাশ, তিমিরবিদারী, যৌবনসূর্য, তিমিরকুমন্তলা, পাষাণস্তূপ, আলোকপিয়াসী, প্রাণচঞ্চল, মেঘলুপ্ত, জয়মুকুট, মার্তন্ডপ্রায়, নবপৃথিবী, সলিলসমাধি।
বানান সতর্কতা
পরিক্রমণ, তারুণ্য, বাণী, অরুণ, মধ্যমণি, মৃণাল, পাষাণ, জীর্ণ, জীর্ণাবরণ, অপরিসীম, নিশীথিনী, লীলাভূমি, পূজারী, পীড়িত, ধ্যানী, তীক্ষ্ণ, ঝরনা, দুর্ভিক্ষ, অগ্নিমান্দা, ঝঞ্ঝা, দ্বিধা।
সমোচ্চারিত শব্দে বানান পার্থক্য
অন্ন -ভাত। পড়-পড় -পড়ন্ত।
অন্য -অপর। পর পর -একের পর এক।
আসা -আগমন। বাণী -কথা, উক্তি।
আশা -প্রত্যাশা, ভরসা। বানি -গয়না তৈরির মজুরি।
বেশি -অনেক। নিচ -নিম্নস্থান, বাড়ির নিম্নতল।
বেশী -বেশধারী। (ছদ্মবেশী) নীচ -হীন, নিকৃষ্ট।
শব -মৃতদেহ। সকল -সব, সমস্ত।
সব -সমস্ত। শকল -মাছের অাঁশ।
দীর্ঘ-উত্তর প্রশ্ন
১. ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধ অনুসরণে যৌবনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
২. ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম তারুণ্য ও বার্ধক্যের মধ্যে যে পার্থক্য দেখিয়েছেন- তার পরিচয় দাও।
৩. ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধের মূল বক্তব্য নিজের ভাষায় লেখ।
বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১. ‘আমি আজ তাঁহাদের দলে, যাঁহারা কর্মী নন- ধ্যানী।’- কর্মী কারা? আর ধ্যানীই বা কারা?
২. কবি নিজের ভূমিকাকে গানের পাখির সঙ্গে সাদৃশ্যমন্ডিত করে দেখেছেন কেন?
৩. ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধ অনুসরণে বার্ধক্যের বৈশিষ্ট্যগুলোর পরিচয় দাও।
৪. ‘বার্ধক্যকে সব সময় বয়সের ফ্রেমে বেঁধে রাখা যায় না’- কথাটার তাৎপর্য বর্ণনা কর। এখানে ‘ফ্রেম’ শব্দটি ব্যবহারের সার্থকতা কী?
৫. ‘যৌবনের মাতৃরূপ’ বলতে লেখক কী বুঝিয়েছেন? এক্ষেত্রে যৌবনের ভূমিকা কী?
৬. ‘ধর্ম আমাদের ইসলাম। কিন্তু প্রাণের ধর্ম আমাদের তারুণ্য, যৌবন।’- কথাটির তাৎপর্য বুঝিয়ে দাও।
৭. সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ :
বক্তিয়ার খিলজি, কামাল পাশা, সানইয়াৎ, লেনিন, বেদুইন।
ভাষাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১. ড্যাশ চিহ্ন কী? এর বিভিন্ন ব্যবহার দেখাও।
২. সেমিকোলন চিহ্নের বিভিন্ন ধরনের প্রয়োগ দেখাও।
৩. নিচের সমাসবদ্ধ শব্দের সমস্যমান পদ নির্দেশ কর।
মোহনিদ্রা, সৈন্যসামন্ত, জবাকুসুমসঙ্কাশ, প্রাণচঞ্চল, মেঘলুপ্ত, মার্তন্ডপ্রায়, সলিলসমাধি।
৪. অর্থ-পার্থক্য দেখিয়ে বাক্য রচনা কর :
অন্ন, অন্য; নিচ, নীচ; শব, সব; বাণী, বানি; পড়-পড়, পর-পর।
৫. প্রমিত চলিত গদ্যে রূপান্তর কর :
(ক) আমার বলিতে দ্বিধা ........................ একান্ত দৈব।
(খ) বার্ধক্য তাহাই .............................. ইহাদের ধর্মই বার্ধক্য।
(গ) তরুণ নামের জয়মুকুট ........................ সেই দুরন্তদের মাঝে।
ব্যাখ্যা
১. তরুণ অরুণের মতোই .................... আলোর দেবতা।
২. যৌবনের সূর্য যেথা ....................... সেই তো লীলাভূমি।
৩. আমরা সকল দেশের ......................... মুরিদ যৌবনের।
৪. আমরা সকলে মিলিয়া ....................... বিকশিত হইতে চাই।