Logo Sponsored by Chowdhury and Hossain, Advanced Publications

Bilashi read



বিলাসী
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

লেখক-পরিচিতি
বাংলা সাহিত্যের
বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক চরৎচন্দ্রের ছেলৈবেলা কাটে দারিদ্রে্যর মধ্যে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বেশি তিনি লেখাপড়া করতে পারেন নি। চবিবম বছর বয়সে মনের ঝোঁকে সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করেছিলেন। সংগীতজ্ঞ হিসেবে খ্যাতির সূত্রে ঘটনাচক্রে এক জমিদারের বন্ধু হয়েছিলেন। জীবিকার তাগিদে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন বর্মা মুল্লুকে।
শরৎচন্দ্র তাঁর জীবনের নানা অভিজ্ঞতা ও বিচিত্র সব মানুষের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর অজস্র উপন্যাসে। বিশেষ করে সমাজের নীচু তরায় মানুষ তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের অপূর্ব মানব-মহিমা নিয়ে চিত্রিত হয়েছে।
শরৎচন্দ্রের প্রথম মুদ্রিত রচনা কুন্তলীন পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘মন্দির’ নামে একটি গল্প। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে : ‘দেবদাস’, ‘পল্লীসমাজ,’,‘শ্রীকান্ত’, ‘গৃহদাহ’, ‘দেনাপাওনা’ ইত্যাদি। এসব উপন্যাসে বাঙালি নারীর প্রতিকৃতি অঙ্কনে তিনি অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাঁর বহু উপন্যাস বারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। তাঁর কয়েকটি উপন্যাস বিদেশি ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে।
তাঁর সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট. ডিগ্রি প্রদান করে।
সরৎচন্দ্রের চন্ম ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম বঙ্গের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে। তাঁর মৃত্যু কলকাতায় ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে।
পাকা দুই ক্রোশ পথ হাঁটিয়ে স্কুলে বিদ্যা অর্জন করিতে যাই। আমি একা নই-দশ-বারোজন। যাহাদেরই বাটী পল্লীগ্রামে, তাহাদেরই ছেলেদের শতকরা আশিজনকে এমনি করিয়া বিদ্যালাভ করিতে হয়। ইহাতে লাভের অঙ্কে শেষ পর্যন্ত একেবারে শূন্য না পড়িলেও, যাহা পড়ে, তাহাতে হিসাব কিরবার পক্ষে এই কয়টা কথা চিন্তা করিয়া দেখিলেই যথেষ্ট হইবে যে, যে ছেলেদের সকাল আটটার মধ্যে বাহির হইয়া যাতায়াতে চার ক্রোশ পথ ভাঙিতে হয়-চার ক্রোশ মানে আট মাইল নয়, ঢের বেশি-বর্ষার দিনে মাথার উপর মেঘের জল পায়ের নিচে এক হাঁটু কাদা এবং গ্রীষ্মের দিনে জলের বদলে কড়া সূর্য এবং কাদার বদলে ধুলার সাগর সাঁতার দিয়া স্কুল-ঘর করিয়ে হয়, সেই দুর্ভাগ্যা বালকদের মা-সরস্বতী খুশি হইয়া বর দিবেন কি, তাহাদের যন্ত্রণা দেখিয়া কোথায় যে তিনি  লুকাইবেন, ভাবিয়া পান না।
তারপরে এই কৃতবিদ্য শিশুর দল বড় হইয়া একদিন গ্রামেই বসুন, আর ক্ষুধার জ্বালায় অন্যত্রই যান তাঁদের চার ক্রোশ হাঁটা বিদ্রঅর তেজ আত্মপ্রকাশ করিবেই করিবে। কেহ কেহ বলেন শুনিয়েছি, আচ্ছঅ, যাঁদের ক্ষুধার জ্বালা, তাঁদের কথা না হয় নাই ধরিলাম কিন্তু যাঁদের সে জ্বালা নাই, তেমন সব ভদ্রলোকই বা কী সুখে গ্রাম ছাড়িয়া পলায়ন করেন? তাঁরা বাস করিতে থাকিলে তো পল্লীর এত দুর্দশা হয় না।
ম্যালেরিয়ার কথাটা না হয় নাই পাড়িলাম। সে থাক, কিন্তু ঐ চার ক্রোশ হাঁটার জ্বালায় কত ভদ্রলোকেই যে ছেলে-পুলে লইয়া ছাড়িয়া শহরে পালান তাহার আর সংখ্যা নাই। তারপরে একদিন ছেলে-পুলে পড়াও শেষ হয়  বটে, তখন কিন্তু শহরের সুখ-সুবিধা রুচি লইয়া আর তাদের গ্রামে ফিরিয়া আসা চলে না।
কিন্তু থাক এ-সকল বাজে কথা। স্কুরে যাই-দু ক্রোশের মধ্যে এমন আরও তো দু তিনখানা গ্রাম পার হইতে হয়। কার বাগানে আম পাকিয়ে শুরু করিয়াছে, কোন বনে বঁইচি ফল অপর্যাপ্ত ফলিয়াছে, কার গাছে কাঁঠাল এই পাকিল বলিয়া, কার মর্তমান রম্ভার কাঁদি কাটিয়া লইবার অপেক্ষা মাত্র, কার কানাচে ঝোপের মধ্যে আনারসের গায়ে রং ধরিয়াছে, কার পুকুরপাড়ের খেজুরমেতি কাটিয়া খাইলে ধরা পড়িবার সম্ভাবনা অল্প, এই সব খবর লইতেই সময় যায়, কিন্তু আসলে যা বিদ্যা-কামস্কাটকার রাজধানীর নাম কী এবং সাইবেরিয়ার খনির মধ্যে রূপা মেলে, না সোনা মেলে-এ সকল দরকারি তথ্য অবগত হইবার ফুরসতই মেলে না।
কাজেই একজামিনের সময় এডেন কী জিজ্ঞাসা করিলে বলি পারশিয়ার বন্দর, আর হুমায়ূনের বাপের নাম জানিতে চাহিলে লিখিয়া দিয়া আসি তোগলক খাঁ এবং আজ চল্লিমের কোঠা পার হইয়াও দেখি, ও সকল বিষয়ৈর ধঅরণা প্রায় একরকমই আছে-তারপরে প্রমোশনের দিন মুখ ভার করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া কখনো বা দল বাঁধিয়া মতলব করি, মাস্টারকে ঠ্যাঙানো উচিত, কখনো বা ঠিক করি, অমন বিশ্রী স্কুল ছাড়িয়া দেওয়াই কর্তব্য।
আমাদের গ্রামের একটি ছেলের সঙ্গে মাঝে মাজেই স্কুলের পথে দেখা ইহত। তাহার নাম ছিল মৃত্যুঞ্জয়। আমাদের চেয়ে সে বয়সে অনেক বড়। থার্ড ক্লাসে পড়িত। কবে সে যে প্রথম থার্ড ক্লাসে উঠিয়াছিল, এ খবর আমার কেহই জানিতাম না- সম্ভাবত তাহা প্রত্নতাত্ত্বিকের গবেষণার বিষয় আমরা কিন্তু তাহার ঐ থার্ড ক্লাসটাই চিরদিন দেখিয়া আসিয়াছি।
তাহার ফোর্থ ক্লাসে পড়ার ইতিহাসও কখনো শুনি নাই, সেকেন্ড ক্লাসে উঠিবার খবরও কখনো পাই নাই। মৃত্যুঞ্জয়ের বাপ-মা, ভাই-বোন কেহই ছিল না, ছিল শুধু গ্রামের এক প্রান্তে একটা প্রকান্ড আম-কাঁঠালের বাগান, আর তার মধ্যে একটা প্রকান্ড পোড়োবাড়ি, আর চিল এক জ্ঞাতি খুড়া। খুড়ার কাজ ছিল ভাইপোর নানাবিধ দুর্নাম রচনা করা সে গাঁজা খায়, সে গুলি খায়, এমনি আরও কত কি! তাঁর আর একটা কাজ ছিল বলিয়া বেড়ানো, ঐ বাগানের অর্ধেকটা তাঁর নিজের অংশ, নালিশ করিয়া দখল করার অপেক্ষা মাত্র। অবশ্য দখল একদিন তিনি পাইয়াছিলেন বটে, কিন্তু সে জেলা-আদালতে নালিশ করিয়া নয়-উপরের আদালতের হুকুমে। কিন্তু সে কথা পরে হইবে।
মৃত্যুঞ্জয়ে নিজে রাঁধিয়া খাইত এবং আমের দিনে ঐ আম-বাগানটা জমা দিয়াই তাহার সারা বৎসরের খাওয়া-পার চলিত এবং ভালো করিয়াই চলিত। যেদিন দেখা হইয়াছে, সেইদিনই দেখিয়াছি ছেঁড়া-খোঁড়া মলিন বইগুলি বগলে করিয়া পথের এক ধার দিয়া নীরবে চলিয়াছে। তাহাকে কখনো কারও সহিত যাচিয়া আলাপ করিতে দেখি নাই-বরহ্চ উপযাচক হইয়া কথা কহিতাম আমরাই। তাহার প্রধান কারণ ছিল এই যে, দোকানোর খাবার কিনিযা খাওয়াইতে গ্রামের মদ্যে তাহার জোড়া ছিল না। আর শুধু ছেলেরাই নয়। কত ছেলের বাপ কতবার যে গোপনে ছেলেকে দিয়া তাহার কাছে স্কুরের মাহিনা হারাইয়া গেছে, বই চুরি গেছে ইত্যাদি বলিয়া টাকা আদায় করিয়া লইত, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু ঋণ স্বীকার করা তো দূরের কথা, ছেলে তাহার সহিত একটা কথা কহিয়াছে, এ কথাও কোনো বাপ ভদ্র সমাজের কবুল করিতে চাহিত না-গ্রামের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়র ছিল এমনি সুনাম।
অনেক দিন মৃত্যুঞ্জয়ের দেখা নাই। একদিন শোনা গেল সে মর-মর। আর একদিন শোনা গেলা, মালোপাড়ার এক বুড়া মালো তাহার চিকিৎসা করিয়া এবং তাহার মেয়ে বিলাসী সেবা করিয়া মৃত্যুঞ্জয়কে যমের মুখ হইতে এ যাত্রা ফিরাইয়া আনিয়াছে।
অনেক দিন তাহার মিষ্টান্নের সদ্ব্যায় করিয়াছি-মনটা কেমন করিতে লাগিল, একদিন সন্ধ্যায় অন্ধকারে লুকাইয়া তাহাকে দেকিতে গেলাম। তাহার পোড়োবাড়িতে প্রাচীরের বালাই নাই। স্বচ্ছন্দে ভিতরের ঢুকিয়া দেখি, ঘরে দরজা খোলা, বেশ উজ্জ্বল একটি প্রদীপ জ্বলিতেছে, আর ঠিক সুমুখেই  তক্তপোষের উপর পরিষ্কার ধবধবে বিছানায় মৃত্যুঞ্জয় শুইয়া আছে, তাহার কঙ্কালসার দেহের প্রতি চাহিলেই বুঝা যায়, বাস্তবিক যমরাজ চেষ্টার ত্রুটি কিছু করেন নাই, তবে যে শেষ পর্যন্ত সুবিধা করিয়া উঠিতে পারেন নাই, সে কেবল ঐ মেয়েটির জোরে। সে সিয়রে বসিয়া পাখার বাতাস করিতেছিল, অকস্মাৎ মানুষ দেখিয়া চমকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। এই সেই বুড়া সাপুড়ের মেয়ে বিলাসী। তাহার বয়স আঠারো কি আঠাশ ঠাহর করিতে পারিলাম না। কিন্তু মুখের প্রতি চাহিবামাত্রই টের পাইলাম, বয়স যাই হোক, খাটিয়া খাটিয়া আর রাত জাগিয়া জাগিয়া ইহার শরীর আর কিছু নাই। ঠিক যেন ফুলদানিতে জল দিয় ভিজাইয়া রাখা বাসি ফুলের মতো। হাত দিয়া এতটুকু স্পর্শ করিলে, এতটুকু নাড়াচাড়া করিতে গেলেই ঝরিয়া পড়িবে।
মৃত্যুঞ্জয় আমাকে চিনিতে পারিয়া বলিল, ‘‘কে, ন্যাড়া?’’
বলিলাম, ‘‘হুঁ।’’
মৃত্যুঞ্জয় কহিল, ‘‘বসো।’’
মেয়েটা ঘার হেঁট করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। মৃত্যুঞ্জয় দুই-চারটি কথায় যাহা কহিল, তাহার মর্ম এই যে, প্রায় দেড়মাস হইতে চলিল সে শয্যাগত। মধ্যে দশ-পনের দিন সে অজ্ঞাত অচৈতন্য অবস্থায় পড়িয়াছিল, এই কয়েকদিন হইল সে লোক চিনিতে পারিতেছে এবং যদিচ এখনো সে বিছানা ছাড়িয়া উঠিতে পারে না, কিন্তু আর ভয় নাই।
ভয় নাই থাকুক। কিন্তু ছেলেমানুষ হইলেও এটা বুঝিলাম, আজও যাহার শয্যাতাগে করিয়া উঠিবার ক্ষমতা হয় নাই, সেই রোগীকে এই বনের মধ্যে একাকী যে মেয়েটি বাঁচাইয়া তুলিবার ভার লইয়াছেন, সে কত বড় গুরুভার। দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি তাহার কত সেবা, কত শুশ্রুষা, কত ধৈর্য, কত রাতজাগা। সে কত বড় সাহাসের কাজ! কিন্তু সে বস্ত্তটি এই অসাধ্য-সাধন করিয়া তুলিয়াছিল তাহার পরিচয় যদিচ সেদিন পাই নাই, কিন্তু আর একদিন পাইয়াছিলাম।
ফিরিয়া সময় মেয়েটি আর একটি প্রদীপ লইয়া আমার আগে আগে ভাঙা প্রাচীরের শেষ পর্যন্ত আসিল। এতক্ষণ পর্যন্ত সে একটি কথাও কহে নাই, এইবার আস্তে আস্তে বলিল, রাস্তা পর্যন্ত তোমার রেখে আসব কি?
বড় বড়ড় আমগাছ সমস্ত বাগানটা যেন একটা জমাট অন্ধকারের মতো বোধ হইতেচিল, পথ দেখা তো দূরের কথা, নিজের হাতটা পর্যন্ত দেখা যায় না। বলিলাম, পৌঁছে দিতে হবে না, শুধু আলোটো দাও।’’
সে প্রদীপটা আমার হাতে দিতেই তাহার উৎকণ্ঠিত মুখের চেহারাটা আমাচচোখে পড়িল। আস্তে আস্তে সে বলিল, ‘‘একলা যেতে ভয় করবে না তো? একটু এগিয়ে দিয়ে আসব?’’
মেয়েমানুষ জিজ্ঞাসা করে, ভয় করবে না তো! সুতরাং মনে যাই থাক, প্রত্যুত্তরে শুধু একটা না’ বলিয়াই অগ্রসর হইয়া গেলাম।
সে পুনরায় কহিল, ‘‘ঘন জঙ্গলের পথ, একটু দেখে পা ফেলে যেয়ো।’’
সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়া উঠিল, কিন্তু এতক্ষণৈ বুঝিলাম, উদ্বেগটা তাহার কিসের জন্য এবং কেন সে আলো দেখাইয়া এই বনের পথ পার করিয়া দিতে চাহিতেছিল। হয়তো সে নিষেধ শুনিত না, সঙ্গেই যাইত, কিন্তু পীড়িত মৃত্যুঞ্জয়কে একাকী ফেলিয়া যাইতেই বোধ করি তাহার শেষ পর্যন্ত মন সরিল না।
কুড়ি-পঁচিশ বিঘার বাগান। সুতরাং পথটা কম নয়।কত এই দারুণ অন্ধকারের মধ্যে প্রত্যেক পদক্ষেপই বোধ করি ভয়ে ভয়ে করিতে হইত, কিন্তু পরক্ষণই মেয়েটির কথাতেই সমস্ত মন এমনি আচ্ছন্ন হইয়া রহিল যে, ভয় পাইবার আর সময় পাইলাম না। কেবল মনে হইতে লাগিল, একটা মৃতকল্প রোগী লইয়া থাকা কত কঠিন। মৃত্যুঞ্জয় তো যে কোনো মুহূর্তেই মরিতে পারিত, তখন সমস্ত রাত্রি এই বনের মধ্যে মেয়েটি একাকী কী করিত। কেমন করিয়া তাহার সে রাতটা কাটিত।
এই প্রসঙ্গের অনেকদিন পরের একটা কথা আমার মনে পড়ে। এক আত্মীয়ের মৃত্যুকালে আমি উপস্থিত ছিলাম। অন্ধকার রাত্রি-বাটীতে ছেলে-পুলে, চাকর-বাকর নাই, ঘরের মধ্যে শুধু তার সদ্যবিধবা স্ত্রী আর আমি। তার স্ত্রী তো শোকের আবেগে দাপাদাপী করিয়া এমন কান্ড করিয়া তুলিলেন যে, ভয় হইল তাহারও প্রাণটা বুঝি বাহির হইয়া যায় বা! কাঁদিয়া কাঁদিয়া বারবার আমাকে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন, তিনি স্বেচ্ছায় যখন সহমরণে যাইতে চাহিতেছেন, তখন সরকারের কী? তাঁর যে আর তিলার্ধ বাঁচিয়া সাধ নাই, এ কি তাহারা বুঝিবে না? তাহাদের ঘককি স্ত্রী নাই? তাহারা কি পাষাণ ? আর এই রাত্রেরই গ্রামের পাঁচজন যদি নদর তীরের কোনো একটা জঙ্গলের মধ্যে তাঁর সহমরণের যোগাড় করিয়া দেয় তো পুলিশের লোক জানিবে কী করিয়া? এমনি কত কি কিন্তু আমার তো আর বসিয়া বসিয়া তাঁর কান্না শুনিলেই চলে না। পাড়ায় খবর দেওয়া চাই- অনেক জিনিস যোগাড় করা চাই। কিন্তু আমার বাহিরে যাইবার  প্রস্তাব শুনিয়াই তিনি প্রকৃতিস্থ হওয়া উঠিলেন। চোখ মুছিয়া বলিলেন, ‘‘ভাই, যা হবার সে তো হইয়াছে, আর বাইরে গিয়া কী হইবে?
বলিলাম, ‘‘অনেক কাজ, না গেলেই যে নয়।’’
তিনি  বলিলেন, ‘‘হোক কাজ, তুমি বসো।’’
বলিলাম, ‘‘বসলে চলবে না, একবার খবর দিতেই হইবে’’, বলিয়া পা বাড়াইবামাত্রেই তিনি চিৎকার করিয়া উঠিলেন, ‘‘ওরে বাপরে। আমি একটা থাকতে পারব না।’’
কাজেই আবার বসিয়া  পড়িতে হইল। কারণ, তখন বুঝিলাম, যে স্বামী জ্যান্ত থাকতে তিনি নির্ভয়ে পঁচিশ বৎসর একাকী ঘরে করিয়াছেন, তাঁর মৃত্যুটা যদি-বা সহে তাঁর মৃতদেহটা এই অন্ধকার রাত্রে পাঁচ মিনিটের জন্যও সহিবে না। বুক যদি কিছুতে ফাটে তো সে এই মৃত স্বামীর কাছে একলা থাকিলে।
কিন্তু দুঃখটা তাহার তুচ্ছ করিয়া দেখানও আমার উদ্দেশ্য নহে। কিংবা তাহা খাঁটি  নয় এ কথা বলার আমার অভিপ্রায় নহে। কিংবা একজনের ব্যবহারেই তাহার চূড়ান্ত মীমাংসা হইয়া গেল তাহারও নহে। কিন্তু এমন  আরও অনেক ঘটনা জানি, যাহার উল্লেখ না করিয়াও আমি এই কথা বলিতে চাই  যে, শুধু কর্তব্যজ্ঞানের জোরে অথবা বহুকাল ধরিয়া একসঙ্গে ঘর করার অধিকারই এই ভয়টাকে কোনো মেয়েমানুষই অতিক্রম করিতে পারে না। ইহা আর একটা শক্তি, যাহা বহু স্বামী-স্ত্রী একশ বৎসর একত্রে ঘর করার পরেও হয়তো তাহার কোনো সন্ধান পায় না।
কিন্তু সহসা সে শক্তির পরিচয় যখন কোনো নরনারীর কাছে পাওয়া যায়, তখন সমাজের আদালতে আসামি করিয়া তাহাদের দন্ড দেওয়ার আবশ্যক যদি হয় তো হোক, কিন্তু মানুষের যে বস্ত্তটটি সামাজিক নয়, সে  নিজে সে ইহাদের দুঃখে গোপন অশ্রু বিসর্জন না করিয়া কোনো মতেই থাকিতে পারে না।
প্রা মাস দুই মৃত্যুঞ্জয়ের খবর লই নাই। যাঁহারা পল্লীগ্রাম দেখেন নাই, কিংবা ওই রেলগাড়ির জানালার মুখ বাড়াইয়া দেখিয়াছেন, তাঁহারা হয়তো সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিবেন, এ কেমন কথা?, এ কি কখনো সম্ভব হইতে পারে যে, অত বড় অসুখটা চোখে দেখিয়া আসিয়াও মাস-দুই আর তার খবরই নাই। তাহাদের অবগতির জন্য বলা আবশ্যক যে, এ শুধু সম্ভব নয়, এই হইয়া থাকে। একজনের বিপদে পাড়াশুদ্ধ ঝাঁক বাঁধিয়া উপুড় হইয়া পড়ে, এই যে একটা জনশ্রুতি আছে, জানি না তাহা সত্যযুগের পল্লীগ্রামে ছিল কি না, কিন্তু একালে তো কোথাও দেখিয়াছি বলিয়া মনে করিতে পারি না। তাবে তাহার মরার খরব যখন পাওয়া যায়  নাই, তখন সে যে বাঁচিয়া আছে এ ঠিক।
এমনি সময়ে হঠাৎ একদিন কানে গেল, মৃত্যুঞ্জয়ের সেই বাগানের অংশীদারে খুড়া তোলপাড় করিয়া বেড়াইতেছেন যে, গেল গেল, গ্রামটা এবার রসাতলে গেল। নালতের মিত্তির বলিয়া সমাজের আর তাঁর মুখ বাহির করিবার যো রহিল না অকালকুস্মান্ডটা একটা সাপুড়ের মেয়ে নিকা করিয়া ঘরে আনিয়াছে। আর শুধু নিকা নয়, তাও না হয় চুলায় যাক, তাহার হাতে ভাত পর্যন্ত খাইতেছে। গ্রামে যদি ইহার শাসন না থাকেক তো বনে গিয়া বাস করিলেই তো হয়।  কোড়েলা, হরিপুরের সমাজ একথা শুনিলে যে-ইত্যাতি ইত্যাদি।
তখন ছেলে বুড়ো সকলের মুখেই ঐ এক কথা-অ্যাঁ এ হইল কী? কলি কি সত্যই উল্টাইতে বসিল।
খুড়া বলিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, এ যে ঘটিবে তিনি অনেক আগেই জানিতেন। তিনি শুধু তামাশা দেখিতেছিলেন, কোথঅকার জল কোথায় গিয়া পড়ে। নইলে পর নয়, প্রতিবেশী নয়, আপনার ভাইপো। তিনি কি বাড়ি লইয়া যাইতে পারিতেন না? তাঁহার কি ডাক্তার-বৈদ্য দেখাইবার ক্ষমতা ছিল না? তবে কেন যে করেন নাই, এখন দেখুন সবাই। কিন্তু আর তো চুপ করিয়া থাকা যায় না। এ যে মিত্তির বংশের নাম ডুবিয়া যায়। গ্রামের যে মুখ পোড়ে।
তখন আমরা গ্রামের লোক মিলিয়া যে কাজটা করিলাম, তাহা মনে করিলে আমি আজও লজ্জায় মরিয়া যাই। খুড়া চলিলেন নালতের মিত্তির বঙশের অভিবাবক হইয়া, আর দশ-বারোজন সঙ্গে চলিলাম গ্রামের বদন দগ্ধ না হয় এইজন্য।
মৃত্যুঞ্জয়ের পোড়োবাড়িতে গিয়া যখন উপস্থিত হইলাম তখন সবেমাত্র সন্ধ্যা হইয়াছে। মেয়েটি ভাঙা বারান্দার একধারে রুটি গড়িতেছিল। অকস্মাৎ লাঠিসোটা হাতে এতগুলি লোককে উঠানোর উপর দেখিয়া ভয়ে নীলবর্ণ হইয়া গেল।
খুড়া ঘরের মধ্যে উঁকি মারিয়া দেখিলেন, মৃতুঞ্জয় শুইয়া আছে। চট করিয়া শিকলটা টানিয়া দিয়া সেই ভয়ে মৃতপ্রায় মেয়েটিকে সম্ভাষণ শুরু করিলেন। বলা বাহুল্য, জগতের কোনো খুড়া কোনো কালে বোধ করি ভাইপোর স্ত্রীকে ওরূপ সম্ভাষণ করে নাই। সে এমনি যে মেয়েটি হীন সাপুড়ের মেয়ে হইয়াও তাহা সহিতে পারিল না, চোখ তুলিলে বলিল, বাবা আমারে বাবুর সাথে নিকা দিয়েছে জানো?
খুড়া বলিলেন, তবে রে! ইত্যাদি ইত্যাদি এবং সঙ্গে সঙ্গেই দশ-বারোজন বীরদর্পে হুংকার দিয়া তাহার ঘাড়ে পড়িল। কেহ ধরিল চুলের মুঠি, কেহ ধরিল কান, কেহ ধরিয় হাত-দুটো এবং যাহাদের সে সুযোগ ঘটিল না তাহারাও নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিল না।
কারণ, সংগ্রামস্থলে আমরা কাপুরুষের ন্যায় চুপ করিয়া থাকিতে পারি,  আমাদের বিরুদ্ধে এত বড় দুর্নাম রটনা করিতে বোধ করি নারায়ণের কর্তৃপক্ষের চক্ষুলজ্জা হইবে।
এইখানে একটা অবান্তর কথা বলিয়া রাখি। শুনিয়াছি নাকি বিলাত প্রভৃতি ম্লেচ্ছাদেশে পুরুষদের মধ্যে একটা কুসংস্কার আছে, স্ত্রীলোক দুর্বল এবং নিরুপায় বলিয়া তাহার গায়ে হাত তুলিতে নাই। এ আবার একটা কী কথা! সনাতন হিন্দু এ কুসংস্কার মানে না। আমরা বলি যাহারই গায়ে জোর নাই, তাহারই গায়ে হাত তুলিতে পারা যায়। তা সে নরনারী যাই হোক না কেন।
মেয়েটি প্রথমেই সেই যা একবার আর্তনাদ করিয়া উঠিয়াছিল, তারপর একেবারে চুপ করিয়া গেল। কিন্তু আমরা যখন তাহাকে গ্রামের বাহিরে রাখিয়া আসিবার জন্য হিঁচড়াইয়া লইয়া চলিলাম, তখন মিনতি করিয়া বলিতে লাগিল, ‘‘বাবুরা, আমাকে একটিবার ছেড়ে দাও আমি রুটি গুলো ঘরে দিয়ে আসি। বাইরে শিয়াল-কুকুরের খেয়ে যাবে রোগা মানুষ সমস্ত রাত খেতে পারে না।’’
মৃত্যুঞ্জয় রুদ্ধ ঘরের মধ্যে পাগলের মতো মাথা কুটিয়ে লাগিল, দ্বারে পদাঘাত করিতে লাগিল এবং শ্রাব্য অশ্রাব্য বহুবিধ ভাষা প্রয়োগ করিতে লাগিল। কিন্তু আমরা তাহাতে তিলার্ধ বিচলিত হইলাম না। স্বদেশের মঙ্গলের জন্য সমস্ত অকাতরে সহ্য করিয়া তাহাকে হিড়মিড় করিয়া টানিয়া লইয়া চলিলাম।
চলিলাম বলিতেছি, কেননা, আমিও বরাবর সঙ্গে ছিলাম, কিন্তু কোথায় আমার মধ্যে একটুখানি দুর্বলতা ছিল, আমি তার গায়ে হাত দিয়া পারি নাই। বরঞ্চ কেমন যেন কান্না পাইতে লাগিল। সে যে অত্যন্ত অন্যায় করিয়াছে এবং তাহাকে গ্রামের বাহির করাই উচিত বটে, কিন্তু্ এটাই যে  আমরা ভালো কাজ করিতেছি সেও কিছুতেই মনে করিতে পারিলাম না। কিন্তু আমার কথা থাক।
আপনারা মনে করিবেন না, পল্লীগ্রামে উদারতার একান্ত অভাব। মোটেই না। বরঞ্চ বড় লোক হইলে আমরা এমন সব ঔদার্য প্রকাশ করি যে, শুনিলে, আপনারা অবাক হইয়া যাইবেন।
এই মৃত্যুঞ্জয়টাই যদি না তাহার হাতে ভাত খাইয়া অমার্জনীয় অপরাধ করিত তাহা হইলে তো আমাদের এত রাগ হইত না। আর কায়েতের ছেলের সঙ্গে সাপুড়ের মেয়ের নিকা-এ তো একটা হাসিয়া উড়াইবার কথা। কিন্তু কাল করিল যে ঐ ভাত খাইয়া। হোক না সে আড়াই মাসের রোগী, হোক না সে শয্যাশায়ী কিন্তু তাই বলিয়অ ভাত! লুচি নয়, সন্দেশ নয়, পাঁঠার মাংস নয়। ভাত খাওয়া যে অন্ন-পাপ। সে তো আর সত্য সত্যই মাপ করা যায় না। তা নইলে পল্লীগাঁয়ের লোক সংকীর্ণচিত্ত নয়। চার ক্রোশ হাঁটা বিদ্যা যেসব  ছেলের পেটে, তারাই তো একদিন বড় হইয়া সমাজের মাথা হয়। দেবী বীণাপাণির বরে সংকীর্ণতা তাহাদের মধ্যে আসিবে কী করিয়া।
এই তো ইহারই কিছুদিন পরে, প্রাতঃস্মরণীয়, স্বর্গীয় মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বিধবা পুত্রবধু, মানের বৈরাগ্যে বছর দুই কাশীবাস করিয়া যখন ফিরিয়া আসিলেন, তখন নিন্দুকেরা কানাকানি করিতে লাগিল যে, অর্ধেক সম্পত্তি ঐ বিধবার এবং পাছে তাহা বেহাত হয় এই ভয়েই ছোটবাবু অনেক চেষ্টা, অনেক পরিশ্রমের পর বৌঠানকে যেখান হইতে ফিরাইয়া আনিয়াছেন, সেটা কাশীই বটে। যাই হোকত, ছোটবাবু তাহার স্বাভাবিক ঔদার্যে গ্রামের বারোয়ারী পূজাবাবদ দুইশত টাকা দান করিয়া কাঁসার গেলাস দিয়া বিদায় করিলেন, তখন ধন্য ধন্য পরিয়া গেল। এমনকি, পথে আসিতে অনেকেই দশের এবং দেশের কল্যাণের নিমিত্ত কামনা করিতে লাগিলেন, এমন সব যারা বড়লোক তাদের বাড়িতে বাড়িতে, মাসে মাসে এমন সদানুষ্ঠানের আয়োজন হয় না কেন?
কিন্তু যাক। মহত্ত্বের কাহিনী আমাদের অনেক আছে। যুগে যুগে সঞ্চিত হইয়া প্রায় প্রত্যেক পল্লীবাসীর দ্বারেই স্তূপাকার হইয়া উঠিয়াছে। এই দক্ষিণ বঙ্গের অনেক পল্লীতে অনেকদিন ঘুরিয়া গৌরব করিবার মতো অনেক বড় বড় ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়াছি। চরিত্রেই বল, ধর্মেই বল, সমাজেই বল, আর বিদ্যাতেই বল, শিক্ষা একবারেই পুরা হইয়া আছে; এখন শুধু   ইংরাজকে কষিয়া গালিগালাজ করিতে পারিলে দেশটা  উদ্ধঅর হইয়া যায়।
বৎসর-খানেক গত হইয়াছে। মশার কামড় আর সহ্য করিতে না পারিয়া সবেমাত্র সন্ন্যাসীগিরিতে ইস্তফা দিয়া ঘরে ফিরিয়াছি। একদিন দুপুরবেলা ক্রোশ দুই দূরের মালোপাড়ায় ভিতর চলিয়াছি, হঠাৎ দেখি, একটা কুটিরের দ্বারে বসিয়া মৃত্যুঞ্জয়। তাহার মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, বড় বড় দাড়ি-চুল, গলায় রুদ্রাক্ষ ও পুঁতির মালা কে বলিবে এ আমাদের সেই মৃত্যুঞ্জয়। কায়স্থের ছেলে একটা বছরের মধ্যেই জাত দিয়া একেবারে পুরাদস্ত্তর সাপুড়ে হইয়া গিয়াছে। মানুষ কত শীঘ্র যে তাহার চৌদ্দ পুরুষের জাতটা বিসর্জন দিয়া আর্কটা জাত হইয়া উঠিতে পারে, সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। ব্রাহ্মণণৈর ছেলৈ মেথরানি বিবাহ করিয়া মেতর হইয়া গেছে এবং তাহাদের ব্যবসা অবলম্বন করিয়াছে, এ বোধ করি আপনারা  সবাই শুনিয়াছেন। আমি সদব্রাহ্মণের ছেলেকে এন্ট্রান্স পাশ করার পরেও ডেমের মেয়ে বিবাহ করিয়া ডোম হইতে দেখিয়াছি। এখন সে ধুচুনি কুলো বুনিয়া বিক্রয় করে, শুয়ার চরায়। ভালো কায়স্থে বিক্রয় করে-তাহাকে দেখিয়া কাহার সাধ্য বলে, কোনো কালে সে কসাই ভিন্ন আর কিছু ছিল। কিন্তু সকলেরই ওই একই হেতু। আমার তাই তো মনে হয়, এমন করিয়া এত সহজে পুরুষকে যাহারা টানিয়া নামাইতে পারে তাহারা কি এমনিই অবলীলাক্রমে তাহাদের ঠেলিয়া উপরে তুলিতে পারে না? যে পল্লীগ্রামের পুরুষদের সুখ্যাতিতে আজ পঞ্চমুখ হইয়া উঠিয়াছি, গৌরবটা কি এটা শুধু তাহাদেরই? শুধু নিজেদের জোরেই এত দ্রুত নিচের দিকে নামিয়ে চলিয়াছে। অন্দরের দিক হইতে কি এতটুকু উৎসাহ, এতটুকু সাহায্য আসে না?
কিন্তু থাক। ঝোঁকের মাথায়, হয়তো বা অনধিকারচর্চা করিয়া বসিত। কিন্তু আমার মুশকিল হইয়াছে যে, আমি কোনোমতেই ভুলিতে পারি না, দেশের নববই জন নরনারীই ঐ পল্লীগ্রামেরই মানুষ এবং সেইজন্য কিছু একটা আমাদের করা চাই-ই। যাক। বলিতেছিলাম যে, দেখিয়া কে বলিবে এ সেই মৃত্যুঞ্জয়। কিন্তু আমাকে সে খ্যাতির করিয়া বসাইল। বিলাসী পুকুরে জল আনিতে গিয়াছিল, আমাকে দেখিয়অ সেও ভারি খুশি হইয়া বার বার বলিতে লাগিল, ‘‘তুমি না আগলালে সে রাত্রিতে আমাকে তারা মেরেই ফেলত। আমার জন্য না জানি কত মার তুমি খেয়েছিলে।’’
কথায় কথায় শুনিলাম,  পরদিনই তাহারা এখানে উঠিয়া ক্রমশ ঘর বাঁধিয়া বাস করিতেছে এবং সুখে আছে। সুখে যে আছে একথা আমাকে বলার প্রয়োজন ছিল না, শুধু তাহাদের মুখের পানে চাহিয়াই আমি তাহা বুঝিয়াছিলাম।
তাই শুনিলাম আজ কোথায় নাকি তাহাদের সাপ ধরার বায়না আছে এবং তাহারা প্রস্ত্তত হইয়াছে, আমিও অমনি সঙ্গে যাইবার জন্য লাফাইয়া উঠিলাম। ছেলেবেলা হইতেই দুটা জিনিসের উপর আমার প্রবল শখ ছিল। এক ছিল খোখরো সাপ ধরিয়া পোষা, আর ছিল মন্ত্র সিদ্ধ  হওয়া।
কিন্তু শক্ত কাজ এবং ভয়ের কারণ আছে বলিয়া প্রথমে তাহারা উভয়ই আপত্তি করিল, কিন্তু আমি এমনি নাছোড়বান্দা হইয়া উঠিলাম যে, মাস খানেকের মধ্যে আমাকে সাগরেদ করিতে মৃত্যুঞ্জয় পথ পাইল না। সাপ ধরার মন্ত্র এবং হিসাব শিখাইয়া দিল এবং কবজিতে ওষুধ সমেত মাদুলি বাঁধিয়া দিয়া দস্ত্তরমতো সাপুড়ে বানাইয়া তুলিল।
মন্ত্রটা কি জানেন? তার শেষটার আমার মনে আছে-
-ওরে কেউটে তুই মনসা বাহন-
মনসা দেবী আমার মা-
ওলটপালট পাতাল-ফোঁড়-
ঢোঁড়ার বিষ তুই নে, তোর বিষ ঢোঁড়ারে দে-
-দুধরাজ, মণিরাজ।
কার আজ্ঞা-বিষহরির আজ্ঞা।
ইহার মানে যে কী তাহা আমি জানি না। কারণ, যিনি এই মন্ত্রের দ্রষ্টা ঋষি ছিলেন-নিশ্চয় কেহ না কেহ ছিলেন-তাঁর সাক্ষাৎ কখনও পাই নাই।
অবশেষে একদিন এই মন্ত্রের সত্য মিথ্যার চরম মীমাংসা হইয়া গেল বটে, কিন্তু যতদিন না হইল ততদিন সাপ ধরার জন্য চতুর্দিকে প্রসিদ্ধ হইয়া গেলাম। সবাই বলাবলি করিতে  লাগিল, হ্যাঁ, ন্যাড়া, একজন গুণী লোক বটে। সন্ন্যাসী অবস্থায় কামাখ্যায় গিয়া সিদ্ধ হইয়া আসিয়াছে। এতটুকু বয়সের মধ্যে এত বড় ওস্তাদ হইয়া অহংকার আমার আর মাটিতে পা পড়ে না, এমনি যো হইল।
বিশ্বাস করিল না শুধু দুই জন। আমার গুরু যে, সে তো ভালো মন্দ কোনো কথাই বলিত না। কিন্তু বিলাসী মাঝে মাঝে মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিত, ‘ঠাকুর, এসব ভয়ংকার জানোয়ার, একটু সাবধানে নাড়াচাড়া কোরো। বস্ত্তত বিষদাঁত ভাঙা, সাপের মুখ হইতে বিষ বাহির করা প্রভৃতি কাজগুলো  এমনি অবহেলার সহিত করিতে শুধু করিয়াছিলাম যে, সেসব মনে পড়িলে আমার আজও গা কাঁপে।
আসলে কথা হইতেছে এই যে, সাপ ধরাও কঠিন নয় এবং ধরা সাপ দুই চারদিন হাঁড়িতে পুরিয়া রাখার পরে তাহার বিষদাঁত ভাঙাই হোক আর নাই হোক, কিছুতেই কামড়াইতে চাহে না। চক্র তুলিয়া কামড়াইবার ভান করে, ভয় দেখায়, কিন্তু কামড়ায় না।
মাঝে মাঝে আমাদের গুরুশিষ্যের সহিত বিলাসী তর্ক করিত। সাপুড়েদের সবচেয়ে লাভের ব্যবসা শিকড় বিক্রি করা, যা দেখাইবামাত্র সাপ পালাইতে পথ পায় না। কিন্তু তার পূর্বে সামান্য একটু কাজ করিতে হইত। যে সাপটা শিকড় দেখিয়ে পালাইবে, তাহার মুখে একটা লোহার শিক পুড়াইয়া বার কয়েক ছ্যাঁকো দিতে হয়। তারপর তাহাকে শিকড়ই দেখান হোক বা একটা কাঠিই দেখান হোক, সে কোথায় পালাইবে তা ভাবিয়া পায় না। এই কাজটার বিরুদ্ধে বিলাসী ভয়ানক আপত্তি করিয়া মৃত্যুঞ্জয়কে বলিত ‘‘দেখ,এমন করে মানুষ ঠকায়ো না।’’
মৃত্যুঞ্জয় কহিত, ‘‘সবাই করে-এতে দোষ কী?’’
বিলাসী বলিত, ‘‘করুক গে সবাই। আমাদের তো খাবার ভাবনা নেই, আমরা কেন মিছামিছি লোক ঠকাতে যাই।’’
আর একটা জিনিস আমি বারবার লক্ষ করিয়াছি। সাপধরার বায়না আসিলেই বিলাসী নানাপ্রকারে বাধা দিবার চেষ্টা করিত-আজ শনিবার, আজ মঙ্গলবার, এমনি কত কি। মৃত্যুঞ্জয় উপস্থিত না থাকিলে সে তো একবারেই ভাগাইয়া দিত, কিন্তু উপস্থিত থাকিলে মৃত্যুঞ্জয়  নগদ টাকার লোভ সামলাইতে পারিত না। আর আমার তো একরকম নেশার মতো হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। নানাপ্রকারে তাহাকে উত্তেজিত করিতে চেষ্টার ত্রুটি করিতাম না। বস্ত্তত ইহার মজা ছাড়া ভয় যে কোথায় ছিল,& এ আমাদের মনেই স্থান পাইত না। কিন্তু এই পাপের দন্ড আমাকে একদিন ভালো করিয়াই দিতে হইল।
সেদিন ক্রোশ-দেড়েক দুরে এক গোয়ালার বাড়িতে সাপ ধরিতে গিয়াছি। বিলাসী বরাবরই সঙ্গে যাইত, আজও সঙ্গে ছিল। মেটে ঘরের মেঝে খুঁড়িতেই একটা গর্তের চিহ্ন পাওয়া গেল। আমরা কেহই লক্ষ করি নাই, কিন্তু বিলাসী সাপুড়ের মেয়ে- সে হেঁট হইয়া কয়েক টুকরা কাগজ তুলিয়া লইয়া আমাকে বলিল, ‘‘ঠাকুর, একটা সাবধানে খুঁড়ো। সাপ একটা নয় একজোড়া তো আছে বটেই হয়তো বা বেশি থাকিতে পারে।’’
মৃত্যুঞ্জয় বলিল, ‘‘এরা যে বলে একটাই এসে ঢুকেছে। একটাই দেখতে পাওয়া গেছে।’’
বিলাসী কাগজ দেখাইয়া কহিল, ‘‘দেখচ না বাসা করেছিল?’
মৃত্যুঞ্জয় কহিল, ‘‘কাগজ তো ইদূরেও আনতে পারে।’’
বিলাসী কহিল, ‘‘দু-ই হতে পারে। কিন্তু দুটো আছে আমি বলছি।’’
বাস্তবিক বিলাসীর কথাই ফলিল এবং মর্মান্তিকভাবেই সেদিন ফলিল। মিনিট-দশেকের মধ্যে একটা প্রকান্ড খরিশ খোখড়ার ধরিয়া ফেলিয়া মৃত্যুঞ্জয়ে আমার হাতে দিল। কিন্তু সেটাকে ঝাঁপির মধ্য পুড়িয়া ফিরিতে না ফিরিতেই মৃত্যুঞ্জয় ‘উঃ’ করিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া বাহিরে আসিয়অ দাঁড়াইল। তাহার হাতের উলটা পিঠ দিয়ে ঝরঝর করিয়া রক্ত পড়িতেছিল।
প্রথমটা যেন সবাই হতবুদ্ধি হইয়া গেলাম্। কারণ সাপ ধরিতে গেলে সে পালাইবার জন্য ব্যাকুল না হইয়া বরঞ্চ গর্ত হইতে একহাত মুখ বাহির করিয়া দর্শন করেন, এমন অভাবনীয় ব্যাপার জীবনে এই একটিবার দেখিয়াছি। পরক্ষণেই বিলাসী চিৎকার করিয়া ছুটিয়া গিয়া অাঁচল দিয়া তাহার হাতটা বাঁধিয়া ফেলিল এবং যত রকমের শিকড় বাকড় সে সঙ্গে আনিয়াছিল সমস্তই তাহাকে চিবাইতে দিল। মৃত্যুঞ্জয়ের নিজের মাদুলি তো ছিলই, তাহার উপরেও আমার মাদুলিটাও খুলিয়ে তাহার হাতে বাঁধিয়া দিলাম। আশা, বিষ ইহার উর্ধ্বে আর উঠিবে না, বরং সেই ‘‘বিষহরির  আজ্ঞা’ মন্ত্রটা সতেজে বারংবার আবৃত্তি করিতে লাগিলাম। চতুর্দিকে ভিড় জমিয়া গেল এবং এ অঞ্চলের মধ্যে যেখানে যত গুণী ব্যক্তি আছেন সকলকে খবর দিবার জন্য দিকে দিকে লোক ছুটিল। বিলাসীর বাপকে সংবাদ দিবার জন্য লোক গেল।
আমার মন্ত্র পড়ার আর বিরাম নাই, কিন্তু ঠিক সুবিধা হইতেছে বলিয়া মনে হইল না। তথাপি আবৃত্তি সমভাবেই চলিতে লাগিল। কিন্তু মিনিট পনের কুড়ি পরেই যখন মৃত্যুঞ্জয় একবার বমি করিয়া দিল, তখন বিলাসী মাটির উপরে একবারে আছাড় খাইয়া পড়িল। আমিও বুঝিলাম, বিষহরির দোহাই বুজি বা আর খাটে না।
নিকটবর্তী আরও দুই চারিজন ওস্তাদ আসিয়া পড়িলেন এবং আমরা কখনও বা একসঙ্গে কখনও আলাদা তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর দোহাই পাড়িতে লাগিলাম। কিন্তু বিষ দোহাই মানিল না, রোগীর অবস্থা ক্রমেই মন্দ হইতে লাগিল। যখন দেখা গেল ভালো কথায় হইবে না, তখন তিন-চারজন ওঝা মিলিয়া বিষকে এমনি অকথ্য অশ্রাব্য গালিগালাজ করিতে লাগিল যে, বিষের কান থাকিলে সে মৃত্যুঞ্জয় তো মৃত্যুঞ্জয়, সেদিন দেশ ছাড়িয়াত পলাইত। কিন্তু কিছুতেই কিছু্ হইল না। আরও আধ ঘণ্টা ধ্বস্তাধ্বস্তির পরে রোগী তাহার বাপ মায়ের দেওয়া মৃত্যুঞ্জয় নাম, তাহার শ্বশরের দেওয়া মন্ত্রৌষধি সমস্ত মিথ্যা প্রতিপন্ন করিয়া ইহলোকের লীলা সাঙ্গ করিল। বিলাসী তাহার স্বামীর মাথাটা কোলে করিয়া বসিয়াছিল, যে যেন একেবারে পাথর ইহয়া গেল।
যাক, তাহার দুঃখের কাহিনীটি আর বাড়ইব না। কেবল এইটুকু বলিয়া শেষ করিব যে, সে সাত দিনের বেশি বাঁচিয়া থাকাটা সহিতে পারিল না। আমারকে শুধু একদিন বলিয়াছিল, ঠাকুর আমার মাথার দিব্যি রইল, এসব তুমি আর কখনও কোরো না।
আমার মাদুলি-কবচ তো মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে কবরে গিয়াছিল, শুধু বিষহরির আজ্ঞা। কিন্তু সে আজ্ঞা যে ম্যাজিস্ট্রেটের আজ্ঞা নহে এবং সাপের বিষ যে বাঙালির বিষয় নয়, তাহা আমিও বুঝিয়াছিলাম।
একদিন গিয়া শুনিলাম, ঘরে তো আর বিষের অবাব ছিল না, বিলাসী আত্মহত্যা করিয়া মরিয়াছে এবং মাস্ত্রমতে সে নিশ্চয় নরকে গিয়াছে। কিন্তু যেখানেই যাক, আমার নিজের যখন যাইবার সময় আসিবে, তখন ওইরূপ কোনো একটা নরকে  যাওয়ার প্রস্তাবে পিছাইয়া দাঁড়াইব না, এইমাত্র বলিতে পারি।
খুড়া মশাই ষোল আনা বাগান দখল করিয়া অত্যন্ত বিজ্ঞের মতো চারিদিকে বলিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, ওর যদি না অপঘাত-মৃত্যু হবে, তো হবে কার? পুরুষমানুষ অমন  একটা ছেড়ে দশটা করুক না, তাতে তো তেমন আসে যায় না- না হয় একটু নিন্দাই হত। কিন্তু হাতে ভাত খেয়ে মরতে গেলি কেন? নিজে মলো, আমার পর্যন্ত মাথা হেঁট করে গেল। না পেলে এক ফোঁটা আগুন, না পেলে একটা পিন্ডি, না হল একটা ভজ্যি উচ্ছুগু্য। গ্রামের লোক একবাক্যে  বলিতে লাগিল, তাহাতে আর সন্দেহ কী? অন্নপাপ। বাপ রে। এর কি আর প্রায়শ্চিত্ত আছে।
বিলাসীর আত্মহত্যার ব্যাপারটা অনেকের কাছে পরিহাসের বিষয় হইল। আমি প্রায় ভাবি, এ অপরাধ হয়তো ইহারা উভয়েই করিয়াছিল, কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় তো পল্লীগ্রামেরই ছেলে, পাড়াগাঁয়ের তেলে-জলের তো মানুষ। তবু অত বড় দুঃসাহসের কাজে প্রবৃত্ত কালিয়াছিল তাহাকে যে বস্ত্তটা সেটা কেহ একবার চোখ মেলিয়া দেখিয়অ পাইল না।
আমার মনে হয়, যে দেশের নরনারীর মধ্যে পরস্পরের হৃদয় জয় করিয়া বিহার করিয়ার রীতি নাই, বরঞ্চ তাহা নিন্দার সামগ্রী, যে দেশে নরনারীর আশা কবিরার সৌভাগ্য, আকাঙ্ক্ষা করিবার ভয়ঙ্কর আনন্দ হইতে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত, যাহাদের জয়ের গর্ব, পরাজয়ের ব্যথা কোনোটাই জীবনে একটিবারও বহন করিতে হয় না, যাহাদের ভুল করিবার দুঃখ, আর ভুল না করিবার আত্মপ্রসাদ, কিছুরই বালাই নাই, যাহাদের প্রচাীন এবং বহুদর্শী বিজ্ঞ সমাজ সর্ব প্রকারের হাঙ্গামা হইতে অত্যন্ত সাবধানে দেশের লোককে তফাৎ করিয়া, আজীবন কেবল ভালোটি হইয়া থাকিবারই ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন, তাই বিবাহ ব্যাপারটা যাহাদের শুধু নিছক Contract তা সে যতই কেননা  বৈদিক মন্ত্র দিয়া  documents পাকা করা  হোক, সে দেশের লোকের সাধ্যই নাই মৃত্যুঞ্জয়ের অন্নপাপের কারণ বোঝে। বিলাসী যাঁহারা  পরিহাস করিয়াছিলেন, তাঁহারা সাধু গৃহস্থ এবং সাধ্বী গৃহিণী অক্ষয় সতীলোক তাঁহারা সবাই পাইবেন, তাও আমি জানি কিন্তু সেই সাপুড়ের মেয়েটি যখন একটি পীড়িত শয্যাগত লোককে তিল তিল করিয়া জয় করিতেছিল, তাহার তখনকার সেই গৌরবের কণামাত্র হয়তো আজিও ইহাদের কেহ চোখে দেখেন নাই। মৃত্যুঞ্জয় হয়তো নিতান্তই একটা তুচ্ছ মানুষ ছিল, কিন্তু তাহার হৃদয় জয় করিয়া দখল করার আনন্দটাও তুচ্ছ নয়, সে সম্পদও অকিঞ্চিৎকর নহে।
এই বস্ত্তটাই এ দেশের লোকের পক্ষে বুঝিয়া উঠা কঠিন। আমি ভূদেববাবুর পারিবারিক প্রবন্ধেরও দোষ দিব না এবং শাস্ত্রীয় তথা সামাজিক বিধি-ব্যবস্থায়ও নিন্দা করিব না। করিলেও মুখের উপর কড়া জবাব দিয়া যাঁহারা বলিবেন, এই হিন্দু সমাজ তাহার নিভুল বিধিব্যবস্থার জোরের অত শতাব্দীর অতগুলো বিপ্লবের মধ্যে বাঁচিয়া আছে, আমি তাঁহাদেরই অতিশয় ভক্তি করি, প্রত্যুত্তরে আমি কখনও বলিব না, টিকিয়া থাকাই চরম সার্থকতা নয়, এবং অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে কিন্তু তেলাপাকা টিকিয়ে আছে। আমি শুধু এই বলিব যে, বড়লোকের নন্দগোপালটির মতো দিবারাত্রি চোখে চোখে এবং কোলে কোলে রাখিলে যে সে বেশটি থাকিবে, তাহাতে কোনোই সন্দেহ নাই, কিন্তু একেবারে তেলাপোকাটির মতো বাঁচাইয়া রাখার চেয়ে এক আধবার কোল হইতে নামাইয়া আরও পাঁচজন মানুষের মতো দু-এক পা হাঁটিতে দিলেই প্রায়শ্চিত্ত করার মতো পাপ হয় না।


শব্দার্থ ও টীকা
মা-সরস্বতী                       -     হিন্দু পুরাণ অনুসারে বিদ্যা ও কলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী, বীণাপাণি, বাণী।
কৃতবিদ্যা                           -     বিদ্যা অর্জন করেছেন এমন পন্ডিত, বিদ্বান।
বঁইচি                                 -     কাঁটাযুক্ত এক রকম ছোট গাছ ও তার ফল।
রম্ভার কাঁদি                         -     কলার ছড়া।
কানাচ                               -     ঘরের পেছন দিককার লাগানো জায়গা।
খেজুর মেতি                        -     খেজুর গাছের মাথার কাছের নরম মিষ্টি অংশ বা রস।
কামস্কাট্কা                         -     প্রকৃত উচ্চারণ কামচাটকা (Kamchatka)। রাশিয়ার অন্তর্গত সাইবেরিয়ার উত্তর পূর্বে অবস্থিত একটি উপদ্বীপ। এর দক্ষিণ-পশ্চিমে ওখটক সাগর ও উত্তর-পূর্বে বেরিং সাগর। উপদ্বীপটি পার্বত্য, তুন্দ্রা ও বনময়। বহু উষ্ণ প্রস্রবণ ও সতেরোটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে এখানে। প্রচুর স্যামন্য মাছ পাওয়া যায় বরে দ্বীপটি স্যামন মাছের দেশ নামে পরিচিত। রাজধানী শহর-পেত্রোপাভলোভস্ক।
সাইবেরিয়া                         -     রাশিয়ার অন্তর্ভূক্ত এশিয়ার উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূভাগ। এশিয়া মহাদেশের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল এর মধ্যে পড়েছে। তুন্দ্রা, সরলবর্গীর বৃক্ষের অরণ্য, স্তেপ তৃণভূমি ও পৃথিবীর গভীরতম হ্রদ ‘‘বৈকাল’’ এখানে অবস্থিত। পৃথিবীর দীর্ঘতম রেলপথ ট্রান্স-সাইবেরিয়ান চালু হওয়ার পর এখানে পর এখানে বহু শহর গড়ে উঠেছে।
এডেন                               -     লোহিতসাগর ও আরব সাগরের প্রবেশপথ আরব দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বিখ্যাত বন্দর। সামুদ্রিক লবণ তৈরির জন্য বিখ্যাত।
পারশিয়া                            -     পারস্য বা ইরান দেশ।
হুমায়ুন                              -     মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের পুত্র এবং দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট। তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের পিতা।
তোগলক খাঁ                        -     ভারতবর্ষের ইতিহাসে তোগলক খাঁ নামে কোনো সম্রাট ছিলেন না। ইতিহাসে যে তিন জন বিখ্যাত তোগলক সম্রাটের নাম পাওয়া যায় তাঁরা হলেন : গিয়াসউদ্দিন তোগলক, মুহাম্মদ তোগলক ও ফিরোজ তোগলক।
চল্লিশের কোঠা                     -     চল্লিশ থেকে উনপঞ্চাশ পর্যন্ত একটি সংখ্যা।
থার্ড ক্লাস                           -     বর্তমান অষ্টম শ্রেণী। সেকালে মাধ্যমিক শিক্ষার শ্রেণী হিসাব করা হত ওপর থেকে নিচের দিকে। দশম শ্রেণীর তখন ছিল ফার্স্ট ক্লাস, নবম শ্রেণীর সেকেন্ড ক্লাস।
প্রত্নতাত্ত্বিক                          -     পুরাতত্ত্বাবিদ, প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, মুদ্রালিপি ইত্যাদি থেকে ঐতিহাসিক তথ্য নির্ণয়ের বিদ্যায় পন্ডিত ব্যক্তি।
ফোর্থ ক্লাস                          -     একনকার সপ্তম শ্রেণী।
সেকেন্ড ক্লাস                       -     এখনাকার নবম শ্রেণী।
গুলি                                  -     আফিমের তৈরি একরকম মাদক  যা বড়ির মতো গুলি পাকিয়ে ব্যবহার করা হয়।
উপরের আদালতে হুকুমে        -     স্রষ্টার নির্দেশে।
এমনি সুনাম                       -     দুর্নাম বোঝাতে বিদ্রুপ করা হয়েছে।
মালো                               -     সাপের ওঝা। অনগ্রসর শ্রেণীবিশেষ। এরা সাপ ধরতে, সাপের কামড়ের চিকিৎসায় ও সাপের খেলা দেখাতে পটু। এসব করে এরা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
সদ্ব্যয় করিয়াছি                    -     অপব্যয় করেছি বোঝাতে ব্যঙ্গভরে বলা হয়েছে।
কঙ্কালসার                         -     অস্থিচর্মসার অবস্থা যেন প্রায় কঙ্কাল।
যমরাজ                             -     মৃত্যু।
যে বস্ত্তটি                           -     যে শক্তি অর্থে ব্যবহৃত।
উৎকণ্ঠিত                           -     উদ্বিগ্ন, ব্যাকুল।
আচ্ছন্ন                               -     অভিভূত।
তিলার্ধ                              -     তিল পরিমাণ সময়ের অর্ধ, মুহূর্তমাত্র।
প্রকৃতিস্থ                             -     স্বাভাবিক।
চূড়ান্ত মীমাংসা                    -     শেষ নিষ্পত্তি।
জনশ্রুতি                             -     হিন্দু পুরাণে বর্ণিত চার যুগের প্রথম যুগ, যখন সমাজ অসত্য অন্যায় একেবারেই চিল না বলে ধারণা।
রসাতলে গেল                      -     অধঃপাতে বা উচ্ছন্নে গেল।
অকালকুম্মান্ড                      -     অসময়ে ফলেছে এমন কুমড়ো, অকর্মণ্য ব্যক্তি।
নিকা                                 -     বিয়ে। এখানে তাচ্ছিল্যসূচক প্রয়োগ।
কলি                                 -     হিন্দু পুরাণে চার যুগের শেষ যুগ। পুরাণ মতে, এ যুগে অন্যায় অসত্য ও অধর্মেল বাড়াবাড়ি ঘটবে।
বদন দগ্ধ না হয়                   -     মুখ যেন না পোড়ে, সুনাম যেন নষ্ট না হয়।
নীল বর্ণ হইয়া গেল               -     বিবর্ণক হয়ে গেল।
বীর দর্পে                            -     বীরত্ব প্রকাশের জন্য তর্জন-গর্জন ও ভাবভঙ্গি করে।
নারায়ণের কর্তৃপক্ষেরওর
চক্ষুলেজ্জা হইবে                  -     কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে একদিকে সর্বভারতীয় রাজারা একপক্ষে নিয়ে যুদ্ধে করেছিলেন। যেখানে শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন নিরস্ত্র রথ সারথি। সেখানে নারায়ণের নিরপেক্ষ আচরণ ছিল কাপুরুষ সুলভ। সেই নারায়ণের পথবলম্বীরাও আমাদের আচরণকে ভীরুতা বলতে লজ্জিত হবে। বাক্যাংশটিতে আসলে ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছে যে-আমাদের আচরণ এতই বর্বর ছিল যে তা কাপুরুষতার চেয়েও লজ্জাজনক ছিল।
বিলাস প্রভৃতি                      -     ইংল্যান্ডসহ ইউরোপীয় দেশসমূহে, যেখানে হিন্দু সমাজের আচার ধর্মের কোনো বালাই নেই।
সনাতন হিন্দু এ কুসংস্কার
মানে না                             -     এখানে হিন্দু ধর্মের সংস্কারাচ্ছান্নতাকে তীব্র ব্যঙ্গ করা হয়েছে। নামে চিরন্তন বা সনাতন  হলে ও হিন্দুধর্ম যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আচারসর্বস্ব, ধর্মীয় খোলস-সর্বস্ব ও সংকীর্ণতাচ্ছন্ন হয়েছে তার স্বরূপ প্রকাশের জন্যেই এই ব্যঙ্গ করা হয়েছে।
শ্রাব্য-অশ্রাব্য                       -     শোনার যোগ্য ও অযোগ্য। এখানে শ্লীল-অশ্লীল।
অমার্জনীয়                          -     ক্ষমার অযোগ্য।
কাল করিল যে ঐ
ভাত খাইয়া                        -     নিচু জাতের মেয়ে বিয়ে করাকে লঘু ও ক্ষমার যোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে আর অমার্জনীয় বলে গণ্য করা হয়েছে নিচু জাতের হাতে ভাত খাওয়াকে।
দেবী বীনাপাণিত বরে
সংকীর্ণতা তাহাদের মধ্যে
আসিবে কী করিয়া                -     এখানে ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছে-দেবী সরস্বতীর প্রকৃত মান্যতার অভাব এরা সঙকীর্ণতাসর্বস্ব হয়ে পড়েছে।
প্রাতঃস্মরণীয়                      -     প্রাতঃকারে স্মরন করার যোগ্য। অর্থাৎ অতি শ্রদ্ধের।
সেটা কাশীই বটে                  -     কাশী ভারতের উত্তরপ্রদেশের অবস্থিত সুবিখ্যাত ও সুপ্রাচীন তীর্থক্ষেত্র। সেখানে সাধু-সন্ত-পুণ্যার্থীর সমাবেশ যেমন হয় তেমনি দুশ্চরিত্র লোকজনের আখড়াও সেখানে জমে। মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বিধবা পুত্রবধুকে যেখান থেকে উদ্ধার করে আনা হয়েছিল তা কাশী হলেও তা যে তীর্থ স্থান ছিল না বরং পতিতালয় বা অনুরূফ কোনো স্থান ছিল এখানে সেই ইঙ্গিতই করা হয়েছে।
বারওয়ারি                          -     অনেকের সমবেত চেষ্টার যা করা হয়, সর্বজনীন। বারোয়ারি।
সদক্ষিণা                            -     পুরোহিতের সম্মানীক বা সেলামি সহকারে।        
ফলাহার                             -     জলযোগ, ফলার।        
ধন্য ধন্য পড়িয়া গেল            -     সকলে প্রশংসার পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন।        
মহত্ত্বের কাহিনী                    -     মহানুভবতার কথা। ব্যঙ্গার্থে নীচতার কাহিনী।
এন্ট্রান্স                               -     প্রবেশিকা পরীক্ষা। বর্তমান মাধ্যমিক পরীক্ষার সমতুল্য।
ধুচুনি                                 -     চাল ইত্যাদি ধোয়ার জন্য বহু ছিদ্র বিশিষ্ট বাঁশের ঝুড়ি।
অবলীলাক্রমে                      -     অনায়াসে।
পঞ্চমুখ                              -     পাঁচ মুখে যে কথা বলে। মুখর।
পল্লীগ্রামের পুরুষদের
সুখ্যাতিতে                          -     ব্য্ঙ্গ করে সুখ্যাতি বলা হয়েছে। বস্ত্তত লেখক গ্রামেরক পুরুষদের সমালোচনা ও নিন্দা করেছেন।
মন্ত্রসিদ্ধ                             -     মন্ত্রের সাধনার সিদ্ধি অর্জন করেছেন এমন। যার উচ্চারিত মন্ত্র অব্যর্থভাবে কার্যকর।
মনসা                                -     হিন্দু ধর্মানুসারে সাপের দেবী        
মন্ত্রের দ্রষ্টা                          -     যিনি প্রথমসন্ত্র লাভ করেন। মন্ত্র সম্পর্কে সাধারণ লোকবিশ্বাস এই যে, মন্ত্র কেউ তৈরি করেন না। তা কোনো ভাগ্যবান দৈববলে পেয়ে থাকেন। যাঁর কাছে প্রথম মন্ত্র আবির্ভূত হয় তিনিই মন্ত্রদ্রষ্টা।
কামাখ্যা                            -     ভারতের আসাম রাজ্যে অবস্থিত প্রাচীন তীর্থস্থান তান্ত্রিক সাধক ও উপসকদের তন্তমন্ত্র সাধনার জন্য বিখ্যাত।
চক্র তুলিয়া                         -     ফণা তুলিয়া।
খরিশ গোখরো                     -     খুব বিষাক্ত এক প্রজাতির গোখরো সাপ।
বিষহরির দোহাই                  -     মন্ত্রশক্তি।
বাপ-মায়ের দেওয়া
মৃত্যুঞ্জয় নাম                       -     মৃত্যুঞ্জয় নামের অর্থ-যিনি মৃত্যুকে জয় করেন। বিসকণ্ঠ মহেশ্বরের অন্য নাম মৃত্যুঞ্জয়। কারণ বিষরূপ মৃত্যু তার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। মৃত্যুঞ্জয়ের বাবা মা তাদের পুত্রের নাম মৃত্যুঞ্জয় রাখলেও সে মৃত্যুকে জয় করতে পারল না। তার নাম মিথ্যা প্রতিপন্ন হল।        
শ্বশরের দেওয়া মন্ত্রৌষধি        -     মৃত্যুঞ্জয় তার শ্বশরের কাছ থেকে অমোঘ মন্ত্রৌষধি পেয়েছিল বলে  জনশ্রুতি ছিল।        
ম্যাজিস্ট্রেটের আজ্ঞা              -     জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা হুকুম, যা পালন করা বাধ্যতামূলক। ম্যাজিস্ট্রেট চলে গেলেও হুকুম বহাল থাকে।
বাঙালির বিষ                      -     বাঙালির ক্রোধ, বিদ্বেষ ইত্যাদি মুখের বাক্যেই সীমাবদ্ধ এবং ক্ষণস্থায়ী। তা সাপের বিষের মতো অব্যর্থভাবে কার্যকর নয়।
অপঘাত মৃত্যু                      -     অস্বাভাবিক মৃত্যু। অপমৃত্যু।
পিন্ডি                                 -     শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে মৃতের উদ্দেশ্যে দের চালের গোলাকার ডেলা।
ভুজ্যি উচ্ছুগু্য                       -     মৃতের আত্মার সদগরি কামনা করে ব্রাহ্মণকে যে ভোজ্য উৎসগ্য করা হয় তা।
আত্মপ্রসাদ                          -     নিজের মনে তৃপ্তি বা আনন্দলাভ।        
বহুদর্শী                              -     জ্ঞানী, অনেক দেখেছেন এমন। বহু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।
ভূদেববাবু                           -     ভূদের চন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৮২৫-১৮৯৪ খ্রিঃ) উনিশ শতকের বাংলা নবরাজগরণের অন্যতম পৃথিকৃৎ। তিনি অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা বিভাগের পরিচালক ছিলেন। হিন্দু সমাজের নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মতামত ব্যক্ত করে আধুনিক মানস গঠনের লক্ষ্যে তিনি অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেন। ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’, ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ ‘আচার প্রবন্ধ’ ইত্যাদি এ বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ। মাইকেল মধুসূদন দত্তের সহপাঠী।
অতিকার হস্তী                      -     মহাগজ, mammoth। হাতির এই প্রজাতির  বর্তমান কালের হাতির চেয়ে অনেকদ বড় ছিল। এই প্রজাতির হাতি প্রাণিজগৎ থেকে লুপ্ত হয়েছেন প্রাগৈতিহাসিক যুগে। তাদের অস্তিত্বের চিহ্ন রয়ে গেছে তাদের কংকালে।
বাগ্ধারা, প্রবাদ ও প্রবচন
লাভের অঙ্কে শূণ্য                -     ফলাফল একেবারে লাভজনক না হয়।        
কাঁটা দেওয়া                        -     বাধা সৃষ্টি করা।
বুক ফাটা                            -     হৃদয়বিদায়ক।
রসাতলে যাওয়া                  -     অধঃপাতে যাওয়া।
অকালকুষ্মান্ড                       -     অকর্মণ্য, অকেজো। পরিবারের অনিষ্টকারী ব্যক্তি।
পঞ্চমুখ                              -     প্রশংসামুখর হওয়া।        
নাছোড়বান্দা                       -     উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মরিয়া হয়ে পিছু লেগে থাকেত এমন লোক।
দোহাই মানা                       -     নজির দেখানো।
পাথর হয়ে যাওয়া                -     স্তন্ধ হয়ে পড়া।
মাথা হেঁট করা                     -     লজ্জায় বা বিনয়ে মাথা নত করা।
উৎস ও পরিচিত
শরৎচন্দ্রের ‘বিলাসী’ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ভারতী’ ১৩২৫ বঙ্গাব্দের (১৯১৮খ্রিঃ) বৈশাখ সংখ্যায়।
‘বিলাসী’ গল্প ‘ন্যাড়া’ নামের এক যুবকের নিজের জবানিতে বিবৃত গল্প। এই গল্পের চরিত্রে শরৎচন্দ্রের ছেলেবেলার  ছায়াপাত ঘটেছে।        
‘বিলাসী’ গল্পে বর্ণিত হয়েছে দুই ব্যতিক্রমধর্মী মানব-মানবীয় চরিত্রের অসাধারন প্রেমের মহিমা যা ছাপিয়ে উঠেছে জাতিগত বিভেদের সংকীর্ণ সীমাকে।
গল্পের প্রধান চরিত্র কর্মনিপূণ, বুদ্ধিমতী ও সেবাব্রতী বিলাসী, শরৎসাহিত্যের অন্যান্য উজ্জ্বল নায়িকাদের মতোই এক জন। যে প্রেমের জন্যে নির্দ্বিধায় বেছে নিয়েছে স্বিচ্ছামৃত্যুর পথ আর তাঁর প্রেমের মহিমাময় আলোয় ধরা পড়েছে অনুদারতা ও রক্ষণশীলতা, সমাজ জীবনের নিষ্ঠুর ও অশুভ চেহারা।
অনুশীলনমূলক কাজ
সাহিত্যবোধ * ছোটগল্প সম্পর্কে লেখা
যে কোনো ছোটগল্প সম্পর্কে লিখতে হলে সেটি বারবার পড়তে হয়। গল্পের প্রথম  পাঠে মূলত রসাস্বাদন হলেও এক্ষেত্রে পরের পাঠগুলো হবে বেশ সতর্ক ও বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক-যাতে গল্পের কাঠামো, কাহিনী, কথকের চরিত্র, বিষয়বস্ত্ত ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা করা যায়।        
কাঠামো ও কাহিনী
গল্পটি কীভাবে গঠিত হয়েছে লক্ষ কর। গল্প একের পর এক যেসব ঘটনা ঘটা তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে গল্পের কাহিনী বা প্লট। বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে সংঘাতের মাধ্যমেই কাহিনী অগ্রসর হয়। সাধারণত গল্পের কাহিনীর একটা সূচনা, মধ্যাংশ ওসমাপ্তির থাকে এবং দ্বন্দ্ব-কাহিনীর গতি সঞ্চারিত, উৎকণ্ঠ প্রখর হয় এবং তারপর একটা চূড়ান্ত মুহুর্তে কাহিনী শেষ হয়। কখনো কখনো কাহিনী শেষ হয় আকস্মিক বিপর্যয়ে, কোনো আনন্দঘন ঘটনায়ও কাহিনী শেষ হতে পারে।
কথক বা বর্ণনাকারীর অবস্থান
লেখক কোন অবস্থান থেকে কাহিনী বলছেন, সেটা অনেক সময় কাহিনী বর্ণনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লেখক সর্বদর্শী অবস্থান থেকেও কাহিনী বর্ণনা করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তিনি সবগুলো চরিত্র ও ছটনা নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বর্ণনা করেন। যেমনটি দেখা যাবে কথাসাহিত্যিক শাহেদ আলীর ‘&একই সমতলে, গল্পে ও মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাস অংশে। পক্ষান্তেরে গল্পটি উত্তমপুরুষে বর্ণিত হতে পারে। এক্ষেত্রে গল্পে আমি, আমাকে ইত্যাদি সর্বনাম এসে যায়। এ রকম  ক্ষেত্রে লেখক নিজেই কাহিনীর একটা চরিত্রের ভূমিকা নেন। আমরা দেখেছি ‘হৈমন্তী’ গল্পে নিয়েছেন গল্পের কথক অপুর ভূমিকা। এ রকম ‘বিলাসী’ গল্পে লেখক কাহিনী বর্ণনা করেছেন ‘ন্যাড়া’র ভূমিকা নিয়ে। উত্তম পুরুষ বর্ণিত এ করম ক্ষেত্রে ততটুকুই দেখতে ও জানতে পারেন যতটা বর্ণনাকারী দেখাতে ও জানাতে পারেন।        
গল্পে উত্তমপুরুস বর্ণনাকারীর ভূমিকা প্রধানত পর্যবেক্ষণের । তাই সাধারণত সেটি কাহিনীর মূল বা প্রধানত চরিত্র হয় না। কথক বা বর্ণনকারীর অবস্থানগত ভূমিকা বোঝার জন্য ভেবের দেখ : ‘‘হৈমন্তী’’ গল্পটি যদি অপুর জবানিতে না হয়ে হৈমন্তীর জবানিতে হত এবং ‘বিলাসী’ ন্যাড়ার জবানিতে না হয়ে যদি বিলাসীর জবানিতে বর্ণিত হয় তবে তা কতটা সার্থক হত।        
প্রসঙ্গ স্মরণীয়, কোনো কোনো গল্পে বর্ণনাকারী উত্তম পুরুষ তার নিজ জীবনের কাহিনীরই বিবরণ দেয়।
পটভূমি বা পারিপার্শ্বিকতা        
গল্পের ক্ষেত্রে পটভূমি বিবেচনাও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ‘হৈমন্তী’ গল্পটির পটভূমিতে রয়েছে কেবল একটি পারিবারিক পরিমন্ডল। পক্ষান্তরে ‘বিলাসী’ গল্পের পটভূমিতে রয়েছে এই শতকের প্রথম  দিককার পল্লীগ্রামের হিন্দুসমাজ। ছোটগল্পের পটভূমির গুরুত্ব বুঝতে হলে তুমি একটা ভাববে ; ঘটনাগুলো কি অন্য কোথাও ঘটতে পারত? গল্পে বর্ণিত স্থানিক ও কালিক পটভূমি গল্পটিতে কী প্রভাব ফেলেছে? স্থানিক ও কালিক পটভুমি কি গল্পটির অপরিহার্য অংশ? না কি   তাকে বাদ দিলে গল্পের ক্ষতি হয়? গল্পের বিষয়বস্ত্ত তও তাৎপর্য বোঝার ক্ষেত্রে স্থানিক ও কালিন পটভূমি কি একেবারেই গুরুত্বহীন?
চরিত্র
গল্প পাঠের সময় গল্পের চরিত্র বোঝার ক্ষেত্রে চরিত্রের সংলাপ ভালোভাবে খেয়াল করবে। কারণ চরিত্র সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা তৈরি হয় চরিত্র যে ধরনের কথাবার্তা বলে তা মাধ্যমে। এর পর  দেখতে  হবে ঐ চরিত্র সম্পর্কে গল্পের অন্যান্য চরিত্র কী বলে?  এছাড়া কোন চরিত্র কোন ঘটনার কোন ধরনের আচরণ করে তার মাধ্যমেও চরিত্র সম্পর্কে আমাদের ধারণা হয়। এছাড়াও লেখক প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে চরিত্রের ভাবনাচিন্তা এবং অতীত আচরণ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকেন। চরিত্র বোঝার ক্ষেত্রে তাও বেশ সহায়ক হয়।
গল্প বোঝার জন্যে সাধারণ কিছু প্রশ্ন        
কোনো গল্প সম্পর্কে লেখার জন্য কিছু আত্মজিজ্ঞাসামূলক সাধারণ প্রশ্নে জবাব খোঁজা অনেক ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। যেমন :
১.      প্রধান চরিত্র কোনটি? কাহিনীর অগ্রসর হলে ঐ চরিত্রের কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায় কি? সে কোন ধরনের লোক? তার জন্যে কি তোমার সহানুভূতির জাগে? কেন?
২.      গল্পের কাহিনী কীভাবে বিন্যস্ত হয়েছে?
৩.      গল্পে কি কোথাও চমক সৃষ্টি করা হয়েছে? সেটি কী? আগে কি সে সম্পর্কে কোনো আভাস পাওয়া যায়?
৪.      গল্পের কালিক ও স্থানিক পটভূমি কী? গল্পে এগুলোর কতটা গুরুত্বপূর্ণ। অন্য কোনো কালে বা সময়ে গল্পের কাহিনীকে কি বিন্যস্ত করা চলে?
৫.      গল্পের কথক বা বর্ণনাকারী কে? গল্পটি উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা কতটুকু? গল্পটি যদি অন্য কোনো চরিত্রের জবানিতে বলা হয় তাতে গল্পটি কি আরও সমৃদ্ধ হবে না আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
৬.      গল্পের নামকরণ সামগ্রিক বিচারে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ বা সার্থক?        
৭.      এই গল্পের মূল বিষয়বস্ত্ত কী?
ভাষা অনুশীলন
নেতিবাচক বাক্যকে প্রশ্নবাচক বাক্যে রূপান্তর :
নেতিবাচক বাক্যকে প্রশ্নবাচক বাক্যে রূপান্তর করতে হলে-
         (ক) কি, কী ইত্যাদি প্রশ্ববোধক সর্বনাম বা ক্রিয়া বিশেষণ যোগ করতে হয়।
         (খ) নেতিবাচক বাক্যের ‘না’ সূচক পদটি বাদ দিতে হয়। এবং        
         (গ) বাক্যের শেষে প্রশ্ন চিহ্ন বসাতে হয়  যেমন :
         নেতিবাচক                :        তাদের গ্রামে ফিরিয়া আসা চলে না।
         প্রশ্নবাচক                  :        তাদের গ্রামের ফিরিয়া আসা  চলে কি।
         নেতিবাচক                :        এ খবর আমরা কেহই জানিতান না।
         প্রশ্নবাচক                  :        এ খবরচ আমাদের কেহই কি জানিত?
         নেতিবাচক                :        মানুষটা সমস্ত রাত খেতে পাবে না।
         প্রশ্নবাচক                  :        মানুষটা সমস্ত রাত খেতে পাবে কি?
প্রশ্নবাচক বাক্যকে অস্তিবাচক বাক্যে রূপান্তর :
এ ক্ষেত্রে প্রশ্নবাচক বাক্য থেকে (ক) প্রশ্নবাচক (খ) প্রশ্নচিহ্ন বাদ দিতে হয়। সেই সঙ্গে (গ) প্রশ্ন করছি’, ‘জিজ্ঞাসা করছি’, ‘জানতে চাই’, ‘মনে হচ্ছে’,  ইত্যাদি ক্রিয়াপদ প্রয়োজন ও সুবিধামতো  ব্যবহার করতে হয়।
(ঘ)     স্বগত প্রশ্নে ‘জানি না’ ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা চলে। যেমন :        
         প্রশ্নবাচক                  :        তেমন সব ভদ্রলোক বা কী সুখে গ্রাম ছাড়িয়া পলায়ন করেন?
         অস্তিবাচক                 :        তেমন সব ভদ্রলোক বা কী সুখে গ্রাম ছাড়িয়া পলায়ন করেন জানি না।
         প্রশ্নবাচক                  :        কামস্কাটকার রাজধানীর নাম কী?
         অস্তিবাচক                 :        কামস্কাটকার রাজধানীর নাম কী তা জানতে চাই।
         প্রশ্নবাচক                  :        একলা যেতে ভয় করবে না তো?
         অস্তিবাচক                 :        একলা যেতে ভয় করবে কি না জানতে চাই।
প্রশ্নবাচক বাক্যকে নেতিবাজক বাক্যে রূপান্তর :
এ ক্ষেত্রে সাধারণত প্রশ্নবাচক বাক্য থেকে (ক)  প্রশ্নবাচক অব্যয় বা ক্রিয়া বিশেসন (কি, কী ইত্যাদি) (খ) প্রশ্নচিহ্ন বাদ দিতে এবং নেতিবাচক শব্দ (না, নয় ইত্যাদি) ও বাক্যের শেষে (গ) দাঁড়ি বসাতে হয়।
         প্রশ্নবাচক                  :        পুলিশের লোক জানিবে কী করিয়া?
         নেতিবাচক                :        পুলিশের লোক জানিবে না।
         প্রশ্নবাচক                  :        তাহারা কি পাষাণ?
         নেতিবাচক                :        তাহারা পাষাণ নয়।        
         প্রশ্নবাচক                  :        এতে দোষ কী?
         নেতিবাচক                :        এতে দোষ নেই।        
দীর্ঘ-উত্তর প্রশ্ন
১.      ‘বিলাসী’ গল্পে বিলাসীর যে বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে তা গুছিয়ে লেখ।
২.      ‘বিলাসী’ গল্পের পটভূমিতে সেকালের সমাজ-বাস্তবতার যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তার পরিচয় দাও।
৩.      ‘বিলাসী’ গল্পের নামকরণ সামগ্রিকভাবে কতটা সার্থক-আলোচনা কর।
বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১.      মা সরস্বতী খুশি হইয়া বর দিবেন কি, তাহাদের যন্ত্রণা দেখিয়া কোথায় যে তিনি লুকাইবেন, ভাবিয়া পানান-কোন প্রসঙ্গে কেন একথা বলা হয়েছে।        
২.      ‘গ্রামের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়ের ছিল এমনি সুনাম’- ন্যাড়ার এই মন্তব্যের কারন কী? ‘সুনাম’ কথাটা এখানে কোন বিশেষ অর্তে ব্যবহৃত হয়েছে?
৩.      অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতে গিয়ে ন্যাড়া যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তা বর্ণনা কর।
৪.      ‘ওরে বাপরে! আমি একলা থাকতে পারব না।’ যে ঘটনার প্রেক্ষাপটে বক্তা এই উক্তি করেছিলেন তা বর্ণনা কর। ‘বিলাসী’ গল্পের কোন দিকটা ফুটিয়ে তুলতে লেখক এ ঘটনাটি ব্যবহার করেছেন?
৫.      ‘বিলাসী’ গল্পে কে কাকে এবং কেন অন্নপাপের জন্য দায়ী করেছে?
৬.      মৃত্যুঞ্জয়ের ‘অন্নপাপ’ সম্পর্কে খুড়ার মতামত এবং গল্প কথক ন্যাড়ার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি? তোমার মতের পক্ষে যুক্তি দাও।
৭.      মৃত্যুঞ্জয় জাত বিসর্জন দিয়ে সাপুড়ে হওয়াতে গল্পকথক ন্যাড়া ঘটনাটিকে কীভাবে মুল্যায়ন করেছেন?
৮.      মৃত্যুঞ্জয়ের সাপুড়ে জীবনের যে পরিচয় পাওয়া যায় সংক্ষেপে তা বর্ণনা কর।        
৯.      বিলাসী কেন আত্মহত্যা করল? এই আত্মহত্যাকে রক্ষণশীল সমাজ কী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছে? তাঁর সঙ্গে গল্পকথকের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য কী? তুমি নিজে কোন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ কর?
ভাষাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১.      নিচের অংশটুকু অস্তিবাচক বাক্যে রূপান্তর কর :
         তিনি স্বেচ্ছায় যখন সহমরণে যাইতে চাহিতেছেন, তখন সরকারের কী? তাঁর যে তিলার্ধ বাঁচিতে সাধ নাই এ কি তাহারা বুঝিবে না? তাহাদের ঘরে কি স্ত্রী নাই? তাহারা কি পাষাণ?
২.      নিচের নেতিবাচক বাক্যগুলোকে প্রশ্নবাচক বাক্যে রূপান্তর কর :
         ক) সরস্বতী বর দেবেন না।
         খ) তাদের সে জ্বালা নাই।        
         গ) তাহার ফোর্থ ক্লাসে পড়ার ইতিহাস কখনো শুনি নাই।
         ঘ) একথা কোনো বাপ ভদ্রসমাজে কবুল করিত  চাহিতনা।
         ঙ) অনেক দিন মৃত্যুঞ্জয়ের দেখা নাই।
৩.      শিষ্ট চলিত ভাষায় রূপান্তর কর :
         ক) তারপর এই কৃতবিদ্যা..........................দুর্দশা হয় না।
         খ) তার ফোর্থ ক্লাসে..........................আদালতের হুকুমে।
         গ) স্বচ্ছন্দে ভিতরে ঢুকিয়ে......................ঝরিয়া পড়িবে।
         ঘ) এমনি সময় হঠাৎ........................ইত্যাদি ইত্যাদি।
         ঙ) বিশ্বাস করি না........................আজও গা কাঁপে।
         চ) মাঝে মাঝে আমাদের গুরু....................মানুষ ঠকায়ো না।
ব্যাখ্যা
১.      ঠিক যেন ফুলদানিতে...........................ঝড়িয়ে পড়িবে।
২.      কিন্তু যে বস্ত্তটি এই অসাধ্য.........................আর একদিন পাইয়াছিলাম। 
৩.      আমার বলি, যাহারই গায়ে.........................পারা যায়।         
৪.      তাহার হৃদয় জয় করিয়া........................সে সম্পদও অকিঞ্চিৎকর নয়।  
৫.      টিকিয়া থাকা চরম...........................টিকিয়া আছে।   



View Foundation Digital Talking Library is developed and maintained by Sigma Enterprise.
Theme designed by Imtiaz
All rights are reserved. Any kind of reproduction of any mp3 files and text files is prohibited. If any organization or any person is found copying or reproducing any of the material will be punished under copy right law.