Logo Sponsored by Chowdhury and Hossain, Advanced Publications

Somaj Kollan Second Part Second B Chapter

পৃষ্ঠা ৪৯
জনসংখ্যা বিস্ফোরণ
পৃথিবীর জনসংখ্যা বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের জনসংখ্যা ১৯৫০ সালের পর দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেয়ে এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করে, জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উন্নয়নশীল দেশেগুলোতে মৃত্যুহার লক্ষণীয়ভাবে কমতে থাকে। জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন ও টীকাদান অভিযানের ফলে বিভিন্ন ব্যাধি নিয়ন্ত্রিত এবং শিশু মৃত্যুর হার স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। যদিও উন্নত দেশগুলোতে মৃত্যুর হার এরূপ হ্রাস পেতে কয়েক শতাব্দী সময় লেগেছিল। উন্নত দেশে জন্ম ও মৃত্যুর হার উভয় ক্ষেত্রে হ্রাস পেয়েছে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
১৯৬০ এর দশকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মহিলাদের গড়ে ছয়টি করে সন্তান হতো। এ সময় গড় আয়ু অভূতপূর্ব হারে বৃদ্ধি পায়। জন্ম নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি উন্নয়নশীল দেশে তেমন প্রসার লাভ না করায় জন্মহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৬০ সালের পর থেকে বিশ্বের জনসংখ্যা সবচেয়ে দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এসময় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল শতকরা ২.৫ ভাগ হারে। যার প্রভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনসংখ্যা বিশ্বের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশে পৌঁছে। এমতাবস্থায় জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক ধারণা দেয়ার জন্য জনসংখ্যা বিস্ফোরণ প্রত্যয় ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে ১৯৬৮ সালে পল এলরিখের ক্লাসিক্যাল গ্রন্থ পপিউলেশন ব্‌ম প্রকাশিত হবার পর জনসংখ্যা বিস্ফোরণ সম্পর্কে চিন্তাবিদগণ হুঁশিয়ার ও সচেতন হয়ে ওঠেন। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ দ্বারা স্বল্প সময়ের মধ্যে অস্বাভাবিক গতিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে নির্দেশ করে।
বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) প্রকাশিত বিশ্ব জনসংখ্যা-১৯৯৮ রিপোর্টের তথ্যানুযায়ী ১৯৯৮ সালে জনসংখ্যা ৫শ ৯০ কোটি, যা ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে ৬শ কোটিতে উপনীত হয়েছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় বিশ্বে প্রতিবছর আট কোটি লোক বর্তমান জনসংখ্যার সঙ্গে যোগ হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বিশ্বজনসংখ্যা তহবিল ১৯৯৯ সালের ১৬ জুন ‘‘ছয় বিলিয়ন দিবস’’ হিসেবে উদযাপন করে। অন্যদিকে গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৯৯৯ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের লোক গণনা ব্যুরোর রিপোর্টের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের জনসংখ্যা ৬শ কোটি। ২০২৬ সাল নাগাদ তা ৮শ কোটিতে পৌঁছাবে। ২০৫০ সালে তা ৯শ ৩০ কোটিতে দাঁড়াবে। রিপোর্টে বলা হয় অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশে জনসংখ্যা ১২০ কোটিতে অপরিবর্তিত থাকবে। অন্যদিকে, স্বল্পোন্নত দেশে ৪শ ৮০ কোটি হতে বৃদ্ধি পেয়ে ৭শ ৮০ কোটি হবে বলে ধারণা করা হয়েছে। শুধু ভারতেই আগামী পাঁচ দশকে জনসংখ্যা ১৫৩ কোটিতে পৌঁছে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশে পরিণত হবে।[1]
জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক হার এবং দ্বিগুণ হবার সময়
বার্ষিক বৃদ্ধির হার
দ্বিগুণ হবার সময়
১.০
৭০ বছর
২.০
৩৫ বছর
৩.০
২৪ বছর
৪.০
১৭ বছর
                 
বিশ্ব জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করলে দেখা যায়, জনসংখ্যা একশত কোটিতে পৌঁছাতে মানব ইতিহাসের প্রথম আঠারশত বছর লেগেছে । ১৮০৪ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা এক’শ কোটি ছাড়িয়ে যায়। এর পর জনসংখ্যা দু’শ কোটিতে পৌঁছতে প্রায় ১২৩ বছর অর্থাৎ ১৯২৭ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা দু’শ কোটিতে পৌঁছে। এর তিন দশক পর ১৯৬০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা তিনশ কোটিতে পৌঁছে। এরপর অতিদ্রুত মাত্র চৌদ্দ বছর পর ১৯৭৪ সালে জনসংখ্যা দাঁড়ায় চারশ কোটিতে। মাত্র তের বছর পর ১৯৮৭ সালে জনসংখ্যা পাঁচ’শ কোটিতে পৌঁছে। আর বার বছর পর ১৯৯৯ সালে তা পৌঁছে ছয়শ কোটিতে। ১৯৬০ সালের পর প্রতি ১২-১৪ বছরের ব্যবধানে একশত কোটি করে বৃদ্ধি পায়। যার প্রভাবে বিগত পঞ্চাশ বছরে দ্বিগুণের বেশি হয়। নিচের টেবিলে বিশ্ব জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির হার দেখানো হলো।







পৃষ্ঠা ৫০

বিশ্ব জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবার সময়কাল
সন
প্রাককলিত বিশ্ব জনসংখ্যা
জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবার প্রয়োজনীয় সময়
৮০০০ বিসি
৫ মিলিয়ন

১৬৫০ এসি
৫০০ মিলিয়ন
১,৫০০ বছর
১৮৫০
এক বিলিয়ন
২০০ বছর
১৯৩০
দু’বিলিয়ন
৮০ বছর
১৯৭৫
চার বিলিয়ন
৪৫ বছর
১৯৯৯
ছয় বিলিয়ন
২৪ বছর দুই বিলিয়ন বৃদ্ধি
সার্কভূক্ত দেশগুলোর জনমিতিক তথ্যাবলী (২০০৮)
 দেশ
জনসংখ্যা (মিলিয়ন)
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার
মাতৃম্যুতু হার (প্রতি হাজারে জীবিত জন্ম)
শিশু মুত্যু হার (প্রতি হাজারে জীবিত জন্ম)
আফগানিস্তান
২৮.২
৩.৯
১.৮
১৫৬
ভারত
১১৮৬.২
১.৫
৪.৫
৫৪
পাকিস্তান
১৬৭.০
১.৮
৩.২
৬৭
শ্রীলংকা
১৯.৪
০.৫
০.৫৮
১১
নেপাল
২৮.৮
২.০
৮.৩
৫৩
মালদ্বীপ
০.৩১
-
১.২০
৩৩
ভূটান
০.৭
১.৪
৪.৪
৪৪
বাংলাদেশ
১৪৪.৫
১.৩৯
৩.৫৬
৬২
 উদ্বৃক্তঃ জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল
বাংলাদেশের জনসংখ্যা পরিস্থিতি
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনসংখ্যাবহুল দেশ। জনসংখ্যার দিক হতে বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম এবং এশিয়ার পঞ্চম জনসংখ্যাধিক্য দেশ। ১৯৯১ সালের লোকশুমারির তথ্যানুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ১১ কোটি ১৪ লাখ। এ সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধির শতকরা হার ছিল ২.১৭ ভাগ। ২০০১ সালের লোকশুমারীর তথ্যানুযায়ী জনসংখ্যা ছিল ১৩০.০৩ মিলিয়ন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১.৪৭ ভাগ। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১৯৯১ সালে ছিল ৭৫৫ জনের মত। গত এক দশকে জনসংখ্যার ঘনত্ব শতকরা ২৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০১ সালের শুমারীর তথ্যানুযায়ী প্রতি কিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ৮৩৪ জন। ২০০৯-১০ সালে প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ১৪.৬১ কোটি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩২ ভাগ। এ সময় জনসংখ্যার ঘনত্ব ৯৯০ জন (প্রক্ষেপিত)।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি
বাংলাদেশে ১৬৫০ সালে জনসংখ্যা ছিল এক কোটি। দীর্ঘ ২১১ বছর পর জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে ১৮৬১ সালে দু’কোটিতে উপনীত হয়পরবর্তী ৪০ বছরে এদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে তিন কোটিতে পৌঁছে। ১৯২১ সালের পর এদেশের জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিভিন্ন আদমশুমারির আলোকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি সারণীতে দেখানো হলো








পৃষ্ঠা ৫১

বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি (১৯০১-২০০১)
আদমশুমারীর সন
মোট জনসংখ্যা
পার্থক্যের সংখ্যা
পার্থক্যের শতকরা হার
বৃদ্ধির শতকরা হার
১৯০১-মার্চ ১
২,৮৯,২৭,৭৮৬



১৯১১-মার্চ ১০
৩,১৫,৫৫,০৫৬
২৬,২৭,২৭০
৯.০৮
০.৮৭
১৯২১-মার্চ ১৮
৩,৩২,৫৪,০৯৬
১৬,৯৯,০৪০
৫.৩৮
০.৫২
১৯৩১-ফেব্রুয়ারি ২৬
৩,৫৬,০৪,১৭০
২৩,৫০,০৭৪
৭.০৭
০.৬৮
১৯৪১-মার্চ ১
৪,১৯,৯৭,২৯৭
৬৩,৯৩,১২৭
১৭.৯৬
১.৬৫
১৯৫১-মার্চ ১
৪,৪১,৬৫,৭৪০
২১,৬৮,৪৪৩
৫.১৬
০.৫০
১৯৬১-ফেব্রুয়ারি ১
৫,৫২,২২,৬৬৩
১,১০,৫৬,৯২৩
২৫.০৪
২.২৩
১৯৭৪-মার্চ ১
৭,৬৩,৯৮,০০০
২,১১,৭৫,৩৩৭
৩৮.৩৫
২.৫০
১৯৮১-মার্চ ৫
৮,৯৯,১২,০০০
১,৩৫,১৪,০০০
১৭.৬৯
২.৩৩
১৯৯১-মার্চ ১১
১১,১৪,৫৫,১৮৫
২,১৫,৪৩,১৮৫
২৩.৯৬
২.১৫
২০০১-জানুয়ারি ২২
১৩,০০,২৯,৭৪৯
১,৮৫,৭৪,৫৬৪
১৬.৬৬
১.৫৪
উৎসঃ আদমশুমারী রিপোর্ট ২০০১; প্রকাশ জুলাই ২০০৩, পৃ-২৪।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবার সময়
যে এলাকা নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত, সে এলাকায় গত কয়েক শতকের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং দ্বিগুণ হওয়ার তালিকা নিচে দেয়া হলো। জনসংখ্যাবিদদের সূত্র অনুযায়ী কোন দেশের লোকসংখ্যা শতকরা এক ভাগ বৃদ্ধি পেলে ৭০ বছরে সে দেশের লোকসংখ্যা দ্বিগুণ হয়। এ হিসেবে বাংলাদেশের জনসংখ্যার বর্তমান বৃদ্ধির হার ধরে আগামী ২০১১ সালে সম্ভাব্য প্রক্ষেপিত জনসংখ্যা কত হবে তা তালিকায় দেখানো হলো
জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবার সময়
সন
লোকসংখ্যা
দ্বিগুণ হওয়ার বছর
বৃদ্ধির মোট সংখ্যা
১৬৫০
১৮৬১
১ কোটি
২ কোটি
২১১ বছর
১ কোটি
১৯০১
১৯১১
১৯২১
১৯৩১
১৯৪১
২ কোটি ৮৯ লাখ
৩ কোটি ১৬ লাখ
৩ কোটি ৩৩ লাখ
৩ কোটি ৫৬ লাখ
৪ কোটি ২০ লাখ


৮০ বছর

২ কোটি ২০ লাখ
(দ্বিগুণেরও বেশি)
১৯৫১
১৯৬১
১৯৭১
১৯৮১
৪ কোটি ২১ লাখ
৫ কোটি ৮ লাখ
৭ কোটি ৬৪ লাখ
৯ কোটি - লাখ

৪০ বছর

৪ কোটি ৮০ লাখ
(দ্বিগুণের বেশি)
১৯৯১
২০০১
২০১১
১১ কোটি ১৪ লাখ
১৪ কোটি
১৮ কোটি

৩০ বছর

৯ কোটি
জনসংখ্যার ঘনত্ব

বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব বিশ শতকের শুরুতে অনেক কম ছিল। ১৯০১ থেকে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জনসংখ্যা ঘনত্ব বৃদ্ধির হার শতকরা ১০ ভাগের নিচে ছিল। এর পর ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ১৮.২৬ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৫১-তে ৪.৯১ শতাংশে নেমে আসে। এর কারণ ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ ভাগ হয়ে ভারত এবং পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠন। বাংলাদেশ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীন হবার পর জনসংখ্যা ঘনত্বের বৃদ্ধি ঘটে। জনসংখ্যার বিবর্তনের এ পর্যায়ে
পৃষ্ঠা ৫২

জন্মহার ও মৃত্যুহার উভয় হ্রাস পায় বলে ঘনত্ব বৃদ্ধির হার যৌক্তিক পর্যায়ে নেমে আসে। নিচের টেবিলে বিগত শতকের জনসংখ্যা ঘনত্বের হার দেখানো হলো।
জনসংখ্যার ঘনত্ব (প্রতি বর্গকিলোমিটার) ১৯০১২০০১
শুমারী বছর
ঘনত্ব
পরিবর্তনের শতকরা হার
১৯০১
১৯৬
-
১৯১১
২১৪
৯.১৮
১৯২১
২২৫
৫.১৪
১৯৩১
২৪১
৭.১১
১৯৪১
২৮৫
১৮.২৬
১৯৫১
২৯৯
৪.৯১
১৯৬১
৩৭৪
২৫.০৮
১৯৭৪
৫১৮
৩৮.৫০
১৯৮১
৬০৯
১৭.৫৭
১৯৯১
৭৫৫
২৩.৯৭
২০০১
৮৮১
১৬.৬৯
২০০৯-২০১০ (প্রক্ষেপিত)
৯৯০

উৎসঃ আদমশুমারী ২০০১ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১০।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ। ২০০১ সালের আদমশুমারীর তথ্যানুযায়ী সমন্বয়ভিত্তিক জনসংখ্যা ছিল ১৩০.০৩ মিলিয়ন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১.৪৮ শতাংশ। ২০০৯-১০ সালে প্রক্ষেপিত জনসংখ্যা ছিল ১৪.৬১। এসময় জনসংখ্যার প্রক্ষেপিত ঘনত্ব ছিল প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৯৯০ জন। সমাগ্রিকভাবে বাংলাদেশে জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।
১. জনসংখ্যা বৃদ্ধির অস্বাভাবিক গতিঃ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অব্যাহত রয়েছে। প্রজনন হার হ্রাস পেলেও মানুষের আযুষ্কাল বৃদ্ধি পাবার পরিপ্রেক্ষিতে মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া সক্রিয় রয়েছে। ১৯৮১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী সমন্বিত মোট জনসংখ্যা ছিল ৮৯.৯ মিলিয়ন এবং ২০০১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৩০.০৩ মিলিয়নে উপনীত হয়। মাত্র বিশ বছরে মোট জনসংখ্যা ৪০.১৩ মিলিয়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২০ সালে মোট জনসংখ্যা ১৮ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমান করা হয়।
২. গ্রামীণ জনবসতিঃ বাংলাদেশে জনসংখ্যার লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হলো শহরায়নের মন্থর গতি। তবে শহরের লোকসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেশের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। ১৯৭৪ সালের শুমারীর তথ্যানুযায়ী মোট জনসংখ্যার ৮.৭৮ শতাংশ শহরে বাস করত। ১৯৮১ সালে তা ১৫.১৮, শতাংশ, ১৯৯১ সালে ১৯.৬৩ শতাংশ এবং ২০০১ সালে ২৩.১ শতাংশে পৌঁছে। তিন দশকের বেশি সময়ে শহুরে জনসংখ্যা প্রায় তিনগুণের বেশি বৃদ্ধি পেলেও, এখনো প্রায় ৭৭ শতাংশ লোক গ্রামে বাস করে।
৩. জনসংখ্যার অস্বাভাবিক ঘনত্বঃ বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাবে জনসংখ্যার ঘনত্ব অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯০১ সালে প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল ৫৩৪ জন, (প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১৯৬ জন)। ২০০১ সালে এ সংখ্যা চারগুণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি বর্গমাইলে ২১৭৪ জনে পৌঁছে (প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৮৮১ জন)। প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০০৯-১০ সালে ৯৯০ জনে পৌঁছেছেজনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান ঘনত্ব চাষাবাদযোগ্য ভূমি ও পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বয়ে আনছে।
৪. জনসংখ্যায় পুরুষের সংখ্যাধিক্যঃ বাংলাদেশে প্রতি একশ স্ত্রীলোকের অনুপাতে পুরুষের সংখ্যাধিক্য অব্যাহত থাকলেও তা হ্রাস পাচ্ছে। ২০০১ সালের আদমশুমারীর সমন্বিত তথ্যানুযায়ী নারীপুরুষের অনুপাত ছিল ১০৬.৬ জন এবং ২০০৯ এর তথ্যানুযায়ী ১০৪.০ জন। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন নারী অনুপাতে পুরুষ ছিল ১০৪ জন।
৫. উচ্চ জন্মহারঃ বাংলাদেশের জনসংখ্যার বয়স কাঠামোর ভিত্তিতে ১৫ বছরের নিচের বয়সের জনসংখ্যাধিক্য উচ্চ জন্মহারের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করছে। ১৯১১ সালের আদমশুমারিতে ০-১৪ বছর বয়সের জনসংখ্যার হার ছিল মোট জনসংখ্যার ৪২.৩ শতাংশ। ১৯৭৪ সালে এ হার ৪৮ শতাংশে

পৃষ্ঠা ৫৩

উপনীত হয়। অন্যদিকে ১৯৯১ সালে শুধু ০-৯ বছর বয়স গ্রুপের জনসংখ্যার হার ছিল ৩৩ শতাংশ এবং ২০০১ সালে ২৬.৬ শতাংশ। মহিলা প্রতি ঊর্বরতা হার (২০০৮) ২.৩। জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০০২-২০০৩ এর তথ্যানুযায়ী ০-১৪ বছর বয়সের শতকরা হার ছিল ৩৯.৪ ভাগ। এতে প্রতীয়মান হয় দেশে অধিক জন্মহার অব্যাহত রয়েছে।
৬. যুব জনসংখ্যা বৃদ্ধিঃ বাংলাদেশে জনসংখ্যার বয়স কাঠামোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো যুব বয়সের (১৫-২৯) জনসংখ্যা বৃদ্ধি। যুব সংখ্যার বৃদ্ধিতে একদিকে যেমন ভবিষ্যত জনসংখ্যার বৃদ্ধির বীজ নিহিত থাকে, তেমনি অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৬১ সালে মোট জনসংখ্যার ২৩.১ শতাংশ ছিল যুব জনসংখ্যা। ১৯৮১ সালে এ হার ২৪.৫ শতাংশে উপনীত হয়। ২০০২-২০০৩ শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুযায়ী যুব শ্রমশক্তির (১৫-২৯) মোট সংখ্যা ছিল ১৯ মিলিয়ন, যা ১৯৯৯-২০০০ সালের জরিপে ছিল ১৪.৫ মিলিয়ন। মোট বে-সামরিক শ্রমশক্তির শতকরা ৪১ ভাগ যুব শ্রমশক্তি। ২০০৫-০৬ শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুযায়ী যুব শ্রমশক্তি ১৭.৮ মিলিয়নে পৌঁচেছে।
৭. নির্ভরশীলতার হার বৃদ্ধিঃ জনমিতিতে ১৫-৬০ বছর বয়সের জনগোষ্ঠীকে উপার্জনক্ষম এবং বাকীদের নির্ভরশীল হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পাবার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিক নির্ভরশীলতার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বর্তমানে জন্মহার হ্রাসের প্রবণতা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে নির্ভরশীলতার হার হ্রাস পাচ্ছে। ২০০১ সালের আদমশুমারীর তথ্যানুযায়ী ৫-১৪ বছর বয়সের জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার ২৬.৩ শতাংশ এবং ৬০ বছর বয়সের ওপরের জনসংখ্যা ৬.১ শতাংশ। যা ১৯৯১ সালে ছিল ৫.৪ শতাংশ। নির্ভরশীলতার হার বৃদ্ধি বাংলাদেশের জনসংখ্যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
৮. প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধিঃ বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস এবং চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে গড় আযুষ্কাল বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে প্রবীণ জনসংখ্যার হার (৬০ +উর্ধে) বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭৪ সালে প্রবীণ জনসংখ্যার হার ছিল ৫.৭ শতাংশ। ২০০১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৬.১ শতাংশে উপনীত হয়েছে। জনসংখ্যা সমস্যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে প্রবীণ জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি বিশেষভাবে বিবেচন করা প্রয়োজন।
৯. জন্মহার ও মৃত্যুহারের বৈষম্যঃ জন্মহার এবং মৃত্যুহারের বৈষম্য হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান নির্ধারক। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি এবং স্বাস্থ্যখাতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রভাবে শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রভাবে জন্মহার হ্রাস পেলেও জন্ম-মৃত্যুর বৈষম্য অব্যাহত রয়েছে। নিচে বাংলাদেশের জন্মহার ও মৃত্যুহার দেখানো হলো।
১০.      গ্রাম এবং শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির বৈষম্যঃ বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা গ্রাম নির্ভর। এদেশের শতকরা প্রায় ৭৭ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী ২০০৭ সালে শহরে স্থূল জন্মহার প্রতি হাজারে ছিল ১৭.৪ জন। অন্যদিকে গ্রামে ২২.১ জন। অর্থাৎ স্থূল জন্মহার শহরের তুলনায় গ্রামে বেশিআবার প্রতি হাজারে স্থূল মৃত্যুহার ২০০৭ সালে শহরে ছিল ৫.২ জন এবং গ্রামে ছিল ৬.৬ জন। জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার ২০০৩ সালে শহরে ছিল ১.০৩ শতাংশ এবং গ্রামে ১.৫৫ শতাংশ। গ্রাম ও শহরের জনসংখ্যার বৃদ্ধির বৈষম্য আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বয়ে আনবে।
১১.      জনসংখ্যার আঞ্চলিক বণ্টনে বৈষম্যঃ বাংলাদেশের জনসংখ্যার আঞ্চলিক বণ্টনের মধ্যে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। কোন কোন অঞ্চলে জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। আবার অনেক অঞ্চলে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন বরিশাল অঞ্চলে (বিভাগে) ১৯০১ সালে মোট জনসংখ্যার ৮.৫৯ শতাংশ বাস করতো। ২০০১ সালে তা হ্রাস পেয়ে ৬.৫৯ শতাংশে নেমে আসে। অর্থাৎ জনসংখ্যার শতকরা দু’শতাংশ হ্রাস পায়। আবার চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৯০১ সালের ১৬.৪৭ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০১ সালে ১৯.৪৭ শতাংশে উপনীত হয়। ঢাকা অঞ্চলে ১৯০১ সালের ২৮.৭৭ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩১.৪৮ শতাংশে পৌঁছে। আবার রাজশাহী অঞ্চলে ১৯০১ সালের ২৬.০৪ শতাংশ জনসংখ্যা থেকে হ্রাস পেয়ে ২৪.২৯ শতাংশে নেমে আসে। খুলনা এবং সিলেট অঞ্চলেও জনসংখ্যা হ্রাস পায়।
১২.      বিবাহের গড় বয়স বৃদ্ধিঃ প্রজণন হারের প্রত্যক্ষ চলক হলো বিবাহ। বিবাহের বয়স, বিবাহিত জীবনের স্থায়িত্ব ইত্যাদির ওপর প্রজনন হার বিশেষভাবে নির্ভর করে। বাল্যবিবাহ প্রজনন হার বৃদ্ধির সহায়ক। বাংলাদেশের মহিলাদের বিবাহের গড় বয়স ১৯৩১ সালে ছিল ১২.৬ বছর আর ২০০৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২০.৩ বছরে পৌঁছে।
 
পৃষ্ঠা ৫৪

জনসংখ্যা তত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে জনসংখ্যাস্ফীতি কি সমস্যা?
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। বিভিন্ন জনসংখ্যাতত্ত্বের আলোকে এবং বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জনসংখ্যাস্ফীতিকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে এখানে আলোচনা করা হলো।
ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের আলোকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা
ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বানুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে যেমন- ১, ২, ৪, ৮, ১৬, ৩২ হারে এবং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় গাণিতিক হারে অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪, ৫ অনুপাতে। ফলে জনসংখ্যা ২৫ বছরে দ্বিগুণ হয়ে জনসংখ্যা ও খাদ্য উৎপাদনের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেয়।
১৯৮১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২.৩৬ শতাংশ এবং ১৯৯১ সালের আদম শুমারির তথ্যনুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২.১৭ ভাগ। ২০০১ সালে শুমারী অনুযায়ী বৃদ্ধির হার ১.৪৭। ম্যালথাসের তত্ত্বের আলোকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা নিচে আলোচনা করা হলো:
১. ম্যালথাসের মতে, খাদ্য ঘাটতি দেশের জনাধিক্যের অন্যতম লক্ষণ। বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত থাকা সত্বেও ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি রয়েছে। নিচের ছকে বিগত এক দশকের খাদ্য সাহায্য ও আমদানীর পরিমাণ দেখানো হলো। যা থেকে খাদ্য ঘাটতির ধারণা পাওয়া যায়।
বিদেশ হতে খাদ্যশস্য সাহায্য ও আমদানির হিসাব
সন
১৯৭২-৭৩
১৯৮৫-৮৬
১৯৮৯-৯০
১৯৯৪-৯৫
১৯৯৯-০০
২০০৩-০৫
২০০৭-০৮
২০০৭-০৮
মোট খাদ্যশস্য
হাজার মে. টন
২৮২৫
১২০০
১৫৩৩
২৫৬৮
২১০৪
২৭৮৮
৩৪৫৭
৩০১৩
উৎসঃ অর্থনৈতিক সমীক্ষাঃ ২০১০, পৃ-২৬৬।
২. ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বানুযায়ী প্রাকৃতিক নিরোধের প্রাদুর্ভাব জনসংখ্যাধিক্যের লক্ষণ বহন করে। তাঁর মতে, জনসংখ্যা খাদ্য সরবরাহকে অতিক্রম করলে দেশে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, আত্মহত্যা, সংঘাত ইত্যাদি দেখা দেবে। বাংলাদেশে পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ধারাবাহিকভাবে সংগঠিত হচ্ছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা লেগেই রয়েছে। অধিক জনসংখ্যার জন্য বাংলাদেশেকে ১৯৭৪ সালে ম্যালথাসের দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
৩. ম্যালথাসের তত্ত্বানুযায়ী জনসংখ্যা ২৫ বছরে দ্বিগুণ হবে। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭.৬৪ কোটি। ২০০৫ সালে প্রায় ১৪ কোটিতে উপনীত হয়। মাত্র ত্রিশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়।
৪. ম্যালথাসের ভবিষ্যৎবাণী হলো যাদি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয় তা হলে প্রাকৃতিক নিয়মে তার সমাধান হবে। জনসংখ্যার প্রকৃতির নিরোধের লক্ষণ ১৯৭০ সালের জলোচ্ছ্বাস, ১৯৭১ সালের যুদ্ধ, ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ, ১৯৮৮ সালের বন্যা, ১৯৯১ সালের জলোচ্ছ্বাস, অব্যাহত রাজনৈতিক সংঘাত ইত্যাদি উল্লেখ করা যায়।
৫. বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রতিরোধের জন্য সরকার কৃত্রিম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। জনগণের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধির জন্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
সুতরাং যৌক্তিক কারণে বলা যায় ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের আলোকে বাংলাদেশে জনসংখ্যাস্ফীতি অন্যতম প্রধান সমস্যা।
কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বানুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা
কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বানুযায়ী দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে ভারসাম্যমূলক বিশেষ জনসংখ্যাকে বলা যায় কাম্য জনসংখ্যা। কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বানুযায়ী বাংলাদেশকে জনসংখ্যাধিক্য দেশ বলা যায়। কারণ এ তত্ত্বের বক্তব্য অনুযায়ী জনসংখ্যা কাম্য জনসংখ্যার অধিক হলে, উৎপাদন হ্রাস পেয়ে মাথাপিছু আয় কম হবে। আমাদের জাতীয় উৎপাদন ও মাথাপিছু আয় অত্যন্ত কম। ইহা-এর তথ্যানুযায়ী ২০০৫ সালে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ লোক দরিদ্রসীমার নিচে এবং ১৮.৭ শতাংশ লোক চরম দরিদ্রাবস্থায় বসবাস করছে। ২০০৮-০৯ সালে মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল মাত্র ৬৯০ মার্কিন ডলার।
সুতরাং কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বানুযায়ী বাংলাদেশে জনসংখ্যাধিক্য সমস্যা বিদ্যমান যুক্তিযুক্তভাবে পরিলক্ষিত হয়।
জনসংখ্যা বিবর্তন তত্ত্বানুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা  : জনসংখ্যার বিবর্তন তত্ত্বটি বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও গ্রহণীয়। এ তত্ত্বটি বিভিন্ন দেশের জনসংখ্যার প্রকৃতি সম্পর্কিত বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত। অষ্ট্রেলিয়া, ভারত এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সংগৃহীত জনসংখ্যা পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বিবর্তন তত্ত্বটি প্রদান করা হয়। এ তত্ত্বে বলা হয়েছে, কোন দেশের জনসংখ্যা নির্দিষ্ট কয়েকটি স্তরের মাধ্যমে উত্তীর্ণ হয়ে থাকে। প্রথম স্তরে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন শুরুর পূর্বে একটি দেশের জনসংখ্যার, জন্ম ও মৃত্যুর হার উভয়টি অত্যন্ত বেশি থাকে। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অতি সামান্য হয়। দ্বিতীয় স্তরে আর্থ-সামাজিক অবস্থার ক্রমোন্নতি ধারায় দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থারও উন্নয়ন ঘটে। এ স্তরে মৃত্যুহার দ্রুতগতিতে হ্রাস পায় কিন্তু জন্মহার হ্রাস পায় না।

পৃষ্ঠা ৫৫

ফলে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। তৃতীয় স্তরে ব্যাপক আর্থ-সমাজিক উন্নয়নের ফলে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং জন্মহার মৃত্যুহারের মতো হ্রাস পায়। ফলে সাধারণত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পেতে থাকে। শেষ পর্যায়ে জন্মহার ও মৃত্যুহার উভয়ই কম এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার স্থিতিশীল থাকে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার বিবর্তন, বর্তমানে দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে কিন্তু জন্মহার মন্থর গতিতে হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিবর্তন প্রথম পর্যায় থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে আসতে যত সময় লাগছে, তৃতীয় পর্যায় থেকে চতুর্থ পর্যায়ে যেতে অনেক বেশি সময় লাগছে। এরূপ বেশি সময়, জনসংখ্যা সমস্যা দেশের সার্বিক উন্নয়নকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে। দেশে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে মৃত্যু হার হ্রাস এবং আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৃত্যুহারের তুলনায় জন্মহার বেশি হওয়ায় জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে সমস্যারূপে বিরাজ করছে।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্ট হয়ে উঠে, প্রধান প্রধান জনসংখ্যা তত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে অতিরিক্ত জনসংখ্যা অন্যতম সমস্যারূপে বিরাজ করছে। জনসংখ্যাস্ফীতির প্রভাবে বাংলাদেশে ক্রমাগত খাদ্য সমস্যা, বেকারত্ব, নিরক্ষতা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিহীনতা, চাষাবাদযোগ্য ভূমির ওপর চাপ, মূলধন গঠনের স্বল্পতা, ভিক্ষাবৃত্তি, দুর্নীতি, পরিবেশ দূষণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতি সমস্যা বৃদ্ধি পেয়ে চলছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কোন দিকই জনসংখ্যাস্ফীতির প্রভাবমুক্ত নেই। এজন্য সরকারিভাবে জনসংখ্যাস্ফীতিকে বাংলাদেশের প্রধান জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যে কোন দৃষ্টিকোণ হতে বিশ্লেষণ করা হোক না কেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যারূপেই বিবেচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক খাতে জনসংখ্যাস্ফীতির প্রভাব
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। বাংলাদেশের এমন কোন ক্ষেত্র নেই, যেখানে জনসংখ্যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় না। দেশের সম্পদ ও প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান জনসংখ্যা বাংলাদেশের জন্য সম্পদ না হয়ে মারাত্মক সমস্যারূপে বিরাজ করছে। সরকারি পর্যায়ে পরিকল্পিত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে জনসংখ্যাস্ফীতির বিরূপ প্রভাব বিভিন্ন গবেষণার তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করা হলো।
  1. খাদ্য ঘাটতিঃ বাংলাদেশে বর্তমানে খাদ্য সমস্যার প্রধান কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও খাদ্য উৎপাদনের অসামঞ্জস্যতা।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি বলে, খাদ্য উৎপাদন অধিক হলেও খাদ্য সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্য আমদানি করতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের দরুণ শিল্পায়ন ব্যাহত হয়। ১৯৬০ সালে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় এক কোটি টন। আর খাদ্য ঘাটতি ছিল চার লাখ টন। অন্যদিকে ২০০১ সালে ধান ও গম উৎপাদনের পরিমাণ ছিল দু’কোটি ৬৭ লাখ ৫৮ হাজার মে. টন। ২০০১ সালে খাদ্য আমদানির পরিমাণ ছিল ১৫.৫৪ লাখ মে. টন এবং ২০০৮-০৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৩০.১৩ লাখ মে. টন-এ পৌঁচেছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাবে আবাদী ভূমি অনাবাদী ভূমিতে পরিণত হয়ে মাথাপিছু ভূমি হ্রাস পাচ্ছে। এতে মাথাপিছু খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য প্রাপ্তির সম্ভাব্যতা আশংঙ্কাজনকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
  1. নির্ভরশীল জনসংখ্যার হার বৃদ্ধিঃ নির্ভরশীলতা বলতে যাদের বয়স ০-১৪ এবং ৬০+ বছরের ঊর্ধ্বে, তাদেরকে বুঝায়। ২০০১ সালের আদমশুমারির তথ্যানুযায়ী জনসংখ্যার শতকরা ৫৪.৬ ভাগের বয়স ১৫-৫৯ বছরের মধ্যে। সুতরাং ধরে নেয়া যায় ৪৫.৪ ভাগ লোক শ্রম শক্তির বাইরে এবং এরা নির্ভরশীল।
৩. শিক্ষার অভাবঃ শিক্ষা মানুষের অন্যতম মৌল চাহিদা। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশের সংবিধান মতে প্রতিটি নাগরিকের জন্য শিক্ষার সুযোগ-সুনিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। দেশের বৃহত্তর জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার জন্য সর্বস্তরে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না পাওয়ায় অশিক্ষিতের মোট সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র বিমোচন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে।
৪. স্বাস্থ্যঃ বাংলাদেশে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সে হারে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য রক্ষার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না পাওয়ায় সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি হচ্ছে। স্বাস্থ্যহীনতা ও পুষ্টিহীনতা দেশের অন্যতম সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিরাজ করছে। যার প্রধান কারণ জনসংখ্যাস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে খাদ্য ও চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধার অভাব।
৫. ভূমির ওপর চাপঃ জনসংখ্যার তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ে ভূমির ওপর। প্রতি বছর বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য বাড়ীঘর, রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা প্রভৃতি স্থাপন ও উত্তরাধিকার সূত্রে ভূমির ভাগ-বাটোয়ারা হবার কারণে বিপুল পরিমাণ আবাদী ভূমি অনাবাদী ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে, নদীর ভাঙ্গনে প্রতিবছর আবাদী ভূমি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। এতে চাষাবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ১৯৯৬ সালের কৃষি

পৃষ্ঠা ৫৬

শুমারীর তথ্যানুযায়ী মাথাপিছু চাষাবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ মাত্র ০.১৫ একর। জনসংখ্যার চাপে এ পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। কৃষি নমুনা জরিপ ২০০৫ এর তথ্যানুযায়ী মাথাপিছু আবাদী ভূমি মাত্র ০.১৩ একর। ২০০৫ সালে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯২৮ জন। ২০০৯-১০ এর প্রাক্কলন অনুযায়ী ৯৯০ জন। জনসংখ্যার চাপে ভূমিহীন এবং দরিদ্র শ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৬. মূলধন গঠন ও শিল্পায়ন ব্যাহতঃ জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির প্রভাবে জনগণের জীবনযাত্রার মান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। মাথাপিছু জাতীয় আয় ও অভ্যন্তরীণ জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি) হ্রাস পায়। যার ফলে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় খুব কম। বর্ধিত জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য বার্ষিক বিপুল পরিমাণ অর্থ অনুৎপাদন খাতে ব্যয় করতে হয়। এতে মূলধন গঠন ব্যাহত হয়ে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সুতরাং জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি মূলধন গঠন ও শিল্পায়নের অন্যতম প্রতিবন্ধক।
৭. বাসস্থান সমস্যাঃ এক সময় বাংলাদেশকে বলা হতো পৃথিবীর বৃহত্তর গ্রামীণ বস্তি। বাংলাদেশের মৌলিক সমস্যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গৃহ সমস্যা, যার মূল কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গৃহায়নের সুযোগ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না।
৮. পরিবেশ দূষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতাঃ বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য বাসগৃহ নির্মাণ, রাস্তাঘাট ও পুকুর খনন প্রভৃতি কারণে গাছপালা ও বনাঞ্চল ক্রমান্বয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে। খাদ্যসহ অন্যান্য চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ওষুধ ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। তদুপরি জনসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পয়ঃপ্রণালী, শৌচাগার ইত্যাদি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না বলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে এবং বিভিন্ন রোগজীবাণু বিস্তার লাভ করছে। এছাড়া বর্ধিত জনসংখ্যার যাতায়াত ও যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত যান্ত্রিক যানবাহন, পরিবেশ দূষণে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
৯. জনসংখ্যার গুণগত ভারসাম্যহীনতা ও সামাজিক বিশৃংখলাঃ বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দরিদ্র ও নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে অধিক। দরিদ্রশ্রেণী তাদের সন্তান-সন্ততিদের লেখাপড়াসহ অন্যান্য মৌল চাহিদা যথাযথভাবে পূরণে সক্ষম হচ্ছে না। এতে দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের সমাজিকীকরণ ব্যাহত হয়ে ব্যক্তিত্ব যথাযথভাবে গড়ে উঠছে না। সমাজে এদের সংখ্যা অধিক। অন্যদিকে, শিক্ষিত ও সম্পদশালী শ্রেণীর মধ্যে সন্তান জন্মদানের হার কম। তারা তাদের সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা ও অন্যান্য মৌল চাহিদা পূরণের মাধ্যমে সুষ্ঠু ব্যক্তিত্ব গঠনে সক্ষম। সমাজে এদের সংখ্যা অত্যন্ত কম। সুতরাং বলা যায়, বাংলাদেশে যে হারে দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং উচ্চ শ্রেণীতে জনসংখ্যা যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশে জনসংখ্যার মধ্যে মারাত্মক গুণগত ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবে। যা সামাজিক সংহতি ও শৃঙ্খলার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ন্যূনতম মৌল চাহিদা পূরণের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না পাওয়ায়, সমাজ জীবনে অশান্তি, হতাশা, ব্যর্থতা ও চরম বিশৃঙ্খলা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১০.      বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধিঃ ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বর্ধিত জনসংখ্যার মৌল চাহিদাসহ অন্যান্য প্রয়োজন পূরণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের দায় ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলছে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ ঋণ পরিশোধে ব্যয় করতে হয়। বাংলাদেশে চক্রাকারে বিরাজমান দারিদ্রের দুষ্টচক্রের মৌলিক প্রভাবক হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মাথাপিছু আয় ও জাতীয় আয় হ্রাস পেয়ে দেশ পুনরায় দারিদ্রের দিকে প্রত্যাবর্তন করছে। অন্যদিকে বিদেশি দায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭১-৭২ অর্থবছর শেষে বৈদেশিক দায়ের স্থিতি ছিল মাত্র ২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০০৮-০৯ সালের শেষে বৈদেশিক দায়ের স্থিতি বৃদ্ধি পেয়ে ২১ হাজার ৮০৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উপনীত হয়েছে।
১১.      ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্যঃ বিশ্ব জনসংখ্যার প্রেক্ষাপটে দেখা যায় বিশ্বে যত শিশু জন্ম গ্রহণ করে, তার সিংহভাগ জন্ম নেয় উন্নয়নশীল দেশে। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে অনুমান করা হয় বিশ্ব জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রায় ৯৮ শতাংশই ঘটে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। কারণ ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশ জনসংখ্যা হ্রাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
১২.      বিনিয়োগ ব্যাহতঃ জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের জনগণের বর্তমান চাহিদা পূরণে বার্ষিক বিপুল অর্থ  বিনিয়োগ করতে হয়। যা ভবিষৎ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে তুলে। অশিক্ষিত দরিদ্র পরিবারের সন্তান সংখ্যা অধিক। ফলে এসব পরিবার সদস্যদের মৌল চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে সব সম্পদ ব্যয় করে, সন্তানদের ভবিষ্যতের মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিনিয়োগ করতে পারে না। ফলে এসব দরিদ্র পরিবার পুনরায় দরিদ্রই থেকে যায়। অন্যদিকে, স্বল্প সংখ্যক সন্তান থাকায় সম্পদশালী পরিবার তাদেরকে উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে ভবিষ্যতের মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। এসব পরিবার ক্রমান্বয়ে আরো উন্নত জীবন লাভে সক্ষম হয়। এভাবে জনসংখ্যার ভারসাম্যহীন বৃদ্ধি আর্থ-সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যাস্ফীতির কারণ
সন্তান জন্মদান ও বংশবৃদ্ধি মানুষের সহজাত জৈবিক প্রবণতা। অন্যদিকে, জনসংখ্যার সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি ক্রমবর্ধমান। তবে বিশেষ কারণে সাময়িকভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা ব্যাহত হতে পারে। যেমন-দুর্ভিক্ষ, মহামারী, যুদ্ধ বিগ্রহ, বিলম্ব বিবাহ, জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির মতো জৈবিক মৌল প্রক্রিয়ার সঙ্গে যেমন আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রশ্ন জড়িত, তেমনি দর্শন, নীতিবোধ, ধর্ম,
পৃষ্ঠা ৫৭
মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি বিষয় জড়িত। সুতরাং জনসংখ্যা সমস্যার কারণ বিশ্লেষণ করতে হলে সামগ্রিক ও বহুমুখী দৃষ্টিকোণ হতে বিশ্লেষণ করা যুক্তিযুক্ত। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো।
১. আবহাওয়া ও খাদ্যাভ্যাসঃ ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ মৌসুমী অঞ্চলে অবস্থিত। ফলে এদেশে নর-নারী তুলনামূলকভাবে অল্পবয়সেই সন্তান উৎপাদন বা প্রজনন ক্ষমতা অর্জন করে। এটি বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে, ১৯৫৭ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওপর হল্যান্ডের পরিচালিত গবেষণায় তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, অতিমাত্রায় শ্বেতসার জাতীয় যেমন- ভাত, গম, আলু প্রভৃতি খাদ্য গ্রহণ এবং স্বল্পমাত্রায় আমিষ যেমন- মাছ, মাংস, ডিম প্রভৃতি গ্রহণ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অধিক জন্মহারের কারণ হিসাবে প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দরিদ্র দেশ হিসেবে খাদ্য গ্রহণের প্রকৃতি অধিক জন্মহারের সহায়ক। বাংলাদেশের জনগণের খাদ্যে আমিষের অভাব এবং শ্বেতসারের আধিক্য প্রজনন ক্ষমতার ক্ষেত্রে অনুকূল প্রভাব সৃষ্টি করছে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল প্রকাশিত সারা বিশ্বের জনসংখ্যা সংক্রান্ত রিপোর্ট ‘বিশ্ব জনসংখ্যা-১৯৯৮ এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের নারী প্রজনন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন। অল্প বয়স্ক মেয়েদের প্রজনন ক্ষমতা শ্রীলঙ্কার চেয়ে, বাংলাদেশের মেয়েদের পাঁচগুণ বেশি। নারীদের দুই তৃতীয়াংশ ২০ বছর বয়সের আগে সন্তান জন্ম দেয়। যেখানে ফিলিপাইনে ২২ বছর এবং পাকিস্তানে ৩০ বছর বয়সে সন্তান জন্ম দিয়ে থাকে।[1]
২. জন্ম ও মৃত্যুর বৈষম্যঃ জন্মহার হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান নির্ধারক। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে বর্তমানে শিশু মৃত্যুর হার অতীতের তুলনায় হ্রাস পাচ্ছে এবং গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্ম, মৃত্যু ও আয়ুষ্কাল সম্পর্কিত পরিসংখ্যান নিচে দেয়া হলো।
সন
১৯৯০
২০০৮
স্থূল জন্ম প্রতি হাজারে
৩২.৮
২০.৫
স্থূল মৃত্যু প্রতি হাজারে
১১.৪
৬.০
শিশুমৃত্যু হাজারে ১ বছরের নীচে
৯৪.০
৪১. জন
ফার্টিলিটি হার (প্রতি মহিলা)
৪.৩
২.৩০
আয়ুষ্কাল
৫৬.১
৬৬.৮
জনসংখ্যা স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার
২.১৪
১.৪৫
উৎসঃ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১০, পৃ-২৯৯।
শিশু মৃত্যুহার হ্রাস এবং আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি জনসংখ্যাস্ফীতির সহায়ক।
  1. দারিদ্রঃ বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান ও মাথাপিছু আয় অত্যন্ত কম। জীবনযাত্রার মান ও সন্তান জন্মদানের মধ্যে বিপরীতমুখী সম্পর্ক বিদ্যমান। উচ্চ শ্রেণী তাদের স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাত্রার মান বজায় রাখার জন্য কম সন্তান কামনা করে। পক্ষান্তরে, দরিদ্র শ্রেণী তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য অধিক সন্তান কামনা করে। মি. ডি ক্যাস্ট্রো তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে বলেছেন, ক্ষুধার্ত মানুষের প্রজনন ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। অর্থনীতিবিদ র‌্যাগনার নার্কস-এর দারিদ্রের দুষ্টচক্র বিশ্লেষণের একটি মাত্রা  হলো







পৃষ্ঠা ৫৮

বাংলাদেশে দারিদ্রের প্রভাবে সন্তান জন্মদানের প্রবণতা অধিক।
৪. কৃষিভিত্তিক সমাজ কাঠামোঃ বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো কৃষিভিত্তিক। কর্মসংস্থানের সিংহভাগ কৃষিখাতে হয়ে থাকে। কৃষি হচ্ছে একটি যৌথবদ্ধ কাজ। কৃষি কাজের স্বার্থে এখানে পুত্র সন্তান মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। এ কারণে গ্রামীণ এলাকায় অধিক সন্তান জন্মদানের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের যৌথ পরিবার ব্যবস্থা উচ্চ জন্মহারের অনুকূল। গ্রামীণ যৌথ পরিবারে সন্তান জন্মদান ও লালন-পালন তেমন ব্যয়বহুল এবং কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়। ফলে সন্তান জন্মদানকে তেমন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয় না।
৫. নারী শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অভাবঃ সমাজবিজ্ঞানী কিংসলি ডেভিস-এর মতে, নারীর অক্ষরজ্ঞান ও শিক্ষা, তার সন্তান সংখ্যার সাথে বিপরীতমুখী। বাস্তব তথ্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় যেদেশে নারী শিক্ষার হার যত বেশি, সে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হার ততো কম। এর কারণ:
  নারীদের পড়ালেখায় অধিক সময় অতিবাহিত হয় বলে দেরিতে বিবাহ হওয়া।
  শিক্ষিত কর্মজীবী মহিলারা সংসারের বাইরে কর্মে ব্যস্ত থাকার দরূণ কম সন্তান কামনা করে।
  শিক্ষিত কর্মজীবী মহিলাদের মধ্যে জীবন সম্পর্কে অধিক সচেতনতা থাকে বলে কম সন্তান কামনা করে।
  কর্মজীবী শিক্ষিত মহিলাদের সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদা অধিক থাকে বলে তারা মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা পায়। যা সন্তান জন্মদানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৬. ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবঃ বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রবণতার অন্যতম প্রধান প্রভাবক ধর্মীয় অনুশাসন, ধর্মপ্রবণতা ও মূল্যবোধের প্রভাব। বাংলাদেশের ধর্মভীরু মুসলমানগণ বিয়ে ও সন্তান জন্মদানকে পবিত্র কাজ বলে মনে করে। ফলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সন্তানদের বিশেষ করে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে। জন্ম শাসন এবং পরিকল্পিত পরিবার গঠনকে ধর্মীয় মূলবোধ বিরোধী কাজ বলে মনে করে। হিন্দু শাস্ত্রের বক্তব্য হলো ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভাযা; পুত্র পিন্ড প্রয়োজনম্অর্থাৎ পুত্রের জন্য স্ত্রী আর পিন্ডের জন্য পুত্রের প্রয়োজন। বলা হয় যে ব্যক্তি পুত্রহীন অবস্থায় দেহ ত্যাগ করে, পরলোকে তাকে পুৎ নামক নরকে বাস করতে হয়। আর ‘পুত্’ নামক নরক থেকে পুত্রই শুধু উদ্ধার করতে পারে। তাই তাকে পুত্র বলা হয়।[2] হিন্দু ধর্মে পিতা-মাতার মুখাগ্নির জন্য ছেলে সন্তান অপরিহার্য। হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে ছেলেদের গুরুত্ব অধিক। এজন্য হিন্দু সমাজে ছেলে সন্তান সবাই কামনা করে। মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত ‘‘সন্তান জন্মদানে মানুষের হাত নেই, সন্তান আল্লাহর দান, মুখ দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি’’ এ জাতীয় অদৃষ্টবাদী দৃষ্টিভঙ্গি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সহায়ক। তবে বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের প্রভাবে এরূপ মনোভাব ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে।
৭. নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতার প্রভাবঃ বাংলাদেশের তুলনামূলকভাবে অধিক জনগোষ্ঠী নিরক্ষর ও অজ্ঞ। ফলে অধিক সন্তানের সমস্যা ও অসুবিধা নিয়ে তারা সামষ্টিকভাবে চিন্তিত নয়। বিশেষ করে অশিক্ষিত ও অজ্ঞ দরিদ্র ও নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে এরূপ চিন্তাধারা বিদ্যমান। তাই বাংলাদেশের নিরক্ষর ও অজ্ঞ দরিদ্র জনগোষ্ঠী দায়িত্বহীনভাবে অধিক সন্তান জন্ম দিয়ে থাকে।
৮. সামাজিক নিরাপত্তার অভাবঃ বাংলাদেশে ব্যাপক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গৃহীত হয়নি। বৃদ্ধ ও অবসরকালীন সময়ের আর্থিক নিরাপত্তার সম্বল সন্তান-সন্তনি। বৃদ্ধ বয়সের আর্থিক নিরাপত্তাজনিত অনিশ্চয়তার দরুণ দেশের মানুষ অধিক পুত্রসন্তান কামনা করে। বিশেষ করে পুত্র সন্তান কামনার মূল প্রবণতা হলো বৃদ্ধ বয়সের সামাজিক নিরাপত্তা।
৯. বাল্যবিবাহঃ বিবাহ বর্তমান সভ্যজগতে বৈধ ও সমাজ অনুমোদিত যৌন মিলন ও সন্তান জন্মদানের একমাত্র প্রথা। এজন্য বিবাহকালীন বয়স প্রজনন হারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। বৈবাহিক সম্পর্কহীন সন্তান জন্মদান দেখা গেলেও এ হার গুরুত্বহীন। মহিলাদের প্রজনন সময় সাধারণত ১৫-৪৯ বছর। সুতরাং মহিলা যত তাড়াতাড়ি বিবাহ করবেন জন্মহার ততো বেশি হওয়া স্বাভাবিক। একজন মহিলা প্রজননক্ষম বয়সের যতো বেশি সময় বিবাহিত অবস্থায় থাকবেন, ততো জন্মহার বেশি হবার সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশে মেয়েদের গড় বিবাহের বয়স উন্নত দেশ অপেক্ষা অনেক কম। ১৯২৯ সালে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন প্রণীত হলেও তা বন্ধ হয়নি। ১৯৬০ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী বাল্য বিবাহের হার ছিল শতকরা ৩২ ভাগ। ১৯৯১ সালের শুমারি জরিপ অনুযায়ী এ হার ছিল শতকরা ৩০ ভাগ। নিচের সারণীতে মহিলাদের বিবাহের গড় বয়সের পরিবর্তন দেখানো হলো




পৃষ্ঠা ৫৯

মহিলাদের বিবাহের গড় বয়সের পরিবর্তন
সন
তথ্যের উৎস
প্রথম বিবাহের গড় বয়স
১৯৩১
আদমশুমারি
১২.৬ বছর
১৯৪১
আদমশুমারি
১৩.৭ বছর
১৯৫১
আদমশুমারি
১৪.৪ বছর
১৯৬১
আদমশুমারি
১৩.৯ বছর
১৯৭৪
পরিকল্পনা কমিশন
১৫.৯ বছর
১৯৮১
পরিকল্পনা কমিশন
১৭.৮ বছর
১৯৯১
পরিকল্পনা কমিশন
১৮.১ বছর
২০০৮
পরিসংখ্যান ব্যুরো
২০.৩ বছর
উদ্ধৃতঃ বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা ও পরিবার পরিকল্পনা সমাজ উন্নয়ন ও সমাজকর্মের পরিপ্রেক্ষিতে।
 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮৯, পৃ-২১। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রতিবেদন পৃ-১৫। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১০।
১০.      পুত্র সন্তান লাভের তীব্র আকাঙ্খাঃ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্র জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। ড. এমএ মান্নান-এর গবেষণার রিপোর্টে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে পুত্র সন্তান লাভের তীব্র আকাঙ্খা এবং সমাজ জীবনে নারীর নিম্ন মর্যাদাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্বের ৪০টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে পুত্র সন্তান লাভের প্রবণতায় বাংলাদেশ শীর্ষে। বাংলাদেশের সনাতন জনপদে শতকরা ৯৭ জন পুত্র সন্তান লাভে যে কোন সংখ্যক সন্তান জন্ম দিতে দ্বিধাবোধ করে না। উন্নত জনপদে অর্থাৎ শহরে শতকরা ৮০ ভাগ নারী পুত্র না হওয়া পর্যন্ত সন্তান জন্ম দিতে ইচ্ছুক।[3]
১১.      বহুমাত্রিক চলকের প্রভাবঃ জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান নিয়ামক হলো জন্মহার। আবার সন্তানের জন্ম নির্ভর করে আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পারিকবারিক গঠন কাঠামো, শিক্ষা, সচেতনতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ প্রভৃতি বহুমাত্রিক চলকের ওপর। ১৯৭৭ সালে বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি মডেল ব্যবহার করে। এ মডেলে কোন দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে পরস্পর নির্ভরশীল বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উপাদানের ভূমিকা উপস্থাপন করা হয়েছে। উক্ত মডেল হতে বুঝা যায়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি যেমন জটিল, তেমনি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস করাও কঠিন। পরস্পর নির্ভরশীল আর্থ-সামাজিক উপাদানসমূহের মধ্যে রয়েছে উন্নয়নের স্তর, শিক্ষার মান ও সুযোগ, ধর্ম, জাতীয়তা, স্থানান্তরের হার, আয়, পরিবেশ, পারিবারিক গঠন কাঠামো ও আকৃতি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি, সন্তানের মূল্য, জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত জ্ঞান ও মনোভাব প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।



[1].    উদ্ধৃতঃ দৈনিক ইনকিলাব, এপ্রিল ৩, ১৯৯৯।
[1].    দৈনিক মানব জমিন, পৃ-৭, সেপ্টেম্বর ৩, ১৯৯৮।
[2].    বিষয় সামজতত্ত্ব, পৃ-৬৬২। সমাজবিজ্ঞান সমীক্ষণঃ নাজমুল করিম, নওরোজ কিতাবিস্তান; পৃ-২৭৫, ১৯৭৩।
[3].    দৈনিক ইত্তেফাক, ২০ জানুয়ারি ১৯৮৯।

View Foundation Digital Talking Library is developed and maintained by Sigma Enterprise.
Theme designed by Imtiaz
All rights are reserved. Any kind of reproduction of any mp3 files and text files is prohibited. If any organization or any person is found copying or reproducing any of the material will be punished under copy right law.