Logo Sponsored by Chowdhury and Hossain, Advanced Publications

Sahittekhela


সাহিত্যে খেলা
প্রমথ চৌধুরী

লেখক পরিচিতি
বাংলা সাহিত্যে চলতি গদ্যরীতির প্রবর্তক প্রমথ চৌধুরী ছিলেন পরিশীলিত বাগবৈদগ্ধময় রম্যরচনায় সিদ্ধহস্ত। তাঁর বহু রচনা প্রকাশিত হয়েছে ‘বীরবল’ ছদ্মনামে। বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষারীতির প্রথম মুখপত্র ‘সবুজপত্র’ (প্রথম প্রকাশ : ১৯১৪) পত্রিকাটি ছিল তাঁরই সম্পাদিত এবং রবীন্দ্রনাথসহ সমকালীন বিখ্যাত মননশীল লেখকদের অনেকেই ছিলেন এই পত্রিকার লেখক। তাঁর গদ্যশৈলীর নিদর্শন রয়েছে ‘চার ইযারী কথা’, ‘বীরবলের হালখাতা’, ‘রায়তের কথা’, ‘তেল-নুন-লকড়ি’ ইত্যাদি গ্রন্থে। তাঁর গল্পগ্রন্থগুরো ও ‘সনেট পঞ্চাশৎ’ কাব্যগ্রন্থ যথাক্রমে গল্পকার ও সনেটকার হিসেবেও বাংলা সাহিত্যে তাঁকে বিশিষ্ট আসন দিয়েছে।
প্রমথ চৌধুরীর পৈত্রিক নিবাস পাবনা জেলার হরিপুর গ্রামে। তিনি ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মৃত্যু ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে।

জগৎ-বিখ্যাত ফরাসি ভাস্কর রোদ্যাঁ, যিনি নিতান্ত জড় প্রস্তরের দেহ থেকে অসংখ্য জীবিতপ্রায় দেবদানব কেটে বার করেছেন তিনিও শুনতে পাই, যখন তখন হাতে কাদা নিয়ে, আঙুলের টিপে মাটির পুতুল ত’য়ের করে থাকেন। এই পুতুল গড়া হচ্ছে তাঁর খেলা। শুধু রেদ্যাঁ কেন, পৃথিবীর শিল্পী মাত্রেই এই শিল্পের খেলা খেলে থাকেন। যিনি গড়তে জানেন, তিনি শিবও গড়তে পারেন, বাঁদরও গড়তে পারেন। আমাদের সঙ্গে বড় বড় শিল্পীদের তফাত এইটুকু যে তাঁদের হাতে এক করতে করতে আর হয় না। সম্ভবত এই কারণে কলারাজ্যের মহাপুরুষদের যা-খুশি তাই করবার যে অধিকার আছে, ইতর শিল্পীদের সে অধিকার নেই। স্বর্গ হতে দেবতারা মধ্যে মধ্যে ভূতলে অবতীর্ণ হওয়াতে কেউ আপত্তি করেন না, কিন্তু মর্তবাসীদের পক্ষে রসাতলে গমন করাটা বিশেষ নিন্দনীয়। অথচ একথা অস্বীকার করবার জো নেই যে, যখন এ জগতে দশটা দিক আছে তখন সেই সব দিকেই গতায়াত করবার প্রবৃত্তিটি মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। মন উঁচুতেও উঠতে চায়, নীচুতেও নামতে চায়। বরং সত্য কথা বলতে গেলে সাধারণ লোকের মন স্বভাবতই যেখানে আছে তারই চারপাশে ঘুরে বেড়াতে চায়, উড়তেও চায় না ডুবতেও চায় না। কিন্তু সাধারণ লোকে সাধারণ লোককে কি ধর্ম, কি নীতি, কি কাব্য, সকল রাজ্যেই অহরহ ডানায় ভর দিয়ে থাকতেই পরামর্শ দেয়। একটু উঁচুতে না চড়লে আমরা দর্শক ও শ্রোতৃমন্ডলীর নয়ন মন আকর্ষণ করতে পারি নে। বেদীতে না বসলে আমাদের উপদেশ কেউ মানে না, রঙ্গমঞ্চে না চড়লে আমাদের অভিনয় কেউ দেখে না, আর কাষ্ঠমঞ্চে না দাঁড়ালে আমাদের বক্তৃতা কেউ শোনে না। সুতরাং জনসাধারণের চোখের সম্মুখে থাকবার লোভে আমরাও অগত্যা চবিবশ ঘণ্টা টঙে চড়ে থাকতে চাই, কিন্তু পারি নে। অনেকের পক্ষে নিজেদের আয়ত্তের বহির্ভূত উচ্চস্থানে ওঠবার চেষ্টাটাই মহাপতনের কারণ হয়। এসব কথা বলবার অর্থ এই যে, কষ্টকর হলেও আমাদের পক্ষে অবশ্য মহাজনদের পথ অনুসরণ করাই কর্তব্য। কিন্তু ডাইনে-বাঁয়ে ছোটখাট গলিখুঁজিতে খেলাচ্ছলে প্রবেশ করবার যে অধিকার তাদের আছে, সে অধিকারে আমরা কেন বঞ্চিত হব। গান করতে গেলেই যে সুর তারায় চড়িয়ে রাখতে হবে, কবিতা লিখতে হলেই যে মনের শুধু গভীর ও প্রখর ভাব প্রকাশ করতে হবে, এমন কোনো নিয়ম থাকা উচিত নয়। শিল্পরাজ্যে খেলা করবার প্রবৃত্তির ন্যায় অধিকারও বড়-ছোট সকলের সমান আছে। এমনকি, একথা বললেও অত্যুক্তি হয় না যে, এ পৃথিবীতে একমাত্র খেলার ময়দানে ব্রাহ্মণশূদ্রের প্রভেদ নেই। রাজার ছেলের সঙ্গে দরিদ্রের ছেলেরাও খেলায় যোগ দেবার অধিকার আছে। আমরা যদি একবার সাহস করে কেবলমাত্র খেলা করবার জন্য সাহিত্যজগতে প্রবেশ করি, তাহলে নির্বিবাদে সে জগতের রাজ-রাজড়ার দলে মিশে যাব। কোনোরূপ উচ্চ আশা নিয়ে সে ক্ষেত্রে উপস্থিত হলেই নিম্নশ্রেণীতে পড়ে যেতে হবে।
লেখকেরাও অবশ্য দশের কাছে হাততালির প্রত্যাশা রাখেন, বাহবা না পেলে মনঃক্ষুণ্ণ হন। কেননা তাঁরাই হচ্ছে যথার্থ সামাজিক জীব, বাদবাকি সকলে কেবলমাত্র পারিবারিক। বিশ্বমানবের মনের সঙ্গে নিত্য নূতন সম্বন্ধ পাতানোই হচ্ছে কবিমনের নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম। এমনকি, কবির আপন মনের গোপন কথাটিও গীতিকবিতাতে রঙ্গভূমির স্বগতোক্তি স্বরূপেই উচ্চারিত হয়, যাতে করে সেই মর্মকথা হাজার লোকের কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু উচ্চমঞ্চে আরোহণ করে উচ্চৈঃস্বরে উচ্চবাক্য না করলে যে জনসাধারণের নয়ন-মন আকর্ষণ করা যায় না এমন কোনো কথা নেই। সাহিত্যজগতে যাঁদের খেলা করবার প্রবৃত্তি আছে, সাহস আছে, ক্ষমতা আছে, মানুষের নয়ন-মন আকর্ষণ করবার সুযোগ বিশেষ করে তাঁদের কপালেই ঘটে। মানুষ যে খেলা দেখতে ভালোবাসে তার পরিচয় তো আমরা এই বড় সমাজেও নিত্য পাই। টাউনহলে বক্তৃতা শুনতেই বা ক জন যায় আর গড়ের মাঠে ফুটবল খেলা দেখতেই বা ক জন যায়। অথচ এ কথাও সত্য যে, টাউনহলের বক্তৃতার উদ্দেশ্য অতি মহৎ, আর গড়ের মাঠের খেলোয়াড়দের ছুটোছুটি, দৌড়াদৌড়ি আগাগোড়া অর্থশূন্য এবং উদ্দেশ্যবিহীন। আসল কথা এই যে, মানুষের দেহমনের সকল প্রকার ক্রিয়ার মধ্যে ক্রীড়া শ্রেষ্ঠ, কেননা তা উদ্দেশ্যহীন। মানুষে যখন খেলা করে, তখন সে এক আনন্দ ব্যতীত অপর কোনো ফলের আকাঙ্ক্ষা রাখে না। যে খেলার ভিতর আনন্দ নেই কিন্তু উপরি পাওনার আশা আছে, তার নাম খেলা নয়, জুয়াখেলা। এবং যেহেতু খেলার আনন্দ নিরর্থক অর্থগত নয়, সে কারণে তা কারও নিজস্ব হতে পারে না। এ আনন্দে সকলেই অধিকার সমান।
সুতরাং সাহিত্যে খেলা করবার অধিকার যে আমাদের আছে, শুধু তাই নয়, স্বার্থ এবং পরার্থ এ দুয়ের যুগপৎ সাধনের জন্য মনোজগতে খেলা করাই হচ্ছে আমাদের পক্ষে সর্বপ্রধান কর্তব্য। যে লেখক সাহিত্য ক্ষেত্রে ফলের চাষ করতে ব্রতী হন, যিনি কোনোরূপ কার্য-উদ্ধারের অভিপ্রায়ে লেখনী ধারণ করে, তিনি গীতের মর্মও বোঝেন না, গীতার ধর্মও বোঝেন না। কেননা খেলা হচ্ছে জীবজগতে একমাত্র নিষ্কাম কর্ম, অতএব মোক্ষলাভের একমাত্র উপায়। স্বয়ং ভগবান বলেছেন, যদিচ তাঁর কোনোই অভাব নেই তবুও তিনি এই বিশ্ব সৃজন করেছেন, অর্থাৎ সৃষ্টি তাঁর লীলামাত্র। কবির সৃষ্টিও এই বিশ্ব সৃষ্টির অনুরূপ, সে সৃজনের মূলে কোনো অভাব দূর করবার অভিপ্রায় নেই- সে সৃষ্টির মূল অন্তরাত্মার স্ফূর্তি এবং তার ফল আনন্দ। এক কথায় সাহিত্য সৃষ্টি জীবাত্মার লীলামাত্র এবং সে লীলা বিশ্বলীলার অন্তর্ভুক্ত; কেননা জীবাত্মা পরমাত্মার অঙ্গ এবং অংশ। সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেওয়া, কারও মনোরঞ্জন করা নয়। এ দুয়ের ভিতর যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ আছে, সেইটি ভুলে গেলেই লেখকেরা নিজে খেলা না করে পরের জন্য খেলনা তৈরি করতে বসেন।
সমাজের মনোরঞ্জন করতে গেলে সাহিত্য যে স্বধর্মচ্যুত হয়ে পড়ে, তার প্রমাণ বাংলাদেশে আজ দুর্লভ নয়। কাব্যের ঝুমঝুমি, বিজ্ঞানের চুষিকাঠি, দর্শনের বেলুন, রাজনীতির রাঙালাঠি, ইতিহাসের ন্যাকড়ার পুতুল, নীতির টিনের ভেঁপ এবং ধর্মের জয়ঢাক- এইসব জিনিসে সাহিত্যের বাজার ছেয়ে গেছে। সাহিত্যরাজ্যে খেলনা পেয়ে পাঠকের মনতুষ্টি হতে পারে, কিন্তু তা গড়ে লেখকের মনতুষ্টি হতে পারে না। কারণ পাঠক সমাজ যে খেলনা আজ আদর করে, কাল সেটিকে ভেঙে ফেলে। সে প্রাচ্যেই হোক আর পাশ্চাত্যই হোক, কাশীরই হোক আর জার্মানিরই হোক দুদিন ধরে তা কারও মনোরঞ্জন করতে পারে না। আমি জানি যে, পাঠক সমাজকে আনন্দ দিতে গেলে তাঁরা প্রায়শই বেদনা বোধ করে থাকেন। কিন্তু এতে ভয় পাবার কিছুই নেই; কেননা কাব্যজগতে যার নাম আনন্দ, তারই নাম বেদনা।
অপর পক্ষে এ যুগে পাঠক হচ্ছে জনসাধারণ, সুতরাং তাদের মনোরঞ্জন করতে হলে আমাদের অতি সস্তা খেলনা গড়তে হবে, নইলে তা বাজারে কাটবে না। এবং সস্তা করার অর্থ খেলো করা। বৈশ্য লেখকের পক্ষেই শূদ্র পাঠকের মনোরঞ্জন করা সংগত। অতএব সাহিত্যে আর যাই কর-না কেন পাঠক সমাজের মনোরঞ্জন করবার চেষ্টা কোরো না।
তবে কি সাহিত্যের উদ্দেশ্য লোককে শিক্ষা দেওয়া? অবশ্য নয়। কেননা কবির মতিগতি শিক্ষকের মতিগতির সম্পূর্ণ বিপরীত। স্কুল না বন্ধ হলে যে খেলার সময় আসে না, এ তো সকলেরই জানা কথা। কিন্তু সাহিত্য রচনা যে আত্মার লীলা, এ কথা শিক্ষকেরা স্বীকার করতে প্রস্ত্তত নন। সুতরাং শিক্ষা ও সাহিত্যের ধর্মকর্ম যে এক নয়, এ সত্যটি একটু স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেওয়া আবশ্যক। প্রথমত শিক্ষা হচ্ছে সেই বস্ত্ত যা লোকে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গলাধঃকরণ করতে বাধ্য হয়, অপর পক্ষে কাব্যরস লোকে শুধু স্বেচ্ছায় নয়, সানন্দে পান করে; কেননা শাস্ত্রমতে সে রস অমৃত। দ্বিতীয়ত শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে হচ্ছে মানুষের মনকে বিশ্বের খবর জানানো, সাহিত্যের উদ্দেশ্য মানুষের মনকে জাগানো; কাব্য যে সংবাদপত্র নয়, একথা সকলেই জানেন। তৃতীয়ত অপরের মনের অভাব পূর্ণ করবার উদ্দেশ্যেই শিক্ষকের হস্তে শিক্ষা জন্মলাভ করছে, কিন্তু কবির নিজের মনের পরিপূর্ণতা হতেই সাহিত্যের উৎপত্তি। সাহিত্যের উদ্দেশ্য যে আনন্দদান করা, শিক্ষাদান করা নয়, একটি উদাহরণের সাহায্যে তার অকাট্য প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে।
বাল্মীকি আদিতে মুনি-ঋষিদের জন্য রামায়ণ রচনা করেছিলেন, জনগণের জন্য নয়। একথা বলা বাহুল্য যে, বড় বড় মুনি-ঋষিদের কিঞ্চিৎ শিক্ষা দেওয়া তার উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু রামায়ণ শ্রবণ করে মহর্ষিরাও যে কতদূর আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন তার প্রমাণ তাঁরা কুশীলবকে তাঁদের যথাসর্বস্ব, এমনকি কৌপীন পর্যন্ত পেলা দিয়েছিলেন। রামায়ণ কাব্য হিসেবে যে অমর এবং জনসাধারণ আজও যে তার শ্রবণে-পঠনে আনন্দ উপভোগ করে তার একমাত্র কারণ, আনন্দের ধর্মই এই যে তা সংক্রামক। অপর পক্ষে লাখে একজনও যে যোগবিশিষ্ট রামায়ণের ছায়া মাড়ান না তার কারণ, সে বস্ত্ত লোককে শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্য রচিত হয়েছিল, আনন্দ দেবার জন্য নয়। আসল কথা এই যে, সাহিত্য কস্মিনকালেও স্কুলমাস্টিারির ভার নেয় নি। এতে দুঃখ করবার কোনো কারণ নেই। দুঃখের বিষয় এই যে, স্কুলমাস্টারেরা একালে সাহিত্যের ভার নিয়েছেন।
কাব্যরস নামক অমৃতে যে আমাদের অরুচি জন্মেছে, তার জন্য দায়ী এ যুগের স্কুল এবং তার মাস্টার। কাব্য পড়বার ও বোঝবার জিনিস, কিন্তু স্কুলমাস্টারের কাজ হচ্ছে বই পড়ানো ও বোঝানো। লেখক এবং পাঠকদের মধ্যে এক স্কুলমাস্টার দন্ডায়মান। এই মধ্যস্থদের কৃপায় আমাদের সঙ্গে কবির মনের মিলন দূরে থাক, চার চক্ষুর মিলনও ঘটে না। স্কুলঘরে আমরা কাব্যের রূপ দেখতে পাই নি, শুধু তার গুণ শুনি। টীকা-ভাষ্যের প্রসাদে আমরা কাব্য সম্বন্ধে সকল নিগূঢ় তত্ত্ব জানি, কিন্তু সে যে কী বস্ত্ত তা চিনিনে।
আমাদের শিক্ষকদের প্রসাদে আমাদের এ জ্ঞান লাভ হয়েছে যে, পাথুরে কয়লা হীরার সবর্ণ না হলেও সগোত্র : অপর পক্ষে হীরক ও কাচ যমজ হলেও সহোদর নয়। এর একের জন্ম পৃথিবীর গর্ভে, অপরটির মানুষের হাতে; এবং এ উভয়ের ভিতর এক দা-কুমড়ার সম্বন্ধে ব্যতীত অপর কোনো সম্বন্ধ নেই। অথচ এত জ্ঞান সত্ত্বেও আমরা সাহিত্যে কাচকে হীরা এবং হীরাকে কাচ বলে নিত্য ভুল করি, এবং হীরা ও সয়লাকে একশ্রেণীভুক্ত করতে তিলমাত্র দ্বিধা করিনে, কেননা ওরূপ করা যে সংগত তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আমাদের মুখস্ত আছে। সাহিত্য শিক্ষার ভার নেয় না, কেননা মনোজগতে শিক্ষকের কাজ হচ্ছে কবির কাজের ঠিক উলটো। কারণ কবির কাজ হচ্ছে কাব্য সৃষ্টি করা, আর শিক্ষকের কাজ হচ্ছে প্রথমে তা বধ করা, তারপরে তার শবচ্ছেদ করা, এবং ঐ উপায়ে তার তত্ত্ব আবিষ্কার করা ও প্রচার করা। এই সব কারণে নির্ভয়ে বলা যেতে পারে যে, কারও মনোরঞ্জন করাও সাহিত্যের কাজ নয়। কাউকে শিক্ষা দেওয়াও নয়। সাহিত্য ছেলের হাতের খেলনাও নয়, গুরুর হাতের বেতও নয়।
বিচারের সাহায্যে এই মাত্রই প্রমাণ করা যায়। তবে বস্ত্ত যে কী, তার জ্ঞান অনুভূতিসাপেক্ষ, তর্কসাপেক্ষ নয়। সাহিত্যের মানবাত্মা খেলা করে এবং সেই খেলার আনন্দ উপভোগ করে। এ কথার অর্থ যদি স্পষ্ট না হয় তাহলে কোনো সুদীর্ঘ ব্যাখ্যার দ্বারা তা স্পষ্টতর করা আমার অসাধ্য।
এই সব কথা শুনে আমার জনৈক শিক্ষাভক্ত বন্ধু এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সাহিত্য খেলাচ্ছলে শিক্ষা দেয়।
শব্দার্থ ও টীকা
রোদ্যাঁ                          -     ফ্রঁ্যাসোয়া অগুস্ত রোদ্যাঁ (১৮৪০-১৯১৭) বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি ভাস্কর। তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘নরকের দুয়ার’ ও ‘বাঘার্স অব ক্যালে’। অন্যান্য অবিনশ্বর কীর্তি- ‘চিন্তাবিদ’, ‘আদম’, ‘ইভ’। তিনি ভিক্টর হুগো, বালজাক, বার্নার্ড শ প্রমুখ বিখ্যাত সাহিত্যিকের প্রতিকৃতি নির্মাণ করেন।
শিব                            -     মহাদেব, মঙ্গলকারী দেবতা।
ইতর                           -     নীচ, অধম। এখানে নগণ্য অর্থে ব্যবহৃত।
কলারাজ্য                      -     শিল্পকলার পরিমন্ডল।
অবতীর্ণ                        -     অবতার হিসেবে মানুষের মূর্তিতে নেমেছে এমন বা নেমে আসা।
মর্তবাসী                        -     মাটির পৃথিবীর অধিবাসী।
রসাতল                        -     পুরাণে বর্ণিত ষষ্ঠ পাতাল, অধঃপাত, ধ্বংস।
গতায়াত                        -     যাতায়াত।
প্রবৃত্তি                          -     অভিরুচি, ইচ্ছা, ঝোঁক, আসক্তি।
অগত্যা                         -     অন্য উপায় না থাকায়, নিরুপায় বা বাধ্য হয়ে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও।
সুর তারায় চড়িয়ে
রাখতে হবে                   -     সুর উচ্চ সপ্তকে ধরে রাখতে হবে।
গীতিকবিতা                   -     আত্মভাবপ্রবণ কবিতা বিশেষ, লিরিক, Lyric
রঙ্গভূমি                        -     আমোদ-প্রমোদের জায়গা। অভিনয় প্রদর্শনের স্থান।
স্বগতোক্তি                     -     আপন মনে নিজে নিজে কথা বলা, অন্যের উদ্দেশ্যে বলা হয় নি এমন উক্তি।
স্বার্থ                            -     নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধি।
পরার্থ                           -     অন্যের হিত, পরোপকার।
নিষ্কাম কর্ম                    -     ফললাভের কামনা করা হয় নি এমন কাজ।
মোক্ষলাভ                      -     ভববন্ধন থেকে মুক্তি লাভ, আত্মার মুক্তি অর্জন।
জীবাত্মা                        -     প্রাণীর দেহে অবস্থানকারী আত্মা।
পরমাত্মা                        -     পরম ব্রহ্ম, ঈশ্বর, সৃষ্টিকর্তা।
মনোরঞ্জন                      -     মনের সন্তোষ সাধন।
স্বধর্মচ্যুত                      -     নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থেকে বিচ্যুত।
খেলো করা                    -     গুরুত্বহীন বা অসার করা।
বৈশ্য                           -     প্রাচীন আর্যসমাজের চতুর্বর্ণের তৃতীয় স্তর- যারা কৃষি কাজ বা ব্যবসা-বাণিজ্য করত।
শূদ্র                             -     প্রাচীন আর্যসমাজের চতুর্বর্ণের নিম্নতম শ্রেণী বা বর্ণ, অনার্য।
মতিগতি                       -     ইচ্ছা ও প্রবণতা।                                                                       
গলাধঃকরণ                   -     ভক্ষণ, পান।                                                                      
বাল্মীকি                        -     ‘রামায়ণ’ প্রণেতা বিখ্যাত ঋষি ও কবি। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের আদি কবি হিসেবে সম্মানিত। যৌবনে এঁর নাম ছিল রত্নাকর এবং পেশা ছিল দস্যুতা। জনশ্রুতি অনুসারে তিনি ব্রহ্মার উপদেশে দস্যুবৃত্তি ছেড়ে তপস্যামগ্ন হন এবং নারদের উপদেশে রামায়ণ রচনা করেন।
কুশীলব                        -     নট, অভিনেতা।                                                                      
যথাসর্বস্ব                       -     সমস্ত কিছু।                                                                      
কৌপীন                        -     ল্যাঙট।
পেলা                           -     পাঁচারী কীর্তন ইত্যাদির আসরে গায়ক-গায়িকাকে দেওয়া শ্রোতাদের পারিতোষিক।
যোগবশিষ্ঠ রামায়ণ           -     রামচন্দ্রের প্রতি বশিষ্ঠ মুনির উপদেশ সংবলিত সংস্কৃত রামায়ণ। এতে যোগ ও আত্মজ্ঞান সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় উপাখ্যানসহ উপদেশাকারে আলোচিত হয়েছে।
কস্মিনকালেও                -     কোনো সময়েই, কখনও।
টীকাভাষ্য                     -     মন্তব্যসহ ব্যাখ্যা ও মন্তব্য।
নিগূঢ়                           -     দুর্জ্ঞেয়, গভীর ও প্রচ্ছন্ন।
তত্ত্ব                             -     কোনো বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান বা বিদ্যা, মতবাদ, Theory
সবর্ণ                            -     সম রং বিশিষ্ট।                                                                      
সগোত্র                         -     একই গোত্রভুক্ত।
শবচ্ছেদ                        -     শবদেহ কেটে পরীক্ষা করা, মড়া কাটা।
অনুভূতিসাপেক্ষ               -     অনুভূতির সাহায্যে উপলব্ধি করতে হয় এমন।
তর্কসাপেক্ষ                    -     তর্কের মাধ্যমে বিচার-বিবেচনা করতে হয় এমন।

উৎস ও পরিচিতি                                                                             
প্রমথ চৌধুরীর ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার শ্রাবণ ১৩২২ বঙ্গাব্দ (১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যায়। পরে তা তাঁর ‘প্রবন্ধসংগ্রহে’ (১৯৫২) সংকলিত হয়। এই প্রবন্ধে সাহিত্যচর্চার আদর্শ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে লেখকের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট পরিচয় ফুটে উঠেছে। লেখাটি ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে এখানে মুদ্রিত হয়েছে।
প্রমথ চৌধুরীর মতে, সাহিত্যের উদ্দেশ্য হচ্চে, সকলকে আনন্দ দান করা, কারও মনোরঞ্জন করা নয়। সমাজের মনোরঞ্জন করতে গেলে সাহিত্য হয়ে পড়বে স্বধর্মচ্যুত। অন্যদিকে সাহিত্যের উদ্দেশ্য শিক্ষা দান করাও নয়। কারণ পাঠ্যবিষয় মানুষ পড়ে অনিচ্ছায় এবং বাধ্য হয়ে। পক্ষান্তরে সাহিত্যের রসাস্বাদন করে মানুষ স্বেচ্ছায় ও আনন্দে। তা ছাড়া শিক্ষার উদ্দেশ্য জ্ঞানের বিষয় জানানো; পক্ষান্তরে সাহিত্যের উদ্দেশ্য মানুষের মনে সাড়া জাগানো।
লেখকের মতে, সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা চলে খেলাধুলার। খেলাধুলায় যেমন নিছক আনন্দই প্রধান, সাহিত্যেও তাই। খেলাধুলায় যেমন আনন্দ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই, সাহিত্যের উদ্দেশ্যও তেমনি- একমাত্র আনন্দ দান করা।

প্রবাদ, প্রবচন ও বাগধারা
রসাতলে গমন                 - অধঃপাতে যাওয়া।                                                                      
ডানায় ভর দিয়ে থাকা       - শূন্যলোকে ভাসা।
উপরি পাওয়া                  - বাড়তি আয় উপার্জন।                                                                       
আকাশ-পাতাল                - বিস্তর পার্থক্য।
বাজারে কাটা                  - বিক্রি হওয়া।
মতিগতি                       - ভাবগতিক, মনের ভাব।
দা-কুমড়া সম্বন্ধ               - নিদারুণ শত্রুতার সম্পর্ক, বৈরী সম্পর্ক।

অনুশীলনমূলক কাজ
ভাষাশৈলী q প্রমথ চৌধুরীর গদ্যশৈলী                                                                       
বাংলা গদ্যের প্রমথ যুগে সাধুরীতিই প্রচলিত ছিল। আমরা যে এখন গদ্যে চলিত রীতির ব্যবহার করছি তার প্রথম প্রবক্তা, সমর্থক ও আন্দোলনকারী ছিলেন প্রমথ চৌধুরী। তাঁর আন্দোলনের প্রভাবে, পরে রবীন্দ্রনাথের মতো লেখকও চলিত গদ্যরীতিতে লিখতে শুরু করেছিলেন।                                                                      
বাংলা গদ্যে প্রমথ চৌধুরী নিজস্ব আলাদা স্টাইল তৈরি করে গেছেন। অনেক জটিল ও গুরুগম্ভীর বিষয় তিনি এমন মজলিসি ঢঙে আলোচনা করেছেন যে তাতে বিষয়বস্ত্তর গুরুত্ব হালকা হয় নি অথচ তা হয়েছে দীপ্তিময় ও আকর্ষণীয়। তাঁর রচনায় লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাতে মননশীলতার সঙ্গে রয়েছে যুক্তিতর্কের ধারালো প্রকাশ। আর বক্তব্যের তীক্ষ্ণতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যঙ্গের ঝাঁজ।
ভালোভাবে লক্ষ করলে প্রমথ চৌধুরীর পদ্যশৈলী বা স্টাইলের কিছু বৈশিষ্ট্য তোমাদের চোখে পড়বে। যেমন :
১.       কথ্য বাগভঙ্গি প্রয়োগ :
         ‘এক করতে আর হয় না’, ‘যা খুশি তাই করবার’, ‘টঙে চড়ে থাকতে চাই’, ‘সুর তারায় চড়িয়ে’, ‘বাহবা না পেলে’, ‘আর যাই কর না কেন’, ‘দা-কুমড়া সম্বন্ধ’ ইত্যাদি।
২.      প্রবাদ জাতীয় বাক্য ব্যবহার :                                                                       
         ক) যিনি গড়তে জানন, তিনি শিবও গড়তে পারেন, বাঁদরও গড়তে পারেন।
         খ) কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ।
৩.      সুভাষিত উক্তি তৈরি :                                                                      
         ক) সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেওয়া, কারও মনোরঞ্জন করা নয়।
         খ) শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মনকে বিশ্বের খবর জানানো, সাহিত্যের উদ্দেশ্য মানুষের মনকে জাগানো।
         গ) সাহিত্য ছেলের হাতের খেলনাও নয়, গুরুর হাতের বেতও নয়।
৪.      অনুপ্রাসমন্ডিত করে তরঙ্গায়িত ও ধ্বনিময় ভাষা সৃষ্টি :
         ১. তিনি গীতের মর্মও বোঝেন না, গীতার ধর্মও বোঝেন না।
         ২. পাথুরে কয়লা হীরার সবর্ণ না হলেও সগোত্র।
         ৩. লেখকেরা নিজে খেলা না করে পরের জন্য খেলনা তৈরি করে বসেন।
৫.     বাক্যের দুটি অংশে বিপরীতের সন্নিবেশ :
         ১. মন উঁচুতেও উঠতে চায়, নিচুতেও নামতে চায়।
         ২. কবির কাজ হচ্ছে কাব্য সৃষ্টি করা, আর শিক্ষকের কাজ হচ্ছে প্রথমে তা বধ করা।
         ৩. তারাই হচ্ছেন যথার্থ সামাজিক জীব, বাদবাকি সকলে কেবলমাত্র পারিবারিক।
         ৪. পাঠক সমাজ যে খেলনা আজ আদর করে, কাল সেটিকে ভেঙ্গে ফেলে।
         ৫. কাব্য জগতে যার নাম আনন্দ, তারই নাম বেদনা।
দীর্ঘ-উত্তর প্রশ্ন                                                                       
১.       ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী সাহিত্যচর্চার আদর্শ সম্পর্কে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তা নিজের ভাষায় লেখ।                                                                      
২.      প্রমথ চৌধুরী মতে সাহিত্যের উদ্দেশ্য কী? তাঁর মত তুমি কতটা সমর্থন কর?
৩.      ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধটির নামকরণের সার্থকতা বিচার কর।
বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১.       রোদ্যাঁ কে? কোন বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য লেখক তাঁর প্রসঙ্গ দিয়ে ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধটি শুরু করেছেন?
২.      শিল্পরাজ্যে কোনোরকম কার্য উদ্ধার বা উদ্দেশ্য সাধনের চেয়ে খেলা করবার ওপর লেখক বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কেন?                                                                      
৩.      শিক্ষার উদ্দেশ্য ও সাহিত্যের উদ্দেশ্যের মধ্যেকার পার্থক্য সম্পর্কে লেখকের অভিমত কী?
ভাষাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১.       ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধে বাগ্ধারা ও প্রবাদবাক্য ব্যবহারের পাঁচটি উদাহরণ দাও।
২.      ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধ থেকে এমন পাঁচটি বাক্যের উদাহরণ দাও যা সুভাষিত উক্তি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
৩.      ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধ থেকে বাক্যে দুটি অংশে বিপরীতের সন্নিবেশ ঘটেছে এমন পাঁচটি উদাহরণ দাও।
৪.      বাক্যে প্রয়োগ দেখাও :                                                                      
         জীবিতপ্রায়, এক করতে আর, দা-কুমড়া সম্বন্ধ, অমৃতে অরুচি, আকাশ-পাতাল প্রভেদ।
৫.    টীকা লেখ :
         রোদ্যাঁ, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র, বশিষ্ঠ রামায়ণ, বাল্মীকি।
ব্যাখ্যা
১.       সাহিত্যের উদ্দেশ্য ....................... মনোরঞ্জন করা নয়।
২.      শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে ...................... মানুষের মনকে জাগানো।
৩.      সাহিত্য ছেলের হাতের ......................... বেতও নয়।
৪.      সাহিত্যে মানবাত্মা খেলা করে এবং সেই খেলার আনন্দ উপভোগ করে।


View Foundation Digital Talking Library is developed and maintained by Sigma Enterprise.
Theme designed by Imtiaz
All rights are reserved. Any kind of reproduction of any mp3 files and text files is prohibited. If any organization or any person is found copying or reproducing any of the material will be punished under copy right law.