Logo Sponsored by Chowdhury and Hossain, Advanced Publications

Hoimonti Golpo



হৈমন্তী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

লেখক পরিচিতি
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অতুলনীয় ও সর্বতোমুখী প্রতিভার অধিকারী। কবিতা ছাড়াও ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, সমালোচনা, পত্রসাহিত্য, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনী, সংগীত- প্রতিটি বিভাগেই রয়েছে তাঁর অসামান্য প্রতিভার বিরলদৃষ্ট পরিচয়। এ ছাড়াও তিনি ছিলেন অনন্য চিত্রশিল্পী; সাহিত্য-পত্রিকার সম্পাদক ও দক্ষ শিক্ষা সংগঠক। ‘শান্তিনিকেতন’ ও ‘বিশ্বভারতী’ তাঁরই অবদান। মাত্র পনর বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্য ‘বনফুল’ প্রকাশিত হয়। আর ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা নিয়ে তিনি এশীয়দের মধ্যে সর্বপ্রথম সাহিত্যে ‘নোবেল পুরস্কার’ পান। বাংলা ছোটগল্পের পথিকৃৎ তিনি। তাঁর অসাধারণ ছোটগল্পগুলো প্রধানত সংকলিত হয়েছে, ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থের চারটি খন্ডে ও ‘গল্পসল্প’ গ্রন্থে। ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’, ‘বলাকা’, ‘মানসী’, ‘কল্পনা’ ইত্যাদি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থসহ তাঁর অজস্র গ্রন্থের মধ্যে আরও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘নৌকাডুবি’, ‘গোরা’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘চার অধ্যায়’, ‘শেষের কবিতা’ ইত্যাদি উপন্যাস; ‘রক্ত করবী’, ‘রাজা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘ডাকঘর’, ‘চিরকুমার সভা’, ‘বিসর্জন’ ইত্যাদি নাটক ও প্রহসন; ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’, ‘কালান্তর’, ‘পঞ্চভূত’, ‘সভ্যতার সংকট’ ইত্যাদি প্রবন্ধ; ‘বাংলা ভাষা পরিচয়’, ‘লোকসাহিত্য’, ‘সাহিত্য’, ভাষা, সাহিত্য ও শিক্ষা ইত্যাদি সম্পর্কিত আলোচনা গ্রন্থ।
রবীন্দ্রনাথের জন্ম কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মে, বাংলা ২৫ শে বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দে এবং মৃত্যু ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই আগস্ট, বাংলা ২২ শে শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে।

কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন, কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না। তিনি দেখিলেন, মেয়েটির বিবাহের বয়স পার হইয়া গেছে, কিন্তু আর কিছুদিন গেলে সেটাকে ভদ্র বা অভদ্র কোনো রকমে চাপা দিবার সময়টাও পার হইয়া যাইবে। মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে, সেইজন্যই তাড়া।
আমি ছিলাম বর। সুতরাং, বিবাহ সম্বন্ধে আমার মত যাচাই করা অনাবশ্যক ছিল। আমার কাজ আমি করিয়াছি, এফ. এ. পাশ করিয়া বৃত্তি পাইয়াছি। তাই প্রজাপতির দুই পক্ষ, কন্যাপক্ষ ও বরপক্ষ, ঘন ঘন বিচলিত হইয়া উঠিল। 
আমাদের দেশে যে-মানুষ একবার বিবাহ করিয়াছে বিবাহ সম্বন্ধে তাহার মনে আর কোনো উদ্বেগ থাকে না। নরমাংসের স্বাদ পাইলে মানুষের সম্বন্ধে বাঘের যে দশা হয়, স্ত্রীর সম্বন্ধে তাহার ভাবটা সেইরূপ হইয়া উঠে। অবস্থা যেমনি ও বয়স যতই হউক, স্ত্রীর অভাব ঘটিবামাত্র তাহা পূরণ করিয়া লইতে তাহার কোনো দ্বিধা থাকে না। যত দ্বিধা ও দুশ্চিন্তা সে দেখি আমাদের নবীন ছাত্রদের। বিবাহের পৌনঃপুনিক প্রস্তাবে তাহাদের পিতৃপক্ষের পাকা চুল কলপের আশীর্বাদে পুনঃপুনঃ কাঁচা হইয়া উঠে, আর প্রথম ঘটকালির অাঁচেই ইহাদের কাঁচা চুল ভাবনায় একরাত্রে পাকিবার উপক্রম হয়।
সত্য বলিতেছি, আমার মনে এমন বিষম উদ্বেগ জন্মে নাই। বরঞ্চ বিবাহের কথায় আমার মনের মধ্যে যেন দক্ষিণে হাওয়া দিতে লাগিল। কৌতূহলী কল্পনার কিশলয়গুলির মধ্যে একটা যেন কানাকানি পড়িয়া গেল। যাহাকে বার্কের ফ্রেঞ্জ রেভোল্যুশনের মোট পাঁচ-সাত খাতা মুখস্ত করিতে হইবে, তাহার পক্ষে এ ভাবটা দোষের। আমার এ লেখা যদি টেকস্টবুক-কমিটির অনুমোদিত হইবার কোনো আশঙ্কা থাকিত তবে সাবধান হইতাম।
কিন্তু, এক কী করিতেছি! এ কি একটা গল্প যে উপন্যাস লিখিতে বসিলাম। এমন সুরে আমার লেখা শুরু হইবে এ আমি কি জানিতাম। মনে ছিল, কয় বৎসরের বেদনার যে মেঘ কালো হইয়া জমিয়া উঠিয়াছে, তাহাকে বৈশাখ সন্ধ্যার ঝোড়ো বৃষ্টির মত প্রবল বর্ষণে নিঃশেষ করিয়া দিব। কিন্তু, না পারিলাম বাংলায় শিশুপাঠ্য বই লিখিতে, কারণ সংস্কৃত মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ আমার পড়া নাই; আর না পারিলাম কাব্য রচনা করিতে, কারণ মাতৃভাষা আমার জীবনের মধ্যে এমন পুষ্পিত হইয়া উঠে নাই যাহাতে নিজের অন্তরকে বাহিরে টানিয়া আনিতে পারি। সেইজন্যেই দেখিতেছি, আমার ভিতরকার শ্মাশানচারী সন্ন্যাসীটা অট্টহাস্যে আপনাকে আপনি পরিহাস করিতে বসিয়াছে। না করিয়া করিবে কী। তাহার যে অশ্রু শুকাইয়া গেছে। জ্যৈষ্ঠ্যের খররৌদ্রই তো জ্যৈষ্ঠের অশ্রুশূন্য রোদন।
আমার সঙ্গে যাহার বিবাহ হইয়াছিল তাহার সত্য নামটা দিব না। কারণ, পৃথিবীর ইতিহাসের তাহার নামটি লইয়া প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিবাদের কোনো আশঙ্কা নাই। যে তাম্রশাসনে তাহার নাম খোদাই করা আছে সেটা আমার হৃদয়পট। কোনোকালে সে পট এবং সে নাম বিলুপ্ত হইবে, এমন কথা আমি মনে করিতে পারি না। কিন্তু, যে অমৃতলোকে তাহা অক্ষয় হইয়া রহিল সেখানে ঐতিহাসিকের আনাগোনা নাই।
আমার এ লেখায় তাহার যেমন হউক একটা নাম চাই। আচ্ছা, তাহার নাম দিলাম শিশির। কেননা, শিশিরে কান্নাহাসি একেবারে এক হইয়া আছে, আর শিশিরে ভোরবেলাটুকুর কথা সকালবেলায় আসিয়া ফুরাইয়া যায়।
শিশির আমার চেয়ে কেবল দুই বছরের ছোট ছিল। অথচ, আমার পিতা যে গৌরীদানের পক্ষপাতী ছিলেন না তাহা নহে। তাঁহার পিতা ছিলেন উগ্রভাবে সমাজবিদ্রোহী; দেশের প্রচলিত ধর্মকর্মে কিছুতেই তাঁহার আস্থা ছিল না; তিনি কষিয়া ইংরাজি পড়িয়াছিলেন। আমার পিতা উগ্রভাবে সমাজের অনুগামী; মানিতে তাঁহার বাধে এমন জিনিস আমাদের সমাজে, সদরে বা অন্দরে, দেউড়ি বা খিড়কির পথে খুঁজিয়া পাওয়া দায়, কারণ ইনিও কষিয়া ইংরেজি পড়িয়াছিলেন। পিতামহ এবং পিতা উভয়েরই মতামত বিদ্রোহের দুই বিভিন্ন মূর্তি। কোনোটাই সরল স্বাভাবিক নহে। তবু বড়ো বয়সের মেয়ের সঙ্গে বাবা যে আমার বিবাহ দিলেন তাহার কারণ, মেয়ের বয়স বড় বলিয়াই পনের অঙ্কটাও বড়। শিশির আমার শ্বশুরের একমাত্র মেয়ে। বাবার বিশ্বাস ছিল, কন্যার পিতার সমস্ত টাকা ভাবী জামাতার ভবিষ্যতের গর্ভ পূরণ করিয়া তুলিতেছে।
আমার শ্বশুরের বিশেষ কোনো একটা মতের বালাই ছিল না। তিনি পশ্চিমের এক পাহাড়ের কোনো রাজার অধীনে বড় কাজ করিতেন। শিশির যখন কোলে তখন তাহার মার মৃত্যু হয়। মেয়ে বৎসর-অন্তে এক-এক বছর করিয়া বড় হইতেছে, তাহা আমার শ্বশুরের চোখেই পড়ে নাই। সেখানে তাঁহার সমাজের লোক এমন কেহই ছিল না যে তাঁহাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাইয়া দিবে। 
শিশিরের বয়স যথাসময়ে ষোলো হইল; কিন্তু সেটা স্বভাবের ষোলো, সমাজের ষোলো নহে। কেহ তাহাকে আপন বয়সের জন্য সতর্ক হইতে পরামর্শ দেয় নাই, সেও আপন বয়সটার দিকে ফিরিয়াও তাকাইত না।
কলেজে তৃতীয় বৎসরে পা দিয়াছি, আমার বয়স উনিশ, এমন সময় আমার বিবাহ হইল। বয়সটা সমাজের মতে বা সমাজ সংস্কারকের মতে উপযুক্ত কি না তাহা লইয়া তাহারা দুই পক্ষ লড়াই করিয়া রক্তারক্তি করিয়া মরুক, কিন্তু আমি বলিতেছি, সে বয়সটা পরীক্ষা পাশ করিবার পক্ষে যত ভাল হউক, বিবাহের সম্বন্ধ আসিবার পক্ষে কিছুমাত্র কম ভাল নয়।
বিবাহের অরুণোদয় হইল একখানি ফটোগ্রাফের আভাসে। পড়া মুখস্ত করিতেছিলাম। একজন ঠাট্টার সম্পর্কের আত্মীয়া আমার টেবিলের উপরে শিশিরের ছবিখানা রাখিয়া বলিলেন, ‘‘এইবার সত্যিকার পড়া পড়ো- একেবারে ঘাড়মোড় ভাঙিয়া।’’
কোনো এক জন আনাড়ি কারিগরের তোলা ছবি। মা ছিল না, সুতরাং কেহ তাহার চুল টানিয়া বাঁধিয়া খোঁপায় জরি জড়াইয়া, সাহা বা মল্লিক কোম্পানির জবড়জঙ জ্যাকেট পরাইয়া বরপক্ষের চোখ ভুলাইবার জন্য জালিয়াতির চেষ্টা করে নাই। ভারি একখানি সাদাসিধা মুখ, সাদাসিধা দুটি চোখ এবং সাদাসিধা একটি শাড়ি। কিন্তু, সমস্তটি লইয়া কী যে মহিমা সে আমি বলিতে পারি না। যেমন তেমন একখানি চৌকিতে বসিয়া, পিছনে একখানা ডোরা দাগ-কাটা শতরঞ্জ ঝোলানো, পাশে একটা টিপাইয়ের উপরে ফুলদানিতে ফুলের তোড়া। আর, গালিচার উপরে শাড়ির বাঁকা পাড়টির নিচে দুখানি খালি পা।
পটের ছবিটির উপর আমার মনের সোনার কাঠি লাগিতেই সে আমার জীবনের মধ্যে জাগিয়া উঠিল। সেই কালো দুটি চোখ আমার সমস্ত ভাবনার মাঝখানে কেমন করিয়া চাহিয়া রহিল। আর, বাঁকা পাড়ের নিচেকার দুখানি খালি পা আমার হৃদয়কে আপন পদ্মাসন করিয়া লইল।
পঞ্জিকার পাতা উল্টাইতে থাকিল; দুটা-তিনটা বিবাহের লগ্ন পিছাইয়া যায়, শ্বশুরের ছুটি আর মেলে না। ওদিকে সামনে একটা অকাল চার-পাঁচটা মাস জুড়িয়া আমার আইবড় বয়সের সীমানাটাকে উনিশ বছর হইতে অনর্থক বিশ বছরের দিকে ঠেলিয়া দিবার চক্রান্ত করিতেছে। শ্বশুরের এবং তাঁহার মনিবের উপর রাগ হইতে লাগিল।
যা হউক, অকালের ঠিক পূর্বলগ্নটাতে আসিয়া বিবাহের দিন ঠেকিল। সেদিনকার সানাইয়ের প্রত্যেক তানটি যে আমার মনে পড়িতেছে। সেদিনকার প্রত্যেক মুহূর্তটিকে আমি আমার সমস্ত চৈতন্য দিয়া স্পর্শ করিয়াছি। আমার সেই উনিশ বছরের বয়সটি আমার জীবনে অক্ষয় হইয়া থাক।
বিবাহসভায় চারিদিকে হট্টগোল; তাহারই মাঝখানে কন্যার কোমল হাতখানি আমার হাতের উপর পড়িল। এমন আশ্চর্য আর কী আছে। আমার মন বারবার করিয়া বলিতে লাগিল, ‘আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম।’ কাহাকে পাইলাম। এ যে দুর্লভ, এ যে মানবী, ইহার রহস্যের কি অন্ত আছে!
আমার শ্বশুরের নাম গৌরীশংকর। যে হিমালয়ে বাস করিতেন, সেই হিমালয়ের তিনি যেন মিতা। তাঁহার গাম্ভীর্যের শিখরদেশে একটি স্থির হাস্য শুভ্র হইয়াছিল। আর, তাঁহার হৃদয়ের ভিতরটিতে স্নেহের যে একটি প্রস্রবণ ছিল তাহার সন্ধান যাহারা জানিত তাহারা তাঁহাকে ছাড়িতে চাহিত না।
কর্মক্ষেত্রে ফিরিবার পূর্বে আমার শ্বশুর আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘‘বাবা, আমার মেয়েটিকে আমি সতেরো বছর ধরিয়া জানি, আর তোমাকে এই কটি দিন মাত্র জানিলাম, তবু তোমার হাতেই ও রহিল। যে ধন দিলাম তাহার মূল্য যেন বুঝিতে পার, ইহার বেশি আশীর্বাদ আর নাই।’’
তাঁহার বেহাই বেহান সকলেই তাঁহাকে বারবার করিয়া আশ্বাস দিয়া বলিলেন, ‘‘বেহাই, মনে কোনো চিন্তা রাখিয়ো না। তোমার মেয়েটি যেমন বাপকে ছাড়িয়া আসিয়াছে, এখানে তেমনি বাপ মা উভয়কেই পাইল।’’
তাহার পরে শ্বশুরমশায় মেয়ের কাছে বিদায় লইবার বেলা হাসিলেন; বলিলেন, ‘‘বুড়ি, চলিলাম। তোর একখানি মাত্র এই বাপ, আজ হইতে ইহার যদি কিছু খোয়া যায় বা চুরি যায় বা নষ্ট হয় আমি তাহার জন্য দায়ী নই।’’
মেয়ে বলিল, ‘‘তাই বই-কি। কোথাও একটু যদি লোকসান হয় তোমাকে তার ক্ষতিপূরণ করিতে হইবে।’’
অবশেষে নিত্য তাঁহার যেসব বিষয়ে বিভ্রাট ঘটে বাপকে সে সম্বন্ধে সে বারবার সতর্ক করিয়া দিল। আহার সম্বন্ধে আমার শ্বশুরের যথেষ্ট সংযম ছিল না; গুটিকয়েক অপথ্য ছিল, তাহার প্রতি তাঁহার বিশেষ আসক্তি- বাপকে সেই সমস্ত প্রলোভন হইতে যথাসম্ভব ঠেকাইয়া রাখা মেয়ের এক কাজ ছিল। তাই আজ সে বাপের হাত ধরিয়া উদবেগের সহিত বলিল, ‘‘বাবা, তুমি আমার কথা রেখো- রাখবে?’’
বাবা হাসিয়া কহিলেন, ‘‘মানুষ পণ করে পণ ভাঙিয়া ফেলিয়া হাঁফ ছাড়িবার জন্য। অতএব কথা না দেওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ।’’
তাহার পরে বাপ চলিয়া আসিলে ঘরে কপাট পড়িল। তাহার পরে কী হইল কেহ জানে না।
বাপ ও মেয়ের অশ্রুহীন বিদায় ব্যাপার পাশের ঘর হইতে কৌতূহলী অন্তঃপুরিকার দল দেখিল ও শুনিল। অবাক কান্ড! খোট্টার দেশে থাকিয়া খোট্টা হইয়া গিয়াছে! মায়া মমতা একেবারে নাই!
আমার শ্বশুরের বন্ধু বনমালীবাবুই আমাদের বিবাহের ঘটকালি করিয়াছিলেন। তিনি আমাদের পরিবারেরও পরিচিত। তিনি আমার শ্বশুরকে বলিয়াছিলেন, ‘‘সংসারে তোমার তো ঐ একটি মেয়ে। এখন ইহাদেরই পাশে বাড়ি লইয়া এইখানেই জীবনটা কাটাও।’’    
তিনি বলিলেন, ‘‘যাহা দিলাম তাহা উজাড় করিয়াই দিলাম। এখন ফিরিয়া তাকাইতে গেলে দুঃখ পাইতে হইবে। অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই।’’
সব শেষে আমাকে নিভৃতে লইয়া গিয়া অপরাধীর মতো সসংকোছে বলিলেন, ‘‘আমার মেয়েটির বই পড়িবার শখ, এবং লোকজনকে খাওয়াইতে ও বড় ভালোবাসে। এজন্য বেহাইকে বিরক্ত করিতে ইচ্ছা করি না। আমি মাঝে মাঝে তোমাকে টাকা পাঠাইব। তোমার বাবা জানিতে পারিলে কি রাগ করিবেন?’’
প্রশ্ন শুনিয়া কিছু আশ্চর্য হইলাম। সংসারে কোনো একটা দিক হইতে অর্থসমাগম হইলে বাবা রাগ করিবেন, তাঁহার মেজাজ এত খারাপ তো দেখি নাই।   
যেন ঘুষ দিতেছেন এমনিভাবে আমার হাতে একখানা একশো টাকার নোট গুঁজিয়া দিয়াই আমার শ্বশুর দ্রুত প্রস্থান করিলেন; আমার প্রণাম লইবার জন্য সবুর করিলেন না। পিছন হইতে দেখিতে পাইলাম, এইবার পকেট হইতে রুমাল বাহির হইল।
আমি স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম। মনে বুঝিলাম, ইহারা অন্য জাতের মানুষ।
বন্ধুদের অনেককেই তো বিবাহ করিতে দেখিলাম। মন্ত্র পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্ত্রীটিকে একেবারে এক গ্রাসে গলাধঃকরণ করা হয়। পাকযন্ত্রে পৌঁছিয়া কিছুক্ষণ বাদে এই পদার্থটির নানা গুণাগুণ প্রকাশ হইতে পারে এবং ক্ষণে ক্ষণে আভ্যন্তরিক উদবেগ উপস্থিত হইয়াও থাকে, কিন্তু রাস্তাটুকুতে কোথাও কিছুমাত্র বাধে না। আমি কিন্তু বিবাহ সভাতেই বুঝিয়াছিলাম, দানের মন্ত্রে স্ত্রীকে যেটুকু পাওয়া যায় তাহাতে সংসার চলে, কিন্তু পনেরো আনা বাকি থাকিয়া যায়। আমার সন্দেহ হয়, অধিকাংশ লোকে স্ত্রীকে বিবাহমাত্র করে, পায় না এবং জানেও না যে পায় নাই; তাহাদের স্ত্রীর কাছেও আমৃত্যুকাল এ খবর ধরা পড়ে না। কিন্তু সে যে আমার সাধনার ধন ছিল; সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ।
শিশির- না, এ নামটা আর ব্যবহার করা চলিল না। একে তো এটা তাহার নাম নয়, তাহাতে এটা তাহার পরিচয়ও নহে। সে সূর্যের মত ধ্রুব; সে ক্ষণজীবিনী ঊষার বিদায়ের অশ্রুবিন্দুটি নয়। কী হইবে গোপন রাখিয়া, তাহার আসল নাম হৈমন্তী।
দেখিলাম, এই সতেরো বছরের মেয়েটির উপরে যৌবনের সমস্ত আলো আসিয়া পড়িয়াছে, কিন্তু এখনো কৈশোরের কোল হইতে সে জাগিয়া উঠে নাই। ঠিক যেন শৈলচূড়ার বরফের উপর সকালের আলো ঠিকরিয়া পড়িয়াছে, কিন্তু বরফ এখনো গলিল না। আমি জানি, কী অকলঙ্ক শুভ্র সে, কী নিবিড় পবিত্র!
আমার মনে একটা ভাবনা ছিল যে, লেখাপড়া জানা বড়ো মেয়ে, কী জানি কেমন করিয়া তাহার মন পাইতে হইবে। কিন্তু অতি অল্পদিনেই দেখিলাম, মনের রাস্তার সঙ্গে বইয়ের দোকানের রাস্তার কোনো জায়গায় কোনো কাটাকাটি নাই। কবে যে তাহার সাদা মনটির উপরে একটু রং ধরিল, চোখে একটু ঘোর লাগিল, কবে যে তাহার সমস্ত শরীর মন যেন উৎসুক হইয়া উঠিল, তাহা ঠিক করিয়া বলিতে পারিব না।
এ তো গেল এক দিকের কথা। আবার অন্য দিকও আছে, সেটা বিস্তারিত বলিবার সময় আসিয়াছে।
রাজসংসারে আমার শ্বশুরের চাকরি। ব্যাঙ্কে যে তাঁহার কত টাকা জমিল সে সম্বন্ধে জনশ্রুতি নানাপ্রকার অঙ্কপাত করিয়াছে, কিন্তু কোনো অঙ্কটাই লাখের নিচে নামে নাই। ইহার ফল হইয়াছিল এই যে, তাহার পিতার দর যেমন-যেমন বাড়িল, হৈমর আদরও তেমনি বাড়িতে লাগিল। আমাদের ঘরের কাজকর্ম রীতিপদ্ধতি শিখিয়া লইবার জন্য সে ব্যগ্র, কিন্তু মা তাহাকে অত্যন্ত স্নেহে কিছুতেই হাত দিতে দিলেন না। এমন কি, হৈমর সঙ্গে পাহাড় হইতে যে দাসী আসিয়াছিল যদিও তাহাকে নিজেদের ঘরে ঢুকিতে দিতেন না, তবু তাহার জাত সম্বন্ধে প্রশ্নমাত্র করিলেন না, পাছে বিশ্রী একটা উত্তর শুনিতে হয়।
এমনিভাবেই দিন চলিয়া যাইতে পারিত, কিন্তু হঠাৎ এক দিন বাবার মুখ ঘোর অন্ধকার দেখা গেল। ব্যাপারখানা এই- আমার বিবাহে আমার শ্বশুর পনেরো হাজার টাকা নগদ এবং পাঁচ হাজার টাকার গহনা দিয়াছিলেন। বাবা তাঁহার এক দালাল বন্ধুর কাছে খবর পাইয়াছেন, ইহার মধ্যে পনেরো হাজার টাকাই ধার করিয়া সংগ্রহ করিতে হইয়াছে, তাহার সুদও নিতান্ত সামান্য নহে। লাখ টাকার গুজব তো একেবারেই ফাঁকি।                                                               
যদিও আমার শ্বশুরের সম্পত্তির পরিমাণ সম্বন্ধে আমার বাবার সঙ্গে তাঁহার কোনোদিন কোনো আলোচনাই হয় নাই, তবু বাবা জানি না কোন যুক্তিতে ঠিক করিলেন, তাঁহার বেহাই তাঁহাকে ইচ্ছাপূর্বক প্রবঞ্চনা করিয়াছেন।
তার পরে, বাবার একটা ধারণা ছিল, আমার শ্বশুর রাজার প্রধানমন্ত্রী গোছের একটা-কিছু। খবর লইয়া জানিলেন, তিনি সেখানকার শিক্ষাবিভাগের অধ্যক্ষ। বাবা বলিলেন, অর্থাৎ ইস্কুলের হেডমাস্টার- সংসারে ভদ্র পদ যতগুলো আছে তাহার মধ্যে সবচেয়ে ওঁচা। আবার বড় আশা ছিল, শ্বশুর  আজ বাদে কাল কাজে  অবসর লইবেন তখন আমিই রাজমন্ত্রী হইব।
এমন সময় রাস-উপলক্ষে দেশের কুটুম্বরা আমাদের কলিকাতার বাড়িতে আসিয়া জমা হইলেন। কন্যাকে দেখিয়া তাঁহাদের মধ্যে একটা কানাকানি পড়িয়া গেল। কানাকানি ক্রমে অস্ফুট হইতে স্ফুট হইয়া উঠিল। দূর সম্পর্কের কোনো এক দিদিমা বলিয় উঠিলেন, ‘‘পোড়া কপাল আমার! নাতবউ যে বয়সে আমাকেও হার মানাইল।’’
আর-এক দিদিমাশ্রেণীয়া বলিলেন, ‘‘আমাদের যদি হার না মাইবে তবে অপু বাহির হইতে বউ আনিতে যাইবে কেন?’’
আমার মা খুব জোরের সঙ্গে বলিয়া উঠিলেন, ‘‘ওমা, সে কী কথা। বউমার বয়স সবে এগারো বই তো নয়, এই আসছে ফাল্গুনে বারোয় পা দিবে। খোট্টার দেশে ডালরুটি খাইয়া মানুষ, তাই অমন বাড়ন্ত হইয়া উঠিয়াছে।’’                                                                                  
দিদিমারা বলিলেন, ‘‘বাছা, এখনো চোখে এত কম তো দেখি না। কন্যাপক্ষ নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে বয়স ভাঁড়াইয়াছে।’’
মা বলিলেন, ‘‘আমরা যে কোষ্ঠি দেখিলাম।’’
কথাটা সত্য। কিন্তু কোষ্ঠিতেই প্রমাণ আছে, মেয়ের বয়স সতেরো।
প্রবীণারা বলিলেন, ‘‘কোষ্ঠিতে কি আর ফাঁকি চলে না?’’
এই লইয়া ঘোর তর্ক, এমনকি, বিবাদ হইয়া গেল।
এমন সময় সেখানে হৈম আসিয়া উপস্থিত। কোনো এক দিদিমা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘‘নাতবউ, তোমার বয়স কত বলো তো?’’

মা তাহাকে চোখ টিপিয়া ইশারা করিলেন। হৈম তাহার অর্থ বুঝিল না। বলিল, ‘‘সতেরো।’’
মা ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘‘তুমি জান না।’’
হৈম কহিল, ‘‘আমি জানি, আমার বয়স সতেরো।’’
দিদিমারা পরস্পর গা-টেপাটেপি করিলেন।
বধূর নির্বুদ্ধিতায় রাগিয়া উঠিয়া মা বলিলেন, ‘‘তুমি তো সব জান! তোমার বাবা যে বলিলেন, তোমার বয়স এগারো।’’ হৈম চমকিয়া কহিল, ‘‘বাবা বলিয়াছেন? কখনো না।’’
মা কহিলেন, ‘‘অবাক করিল। বেহাই আমার সামনে নিজের মুখে বলিলেন, আর মেয়ে বলে ‘কখনো না’।’’ এই বলিয়া আর একবার চোখ টিপিলেন।
এবার হৈম ইশারার মানে বুঝিল। স্বর আরো দৃঢ় করিয়া বলিল, ‘‘বাবা এমন কথা কখনোই বলিতে পারেন না।’’
মা গলা চড়াইয়া বলিলেন, ‘‘তুই আমাকে মিথ্যাবাদী বলিতে চাস?’’
হৈম বলিল, ‘‘আমার বাবা তো কখনোই মিথ্যা বলেন না।’’
ইহার পরে মা যতই গালি দিতে লাগিলেন, কথাটার কালি ততই গড়াইয়া ছড়াইয়া চারিদিকে লেপিয়া গেল।
মা রাগ করিয়া বাবার কাছে তাঁহার বধূর মূঢ়তা এবং ততোধিক একগুঁয়েমির কথা বলিয়া দিলেন। বাবা হৈমকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘‘আইবড় মেয়ের বয়স সতেরো, এটা কি খুব একটা গৌরবের কথা, তাই ঢাক পিটিয়া বেড়াইতে হইবে? আমাদের এখানে এসব চলিবে না, বলিয়া রাখিতেছি।’’
হায় রে, তাঁহার বউমার প্রতি বাবার সেই মধুমাখা পঞ্চম স্বর আজ একেবারে এমন বাজখাঁই খাদে নাবিল কেমন করিয়া।
হৈম ব্যথিত হইয়া প্রশ্ন করিল, ‘‘কেহ যদি বয়স জিজ্ঞাসা করে, কী বলিব?’’
বাবা বলিলেন, ‘‘মিথ্যা বলিবার দরকার নাই, তুমি বলিও আমি জানি না, আমার শাশুড়ি জানেন।’’
কেমন করিয়া মিথ্যা বলিতে না হয় সেই উপদেশ শুনিয়া হৈম এমনভাবে চুপ করিয়া রহিল যে বাবা বুঝিলেন, তাঁহার সদুপদেশটা একেবারে বাজে খরচ হইল।


হৈমর দুর্গতিতে দুঃখ করিব কী, তাহার কাছে আমার মাথা হেঁট হইয়া গেল। সেদিন দেখিলাম, শরৎপ্রভাতের আকাশের মতো তাহার চোখের সেই সরল উদাস দৃষ্টি একটা কী সংশয়ে ম্লান হইয়া গেছে। ভীত হরিণীর মতো সে আমার মুখের দিকে চাহিল। ভাবিল, ‘আমি ইহাদিগকে চিনি না।’
সেদিন একখানা শৌখিন বাঁধাই করা ইংরেজি কবিতার বই তাহার জন্য কিনিয়া আনিয়াছিলাম। বইখানি সে হাতে করিয়া লইল এবং আস্তে আস্তে কোলের উপর রাখিয়া দিল, একবার খুলিয়াও দেখিল না।
আমি তাহার হাতখানি তুলিয়া ধরিয়া বলিলাম, ‘‘হৈম, আমার উপর রাগ করিয়ো না। আমি তোমার সত্যে কখনো আঘাত করিব না, আমি যে তোমার সত্যের বাঁধনে বাঁধা।’’
হৈম কিছু না বলিয়া একটুখানি হাসিল। সে হাসি বিধাতা যাহাকে দিয়াছেন তাহার কোনো কথা বলিবার দরকার নাই।
পিতার আর্থিক উন্নতির পর হইতে দেবতার অনুগ্রহকে স্থায়ী করিবার জন্য নূতন উৎসাহে আমাদের বাড়িতে পূজার্চনা চলিতেছে। এ পর্যন্ত যে সমস্ত ক্রিয়াকর্মে বাড়ির বধূকে ডাক পড়ে নাই। নূতন বধূর প্রতি একদিন পূজা সাজাইবার আদেশ হইল; সে বলিল, ‘‘মা, বলিয়া দাও কী করিতে হইবে?’’
ইহাতে কাহারও মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িবার কথা নয়, কারণ সকলেরই জানা ছিল, মাতৃহীন কন্যা প্রবাসে মানুষ। কিন্তু কেবলমাত্র হৈমকে লজ্জিত করাই এই আদেশের হেতু। সকলেই গালে হাত দিয়া বলিল,    ‘‘ওমা, এ কী কান্ড!  এ কোন নাস্তিকের ঘরের মেয়ে। এবার এ সংসার হইতে লক্ষ্মী ছাড়িল, আর দেরি নাই।’’
এই উপলক্ষে হৈমর বাপের উদ্দেশ্যে যাহা-না বলিবার তাহা বলা হইল। যখন হইতে কটু কথার হাওয়া দিয়াছে, হৈম একেবারে চুপ করিয়া সমস্ত সহ্য করিয়াছে। একদিনের জন্য কাহারও সামনে সে চোখের জলও ফেলে নাই। আজ তাহার বড় বড় দুই চোখ ভাসাইয়া দিয়া জল পড়িতে লাগিল। সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘‘আপনারা জানেন- সে দেশে আমার বাবাকে সকলে ঋষি বলে?’’ ঋষি বলে! ভারি একটা হাসি পড়িয়া গেল। ইহার পরে তাহার পিতার উল্লেখ করিতে প্রায়ই বলা হইত, তোমার ঋষিবাবা! এই মেয়েটির সকলের চেয়ে দরদের জায়গাটি যে কোথায় তাহা আমাদের সংসার বুঝিয়া লইয়াছিল।
বস্ত্তত, আমার শ্বশুর ব্রাহ্মও নন, খ্রিষ্টানও নন, হয়তো বা নাস্তিকও না হইবেন। দেবার্চনার কথা কোনোদিন তিনি চিন্তাও করেন  নাই। মেয়েকে তিনি অনেক পড়াইয়াছেন- শুনাইয়াছেন, কিন্তু কোনোদিনের জন্য দেবতা সম্বন্ধে তিনি তাহাকে কোনো উপদেশ দেন নাই। বনমালীবাবু এ লইয়া তাঁহাকে একবার প্রশ্ন  করিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন, ‘‘আমি যাহা বুঝি না, তাহা শিখাইতে গেলে কেবল কপটতা শেখানো হইবে।’’
অন্তঃপুরে হৈমর একটি প্রকৃত ভক্ত ছিল, সে আমার ছোট বোন নারানী। বউদিদিকে ভালোবাসে বলিয়া তাহাকে অনেক গঞ্জনা সহিতে হইয়াছিল। সংসারযাত্রায় হৈমর সমস্ত অপমানের পালা আমি তাহার কাছেই শুনিতে পাইতাম। একদিনের জন্যও আমি হৈমর কাছে শুনি নাই। এ সব কথা সংকোচে সে মুখে আনিতে পারিত না। সে সংকোচ নিজের জন্য নহে।
হৈম তাহার বাপের কাছ হইতে যত চিঠি পাইত সমস্ত আমাকে পড়িতে দিত। চিঠিগুলি ছোট কিন্তু রসে ভরা। সেও বাপকে যত চিঠি লিখিত সমস্ত আমাকে দেখাইত। বাপের সঙ্গে তাহার সম্বন্ধটিকে আমার সঙ্গে ভাগ করিয়া না লইলে তাহার দাম্পত্য যে পূর্ণ হইতে পারিত না। তাহার চিঠিতে শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে কোনো নালিশের ইশারাটুকুও ছিল না। থাকিলে বিপদ ঘটিতে পারিত। নারানীর কাছে শুনিয়াছি, শ্বশুরবাড়ির কথা কী লেখে জানিবার জন্য মাঝে মাঝে তাহার চিঠি খোলা হইত।
চিঠির মধ্যে অপরাধের কোনো প্রমাণ না পাইয়া উপরওয়ালাদের মন যে শান্ত হইয়াছিল তাহা নহে। বোধ করি তাহাতে তাঁহারা আশাভঙ্গের দুঃখই পাইয়াছিলেন। বিষম বিরক্ত হইয়া তাঁহারা বলিতে লাগিলেন, ‘‘এত ঘন ঘন চিঠিই বা কিসের জন্য? বাপই যেন সব, আমরা কি কেহ নই?’’
এই লইয়া অনেক অপ্রিয় কথা চলিতে লাগিল। আমি ক্ষুব্ধ হইয়া হৈমকে বলিলাম, ‘‘তোমার বাবার চিঠি আর-কাহাকেও না দিয়া আমাকেই দিয়ো। কলেজে যাইবার সময় আমি পোস্ট করিয়া দিব।’’
হৈম বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘‘কেন?’’
আমি লজ্জায় তাহার উত্তর দিলাম না।
বাড়িতে এখন সকলে বলিতে আরম্ভ করিল, ‘‘এইবার অপুর মাথা খাওয়া হইল। বি.এ. ডিগ্রি শিকায় তোলা রহিল। ছেলেরই বা দোষ কী?’’
সে তো বটেই। দোষ সমস্তই হৈমর। তাহার দোষ যে তাহার বয়েস সতেরো; তাহার দোষ যে আমি তাহাকে ভালোবাসি; তাহার দোষ যে বিধাতার এই বিধি, তাই আমার হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সমস্ত আকাশ আজি বাঁশি বাজাইতেছে।
বি.এ. ডিগ্রি অকাতরচিত্তে আমি চুলায় দিতে পারিতাম কিন্তু হৈমর কল্যাণে পণ করিলাম, পাশ করিবই এবং ভালো করিয়াই পাশ করিব। এ পণ রক্ষা করা আমার সে অবস্থায় যে সম্ভবপর বোধ হইয়াছিল তাহার দুইটি কারণ ছিল- এক তো হৈমর ভালোবাসার মধ্যে এমন একটি আকাশের বিস্তার ছিল যে, সংকীর্ণ আসক্তির মধ্যে সে মনকে জড়াইয়া রাখিত না, সেই ভালোবাসার চারিদিকে ভারি একটি স্বাস্থ্যকর হাওয়া বহিত। দ্বিতীয়, পরীক্ষার জন্য যে বইগুলো পড়ার প্রয়োজন তাহা হৈমর সঙ্গে একত্রে মিলিয়া পড়া অসম্ভব ছিল না।
পরীক্ষা পাশের উদযোগে কোমর বাঁধিয়া লাগিলাম। একদিন রবিবার মধ্যাহ্নে বাহিরের ঘরে বসিয়া মার্টিনোর চরিত্রতত্ত্ব বইখানির বিশেষ লাইনের মধ্যপথগুলো ফাড়িয়া ফেলিয়া নীল পেন্সিলের লাঙল চালাইতেছিলাম, এমন সময় বাহিরের দিকে হঠাৎ আমার চোখ পড়িল।
আমার ঘরে সম্মুখে আঙিনার উত্তর দিকে অন্তঃপুরে উঠিবার একটা সিঁড়ি। তাহারাই গায়ে গায়ে মাঝে মাঝে গরাদে-দেওয়া এক একটা জানলা। দেখি তাহারই একটি জানলায় হৈম চুপ করিয়া বসিয়া পশ্চিমের দিকে চাহিয়া। সেদিকে মল্লিকদের বাগানে কাঞ্চনগাছ গোলাপি ফুলে আচ্ছন্ন।
আমার বুকে ধক্ করিয়া একটা ধাক্কা দিল; মনের মধ্যে একটা অনবধানতার আবরণ ছিঁড়িয়া পড়িয়া গেল। এই নিঃশব্দ গভীর বেদনার রূপটি আমি এতদিন এমন স্পষ্ট করিয়া দেখি নাই!
কিন্তু না, আমি কেবল তাহার বসিবার ভঙ্গিটুকু দেখিতে পাইতেছিলাম। কোলের উপরে একটি হাতের উপর আর একটি হাত স্থির পড়িয়া আছে, মাথাটি দেয়ালের উপরে হেলানো, খোলা চুল বাম কাঁধের উপর দিয়া বুকের উপর ঝুলিয়া পড়িয়াছে। আমার বুকের ভিতরটা হু হু করিয়া উঠিল।
আমার নিজের জীবনটা এমনি কানায় কানায় ভরিয়াছে যে, আমি কোথাও কোনো শূন্যতা লক্ষ করিতে পারি নাই। আজ হঠাৎ আমার অত্যন্ত নিকটে অতি বৃহৎ একটা নৈরাশ্যের গহবর দেখিতে পাইলাম। কেমন করিয়া কী দিয়া আমি তাহা পূরণ করিব? আমাকে তো কিছুই ছাড়িতে হয় নাই। না আত্মীয়, না অভ্যাস, না কিছু। হৈম যে সমস্ত ফেলিয়া আমার কাছে আসিয়াছে। সেটা কতখানি তাহা আমি ভালো করিয়া ভাবি নাই।
আমাদের সংসারে অপমানের কণ্টকশয়নে সে বসিয়া; সে শয়ন আমিও তাহার সঙ্গে ভাগ করিয়া লইয়াছি। সেই দুঃখে হৈমর সঙ্গে আমার যোগ ছিল, তাহাতে আমাদিগকে পৃথক করে নাই। কিন্তু, এই গিরিনন্দিনী সতেরো বৎসর-কাল অন্তরে বাহিরে কত বড় একটা মুক্তির মধ্যে মানুষ হইয়াছে। কী নির্মল সত্যে এবং উদার আলোকে তাহার প্রকৃতি এমন ঋজু শুভ্র ও সবল হইয়া উঠিয়াছে। তাহা হইতে হৈম যে কীরূপ নিরতিশয় ও নিষ্ঠুররূপে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে এতদিন তাহা আমি সম্পূর্ণ অনুভব করিতে পারি না, কেননা সেখানে তাহার সঙ্গে আমার সমান আসন ছিল না।
হৈম যে অন্তরে মুহূর্তে মুহূর্তে মরিতেছিল। তাহাকে আমি সব দিতে পারি কিন্তু মুক্তি দিতে পারি না- তাহা আমার নিজের মধ্যে কোথায়? সেই জন্যই কলিকাতার গলিতে ঐ গরাদের ফাঁক দিয়া নির্বাক আকাশের সঙ্গে তাহার নির্বাক মনের কথা হয়; এবং এক এক দিন রাত্রে হঠাৎ জাগিয়া উঠিয়া দেখি, সে বিছানায় নাই; হাতের উপর মাথা রাখিয়া আকাশ-ভরা তারার দিকে মুখ তুলিয়া ছাদে শুইয়া আছে।
মার্টিনো পড়িয়া রহিল। ভাবিতে লাগিলাম, কী করি! শিশুকাল হইতে বাবার কাছে আমার সংকোচের অন্ত ছিল না, কখনো মুখোমুখি তাঁহার কাছে দরবার করিবার সাহস বা অভ্যাস আমার ছিল না। সেদিন থাকিতে পারিলাম না। লজ্জার মাথা খাইয়া তাঁহাকে বলিয়া বসিলাম, ‘‘বউয়ের শরীর ভালো নয়, তাহাকে একবার বাপের কাছে পাঠাইলে হয়।’’
বাবা তো একেবারে হতবুদ্ধি। মনে লেশমাত্র সন্দেহ রহিল না যে, হৈমই এইরূপ অভুতপূর্ব স্পর্ধায় আমাকে প্রবর্তিত করিয়াছে। তখনই তিনি উঠিয়া অন্তঃপুরে গিয়া হৈমকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘‘বলি, বউমা, তোমার অসুখটা কিসের?’’ হৈম বলিল, ‘‘অসুখ তো নাই।’’
বাবা ভাবিলেন, এ উত্তরটা তেজ দেখাইবার জন্য।
কিন্তু, হৈমর শরীর যে দিনে দিনে শুকাইয়া যাইতেছিল তাহা আমরা প্রতিদিনের অভ্যাসবশতই বুঝি নাই। একদিন বনমালীবাবু তাহাকে দেখিয়া চমকিয়া উঠিলেন, ‘‘অ্যাঁ, এ কী! হৈমী, এ কেমন চেহারা তোর! অসুখ করে নাই তো?’’
হৈম কহিল, ‘‘না।’’
এই ঘটনার দিন দশেক পরেই বলা নাই, কহা নাই, হঠাৎ আমার শ্বশুর আসিয়া উপস্থিত। হৈমর শরীরের কথাটা নিশ্চয় বনমালীবাবু তাঁহাকে লিখিয়াছিলেন।
বিবাহের পর বাপের কাছে বিদায় লইবার সময় মেয়ে আপনার অশ্রু চাপিয়া নিয়াছিল। এবার মিলনের দিন বাপ যেমনি তাহার চিবুক ধরিয়া মুখটি তুলিয়া ধরিলেন অমনি হৈমর চোখের জল আর বাধা মানিল না। বাপ একটি কথা বলিতে পারিলেন না; জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করিলেন না, ‘কেমন আছিস।’ আমার শ্বশুর তাঁহার মেয়ের মুখে এমন একটা কিছু দেখিয়াছিলেন যাহাতে তাঁহার বুক ফাটিয়া গেল।
হৈম বাবার হাত ধরিয়া তাঁহাকে শোবার ঘরে লইয়া গেল। অনেক কথা যে জিজ্ঞাসা করিবার আছে। তাহার বাবারও যে শরীর ভালো দেখাইতেছে না।
বাবা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘‘বুড়ি, আমার সঙ্গে যাবি?’’
হৈম কাঙালের মতো বলিয়া উঠল, ‘‘যাব।’’
বাপ বলিলেন, ‘‘আচ্ছা, সব ঠিক করিতেছি।’’
শ্বশুর যদি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়া না থাকিতেন তাহা হইলে এ বাড়িতে ঢুকিয়াই বুঝিতে পারিতেন, এখানে তাঁহার আর সেদিন নাই। হঠাৎ তাঁহার আবির্ভাবকে উপদ্রব মনে করিয়া বাব তো ভালো করিয়া কথাই কহিলেন না। আমার শ্বশুরের মনে ছিল তাঁহার বেহাই একদা তাঁহাকে বারবার আশ্বাস দিয়াছিলেন যে, যখন তাঁহার খুশি মেয়েকে তিনি বাড়ি লইয়া যাইতে পারিবেন। এ সত্যের অন্যথা হইতে পারে সে কথা তিনি মনেও আনিতে পারেন নাই।
বাবা তামাক টানিতে টানিতে বলিলেন, ‘‘বেহাই, আমি তো কিছু বলিতে পারি না। একবার তাহলে বাড়ির মধ্যে-’’
বাড়ির-মধ্যের উপর বরাত দেওয়ার অর্থ কী আমার জানা ছিল। বুঝিলাম, কিছু হইবে না। কিছু হইলও না। বউমার শরীর ভালো নাই! এত বড় অন্যায় অপবাদ।
শ্বশুরমশায় স্বয়ং এক জন ভালো ডাক্তার আনিয়া পরীক্ষা করাইলেন। ডাক্তার বলিলেন, ‘‘বায়ু পরিবর্তন আবশ্যক, নহিলে হঠাৎ একটা শক্ত ব্যামো হইতে পারে।’’
বাবা হাসিয়া কহিলেন, ‘‘হঠাৎ একটা শক্ত ব্যামো তো সকলেরই হইতে পারে। এটা কি আবার একটা কথা।’’
আমার শ্বশুর কহিলেন, ‘‘জানেন তো উকি একজন প্রসিদ্ধ ডাক্তার, উহার কথাটা কি-’’
বাবা কহিলেন, ‘‘অমন ঢের ডাক্তার দেখিয়াছি। দক্ষিণার জোরে সকল পন্ডিতেরই কাছে সব বিধান মেলে এবং সকল ডাক্তারেরই কাছে সব রোগের সার্টিফিকেট পাওয়া যায়।’’
এই কথাটা শুনিয়া আমার শ্বশুর একেবারে স্তব্ধ হইয়া গেলেন। হৈম বুঝিল, তাহার বাবার প্রস্তাব অপমানের সহিত অগ্রাহ্য হইয়াছে। তাহার মন একেবারে কাঠ হইয়া গেল।
আমি আর সহিতে পারিলাম না। বাবার কাছে গিয়া বলিলাম, ‘‘হৈমকে আমি লইয়া যাইব।’’
বাবা গর্জিয়া উঠিলেন, ‘‘বটে রে-’’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
বন্ধুরা কেহ কেহ আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, যাহা বলিলাম তাহা করিলাম না কেন। স্ত্রীকে লইয়া জোর করিয়া বাহির হইয়া গেলেই তো হইত। গেলাম না কেন? কেন! যদি লোকধর্মের কাছে সত্যধর্মকে না ঠেলিব, যদি ঘরের কাছে ঘরের মানুষকে বলি দিতে না পারিব, তবে আমার রক্তের মধ্যে বহু যুগের যে শিক্ষা তাহা কী করিতে আছে। জান তোমরা? যেদিন অযোধ্যার লোকেরা সীতাকে বিসর্জন দিবার দাবি করিয়াছিল তাহার মধ্যে আমিও ছিলাম। আর সেই বিসর্জনের গৌরবের কথা যুগে যুগে যাহারা গান করিয়া আসিয়াছে আমিও যে তাহাদের মধ্যে একজন। আর, আমিও তো সেদিন লোকরঞ্জনের জন্য স্ত্রী পরিত্যাগের গুণ বর্ণনা করিয়া মাসিকপত্রে প্রবন্ধ লিখিয়াছি। বুকের রক্ত দিয়া আমাকে যে একদিন দ্বিতীয় সীতা-বিসর্জনের কাহিনী লিখিতে হইবে সে কথা কে জানিত।
পিতায় কন্যায় আর একবার বিদায়ের ক্ষণ উপস্থিত হইল। এইবারেও দুইজনেরই মুখে হাসি। কন্যা হাসিতে হাসিতেই ভৎর্সনা করিয়া বলিল, ‘‘বাবা, আর যদি কখনো তুমি আমাকে দেখবার জন্য এমন ছুটাছুটি করিয়া এ বাড়িতে আস তবে আমি ঘরে কপাট দিব।’’
বাপ হাসিতে হাসিতেই বলিলেন, ‘‘ফের যদি আসি, তবে সিঁধকাটি সঙ্গে করিয়াই আসিব।’’
ইহার পরে হৈমর মুখে তাহার চিরদিনের সেই স্নিগ্ধ হাসিটুকু আর একদিনের জন্যও দেখি নাই। তাহারও পরে কী হইল সেকথা আর বলিতে পারিব না।
শুনিতেছি মা পাত্রী সন্ধান করিতেছেন। হয়তো একদিন মার অনুরোধ অগ্রাহ্য করিতে পারিব না, ইহাও সম্ভব হইতে পারে। কারণ- থাক্ আর কাজ কী!
 



শব্দার্থ ও টীকা
মেয়ের বয়স অবৈধ
রকম বাড়িয়া গেছে                 -     তৎকালীন হিন্দু সমাজে আট বছর বয়সী কন্যাকে গৌরী, নয় বছর বয়সী কন্যাকে রোহিণী, দশ বছর বয়সী কন্যাকে কুমারী বলা হত। দশ বছর বয়সের মধ্যেই কন্যাকে বিয়ে দেওয়ার নিয়ম ছিল। সেই হিসেবে মেয়েটির বিয়ের বয়স সাত বছর আগেই পার হয়ে গিয়েছিল।
আপেক্ষিক গুরুত্ব                   -     তুলনামূলক গ্রহণযোগ্যতা।
এফ. এ.                              -     সে সময়ে বর্তমান উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়কে এফ.এ. বা First Arts বলা হত।
প্রজাপতি                             -     ব্রহ্মা। হিন্দু পুরাণ অনুসারে বিয়ের দেবতা।
পৌনঃপুনিক                         -     বারবার ঘটে এমন। এখানে বারবার উত্থাপিত।
কলপ                                 -     পাকা বা সাদা চুল কালো করার রং।
বিষম                                -     দারুণ, দুঃসহ।
দক্ষিণে হাওয়া দিতে লাগিল       -     মনের মধ্যে বসন্ত-বাতাসের হিল্লোল বইতে থাকল। আনন্দে বিয়ের জন্য চঞ্চল হয়ে উঠল।
বার্ক                                  -     এডমন্ড বার্ক (১৭২৯-১৭৯৭) ইংরেজ রাজনীতিক, প্রাবন্ধিক এবং সুবিখ্যাত বক্তা।
ফ্রেঞ্চ রেভোল্যুশন                  -     আঠারো শতকের শেষ প্রান্তে সংঘঠিত ঐতিহাসিক ফরাসি বিপ্লবের উপরে লেখা এডমন্ড বার্কের গ্রন্থ- 'Reflections on the Revolution in France।’ এটি ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশি হয়।
টেকস্ট বুক কমিটি                 -     পাঠ্যপুস্তক অনুমোদন করে এমন সংস্থা।
মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ                   -     বোপদেব গোস্বামী রচিত সংস্কৃত ভাষার বিখ্যাত ব্যাকরণ- ‘মুগ্ধবোধং ব্যাকরণম্।’
শ্মশানকারী                          -     শ্মশানে বিচরণ করে এমন।
জ্যৈষ্ঠের খররৌদ্রই তো
জ্যৈষ্ঠের অশ্রুশূন্য রোদন           -     জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রচন্ড রোদকে লেখক অশ্রুবিহীন কান্না হিসেবে কল্পনা করেছেন। এ উপমার ভিতর দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে প্রচন্ড দুঃখের দহনে অপুর চোখের জল শুকিয়ে গেছে। তার এই কাহিনী বর্ণনা তাই অশ্রুহীন রোদনের নামান্তর।
প্রত্নতাত্ত্বিক                           -     প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, মুদ্রালিপি ইত্যাদি থেকে ঐতিহাসিক তথ্য নির্ণয়ের বিদ্যা বা প্রত্নতত্ত্বে পন্ডিত ব্যক্তি। Archaeologist। পুরাতত্ত্ববিদ।
তাম্রশাসন                            -     তামার পাতে খোদাই করা প্রাচীন কালের রাজাজ্ঞা বা অনুশাসন।
গৌরীদান                             -     মেয়েদের বয়স সম্পর্কে প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রবিদদের বিধান অনুসারে আট বছর বয়সী কন্যাকে বিয়ে দেওয়া।
কষিয়া                               -     পূর্ণোদ্যমে। খুব করে।
খিড়কি                              -     বাড়ির পেছনের দিক বা পেছনের দিকে দরজা।
সমাজ-সংস্কারক                    -     যাঁরা সমাজের অগ্রগতির পথে বাধা হিসেবে থাকা নানা দোষ-ত্রুটি, পশ্চাৎপদতা, প্রথা ইত্যাদি দূর করে সমাজের উন্নতি সাধন করেন।
আনাড়ি                              -     অনিপুণ।
জবড়জঙ                            -     পারিপাট্যহীন। বেমানান। বেঢপ।
টিপাই                                -     তিন পায়াওয়ালা ছোট টেবিল। ইংরেজি 'Tripod' শব্দজাত।
গালিচা                               -     পুরু ফরাশ। কার্পেট।
পদ্মাসন                              -     দুই পা মুড়ে বসার বিশেষ ভঙ্গি। পদ্মের আসন।
অকাল                               -     বিয়ে ইত্যাদি শুভকাজের অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত সময়।
হিমালয়ের তিনি যেন মিতা       -     হিমালয়ের একটি শৃঙ্গের নাম গৌরীশঙ্কর। অপুর শ্বশুরের নামও গৌরীশঙ্কর। তিনি থাকতেন হিমালয়ে। তাঁর চরিত্রেও ছিল হিমালয়ের বৈশিষ্ট্য। এসব বিবেচনায় অপুর তার শ্বশুরকে হিমালয়ের মিতা বলেছে।
প্রস্রবণ                                -     ঝরনা।
অন্তঃপুরিকা                         -     অন্দর মহলের মহিলা।
খোট্টা                                 -     নিন্দার্থে হিন্দিভাষী লোকজন।
নিভৃত                                -     নির্জন জায়গা।
গলাধঃকরণ                         -     গিলে ফেলা।
পাকযন্ত্র                              -     পাকস্থলী ইত্যাদি হজমের অঙ্গ।
আভ্যন্তরিক উদ্বেগ                  -     ভেতরের অস্বস্তি।
সে আমার সম্পত্তি নয়,
সে আমার সম্পদ                   -     এখানে সম্পত্তি বলতে জমিজমা, বিষয়-আশয় ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে যা অর্থমূল্যে বিক্রি করা চলে। পক্ষান্তরে সম্পদ বলতে গৌরব ও ঐশ্বর্য বাড়ায় এমন অমূল্য কিছুকে বোঝানো হয়েছে। অপুর কাছে হৈমন্তী ভোগ্যবস্ত্ত ছিল না, ছিল যথার্থ জীবনসঙ্গিনী ও গৌরবের ধন।
ধ্রুব                                    -     অক্ষয়, নিত্য।
ক্ষণজীবিনী                          -     স্বল্পস্থায়ী।
রীতিপদ্ধতি                          -     কায়দাকানুন।
জনশ্রুতি                              -     লোকমুখে শোনা যায় এমন। জনরব।
প্রবঞ্চনা                              -     প্রতারণা, ঠকানো।
ওচাঁ                                  -     হেয়, জঘন্য, নিকৃষ্ট।
রাস                                   -     শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা সংক্রান্ত উৎসব।
কোষ্ঠি                                -     জন্মপত্রিকা, জীবনের শুভাশুভ নিরূপিত থাকে এমন পত্র।
মূঢ়তা                                -     অনভিজ্ঞতা, বোকামি।
একগুঁয়েমি                           -     একরোখা ভাব।
আইবড়                              -     অবিবাহিত, এখানে নিন্দাসূচক ব্যবহার ঘটেছে।
পঞ্চম স্বর                            -     কোকিলের সুরলহরী, রাগবিশেষ।
বাজখাঁই নাদ                        -     কর্কশ ধ্বনি, বাজ খাঁ বা বাজ বাহাদুর খাঁ নামে একজন গায়কের মাধুর্যহীন কর্কশ কণ্ঠস্বর বা সুরের অনুরূপ ধ্বনি।
দুর্গতি                                -     দুর্ভোগ, দুর্দশা, দুরবস্থা।
সংশয়                                -     দ্বিধাবোধ, অনিশ্চয়তা, আশংকা।
সৌখিন                               -     মনোরম, বিলাসী।
আকাশ ভাঙিয়া
পড়িবার কথা নয়                   -     ‘আকাশ ভেঙে পড়া’- কথাটির বিশিষ্ট প্রয়োগ। অর্থ- আকস্মিক বিপদে দিশেহারা হওয়া।
নাস্তিক                               -     ঈশ্বরে বিশ্বাসী নয় এমন।
প্রবাস                                 -     বিদেশে বসবাস।
লক্ষ্মী ছাড়িল, আর দেরি নাই      -     দুরবস্থা নেমে আসতে দেরি হবে না।
কটু কথা                             -     তিরস্কার, গালিগালাজ।
ঋষি                                  -     শাস্ত্রজ্ঞ তপস্বী।
দেবার্চনা                              -     দেবতার আরাধনা, পূজা।
গঞ্জনা                                 -     যাতনা, ভৎর্সনা, লাঞ্ছনা।
ক্ষুব্ধ                                  -     মনঃক্ষুণ্ণ, ক্ষোভে আলোড়িত।
রন্ধ্রে রন্ধ্রে                            -     ছিদ্রে ছিদ্রে।
অকাতর চিত্তে                      -     অক্লেশে, নির্দ্বিধায়।
চুলায় দিতে পারিতাম              -     পরিত্যাগ করতে বা বিসর্জন দিতে পারতাম।
আসক্তি                              -     তীব্র লিপ্সা, গভীর অনুরাগ।
মার্টিনো                              -     ইংরেজ লেখক।
গরাদে দেওয়া                       -     লোহা বা কাঠের মোটা শিক লাগানো।
অনবধানতা                          -     মনোযোগের অভাব, অমনোযোগিতা।
হু হু করিয়া উঠিল                  -     গভীর দুঃখে ভরে গেল।
শূন্যতা                               -     রিক্ততা, ফাঁকা ভাব।
নৈরাশ্যের গহবর                    -     নিরাশার গভীর গর্ত।
কণ্টকশয়ন                          -     কাঁটার বিছানা।
গিরিনন্দিনী                          -     পর্বতদুহিতা। হৈমন্তী হিমালয়ের উদার মুক্ত পরিবেশে বড় হয়েছে বলে তাকে এই বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে।
মার্টিনো পড়িয়া রহিল              -     লেখক মার্টিনোর লেখা ‘চরিত্রতত্ত্ব’ বই পড়ে রইল।
স্পর্ধা                                 -     দুঃসাহস, ঔদ্ধত্য।
আবির্ভাব                             -     হঠাৎ আগমন।
উপদ্রব                                -     অহেতুক উৎপাত।
বাড়ির মধ্যের                       -     অন্দর মহলের।
বরাত দেওয়া                        -     অন্যের ওপর দায়-দায়িত্ব অর্পণ, এখানে অজুহাত দেওয়া।
শক্ত ব্যামো                          -     কঠিন অসুখ, দুরারোগ্য ব্যাধি।
দক্ষিণার জোরে                     -     টাকা-পয়সা দিয়ে।
কাঠ হইয়া গেল                     -     কাঠের মতো অনড় ও স্পন্দনহীন হয়ে গেল।

বাগ্ধারা, প্রবাদ ও প্রবচন
চাপা দেওয়া                         -     গোপন করা।
কানাকানি                           -     গোপন পরামর্শ।
কষিয়া                               -     মনোযোগ দিয়ে, উদ্যমের সঙ্গে, ভালোমতো।
চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো       -     প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া বা সন্দেহ দূর করা।
মন পাওয়া                           -     সম্মতি বা প্রীতি লাভ করা।
কানাকানি পড়িয়া যাওয়া          -     গোপনে নিন্দা রটানো।
বাড়ন্ত                                 -     বেড়ে উঠেছে এমন।
গা টেপাটেপি করা                  -     অন্যকে লুকিয়ে গায়ে হাত দিয়ে কোনো কিছুর প্রতি ইশারা বা ইঙ্গত করা।
ঢাক পেটানো                        -     সগর্বে প্রচার করা।
বাজখাঁই                              -     কর্কশ ও উঁচু।
মাথা হেঁট হওয়া                     -     অপমানিত বা লজ্জিত হওয়া।
আকাশ ভাঙিয়া পড়া               -     আকস্মিক বিপদে দিশেহারা হয়ে যাওয়া।
মাথা খাওয়া                         -     বিগড়ে দেওয়া, সর্বনাশ করা।
শিকায় তোলা                       -     স্থগিত রাখা, মুলতবি রাখা।
চুলায় দেওয়া                         -     গোল্লায় যেতে দেওয়া।
কানায় কানায় ভরিয়া ওঠা         -     পুরোপুরি ভরা।
লজ্জার মাথা খাওয়া                -     নির্লজ্জের মতো আচরণ করা।
বুক ফাটিয়া যাওয়া                  -     শোকে হৃদয় বিদীর্ণ হওয়া।

উৎস ও পরিচিতি
রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্পটি প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ মাসিক পত্রিকায় জ্যৈষ্ঠ ১৩২১ বঙ্গাব্দে (১৯১৪ খ্রি.) প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি প্রথমে ‘গল্প সপ্তক’ গ্রন্থে (১৯১৬ খ্রি.) সংকলিত হয়েছিল। পরে ‘গল্পগুচ্ছ’ : তৃতীয় খন্ডে (১৯২৬ খ্রি.) সন্নিবেশিত হয়।
‘হৈমন্তী’ এক স্বভাবকোমল পবিত্র মাধুর্যময় লাবণ্যময়ী মেয়ের কাহিনী, যে যৌতুক প্রথার যূপকাষ্ঠে হয়েছে নির্মম বলি। হৃদয়হীন স্বার্থান্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির নিষ্ঠুর আচরণে আর তার গুণমুগ্ধ অথব পৌরুষহীন স্বামীর নিশ্চেষ্ট অসহায়তার মুখে সরল শুভ্র নিষ্কলঙ্ক সত্যব্রতী এবং একই সঙ্গে সরল তেজস্বিনী হৈমন্তীর বেদনাবিধুর পরিণতি আমাদের মর্মমূলে আঘাত করে।
নিতান্ত সাধারণ এক পারিবারিক পমিন্ডলের অসাধারণ ছবি অাঁকার দক্ষতা এবং চরিত্র চিত্রণে সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি, গভীর সহানুভূমি ও অপূর্ব মনোবিশ্লেষণের পরিচয় রয়েছে রবীন্দ্রনাথের এই আশ্চর্য শিল্পনৈপুণ্যময় ছোটগল্পে।

অনুশীলনমূলক কাজ
সাহিত্যবোধ q ছোটগল্প
আমরা গল্প শুনে বা পড়ে আনন্দ পাই। যে কোনো গল্পেই আমরা আকৃষ্ট হই ঘটনার ঘনঘটায়। এ থেকে আমরা পাই (১) প্লট বা কাহিনী। ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নানা কাহিনীর সূত্রে নানা মানব ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। এরা হল গল্পের (২) চরিত্র। গল্পের কাহিনীর ভেতর দিয়ে আমরা মানব-ভাগ্য সম্পর্কে হয়তো অনেক ধারণা পেয়ে যাই এবং তাতে করে গল্পের (৩) মর্মবাণী আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে। এভাবে কাহিনী, চরিত্র এবং মর্মবাণীর ভেতর দিয়ে আমরা পরিচিত হই গল্পকার জীবন ও জগৎ সম্পর্কে যে (৪) দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ঘটনা, চরিত্র ইত্যাদি সন্নিবেশ করেছেন তার সঙ্গে।
রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্প পড়ে আমাদের প্রথম ধারণা স্পষ্ট হতে পারে এই প্রশ্নের মাধ্যমে-গল্পটি আমাদের কেমন লেগেছে?
এরপর আমরা দৃষ্টিপাত করব এর গঠন ও নির্মাণশৈলীর দিকে। তা যথাযথভাবে অনুধাবন করার ক্ষেত্রে আমরা কিছু প্রশ্নের সাহায্য নিতে পারি : কী ঘটেছে? কার ক্ষেত্রে ঘটেছে? কেন? কীভাবে? এই প্রশ্নের জবাবে আমরা পেয়ে যাই গল্পের (১) কাহিনী বা ঘটনাধারার নির্মাণ কাঠামো। কার ক্ষেত্রে ঘটেছে? এই প্রশ্নের জবাবে ফুটে ওঠে গল্পের বিভিন্ন (২) চরিত্র। কেন? এই প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধানের চেষ্টায় আমরা পেয়ে যাই গল্পের (৩) বিষয়বস্ত্ত বা মর্মবাণী যা কিনা চরিত্রের ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ ও মূর্ত করে। আর এসব প্রশ্নের জবাব কীভাবে লেখক জীবনের তাৎপর্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পে, সেটাই হচ্ছে লেখকের (৪) দৃষ্টিভঙ্গি।

সাহিত্যবোধ q আত্মজিজ্ঞাসা
সাহিত্য উপলব্ধি করার এক ধরনের উপায় হচ্ছে নিজে নিজে প্রশ্ন করে উত্তর খোঁজা। তবে এক্ষেত্রে কোন ধরনের প্রশ্নের মাধ্যমে সাহিত্যকর্ম পরীক্ষা করা যায় তা জানা দরকার। গল্প-উপন্যাস ইত্যাদি সাহিত্যকর্ম বুঝতে হলে প্রধানত প্রশ্ন করতে হয় চরিত্র, তাদের অবস্থা, তাদের উদ্দেশ্য, দ্বন্দ্বের কারণ, তাদের প্রত্যাশা, অন্যান্য চরিত্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সম্পর্কে। যে পরিবেশে তারা অবস্থান করে সে সম্পর্কেও প্রশ্ন করতে হবে। তা ছাড়া তাদের ক্রিয়াকলাপ ও সংঘটিত ঘটনায় তাদের ভূমিকা ও গুরুত্ব এবং সে সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবও খুঁজে দেখতে হয়।
‘হৈমন্তী’ সম্পর্কিত নিচের প্রশ্নগুলোর যে সব জবাব তোমার মনে আসে লিখে ফেল। তাহলে গল্পটি যে শুধু ভালোভাবে বুঝবে তা নয়, তোমার গোছানো উত্তর তৈরি করার জন্যেও তা কাজে লাগবে।
১.       (ক) হৈমন্তীর নিজের বাড়ির পরিবেশ কেমন ছিল? (খ) বিয়ের পর নতুন জায়গার পরিবেশে সে কী ধরনের ব্যবহার পেয়েছে? (গ) সেই পরিবেশের অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন ঘটল কেন? (ঘ) এতে সে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে?
২.      হৈমন্তীর বয়স কত ছিল? এই গল্পে তার বয়স কোনো সমস্যার সৃষ্টি করেছে কী?
৩.      অপুর চোখে হৈমন্তী কোমল ও মৃদুভাষী। কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে সে অত্যন্ত দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে?
৪.      হৈমন্তীর বাবা কেমন লোক ছিলেন? মেয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের যে যে ছবি এই গল্পে রয়েছে তা একে একে উল্লেখ কর।
৫.      (ক) হৈমন্তীর বাবার সঙ্গে অপুর বাবার চরিত্রের কী পার্থক্য লক্ষ করা যায়?
         (খ) অপুর বাবা হৈমন্তীর বাবাকে প্রথমে কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন?
         (গ) হৈমন্তীকে বাড়িতে নিতে এসে তিনি প্রত্যাখ্যাত হলেন কেন?
৬.      শ্বশুর বাড়ির নির্মম আচরণে হৈমন্তীর ভেতরে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া ঘটেছিল? সে সবচেয়ে দারুণ আঘাত পেয়েছে কিসে? এ ক্ষেত্রে গল্পে ‘ঋষিবাবা’ কথাটি ব্যবহারর তাৎপর্য কী?
৭.      (ক) অপু কোন ধরনের লোক? (খ) হৈমন্তী তাকে কতটা ভালোবাসত?
         (গ) সে-ই বা হৈমন্তীকে কতটা ভালোবাসত?
৮.      হৈমর প্রতি পিতামাতার রূঢ় নির্মম আচরণের মুখে অপুর অসহায়তার কারণ কী? এই অসহায়তা কতটুকু সঙ্গত?
৯.      অপু ‘দ্বিতীয় সীতা বিসর্জনের কাহিনী’ কথাটি দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছে?
১০.     (ক) হৈমন্তীর শেষ পরিণতি কী হয়েছিল?
         (খ) ঐ পরিণতির জন্য কে বা কারা দায়ী?
চরিত্র চিত্রণ ও বিশ্লেষণ
কোনো চরিত্র চিত্রণ বা বিশ্লেষণ সাধারণভাবে নিচের ছক অনুসারে হতে পারে :
১.       সূচনা : যে চরিত্র আলোচনা বা বিশ্লেষণ করতে যাচ্ছ তার উল্লেখ করে তার চরিত্রের আসল বা মৌলিক কথাটি লেখ।
২.      মধ্যভাগ : চরিত্রের ব্যক্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্যের বিভিন্ন দিকের ওপরে আলোকপাত কর। মনে রাখবে চরিত্রের পরিচয় ফুটে ওঠে প্রথমত, চরিত্র যা বলে, ভাবে ও করে তার মাধ্যমে; দ্বিতীয়ত, ঐ চরিত্র সম্পর্কে অন্যান্য চরিত্র যা বলে ও ভাবে তার মাধ্যমে; তৃতীয়ত, গল্পের কথক ঐ চরিত্রটিকে যেভাবে ফুটিয়ে তোলেন তার মাধ্যমে।
৩.      সমাপ্তি : তোমার নিজের দৃষ্টিভঙ্গির সংক্ষিপ্তসার লেখ এবং গল্পের বিষয়বস্ত্ত বা মর্মবাণী ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে চরিত্রের ভূমিকার গুরুত্বকে জোরালোভাবে দেখাতে চেষ্টা কর।
এই খসড়া ছক-এর আদলে হৈমন্তী চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য সূত্রায়িত করা যেতে পারে এভাবে :
১।      সূচনা : কোমল, উদার, সরল, শুভ্র, হৈমন্তীকে স্বার্থক্লিষ্ট সংসারের নির্মম নিষ্ঠুরতার বিষবাষ্পে তিলে তিলে করুণ পরিণতি বরণ করে নিতে হয়েছে।
২।      মধ্যভাগ : ক) স্বামী অপুর স্বীকৃতিতে হৈমন্তীর কোমল মাধুর্য ও চরিত্র সুষমা। খ) স্বার্থক্লিষ্ট সংসারের নিষ্ঠুরতার মুখে হৈমন্তীর ভাগ্যবিড়ম্বনাময় পরিস্থিতির চিত্র এ রকম :
         (এক) অপুত্রক বেহাই-এর আজীবন সঞ্চিত লক্ষাধিক টাকা ঘরে আসবে এবং পুত্র শ্বশুরের সাহায্যে বড় চাকরি পাবে অপুর পিতার এই আশা ভঙ্গ হলে হৈমন্তীর ওপর নিষ্ঠুরতার শুরু।
         (দুই) রূঢ় নির্মম নিষ্ঠুরতায় হৈমন্তীর দেহমন শুকিয়েছে কিন্তু কোনো প্রতিবাদ বিক্ষোভ সে করে নি।
         (তিন) দারুণতম আঘাত এসেছে পিতার প্রতি শ্বশুর বাড়ির লোকের অসম্ভ্রম ও অবজ্ঞায়।
         (চার) পিতৃ-নির্ভরতার বন্ধন শিথিল ও ছিন্ন হয়ে যাওয়াতে সমস্ত জীবন হয়েছে বিস্বাদ ও অর্থহীন।
         (পাঁচ) মর্মান্তিক আঘাত এসেছে স্বামীর নিশ্চেষ্টতা ও অক্ষমতায়।
৩।      সমাপ্তি : হৈমন্তীর বেদনাবিধুর নির্মম পরিণতির মধ্য দিয়ে সমাজ জীবনে যৌতুক প্রথার নির্মম বেদনাদায়ক দিকটিই আমাদের মর্মমূল স্পর্শ করে।
সমালোচনামূলক আলোকসম্পাত
চরিত্র চিত্রণের মত মূল্যায়ণধর্মী লেখার সময়ে কেবল কাহিনী সম্পাত না করাই ভালো। বরং কাহিনীসূত্র যথাসম্ভব মূল্যায়ণমূলক মন্তব্য-সমৃদ্ধ হওয়া উচিত। কথাটা স্পষ্ট হবে কাহিনী সম্পাতের সঙ্গে নিচের সমালোচনামূলক মন্তব্যের তুলনা লক্ষ করলে :
কাহিনী সম্পাত : ‘হৈমন্তী’ গল্পের নায়িকা হৈমন্তী।
সমালোচনামূলক মন্তব্য : ‘হৈমন্তী’ গল্পটির উপজীব্য বিষয় ‘যৌতুকের’ বলি হিসেবে নায়িকা হৈমন্তীর বিষাদঘন করুণ পরিণতি।
কাহিনী সম্পাত : হৈমর প্রতি অপুর ভালোবাসার ঘাটতি ছিল না।
মূল্যায়নধর্মী : হৈমর প্রতি অপুর ভালোবাসার ঘাটতি না থাকলেও অপুর ক্লীবত্ব ও অক্ষমতা অনিবার্যভাবে হৈমন্তীকে মর্মান্তিক পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এভাবে যতটা সম্ভব তোমার লেখা মূল্যায়নধর্মী হলে ভালো। এই আলোকে এবার হৈমন্তীর চরিত্রের ভূমিকা অংশ লিখতে চেষ্টা কর। তুমি হয়তো এভাবে শুরু করতে পার :
হৈমন্তী রবীন্দ্রনাথের একটি অসাধারণ ছোটগল্প।
এর চেয়ে সম্ভবত এটা ভালো, যদি তুমি লেখ :
রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ ছোটগল্প হৈমন্তীর প্রতিপাদ্য বিষয় পণপ্রথার মারাত্মক কুফল।
আরও ভাল করার জন্য শুরুটা এভাবেও করা যেতে পারে :
রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ ছোটগল্প ‘হৈমন্তী’তে পণপ্রথার মারাত্মক কুফল উঠেছে স্বার্থান্ধ সংসারের নির্মম নিষ্ঠুরতায় গল্পের নায়িকা হৈমন্তীর করুণ পরিণতিতে।
কিংবা তা এরকমও হতে পারে :
রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ ছোটগল্প ‘হৈমন্তী’তে পণপ্রথার মারাত্মক কুফলের দিকটা ফুটে উঠেছে হৈমন্তী চরিত্রের বেদনাঘন পরিণতির মাধ্যমে, যেখানে স্বার্থান্ধ সংসারের নির্মম নিষ্ঠুরতার যাঁতাকলে হৈমন্তীর স্বল্পায়ু বধূ-জীবনের পরিণতি অশ্রুবিন্দুর মতো জমাট বেঁধেছে।
নিজের লেখা নিজেই এভাবে আরও উন্নত করতে পার তোমরা। তবে এর জন্য চেষ্টা করতে হয়। সময় দিতে হয়।
ভাষা অনুশীলন q নির্দেশক বাক্য
নির্দেশক বাক্যে কোনো তথ্য, সংবাদ বা ঘটনার বর্ণনা বা বিবৃতি নির্দেশিত হয়। এ ধরনের বাক্য দুটো ভাগে বিভক্ত
ক)    সদর্থক বা অস্তিবাচক  : এতে কোনো নির্দেশ, ঘটনার সংঘটন বা হওয়ার সংবাদ থাকে। যেমন :
         বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা জিতেছে।
         আজ দোকানপাট বন্ধ থাকবে।
খ)    নেতিবাচক বা নঞর্থক : এ ধরনের বাক্যে কোনো কিছু হয় না বা ঘটছে না- নিষেধ, আকাঙ্ক্ষা, অস্বীকৃতি ইত্যাদি সংবাদ কিংবা ভাব প্রকাশ করা যায়। যেমন :
         আজ ট্রেন চলবে না।
         আপনি আমার সঙ্গে কথা বলবে না।
বাক্যের রূপান্তর
বাক্য রূপান্তরের ক্ষেত্রে মৌলিক অর্থ অপরিবর্তিত রাখতে হয়। প্রয়োজনে শব্দের কিছুটা পরিবর্তন, নতুন শব্দ যোগ কিংবা শব্দ বর্জন করা যেতে পারে।
অস্তিবাচক বাক্যকে নেতিবাচক
অস্তি      :        বিবাহ সম্বন্ধে আমার মত যাচাই করা অনাবশ্যক ছিল।
নেতি      :        বিবাহ সম্বন্ধে আমার মত যাচাই করা আবশ্যক ছিল না।
অস্তি      :        পঞ্জিকার পাতা উল্টাইতে থাকিল।
নেতি      :        পঞ্জিকার পাতা উল্টানো বন্ধ রহিল না।
অস্তি      :        শ্বশুরের ও তাহার মনিবের উপর রাগ হইল।
নেতি      :        শ্বশুরের ও তাহার মনিবের উপর রাগ না হইয়া পারিলাম না।
নেতিবাচক বাক্যকে অস্তিবাচক
নেতি      :        দেশের প্রচলিত ধর্মকর্মে তাঁহার আস্থা ছিল না।
অস্তি      :        দেশের প্রচলিত ধর্মকর্মে তাঁহার অনাস্থা ছিল।
নেতি      :        আমার প্রণাম লইবার জন্য সবুর করিলেন না।
অস্তি      :        আমার প্রণাম লইবার পূর্বেই প্রস্থান করিলেন।
নেতি      :        কিন্তু বরফ গলিল না।
অস্তি      :        কিন্তু বরফ অগলিত রহিল।

দীর্ঘ-উত্তর প্রশ্ন
১.       ‘হৈমন্তী’ গল্প অবলম্বনে হৈমন্তীর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
২.      ‘হৈমন্তী’ গল্পে তৎকালীন হিন্দু সমাজের যে স্বার্থলোলুপ মানসিকতার ছবি ফুটে উঠেছে তার পরিচয় দাও।
বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
‘সাহিত্যবোধ : আত্ম-জিজ্ঞাসা’ অংশে বর্ণিত প্রশ্নগুলো বিবেচ্য।
ভাষাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১.       নিম্নলিখিত যৌগিক বাক্যগুলোকে সরল বাক্যে পরিণত কর :
       ক) কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন, কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না।
         খ) আমি ছিলাম বর, সুতরাং বিবাহ সম্বন্ধে আমার মত যাচাই করা অনাবশ্যক ছিল।
         গ) শিশিরের বয়স যথাসময়ে ষোলো হইল; কিন্তু সেটা স্বভাবের ষোলো।
         ঘ) তোমাকে এই কটি দিন মাত্র জানিলাম, তবু তোমার হাতেই ও রহিল।
২.      নিচের অস্তিবাচক বাক্যগুলোকে নেতিবাচক বাক্যে রূপান্তরিত কর :
         ক) আমার বুকের ভেতরটা হু হু করিয়া উঠিল।
         খ) হৈমন্তী চুপ করিয়া রহিল।
         গ) হৈম কিছু না বলিয়া একটু হাসিল।
         ঘ) সে বাপকে যত চিঠি লিখিত আমাকে দেখাইত।
         ঙ) তাহার মন একেবারে কাঠ হইয়া গেল।
৩.      নিচের নেতিবাচক বাক্যগুলোকে অস্তিবাচক বাক্যের রূপান্তরিত কর :
         ক) হৈম তাহার অর্থ বুঝিল না।
         খ) দেবার্চনার কথা কোনোদিন তিনি চিন্তাও করেন নাই।
         গ) এসব কথা সে মুখে আনিতে পারিত না।
         ঘ) বইগুলি হৈমর সঙ্গে একত্রে মিলিয়া পড়া অসম্ভব ছিল না।
         ঙ) দেখি, সে বিছানায় নাই।
ব্যাখ্যা
১.       জ্যৈষ্ঠের খর রৌদ্রই তো .......................... অশ্রুশূন্য রোদন।
২.      অধিকার ছাড়িয়া দিয়া ............................. বিড়ম্বনা আর নাই।
৩.      আমার সন্দেহ হয় .......................... সম্পদ।
৪.      এই নিঃশব্দ বেদনার ......................... দেখি নাই।
৫.      যেদিন অযোধ্যার ............................ আমিও ছিলাম।
নমুনা উত্তর : ব্যাখ্যা ৩
আলোচ্য অংশটুকু রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্প থেকে চয়িত হয়েছে। এ অংশটিতে বিবাহিত স্ত্রী সম্পর্কে এবং সাথে হৈমন্তী সম্পর্কে অপুর অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করা হয়েছে।
অপুর মতে বিয়ে করা এবং স্ত্রীকে পাওয়া এক কথা নয়। আনুষ্ঠানিক মন্ত্র পড়ে অধিকাংশ পুরুষই যে স্ত্রীকে পায় তাতে শুধু সংসারের প্রয়োজন মেটে, কিন্তু সমগ্র নারীসত্তাকে একান্তভাবে নিজের করা হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই নিতান্ত দৈহিক কামনা-বাসনা মেটে বটে কিন্তু দেহের একান্ত সঙ্গোপনে যে অসীম, জটিল ও বিচিত্র মনের অবস্থান তার খবর অনেকেই জানে না। পতি বা পত্নীর এই সমগ্র সত্তাটিকে তারা যে অধিকার করতে পারে না, তা তারা অনেক সময় সারা জীবনেও বুঝতে পারে না। কিন্তু অপুর বেলায় তেমনটি হয় নি। বিয়ের মন্ত্রের হৈমন্তীর হাতটা হাতে পেয়ে যে প্রাপ্তিবোধ তার জেগেছিল তার চেয়েও দুর্লভ আর একটা কিছু পাওয়ার জন্য সে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। সে বুঝেছিল নারী কঠিন সাধনার ধন, তা নিতান্তই ভোগের সামগ্রী নয়, এক আশ্চর্য ঐশ্বর্য। এই কারণেই অপু হৈমন্তীকে দেখেছে সম্পদ হিসেবে, সম্পত্তি হিসেবে নয়।
সাধারণভাবে সম্পত্তি ও সম্পদ একই অর্থে ব্যবহৃত হলেও এখানে বিশেষ বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সম্পত্তি ভোগ্যবস্ত্ত, ইংরেজিতে যাকে বলা হয়- Property, আর সম্পদ ভোগাতীত ঐশ্বর্য যার ইংরেজি ভাষ্য হচ্ছে- wealth। সম্পদ লাভ করা যেমন কঠিন তেমনি লাভের আনন্দও অনির্বচনীয়। সম্পত্তি তার মালিকের প্রয়োজন মেটায় আর সম্পদ বা ঐশ্বর্য তাকে গৌরবান্বিত করে। অন্যান্য আর দশজনের কাছে স্ত্রী যেখানে নিতান্ত সম্পত্তি মাত্র, অপুর কাছে হৈমন্তী তেমন ছিল না। অপুর কাছে হৈমন্তী ছিল এক দুর্লভ সম্পদ, এক বিরাট ঐশ্বর্যের মতো।


View Foundation Digital Talking Library is developed and maintained by Sigma Enterprise.
Theme designed by Imtiaz
All rights are reserved. Any kind of reproduction of any mp3 files and text files is prohibited. If any organization or any person is found copying or reproducing any of the material will be punished under copy right law.