Logo Sponsored by Chowdhury and Hossain, Advanced Publications

Panjeri Read


পাঞ্জেরি
ফররুখ আহমদ
কবি পরিচিতি
চল্লিশের দশকে আবির্ভূত শক্তিমান কবিদের অন্যতম ফররুখ আহমদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি' প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালে। এর পর একে একে তাঁর অনেক কাব্যগ্রন্থ, কাব্যনাট্য ও কাহিনীকাব্য প্রকাশিত হয়েছে। ইসলামী ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাসী এ কবির কবিতায় প্রধানত প্রকাশ ঘটেছে ইসলামী আদর্শ ও জীবনবোধের।
কর্মজীবনে বহু বিচিত্র পেশা অবলম্বন করেছেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত দীর্ঘকাল ধরে স্থিত হয়েছেন ঢাকা বেতারে ‘স্টাফ রাইটার' হিসেবে। তাঁর অন্য কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে : কাব্যগ্রন্থ ‘সিরাজাম মুনীরা', কাব্যনাট্য ‘নৌফেল ও হাতেম', সনেটসংকলন ‘মুহূর্তের কবিতা' এবং কাহিনীকাব্য ‘হাতেম তায়ী'। এ ছাড়া তিনি ছোটদের জন্য বেশ কিছু ছড়া ও কবিতা লিখে গেছেন।
সাহিত্যকৃতির স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার ও ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেছেন এবং মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন।
ফররুখ আহমদের জন্ম ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে মাগুরা জেলার মাঝআইল মান্দারতলা গ্রামে। তাঁর মৃত্যু ঢাকায় ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে।

                       
                        রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
                                          এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
                                          সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
                                          তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
                                          অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।

                        রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
                                          দীঘল রাতের শ্রান্ত সফর শেষে
                                          কোন্ দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে?
                                          এ কী ঘন-সিয়া জিন্দেগানীর বা’ব
                                          তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের তুফান-শ্রান্ত খা'ব
                                          অস্ফুট হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী।
                                          তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
                                          সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি।
                       
                        রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
                                          বন্দরে বসে যাত্রীরা দিন গোনে,
                                          বুঝি মৌসুমী হাওয়ায় মোদের জাহাজের ধ্বনি শোনে,
                                          বুঝি কুয়াশায়, জোছনা-মায়ায় জাহাজের পাল দেখে।
                                          আহা, পেরেশান মুসাফির দল
                                          দরিয়া কিনারে জাগে তক্দিরে
                                          নিরাশার ছবি এঁকে!
                                          পথহারা এই দরিয়া-সোঁতায় ঘুরে
                                          চলেছি কোথায়? কোন সীমাহীন দূরে?
                                          তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
                                          একাকী রাতের ম্লান জুলমাত হেরি।

                        রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
                                          শুধু গাফলতে, শুধু খেয়ালের ভুলে,
                                          দরিয়া-অথই ভ্রান্তি নিয়াছি তুলে,
                                          আমাদেরি ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি
                                          দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের সেতারা, শশী।
                                          মোদের খেলার ধুলায় লুটায়ে পড়ি
                                          কেটেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী।
                                          সওদাগরের দল মাঝে মোরা ওঠায়েছি আহাজারি,
                                          ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দনধ্বনি আওয়াজ শুন্ছি তারি।
                                          ও কি বাতাসের হাহাকার, - ও কি
                                                    রোনাজারি, ক্ষুধিতের!
                                          ও কি দরিয়ার গর্জন, -ও কি বেদনা মজলুমের!
                                          ও কি ক্ষুধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী।
                                          পাঞ্জেরি।
                                          জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রূকুটি হেরি,
                                          জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি!
                                          দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি!!

 


শব্দার্থ ও টীকা
পাঞ্জেরি                  -      যে নৌ-কর্মচারী জাহাজের অগ্রভাগে বা মাস্তুলসংলগ্ন বাতি দিয়ে চারপাশ দেখে মাঝিকে পথনির্দেশক সংকেত দেয়। প্রতীকী অর্থ-জাতির পথপ্রদর্শক।
সেতারা                  -      তারা, নক্ষত্র।
হেলাল                   -      চাঁদ।
মাস্তুল                    -      নৌকা, জাহাজ ইত্যাদিতে পাল লাগানোর দন্ড।
ঘন-সিয়া                 -      নিবিড় কালো (অন্ধকার)।
জিন্দেগানির বা'ব       -      জীবনের অধ্যায় বা পর্যায়।
মর্সিয়া                   -      শোকগীতি।
খা'ব                      -      স্বপ্ন।
হেরি                      -      দেখি, প্রত্যক্ষ করি, অবলোকন করি।
পেরেশান                -      উদ্বিগ্ন, চিন্তিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, ক্লান্ত।
মুসাফির                 -      পথিক, সফরকারী, যাত্রী, পর্যটক।
তকদির                  -      ভাগ্য, অদৃষ্ট, কপাল, নসিব।
জুলমাত                  -      অন্ধকার।
গাফলত                  -      অবহেলা, ঔদাসীন্য। অমনোযোগিতা। ভুলচুক।
শর্বরী                     -      রাত্রি।
আহাজারি                -      হাহাকার।
রোনাজারি               -      কান্না, ক্রন্দন।
মজলুম                   -      অত্যাচারিত।
ভ্রূকুটি                     -      ক্ষোভ, ক্রোধ ইত্যাদির কারণে ভুরুর কুঞ্চন বা কুঞ্চিত অবস্থা।
কৈফিয়ত                 -      জবাবদিহি, কারণ দেখিয়ে জবাব।

উৎস
ফররুখ আহমদের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি' থেকে ‘পাঞ্জেরি' কবিতাটি সংকলিত হয়েছে। ‘সাত সাগরের মাঝি' কবিতাটিতে জাতীয় জীবনের অগ্রযাত্রার কান্ডারীকে যেমন প্রতীকী তাৎপর্য দেয়া হয়েছে ‘পাঞ্জেরি' কথাটিও অনুরূপ এবং একই তাৎপর্যমন্ডিত।
ছন্দ
কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। মূল পর্ব ৬ মাত্রার। চরণের পর্ববিন্যাস মূলত এ রকম : ৬+৬+২। তবে সর্বত্র সমতার বাঁধন নেই।
অনুশীলনমূলক কাজ
বিশিষ্টতা
‘পাঞ্জেরি' ফররুখ আহমদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। একটি একটি রূপক কবিতা। এ কবিতায় পাঞ্জেরি জাতির কর্ণধারের প্রতীক। কবিতায় ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দ ও চিত্রকল্প এমনিভাবে নানা প্রতীকী তাৎপর্যমন্ডিত। কবিতাটিতে সমুদ্রযাত্রার প্রতিকূল পরিস্থিতি এবং তা থেকে উত্তরণের আকাঙ্ক্ষার ভেতর দিয়ে কবি জাতীয় বিরাজমান সঙ্কট উত্তরণে জাতীয় নেতৃত্বের সচেতন ভূমিকা প্রত্যাশা করেছেন। এভাবে আপাতবর্ণিত ভাববস্তুর আড়ালে আমরা অন্তর্নিহিত আলাদা ভাববস্তু পাই।
এ কবিতায় ভাবকল্পনা ও আবেগ মাধুর্য রূপায়ণে ধ্বনিসৌকর্য, শব্দব্যবহার, চিত্রকল্প রচনা ও রূপক-প্রতীক সৃষ্টিতে কবি চমৎকারিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
আরবি-ফারসি শব্দ
এ কবিতায় ভাবানুষঙ্গ রচনায় কবি বেশ কিছু আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সেগুলোর সারিবদ্ধ একটি তালিকা তৈরি কর। এবার মিলিয়ে দেখ নিচের শব্দগুলো তোমার তালিকায় আছে কিনা। এর পর এগুলোর অর্থ লেখ ও বাক্যে ব্যবহার করা যায় কি না দেখ:
পাঞ্জেরি, আসমান, সেতারা, হেলাল, সফর, দরিয়া, সিয়া, জিন্দেগানী, বা'ব, মর্সিয়া, তুফান, খা'ব, হাওয়া, পেরেশান, মুসাফির, তকদির, জুলমাত, গাফলত, সওদাগর, আহাজারি, আওয়াজ, রোনাজারি, মজলুম, কৈফিয়ত।
কবিতার ভাবস্তু উপলব্ধি
এ কবিতায় বেশ কিছু শব্দ বিশেষ অর্থসূচক প্রতীকী শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। নিচের উদাহরণগুলো লক্ষ কর:
শব্দ
সাধারণ অর্থ
বিশেষ প্রতীকী তাৎপর্য
পাঞ্জেরি
জাহাজের অগ্রভাগের পথনির্দেশক আলো বা বাতিধারী নৌকর্মী
জাতির পথপ্রদর্শক
আসমান
আকাশ
জাতীয় জীবন
মেঘ
নৌযাত্রার দুর্যোগের আভাস
জাতীয় জীবনে দুর্যোগের আভাস
সেতারা, হেলাল
নৌযাত্রায় পথনির্দেশ বা আশার আলো
জাতীয় জীবনে সংকট উত্তরণের সম্ভাবনার ইঙ্গিত
অসীম কুয়াশা
নৌযাত্রায় অচল অবস্থার কারণ
জাতীয় জীবনে অচলাবস্থার প্রতীক
রাত
অন্ধকারময় পরিবেশ
জাতীয় জীবনের সংকটজনক কালো অধ্যায়
কবিতায় ব্যবহৃত এ ধরনের অন্যান্য শব্দ খুঁজে বের কর এবং সেগুলোর সাধারণ অর্থ ও প্রতীকী তাৎপর্য লিপিবদ্ধ কর। এভাবে এ কবিতার ভাববস্তুর দুটো রূপ তোমাদের কাছে ধরা পড়বে। একটি হবে জাহাজ যাত্রার প্রতিকূলতার ছবি। অন্যটি হবে জাতীয় জীবনের সংকট ও তা থেকে উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা। এবার আলাদা দুটি শিরোনামে দুটি অনুচ্ছেদে কবিতার আপাতদৃষ্ট ভাববস্তু এবং অন্তর্নিহিত তাৎপর্য লেখ।

সাহিত্যবোধ q রূপক কবিতা
রূপক কবিতা বলতে এমন ধরনের কবিতা বোঝায় যেখানে কবি তাঁর কোনো বিশেষ ভাব বা তত্ত্বকে সরাসরি প্রকাশ না করে অন্য কোনো বাহ্যিক ঘটনা, চিত্র ইত্যাদির আড়ালে রেখে সমান্তরালে ব্যঞ্জিত করে থাকেন। রূপকের ইংরেজি শব্দ হচ্ছে Allegory গ্রিক ভাষায় এর অর্থ হল- ‘অন্য কিছুকে বোঝাচ্ছে'। রূপক কবিতায় ভাববস্তুর দুটো দিক থাকে। একটি হল আপাতদৃষ্ট ভাববস্তু। অন্যটি হল অন্তর্নিহিত সমান্তরাল ভাববস্তু। অর্থাৎ রূপক কবিতায় বাইরের অর্থ হচ্ছে বাচ্যার্থ, আর অন্তর্নিহিত অর্থ হল নিহিতার্থ।
সুতরাং রূপক কবিতা হচ্ছে বাইরের রূপের আড়ালে ভেতরের রূপের আভাসদানকারী কবিতা।
‘পাঞ্জেরি' এ ধরনের একটি রূপক কবিতা। ‘কবিতার ভাববস্তু উপলব্ধি' অংশটির সাহায্য নিলে কবিতাটির রূপক তাৎপর্য অনুধাবন করা সহজ হবে।

দীর্ঘ-উত্তর প্রশ্ন
১.     ‘পাঞ্জেরি’ কবিতার ভাববস্ত্ত নিজের ভাষায় লেখ।
২.     রূপক কবিতা কাকে বলে? রূপক কবিতা হিসেবে ‘পাঞ্জেরি’র সার্থকতা আলোচনা কর।
বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১.     ‘পাঞ্জেরি’ কবিতায় ব্যবহৃত প্রতীকী তাৎপর্যপূর্ণ পাঁচটি শব্দ লেখ। সে সব শব্দের সাধারণ অর্থ ও প্রতীকী তাৎপর্য দেখাও।
২.     টীকা লেখ :
        (ক) দরিয়া-অথই ভ্রান্তি
        (খ) দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী
        (গ) ও কি বাতাসের হাহাকার,- ও কি রোনাজারি ক্ষুধিতের!
        (ঘ) ও কি দরিয়ার গর্জন,- ও কি বেদনা মজলুমের!
ভাষাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১.     ‘পাঞ্জেরি’ কবিতায় ব্যবহৃত পাঁচটি আরবি-ফারসি শব্দের অর্থ লেখ এবং বাক্যে প্রয়োগ দেখাও।
২.     ‘‘ও কি বাতাসের হাহাকার,- ও কি
                                        রোনাজারি ক্ষুধিতের!
        ও কি দরিয়ার গর্জন,- ও কি বেদনা মজলুমের!’’-
        এ অংশে ‘ও কি’ কথাটি কবি বারবার ব্যবহার করেছেন কেন?

ব্যাখ্যা
সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা লেখ :
১.     শুধু গাফলতে, শুধু খেয়ালের ভুলে;
        দরিয়া-অথই ভ্রান্তি নিয়াছি তুলে।
২.     মোদের খেলার ধূলায় লুটায়ে পড়ি
        কেটেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী।
৩.     জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রূকুটি হেরি,
        জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রূকুটি হেরি!





View Foundation Digital Talking Library is developed and maintained by Sigma Enterprise.
Theme designed by Imtiaz
All rights are reserved. Any kind of reproduction of any mp3 files and text files is prohibited. If any organization or any person is found copying or reproducing any of the material will be punished under copy right law.