আমার পূর্ব বাংলা
সৈয়দ আলী আহসান
কবি-পরিচিতি
সৈয়দ আলী আহসান একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক।
কর্মজীবনে তিনি অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা, করাচি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। উপাচার্যের দাযিত্ব পালন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যায়ে। বাংলা একাডেমীর পরিচালক এবং বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টাও ছিলেন তিনি।
সৈয়দ আলী আহসান বাংলাদেশের বিশিষ্ট আধুনিক কবিদের একজন। তাঁর কবিতার ভাববস্তুতে ঐতিহ্য সচেতনতা, সৌন্দর্যবোধ ও দেশপ্রীতি এবং সেইসঙ্গে রূপরীতিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিচয় আছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে : কাব্যগ্রন্থ- ‘অনেক আকাশ', ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত', ‘সহসা সচকিত' ‘আমার প্রতিদিনের শব্দ', ‘সমুদ্রেই যাবো', গবেষণা ও প্রবন্ধগ্রন্থ- ‘কবি সধুসূদন', ‘রবীন্দ্র কাব্যবিচারের ভূমিকা', ‘কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা', ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস', ‘সতত স্বাগত', ‘শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য'; অনুবাদগ্রন্থ-‘হুইটম্যানের কবিতা'। এ ছাড়াও তাঁর একাধিক স্মৃতিকথা ও ভ্রমণকাহিনী প্রকাশিত হয়েছে।
সৈয়দ আলী আহসান বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক, নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদকসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও পদক লাভ করেছেন।
সৈয়দ আলী আহসানের জন্ম ১৯২২ খ্রিষ্টব্দে মাগুরা জেলার আলোকদিয়ায়। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ২৫শে জুলাই ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে।
আমার পূর্ব-বাংলা এক গুচ্ছ স্নিগ্ধ
অন্ধকারের তমাল
অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়
একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ
সন্ধ্যার উন্মেষের মতো
সরোবরের অতলের মতো
কালো-কেশ মেঘের সঞ্চয়ের মতো বিমুগ্ধ বেদনার শান্তি
আমার পূর্ব বাংলা বর্ষার অন্ধকারের অনুরাগ
হৃদয় ছুঁয়ে- যাওয়া
সিক্ত নীলাম্বরী
নিকুঞ্জের তমাল কনক-লতায় ঘেরা
কবরী এলো করে আকাশ দেখার
মুহূর্ত
অশেষ অনুভব নিয়ে
পুলকিত সচ্ছলতা
এক সময় সূর্যকে ঢেকে অনেক মেঘের পালক,
রাশি রাশি ধান মাটি আর পানির
কেমন নিশ্চেতন করা গন্ধ
কত দশা বিরহিণীর- এক দুই তিন
দশটি
এখানে ত্রস্ত আকুলতায় চিরকাল
অভিসার
ঘর আর বিদেশ আঙিনা
আকুলতায় একাকার
তিনটি ফুল আর অনেক পাতা নিয়ে
কদম্ব তরুর একটি শাখা মাটি
ছুঁয়েছে
আরও অনেক গাছ পাতা লতা
নীল হলুদ বেগুনি অথবা সাদা
অজস্র ফুলের বন্যা অফুরন্ত
ঘুমের অলসতায় চোখ বুঁজে আসার মতো
শান্তি
কাকের চোখের মতো কালোচুল
এলিয়ে
পানিতে পা ডুবিয়ে-রাঙা-উৎফল
যার উপমা
হৃদয় ছুঁয়ে-যাওয়া স্নিগ্ধ নীলাম্বরীতে
দেহ ঘিরে
যে দেহের উপমা স্নিগ্ধ তমাল-
তুমি আমার পূর্ব-বাংলা-
পুলকিত সচ্ছলতায়, প্রগাঢ় নিকুঞ্জ। ।
শব্দার্থ ও টীকা
একগুচ্ছ স্নিগ্ধ অন্ধকারের তমাল - এ চিত্রকল্পটি ব্যবহৃত হয়েছে পূর্ব বাঙলার উপমা হিসেবে। কবির ভাব এখানে পেয়েছে একান্ত ও অন্তরঙ্গ ইন্দ্রিয়ানুভূতির তীব্রতা। অন্ধকারের তমালগুচ্ছ যে অনুপম কোমল মাধুর্যের দ্যোতনা দেয়, পূর্ব বাঙলার শ্যামল শান্ত কোমল পরিবেশ যেন ঠিক তেমনি। তা যেন কবির চোখে মোহাঞ্জন সৃষ্টি করে।
অনেক পাতায় ঘনিষ্ঠতায়
একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ - পাতায় ছাওয়া লতায় ঘেরা গৃহ যেমন অনুপম আবাস, সবুজ-শ্যামল পূর্ব বাংলাও কবির কাছে তেমনি। একটি চিত্রকল্প।
নিকুঞ্জ - লতাগৃহ। অরণ্যে বা উদ্যানে লতাপাতা ঘেরা কুটিরের মত জায়গা।
সন্ধ্যার উন্মেষের মতো - দিনের কর্মকোলাহলের শেষে সন্ধ্যালগ্নে প্রকৃতিতে যে অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের বিস্তার হয় তা মনে যে অপূর্ব ভাব জাগায়। একটি উপমা।
সরোবরের অতলের মতো - শান্ত শীতল অনুভূতির গভীরতা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। এটিও উপমা। দুটি উপমাই প্রশান্তির ভাব জাগ্রত করে।
বিমুগ্ধ বেদনায় শান্তি - কবির এ অনুভবে বিষণ্ণতার মধ্যে এক ধরনের প্রশান্তির আভাস রয়েছে।
বর্ষার অন্ধকারের অনুরাগ - এ অভিব্যক্তিতে আবহমান বাংলা কবিতায় বর্ষার অন্ধকার রাতে নায়ক-নায়িকার প্রেমের অনুরাগের ঐতিহ্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। স্মরণীয়;
এমন দিনে তারে বলা যায়।
এমন ঘনঘোর বরষায়।’’ (রবীন্দ্রনাথ)
হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া - সিক্ত নীলাম্বরী - এ চিত্রকল্পে মধ্যযুগের বাংলা কবিতার প্রসঙ্গ এসেছে। বৈষ্ণব কবিতায় বর্ষা রাতে রাধার বিরহের যে ছবি পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় - বর্ষাকে উপেক্ষা করে বিরহ বিহবলা রাধা নীল শাড়ি পরে রাতের অন্ধকারে প্রিয় মিলনের আশায় অভিসারে যেতেন। নায়িকার সিক্ত নীল শাড়ি নায়কের মনে যে গভীর অনুরাগের জন্ম দিয়ে এসেছে পূর্ব বাংলার নীলাভ শ্যামল প্রকৃতির পরিবেষ্টন তেমনি কবির অন্তর ছুঁয়ে যায়। চিত্রকল্পটিতে কবির হৃদয়াবেগ ও রূপমুগ্ধতা প্রকাশিত হয়েছে।
কনক-লতা - স্বর্ণলতা।
কবরী এলো করে
আকাশ দেখার মুহুর্ত - এ চিত্রকল্পটিতেও মহাকবি কালিদাসের বিখ্যাত ‘মেঘদূত' কাব্যে নবমেঘের সঞ্চারে উৎফুল্ল নারীর কেশ আলুলায়িত করে আকাশ অবলোকনের প্রসঙ্গ নতুনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। নবমেঘের সঞ্চার তন্বী-হৃদয়ে যে আনন্দের সঞ্চার করে সেই আনন্দ কবি অনুভব করেন এ দেশের প্রকৃতির সৌন্দর্যের মধ্যে।
অশেষ অনুভব নিয়ে
পুলকিত সচ্ছলতা - বাংলাদেশের রূপবৈচিত্র্য কবির অনুভূতির বহুমাত্রিকতা ও বৈচিত্র্য নিয়ে উপস্থিত এবং সেগুলো তার অফুরন্ত আনন্দের উৎস।
কত দশা বিরহিণীর
এক দুই তিন দশটি - বৈষ্ণব কবিতায় বর্ণিত রাধার বিরহের দশটি অবস্থার উল্লেখসূত্রে কবি পূর্ব বাংলার মানুষের ভাবাবেগের বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যকেও এ দেশের অস্তিত্বের সঙ্গে একীভূত করে দেখেছেন।
এখানে ত্রস্ত আকুলতায়
চিরকাল অভিসার/ঘর আর বিদেশ
আঙিনা আকুলতায় একাকার - বৈষ্ণব কবিতার ঐতিহ্যের অনুসরণে কবি এ দেশের মানুষের হৃদয়াবেগের চিত্র এঁকেছেন। প্রেমবিহবল এদেশের মানুষ আবহমানকাল ধরে ঘরকে করেছে বাহির, বাহিরকে করেছে ঘর।
কাকের চোখের মত
কালো চুল এলিয়ে - কবি পূর্ব বাংলাকে মমতাময়ী নারীমূর্তি রূপে কল্পনা করতে গিয়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশকে কালোচুলের সঙ্গে উপমিত করেছেন।
পানি পা ডুবিয়ে - বর্ষাকালে পূর্ব বাংলার মাঠঘাট পানিতে ডুবে যায়। কবি কল্পনা করেছেন মূর্তিমতী পূর্ব বাংলা যেন তখন পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকে, যেমন করে পানিতে ভেসে থাকে রাঙা পদ্ম।
হৃদয় ছুঁয়ে-যাওয়া স্নিগ্ধ
নীলাম্বরীতে দেহ ঘিরে - বর্ষাস্নাত পূর্ব বাংলার নীলাভ শ্যামল প্রকৃতি যেন মূর্তিমতী নারীরূপী পূর্ব বাঙলার দেহ ঘিরে থাকা নীল শাড়ি।
পুলকিত স্বচ্ছলতার প্রগাঢ় নিকুঞ্জ - পূর্ব বাংলা কবির চোখে সীমাহীন আনন্দ ও সৌন্দর্যের এক সুগভীর আকর্ষণীয় লতা-নিকুঞ্জের সঙ্গে তুলনীয়।
উৎস ও পরিচিতি
‘আমার পূর্ব বাংলা' কবিতাটি সংকলিত হয়েছে সৈয়দ আলী আহসানের ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত' কাব্যগ্রন্থ থেকে।
কবিতাটিতে কবির সৌন্দর্যপ্রীতি ও স্বদেশচেতনা নানা উপমা-রূপক ও চিত্রকল্পের সুনিপুণ বিন্যাসে এক অখন্ড ভাবমূর্তিতে উজ্জ্বল। কবির একান্ত ও অন্তরঙ্গ অনুভূতির স্নিগ্ধ ফসল কবিতাটি।
স্বদেশের রূপলাবণ্য ও বৈচিত্র্যে কবি অভিভূত। পূর্ব বাংলার প্রকৃতি তাঁর অন্তরে অজস্র অনুভবের সৃষ্টি করেছে। আর কবি সেই ভাবের প্রবাহকে একের পর এক পরতে পরতে সাজিয়েছেন উপমা, রূপক ও চিত্রকল্পে। একই সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটেছে আবহমান বাংলার প্রকৃতি ও মানুষের অনুপম ঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গের।
প্রকৃতির অজস্র রূপময়তা, ব্যক্তিগত অনুভব, শেকড়সন্ধানী চেতনা- সব মিলিয়ে শিল্পসফল এ কবিতাটি নির্মাণ করা হয়েছে মাত্র একটি বাক্যের আধারে। নিঃসন্দেহে এটি কবির আধুনিক শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্যের এক ঐশ্বর্যময় ফসল।
ছন্দ
‘আমার পূর্ব বাংলা' কবিতাটি গদ্যছন্দে রচিত। গদ্যছন্দে কোনো সুনির্দিষ্ট পর্ব বা মাত্রাসাম্য রক্ষিত হয় না। কিন্তু কবি একটি অনতিনিরূপিত ধ্বনি সৃষ্টি করেন।
অনুশীলনমূলক কাজ
ভাষা অনুশীলন q সম্বন্ধ পদ
কোনো কিছু বর্ণনা বা ভাবানুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে আমরা অনেক সময় সম্বন্ধ পদের ব্যবহার করে থাকি। ব্যাকরণে সম্বন্ধ পদ বলতে কোনো কিছুর সঙ্গে অন্য কিছুর সম্পর্ককে বোঝায়। সাধারণত যার সঙ্গে সম্বন্ধ সেই শব্দের শেষে ‘র' বা ‘এর' বিভক্তি যোগ করে সম্বন্ধ প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
‘আমার পূর্ব বাংলা' কবিতায় সম্বন্ধ পদের ব্যাপক ও বৈচিত্র্যময় ব্যবহার দেখা যায়। যেমন:
অন্ধকারের তমাল
অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতা
কালো কেশ মেঘের সঞ্চয়
বিমুগধ বেদনার শান্তি
আকাশ দেখার মুহূর্ত
কদম্ব তরুর একটি শাখা
অজস্র ফুলের বন্যা।
কোনো কোনো সম্বন্ধ পদ উপমা ব্যবহারে সহায়ক হয়েছে:
ক) সন্ধ্যার উন্মেষের মতো
সরোবরের অতলের মতো
কালো-কেশ মেঘের সঞ্চয়ের মতো
বিমুগ্ধ বেদনার শান্তি
খ) ঘুমের অসতায় চোখ বুঁজে আসার মতো
শান্তি
গ) কাকের চোখের মতো কালোচুল
এলিয়ে
বানান সতর্কতা
সন্ধ্যা, নীলাম্বরী, কবরী, মুহূর্ত, সূর্য, বিরহিণী, প্রগাঢ়, ত্রস্ত, স্বচ্ছলতা।
উপসর্গ অ-যোগে গঠিত শব্দ
অতল, অশেষ, অফুরন্ত, অলসতা।
কবিতার অলংকার q চিত্রকল্প
চিত্রকল্প বলতে এমন সব শব্দ বা শব্দগুচ্ছের ব্যবহার বোঝায়, যার সাহায্যে মনের পর্দায় বর্ণিত বস্তু বা ভাবের একটা ছবি ওঠে। ‘আমার পূর্ব বাংলা' কবিতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই গড়ে উঠেছে নানা চিত্রকল্পের সমাহারে। যেমন কবিতাটির শুরুতেই আছে:
আমার পূর্ব বাংলা একগুচ্ছ স্নিগ্ধ
অন্ধকারে তমাল।
এখানে ‘একগুচ্ছ স্নিগ্ধ অন্ধকারের তমাল' কথাটা সহজেই আমাদের মনের পর্দায় একটি ছবির আভাস দেয়। কবিতাটি মনোযোগসহকারে পড় এবং চিত্রকল্পগুলো খুঁজে বের কর।
দীর্ঘ-উত্তর প্রশ্ন
১. ‘আমার পূর্ব বাংলা’ কবিতার অনুসরণে বাংলাদেশের রূপময় চিত্র অংকন কর।
২. ‘আমার পূর্ব বাংলা’ কবিতার ভাববস্ত্ত নিজের ভাষায় লেখ এবং কবিতাটির দু’একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য তুলে ধর।
বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১. আমার পূর্ব বাংলাকে কবি কিসের সঙ্গে তুলনা করেছেন? তিনি ‘বিমুগ্ধ বেদনার শান্তি’র যেসব উপমা কবিতায় দিয়েছেন সেগুলো কী কী?
২. টীকা লেখ :
ক) হৃদয় ছুঁয়ে-যাওয়া সিক্ত নীলাম্বরী
খ) কবরী এলো করে আকাশ দেখার মূহূর্ত
গ) কত দশা বিরহিণীর।
ভাষাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১. সম্বন্ধ পদ কাকে বলে? ‘আমার পূর্ব বাংলা’ কবিতা থেকে সম্বন্ধ পদের পাঁচটি প্রয়োগ দেখাও।
২. নিম্নরেখ শব্দগুলোর পদ নির্দেশ কর :
ক) প্রগাঢ় নিকুঞ্জ
খ) সিক্ত নীলাম্বরী
গ) পুলকিত সচ্চলতা
ঘ) তিনটি ফুল আর অনেক পাতা
ঙ) নীল হলুদ বেগুনি অথবা সাদা
চ) তুমি আমার পূর্ব বাংলা
ছ) রাঙা উৎপল যার উপমা।
ব্যাখ্যা
সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা লেখ :
১. আমার পূর্ব-বাংলা ........ একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ
২. সন্ধ্যার উন্মেষের ........... বেদনার শান্তি
৩. কাকের চোখের মতো ........ যার উপমা