Logo Sponsored by Chowdhury and Hossain, Advanced Publications

Komolakanter Jobanbondi




কমলাকান্তের জবানবন্দি
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

লেখক পরিচিতি
বাংলা উপন্যাসের জনক ও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘সাহিত্য সম্রাট’ হিসেবেও অভিহিত হয়ে থাকেন। ‘বঙ্গদর্শন’ নামে যে বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকার তিনি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিকাশে এবং শক্তিশালী লেখক সৃষ্টিতে তার অবদান অসামান্য। যুগন্ধর এই সাহিত্য-স্রষ্টার বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুন্ডলা’, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘রাজসিংহ’ ইত্যাদি। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫) প্রথম প্রকৃত বাংলা উপন্যাস।
মননশীল প্রবন্ধ রচনায়ও বঙ্কিমচন্দ্রের অনন্য কুশলতার পরিচয় রয়েছে। তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘লোকরহস্য’, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’, ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ ও ‘সাম্য’।
বঙ্কিমচন্দ্র আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম প্রধান সৃষ্টিশীল লেখকদের একজন।
বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকদের একজন। পেশায় তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।
বঙ্কিমচন্দ্রের জন্ম ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগণা জেলার কাঁঠালপাড়ায় এবং তাঁর মৃত্যু ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে।

সেই আফিংখোর কমলাকান্তের অনেকদিন কোনো সংবাদ পাই নাই। অনেক সন্ধান করিয়াছিলাম, অকস্মাৎ সম্প্রতি একদিন তাহাকে ফৌজদারি আদালতে দেখিলাম। দেখি যে, ব্রাহ্মণ এক গাছতলায় বসিয়া, গাছের গুঁড়িতে ঠেসান দিয়া, চক্ষু বুজিয়া ডাবায় তামুক টানিতেছেন। মনে করিলাম, আর কিছু না, ব্রাহ্মণ লোভে পড়িয়া কাহার ডিবিয়া হইতে আফিং চুরি করিয়াছে- অন্য সামগ্রী কমলাকান্ত চুরি করিবে না- ইহা নিশ্চিত জানি। নিকটে একজন কালোকোর্তা কনস্টেবলও দেখিলাম। আমি বড় দাঁড়াইলাম না- কি জানি যদি কমলাকান্ত জামিন হইতে বলে। তফাতে থাকিয়া দেখিতে লাগিলাম যে, কান্ডটা কী হয়।
কিছুকাল পরে কমলাকান্তের ডাক হইল। তখন একজন কনস্টেবল রুল ঘুরাইয়া তাহাকে সঙ্গে করিয়া এজলাসে লইয়া গেল। আমি পিছু পিছু গেলাম। দাঁড়াইয়া দুই একটি কথা শুনিয়া, ব্যাপারখানা বুঝিতে পারিলাম।
এজলাসে, প্রথামত মাচানের উপর হাকিম বিরাজ করিতেছেন। হাকিমটি একজন দেশী ধর্মাবতার-পদে ও গৌরবে ডিপুটি। কমলাকান্ত আসামী নহে- সাক্ষী। মোকদ্দমা গরুচুরি। ফরিয়াদি প্রসন্ন গোয়ালিনী।
কমলাকান্তকে সাক্ষীর কাটারায় পুরিয়া দিল। তখন কমলাকান্ত মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল। চাপরাশি ধমকাইলেন- ‘হাস কেন?’
কমলাকান্ত জোড়হাত করিয়া বলিল, ‘বাবা, কার ক্ষেতে ধান খেয়েছি যে, আমাকে এর ভিতর পুরিলে?’ চাপরাশি মহাশয় কথাটা বুঝিলেন না। দাড়ি ঘুরাইয়া বলিলেন, ‘তামাশার জায়গা এ নয়- হলফ পড়।’’ কমলাকান্ত বলিল, ‘‘পড়াও না বাপু।’’
একজন মুহুরি তখন হলফ পড়াইতে আরম্ভ করিল। বলিল, ‘‘বল, আমি পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ জানিয়া .......’’ কমলাকান্ত। (সবিস্ময়ে) কী বলিব?
মুহুরি। শুনতে পাও না- ‘‘পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ জেনে-’’
কমলা। পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ জেনে! কী সর্বনাশ!
হাকিম দেখিলেন, সাক্ষীটা কী একটা গন্ডগোল বাধাইতাছে। জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘‘সর্বনাশ কী?’’
কমলা। পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ জেনেছি- একথাটা বলতে হবে?
হাকিম। ক্ষতি কী? হলফের ফারমই এই।
কমলা। হুজুর সুবিচার বটে। কিন্তু একটা কথা বলি কি, সাক্ষ্য দিতে দিতে দুই একটা ছোট রকম মিথ্যা বলি, না হয় বলিলাম- কিন্তু গোড়াতেই একটা বড় মিথ্যা বলিয়া আরম্ভ করিব, সেটা কি ভাল?
হাকিম। এর আর মিথ্যা কী?
কমলাকান্ত মনে মনে বলিল, ‘‘এত বুদ্ধি থাকিলে তোমার কি এ পদবৃদ্ধি হইত?’’ প্রকাশ্যে বলিল, ‘‘ধর্মাবতার, আমার একটু একটু বোধ হইতেছে কি যে, পরমেশ্বর ঠিক প্রত্যক্ষের বিষয় নয়। আমার চোখের দোষই হউক আর যাই হউক, কখনও ত এ পর্যন্ত পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ দেখিতে পাইলাম না। আমি যখন তাঁহাকে এ ঘরের ভিতর প্রত্যক্ষ পাইতেছি না- তখন কেমন করিয়া বলি- আমি পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ জেনে-’’
ফরিয়াদির উকিল চটিলেন- তাঁহার মূল্যবান সময়, যাহা মিনিটে মিনিটে টাকা প্রসব করে, তাহা এই দরিদ্র সাক্ষী নষ্ট করিতেছে। উকিল তখন গরম হইয়া বলিলেন, ‘‘সাক্ষী মহাশয়! Theological Lecture টা ব্রাহ্মসমাজের জন্য রাখিলে ভাল হয় না? এখানে আইনের মনে চলিতে মন স্থির করুন।’’
কমলাকান্ত তাঁহার দিকে ফিরিল। মৃদু হাসিয়া বলিল, ‘‘আপনি বোধ হইতেছে উকিল।’’
উকিল। (হাসিয়া) কিসে চিনিলে?
কমলা। বড় সহজে। মোটা চেন আর ময়লা শামলা দেখিয়া। তা, মহাশয়! আপনাদের জন্য এ Theological Lecture নয়। আপনারা পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ দেখেন স্বীকার করি- যখন মোয়াক্কেল আসে।
উকিল সরোষে উঠিয়া হাকিমকে বলিলেন, "I ask the protection of the Court against the insults of this witness."
কোর্ট বলিলেন, "O Baboo! the witness is your own witness, and you are at liberty to send him away if you like."
এখন কমলাকান্তকে বিদায় দিলে উকিলবাবুর মোকদ্দমা প্রমাণ হয় না- সুতরাং উকিলবাবু চুপ করিয়া বসিয়া পড়িলেন।
হাকিম গতিক দেখিয়া, মুহুরিকে আদেশ করিলেন যে, ‘‘ওথের প্রতি সাক্ষীর objection আছে- উহাকে simple affirmation দাও।’’ তখন মুহুরি কমলাকান্তকে বলিল, ‘‘আচ্ছা, ও ছেড়ে দাও- বল, আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি- বল।’’
কমলা। কী প্রতিজ্ঞা করিতেছি, সেটা জানিয়া প্রতিজ্ঞাটা করিলে ভাল হয় না?
মুহুরি হাকিমের দিকে চাহিয়া চলিল, ‘‘ধর্মাবতার! সাক্ষী বড় সের্কশ্।’’
উকিলবাবু হাঁকিলেন, "Very Obstructive."
কমলাকান্ত। (উকিলের প্রতি) সাদা কাগজে দস্তখত করিয়া লওয়ার প্রথাটা আদালতের বাইরে চলে জানি- ভিতরেও চলিবে কি?
উকিল। সাদা কাগজে কে তোমার দস্তখত লইতেছে?                                                 
কমলা। কী প্রতিজ্ঞা করিতে হইবে, তাহা না জানিয়া, প্রতিজ্ঞা করা, আর কাগজে কী লেখা হয়, তাহা না দেখিয়া দস্তখত করা, একই কথা।                                                                                              
হাকিম তখন মুহুরিকে আদেশ করিলেন যে, ‘‘প্রতিজ্ঞা আগে ইহাকে শুনাইয়া দাও- গোলমালে কাজ নাই।
মুহুরি তখন বলিলেন, ‘‘শোন, তোমাকে বলিতে হইবে যে, আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আমি যে সাক্ষ্য দিব, তাহা সত্য হইবে, আমি কোনো কথা গোপন করিব না- সত্য ভিন্ন আর কিছু হইবে না।’’
কমলা। ওঁ মধু মধু মধু।
মুহুরি। সে আবার কী?
কমলা। পড়ান, আমি পড়িতেছি।
কমলাকান্ত তখন আর গোলযোগ না করিয়া প্রতিজ্ঞা পাঠ করিল। তখন তাঁহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিবার জন্য উকিলবাবু গাত্রোত্থান করিলেন, কমলাকান্তকে চোখ রাঙ্গাইয়া বলিলেন, ‘‘এখন আর বদ্মায়েশি করিও না- আমি যা জিজ্ঞাসা করি, তার যথার্থ উত্তর দাও। বাজে কথা ছাড়িয়া দাও।’’                                                     
কমলা। আপনি যা জিজ্ঞাসা করিবেন, তাই আমাকে বলিতে হইবে? আর কিছু বলিতে পাইব না?
উকিল। না।
কমলাকান্ত তখন হাকিমের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘অথচ আমাকে প্রতিজ্ঞা করাইলেন যে, কোনো কথা গোপন করিব না।’ ধর্মাবতার, বেআদবি মাফ হয়। পাড়ায় আজ একটা যাত্রা হইবে, শুনিতে যাইব ইচ্ছা ছিল; সে সাধ এইখানেই মিটিল। উকিলবাবু অধিকারী- আমি যাত্রার ছেলে, যা বলাইবেন, কেবল তাই বলিব; যা না বলাইবেন; তা বলিব না। যা না বলাইবেন, তা কাজেই গোপন থাকিবে। প্রতিজ্ঞাভঙ্গের অপরাধ লইবেন না।’’
হাকিম। যাহা আবশ্যক বিবেচনা করিবে, তাহা না জিজ্ঞাসা হইলেও বলিতে পার।                           
কমলাকান্ত তখন সেলাম করিয়া বলিল, ‘বহৎ খুব।’’ উকিল তখন জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করিলেন, ‘‘তোমার নাম কী?’’
কমলা। শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্তী।                                                                                               
উকিল। তোমার বাপের নাম কী?
কমলাকান্ত পিতার নাম বলিল। উকিল তখন জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘‘তুমি কী জাতি?’’
কমলা। আমি কি একটা জাতি?                                                                        
উকিল। তুমি কোন জাতীয়?
কমলা। হিন্দু জাতীয়।
উকিল। আঃ! কোন বর্ণ?
কমলা। ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ।
উকিল। দূর হোক ছাই! এমন সাক্ষীও আনে! বলি তোমার জাত আছে?
কমলা। মারে কে?                                                                      
হাকিম দেখিলেন, উকিলের কথায় হইবে না। বলিলেন, ‘‘ব্রাহ্মণ, কায়স্ত, কৈবর্ত, হিন্দুর নানা প্রকার জাতি আছে জান তা- তুমি তার কোন্ জাতির ভিতর?’’
কমলা। ধর্মাবতার! এ উকিলেরই ধৃষ্টতা! দেখিতেছেন আমার গলায় যজ্ঞোপবীত, নাম বলিয়াছি চক্রবর্তী- ইহাতেও যে উকিল বুঝেন নাই যে, আমি ব্রাহ্মণ, ইহা আমি কী প্রকারে জানিব?
হাকিম লিখিলেন, ‘‘জাতি ব্রাহ্মণ।’’ তখন উকিল জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘‘তোমার বয়স কত?’’
এজলাসে একটা ক্লক ছিল- তাহার পানে চাহিয়া হিসাব করিয়া কমলাকান্ত বলিল, ‘‘আমার বয়স ৫১ বৎসর, দুই মাস, তের দিন, চারি ঘণ্টা, পাঁচ মিনিট-’’
উকিল।         কী জ্বালা! তোমার ঘণ্টা মিনিট কে চায়?                                                                      
কমলা।          কেন, এই মাত্র প্রতিজ্ঞা করাইয়াছেন যে, কোনো কথা গোপন করিব না।
উকিল।         তোমার যা ইচ্ছা কর। আমি তোমায় পারি না। তোমর নিবাস কোথা?
কমলা।          আমার নিবাস নাই।                                                                      
উকিল।         বলি, বাড়ি কোথা?
কমলা।          বাড়ি দূরে থাক্, আমার একটা কুঠারিও নাই।
উকিল।         তবে থাক কোথা?
কমলা।          যেখানে সেখানে।
উকিল।         একটা আড্ডা ত আছে?
কমলা।          ছিল, যখন নসীবাবু ছিলেন, এখন আর নাই।
উকিল।         এখন আছ কোথা?
কমলা।          কেন, এই আদালতে।
উকিল।         কাল ছিলে কোথা?
কমলা।          একখানা দোকানে।
হাকিম বলিলেন, ‘‘আর বকাবকিতে কাজ নাই- আমি লিখিয়া লইতেছি, নিবাস নাই। তার পর?’’
উকিল।         তোমার পেশা কী?
কমলা।          আমার আর পেশা কী? আমি কি উকিল যে, আমার পেশা আছে।
উকিল।         বলি খাও কী করিয়া?
কমলা।          ভাতের সঙ্গে ডাল মাখিয়া, দক্ষিণ হস্তে গ্রাস তুলিয়া, মুখে পুরিয়া গলাধঃকরণ করি।
উকিল।         সে ডাল ভাত জোটে কোথা থেকে?
কমলা।          ভগবান জোটালেই জোটে, নইলে জোটে না।
উকিল।         কিছু উপার্জন কর?
কমলা।          এক পয়সাও না।
উকিল।         তবে কি চুরি কর?
কমলা।          তাহা হইলে ইতিপূর্বেই আপনার শরণাগত হইতে হইত। আপনি কিছু ভাগও পাইতেন।
উকিল তখন হাল ছাড়িয়া দিয়া, আদালতকে বলিলেন, ‘‘আমি এ সাক্ষী চাহি না। আমি ইহার জবানবন্দি করাইতে পারিব না।’’

শব্দার্থ ও টীকা
ফৌজদারি আদালত          -     যে আদালতে বা বিচারালয়ে ফৌজদারি দন্ডবিধির আওতায় মামলা পরিচালিত হয়।
এজলাস                        -     বিচারকক্ষ।
ডেপুটি                          -     ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।
কাটারা                         -     কাঠগড়া।
মুহুরি                           -     উকিলের কাজে সহায়তাকারী লেখক।
ফারম                          -     ফর্ম। form.
ধর্মাবতার                      -     বিচারককে সম্বোধন বিশেষ। ধর্ম বা ন্যায়ের মূর্তিমান রূপ।
Theological Lecture -     ধর্মতত্ত্বীয় বক্তৃতা।                                                                      
ব্রাহ্মসমাজ                     -     রাজা রামমোহন রায় (১৭৭৪-১৮৮৩) প্রবর্তিত এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) প্রমুখ প্রচারিত একেশ্বরবাদী ধর্মসম্প্রদায়।
শামলা                          -     উকিলের পোশাক হিসেবে ব্যবহৃত শালের পাগড়ি।
ওথ                             -     হলফনাতা, শপথ-বাক্য। oath।                                                          
Objection                 -     আপত্তি।
Simple affirmation   -     সহজ হলফনামা।                                                                      
সের্কশ্                          -     বেয়াড়া, উদ্ধত, একরোখা, একগুঁয়ে।
Obstructive              -     বাধাসৃষ্টিকারী। ঝামেলার।
ওঁ                               -     ঈশ্বরবাচক ধ্বনি।
মধু                             -     এখানে সুর (অথবা ব্যঙ্গে টাকাকড়ি) বোঝাতে ব্যবহৃত।
অধিকারী                      -     যাত্রাদলের মালিক বা পরিচালক।
বহৎ খুব                       -     বেশ ভাল। প্রশংসাসূচক ধ্বনি।                                                           
বর্ণ                              -     উকিল জানতে চেয়েছেন। হিন্দু সমাজের সামাজিক শ্রেণীবিভাগ অনুসারে কমলাকান্তের জাতিসম্প্রদায় কী। আর কমলাকান্ত বর্ণ অর্থে রং ধরে নিয়ে জবাব দিয়েছে ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ।
যজ্ঞোপবীত                    -     যজ্ঞসূত্র, উপবীত, পৈতা।                                                                      
কুঠারি                         -     ছোট কামরা, খোপ।
শরণাগত                       -     আশ্রয়প্রার্থী বা আশ্রয়প্রাপ্ত।
জবানবন্দি                     -     বিচারকের কাছে প্রদত্ত বিবৃতি।

উৎস ও পরিচিতি                                                                      
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের জবানবন্দি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার ১২৮৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যায়। এটি বঙ্কিমের বিখ্যাত রম্যব্যঙ্গ রচনা সংকলন ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর সর্বশেষ রচনা। রচনার নির্বাচিত অংশবিশেষ এখানে সম্পাদিতভাবে সংকলিত হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বঙ্কিমচন্দ্রের এই রচনাটির মূল শিরোনাম ছিল : ‘কমলাকান্তের জোবানবন্দি।’                                                                      
বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর রচনাগুলোর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এক ধরনের হাস্যরসাত্মক রঙ্গব্যঙ্গমূলক রচনার প্রচলন করেছিলেন, যার ভেতর দিয়ে তিনি পরিহাসের মধ্য দিয়ে সমকালীন সমাজ, ধর্ম, সভ্যতা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।                                                   
‘কমলাকান্তের জবানবন্দি’ রচনাটি নকশা জাতীয় অভিনব রচনা। এটি বঙ্কিম সাহিত্যের অন্যতম চমকপ্রদ সম্পদ। এখানে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সাক্ষী কমলাকান্তের জবানবন্দির মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র দেখিয়েছেন আদালতে সাজানো-গোছানো যে গালভরা কারবার চলে তা অনেকাংশেই কৃত্রিম আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
প্রসন্ন গোয়ালিনীর গরু চুরির মামলায় সাক্ষী আফিং-এর নেশায় কিছু অপ্রকৃতিস্থ কমলাকান্তকে জেরা করতে গিয়ে উকিল যেভাবে পদে পদে বিব্রত ও নাকাল হয়েছেন, তাতে আমরা বিস্মিত না হয়ে পারি না। উকিল বাবু কমলাকান্তকে যতই উন্মাদ মনে করুন না কেন, তার প্রচ্ছন্ন শ্লেষাত্মক উক্তিগুলো বাস্তব সত্যের আলোয় আমাদের চোখে উজ্জ্বল হয়ে ধরা পড়ে।
আপাতদৃষ্টিতে কমলাকান্তের আচরণ ও কথাবার্তা অনেকখানি পাগলামির সামিল। সে আফিং খায়, বসে বসে ঝিমায়, নানা উদ্ভট কথা বলে। কিন্তু নেশাখোর ও বাতিকগ্রস্ত চেহারা ও অসংলগ্ন কথাবার্তার আড়ালে রয়েছে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশীল জীবনদৃষ্টি। তা আমাদের চারপাশের নানা রুচি ও অসঙ্গতিকেই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
এই রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র কৌতুকরস সৃষ্টিতে যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তা অতুলনীয়।

অনুশীলনমূলক কাজ                                                                      
সাহিত্যবোধ q নকশা
একটা দালানের ছবি যখন ক্যামেরায় ধরা পড়ে তখন তাকে বলি আলোকচিত্র। আর নকশাকার যখন গৃহনির্মাণের প্রাথমিক খসড়া রেখাঙ্কিত করে তৈরি করেন তখন তাকে বলা হয় নকশা।
তেমনি গল্প-উপন্যাসের মতো বিস্তৃত ও গভীর তাৎপর্যময় ছবি না এঁকে লেখক যখন তার খসড়া একটা ছবি অাঁকেন স্বল্প কিছু রেখায়, তখন তাকে বলা হয় নকশা।                                                                      
‘কমলাকান্তের জবানবন্দি’ও এ ধরনের নকশা জাতীয় হালকা সরস রচনা। এখানে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সাক্ষীকে উকিলের জেরার একটা চালচিত্র বা চিত্রধর্মী বর্ণনা ফুটে উঠেছে।
আপাতদৃষ্টিতে এখানে কোনো গভীর জীবন-দর্শন দেখা যায় না। কিন্তু হালকা রসালো কথাবার্তার ভেতর দিয়ে তৎকালীন আদালতের বিচার ব্যবস্থার অসঙ্গতির দিকটিকে এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

সাহিত্যবোধ q বাগ্বৈদগ্ধ (wit)                                                                      
অনেক সময় কথাবার্তায় থাকে বুদ্ধির চমক ও দীপ্তি। তা এমন এক অপ্রত্যাশিত অর্থ প্রকাশ করে যে, তাতে আমরা হাস্যরস অনুভব করি। একে বলা হয় বাগ্বৈদগ্ধ। যে কোনো বিষয় নিয়ে চকিত ও সুতীক্ষ্ণ মন্তব্যের মধ্যেও বাগ্বৈদগ্ধের প্রকাশ ঘটতে পারে। ‘কমলাকান্তের জবানবন্দি’ রচনায় উকিলের জেরার জবাব এ ধরনের বাগ্বৈদগ্ধপূর্ণ।
গরু চুরি মামলার সাক্ষী কমলাকান্তকে সাক্ষীর কাটরায় ঢোকানো হলে কমলাকান্ত বলেছেন, ‘বাবা, কার ক্ষেতে ধান খেয়েছি যে, আমাকে এর মধ্যে পুরিলে?’ এখানে কমলাকান্ত সাক্ষীর কাটরাকে খোঁয়াড় কল্পনা করেছেন। ফলে স্বভাবতই তাঁর সম্পর্কে আমাদের সাক্ষীর বদলে ‘গরু’ কথাটাই মনে আসে এবং এর ফলে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়।
এ রকম :                                                                       
উকিল। তুমি কী জাতি?                                                                      
কমলা। আমি কি একটা জাতি?
উকিল। তুমি কোন জাতীয়?
কমলা। হিন্দু জাতীয়।
উকিল। আঃ! কোন বর্ণ?
কমলা। ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ।

ভাষা অনুশীলন q বাক্যের প্রকার পরিবর্তন
এক প্রকার বাক্যকে মূল অর্থের পরিবর্তন না ঘটিয়ে অন্য প্রকারের বাক্যে পরিণত করাকে বলা হয় বাক্যের প্রকার পরিবর্তন বা বাক্য পরিবর্তন। যেমন :
সরল বাক্য        :           ফরিয়াদি প্রসন্ন গোয়ালিনী।
জটিল বাক্য       :           যে ফরিয়াদি, সে প্রসন্ন গোয়ালিনী।
সরল বাক্য        :           সাক্ষীটা কী একটা গন্ডগোল বাঁধাইতেছে।
জটিল বাক্য       :           যে সাক্ষী, সে একটা গন্ডগোল বাঁধাইতেছে।
সরল বাক্য        :           আমার নিবাস নাই।
জটিল বাক্য       :           যা নিবাস, তা আমার নাই।
সরল বাক্য        :           তোমার বাপের নাম কী?
জটিল বাক্য       :           তোমার যিনি বাপ, তার নাম কী?
সরল বাক্য        :           আমি এ সাক্ষী চাই না।
জটিল বাক্য       :           যে সাক্ষী এ রকম, তাকে আমি চাই না।

বিচার-কাজের সঙ্গে যুক্ত শব্দ
নিচের (ক) গুচ্ছে শব্দগুলোর ইংরেজি পরিভাষা (খ) গুচ্ছ থেকে বেছে নাও।
ক.   ফৌজদারি আদালত, আদালত, জামিন, এজলাস, হাকিম, আসামি, ফরিয়াদি, সাক্ষী, হলফ, মুহুরি, উকিল, জবানবন্দি।
খ.   the court-room, bail, complainant, criminal court, legal statement, judge, witness, court, accused, oath, clerk, lawyer.
বানান সতর্কতা
ব্রাহ্মণ, সামগ্রী, সাক্ষী, সাক্ষ্য, প্রত্যক্ষ, ব্রাহ্ম।
দীর্ঘ-উত্তর প্রশ্ন
১.    ‘কমলাকান্তের জবানবন্দি’- রচনার ভেতর দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র তৎকালীন আদালতের কাজকর্মের যে অসঙ্গতির দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তা আলোচনা কর।
২.   ‘কমলাকান্তের জবানবন্দি’ রচনায় কমলাকান্তের চরিত্রের যে পরিচয় ফুটে উঠেছে তা লিপিবদ্ধ কর।
বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১.    ‘বাবা, কার ক্ষেতে ধান খেয়েছি যে, আমাকে এর ভিতরে পুরিলে?’- এটি কার উক্তি? এই উক্তির মাধ্যমে বক্তা আসলে কী বুঝিয়েছেন? সে কোথায় এবং কী প্রসঙ্গে এ কথা বলেছে?
২.   কমলাকান্তকে হলফ পড়াতে গিয়ে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল এবং যেভাবে মিটেছিল তা গুছিয়ে লেখ।
৩.   কমলাকান্তের জাতিগত পরিচয় সংক্রান্ত প্রশ্ন করে উকিল কী বিড়ম্বনার সম্মুখীন হয়েছিল?
৪.   কমলাকান্তের নিবাস সম্পর্কে উকিলের জেরা ও কমলাকান্তের জবানবন্দির অংশটি নিজের ভাষায় লেখ। এ জেরার ফলাফল কী নির্ধারিত হয়েছিল?
৫.   ‘‘আমি ইহার জবানবন্দি করাইতে পারিব না’’- কে, কেন এ ধরনের মন্তব্য করেছেন?
ভাষাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১.    ‘কমলাকান্তের জবানবন্দি’ রচনা অবলম্বনে বিচার-কাজের সঙ্গে যুক্তক পাঁচটি শব্দ লেখ এবং সেগুলোর পরিচয় দাও।
২.   নিচের সরল বাক্যগুলোকে জটিল বাক্যে রূপান্তরিত কর :
      ক) আমি এ সাক্ষী চাই না।
      খ) কমলাকান্ত পিতার নাম বল।
      গ) তোমার বাপের নাম কী?
      ঘ) কোনো কথা গোপন করিব না।
      ঙ) উকিলবাবু চুপ করিয়া বসিয়া পড়িলেন।
ব্যাখ্যা
১.    কী প্রতিজ্ঞা করিতে হইবে .............. দস্তখত কর, এই কথা।
২.   উকিলবাবু অধিকারী ................ তা বলিব না।


View Foundation Digital Talking Library is developed and maintained by Sigma Enterprise.
Theme designed by Imtiaz
All rights are reserved. Any kind of reproduction of any mp3 files and text files is prohibited. If any organization or any person is found copying or reproducing any of the material will be punished under copy right law.