পৃষ্ঠা ৩৭
বাংলাদেশে দরিদ্রতার কারণ
বাংলাদেশে বিরাজমান দারিদ্র অবস্থা দীর্ঘদিনের প্রতিকূল প্রাকৃতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার সমন্বিত প্রভাব। বাংলাদেশের ভৌগোলিক এবং প্রাকৃতিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দারিদ্র সমস্যা স্থায়ী আকার ধারণ করছে। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী গিলীন কোন দেশের দারিদ্র পরিস্থিতির জন্য তিনটি অবস্থাকে দায়ী করছেন। এগুলো হলো
১ পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে সামঞ্জ্যস বিধানে মানুষের অক্ষমতা;
২ প্রতিকূল প্রাকৃতিক আবহাওয়া, জলবায়ু এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা;
৩ সম্পদের অসম বন্টন এবং অসম উপার্জনের সুযোগ-সুবিধা।
বাংলাদেশের দারিদ্র বিস্তারের মৌলিক কারণরূপে উপর্যুক্ত তিনটি বিষয়কে চিহ্নিত করা যায়।
বাংলাদেশে সরকারিভাবে পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৯৭-২০০২) প্রতিবেদনে দারিদ্রের প্রধান কারণ হিসেবে
ক. নিম্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি; খ. আয়ের অসম বন্টন; গ. উৎপাদন উপকরণের অসম বন্টন; ঘ. বেকারত্ব-অর্ধবেকারত্ব; ঙ. জনসংখ্যাস্ফীতি; চ. মানব সম্পদ উন্নয়নের নিম্নহার; ছ. প্রাকৃতিক দুর্যোগ; এবং জ. সরকারি সমাজসেবা কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতা এ আটটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে।[1]
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও প্রাকৃতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দারিদ্রের প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলোঃ
১ পরিকল্পিত বিদেশি শাসন ও শোষণের প্রভাবঃ বাংলাদেশে বিরাজমান দারিদ্রের ঐতিহাসিক পটভূমি দীর্ঘদিনের বিদেশি শাসন ও শোষণের মধ্যে নিহিত। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসনাধীন থাকায় এদেশ পরিকল্পিত আর্থিক বঞ্চনা ও শোষণের শিকারে পরিণত হয়। ফলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বুনিয়াদ সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।
বাংলাদেশের উদ্বৃত্ত বিপুল পরিমাণ সম্পদ পরিকল্পিতভাবে বছরের পর বছর বিদেশে পাচার হয়েছে। ব্রিটিশ প্রবর্তিত দ্বৈতশাসন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং পাকিস্তান আমলের বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক নীতি এদেশে দারিদ্র বিকাশের প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করে। সুতরাং বলা যায়, ‘বাংলাদেশের দারিদ্র হলো ধারাবাহিক ও পরিকল্পিত বঞ্চনার ফল’
২ দারিদ্রের দুষ্টচক্রঃ বাংলাদেশে দারিদ্রের প্রধান কারণ দারিদ্রের দুষ্টচক্রের প্রভাব এবং দরিদ্র মানুষের জীবনবৃত্ত । বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের জীবনবৃত্ত এবং দারিদ্রের দুষ্টচক্রের প্রভাবে দরিদ্র শ্রেণীর নিম্ন জীবনমান থেকে শুরু করে কতিপয় সোপান অতিক্রম করে পুনরায় আবার দারিদ্রাবস্থায় ফিরে যায়। এভাবে দরিদ্র শ্রেণী ভবিষ্যত সন্তানদেরকেও দারিদ্রের মধ্যে রেখে যাচ্ছে। একজন দরিদ্র মানুষের জীবন বৃত্তের মতো, একটি দরিদ্র দেশও দারিদ্রাবস্থা থেকে শুরু করে আবার পুনরায় দারিদ্রাবস্থায় ফিরে আসে। সুতরাং বলা যায় বাংলাদেশে দারিদ্রের প্রধান কারণ বিরাজমান দারিদ্রাবস্থা বা দারিদ্রের দুষ্টচক্র।
৩ জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ বাংলাদেশের অন্যান্য আর্থ-সামাজিক সমস্যার মতো দারিদ্রের অন্যতম প্রধান কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সমাজবিজ্ঞানী গিলীন প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা, খারাপ জলবায়ু, আবহাওয়া এবং মহামারী প্রভৃতি প্রাকৃতিক অসুবিধাকে দারিদ্রের কারণ রূপে চিহ্নিত করছেন।[2] ভৌগোলিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে প্রতি বছর নদীর ভাঙ্গন, বন্যা, জলোচ্ছাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপুল পরিমাণ জানমাল ধ্বংস হয়। যা দরিদ্রতাকে ক্রমান্বয়ে জটিল করছে।[3] জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং প্রতিবছর নদীর ভাঙ্গনে বিপুল সম্পদের ক্ষতি ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় একদিকে বিপুল সম্পদের ক্ষতি হয়, অন্যদিকে কর্মসংস্থানের অভাব দেখা দেয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে সংক্রামক ব্যাধি মহামারী আকার ধারণ এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় এবং ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়। এতে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হবার প্রভাবে দারিদ্রের প্রসার ঘটে।
৪ প্রাকৃতিক সম্পদের অভাবঃ দারিদ্রের সঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পদ এবং প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার প্রত্যক্ষ যোগসূত্র রয়েছে। তবে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য এবং প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা না থাকলেও কোন দেশে ব্যাপক দারিদ্র বিরাজ করতে পারে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদের সংখ্যা ও পরিমাণ অত্যন্ত সীমিত। প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়া দেশে অর্থনৈতিক দিক হতে গুরুত্বপূর্ণ কৃষি বহির্ভূত বা অকৃষিজ সম্পদের পরিমাণ অত্যন্ত সীমিত। কয়লা, লোহা, কাঠ, মূল্যবান ধাতু, তেল প্রভৃতি সম্পদ অপ্রতুল। বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদ জমি এবং পানি খুবই সীমিত। বর্তমানে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত উজানে নদীতে বাঁধ দেয়ার প্রভাবে, পানি সম্পদ সীমিত হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নদীর ভাঙ্গন, ঘরবাড়ী তৈরির অবকাঠামো নির্মাণ, শহরায়ন ও শিল্পায়নের প্রভাবে মাথাপিছু কৃষি জমি হ্রাস এবং আবাদী জমি অনাবাদী হয়ে পড়ছে।
পৃষ্ঠা ৩৮
জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাবে চাষাবাদযোগ্য ভূমির ওপর চাপ পড়ায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীরা ভূমিহীনে পরিণত হচ্ছে। ১৯৯৬ সালের কৃষি শুমারির তথ্যানুযায়ী মোট আবাদকৃত ভূমির পরিমাণ ১৯৮৩ সালের কৃষি শুমারির চেয়ে শতকরা ২৭ ভাগ কমেছে। ২০০৫ এর কৃষি শুমারীর তথ্যানুযায়ী মাথাপিছু আবাদী জমি মাত্র ০.১৩ একর।
৫ জনসংখ্যাস্ফীতিঃ বাংলাদেশে দারিদ্রের অন্যতম প্রধান কারণ হলো জনসংখ্যা বিস্ফোরণ। ২০০১ সালের লোকশুমারীর তথ্যানুযায়ী এদেশে বার্ষিক জনসংখ্যার বৃদ্ধির শতকরা হার ১.৪৭ ভাগ। বাংলাদেশে প্রতি বছর আনুমানিক প্রায় ২২ লাখ লোক নতুন সংযোজিত হয়। ২০০৯-১০ এর তথ্যানুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, ১.৩২ শতাংশ এবং প্রক্ষেপিত মোট জনসংখ্যার ১৪৬.১ মিলিয়ন এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব ৯৯০ জন (প্রতি বর্গ কিলোমিটার)।[4] জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন, কর্মসংস্থান এবং বিনিয়োগসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না পাওয়ায় সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিম্নহার এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহারের ভারসাম্যহীনতার প্রভাবে নির্ভরশীলতার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা দারিদ্র বিমোচনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
৬ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাবঃ যে কোন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনের পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা ও পরিকল্পিত উন্নয়ন প্রত্যাশা অনুযায়ী সম্ভব হয়নি। উৎপাদন, বিনিয়োগ, প্রাপ্ত সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নয়ন সাধন প্রভৃতির প্রতিবন্ধকতা হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা। রাজনৈতিক আন্দোলন, হরতাল, অবরোধ, ধর্মঘট, দুর্নীতি প্রভৃতি নেতিবাচক পরিবেশ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও উন্নয়নকে ব্যাহত করছে, যার প্রভাবে দারিদ্র বিমোচন কার্যক্রম প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল বয়ে আনছে না।
৭. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিম্নহারঃ অর্থনৈতিক উন্নয়নের উচ্চহার দারিদ্র বিমোচনের সহায়ক। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গিয়েছে, এশিয়ার যেসব দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে শতকরা সাত থেকে আট ভাগ ছিল, সেখানে দারিদ্র বিমোচনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধির নিম্নহার দেখানো হলো।
প্রবদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ও অর্জন
পরিকল্পনা | প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা % | অর্জিত প্রবৃদ্ধি % |
প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা | ৫.৫০ | ৪.০১ |
দ্বি-বার্ষিক পরিকল্পনা | ৫.৬০ | ৩.৫০ |
দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা | ৫.৪০ | ৩.৮০ |
তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা | ৫.৪০ | ৩.৮০ |
চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা | ৫.০০ | ৪.১৫ |
পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা | ৭.০০ | ৫.২১ |
উদ্ধৃতঃ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১০, পৃ-২৯৮।
২০০৮-০৯ অর্থবছরের স্থির মূল্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৫.৮৮। এরূপ নিম্ন পর্যায়ের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্বারা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান বৃদ্ধি সম্ভব নয়। ১৯৯৬ সালে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ পরিচালিত গবেষণার তথ্যানুযায়ী, যদি প্রতি বছর মাথাপিছু আয় শতকরা চারভাগ হারে বৃদ্ধি পায়, তাহলে সাধারণ একজন দরিদ্রকে দারিদ্র অবস্থা হতে তুলে আনতে তেরো বছর সময় লাগবে। আর চরম দারিদ্র ব্যক্তির দারিদ্র মোচনে তেইশ বছর সময় লাগবে। তবে প্রবৃদ্ধিকে অবশ্য যথাযথ নীতির মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনের ভিত্তিতে পরিচালিত হতে হবে।
৮. আয়ের অসম বন্টনঃ বাংলাদেশে সরকারিভাবে আয়ের অসম বন্টনকে দারিদ্রের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানী গিলিন ধনসম্পদের অসম বন্টন ও অসম আয়কে দারিদ্রের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রধানত ধনসম্পদের অসম বন্টনের ফলে, আধুনিক সমাজে দরিদ্রতা দেখা দেয় বলে সমাজবিজ্ঞানীরা গুরুত্ব আরোপ করছেন।[5] বাংলাদেশের বাজার অর্থনীতি এমনভাবে পরিচালিত হচ্ছে, এতে ধনী আরো ধনী এবং দরিদ্র ক্রমান্বয়ে দারিদ্র অবস্থার শিকার হচ্ছে। বিগত শতকের নববইয়ের দশকে বাংলাদেশকে সাহায্যদাতা গ্রুপের প্যারিস কনসোর্টিয়াম বৈঠকে বাংলাদেশে দারিদ্রের কারণ হিসেবে প্রাপ্ত সম্পদের ওপর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার অভাবকে চিহ্নিত করা হয়েছিল।[6]
পৃষ্ঠা ৩৯
১৯৯৫-৯৬ সালে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ পরিবারের আয় চরম দারিদ্রপীড়িত ৫ শতাংশ পরিবারের আয়ের তুলনায় ২৭ গুণ বেশি ছিল। পক্ষান্তরে ২০০০ সালে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ধনী পরিবারের আয় চরম দারিদ্র জনগোষ্ঠীর আয়ের ৪৬ গুণ বেশি। সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ চরম দারিদ্রপীড়িত লোকের আয় ২০০০ সালের মোট আয়ের ০.৯৩ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০০৫ সালে মোট আয়ের ০.৭৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে জনসংখ্যার মোট প্রায় ৫০ ভাগের অংশীদারে রয়েছে জাতীয় আয়ের মাত্র ২০.৩২ শতাংশ।[7]
৯. উৎপাদনশীল সম্পদের অসম বন্টনঃ বাংলাদেশে সরকারিভাবে চিহ্নিত দারিদ্রের কারণগুলোর মধ্যে উৎপাদনশীল সম্পদের অসম বন্টন অন্যতম। বাংলাদেশের অর্থনীতির বস্তুগত মূলধন হলো ভূমি। বিশেষ করে পল্লীর কৃষি উৎপাদন ও আয়ের একক মূলধন হলো ভূমি। সুতরাং দারিদ্র বিশ্লেষণে ভূমি মালিকানার বিষয়টি গুরুত্ব পাওয়া স্বাভাবিক। পল্লী অঞ্চলের অসম ভূমি মালিকানা দারিদ্র পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ১৯৯৯ সালের তথ্যানুযায়ী জমির শ্রেণী বিন্যাসে গ্রামের শতকরা ৮২.২ ভাগ পরিবার ছিল ভূমিহীন বা ছোট জমির মালিক। মাত্র ১৭.৮ ভাগ পরিবার ছিল মাঝারি বা বড় জমির মালিক।[8] খানা আয় ব্যয় জরিপ ২০০৫ এর তথ্যানুযায়ী পল্লীর মোট খানার ৪৯.৩ শতাংশ ছিল ভূমিহীন, যা ২০০০ সালে ছিল ৩০.৪ শতাংশ। আর মোট খানার ৪৭.৮ শতাংশের জমির পরিমাণ ছিল ০.০৫ একরের নিচে। সরকারি তথ্যানুযায়ী দেশের ১৪,৯১৮,৫৫টি পরিবার বসতভিটাহীন। শুধু বসতভিটা রয়েছে এরূপ পরিবারের সংখ্যা ২১,৬৮০,০৩টি বসতভিটাসহ পাঁচ শতাংশের কম ভূমি রয়েছে এরূপ পরিবারের সংখ্যা ৪০,৬০১,৩৭টি। সুতরাং দেখা যায় বাংলাদেশে ৭৬ লাখ ৬০ হাজার ৭৩৫টি পরিবারের আবাদী ভূমি নেই। উল্লেখ্য বাংলাদেশে মোট হোল্ডিং দু’কোটি ৮১ লাখ ৬৬ হাজার।[9]
১০. বেকারত্ব এবং অর্ধবেকারত্বঃ দারিদ্র ও বেকারত্ব পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কযুক্ত। বাংলাদেশে দারিদ্রের উৎস হলো বেকারত্ব ও অর্ধবেকারত্ব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরোর ২০০৫-০৬ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুযায়ী মোট বেসামরিক শ্রমশক্তি ৪৯.৫ মিলিয়নের মধ্যে ৪৭.৪ মিলিয়ন কর্মে নিয়োজিত। বেকারত্বের হার ৪.৩ ভাগ এবং মহিলা শ্রমশক্তির ৭ শতাংশ বেকার।
বাংলাদেশে বেকারত্ব বৃদ্ধির প্রবণতা (মিলিয়ন)
শ্রমশক্তি জরিপ | ১৯৯৯-০০ | ২০০২-০৩ | ২০০৫-০৬ |
মোট বেসামরিক শ্রমশক্তি | ৪০.৭ | ৪৬.৩ | ৪৯.৫ |
পুরুষ | ৩২.২ | ৩৬.০ | ৩৭.৪ |
মহিলা | ৮.৫ | ১০.৩ | ১২.১ |
মোট বেকার | ১.৮ | ২.০ | ২.১ |
পুরুষ বেকার | ১.১ | ১.৫ | ১.২ |
মহিলা বেকার | ০.৭ | ০.৫ | ০.৯ |
উৎসঃ পরিসংখ্যান বুক পকেট বুক-২০০৮।
বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন শিক্ষাব্যবস্থা ও উৎপাদনবিমুখ শিক্ষিত বেকারত্ব সৃষ্টি করে নিশ্চিতভাবে দারিদ্র অবস্থা বৃদ্ধি করছে।
১১. মানব সম্পদ উন্নয়নের নিম্নহারঃ বাংলাদেশে মানব সম্পদ উন্নয়নের পর্যায় নিম্ন হওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী দক্ষতার অভাবে নিজেদের উন্নয়নে অর্থবহ ভূমিকা পালন করতে পারে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, পরিবারকল্যাণ প্রভৃতি দারিদ্র বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হলেও এসব খাতে বাংলাদেশে প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি। ফলে দেশের শ্রমশক্তির উৎপাদন ক্ষমতা ও কর্মস্পৃহা হ্রাস পাচ্ছে।
১২. সরকারি সাহায্যের সুযোগ-সুবিধার সীমাবদ্ধতাঃ বাংলাদেশে দারিদ্রের উল্লেখযোগ্য প্রভাবক কারণ হলো সরকারি সাহায্যের সুযোগ-সুবিধার সীমাবদ্ধতা। বাংলাদেশে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে (বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন) সরকারি সেবা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু অপর্যাপ্ত তহবিল, ত্রুটিপূর্ণ সমন্বয় ব্যবস্থা, আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রীতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব প্রভৃতি কারণে সরকারি সাহায্য দারিদ্র নিয়ন্ত্রণে প্রত্যাশা অনুযায়ী কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে।
১৩. সামাজিক নিরাপত্তার অভাবঃ বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৭৭ ভাগ (২০০১-এর লোক গণনা) গ্রামে বাস করে। কিন্তু গ্রামীণ পর্যায়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি না থাকায় জনগণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিবাহ, ফসলহানি, প্রবীণ বয়সের নিরাপত্তাহীনতা প্রভৃতি আকস্মিক বিপর্যয়ের কারণে
পৃষ্ঠা ৪০
ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দরিদ্রতা প্রসারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অভাব অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশে প্রচলিত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রয়োজনের তুলনায় কম এবং সাময়িক।
১৪. রক্ষণশীল ধ্যান-ধারণা ও আচার-আচরণঃ বাংলাদেশের জনগণের কুসংস্কার ও রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি দারিদ্র প্রসারের জন্য বিশেষভাবে দায়ী। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের উন্নয়নকর্মী ক্লারেন্স মেলোনী বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্পর্কিত গবেষণার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখিত বিহেবিয়ার এ্যান্ড পোভা্রটি গ্রন্থে বাংলাদেশের দারিদ্রের কারণ হিসেবে সনাতন দয়াদাক্ষিণ্য, অযৌক্তিক প্রত্যাশা, রক্ষণশীল ধ্যান-ধারণা, দুর্নীতিমূলক আচরণ ও চরিত্র ইত্যাদিকে দায়ী করেছেন। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় দয়াদাক্ষিণ্য প্রত্যাশা করাকে নৈতিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করায় সমাজে পরনির্ভর মানসিকতা বিস্তার লাভ করেছে। এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ দারিদ্রের জন্য বিশেষভাবে দায়ী।[10] বাংলাদেশে যেসব ধ্যান ধারণা দারিদ্র প্রসারের সহায়ক সেগুলোর মধ্যে রয়েছে কায়িক শ্রমের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ মর্যাদাহানিকর বলে বিবেচনা করা; নারীদের গার্হস্থ্যকর্মে সীমিত রাখা; অদৃষ্টবাদ যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উৎপাদন শক্তির বিকাশকে বাঁধা দেয়; ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও আচার-আচরণ পালনজনিত বিপুল ব্যয়, যা উৎপাদনী বিনিয়োগ হ্রাস করে।
১৫. ঋণগ্রস্ততাঃ বাংলাদেশে দারিদ্রের জন্য কৃষকদের ঋণের সমস্যা অনেকাংশে স্থায়ী। ঋণগ্রস্ততা পরিস্থিতি অনেক সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক দেনার দায়ে ভিটে মাটি বিক্রি করে দিনমজুর ও ভূমিহীনে পরিণত হয়ে পড়ে। কৃষকের ঋণগ্রস্ততার প্রধান কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানি, বন্যা-খরা, মামলা মোকদ্দমা, পৈতৃক ঋণ, স্বাস্থ্যহীনতা ও দীর্ঘমেয়াদী রোগ, অদূরদর্শিতা ও অপব্যয় প্রভৃতি। কৃষকদের ঋণগ্রসত্মতা সম্পর্কে ব্রিটিশ আমলে গঠিত রাজকীয় কমিশন মন্তব্য করেছিল, ‘‘অসংখ্য লোক ঋণগ্রস্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে, ঋণগ্রস্ত হয়েই বেঁচে থাকে এবং ঋণগ্রস্ত অবস্থাতেই মারা যায়। তারপর সে ঋণের বোঝা তাদের বংশধরদের ওপর চাপে। পৈতৃক ঋণ সাধারণত মর্যাদার ঋণে পরিণত হয়।’’[11] কৃষকের ঋণের দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, তাকে ঋণ করতে হয় খাদ্য উৎপাদনের জন্য, বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য নয়। খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য ব্যবহৃত ঋণ বিপদ সংকেত বয়ে আনে।
১৬. দুর্নীতিঃ বাংলাদেশে অনেক মানবিক ও সামাজিক সমস্যার মতো দারিদ্রের অন্যতম প্রধান কারণ ব্যাপক দুর্নীতি। বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রভাবে সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি দারিদ্র মোকাবেলায় গৃহীত ব্যবস্থাও সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশে দুর্নীতি এমন একটি সামাজিক ব্যাধি, যা দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে তুলছে।
১৭. মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবঃ বাংলাদেশে অব্যাহত মুদ্রাস্ফীতি দারিদ্র প্রসারে প্রভাব বিস্তার করছে। ২০০১-০২ অর্থ বছরের মুদ্রাস্ফীতি ২.৭৯ হার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৯.৯৩ হারে উপনীত হয়েছে। অব্যাহত মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে দারিদ্র রেখা উর্ধমুখী হচ্ছে।
দারিদ্র বিমোচনের উপায়
দারিদ্র এবং বেকারত্ব মানব সমাজের চিরন্তন সমস্যা। মানব সমাজে পরিবর্তন, বিবর্তন যা কিছু ঘটুক দারিদ্র কখনও শেষ হয়নি। সমাজে সবসময় গরিব লোক ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। সমাজবিজ্ঞানী হার্বাট স্পেনসার এর মতে, দারিদ্র হলো প্রকৃতির একটি সাধারণ নির্বাচন। তবে দারিদ্রমুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব না হলেও দারিদ্রের প্রসার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশের কারণে বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র নির্মূল সম্ভব না হলেও সুনির্দিষ্ট নীতি, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাপ্ত সম্পদের দ্বারা দরিদ্রতা সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব। বাংলাদেশে বিরাজমান দারিদ্র নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কতিপয় সুপারিশ এখানে উল্লেখ করা হলো।
১. সামাজিক জরিপ ও গবেষণাঃ বাংলাদেশে দারিদ্র বিমোজনের জন্য প্রয়োজন জরিপ ও গবেষণা পরিচালণা । গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল দরিদ্রতার কারণ , প্রকৃতি , প্রভাব, ব্যপকতা এং দরিদ্র শ্রেনীর বাস্তব তথ্য সংগ্রহ করা । দারিদ্র মোকাবেলা করার সম্ভাব্য উপায় উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা চালানোর ক্ষেত্রেও এরূপ জরিপের প্রয়োজন রয়েছে। সুতরাং দারিদ্র সমস্যার সার্বিক তথ্য সংগ্রহ এবং দারিদ্র বিমোচনের নতুন কৌশল উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ধারাবাহিক সামাজিক জরিপ ও গবেষণা পরিচালনার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
২. সুনির্দিষ্ট জাতীয় নীতি প্রণয়নঃ জরিপ ও গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দারিদ্র বিমোচনের সুনির্দিষ্ট জাতীয় নীতি প্রণয়ন। দারিদ্র বান্ধব জাতীয় নীতির ভিত্তিতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের উপযুক্ত সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করে পর্যায়ক্রমে দারিদ্র সমস্যা হ্রাসের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য জাতিসংঘের সহস্রাব্দ লক্ষ্যসমূহের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ সরকার দারিদ্র বিমোচন কৌশল পত্র প্রণয়ন করে টেকসই দারিদ্র বিমোচন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
পৃষ্ঠা ৪১
৩. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণঃ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ বাংলাদেশে দারিদ্রের অন্যতম প্রধান কারণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধকল্পে প্রচলিত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিকে অধিক কার্যকরী করে তোলা আবশ্যক। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
৪. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধিঃ দারিদ্র বিমোচনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বিকল্প নেই। দরিদ্রদের জীবনযাত্রার মান এমন এক পর্যায়ে উন্নীত করার ব্যবস্থা্ গ্রহণ, যাতে দরিদ্রদের মৌল চাহিদা পূরণের পর সঞ্চয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
মনীষী র্যাগনার নার্কসের মতে, বিশ্বের সকল অনুন্নত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে চক্রাকারে ক্রিয়াশীল দারিদ্রের দুষ্টচক্র ভেঙ্গে ফেলতে হবে। দারিদ্রের দুষ্ট চক্রকে ভেঙ্গে ফেলার জন্য সঞ্চয়, মূলধন ও বিনিয়োগের সাহায্যে সজোরে ধাক্কা দিতে হবে। মূলধনের সাহায্যে প্রবৃদ্ধির দ্বারা সজোরে ধাক্কায় একবার চক্রটির গতিপথ ছিন্ন করতে পারলে, অনুন্নত দেশ কোনদিন স্বল্প আয়ে ফিরে আসবে না।
৫. কৃষি উন্নয়নঃ বাংলাদেশে বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ ও মূলধনের তীব্র অভাব রয়েছে। অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে (যেমন কৃষি, শিল্প) একসঙ্গে মূলধন বিনিয়োগ করে সুষম উন্নয়ন প্রায় অসম্ভব বিধায় বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে খাদ্যাভাব দূর এবং কাঁচামাল সহজলভ্য হবে। এছাড়া উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্য রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে, কৃষিপণ্য রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা শিল্পায়নের যন্ত্রপাতি ও মূলধন সামগ্রী আমদানিতে ব্যয় করা যাবে। কৃষির উন্নয়ন হলে, কৃষিজ দ্রব্যের আয়ে শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হবে। দেশ ভারসাম্যপূর্ণ প্রবৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে। কৃষি উন্নয়ন বাংলাদেশের দারিদ্র বিমোচনের প্রধান খাত।
৬. মানবসম্পদ উন্নয়নঃ কল্যাণমুখী অর্থনীতিবিদদের মতে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জনগণের জীবযাত্রার মান উন্নয়নের একমাত্র সূচক নয়। জনসংখ্যার বৃহৎ অংশকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন বৃহৎ জনগোষ্ঠীয় উন্নয়ন। নিরক্ষরতা, অদক্ষতা, অপুষ্টি, অনুন্নত ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ প্রভৃতি নেতিবাচক উপাদান উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। এজন্য প্রয়োজন সার্বিক মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। যাতে, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অংশগ্রহণ করতে পারে। কারণ দক্ষ ও উৎপাদনশীল মানব সম্পদ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি।
৭. জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণঃ বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রতিবন্ধক এবং দারিদ্র প্রসারের প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার বহির্ভূত, তথাপি সতর্কতামূলক প্রাক-দুর্যোগ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রক্ষা সম্ভব। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যৌথ ব্যবস্থা গ্রহণ।
৮. শিল্পায়নঃ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্পখাতের অবদান ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে স্থির মূল্যে দেশজ উৎপাদনে শিল্পখাতের অবদান ছিল ১৭.৩১ শতাংশ। তা ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ২৯.৭৩ শতাংশে উপনীত হয়। ১৯৯৯-২০০০ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুযায়ী শ্রমশক্তির মাত্র শতকরা ৭.৬০ ভাগ থেকে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৫-০৬ শ্রমশক্তির জরিপের তথ্যানুযায়ী ২৪.৩ ভাগ শিল্পখাতে নিয়োজিত।[12]। উপযুক্ত শিল্পনীতি প্রণয়ন এবং দেশীয় কাঁচামাল ও লাগসই প্রযুক্তিনির্ভর শ্রমনিবিড় শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। কৃষি নির্ভর শ্রমনিবিড় শিল্পায়ন দারিদ্র নিয়ন্ত্রণের অন্যতম প্রধান কৌশল।
৯. কর্মমুখী শিক্ষার উন্নয়নঃ শিক্ষা মানব সম্পদ উন্নয়নের প্রধান কৌশল এবং বিনিয়োগের সর্বোত্তম খাত। চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কর্মমুখী শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে জনগণের অজ্ঞতা, কুসংস্কার, অদৃষ্টবাদিতা দূর করে বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করে তোলা যায়, এগুলো দারিদ্র বিস্তারে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে। তবে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করে দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি দারিদ্র হ্রাসের সহায়ক।
১০. কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধিঃ বাংলাদেশে দারিদ্রের প্রধান কারণ বেকারত্ব ও অর্ধবেকারত্ব। শ্রম নিবিড় লাগসই প্রযুক্তি আমদানির মাধ্যমে অকৃষি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি দারিদ্র হ্রাসের সহায়ক। পল্লীর কর্মহীন মৌসুমে গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। কৃষি ভিত্তিক কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গ্রামীণ মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি দারিদ্র বিমোচনের সহায়ক।
১১. সরকারি পর্যায়ে সেবামূলক কার্যক্রমের সুযোগ বৃদ্ধিঃ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশসমূহের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণ এবং জীবন মানোন্নয়নের স্বার্থে খাদ্য, স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি ভর্তুকি অপরিহার্য বলে মন্তব্য করেছেন। অনু্ন্নত দেশে দরিদ্রদের মৌল চাহিদা পূরণের বিষয়টি মূলত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ওপর নির্ভর করে। এসব
পৃষ্ঠা ৪২
সুযোগের মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতা, মৌলিক শিক্ষার সুযোগ, মহামারীমুক্ত নিরাপদ জীবন যাপনের সুস্থ পরিবেশ প্রভৃতি। সরকারি সাহায্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন করা যায়।
১২. দরিদ্র শ্রেণীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধিঃ দারিদ্র নিয়ন্ত্রণের জন্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা প্রদানের সুযোগ বৃদ্ধি এবং সচেতন করার মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কৃষির উন্নয়ন হলে দারিদ্র দূর হবে না, কারণ দরিদ্রদের ভূমি মালিকানা নেই। আবার দ্রব্য উৎপাদিত হলেই দরিদ্রদের জীবন মানোন্নয়ন হবে না, যদি না দরিদ্রশ্রেণী উৎপাদিত দ্রব্যাদি ক্রয়ের ক্ষমতা অর্জন না করে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উৎপাদন স্বত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে, তাদের ক্ষমতায়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা গ্রহণ করা প্রয়োজন। দরিদ্র শ্রেণী নিজের পায়ে দাঁড়াবার সক্ষমতা অর্জন করলেই নিজেদের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারবে।
১৩. মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণঃ বাংলাদেশে দরিদ্র প্রসারে মুদ্রাস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হ্রাসের পদক্ষেপ গ্রহণ। বিদেশী ঋণ, সাহায্য এবং জনশক্তি রাপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পরিকল্পিত উপায়ে উৎপাদনমুখী খাতে ব্যয় করা। যাতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি রোধ করা সম্ভব হয়।
১৪. কুটির শিল্পের উন্নয়নঃ গ্রামীণ দক্ষ-অদক্ষ কারিগরদের সংগঠিত করে স্থানীয় কাঁচামাল ও চাহিদা-নির্ভর কুটির শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে পল্লী এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে গৃহকেন্দ্রিক কুটির শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম।
১৫. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রবর্তনঃ বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৭৭ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে।[13] কিন্তু গ্রামভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসূচি বাংলাদেশে আজও গড়ে ওঠেনি। গ্রামীণ পর্যায়ে সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি সম্প্রসারণ করে দরিদ্রতার গতি অনেকাংশে রোধ করা যায়। উল্লেখ্য দারিদ্র বিমোচনের নিরাপত্তা কর্মবেষ্টনী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যা শুধু বিশেষ দরিদ্রদের নিয়ে ব্যপৃত।
১৬. সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিতকরণঃ বাংলাদেশে গণদারিদ্রের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সম্পদ ও প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অসম বণ্টন। সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণদারিদ্র বহুলাংশে হ্রাস করা সম্ভব। প্রাপ্ত সম্পদের উপর দরিদ্রতম মানুষের অধিকার ও স্বত্ব প্রতিষ্ঠা ব্যতীত তাদের উন্নয়ন আশা করা যায় না।
১৭. গণমুখী সমবায় আন্দোলন গড়ে তোলাঃ সমবায়কে দরিদ্রদের নিজস্ব কর্মসূচি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সমবায়ের ত্রুটি ও সমস্যাবলী দূর করে একে অধিক গণমুখী করে তোলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। যাতে গ্রামীণ দরিদ্র জনগণ সমবায়কে উন্নয়ন কর্মসূচি হিসেবে স্বতঃস্ফুর্তভাবে গ্রহণ করতে পারে। দারিদ্র হ্রাসে সমবায়ের ভূমিকা সর্বজস্বীকৃত। উল্লেখযোগ্য সমবায় অধিদপ্তরের অধীন নিবন্ধিত সমবায় সমিতির সংখ্যা একলাখ ৬২ হাজার ১১২টি। এর মধ্যে মাত্র ১৩ হাজার ২০০টি সক্রিয়।
১৮. দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণঃ দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে নির্দিষ্ট খাতে যথাযথভাবে ব্যয় করা হয়, তার জন্য উপযুক্ত, দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা। কারণ যে কোন জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের একটি অপহিার্য কাঠামোগত উপাদান হল সুশাসন।
১৯. কর্মহীন মওসুমে কর্মের সুযোগ সৃষ্টিঃ কর্মহীন মওসুমে পল্লী অবকাঠামো নির্মাণ কর্মসূচি (কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি) বাস্তবায়নের মাধ্যমে কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করা। যাতে কর্মহীন অবস্থায় গ্রামীণ দরিদ্র শ্রেণী ঋণগ্রস্ত হয়ে আরো দরিদ্র না হয়ে পড়ে।
২০. প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সহজলভ্যতাঃ প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি ঋণ প্রদানের জটিলতা দূর করে দরিদ্র কৃষকদের নিকট সহজলভ্য ও গ্রহণযোগ্য করে তোলা। যাতে উচ্চ হারে সুদের ঋণ গ্রহণ থেকে দরিদ্র জনগণ মুক্তি পায়। ক্ষুদ্র ঋণদান সংস্থাগুলোর কার্যক্রম প্রসারের মাধ্যমে দরিদ্রদের নিকট সহজলভ্য করে তোলা।
২১. বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) কার্যাবলী বৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণঃ বাংলাদেশে দরিদ্রদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকারি প্রচেষ্টার পরিপূরক হিসেবে দেশি-বিদেশী বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কাজ করছে। সরকারের হিসাব অনুযায়ী সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন ৫৫ হাজার ৯৪৫টি, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অধীন নিবন্ধিত ১৫ হাজার ৩৯৮টি, সমবায় অধিদপ্তরের অধীন এক লাখ ৬২টি হাজার ১১২টি। এনজিও ব্যুরোর অধীন নিবন্ধিত প্রায় আড়াই হাজার কোম্পানী, নিবন্ধন অধিদপ্তরের অধীন এনজিওর সংখ্যা ৯৭১০টি। দেশী ও বিদেশী স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো কোথায়, কিভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে, তার যথাযথ তদারক ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি পর্যায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
২২. গ্রামীণ পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি করাঃ স্বাস্থ্যহীনতা বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যহীনতার শিকার হয়ে ক্রমান্বয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। গ্রামীণ পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি দারিদ্র বিমোচনের সহায়ক।
পৃষ্ঠা ৪৩
২৩. ভূমিস্বত্ব প্রথার সংস্কার সাধনঃ বাংলাদেশের বর্তমান ভূমিস্বত্ব প্রথা দারিদ্র সম্প্রসারণে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করছে। ১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশের যথাযথ ও কার্যকর বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করে খাস জমি বণ্টনের দ্বারা দারিদ্র সমস্যার মোকাবেলা করা সম্ভব।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সংক্ষেপে বলা যায় দারিদ্র নিয়ন্ত্রণের প্রধান তিনটি কৌশল হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বাস্তবসম্মত সঠিক নীতি ও কর্মসূচি অনুসরণ; মৌল দ্রব্যাদি ও সেবাদির ওপর সর্বজনীন অধিকার নিশ্চিত করা এবং লক্ষ্যদল ভিত্তিক দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা। আর এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা।
পৃষ্ঠা ৪৩
বাংলাদেশের দারিদ্র বিমোচন কার্যক্রম
বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধক দারিদ্র। দেশের উন্নয়ন নীতি ও লক্ষ্যসমূহের মধ্যে দারিদ্র বিমোচন অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। প্রতিটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দারিদ্র বিমোচনের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এজন্য উন্নয়ন পরিকল্পনায় উৎপাদনভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, যাতে পারিবারিক আয় এমন এক স্তরে উন্নীত হয়, যা দিয়ে দারিদ্র ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির দুষ্টচক্র ভাঙ্গা সহজ হয়। বাংলাদেশে দরিদ্রদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি (ঘড়হ-মড়াবৎহসবহঃ) পর্যায়ে ব্যাপক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
দারিদ্র বিমোচনে গৃহীত বিশেষ কর্মসূচিঃ দরিদ্রদের আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও উন্নয়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি (এনজিও) পর্যায়ে কর্মসূচি রয়েছে। সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা, অধিদপ্তর দারিদ্র বিমোচনে নিয়োজিত রয়েছে। সরকারি পর্যায়ে কৃষি মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচি রয়েছে। এছাড়া সরকার কাজের বিনিময়ে খাদ্য, ভিজিডি কর্মসূচি, গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। অপরদিকে, শিক্ষা সম্প্রসারণ কর্মসূচি যেমন- শিক্ষার জন্য খাদ্য, ছাত্রীদের জন্য বিশেষ বৃত্তি ও আর্থিক সাহায্য, অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা, সরাসরি শিক্ষার ব্যয়ভার লাঘব করছে।
সরাসরি দারিদ্র বিমোচনে সহায়তা করার জন্য অনেকগুলো কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। এসব কর্মসূচিসমূহ সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।
১. বয়স্ক ভাতাঃ এটি সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম। প্রারম্ভিক পর্যায়ে দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটি ওয়ার্ডে দশ জন সর্বাপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ দরিদ্র ব্যক্তিকে মাসিক একশত টাকা হারে বয়স্ক ভাতা প্রদানের মাধ্যমে এটি শুর হয়। এ দশ জনের মধ্যে অন্তত পাঁচ জন মহিলা থাকবে। এ ব্যবস্থায় সারা দেশে চার লক্ষাধিক দরিদ্র বয়স্ক ব্যক্তি উপকৃত হয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমাজসেবা অধিদপ্তর সার্বিকভাবে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে। এর তত্ত্বাবধানের জন্য অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি মন্ত্রিসভা কমিটি গঠিত হয়েছে। ২০০৯-২০১০ অর্থবছর হতে মাসিক ভাতা ২৫০ টাকা হতে ৩০০ টাকায় এবং উপকারভোগীর সংখ্যা বিশ লাখ হতে ২২.৫০ লাখে উন্নীত করা হয়েছে।
২. গৃহহীন দরিদ্রদের গৃহায়নের জন্য গৃহায়ন তহবিল গঠনঃ আশ্রয় মানুষের অন্যতম মৌল চাহিদা। দরিদ্রদের গৃহায়নের লক্ষ্যে এ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। গৃহায়ন তহবিল হতে দরিদ্রদের গৃহায়ন সাহায্যার্থে প্রধানত ঋণ প্রদান করা হয়। তবে ক্ষেত্র বিশেষে অনুদানও প্রদান করা হয়। তহবিল পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছে।
৩. বেকার যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান ব্যাংক প্রতিষ্ঠাঃ বেকারত্ব দারিদ্রের অন্যতম প্রধান কারণ। বেকারত্ব লাঘবে কর্মসংস্থান ব্যাংক দেশের বেকার যুবকদের বিভিন্ন লাভজনক ও উৎপাদনমুখী কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ঋণ প্রদান করবে। এ ব্যাংক একটি বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৯৮ সালের ২২ শে সেপ্টেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ডিসেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত দেশের ৬৪টি জেলায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা এক লাখ ৬০ হাজার ৭৭৫ জন এবং পাঁচ লাখ ৮০ হাজার ৩৯৮ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে।
৪. বিধবা ও স্বামী পরিত্যাক্ত দুঃস্থ মহিলা ভাতাঃ ১৯৯৮ সাল হতে দারিদ্র বিমোচনের বিশেষ কর্মসূচি হিসেবে বিধবা ও স্বামী পরিত্যাক্ত দুঃস্থ মহিলা ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। প্রথম পর্যায়ে মাসিক ভাতা ১০০ টাকা এবং উপকারভোগীর সংখ্যা তিন লাখের বেশি ছিল। ২০০৯-১০ অর্থ বছরে মাথাপিছু মাসিক ভাতার পরিমাণ ২৫০ টাকা হতে ৩৫০ টাকায় এবং উপকারভোগীর সংখ্যা ৯.২০ লাখে বৃদ্ধি করা হয়েছে।
৫. নিরাপত্তা বেষ্টনীঃ সমাজের দুঃস্থ অসহায় শ্রেণীকে বিপর্যয়কালীন সময়ে আর্থিক নিরাপত্তার সহায়তা প্রদানের লক্ষে নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। গ্রামীণ দরিদ্র, দুঃস্থ, বিত্তহীনদের কর্মহীন মৌসুমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে আর্থিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করা নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রমের মূল লক্ষ। নিরাপত্তা কর্মবেষ্টনীর মধ্যে রয়েছে খাদ্য
পৃষ্ঠা ৪৪
সহায়তায় পল্লী রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচি (আরএমপি), কাজের বিনিময়ে খাদ্য (অর্থ), টেস্ট রিলিফ (টিআর), ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণীর খাদ্য কর্মসূচি (ভিজিএফ), ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণীর উন্নয়ন কর্মসূচি (বিজিডিপি) ইত্যাদি নিরাপত্তা কার্যক্রম দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ দরিদ্র ও দুঃস্থ শ্রেণীর আর্থিক বিপর্যয়ের সময় সহায়তা প্রদান করছে।
৬. সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত কার্যক্রমঃ বাংলাদেশের সব উপজেলা ও শহর এলাকায় সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত গ্রামীণ সমাজসেবা (আরএসএস), শহর সমাজ উন্নয়ন (ইউসিডি) এবং পল্লী মাতৃকেন্দ্রের (আরএমসি) মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনের জন্য উপার্জনমুখী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের সার্বিক দারিদ্র বিমোচন কার্যক্রমগুলো সামাজিক সংহতি উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচন কার্যক্রম; সামাজিক নিরাপত্তা এবং মানবসম্পদ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম এ তিন ভাগে বিভক্ত।
৭. মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরঃ গ্রামীণ দুঃস্থ অসহায় মহিলাদের প্রশিক্ষণ, কর্মস্থান ও ঋণ প্রদানের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির বৃদ্ধিতে অধিদপ্তর সহায়তা করছে। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের অধীন ১৫ হাজার ৩৯৮টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দারিদ্র বিমোচনে কাজ করে যাচ্ছে।
৮. পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ) : পল্লীর সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে কার্যকরী ঋণ প্রদান, দক্ষতা উন্নয়ন, নেতৃত্ব বিকাশ, সমাজিক উন্নয়ন প্রশিক্ষণ এবং নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে দেশের ২৮টি জেলার ২২৬টি শাখায় ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
৯. যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরঃ আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে যুব উন্নয়নের লক্ষ্য অধিদপ্তর বিভিন্ন ট্রেডে দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষিত যুবকদের সুবিধা প্রদান করছে। ডিসেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত ৩০ লাখ ৩৯ হাজার ৬৫৭ জন আত্মকর্মস্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলায় ৭০টি কেন্দ্রের মাধ্যমে শিক্ষিত বেকার যুবকদের প্রযুক্তি উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
১০. কর্মসংস্থান ব্যাংকঃ বেকার বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার ও যুবমহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধিতে সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনে কাজ করে যাচ্ছে। কর্সসংস্থান ব্যাংক ব্যাংকের মাধ্যমে ডিসেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত ৬৪টি জেলায় ৫ লাখ ৮০ হাজার ৩৯৮ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে।
১১. আবাসন (দারিদ্র বিমোচন ও পুনর্বাসন) প্রকল্পঃ গৃহহীন, ছিন্নমূল হতদরিদ্র প্রায় ৬৫ হাজার পরিবারকে আবাসন ও কর্মসংস্থান সৃজনের মাধ্যমে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
১২. গৃহহীনদের ঋণ ও অনুদানের তহবিলঃ গ্রামীণ দারিদ্র জনগণের জন্য গৃহনির্মাণ কর্মসূচির আওতায় ফেব্রুয়ারী ২০১০ পর্যন্ত ৪৭ হাজার ৫৭৫টি গৃহনির্মাণ করা হয়েছে। উপকারভোগীর সংখ্যা সারাদেশের ৬৪টি জেলায় ৪৩০টি উপজেলায় মোট ৪৬৪টি এনজিও দরিদ্রদের গৃহায়ন ঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
১৩. এনজিওদের দারিদ্র বিমোচন কার্যক্রমঃ বাংলাদেশে দারিদ্র বিমোচন ও নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হলো ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম, যার বেশিরভাগ পরিচালিত হয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) দ্বারা। ডিসেম্বর ২০০৫ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬৯০ টি এনজিও এবং ডিসেম্বর ২০০৭ এর তথ্যানুযায়ী ৫৩৫টি এনজিও দারিদ্র বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। উপকারভোগীর সংখ্যা ৩.৯১ কোটি।
১৪. কমিউনিটি ক্লিনিকঃ গ্রামীন দরিদ্র ও স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর নিকট স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার কল্যাণ সেবা পৌঁছানোর জন্য ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
এছাড়া উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরাসরি দারিদ্র বিমোচনে অবদান রাখার লক্ষ্যে আশ্রায়ন, আদর্শ গ্রাম, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য, সমন্বিত এলাকা উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন, পশু সম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান, দারিদ্র বিমোচনে স্থানীয় জনগণের অংশায়ন বৃদ্ধি, সামাজিক ক্ষমতায়ন, পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন, পল্লী বিদ্যুতায়ন, গ্রামীণ স্যানিটেশন, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম, মসজিদভিত্তিক দারিদ্র বিমোচন, মেয়েদের শিক্ষা উপবৃত্তি, পল্লী মাতৃকেন্দ্রের মাধ্যমে জনসংখ্যা কার্যক্রম জোরদারকরণ, সম্প্রসারিত পল্লী সমাজকর্ম, নারী উন্নয়ন, যুব উন্নয়ন ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।
পৃষ্ঠা ৪৫
দারিদ্র বিমোচনে নিয়োজিত কয়েকটি সংস্থার কার্যক্রম
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়াধীন এ অধিদপ্তর বিভিন্ন অবকাঠামোমূলক উন্নয়ন প্রকল্প, বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলে গ্রামীণ সড়ক, গ্রোথ সেন্টার, বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। এতে পল্লী অঞ্চলে কর্মসংস্থান সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১ খাদ্য সহায়তায় পল্লী রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচি: দারিদ্র বিমোচনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কানাডা থেকে খাদ্য সহায়তার মাধ্যমে আর.এম.পি. ১৯৮৩ সালে শুরু হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কেয়ার-এর সহযোগিতায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়।
২. বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড : সমগ্র দেশব্যাপী সমবায় ও অনানুষ্ঠানিক গ্রুপ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিআরডিবি বাংলাদেশ সরকার ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় পল্লী উন্নয়ন এবং পল্লী দারিদ্র বিমোচন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। দরিদ্রদের টার্গেট গ্রুপের মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র কৃষক (০.৫০ একর পর্যন্ত), বিত্তহীন মহিলা ও পুরুষ। ঋণ ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সাথে রয়েছে পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কর্মসূচি।
৩. বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (কুমিল্লা) : বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (কুমিল্লা) বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষুদ্র কৃষক, ভূমিহীন মজুর ও দরিদ্র মহিলাদেরকে বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক গ্রুপে সংগঠিত করে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান এবং আয় বৃদ্ধি ও মূলধন গঠনের জন্য ঋণ দিচ্ছে।
৪. পল্লী উন্নয়ন একাডেমী বগুড়াঃ বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমী দারিদ্র বিমোচনে সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি, প্রাথমিক বনায়ন ও ক্ষমতায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। দারিদ্র বিমোচন ও পল্লী উন্নয়ন মডেল উদ্ভাবনের লক্ষ্যে সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
৫. বাণিজ্যিক ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণদান কর্মসূচিঃ দারিদ্র বিমোচনে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ অংশ গ্রহণ করছে। এ কর্মসূচির অধীনে ভূমিহীন ও ক্ষুদ্র কৃষককে ঋণ সরবরাহ করা হয়। এনজিও সহ বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে এ ঋণ সরবরাহ করা হয় এবং ব্যাংকসমূহের নিজস্ব কর্মসূচিও রয়েছে।
৬. সমবায় অধিদপ্তরঃ সমবায় সমিতি গঠনের মাধ্যমে পেশাজীবী মানুষকে স্বাবলম্বী এবং দারিদ্র বিমোচনে সমবায় অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে। ডিসেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত সারাদেশে একলাখ ৬৭ হাজার ৮৫৫টি সমবায় সমিতি নিবন্ধিত হয়েছে।
৭. পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) : এটি ১৯৯০ সালে স্থাপিত। এ প্রতিষ্ঠানটি সহযোগী সংস্থা এনজিও এর মাধ্যমে লক্ষ্যভিত্তিক দরিদ্র এবং বিত্তহীন জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে আসছে। সংস্থাটি পল্লী ক্ষুদ্রঋণ, শহর ক্ষুদ্রঋণ, অতি দরিদ্রদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ এবং ক্ষুদ্র উদ্যোগ ঋণ এ চার ধরনের ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করছে।
৮. ব্র্যাক : বাংলাদেশের বৃহত্তর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। ১৯৭২ সালে ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য গঠিত ব্র্যাক বর্তমানে বহুমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে ঋণ প্রদান, শিশু ও বয়স্কদের জন্য অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, মহিলাদের অধিকার সম্বন্ধীয় আইনগত পরার্মশ দান ইত্যাদি।
৯. গ্রামীণ ব্যাংক : ১৯৮৩ সালে এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে এ ব্যাংক স্থাপিত হয়। তবে এর কার্যক্রম একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্পের অধীনে ১৯৭৬ সালে শুরু হয়। বিত্তহীনদের সংগঠিত করে দলভিত্তিক ঋণের মাধ্যমে তাদের আয়, পুঁজি ও সম্পদ গঠনের উদ্দেশ্যে ব্যাংকের কার্যক্রম বিস্তার লাভ করে।
১০. স্বনির্ভর বাংলাদেশ : ১৯৭৫ সালে স্থাপিত এ সংস্থাটি ঋণদান কর্মসূচির পাশাপাশি জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং মাতৃ ও শিশু পরিচর্যা পরিচালনা করছে।
পৃষ্ঠা ৪৬
১১. প্রশিকা : ১৯৭৬ সালের স্থাপিত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকা বহুমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান, মৎস্য ও পশুসম্পদ উন্নয়ন, রেশম সম্পদ উন্নয়ন, সেচ কর্মসূচি, স্বাস্থ্য পুষ্টি, নলকূপ স্থাপন ও বিতরণ, পরিবেশ সম্মত কৃষি, সমাজিক বনায়ন ও গৃহায়ণ কর্মসূচি ইত্যাদি।
১২. আশা : দারিদ্র বিমোচনে নিয়োজিত বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আশা অন্যতম। ১৯৯২ সাল হতে দারিদ্র বিমোচনে এ সংস্থা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে ঋণ দিয়ে আসছে।
১৩. শক্তি ফাউন্ডেশন : ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বগুড়া, কুমিল্লাসহ বড় বড় শহরের বস্তির দুঃস্থ মহিলাদের ঋণদানের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনে সহায়তা করছে।
১৪. ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ : ১৯৮৬ সাল হতে দারিদ্র বিমোচন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং মহিলাদের ক্ষমতায়নে কাজ করে যাচ্ছে।
১৫. সোসাইটি ফর সোস্যাল সার্ভিস : ১৯৮৬ সাল হতে দারিদ্র বিমোচন, দরিদ্রদের অধিকার আদায়, সচেতনতা বৃদ্ধিসহ টেকসই সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
দারিদ্র বিমোচন কার্যক্রমের প্রভাব
বাংলাদেশে দারিদ্র ব্যাপক হলেও গৃহীত দারিদ্র বিমোচন কার্যক্রমের প্রভাবে দরিদ্রদের অবস্থার পরিবর্তন লক্ষণীয়। বিভিন্ন তথ্যানুযায়ী দারিদ্র হ্রাসের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে ১৯৯১-৯২ থেকে ২০০০ সালের আয় দারিদ্রের হার ৫৮.৮ শতাংশ থেকে ৪৮.৯ শতাংশে নেমে আসে। ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে আয় দারিদ্রের হার ৪৮.৯ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে নেমে আসে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বিভিন্ন খানা আয় ব্যয় জরিপের তথ্যের আলোকে দারিদ্র হ্রাসের প্রবণতা নিচের সারণীতে দেখানো হলো
ক্যালরী গ্রহণ ভিত্তিক দারিদ্র ও চরম দারিদ্রের হারের পরিবর্তন (শতকরা হার)
দারিদ্রের প্রকৃতি | ১৯৮৩-৮৪ | ১৯৮৫-৮৬ | ১৯৮৮-৮৯ | ১৯৯১-৯২ | ১৯৯৫-৯৬ | ১৯৯৯-০০ | ২০০৫-০৬ | |
অনপেক্ষ দারিদ্র দৈনিক মাথাপিছু ২১২২ কি. ক্যালরী | জাতীয় | ৬২.৬ | ৫৫.৭ | ৪৭.৮ | ৪৭.৫ | ৪৭.৫ | ৪৪.৩ | ৪০.৪ |
পল্লী | ৬১.৯ | ৫৪.৭ | ৪৭.৮ | ৪৭.৬ | ৪৭.১ | ৪২.৩০ | ৩৯.৫ | |
শহর | ৬৭.৭ | ৬২.৬ | ৪৭.৬ | ৪৬.৭ | ৪৯.৭ | ৫২.৫০ | ৪৩.২ | |
চরম দরিদ্র দৈনিক মাথাপিছু ১৮০৫ কি. ক্যালরী | জাতীয় | ৩৬.৮ | ২৬.৯ | ২৮.৪ | ২৮.০ | ২৫.১ | ২০.০ | ১৯.৫ |
পল্লী | ৩৬.৭ | ২৬.৩ | ২৮.৬ | ২৮.৩ | ২৪.৬ | ১৮.৮০ | ১৭.৯ | |
শহর | ৩৭.৪ | ৩০.৭ | ২৬.৪ | ২৬.৩ | ২৭.৩ | ২৫.০০ | ২৪.৪ |
উৎসঃ বিবিএস খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০০৫, অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৭ এবং ২০১০; পৃ-১৪৮ এবং ১৮৩।
জনসংখ্যাস্ফীতি
বিশ্বের আলোচিত সমস্যা জনসংখ্যা বিস্ফোরণ। জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে ১৯৭৭ সালে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা বলেছিলেন, পারমাণবিক যুদ্ধ ছাড়া বিশ্ববাসীর সম্মুখে অন্যতম যে গুরুতর সমস্যা, তা হচ্ছে জনসংখ্যাস্ফীতি। অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এটি পারমাণবিক যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ। কারণ, জনসংখ্যাস্ফীতিকে সংঘবদ্ধভাবে নিয়ন্ত্রণের উপায় নেই। বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিধর কয়েকটি রাষ্ট্রের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা হ্রাস করা সম্ভব। কিন্তু জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে এরূপ করা সম্ভব নয়। কারণ, সন্তান জন্মদান মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি এবং ব্যাক্তিগত চাহিদা, রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি আদর্শ ও মূল্যবোধের ওপর নির্ভরশীল।
জনসংখ্যা এবং প্রাপ্ত সম্পদের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা দেখা দিলে অর্থাৎ সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা অধিক হলে অথবা সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা কম হবার কারণে সম্পদ অব্যবহৃত থাকলে তাকে জনসংখ্যা সমস্যা বলা হয়। জনসংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকলেও সমস্যা; পক্ষান্তরে, প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হলেও সমস্যা। অধিক জনসংখ্যা এবং স্বল্প জনসংখ্যা বিপরীতমুখী দু’টি অবস্থা। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ, ভারত, চীন প্রভৃতি দেশ অধিক জনসংখ্যা সমস্যায় আক্রান্ত এবং জার্মানি, সৌদি আরব, লিবিয়া প্রভৃতি স্বল্প জনসংখ্যাসম্পন্ন দেশ।
জনসংখ্যা প্রত্যয়
জনসংখ্যা বলতে নির্দিষ্ট অঞ্চল বা এলাকার সকল মানবসত্তাকে বুঝানো হয়। জনসংখ্যা একটি অঞ্চলের সকল জনগোষ্ঠি অথবা কোন অঞ্চলের বিশেষ শ্রেণীর অধিবাসী বা শ্রেণীর জনগোষ্ঠীকে জনসংখ্যা প্রত্যয় দ্বারা বুঝানো হয়। সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী (১৯৯৫), ‘‘জনসংখ্যা বলতে কোন একটি জাতির বা নির্দিষ্ট এলাকার মোট জনসংখ্যা অথবা একটি এলাকার বিশেষ শ্রেণীর বা দলের (যেমন- নারী, রোমান ক্যাথলিক, কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী এবং অক্ষম জনগোষ্ঠী) অন্তর্ভুক্ত জনগোষ্ঠীকে বুঝায়।’’ জনবিজ্ঞানের পরিভাষায়, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশে পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ এবং সংঘবদ্ধভাবে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সমষ্টিকে জনসংখ্যা বলা হয়।
মনীষী উইলিয়াম পি স্কট-র ব্যাখ্যানুযায়ী, ‘‘নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমায় যেমন একটি জাতি, একটি ভৌগোলিক অঞ্চল, রাষ্ট্র, মেট্রোপলিটন এলাকা, একটা শহরে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠীকে জনসংখ্যা বলা হয়।’’
জনসংখ্যাস্ফীতি ধারণা
পৃষ্ঠা ৪৮
যখন কোন দেশের প্রাপ্ত সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা অধিক এবং এ অধিক জনসংখ্যার প্রভাবে সেদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়, তখন তাকে জনসংখ্যাস্ফীতি বলা হয়। আর যখন স্বল্প সময়ে জনসংখ্যা অস্বাভাবিক দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়ে সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে দেখা দেয়, তখন তাকে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ বলা হয়।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ম্যালথাস ১৭৯৮ সালে প্রকাশিত অ্যান এসেই অন দ্যা প্রিনসিপল অব পপিঊলেশন প্রবন্ধে বলেছেন, ‘‘কোন দেশের জনসংখ্যা সে দেশের মোট খাদ্য উৎপাদনের চেয়ে বেশি হলে যে অবস্থায় সৃষ্টি হয়, তাকে জনসংখ্যা সমস্যা বলা হয়।’’ তাঁর মতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় অনেকটা জ্যামিতিক হারে। যেমন- ১, ২, ৪, ৮, ১৬ প্রভৃতি হারে। সে তুলনায় খাদ্য উৎপাদন বাড়ে গাণিতিক হারে। যেমন ১, ২, ৩, ৪, ৫ হারে। ম্যালথাসের মতে, প্রতি ২৫ বছর পর পর জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়।
জনসংখ্যা সমস্যার দু’টি দিক রয়েছে। যেমন-
প্রথমত, দেশের প্রাপ্ত সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা কম হলে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের অভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়ে জনগণের জীবন মান হ্রাস পায়। জনসংখ্যার এরূপ অবস্থাকে স্বল্প জনসংখ্যা সমস্যার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
দ্বিতীয়ত, দেশের প্রাপ্ত সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা অধিক হলে জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত হয়। জনসংখ্যার এরূপ অস্বাভাবিক আধিক্যকেও জনসংখ্যা সমস্যা বলা হয়।
তৃতীয়ত, আবার যখন দেশের জনসংখ্যা ও সম্পদ সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং মাথাপিছু আয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়, তখন জনসংখ্যাকে কাম্য জনসংখ্যা বলা হয়। তবে কাম্য জনসংখ্যা একটি আপেক্ষিক ধারণা। কারণ, দেশের উৎপাদন ও সম্পদ বৃদ্ধি পেলে কাম্য জনসংখ্যার ধারণা পরিবর্তিত হয়।