কবর
জসীমউদ্দীন
কবি - পরিচিতি
বাংলা সাহিত্যে জসীমউদ্দীনের সাধারণ পরিচয়- তিনি ‘পল্লীকবি'। বস্তুত বাংলার গ্রামীণ জীবনের আবহ, সহজ সরল প্রাকৃতিক রূপ উপযুক্ত শব্দ উপমা ও চিত্রের মাধ্যমে তাঁর কাব্যে যেমন মূর্ত হয়ে উঠেছে তেমনি আর কারও কবিতায় সামগ্রিকভাবে দেখা যায় না।
জসীমউদ্দীনের কবিপ্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিল ছাত্রজীবনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালেই তাঁর ‘কবর' কবিতাটি প্রবেশিকা বাংলা সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ফলে ঐ সময়েই তিনি দেশব্যাপী কবিখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
কর্মজীবনের শুরুতে জসীমউদ্দীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু দিন অধ্যাপনা করেন। পরে সরকারের প্রচার ও জনসংযোগ বিভাগে উচ্চপদে আসীন হন। জসীমউদ্দীনের বিখ্যাত ‘নকশী কাঁথার মাঠ' কাব্যটি বিভিন্ন বিদেশী ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর অন্যান্য জনপ্রিয় ও সমাদৃত গ্রন্থ হচ্ছে: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট', ‘বালুচর', ‘ধানখেত', ‘রঙিলা নায়ের মাঝি'। এছাড়াও তিনি স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনী, নাটক ও প্রবন্ধ লিখেছেন।
কর্মকৃতির স্বীকৃতি হিসেবে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানিত করেছে ডক্টর অব লিটারেচার উপাধি দিয়ে।
জসীমউদ্দীনের জন্ম ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে। তাঁর মৃত্যু ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায়।
এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!
সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি
লাঙল লইয়া খেতে ছুটিতাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।
যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত
এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত।
এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে
ছোট-খাট তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।
বাপের বাড়িতে যাইবার কালে কহিত ধরিয়া পা
‘‘আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।’’
শাপলার হাটে তরমুজ বেচে ছ পয়সা করি দেড়ী,
পুঁতির মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।
দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,
সন্ধ্যাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে।
হেস না-হেস না-শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে,
দাদি যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে!
নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, ‘‘এতদিন পরে এলে,
পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখিজলে।’’
আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,
কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝ্ঝুম নিরালায়।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ্ দাদু, ‘‘আয় খোদা! দয়াময়,
আমার দাদির তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।’’
তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।
শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি,
গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।
এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে,
গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।
মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে মিশায়ে বুক,
আয়-আয় দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ।
এইখানে তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা,
কাঁদ্ছিস্ তুই? কী করিব দাদু! পরাণ যে মানে না।
সেই ফাল্গুনে বাপ তোর এসে কহিল আমারে ডাকি,
‘‘বা-জান, আমার শরীর আজিকে কী যে করে থাকি থাকি।’’
ঘরের মেঝেতে সপ্টি বিছায়ে কহিলাম বাছা শোও,
সেই শোওয়া তার শেষ শোওয়া হবে তাহা কি জানিত কেউ?
গোরের কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে,
তুমি যে কহিলা ‘‘বা-জানরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে?’’
তোমার কথায় উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে,
সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে।
তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দুহাতে জড়ায়ে ধরি,
তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিত সারা দিনমান ভরি।
গাছের পাতারা সেই বেদনায় বুনো পথে যেত ঝরে,
ফাল্গুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো-মাঠখানি ভরে।
পথ দিয়া যেতে গেঁয়ো পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ,
চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক।
আথালে দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি,
হাম্মা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি।
গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা,
চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ।
উদাসিনী সেই পল্লী-বালার নয়নের জল বুঝি,
কবর দেশের আন্ধার ঘরে পথ পেয়েছিল খুঁজি।
তাই জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ,
হায় অভাগিনী আপনি পরিল মরণ-বিষের তাজ।
মরিবার কালে তোরে কাছে ডেকে কহিল, ‘‘বাছারে যাই,
বড় ব্যথা র'ল, দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই;
দুলাল আমার, যাদুরে আমার, লক্ষ্মী আমার ওরে,
কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।’’
ফোঁটায় ফোঁটায় দুইটি গন্ড ভিজায়ে নয়ন-জলে,
কী জানি আশিস করে গেল তোরে মরণ-ব্যথার ছলে।
ক্ষণপরে মোরে ডাকিয়া কহিল-‘‘আমার কবর গায়
স্বামীর মাথার মাথালখানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়।’’
সেই সে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে,
পরাণের ব্যথা মরে নাকো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে।
জোড়মানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরু-ছায়,
গাছের শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে গায়।
জোনাকি-মেয়েরা সারারাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো,
ঝিঁঝিরা বাজায় ঘুমের নুপুর কত যেন বেসে ভালো।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ্ দাদু, ‘‘রহমান খোদা! আয়;
ভেস্ত নসিব করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়!’’
এইখানে তোর বুজির কবর, পরীর মতন মেয়ে,
বিয়ে দিয়েছিনু কাজিদের বাড়ি বনিয়াদী ঘর পেয়ে।
এত আদরের বুজিরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে,
হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে।
খবরের পর খবর পাঠাত, ‘‘দাদু যেন কাল এসে
দুদিনের তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে।’’
শ্বশুর তাহার কসাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে,
অনেক কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে।
সেই সোনামুখ মলিন হয়েছে ফোটে না সেথায় হাসি,
কালো দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিছে ভাসি।
বাপের মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন,
কে জানিত হায়, তাহারও পরাণে বাজিবে মরণ-বীণ!
কী জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিল না ফিরে,
এইখানে তারে কবর দিয়েছি দেখে যাও দাদু! ধীরে।
ব্যথাতুরা সেই হতভাগিনীরে বাসে নাই কেহ ভালো,
কবরে তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো।
বনের ঘুগুরা উঁহু উঁহু করি কেঁদে মরে রাতদিন,
পাতায় পাতায় কেঁপে উঠে যেন তারি বেদনার বীণ।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ্-দাদু! ‘‘আয় খোদা! দয়াময়।
আমার বু-জীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।’’
হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুপু, সাত বছরের মেয়ে,
রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে।
ছোট বয়সেই মায়েরে হারায়ে কী জানি ভাবিত সদা,
অতটুকু বুকে লুকাইয়াছিল কে জানিত কত ব্যথা!
ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে,
তোমার দাদির ছবিখানি মোর হৃদয়ে উঠিত ছেয়ে।
বুকেতে তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা,
রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা।
একদিন গেনু গজনার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে,
ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের 'পরে।
সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকল তেমন আছে।
কী জানি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গেছে।
আপন হস্তে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি,
দাঁদু! ধর-ধর-বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি।
এইখানে এই কবরের পাশে আরও কাছে আয় দাদু,
কথা কস নাকো, জাগিয়া উঠিবে ঘুম-ভোলা মোর যাদু।
আস্তে আস্তে খুঁড়ে দেখ দেখি কঠিন মাটির তলে,
দীনদুনিয়ার ভেস্ত আমার ঘুমায় কিসের ছলে!
* * * *
ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।
মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সকরুণ সুর,
মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতজি কত দূর।
জোড়হাতে দাদু মোনাজাত কর, ‘‘আয় খোদা! রহমান।
ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু-ব্যথিত-প্রাণ।’’
শব্দার্থ ও টীকা
তিরিশ বছর ভিজায়ে
রেখেছি দুই নয়নের জলে - ত্রিশ বছর আগে বৃদ্ধের স্ত্রীর (অর্থাৎ পৌত্রের দাদির) মৃত্যু হয়েছে। ত্রিশ বছর ধরে শোকার্ত বৃদ্ধের বেদনাশ্রুতে এই কবর নিয়ত সিক্ত হয়েছে।
সোনার মতন মুখ - সোনার মতো লাবণ্যে ঝলমল মুখ।
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে
কেঁদে ভাসাইত বুক - ছোট মেয়েটির আনন্দময় খেলা ছিল পুতুলের বিয়ে দেয়া। কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় সে আনন্দ হারিয়ে মেয়েটি মনের দুঃখে কাঁদত। এ দেশে যে বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল তারই ইঙ্গিত।
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর
ছড়াইয়া দিল কারা - সেই লাবণ্যময়ী মেয়েটি যখন কর্মচঞ্চল হয়ে বাড়ির সর্বত্র বিচরণ করত তখন সেই তরুণ বয়সে বৃদ্ধ মুগ্ধ বিস্ময়ে ভাবতেন, গোটা বাড়িটা কারা যেন অজস্র সোনায় ভরিয়ে দিয়েছে।
সোনামুখ তার আমার
নয়নে ভরি - মেয়েটির সেই কনকলাবণ্যে ভরা মুখ চোখ ভেবে ভেবে।
যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে
দেখে লইতাম কত - কৃষি ক্ষেতে যাওয়ার সময়ে তাকে বার বার ফিরে ফিরে দেখেও যখন দেখার সাধ মিটত না। তুলনীয় বিদ্যাপতির পদ : ‘জনম অবধি হাম রূপ নেহারিলু নয়ন না তিরপিত ভেল।'
দু পয়সার করি দেড়ী - দু পয়সাকে দেড়গুণ (তিন পয়সা) করে অর্থাৎ ভালরকম লাভ করে।
‘দেড় পয়সার তামাক এবং
মাজন .....' সেই তামাক মাজন পেয়ে,
দাদি যে তোমার কত খুশি হত' - লৌকিক আচারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের মতো এ দেশেও মেয়েদের মধ্যে তামাক খাওয়ার রীতি যে প্রচলিত ছিল তারই ইঙ্গিত। মেয়েরা দাঁতে মিশি হিসেবেও তামাক ব্যবহার করত।
বাট - পথ, রাস্তা।
আমারে ছাড়িয়া
এত ব্যথা যার - আমার সঙ্গে সামান্য বিচ্ছেদে যার বেদনার অন্ত থাকত না।
তরেতে - জন্য।
ভেস্ত-নসিব হয় - ভাগ্যে যেন বেহেশতের সুখ লাভ ঘটে। ‘বেহেশত' শব্দের বিকৃত রূপ-ভেস্ত।
তারপর এই শূন্য জীবনে - স্ত্রীর মৃত্যুতে একেবারে ফাঁকা হয়ে যাওয়া জীবনে।
শত কাফনের, শত কবরের
অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি - মনের পর্দায় অগণিত মৃত্যুর হিসাব কষে কষে।
নাওয়ায়ে চোখের জলে - প্রিয়পাত্রদের শেষ গোসল যেন চোখের জলেই সমাধা করা হয়েছিল।
মাটিরে আমি যে বড় ভালোবাসি - বৃদ্ধ কৃষক বলে যে মাটিতে ফসল ফলে সেই মাটির প্রতি তার মমতা অপরিসীম। কিন্তু সেই মমতা আরও গভীর হয়েছে মাটিতে কবরের মধ্যে তার বেশ কয়েকজন প্রিয়পাত্র শায়িত বলে।
কাঁদছিস তুই? কী করিব দাদু!
পরাণ যে মানে না - নাতিটির বাবা ও মায়ের কবরের উল্লেখ করায় নাতির চোখ জলে ভরে গেছে। কিন্তু বৃদ্ধের মনে যে বিপুল দুঃখ-বেদনার ভার জমেছে সে দুঃখ-বেদনা কিছুটা না বলতে পারলে সে বেদনা-ভার লাগব হবে না।
বা-জান - ‘বাপজান' শব্দের সংক্ষিপ্ত আঞ্চলিক রূপ। পিতা।
কী যে করে থাকি থাকি - অব্যক্ত ব্যখ্যায় মন মোচড় দিয়ে ওঠে বার বার।
ছপ, সপ্ - পাটি, চাটাই।
তুমি যে কহিলা, ‘বা-জানরে মোর
কোথা যাও দাদু লয়ে?’’ - নাতি তখনও মৃত্যুর সঙ্গে অপরিচিত। তাই সে বুঝতে পারেনি যে তার বাবাকে কবর দিতে নিয়ে যাওযা হচ্ছে।
তোমার কথার উত্তর দিতে
কথা থেমে গেল মুখে,
সারা দুনিয়ার যত কথা আছে
কেঁদে ফিরে গেল দুখে! - পিতাকে যে কবরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে কথা বলা সম্ভব ছিল না বলে বৃদ্ধ নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন। সে দুঃখের মধ্যে মৃত্যুসংবাদ দেয়ার মতো শব্দ যেন হারিয়ে গিয়েছিল সারা দুনিয়ার শব্দ ভান্ডার থেকে।
শুনো - শূন্য।
চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত
গাছের পাতার শোক - বৃদ্ধের পুত্রবধূর শোকার্ত কান্নায় ব্যথিত হয়ে পথচারী পথিকের পায়ের তলায় শুকনো ঝরা পাতারা যেন মর্মর ধ্বনিতে গুমরে গুমরে কেঁদে উঠত। বনপথে পথিকের পায়ের তলায় দলিত শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি এখানে শোকধ্বনির ব্যঞ্জনা পেয়েছে।
আথালে - গোয়ালে, গোশালায়।
আথালে দুইটি জোয়ান বলা
সারা মাঠ পানে চাহি - বৃদ্ধের পুত্রের মৃত্যুতে হালের দুটি বলদও বেদনামথিত কান্নায় আকুল হয়েছে। ভাষাহারা বোবা প্রাণী দুটির সে বেদনা প্রকাশ পেত করুণ হাম্বা রবে আর অবিরত ঝরে পড়া চোখের পানিতে।
নাহি - স্নান করে।
গহীন - গহন শব্দের কাব্যিক রূপ। গভীর।
সায়র - সাগর শব্দের কাব্যিক রূপ। দিঘি, সরোবর।
চোখের জলের গহীন সায়রে
ডুবায়ে সকল গাঁ - পুত্রবধুর শোক এতই গভীর বেদনাবহ ছিল যে সেই শোকের সহানুভূতিতে সমস্ত গ্রামটিই যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ত।
উদাসিনী সেই পল্লীবালা - স্বামীশোকে মেয়েটি (সেখানে পুত্রবধূ) সংসারের প্রতি সমস্ত আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিল।
নয়নের জল বুঝি/ কবর দেশের
আন্ধার ঘরে পথ পেয়েছিল খুঁজি - স্বামীহারা শোকাকুল মেয়েটি অচিরেই মৃত্যুপথযাত্রী হয়েছিল।
তাই জীবনের প্রথম বেলায়
ডাকিয়া আনিল সাঁঝ - শোকাহত মেয়েটি জীবনপ্রভাতেই জীবনসন্ধ্যারূপ মৃত্যুকে ডেকে আনল। অকালেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।
তাজ - মুকুট, শিরোভূষণ।
অভাগিনী আপনি পরিল
মরণ-বিষের তাজ - ভাগ্যহত মেয়েটি যেন স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করে নিল। মৃত্যু বিষাক্ত মুকুটরূপে কল্পিত।
মরিবার কালে ...
ছাড়িয়া যাইতে তোরে - সন্তানবৎসল জননী শিশুপুত্রকে মাতৃহীন করে যেতে চাননি। কিন্তু স্বামীকে হারানোর দুঃখ তাকে এতই কাতর করে তুলেছিল যে, তিলে তিলে সে মৃত্যুকেই বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছে।
কী জানি আশিস করে গেল তোরে
মরণ-ব্যথার ছলে - মরণযন্ত্রণায় তার চোখে যে অশ্রুধারা নেমেছিল তা আসলে সন্তানের প্রতি বেদনামথিত আশীর্বাদ।
মাথাল - তালপাতা, গোলপাতা ও বাঁশের কাঠি দিয়ে তৈরি বড় টুপি জাতীয় আচ্ছাদন, যা রোদবৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চাষীরা ব্যবহার করে।
জোড়মানিকেরা - রত্নযুগল। এখানে পাশাপাশি কবরে শায়িত পুত্র ও পুত্রবধূকে বোঝানো হয়েছে। জোড়মানিক শব্দ ব্যবহারে চখা-চখির নিবিড় প্রণয়ের অনুষঙ্গটি জড়িত। চখা ও চখি সাধারণত একে অন্যের বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারে না।
জোনাকী-মেয়েরা সারারাত
জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো - নিরাভরণ কবরে আলো জ্বালিয়ে রাখে রাতের জোনাকিরা।
রহমান - দয়াময়।
বুজি - বুবুজি, বড় বোন।
বনিয়াদি - প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত। খানদানি ঐতিহ্য রয়েছে এমন।
শত যে মারিত ঠোঁটে - তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গবিদ্রূপ ও কটু কথায় মর্মান্তিক যন্ত্রণা দিত।
কসাই চামার - কসাই ও চামারের মতো নির্মম, নিষ্ঠুর।
কে জানিত হায়, তাহারও পরাণে
বাজিবে মরণ-বীণ - সেই মেয়েটির জীবনেও যে মৃত্যুর ডাক আসবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
ব্যথাতুর - বেদনার্ত।
বনের ঘুঘুরা উহু উহু
করি ... বেদনার বীণ - হতভাগিনী মেয়েটির দুঃখে কাতর হয়ে বনের ঘুঘুরা যেন হা-হুতাশ করে উদাস সুরে ডাকত আর গাছের পাতারা যেন কেঁপে উঠত বেদনার মর্মর ধ্বনিতে।
রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল
ভেস্তের দ্বার বেয়ে - বৃদ্ধের কনিষ্ঠা কন্যাটির জন্ম হয়েছিল স্বর্গীয় সুষমা ও সৌন্দর্য নিয়ে।
তোমার দাদির মুখখানি
মোর হৃদয়ে উঠিত ছেয়ে - কনিষ্ঠা কন্যাটির চেহারা ছিল অবিকল বৃদ্ধের স্ত্রীর মতো। তাই তাকে দেখলেই বৃদ্ধের অন্তরে প্রয়াত স্ত্রীর চেহারাটুকু ভেসে উঠত।
রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে
দিত মোদের চোখের ধারা - চমৎকার চিত্রকল্প এটি। বৃদ্ধ তার ছোট কন্যাকে জড়িয়ে ধরে স্ত্রীর কথা স্মরণ করে অঝোরে কাঁদতে শুরু করলে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে আসত।
দাদু! ধর-ধর-বুক ফেটে
যায়, আর বুঝি নাহি পারি - শোকের ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বৃদ্ধ যেন মূর্ছিতপ্রায় হয়ে পড়েন।
দীন-দুনিয়ার ভেস্ত - ইহকাল ও পরকালের স্বর্গ, অর্থাৎ ইহজীবন ও পরজীবনের সর্বসুখের আকর।
দীন-দুনিয়ার ভেস্ত আমার
ঘুমায় কিসের ছলে! - পার্থিব জগতে যে বেহেশতের সৌন্দর্যসুষমা নিয়ে এসেছিল সে কোন লীলাচ্ছলে এ কবরে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ঘন আবিরের রাগে - দূর বনের মাথায় আসন্ন সন্ধ্যাকাশ আবিরের মতো লাল আভায় রঙিন হয়ে উঠেছে।
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে - স্ত্রী পুত্র কন্যা যে কবরে শুয়ে আছে সেখানে তাদের কাছে যেতে।
মজিদ - মসজিদ।
রোজ কেয়ামত - পৃথিবীর পরিসমাপ্তির দিন। মহাপ্রলয়।
মোর জীবনের রোজ কেয়ামত
ভাবিতেছি কতদূর! - বৃদ্ধ তাঁর জীবনের শেষ দিনটির জন্য আকুল হয়ে প্রতীক্ষা করছেন। মানুষ নিজের জীবনের শেষ কবে তা জানে না।
উৎস ও পরিচিতি
‘কবর' জসীমউদ্দীনের বিখ্যাত ও বহুল আলোচিত কবিতা। এটি প্রথম যখন ‘কল্লোল' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ ক্লাসের ছাত্র। এ কবিতায় কবি জসীমউদ্দীনের কবিপ্রতিভার বৈশিষ্ট্য প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কবিতাটিকে প্রবেশিকা পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। পরবর্তীকালে কবিতাটি কবির ‘রাখালী' কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়।
করুণ রসাত্মক এ কবিতায় প্রধান হয়ে উঠেছে এক গ্রামীণ বৃদ্ধের জীবনের গভীর বেদনাগাঁথা। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ তার জীবনের শোকার্ত অধ্যায়গুলো উন্মোচন করেছেন তার একমাত্র অবলম্বন নাতির কাছে। গোরস্থানে গিয়ে নাতিকে তিনি এক এক করে তার স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ ও কন্যার কবর দেখিয়ে বেদনার্ত কণ্ঠে বর্ণনা করছেন তাদের মৃত্যুর মর্মান্তিক স্মৃতিগুলো। যে অনেক মৃত্যুবেদনায় তার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত সেই হৃদয় থেকে আজ উৎসারিত হচ্ছে চোখের জলে বুক ভাসানো হাহাকার।
বৃদ্ধ দাদুর করুণ স্মৃতিময় শোক-বেদনাই কবি গভীর সহানুভূতি দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন।
ছন্দ
কবিতাটি ষান্মাত্রিক মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। প্রতিটি চরণে ৩টি পূর্ণ পর্ব এবং ১ টি অপূর্ণ পর্ব রয়েছে। পূর্ণ পর্বের মাত্রা ৬ এবং অপূর্ণ পর্বের মাত্রা ২। প্রতি চরণে মাত্রা সংখ্যা মোট ২০। দুএকটি চরণে শেষ অপূর্ণ পর্ব ১ মাত্রার। যেমন: ‘বাপের বাড়িতে যাইবার কালে কহিত ধরিয়া পা/আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।'
অনুশীলনমূলক কাজ
ভাষা অনুশীলন
বানান q সাধু ভাষায় ‘ঙ্গ' এর স্থানে চলিত ভাষায়- ‘ঙ'
সাধু ভাষায় ব্যবহৃত কিছু শব্দের বানানে ‘ঙ্গ'-এর জায়গায় চলিত ভাষায় কোমল রূপ হিসেবে বানানে ‘ঙ' হয়।
যেমন:
ভেঙ্গে > ভেঙে। ‘কবর' কবিতায় ব্যবহৃত এমন কিছু শব্দের উদাহরণ’’
ভেঙে : পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
লাঙল : লাঙল লইয়া খেতে ছুটিতাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।
রঙিন : রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা।
সমোচ্চারিত শব্দে বানান ও অর্থ-পার্থক্য
সাড়া - শব্দ, ডাকের জবাব, প্রতিক্রিয়া। সারা - সমগ্র, শেষ, আকুল। শোনা - শ্রবণ করা। সোনা - স্বর্ণ। দেড়ী - দেড়গুণ। দেরি - বিলম্ব | জোড় - যুক্ত, যুগল। জোর - বল, শক্তি, সামর্থ্য। পাড়ি - পারাপার। পারি - সমর্থ বা সক্ষম হই। |
বানান সতর্কতা
শ্বশুর, অঙ্ক, ব্যথা, লক্ষ্মী, আশিস, গন্ড, আবির।
ব্যুৎপত্তি নির্দেশ
তিরিশ < ত্রিশ সোনা < স্বর্ণ বুক < বক্ষ পা < পদ গাঁ < গ্রাম অাঁখি < অক্ষি মাটি < মৃত্তিকা রাত < রাত্রি চামার < চর্মকার | পরান < প্রাণ দুখ < দুঃখ হাত < হস্ত বুনো < বন্য শুনো < শূন্য সায়র < সাগর আন্ধার < অন্ধকার সাত < সপ্ত সাপ < সর্প |
সাহিত্যবোধ q শোক কবিতা
‘কবর' কবিতার শুরু শোকবেদনা দিয়ে আর এর সমাপ্তিও ঘটেছে শোকার্ত হাহাকারে। জীবনের একমাত্র অবলম্বন নাতির কাছে বেদনা-ভরাক্রান্ত কণ্ঠে বৃদ্ধ ব্যক্ত করেছেন নিজের পাঁচ-পাঁচজন পরমাত্মীয়য়ের মৃত্যুগাঁথা। সমস্ত কবিতার পরতে পরতে শোনা যায় অনুচ্চ ক্রন্দনধ্বনির মর্মরিত মূর্ছনা।
প্রিয়জনের মৃত্যুতে এ কবিতায় মর্মান্তিক শোকের এক করুণ আবহ তৈরি হয়েছে। এ জন্য এ জাতীয় কবিতাকে শোক-কবিতা (Elegy) বলা হয়। কখনও কখনও বিখ্যাত কোনো ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতে শোক-কবিতা লেখা হয়ে থাকে। বাংলা সাহিত্যে স্ত্রীর মৃত্যুতে লেখা রবীন্দ্রনাথের ‘স্মরণ' কবিতাগুচ্ছ, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের লেখা ‘২২ শ্রাবণ ১৩৪৮', মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘পাথরের ফুল' বিশেষ উল্লেখযোগ্য শোক-কবিতা।
সাহিত্যবোধ q নাটকীয় স্বগতোক্তি
নাটকীয় স্বগতোক্তিতে বক্তা তার মনের একান্ত ভাবনা, অনুভূতি কিংবা নাটকীয় অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করে থাকেন। কোনো শ্রোতা উপস্থিত থাকলেও তার কোনো ভূমিকা থাকে না এবং বক্তার স্বগতোক্তিতে সে কোনোরকম বাধা দেয় না। এ পন্থায় লেখক বক্তার অন্তর্জগতের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে পারেন।
‘কবর' কবিতাটি নাটকীয় স্বগতোক্তির চমৎকার উদাহরণ। এখানে বৃদ্ধ দাদুর জীবনের মর্মান্তিক দুঃখময় ঘটনা ও অভিজ্ঞতার গভীর ও নিবিড় শোকাবহ প্রকাশ ঘটেছে নাটকীয় স্বগতোক্তির মাধ্যমে। শ্রোতা হিসেবে শিশু পৌত্রের উপস্থিতি লক্ষ করা গেলেও তার ভূমিকা সম্পূর্ণরূপে নীরব শ্রোতার।
দীর্ঘ-উত্তর প্রশ্ন
১. ‘কবর’ কবিতায় বৃদ্ধ দাদুর জীবনের যে করুণ কাহিনী বিবৃত হয়েছে তা নিজের ভাষায় লেখ।
২. ‘যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি। - ‘কবর’ কবিতা অবলম্বনে উক্তিটির তাৎপর্য বুঝিয়ে দাও।
বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১. ‘কবর’ কবিতায় দাদির জীবনের যে স্মৃতিচিত্র অঙ্কিত হয়েছে তা সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ কর।
২. ‘এ কথ লইয়া ভাবি সাব মোরে তামাশা করিত শত’- কী কথা নিয়ে কেন ভাবি সাব তামাশা করত?
৩. ‘পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি অাঁখিজলে’- কে কী উপলক্ষে এ কথা বলেছিল? পটভূমিসহ বিশদ বর্ণনা কর।
৪. ‘জোড়ামানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরু-ছায়’- এই জোড়মানিক কে কে? এদের জীবনের করুণ পরিণতির ঘটনা সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
৫. ‘তাই জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ’ - কে কী কারণে জীবনের প্রথম বেলায় সাঁঝ ডেকে এনেছিল?
ভাষাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১. সাধু ভাষায় ‘ঙ্গ’-এর জায়গায় চলিত ভাষার বানানে ‘ঙ’ হয় এমন পাঁচটি শব্দ লেখ এবং বাক্যে সেগুলোর প্রয়োগ দেখাও।
২. নিচের সমোচ্চারিত শব্দগুলোর অর্থ পাথ্যক্য দেখাও :
সাড়া, সারা। শোনা, সোনা। জোড়, জোর। দেড়ী, দেরি।
৩. ব্যুৎপত্তি নির্দেশ কর :
সোনা, বুক, গাঁ, অাঁখি, মাটি, চামার, সায়র, পা, বাছা, বুনো।
৪. জটিল বাক্যে নিচের সম্বন্ধ পদগুলোর প্রয়োগ দেখাও :
দাদির কবর, নয়নের জল, পুতুলের বিয়ে, গাঁয়ের পথ, বাপের বাড়ি, পুঁতির মালা, মাটির তলায়, ঘরে মেঘে, তোমার কথা, গাছের পাতা, সাপের দংশন, সোনার প্রতিমা।
ব্যাখ্যা
সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা লেখ :
ক. এখানে ওখানে ঘুরিয়ে ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!
খ. আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,
কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝুম নিরালায়।
গ. শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে অাঁকি,
গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।
ঘ. গাছের পাতারা সেই বেদনায় বুনো পথে যেত ঝরে,
ফাল্গুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো-মাঠখানি ভরে।
ঙ. বনের ঘুঘুরা উহু উহু করি কেঁদে মরে রাতদিন,
পাতায় পাতায় কেঁপে উঠে যেন তারি বেদনার বীণ।
চ. আস্তে আস্তে খুঁড়ে দেখ দেখি কঠিন মাটির তলে,
দীনদুনিয়ার ভেস্ত আমার ঘুমায় কিসের ছলে!
ছ. ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।
মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সকরুণ সুর,
মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূর।