Logo Sponsored by Chowdhury and Hossain, Advanced Publications

Somajkollan 2nd part 5th chap read


পৃষ্ঠা ২২০
পঞ্চম অধ্যায়
বাংলাদেশে প্রচলিত কয়েকটি সামাজিক আইন
 

মানুষ বিধিশাসিত সমাজে বাস করে। সামাজিক জীব হিসেবে তাকে বিভিন্ন বিধি-বিধান মেনে চলতে হয়। এসব বিধি-বিধানের বিশেষ রূপই হচ্ছে আইন। অন্যভাবে বলা যায়, সামাজিক জীব হিসেবে সমাজে বাস করতে গিয়ে মানুষকে যেসব নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়, সাধারণভাবে সেসব নিয়ম-কানুনকে আইন হিসেবে গণ্য করা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায়, মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম প্রণীত এবং অনুমোদিত বিধিবদ্ধ নিয়ম-কানুনকে আইন বলা হয়। মনীষী অস্টিন বলেছেন, সার্বভৌম শাসকের আদেশই আইন। আইনের বাস্তব সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ডব্লিউ. উইলসন বলেছেন, ‘‘আইন হলো সমাজের সেসব সুপ্রতিষ্ঠিত প্রথা ও রীতি-নীতি, যেগুলো সমাজ স্বীকৃত ও রাষ্ট্র গৃহীত বিধিতে পরিণত হয়েছে এবং যেগুলোর পেছনে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সমর্থন রয়েছে।’’ সুতরাং বলা যায়, আইন হলো এমন কতগুলো বিধি-বিধান, যেগুলো মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। যা সমাজের বেশির ভাগ লোক কর্তৃক স্বীকৃত, যা সার্বভৌম কোন কর্তৃপক্ষ প্রণীত এবং যা ভঙ্গ করলে শাস্তির বিধান রয়েছে।
সামাজিক আইন
রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম প্রণীত যেসব বিধি-বিধান ও আইন-কানুন সমাজ জীবন হতে অবাঞ্ছিত অবস্থা দূর করে সুন্দর, সুষ্ঠু ও প্রগতিশীল সমাজ গড়ে তুলতে প্রয়াস পায়, সেগুলোই সামাজিক আইন নামে পরিচিত। অন্যকথায়, সামাজিক প্রগতি ও উন্নতির প্রতিবন্ধকতা দূর করার লক্ষ্যে যেসব আইনগত ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম কর্তৃক প্রণীত হয়, সেগুলোই সামাজিক আইন নামে পরিচিত।
সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী, মানবকল্যাণের প্রয়োজন, আয়ের নিরাপত্তা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উন্নতি, নাগরিক অধিকার, ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ এবং সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় গৃহীত কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনকে সামাজিক আইন বলা হয়।[1] সমাজকল্যাণ অভিধান -এর সংজ্ঞানুযায়ী, ‘‘শারীরিক পঙ্গুত্ব, দারিদ্র অথবা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার অভাবে যারা উন্নত জীবন লাভে অক্ষম, সেসব মানুষের প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ কিংবা সমাজের স্বল্প সুবিধা প্রাপ্ত শ্রেণীর জন্য সেবা লাভ নিশ্চিতকরণ এবং তাদের অধিকার সংরক্ষণকল্পে প্রণীত আইনকেই সামাজিক আইন বলা হয়।’’[2]
সমাজবিজ্ঞান এবং সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানসমূহের অভিধানে উল্লিখিত সংজ্ঞানুযায়ী, ‘‘সমাজের যেসব লোক লিঙ্গ, বয়স, বর্ণ, শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে পঙ্গুত্ব অথবা কর্মক্ষমতার অভাবে অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে সুষ্ঠু ও সন্তোষজনক জীবনযাপনে অক্ষম, তাদের রক্ষা করার এবং উন্নয়নের জন্য গৃহীত আইনকেই সামাজিক আইন বলা হয়।’’[3] সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া এবং সামাজিক কল্যাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনগুলোকে সামাজিক আইন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
সামাজিক আইনের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব
সুনিয়ন্ত্রিত সমাজ কাঠামো সৃষ্টি করে সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণ ও বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা সামাজিক আইনের মূল লক্ষ্য। এটি সবসময় অনাকাঙ্খিত অবস্থা রোধ করে, বাঞ্ছিত সমাজ কাঠামো গঠনে সাহায্য করে। নিচে সামাজিক আইনের বিশেষ উদ্দেশ্যগুলো উল্লেখ করা হলো
  মানুষের সামাজিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণঃ মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি হচ্ছে স্বার্থপরতা। ব্যক্তি স্বার্থকে মানুষ সব সময় সমষ্টি স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে থাকে। অনেক সময় মানুষ ব্যক্তি স্বার্থে যথেচ্ছা আচরণ করে থাকে। সামাজিক আইন সমাজের মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রণীত হয়। যাতে মানুষ ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে সমষ্টি ও সামাজিক স্বার্থের প্রতি সচেতন থেকে বাঞ্ছিত আচরণ করতে সক্ষম হয়। আইন মানুষকে তার করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে একটি মানদন্ড প্রদান করে।  দার্শনিক প্লেটোর মতে, রাষ্ট্রের আইন মানুষের আচরণের এমন এক মানদন্ড প্রদান করে, যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানুষের ক্ষুধা ও প্রবৃত্তিকে সীমিত করে এবং তার পক্ষে যা করা উচিত অথচ সে করতে চায় না, তাকে তা করতে বাধ্য করে।
  সমাজসংস্কার ও গঠনমূলক সামাজিক পরিবর্তনের ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টিঃ সামাজিক আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হচ্ছে, সমাজ কাঠামো থেকে অবাঞ্ছিত ক্ষতিকর প্রথা প্রতিষ্ঠানের উচ্ছেদ সাধন। যাতে গঠনমূলক সামাজিক পরিবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টি ও তা বজায় রাখা যায়। সামাজিক আইনের সমর্থন ছাড়া সমাজসংস্কার স্থায়ী হতে পারে না। যেমন আইন প্রণয়ন ছাড়া সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ সাধন সম্ভব হয়নি। সামাজিক আইনের মাধ্যমে অপরিকল্পিত পরিবর্তন রোধ এবং পরিকল্পিত পরিবর্তন আনয়নের প্রচেষ্টা চালানো হয়। পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে মানুষ যাতে সহজে সামঞ্জস্য বিধানে সক্ষম হয়, সে জন্য সামাজিক আইন সাহায্য করে।
  সকলের স্বার্থ সংরক্ষণঃ সামাজিক আইন সমাজের সর্বস্তরের জনগণের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণে সহায়তা করে। বিশেষ করে সমাজের দুর্বল, অসহায়, বঞ্চিত শ্রেণীর অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ করা সামাজিক আইনের অন্যতম লক্ষ্য।

পৃষ্ঠা ২২১
সামাজিক সংহতি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখাঃ সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সংহতি বজায় রেখে সামাজিক মূল্যবোধ, প্রথা, প্রতিষ্ঠান, আচার-আচরণ ইত্যাদির মধ্যে সমন্বয় সাধনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা সামাজিক আইনের লক্ষ্য।
  ভবিষ্যত সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করাঃ আকস্মিক দুর্ঘটনা ও বিপর্যয় মোকাবেলায় সামাজিক আইন মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। ফলে সামাজিক উন্নয়ন ও প্রগতিতে সমাজের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের অনুপ্রেরণা লাভ করে।
সামাজিক সাম্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠাঃ সামাজিক আইন সমাজের সবশ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের প্রতি সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এতে সামাজিক বৈষম্য দূর হয়। সামাজিক সাম্য, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং তা সংরক্ষণের রক্ষাকবচ হিসেবে সামাজিক আইন কাজ করে।
  সামাজিক নীতি বাস্তবায়নের পরিবেশ সৃষ্টিঃ মানুষের কল্যাণে গৃহীত সামাজিক নীতিমালা অনেক সময় আইনের সমর্থন ছাড়া বাস্তবায়ন করা যায় না। সামাজিক নীতি বাস্তবায়নের উপযুক্ত কাঠামো ও পরিবেশ সৃষ্টিতে সামাজিক আইন বিশেষভাবে সহায়তাকরে।
  সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার সুষম বণ্টন নিশ্চিত করাঃ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি যাতে সমাজের সর্বস্তরের জনগণ ভোগ করতে পারে, তার জন্য সুষ্ঠু বণ্টন নীতি প্রণয়নে সহায়তা করে সামাজিক আইন। সমাজের সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধা যাতে বিশেষ কোন শ্রেণীর হাতে কুক্ষিগত না হয়, তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে সামাজিক আইন প্রণীত হয়।
  অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলাঃ সামাজিক আইনের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, সমাজের মানুষকে অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। যাতে মানুষ আইনগত কাঠামোর অধীনে নিজ অধিকার ভোগের মাধ্যমে, অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে।
১০       সামাজিক সমস্যা সমাধান এবং ভবিষ্যত সমস্যা নিয়ন্ত্রণঃ কোন সমাজই সমস্যাহীন নয়। সব সমাজেই কোন না কোন সমস্যা বিদ্যমান থাকে। সামাজিক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বিরাজমান সামাজিক সমস্যা প্রতিকার এবং ভবিষ্যত সমস্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা হয়। আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না।
১১       সমাজকল্যাণ ও সামাজিক সংহতির রক্ষাকবচ : সামাজিক আইন সমাজকল্যাণের স্বার্থেই প্রণীত হয়। সমাজের বিভিন্ন দিককে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সমস্যা ও অবাঞ্ছিত অবস্থা মোকাবেলা করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক আইন প্রণীত হয়। এজন্য সামাজিক আইনকে সমাজকল্যাণ ও সামাজিক সংহতির রক্ষাকবচ বলা হয়।
সামাজিক আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া
সামাজিক আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া কয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত। সমাজসংস্কার আন্দোলন বা সামাজিক আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট জনমত হলো সামাজিক আইনের মূল ভিত্তি। গঠনমূলক জনমত সামাজিক আইন প্রণয়নের ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করেজনগণের সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত জনমত ছাড়া সামাজিক আইন প্রণয়ন এবং তা কার্যকর হতে পারে না। সামাজিক আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার দশটি পর্যায় উল্লেখ করেছেন মনীষী ড. ডি পল চৌধুরী । তার আলোকে নিচে সামাজিক আইন প্রণয়নের দশটি পর্যায় উল্লেখ করা হলো।[4]
১.       সমস্যা চিহ্নিতকরণ : সমাজে বিদ্যমান সমস্যা হতে সুনির্দিষ্ট সমস্যা চিহ্নিতকরণ সামাজিক আইন প্রণয়নের প্রথম পদক্ষেপ। যে সমস্যা মোকাবেলার জন্য সামাজিক আইন প্রণীত হবে সেটি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করার মধ্যদিয়ে সামাজিক আইন গঠন প্রক্রিয়ার সূচনা হয়।
২.       সমাজসংস্কার আন্দোলন : সামাজিক আইন প্রণয়নের দ্বিতীয় পর্যায়ে চিহ্নিত সমস্যাকে কেন্দ্র করে সমাজসংস্কার আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। সমাজসংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে চিহ্নিত সমস্যার বিস্তৃতি, প্রভাব, মোকাবেলার উপায় প্রভৃতি সম্পর্কে জনমত গঠনের প্রচেষ্টা চালানো হয়। বর্তমানে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম, রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি, সভা সমিতির মাধ্যমে প্রচারণা প্রভৃতি সমাজ সংস্কারের ভূমিকা পালন করে। জনমত গঠনে এ ধরনের প্রচেষ্টা গণতান্ত্রিক সমাজে পরিলক্ষিত হয়। অনেক সময় সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে নির্দিষ্ট সমস্যা নিয়ন্ত্রণে সামাজিক আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তোলা হয়। পেশাদার সমাজকর্মের সহায়ক পদ্ধতি সামাজিক কার্যক্রম প্রয়োগের মাধ্যমে সামাজিক আইন প্রণয়নের স্বপক্ষে জনমত গঠন করা হয়।
৩.       জনমত গঠন : সমাজসংস্কার বা সামাজিক আন্দোলনের প্রভাবে সংশ্লিষ্ট সমস্যার প্রভাব ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জনমত গঠিত হয়। আইন প্রণয়নের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো জনমত। জনমত গঠনের ফলে আইন প্রণেতাদের ওপর আইন প্রণয়নের চাপ সৃষ্টি হয়।
৪.       নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ : জনমত গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সমস্যা মোকাবেলার জন্য আইন প্রণয়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
৫.       বিল তৈরির বিষয়বস্ত্ত উপস্থাপন : আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে আইনের বিল তৈরির জন্য বিষয়বস্ত্ত রচনা করা। সামাজিক আইন প্রণয়নের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হলো বিলের বিষয়বস্ত্ত তৈরিকরণ।
৬.       আইনের খসড়া বিল তৈরি : আইনের বিষয়বস্ত্তর আলোকে আইন বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে খসড়া বিল তৈরি করা। খসড়া বিলে আইনের উদ্দেশ্য, ধারা, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াসহ সামগ্রিক দিক উল্লেখ থাকে।

পৃষ্ঠা ২২২
৭.       আইন বিশেষজ্ঞ নির্বাচন : আইনের খসড়া বিল বিবেচনা ও পর্যালোচনার জন্য আইন বিশেষজ্ঞ নির্বাচন করা আইন প্রণয়নের গুরুত্বপূর্ণ  দিক। আইনের মধ্যে যাতে কোনরূপ অসম্পূর্ণতা না থাকে সেজন্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হয়।
৮.       আইন বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ : নির্বাচিত আইন বিশেষজ্ঞদের বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে আইনের বিল চূড়ান্ত করা হয়। এ পর্যায়ে আইনের খসড়া বিলে কোনরূপ অসামঞ্জস্যতা থাকলে তা সংশোধন করা হয়, যাতে আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতিফলন ঘটে।
৯.       আইন সভায় বিল উপস্থাপন : সামাজিক আইন প্রণয়নের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হলো আইনের বিল অনুমোদনের জন্য আইন সভায় উপস্থাপন। আইন সভায় উপস্থাপিত বিলের ওপর খোলাখুলি আলোচনার মাধ্যমে সংখ্যা গরিষ্ঠের ভোটে অনুমোদিত হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনসভার সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে অনেক সময় আইনের বিল জনমত যাচাইয়ের জন্য অথবা আইন সভার সদস্যদের নিয়ে গঠিত কমিটিতে যাচাই বাছাই করে আইন সভায় একাধিকবার উপস্থাপন করা হয়। সামাজিক আইনকে অধিক কার্যকরী ও প্রয়োগযোগ্য করে তোলার জন্য আইন পরিষদে খোলাখুলি আলোচনার মাধ্যমে আইনের বিল অনুমোদন করা হয়।
১০.      রাষ্ট্র প্রধানের অনুমোদনঃ আইন প্রণয়নের চূড়ান্ত পর্যায় হলো রাষ্ট্র প্রধানের মাধ্যমে আইন সভায় অনুমোদিত আইনের বিলে সম্মতি প্রদান। রাষ্ট্র প্রধানের সম্মতি প্রদানের মাধ্যমে আইন পরিষদে পাসকৃত বিল আইনে পরিণত হয়।
বাংলাদেশে সামাজিক আইন প্রণয়নে উপরিউক্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। যখন জাতীয় সংসদের অর্থাৎ আইনসভার অধিবেশন বা কার্যকারিতা বন্ধ থাকে, তখন রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ আকারে সামাজিক আইন প্রণয়ন করেন। আইন পরিষদের অনুমোদনের মাধ্যমে পরবর্তীতে অধ্যাদেশ আইনে পরিণত হয়আইন পরিষদের অনুমোদন না পেলে অধ্যাদেশ হিসেবে বলবত থাকে।
সামাজিক আইনের সঙ্গে অন্যান্য আইনের পার্থক্য
রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম কর্তৃক প্রণীত আইন বিভিন্ন ধরনের হয়। যেমন- শাসনতান্ত্রিক আইন, প্রশাসনিক আইন, ফৌজদারী আইন, জরুরী আইন ইত্যাদি। এসব আইনের সঙ্গে সামাজিক আইনের পার্থক্য রয়েছে।
শাসনতান্ত্রিক আইন সরকারের বিভিন্ন বিভাগের গঠন ও কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ এবং শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক নির্ধারণ করে। প্রশাসনিক আইন রাষ্ট্রের প্রশাসন সংক্রান্ত কার্যাবলী পরিচালনা করে। যেসব আইন দ্বারা রাষ্ট্রীয় অধিকার ভঙ্গ করা হতে বিরত রাখা এবং শাস্তির বিধান রাখা হয়, সেসব আইনকে ফৌজদারী আইন বলা হয়। সামাজিক আইন হলো জনগণের স্বার্থে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ এবং সামাজিক অনাচার দূরীকরণের লক্ষ্যে প্রণীত আইন।
সুতরাং দেখা যায়, অন্যান্য আইনের বিষয়বস্তু ও প্রয়োগক্ষেত্র হতে সামাজিক আইনের বিষয়বস্তু এবং প্রয়োগক্ষেত্র পৃথক। সামাজিক আইন সামাজিক অনাচার ও কুপ্রথা দূরীকরণের লক্ষ্যে প্রণীত। সমাজের দুর্বল, অসহায় ও অক্ষম শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ এবং সমাজের মানুষের ভবিষ্যত সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে সামাজিক আইন প্রণীত হয়। যেমন- ফৌজদারী আইনের লক্ষ্য হলো আইন ভঙ্গকারীর শাস্তির বিধান করা। পক্ষান্তরে, সামাজিক আইনের লক্ষ্য হলো অপরাধীর চরিত্র সংশোধনের সুযোগ দান করে, অপরাধ প্রবণতা দূর করা। সামাজিক আইন সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম গ্রহণ ও পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। শিশুকল্যাণ, পঙ্গু ও প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন, এতিম ও পরিত্যক্ত শিশু, ভিক্ষুক পুনর্বাসন, সামাজিক নিরাপত্তামূলক আইন প্রভৃতি আইনগুলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
মূলত শাস্তিমূলক ফৌজদারী আইন ও দন্ডবিধির বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে সমাজের মানুষকে রক্ষা করার লক্ষ্যে সামাজিক আইন প্রণীত হয়। সামাজিক আইনের প্রয়োগক্ষেত্র হলো ক. সমাজের মানুষের পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্ক হতে সৃষ্ট অবাঞ্ছিত অবস্থা দূর করা; খ. দুর্বল, অসহায় ও অক্ষম শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ; গ. সামাজিক অনাচার ও কুপ্রথা হতে সমাজকে মুক্ত রাখা; ঘ. সমাজের মানুষের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা; এবং ঙ. আয়ের নিশ্চয়তা বিধান করে সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থাকরণ।

বাংলাদেশে প্রচলিত কয়েকটি সামাজিক আইন

প্রবেশন অব অফেন্ডার্স (বাংলাদেশ এমেন্ডম্যান্ট) এ্যাক্ট-১৯৬৪
১৯৬০ সালে প্রণীত ‘‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স-এর কতিপয় ধারা সংশোধনপূর্বক সাবেক পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে ২৮শে জানুয়ারি ১৯৬৪ সালে একটি আইন পাস করা হয়। এ আইনের সংক্ষিপ্ত শিরোনাম হলো ‘‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স (পূর্ব পাকিস্তান এমেন্ডম্যান্ট) এ্যাক্ট-১৯৬৪’’[5]
১৯৬০ সালের প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স এর প্রায় সবগুলো ধারা ঠিক রেখে শুধু কতিপয় শব্দের সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধিত আইনটি সারা বাংলাদেশের (সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের) জন্য প্রযোজ্য হয়। সংশোধিত আইনে ডাইরেক্টরকে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবর্তে প্রাদেশিক সরকারকে বুঝানো হয়েছে। এছাড়া মূল আইনের কয়েকটি ধারা বিলুপ্ত করা হয়েছে।


পৃষ্ঠা ২২৩
১৯৬৪ সালের প্রবেশন অব অফেন্ডার্স (বাংলাদেশ এমেন্ডম্যান্ট) এ্যাক্ট অপরাধীদের অপরাধ প্রবণতা দূরীকরণের লক্ষ্যে অপরাধ সংশোধনমূলক কার্যক্রমের আইনগত ভিত্তি রচনা করে। উক্ত আইনের প্রধান ধারাগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো।
ধারা ৪। শর্তসাপেক্ষে মুক্তি
উক্ত আইনের ৪ নং ধারা অনুযায়ী কোন অপরাধী প্রথমবারের মত অপরাধ করলে বা আদালত কর্তৃক যার অপরাধের কোন পূর্ব রেকর্ড নেই এবং যার কৃত অপরাধের শাস্তি দু’বছরের অধিক হবার যোগ্য নয়, তাহলে বিচারক তার অপরাধের শাস্তি স্থগিত রেখে শর্তসাপেক্ষে প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে সংশোধনের জন্য মুক্তি দিতে পারেন। যদি অপরাধীর বয়স, চরিত্র, অতীত ইতিহাস, দৈহিক এবং মানসিক অবস্থা শর্তসাপেক্ষে মুক্তির অনুকূল বিবেচিত হয়, তাহলে বিচারক এরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। তবে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তির মেয়াদ এক বছরের অধিক হবে না।
শর্তগুলো হলো
ক) অপরাধীকে পুনরায় অপরাধ না করার অঙ্গীকার করা;
খ) আদালত কর্তৃক নিয়োগকৃত প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে বা নির্দিষ্ট জিম্মাদারের আওতায় নির্দিষ্ট বাসস্থানে ও পেশায় নিয়োজিত থাকা; এবং
গ) সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার অঙ্গীকার করা।
এসব শর্ত ভঙ্গ করলে অপরাধীর শর্তসাপেক্ষ মুক্তির আদেশ বাতিল করে, শাস্তি কার্যকর করার ব্যবস্থা আদালত গ্রহণ করবে।
ধারা ৫। নির্দিষ্ট অপরাধের প্রবেশন প্রদানে আদালতের ক্ষমতা : যেসব পুরুষ বা মহিলা অপরাধী ফৌজদারী আইন অথবা ফৌজদারী দন্ডবিধির ধারা অনুযায়ী এরূপ অপরাধ না করে, যার শাস্তি মুত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতে পারে, তাদেরকে আদালত প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে কমপক্ষে এক বছর এবং সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত প্রবেশন মঞ্জুর করতে পারেন। তবে অপরাধীকে জিম্মাদারের আওতায় চুক্তিনামায় সই করতে হবে
ক) ভবিষ্যতে সে কোন অপরাধ করবে না;
খ) শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখবে;
গ) সমাজে উত্তম আচরণ ও সম্পর্ক বজায় রাখবে;
ঘ) প্রবেশন কালীন সময়ে যেরূপ আদেশ করা হবে, তা গ্রহণে সে প্রস্ত‍ুত থাকবে।
তবে আদালত অপরাধী অথবা তার জিম্মাদারের স্থায়ী বাসস্থান ও স্থায়ী পেশা সম্পর্কে নিশ্চিত এবং সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত প্রবেশনের আদেশ দিতে পারবে না। প্রবেশনের আদেশ দানের সঙ্গে আদালত প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে অপরাধীকে সংশোধন করে সৎ, পরিশ্রমী এবং আইনের প্রতি আনুগত্যশীল নাগরিক হিসেবে সামাজিক ক্ষেত্রে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারেন। যদি অপরাধী প্রবেশনের শর্তভঙ্গ করে, তবে তাকে পুনরায় বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।
ধারা ৭। প্রবেশনের শর্ত পালনের ব্যর্থতা
যদি আদালত মনে করে যে, অপরাধী প্রবেশনের যেকোন শর্ত পালনে ব্যর্থ হয়েছে, তাহলে অপরাধী এবং তার জিম্মাদারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করতে পারে। আদালত ইচ্ছা করলে অপরাধীকে কার্য সমাধা পর্যন্ত কারাগারের হেফাজতে রাখতে অথবা মামলার শুনানির তারিখে হাজির হবার শর্তে জামিন মঞ্জুর করতে পারবেন।
ধারা ১২। প্রবেশন অফিসার নিয়োগ
১৯৬৪ সালের প্রবেশন অব অফেন্ডার্স (বাংলাদশ এমেন্ডম্যান্ট) এ্যাক্ট-এর ধারা-১২ উপধারা-১ অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকার) সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উপযুক্ত যেকোন লোককে প্রবেশন অফিসার হিসেবে নিয়োগ করতে পারবেন। প্রবেশন অফিসার সমাজকল্যাণ বিভাগের ডাইরেক্টরের নিয়ন্ত্রণে (বর্তমান সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নিয়ন্ত্রণে) তার দায়িত্ব পালন করবেন।
ধারা ১৩। প্রবেশন অফিসারের দায়িত্ব
আইনের ধারা অনুযায়ী প্রবেশন অফিসার নিম্নোক্ত দায়িত্ব পালন করবেন।
ক) প্রবেশন আদেশের নির্দেশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পর পর অপরাধীদের পরিদর্শন করা।
খ) প্রবেশনাধীন অপরাধী যথাযথভাবে প্রবেশনের শর্ত পালন কারেছে কিনা তা দেখা।
গ) সমাজকল্যাণ বিভাগের ডাইরেক্টরের নিকট অপরাধীর আচরণ সম্পর্কে প্রতিবেদন পেশ করা।
ঘ) অপরাধীকে প্রয়োজনীয় উপদেশ, সাহায্য এবং প্রয়োজনে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
ঙ) আলোচ্য আইনের বিধান অনুযায়ী অর্পিত অন্যান্য যেকোন দায়িত্ব পালন।
ধারা ১৪। বিধি প্রণয়ন
আলোচ্য আইনের বাস্তব প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় বিধি মালা প্রণয়নের যেমন প্রবেশন অফিসার যোগ্যতা, নিয়োগ, প্রত্যাহার, দায়িত্ব প্রভৃতি সম্পর্কে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা সরকারের ওপর অর্পণ করা হয়েছে।
পৃষ্ঠা ২২৪
প্রবেশন অব অফেন্ডার্স এর আইনের বাস্তব প্রয়োগ
প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৬০-এর সংশোধনী হলো ‘‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স (বাংলাদেশ এমেন্ডম্যান্ট) ১৯৬৪ এ্যাক্ট।’’ অপরাধ নিরোধের জন্য শাস্তির চাইতে সংশোধনমূলক কার্যক্রম অধিক কার্যকরী ও ফলপ্রসূ’’ এ দর্শনের ওপর ভিত্তি করে এ আইনটি জারি করা হয়। এটি একটি সংশোধনমূলক সামাজিক আইন। এ আইনের বিধান অনুযায়ী কিশোর অপরাধ বা প্রথমবারের মত অপরাধ করেছে বা আইনের দৃষ্টিতে যাদের অপরাধের কোন পূর্ব রেকর্ড নেই ও যাদের শাস্তি দু’বছরের অধিক হবার যোগ্য নয়, তাঁদের দৈহিক ও মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে শাস্তি স্থগিত রেখে প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে সংশোধনের জন্য শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দানের ব্যবস্থা রাখা হয়। ১৯৬২ সাল হতে বাংলাদেশে আলোচ্য আইনের আওতায় প্রবেশন কার্যক্রম শুরু করা হয়। ১৯৬৯ সাল হতে কিশোর অপরাধীদের ক্ষেত্রে আলোচ্য আইনটি প্রযোজ্য ছিল। তবে ১৯৭৪ সালের শিশু আইন প্রণয়নের পর কিশোর অপরাধীদের জন্য পৃথক সংশোধনের ব্যবস্থা করা হয়।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে বংলাদেশে ২২টি ইউনিটে উক্ত আইনের বিধান অনুযায়ী প্রবেশন এবং আফটার কেয়ার সার্ভিস কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। এছাড়া দেশে ৪০০টি উপজেলায় প্রবেশন ও আফটার কেয়ার সার্ভিস বাস্তবায়নে থানা সমাজসেবা অফিসারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।







[5]     প্রবেশন এ্যাক্ট পুনর্বাসন কার্যাবলীঃ সমাজসেবা অধিদপ্তর, ১৯৮৯।

View Foundation Digital Talking Library is developed and maintained by Sigma Enterprise.
Theme designed by Imtiaz
All rights are reserved. Any kind of reproduction of any mp3 files and text files is prohibited. If any organization or any person is found copying or reproducing any of the material will be punished under copy right law.