পৃষ্ঠা ১৯১
চতুর্থ অধ্যায়
বাংলাদেশে বেসরকারি সমাজসেবা কার্যক্রম

বিশ্বায়নের যুগে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বেসরকারি সংস্থাগুলো বিশেষ কার্যকর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কর্মরত রয়েছে। ২০১০ এর প্রাপ্ত সরকারি তথ্যানুযায়ী সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমাজসেবা অধিদপ্তরে ৫৫ হাজার ৯৪৫টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিবন্ধন করা হয়। এনজিও বিষয়ক ব্যুরোতে বিদেশী তহবিলপুষ্ট নিবন্ধিকৃত এনজিও-র সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে নিবন্ধিত সেচ্ছাসেবী সংস্থার সংখ্যা ১৫ হাজার ৩৯৮টি। যৌথ মূলধনী কোম্পানী ও ফার্মসমূহ নিবন্ধন অধিদপ্তরে নিবন্ধিত এনজিও-র সংখ্যা ৯৭১০টি। ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার অধীন এনজিও-র সংখ্যা ১৩৮০টি।[1]
বাংলাদেশের সব জেলা এবং উপজেলা এনজিও কার্যক্রমের পরিধিভুক্ত। এনজিওগুলো বিশেষ করে উন্নয়ন এনজিওগুলো বহুমাত্রিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ সংস্থা
স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ এবং বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্রত্যয় দু’টি অভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে উভয়ের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য বিদ্যমান। সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী, ‘‘স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হলো এমন সব সংগঠন, যেগুলোর তহবিল বেসরকারি উৎস হতে সংগৃহীত এবং লক্ষ্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে অনগ্রসর শ্রেণীকে স্বাস্থ্য ও সমাজসেবাসহ অন্যান্য সেবা প্রদান। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহের প্রবণতা হলো নির্দিষ্ট চাহিদা ও সেবা প্রদানের বিশেষায়ন।’’ সেবা প্রদানের বিশেষ ক্ষেত্রসমূহের মধ্যে রয়েছে-স্বাস্থ্য ও হাসপাতাল সেবা (যেমন-বাংলাদেশ বহুমূত্র সমিতি, বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি, বাংলাদেশ যক্ষ্মা সমিতি।) বিশেষ দল বা শ্রেণীকে সাহায্য করা (যেমন প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, এতিমখানা)। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মূল লক্ষ্য হলো, সরকারি এজেন্সীর পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে মানবিক সেবা প্রদান।
স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ হচ্ছে জনগণের স্ব-ইচ্ছায় পরিচালিত স্বতঃস্ফূর্ত সমাজসেবা কার্যাবলির সমষ্টি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে সমাজের অনগ্রসর শ্রেণীর কল্যাণে সমাজসেবা কার্যাবলি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে গড়ে ওঠা সংস্থা স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ সংগঠন নামে পরিচিত।
১৯৬১ সালে প্রণীত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিবন্ধীকরণ এবং নিয়ন্ত্রণ আইনে স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ সংগঠনের কার্যকরী সংজ্ঞায় বলা হয়েছে
‘‘কোন সমাজসেবা বা কল্যাণমূলক কাজ করার লক্ষ্যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমূহের স্বাধীন ও স্বেচ্ছা প্রণোদিত ইচ্ছায় গঠিত সংগঠন, সমিতি বা কর্মকান্ডকেই স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ বলা হয়। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত দান, চাঁদা এবং সরকারি অনুদান হচ্ছে স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ সংস্থার আয়ের উৎস’’। যেমন-বাংলাদেশের বহুমূত্র সমিতি, বাংলাদেশের যক্ষ্মা নিরোধ সমিতি।
বেসরকারি সংস্থা
বেসরকারি সংস্থা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অনুরূপ একটি প্রত্যয়। জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠিত অলাভজনক ও অমুনাফামুখী প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি সংস্থা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
বাংলাদেশে এনজিও কর্মতৎপরতার জন্য প্রচুর আইন, অধ্যাদেশ, বিধি রয়েছে। এসব বিধিবদ্ধ আইনের কোনটিতেই বেসরকারি সংস্থার প্রামাণ্য সংজ্ঞা নেই। প্রত্যয়টি গ্রেট বৃটেনসহ অন্যান্য কতিপয় ইংরেজি ভাষাভাষি দেশে ব্যবহৃত হয়। সংক্ষেপে বেসরকারি অমুনাফামুখী স্বেচ্ছাসেবী খাতকে বেসরকারি সংস্থা হিসেবে অভিহিত করা হয়। সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী, ‘‘বেসরকারি সংস্থা হলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং যেগুলো জনস্বার্থে সেবা প্রদান করে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ সামাজিক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত। আর্থিক লাভ বা অর্থলগ্নীকারীর পৃষ্ঠপোষকতায় লাভজনক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। এনজিও প্রত্যয়টি সাধারণত বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী অমুনাফামুখী সামাজিক সংস্থার জন্য সংরক্ষিত। মালিকানাধীন বা স্বত্বাধিকারী লাভজনক সামাজিক সংস্থা এনজিও প্রত্যয়ের বহির্ভূত।’’ এনজিও-র মতো অলাভজনক সামাজিক সংস্থাসমূহের সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট নীতি এবং প্রতিষ্ঠিত পরিচালনা বোর্ড থাকে। এসব সংস্থার আয়ের বিভিন্ন উৎস রয়েছে। জনগণের চাঁদা, দানশীল ব্যক্তিদের দান, ক্লায়েন্ট এর নিকট থেকে আদায়কৃত প্রত্যক্ষ চাঁদা, তৃতীয় পক্ষ এবং সরকারি অনুদান । বাংলাদেশে কর্মরত এনজিওদের মধ্যে ব্র্যাক, প্রশিকা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, বহুমূত্র সমিতি, রেডক্রিসেন্ট সমিতি, স্বনির্ভর বাংলাদেশ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বেসরকারি সাহায্য সংস্থার বৈশিষ্ট্যঃ এনজিওগুলোর উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো লক্ষ্যকেন্দ্রিক সেবা প্রদান। এনজিওগুলো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্যভুক্ত করে সেবাদানে নিয়োজিত।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর কার্যক্রম ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে কতিপয় বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন
১. বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর মূল ভিত্তি হলো ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসন এবং মানবিক দায়িত্ববোধ।
২. জনগণের স্বেচ্ছা দান, চাঁদা, সরকারি অনুদান, বিভিন্ন ট্রাস্ট এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর আর্থিক আনুকূল্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর আয়ের প্রধান উৎস।
পৃষ্ঠা ১৯২
৩. অমুনাফামুখী এবং মানবিক সেবা প্রদানের লক্ষ্যে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গঠিত হয়।
৪. প্রশাসনিক কাঠামো সরকারি সংস্থার মতো ততটা জটিল নয় বিধায় পরিবর্তিত অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
৫. দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের সরকারি প্রশাসনিক কাঠামোর বাইরে, সংশ্লিষ্ট আইনের আওতাধীন থেকে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করে।
৬. স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো টার্গেট নির্দিষ্ট করে, তাদের মধ্যে সাহায্য ও পুনর্বাসন কার্যাবলি পরিচালনা করে।
৭. দাতা সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা ট্রাস্টের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে বেতনভুক্ত কর্মী বাহিনীর মাধ্যমে, বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর সার্বিক কার্যাবলি পরিচালিত হয়।
৮. অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে কর্মরত বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য অনেকক্ষেত্রে নিজস্ব কেন্দ্রীয় সমন্বয় ব্যবস্থা গড়ে তুলে।
৯. স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহ প্রধানত নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে টার্গেট গ্রুপ হিসেবে গ্রহণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করে।
১০. স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ কাঠামো অপেক্ষাকৃত নমনীয় হওয়ায় নতুন উদ্যোগ ও কর্মসূচি পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করতে পারে।
বাংলদেশে রেড ক্রিসেন্ট সমিতি
রেডক্রসের পটভূমি
বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সমিতি সম্পর্কে আলোচনা করার প্রেক্ষাপট হিসেবে রেডক্রস প্রতিষ্ঠার পটভূমি আলোচনা করা প্রয়োজন। রেডক্রসের প্রতিষ্ঠাতা হলেন জীন হ্যানরী ডুনান্ট। ১৮৫৯ সালের ২৪ জুন উত্তর ইতালীর সলফ্যারিনো নামক গ্রামে ফ্রান্স ও অষ্ট্রিয়ার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হ্যানরী ডুনান্টকে রেডক্রস সমিতি প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা যোগায়। সলফ্যারিনো যুদ্ধের ভয়াবহ এবং বিভীষিকাময় স্মৃতি নিয়ে ১৯৬২ সালে ডুনান্ট একটি বই রচনা করে, বিশ্ব বিবেকের নিকট যুদ্ধাহত মানবতার সেবায় দুটি প্রসত্মাবনা উপস্থান করেন।
১. যুদ্ধের সময় আহত সৈন্যদের সেবার জন্য প্রতিটি দেশে সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নেতৃত্বে ও স্বেচ্ছাসেবকদের পরিচালনায় একটি ত্রাণ সংগঠন প্রতিষ্ঠা।
২. যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈন্য ও তাদের সেবায় নিয়োজিত কর্মীদের স্বীকৃতি ও নিরাপত্তার জন্য আমত্মর্জাতিক চুক্তির উদ্যোগ গ্রহণ।
এই প্রসত্মাবনা বাসত্মবায়নে এগিয়ে আসার জন্য ডুনান্ট ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের আহবান জানান। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে অবস্থিত পাবলিক ওয়েল ফেয়ার সোসাইট তাঁর ডাকে সাড়া দেন। ১৮৬৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী হেনরী ডুনান্ট পাঁচজন বিশিষ্ট জেনেভাবাসীকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন; যা কমিটি অব ফাইভ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্যা রেড ক্রস এ পরিণত হয়। ১৮৬৩ সালের ২৬ অক্টোবর ১৬টি দেশের এবং চারটি জনহিতকর সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে জেনেভায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জেনেভা সম্মেলনে বিশ্বব্যাপী আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত আন্তর্জাতিক রেডক্রসের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
রেডক্রসের মৌলিক নীতি
ভিয়েনায় ১৯৬৫ সালে অনুষ্ঠিত রেডক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট এর ২০তম আমত্মর্জাতিক সম্মেলনে সাতটি মৌলিক নীতি গৃহীত হয়। তখন হতে আন্তর্জাতিক রেডক্রস সমিতি প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট দুর্যোগের শিকার দুর্গত মানবতার সেবায় যে সব নীতিসমূহ অনুসরণ করে সেগুলো হলো-
১. মানবতা : কোনরূপ বৈষম্য ছাড়া সবক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় মানব সেবায় নিয়োজিত থাকা।
২. একতা : কোন দেশে শুধু একটি রেডক্রস বা রেড ক্রিসেন্ট থাকবে। সবার জন্য সেবার দ্বার উন্মুক্ত থাকবে।
৩. স্বাধীনতা : মানব সেবায় সরকারের সহায়ক হিসেবে দেশের আইনের আওতায় স্বাধীনভাবে কাজ করবে।
৪. নিরপেক্ষতা : সকলের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে কোন পক্ষ অবলম্বন না করে কাজ করবে।
৫. সর্বজনীনতা : এটি বিশ্বব্যাপী একটি সর্বজনীন আন্দোলন।
৬. স্বেচ্ছামূলক : স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হিসেবে এটি স্বার্থ বা লাভ অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে না।
৭. পক্ষপাতহীনতা : জাতি, গোত্র, ধর্মীয় বিশ্বাস, শ্রেণী বা রাজনৈতিক মতবাদের মধ্যে এ আন্দোলন কোন বৈষম্য করে না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর দুর্গত মানুষের সেবায় রেডক্রস সমিতি নিয়োজিত।
রেড ক্রিসেন্ট সমিতির জন্ম
রেডক্রিসেন্টের জন্ম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুর্কী সুলতান খ্রিস্টানদের প্রতি বিরোধিতার প্রশ্নে রেডক্রসের পরিবর্তে রেডক্রিসেন্ট নাম ব্যবহার করতে থাকেন। রেডক্রিসেন্ট মূলত খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের বৈরীতায় সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে মুসলিম দেশগুলো রেডক্রসের
পৃষ্ঠা ১৯৩
পরিবর্তে রেডক্রিসেন্ট নাম ব্যবহার করতে থাকে। এ নিয়ে তখনই বিতর্ক উঠেছেল যে রেড ক্রিসেন্ট শব্দটিও যথাযথ নয়। কারণ চাঁদ কখনো লাল হয় না।
বর্তমানে মুসলিম দেশগুলোর বেশির ভাগই রেডক্রসের পরিবর্তে রেডক্রিসেন্ট নাম ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সমিতির পটভূমিঃ ১৯৪৯ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান রেডক্রস সমিতি গঠিত হয় এবং সাবেক পূর্ব-পাকিস্তানে এর প্রাদেশিক শাখা গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সাবেক পূর্ব-পাকিস্তান রেডক্রস সমিতিকে ‘‘বাংলাদেশ জাতীয় রেডক্রস সমিতিতে’’ পরিণত করা হয়। ১৯৭১ সালে ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদনের জন্য আবেদন জানানো হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি সরকারি আদেশ বলে বাংলাদেশ জাতীয় রেডক্রস সমিতি গঠিত হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ১৯৭৩ সালের ৩১ মার্চ বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটি আদেশ জারি করেন। ১৯৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটি ‘আমত্মর্জাতিক কমিটি অব রেডক্রস’ এর স্বীকৃতি এবং লীগ অব রেডক্রস সোসাইটিজের পূর্ণাঙ্গ সদস্য পদ লাভ করে।
বাংলাদেশ সরকার ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করার পর ১৯৮৮ সালের ৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ বলে বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির নাম পরিবর্তন করে ‘‘বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি’’ রাখা হয়। তবে এখনও এটি আন্তর্জাতিক রেডক্রসের সদস্য হিসেবেই কাজ করছে। তখন রেডক্রসের নাম পরিবর্তন করে রেডক্রিসেন্ট রাখার ফলে আন্তর্জাতিক সাহায্যের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কায় তখন দেশের বুদ্ধিজীবি মহলের অনেকেই এ নাম পরিবর্তনের বিরোধিতা করে মত পোষণ করেছিলেন।
বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সমিতির সাংগঠনিক কাঠামো
জেলা পর্যায়ে গঠিত রেডক্রিসেন্ট সমিতিগুলোর সমন্বয়ে জাতীয় রেডক্রিসেন্ট সমিতি গঠিত। রেডক্রিসেন্ট সমিতির একটি সাধারণ পরিষদ এবং একটি কার্যনির্বাহী ব্যবস্থাপনা পরিষদ রয়েছে। সাধারণ পরিষদ হচ্ছে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পরিষদ। এর কাজ হলো নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়ন এবং কার্যনির্বাহী ব্যবস্থাপনা পর্ষদ সেগুলো বাস্তবায়নে নিয়োজিত। এছাড়া প্রত্যেকটি জেলায় একটি করে ইউনিট এবং সচিবালয় রয়েছে।
প্রেসিডেন্টঃ গণপ্রজতন্ত্রী বাংলাদেশে সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতি পদাধিকার বলে বাংলাদেশে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রেসিডেন্ট।
চেয়ারম্যানঃ সোসাইটির প্রেসিডেন্ট তিন বছর মেয়াদের জন্য বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান পরপর দুটি মেয়াদের জন্য নিযুক্ত হতে পারেন।
ইউনিটঃ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী খুলনাসহ ৪টি সিটি কর্পোরেশন এলাকা এবং দেশের ৬৪টি জেলায় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ১টি করে মোট ৬৮টি রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটি রয়েছে। সোসাইটির প্রতিটি ইউনিটে ৩ বছর মেয়াদী ১১ সদস্য বিশিষ্ট ইউনিট নির্বাহী কমিটি রয়েছে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালতি হয়।
ইউনিট নির্বাহী কমিটিতে ১ জন চেয়ারম্যান, ১ জন ভাইস চেয়ারম্যান, ১ জন সেক্রেটারি এবং ৮ জন সদস্য রয়েছে। জেলার ক্ষেত্রে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং সিটি কর্পোরেশনের ক্ষেত্রে মেয়র পদাধিকার বলে ইউনিট নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান।
জেনারেল বডিঃ বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম হচ্ছে সোসাইটির জেনারেল বডি। প্রতিটি ইউনিট নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মধ্যে হতে মনোনীত ২ জন প্রতিনিধি, সোসাইটির চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, ট্রেজারার, ব্যবস্থাপনা বোর্ডের ১২ জন সদস্য এবং সরকারের ৪টি মন্ত্রণালয় যথা- প্রতিরক্ষা, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা , স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ এবং সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ১ জন করে মোট ৪টি মন্ত্রণালয়ের ১ জন করে মোট ৪ জন প্রতিনিধিসহ মোট ১৪১ জন সদস্য সমন্বয়ে সোসাইটির জেনারেল বডি গঠিত।
ব্যবস্থাপনা বোর্ডঃ সোসাইটির চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়াম্যানম ট্রেজারার ও ১২ জন সদস্য সমন্বয়ে ব্যবস্থাপনা বোর্ড ৩ বছর মেয়েদের জন্য গঠিত। জেনারেল বডির নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে সোসাইটির প্রসাশন বিষয়ক সকল নীতি নির্ধারণী কার্যক্রম ব্যবস্থাপনা বোর্ডের ওপর ন্যস্ত।
সেক্রেটারিয়েটঃ দুর্যোগ ব্যবস্থপনা, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, স্বাস্থ্য বিভাগ, সেন্ট্রাল সাপোর্ট সার্ভিসেস এবং অর্থ ও হিসাব বিভাগ সমন্বয়ে গঠিত সেক্রেটারিয়েট সোসাইটির জাতীয় সদর দফতরে অবস্থিত। ব্যবস্থাপনা বোর্ড কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত সোসাইটির সেক্রেটারি জেনারেল সেক্রেটারিয়েটের প্রধান নির্বাহী।
রেডক্রিসেন্ট সমিতির অর্থের উৎস
বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সমিতির অর্থের উৎস হচ্ছে, সদস্য সংগ্রহ চাঁদা, সদস্য চাঁদা, লীগ অব রেডক্রসের সাহায্য, আন্তর্জাতিক সাহায্য, বিভিন্ন দেশের জাতীয় রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট প্রদত্ত সাহায্য, লটারী, সরকারি অনুদান ইত্যাদি।
বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির লক্ষ্য
বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির লক্ষ্যসমূহ হলো-
১.বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর আহত ও অসুস্থ সৈন্যদের সেবা-শুশ্রূষা করা;
২.সকল জাতির মধ্যে শান্তি স্থাপন ও তা বজায় রাখা;
পৃষ্ঠা ১৯৪
৩.মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য ত্রাণসামগ্রী বিতরণ এবং অবস্থার উন্নতি করা;
৪.স্বাস্থ্যের উন্নতি, রোগ প্রতিরোধ ও উপশমের ব্যবস্থা করা;
৫.নার্সিং ও প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা;
৬.মাতৃ এবং শিশুমঙ্গল কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করা;
৭.দেশের যুব সমাজকে সুসংগঠিত করা;
৮.এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস পরিচালনা করা;
৯.রোগীদের কল্যাণে হাসপাতালে নিত্য ব্যবহার্য ও উপহার সামগ্রী সরবরাহ করা;
১০.আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট আন্দোলনে প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহায়তা করা;
১১.সোসাইটি অনুমোদিত অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কার্যাবলী বাস্তবায়ন।
রেড ক্রিসেন্ট সমিতির কার্যক্রম
বাংলাদেশে কর্মরত স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলোর মধ্যে রেডক্রিসেন্ট সমিতি অন্যতম। যুদ্ধ বিধ্বস্ত এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ জর্জরিত বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও দুঃস্থ মানবতার সেবায় রেডক্রিসেন্ট গতিশীল ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস এ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ এর সহায়তায় বাংলাদেশে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
সোসাইটির ৫টি বিভাগের আওতাধীন অধিদপ্তর ও কার্যক্রমসমূহঃ বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সমিতির ৫টি বিভাগের আওতাধীন বাস্তবায়িত কার্যক্রমগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো-
পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ
১. সাংগঠনিক উন্নয়ন বিভাগ
২. ইউনিট এ্যাফেয়ার্স অধিদপ্তর
৩. প্রশিক্ষণ অধিদপ্তর
৪. তহবিল সংগ্রহ অধিদপ্তর
৫. যুব ও সেচ্ছাসেবক অধিদপ্তর
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ
১. সমাজভিত্তিক দুর্যোগ ব্যবস্থপনা কর্মসূচি
২. ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি
৩. ত্রাণ ও পূর্ণবাসন অধিদপ্তর
৪. কমিউনিটি এ্যাম্পওয়ারমেন্ট প্রোগ্রাম
৫. অনুসন্ধান কার্যক্রম
স্বাস্থ্য বিভাগ
১. স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর
২. রক্ত কর্মসূচি
৩. এইচআইভি/ এইডস্ কর্মসূচি
৪. স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচি
সেন্ট্রাল সাপোর্ট সার্ভিসেস বিভাগ
১. মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা
২. প্রশাসন
৩. সম্পত্তি উন্নয়ন ও ব্যাবস্থাপনা
৪. তথ্য ও জনসংযোগ
৫. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
৬. লিগ্যাল এ্যাফেয়ার্স
অর্থবিভাগ
পৃষ্ঠা ১৯৫
১. হিসাব ও অর্থ
২. বাজেট নিয়ন্ত্রণ ও এমআইএস
৩. অভ্যন্তরীণ হিসাব নিকাশ
সোসাইটির প্রধান কার্মসূচি
সোসাইটির জাতীয় সদর দফতর এবং ৬৮টি ইউটিটের প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সাংগঠনিক উন্নয়ন কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় সোসাইটির জাতীয় সদর দফতরের সকল বিভাগ এবং ৬৮টি ইউনিটসমূহ তাদের নিজস্ব কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ন, কার্যক্রম বাস্তবায়ন, প্রতিবেদন প্রণয়ন, তদারকি ও মূল্যায়ন ইত্যাদি বিষয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
রক্ত কর্মসূচিঃ চিকিৎসার প্রয়োজনে রক্ত সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ১৯৮১ সাল থেকে রক্ত সংগ্রহ কর্মসূচি পরিচলানা করে আসছে। সোসাইটির ভ্রাম্যমাণ রক্ত সংগ্র ইউনিটের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে রেড ক্রিসেন্ট কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকগণ রক্ত সংগ্রহ করে থাকেন। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উন্নতমানের উপকরণাদি ব্যবহার করে রেড ক্রিসেন্ট পরিচালিত রক্তকেন্দ্র রক্ত সংরক্ষণ করা হয়। বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, সিলেট ও দিনাজপুরে ১টি করে মোট ৫টি রক্ত কেন্দ্র আছে।
তথ্য ও জনসংযোগ বিভাগঃ বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির তথ্য ও জনসংযোগ বিভাগ সোসাইটির বহুবিধ কার্যক্রমের বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি সম্পর্ক সাধারণ জনগণকে অবহিত করে থাকে। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমসমূহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ইতিবাচক ভাবমূতি সৃষ্টি করা এর মূল লক্ষ্য। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস উদযাপন, নিউজ বুলেটিন প্রকাশ ও প্রচার, সংবাদ সম্মেলন, জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ক্রোড় পত্র প্রকাশ, রেডিও, টেলিভিশনে ফিচার ফিল্ম প্রদর্শন ও বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে এই বিভাগ সোসাইটির বিভিন্ন কার্যক্রমের বিষয় জনসমক্ষে তুলে ধরছে।
ডিসেমিনেশন ও এসিস্টেন্স কর্মসূচিঃ আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি এর সহায়তায় পরিচালিত এই কর্মসূচির আওতায় রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের ইতিহাস, মূলনীতি, আদর্শ, প্রতীক ও মানবিক আইন বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দেয় হয়ে থাকে। রেড ক্রিসেন্ট প্রতীকের অপব্যবহার রোধ করার লক্ষ্যে ধারাবাহিক কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। এছাড়া এই কর্মসূচির উদ্যোগে ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও পার্বত্য জেলাসমূহ সংঘর্ষ বা দুর্যোগকালীন ক্ষতিগ্রস্তদের সেবা দেওয়ার জন্য স্বেচ্ছাসেবকরা কিভাবে নিরাপদে কাজ করতে পারে সে বিষয়ে তাদের সেফার একসেস ও ফাস্ট এইড প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এই কর্মসূচির আর একটি অংশ হচ্ছে মানবিক সাহায্য প্রদান একসেস । কো-অপারেশন কর্মসূচি আওতায় পরিচালিত এসিস্টেন্স কার্যক্রমের আংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুবিধাবঞ্চিত বিভিন্ন কমিউনিটিতে বিশুদ্ধে পানীয় জল সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
প্রশিক্ষণ বিভাগঃ সোসাইটির জাতীয় দফতরে ১৯৯৭ সালে প্রশিক্ষণ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিভাগ বিভিন্ন কর্মসূচি প্রকল্প কর্মরত স্টাফ-মেম্বার এবং সেচ্ছাসেবকদের বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে। এছাড়া প্রশিক্ষণ বিভাগগের পরিচালনায় ও তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ওয়ার্কশপ, সেমিনার আয়োজন করা হয়। বর্তমানে এই বিভাগের আওতায় প্রধান প্রথমিক চিকিৎসা, সমাজভিত্তিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষক-প্রশিক্ষণ কোর্স, অনুসন্ধান ও উদ্ধার, রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের মৌলিক বিষয়ে ওপর নিয়মিত প্রশিক্ষণ গ্রদান করে আসছে।
যুব রেড ক্রিসেন্ট কার্যক্রমঃ যুব রেড ক্রিসেন্ট সদস্যবৃন্দ বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সোসাইটির সকল স্তরে সর্বপ্রকার সেবামূলক কার্যক্রমে যুব রেড ক্রিসেন্ট স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ মূল চালিকা শক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে এবং স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রমের আদর্শকে সমুন্নত রেখে চলছে। যুব সদস্যবৃন্দ রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের আদর্শ উদ্দেশ্য ও মূলমন্ত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে আর্ত, দুস্থ ও বিপন্ন মানবতার সেবায় নিরলসভাবে কাজ করছে। বর্তমানে দেশব্যাপী যুব রেড ক্রিসেন্ট কার্যক্রমের আওতায় ৬৮টি ইউনিটের বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় পর্যায়ে ১,৬০,০০০ যুব রেড ক্রিসেন্ট সদস্য-সদস্যা স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, স্বেচ্ছায় রক্তদান ও অপরকে রক্তদানে অনুপ্রাণিত করা, প্রাথমিক চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচলনা এবং দুর্যোগ প্রস্ত্ততি ও মোকাবিলা কার্যক্রমহ দুর্যোগোত্তর ক্ষয়ক্ষতি ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম গুরুত্বপূণ ভূমিকা রাখছে। সোসাইটির যুব সদস্যদের মানব সেবায় দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের মৌলিক নীতিমালা ও প্রতীকের ব্যবহার সংরক্ষণ, মানবিক মূল্যাবোধ বিকাশ, আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রচার ও প্রসার, নেতৃত্ব উন্নয়ন , অনুসন্ধান ও উদ্ধার, প্রাথমিক চিকিৎসা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ নানাবিধ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
সামাজভিত্তিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচিঃ ‘‘দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস’’ সহায়তা প্রদানের জন্য দেশের প্রায় ১০টি জেলার অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ৮০টি কমিউনিটিতে অসহায় জনগোষ্ঠীর বিপদাপন্নতা লাঘবের নিমিত্তে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ২০০৫ সাল হতে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সম্ভাব্য
পৃষ্ঠা ১৯৬
দুর্যোগ প্রস্ত্ততির জন্য বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর সাদা প্রদানে সামর্থ্য বৃদ্ধি এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে সার্বিক সহায়তা প্রদানের বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনায় রেখে বর্তমান এ কার্যক্রম পরিচলানা হচ্ছে। দুর্যোগে কার্যকর সাড়া প্রদানের জন্য প্রকল্পভুক্ত ১০টি ইউটিটে সাড়াকার্যে দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে সমাজভিত্তিক দুর্যোগে ব্যবস্থাপনার ওপর মৌলিক প্রশিক্ষণ, সমাজভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ, গণসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম, দুর্যোগ ব্যবস্থপনায় স্থানীয় পর্যায়ে কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন, সহায়তা তহবিল গঠন, মানব সম্পদের উন্নয়ন, রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের ইতিহাস ও মূলনীতির প্রচার এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রসারসহ বিবিধ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
মানবিক মূল্যবোধঃ বর্তমান সংঘাতময় বিশ্ব পরিস্থিতিতে শান্তি বহুল প্রত্যাশিত একটি বিষয়। মানবিক মূল্যবোধের মাধ্যমে বৈষম্য পরিহার করে বিশ্বশান্তি স্থাপন করা সম্ভব। জন্মসুত্রে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ, আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ সমান মর্যাদা প্রাপ্তির অধিকার সংরক্ষণ করে। মানবিক অধিকার ও পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে মানুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি মানবিক মূল্যবোধ কর্মসূচি পরিচালনা করছে।
বিল্ডিং কমিউনিটি ডিজাষ্টার প্রিপেয়ার্ডনেস ক্যাপসিটি প্রজেক্টঃ বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ব্রিটিশ, জার্মান ও সুইডিশ রেড ক্রসের আর্থিক ও কৌশলগত সহায়তায় ‘বিল্ডিং কমিউনিটি ডিজাষ্টার প্রিপেয়ার্ডনেস ক্যাসাসিটি প্রজেক্ট নামে একটি নতুন প্রজেক্ট শুরু করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ঘূর্ণিঝড় প্রবণ নয়টি উপকূলীয় জেলায় ২০টি উপজেলায় এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
এই প্রকল্পের সামগ্রিক উদ্দেশ্য হচ্ছে উপকূলীয় এলকার জনগোষ্ঠীর বিশেষত নারী ও শিশুদের সামর্থ্য সৃষ্টির মাধ্যমে বিপদাপন্নতা হ্রাস করা এবং ঘূর্ণিঝড়প্রবণ নয়টি উপকূলীয় জেলার জনগোষ্ঠীকে ঘূণিঝড় প্রস্তুতিতে ব্যবস্থা গ্রহণে অধিকতর সক্ষম করে তোলা।
ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও সাড়া প্রদান কর্মসূচিঃ বাংলাদেশ সাম্প্রতিককালে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হওয়ায় সোসাইটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের আওতায় ভুমিকম্প প্রস্তুতি ও সাড়া প্রদান কর্মসূচি নামে একটি নতুন কার্যক্রম শুরু করেছে। কর্মসূচির লক্ষ্য হলো- ঢাকা সিটি, চট্টগ্রাম সিটি, সিলেট ও রংপুর ইউনিটের অন্তগর্ত ভূমিকম্পে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা। এম মধ্যে রয়েছে সর্বাধিক বিপদাপন্ন জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি, ভূমিকম্পজনিত ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসকল্পে প্রস্তুতি গ্রহণ সামর্থ্য বৃদ্ধি করা।
স্বাস্থ্য কার্যক্রমঃ বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি স্বাস্থ্যসেবাকে প্রাধান্য দিয়ে গ্রাম ও শহরভিত্তিক স্বাস্থ্যকার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ঢাকা শহরে অবস্থিত ৫১৫ শয্যা বিশিষ্ট হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঁচটি হাসপাতাল, পাঁচটি মাতৃসদন, ৬০টি গ্রামীণ মাতৃসদন কেন্দ্র, দু’টি চক্ষু ক্লিনিক, তিনটি বহির্বিভাগ ক্লিনিক, একটি মেডিকেল কলেজ, একটি নাসিং স্কুল এবং দু’টি ধাত্রী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-পরবর্তী জরুরি চিকিৎসা, ত্রাণ কার্যক্রম ও স্বাস্থ্য কর্মসূচির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ।
ঘূণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচিঃ বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী ঘূণিঝড়প্রবণ ঝুঁকিপূর্ণ ৭১০ কি.মি. প্রলম্বিত এলাকা জুড়ে বসবাসকারী সর্বাধিক বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীকে জীবনহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করার লক্ষ্যে প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম চালু আছে। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ১৯৭২ সাল থেকে ঘূণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি নামে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। এ কর্মসূচির আওতায় ১১টি উপকূলীয় জেলার ৩২টি উপজেলায় ২৭৪টি ইউনিয়নে ২,৮৪৫টি ইউনিটের আওতায় ২৮,৪৫০ জন পুরুষ ও ১৪,২২৫ জন মহিলাসহ মোট ৪২,৬৭৫ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছসেবক এবং ১৬০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন। উপকূলীয় জনসাধারণের মধ্যে ঘূণিঝড়ের আগাম সংকেত প্রচার, অপসারণ, উদ্ধার, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান এবং দূর্যোগোত্তর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপনসহ ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে প্রস্ত্ততিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাই এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য। সমগ্র উপকূলীয় এলাকা এবং উপকূল থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপসমূহে ঘূণিঝড়ের আগাম সংকেত প্রচারের জন্য এ কর্মসূচির মোট ১৩০টি এইচএফ/ভিএইএফ রেডিও সেট সম্বলিত একটি শক্তিশালী ওয়্যারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থা বিদ্যমান। ঘূণিঝড়ের সময় স্থানীয় জনগণের জরুরি আশ্রায়গ্রহণের জন্য সমগ্র উপকূল অঞ্চলে বিশেষভাবে তৈরি সোসাইটির ১৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে।