পৃষ্ঠা ৭৬
তৃতীয় অধ্যায়
সমাজ ও বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান

সমাজ |
ভূমিকা
সামাজিক বিজ্ঞানগুলোর মূল আলোচ্য বিষয় হলো সমাজ। সমাজের বিভিন্ন উপাদানকে কেন্দ্র করে সামাজিক বিজ্ঞানগুলো গড়ে উঠেছে। কিন্তু সমাজের সংজ্ঞা নিরূপণ ও স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সামাজিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতনৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে সমাজের এককভাবে কোন সংজ্ঞাই সর্বজনীন স্বীকৃতি পায়নি। সমাজের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও প্রথা-প্রতিষ্ঠানের বিভিন্নতার প্রেক্ষাপটে সমাজকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে, তাই সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্নভাবে সমাজের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
সমাজের সংজ্ঞা
ইংরেজি সোসাইটি পরিভাষাটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ সোসিয়াস থেকে। আর সোসিয়াস শব্দের অর্থ বন্ধুত্ব বা সঙ্গী (ফ্রেন্ডশিপ বা কম্পেনিয়নশিপ)। আবার কম্পেনিয়নশিপ এর অর্থ হলো বন্ধুসুলভ, সঙ্গপ্রিয় বা বন্ধুভাবাপন্ন, যা নির্দেশ করছে মানুষ সবসময় অন্যের সঙ্গে বসবাস করছে। সে কখনো একা বাস করতে পারেনা। বহুশত বছর পূর্বে দার্শনিক এরিষ্টটল বলেছেন, ‘মানুষ সামাজিক জীব’।
সাধারণ অর্থে সমাজ হলো অভিন্ন উদ্দেশ্য প্রণোদিত এমন একদল লোকের সমাবেশ, যারা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে অভিন্ন উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করে।
সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার সমাজের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সামাজিক সম্পর্কের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে, ‘‘যে সব সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমে আমরা জীবন ধারণ করি, সেসব সম্পর্কের সংগঠিত রূপ হলো সমাজ।’’
অপর এক সংজ্ঞায় ম্যাকাইভার এবং পেজ বলেছেন, ‘‘সমাজ হলো মানুষের আচার ও কার্যপ্রণালী, কর্তৃত্ব ও পারস্পরিক সাহায্য, বিভিন্ন সংঘ ও বিভাগ, মানব আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতা- এসব কিছুর সমন্বয়ে গঠিত সদা পরিবর্তনশীল একটি জটিল ব্যবস্থা। সমাজ সদা পরিবর্তনশীল সামাজিক সম্পর্কের একটি প্রবহমাণ ধারা’’।
আলোচ্য সংজ্ঞায় সমাজের ভূমিকা সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে সমাজ একটি প্রথা ও প্রণালীর সমষ্টি, যা মানুষের ওপর কর্তৃত্ব আরোপ ও পারস্পরিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করে। সমাজ যেমন সংগঠন তৈরি করে, তেমনি বিভিন্ন বিভাগও সৃষ্টি করে। সমাজ একদিকে মানুষের ব্যবহারের নিয়ন্ত্রক, অন্যদিকে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ।
সমাজবিজ্ঞানী ল্যাপিয়ার এর মতে, সমাজ বলতে একদল লোকের সমষ্টিকে নির্দেশ করে না, বরং মানুষের পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার আদর্শের জটিল ধরনকে বুঝায়; যা মানুষের নিজেদের এবং অন্যান্যদের মধ্যে ঘটে থাকে।
সমাজবিজ্ঞানী গিডিংস এর মতে, ‘‘সমাজ হলো সম-মনোভাবাপন্ন এমন একদল লোকের সমাবেশ, যার সদস্যরা তাদের অভিন্ন মানসিকতা সম্পর্কে জানে এবং সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করে।’’ সমাজবিজ্ঞানী জিসবার্ট প্রদত্ত সংজ্ঞানুযায়ী, ‘‘সমাজ হলো সামাজিক সম্পর্কের জটিল জাল, যে সম্পর্কের দ্বারা প্রত্যেক মানুষ তার সঙ্গীদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।’’
সমাজ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীদের প্রদত্ত সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে বাইরের দিক হতে পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও সমাজ বলতে কোন বিজ্ঞানী পৃথক ব্যবস্থার কথা বলেননি। বরং একই ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা এবং গুরুত্ব আরোপের পরিপ্রেক্ষিতেই তাদের সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে পার্থক্য দেখা দিয়েছে। সমাজ সম্পর্কিত সংজ্ঞাগুলোকে দু’টি দিক হতে আলোচনা করা যায়।
প্রথমতঃ মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে যে সম্বন্ধ-জাল সৃষ্টি হয়, তাকে সমাজ বলা হয়। সমাজস্থ মানুষের পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্কের ধরন বিশ্লেষণ করলে সমাজের প্রকৃতি স্পষ্ট হয়ে উঠে।
পৃষ্ঠা ৭৭
দ্বিতীয়তঃ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত আচার-ব্যবস্থা ও প্রথার সমন্বয়ে যে সুসংঘবদ্ধ কাঠামো গড়ে উঠে, তাকে সমাজ বলা হয়। মানুষের প্রতিষ্ঠিত আচার-ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করলেই সমাজের প্রকৃতি ও স্বরূপ সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায়।
পরিশেষে বলা যায়, সমাজ সম্পর্কে স্থির সংজ্ঞায় সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কারণ সমাজ একটি বিমূর্ত ধারণা, যাকে ধরা ছোঁয়া যায় না; শুধু অনুভব করা যায়। এটি একটি অবিচ্ছিন্ন প্রবাহের মত। এর কোন স্থির ধ্রুব রূপ নেই। সমাজ জীবন প্রবাহের একটি কালক্রম। জীববিজ্ঞানের মৌল বিষয় জীবন এর সংজ্ঞা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে প্রদানের চেষ্টা করা হলেও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি।
সমাজের বৈশিষ্ট্য
সমাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন সংজ্ঞা এবং সমাজের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কিত মনীষীদের অভিমত বিশ্লেষণ করলে সমাজের একাধিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। নিচে সমাজের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো-
১. সাধারণ স্বার্থ প্রণোদিত একাধিক লোকের সমাবেশ : সমাজ গঠনের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সাধারণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে বহু লোকের সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করা। অভিন্ন সাধারণ উদ্দেশ্য পূরণকে কেন্দ্র করে যখন মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সংঘটিত হয়, তখনই তাদের মধ্যে গড়ে উঠে পারস্পরিক সম্পর্ক। আর পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ জনগোষ্ঠীই হলো সমাজ। সমাজবিজ্ঞানী বুশী বলেছেন, ‘‘কতক লক্ষ্য চরিতার্থে সংগঠিত জনসমষ্টিই সমাজ।’’ সংঘবদ্ধ মানুষ ব্যতীত সামাজিক সম্পর্ক, মিথষ্ক্রিয়া, গড়ে উঠতে পারে না।
২. পারস্পরিক সম্পর্ক, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং সচেতনতা : সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার সমাজকে “ওয়েব অফ সোস্যাল রিলিশনশিপ” বা পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্কের জাল বলে বর্ণনা করেছেন। উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে একাধিক লোকের সমাবেশ হলে তাকে সমাজ বলা যাবে না, লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও সচেতনতা থাকতে হবে। পারস্পরিক স্বীকৃতি ও সচেতনতা হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মূলভিত্তি। এজন্য সমাজকে ‘‘অনুভূতিক্ষম জীবের সমষ্টি’’ বলা হয়। সচেতনভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত মানব সমষ্টিই সমাজ। পারস্পরিক সচেতনতার ফলে মিথষ্ক্রিয়া সম্ভব হয়।
৩. সহযোগিতা ও ঐক্যবোধ : ঐক্যবোধ ও সহযোগিতার মনোভাব না থাকলে সামাজিক সম্বন্ধ গড়ে উঠতে পারে না। এ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার বলেছেন, ‘‘সমাজ অর্থ হচ্ছে সহযোগিতা। যুদ্ধ-বিগ্রহ সমাজ গঠনের প্রতিবন্ধক। যুদ্ধ অর্থ পারস্পরিক ধ্বংস। আর সমাজ পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সৃষ্ট’’ সুতরাং দেখা যায়, পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্য হচ্ছে সমাজ গঠনের মূলভিত্তি। উল্লেখ্য সহযোগিতা ও দ্বন্দ্বের সহাবস্থান সব সমাজেই রয়েছে। তবে সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ থাকায় বিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। যে সমাজে বিরোধ ও দ্বন্দ্ব ক্রমাগত চলতে থাকে, সেখানে সামাজিক সম্পর্ক শিথিল হয়ে সমাজের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলে। সহযোগিতার জন্যই সমাজে শ্রমবিভাগ সম্ভব হয়েছে।
৪. স্থায়িত্ব : ক্ষণস্থায়ী জনসমষ্টিকে সমাজ বলা যায় না। যেমন-মুসলমানগণ হজ্ব পালনের সময় একই উদ্দেশ্যে একই স্থানে সমবেত হলেও তাদেরকে সমাজ বলা যায় না। একটি উল্লেখযোগ্য সময় পর্যন্ত স্থায়ী না হলে জনসমাবেশকে সমাজ বলে চিহ্নিত করা যায় না।
৫. পারস্পরিক নির্ভরতা : কোন মানুষই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। পারস্পরিক প্রয়োজন ও নিরাপত্তা লাভের ক্ষেত্রে মানুষ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। পারস্পরিক নির্ভরশীলতাই মানুষকে সমাজ গঠনে উদ্বুদ্ধ করেছে। পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে কেন্দ্র করে সমাজে সহযোগিতা ও শ্রমবিভাগ বলবত হয়।
৬. পরিবর্তন : সমাজ গতিশীল, স্থবিরতা সমাজ-বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থী। সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন পর্যায়ে সংগঠিত মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সমাজকে গতিশীলতা দান করে। তবে শৃঙ্খলাহীন গতিশীলতা সমাজ গঠনের পরিপন্থী। ম্যাকাইভার নিয়ত পরিবর্তনশীল সামাজিক সম্পর্কের জাল বলে সমাজকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
পৃষ্ঠা ৭৮
৭. গোষ্ঠী চেতনা : গিডিংস, ম্যাকাইভার এবং ডারউইনপন্থী সামাজিক বিজ্ঞানীরা গোষ্ঠী চেতনাকে সমাজের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করেছেন। গিডিংস-এর মতে, ‘‘সমাজের মূল সূত্র হলো স্বজাতি-চেতনা বা স্বজাত্যবোধ’’। কারণ গোষ্ঠী চেতনা ব্যতীত সামাজিক জীবন অসম্ভব। সমাজস্থ মানুষের মধ্যে যতদিন গোষ্ঠী চেতনা থাকবে, ততদিন সামাজিক ঐক্য বজায় থাকবে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে বৃহৎ মানব সমাজ গড়ে উঠলেও ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা-প্রতিষ্ঠানের দিক হতে প্রতিটি জনগোষ্ঠী স্বতন্ত্র। এরূপ স্বাতন্ত্রের মূল ধারক হচ্ছে গোষ্ঠী চেতনা ও ঐক্য।
৮. সমন্বিত যৌগিক ব্যবস্থা : সমাজবিজ্ঞানের জনক অগাষ্ট কোঁৎ সমাজকে একটি যৌগিক ব্যবস্থা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। সমাজের বিভিন্ন অংশ পরস্পর নির্ভরশীল এবং অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত হওয়ায় মানব সমাজ একটি অখন্ড সমন্বিত যৌগিক বস্ত্ততে পরিণত হয়েছে। সুতরাং সমাজের বিভিন্ন অংশকে পরস্পর সম্পর্কহীনভাবে আলোচনা করা যায় না। অখন্ড যৌগিক একক সত্তা হিসেবে গণ্য করা না হলে সমাজের সংহতি বজায় থাকে না।
৯. সুশৃঙ্খল ও সুনিয়ন্ত্রিত জীবন ব্যবস্থা : মানুষ নিজের প্রয়োজনেই সমাজ সৃষ্টি করেছে। আবার সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বিধান প্রণয়ন করেছে। তাই সমাজস্থ মানুষ তার ইচ্ছা ও মর্জি মোতাবেক আচার-আচরণ করতে পারে না। বিভিন্ন সামাজিক রীতি-নীতি, বিধি-বিধান, আইন-কানুন, আদর্শ, মূল্যবোধ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক সংহতি ও ঐক্য বজায় রেখে সমাজকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করে।
১০. সামাজিক প্রতিষ্ঠান : মানুষের বহুমুখী চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে সমাজের সৃষ্টি। এসব চাহিদা পূরণের জন্য গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সামাজিক প্রথা-প্রতিষ্ঠান। এসব প্রথা-প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই সমাজ টিকে থাকে। সমাজের স্থায়িত্ব এগুলোর ওপর নির্ভরশীল। প্রতিষ্ঠিত আচার-ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করলে সমাজের প্রকৃতি ও স্বরূপ সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায়।
১১. সাদৃশ্য বা অভিন্নতা : সমাজের অপরিহার্য উপাদান হলো সাদৃশ্যতা নীতি। মানুষের চাহিদা, প্রয়োজন, কর্ম, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, আদর্শ, মূল্যবোধ, জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদির মধ্যে সাদৃশ্য বা অভিন্নতা ছাড়া সমাজ গঠিত হয় না। অভিন্ন কতগুলো সাধারণ লক্ষ্য ও বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে সমাজ।
১২. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ : সমাজের নিজস্ব উপায় ও মাধ্যম রয়েছে, যেগুলো দ্বারা সমাজ তার সদস্যদের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। সমাজে বিরাজমান প্রতিযোগিতা, দ্বন্দ্ব, চাপ, উত্তেজনা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের জন্য সমাজে বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকে। নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কার্যকারিতার ওপর সমাজের অস্তিত্ব নির্ভর করে।
১৩. সংস্কৃতি : প্রত্যেক সমাজ একটি অন্যটি থেকে স্বতন্ত্র। প্রত্যেকটি সমাজ অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারি। কারণ সব সমাজের নিজস্ব জীবনধারা রয়েছে, যেটি সংস্কৃতি নামে পরিচিত। সামগ্রিক জীবন প্রণালীই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। সমাজবিজ্ঞানী লিনটন সংস্কৃতিকে “সোস্যাল হেরিট্যাজ অফ মেন” অর্থাৎ মানুষের সামাজিক ঐতিহ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। সমাজ ও সংস্কৃতি একত্রে চলে।
১৪. মানুষের সংঘবদ্ধতার সহজাত প্রবণতা : সমাজ গঠনের অন্যতম উপাদান হলো সংঘপ্রিয়তা এবং সংঘবদ্ধ জীবনযাপনের সহজাত প্রবণতা। মনোবিজ্ঞানীরা মানুষের মৌলিক সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে সংঘবদ্ধ জীবনযাপনের প্রবণতাকে চিহ্নিত করেছেন। তারা একে সহজাত প্রবণতা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
পরিশেষে বলা যায়, ক্রমবিবর্তনের ফলে সমাজকাঠামো ক্রমান্বয়ে জটিল হওয়ায় সামাজিক সংহতি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন আচার-ব্যবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
মানব জীবনে সমাজের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
মানুষ সামাজিক জীব। জন্মগতভাবে মানুষ সংঙ্গপ্রিয়। সে নিঃসঙ্গ অবস্থায় থাকতে পারে না। সহজাত প্রবৃত্তির তাড়না এবং বহুমুখী প্রয়োজন পূরণের তাগিদে মানুষকে সামাজিক পরিবেশে বসবাস করতে হয়। মানব জীবনে সমাজের প্রয়োজনের সামগ্রিক দিক তুলে ধরেছেন ম্যাকাইভার এবং পেজ তাঁদের “সোসাইটি” গ্রন্থে। তাঁদের মতে, ‘‘মানুষ তার নিরাপত্তা, সুখ, পুষ্টি, শিক্ষা,
পৃষ্ঠা ৭৯
উপকরণ, সুযোগ-সুবিধা এবং সমাজের দেয়া বহুমুখী সেবাকার্যের জন্য সমাজের ওপর নির্ভরশীল। সমাজে মানুষের জন্মগ্রহণই সমাজের প্রয়োজনীয়তার কথা সূচিত করে।
মানব জীবনে সমাজের প্রয়োজনীয়তার বিশেষ দিকগুলো এপর্যায়ে আলোচনা করা হলো¾
১. সহজাত প্রবৃত্তি : প্রাণীজগতের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে মানুষ সবচেয়ে অসহায়। জন্মগত অসহায়ত্বের হাত হতে নিজেদের রক্ষা করার জন্য স্রষ্টা এককভাবে মানুষকে কোন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা দান করেননি, যেমন দান করেছেন অন্যান্য প্রাণীকে। সুতরাং পারস্পরিক সহযোগিতায় জন্মগত অসহায়ত্ব কাটিয়ে উঠার জন্য মানুষকে সামাজিক পরিবেশে বসবাস করতে হয়। মনোবিজ্ঞানী ম্যাকডোগ্যাল একে মানুষের সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের সহজাত প্রবণতা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
২. বহুমুখী প্রয়োজন পূরণ : বহুমুখী প্রয়োজন পূরণের তাগিদেই মানুষকে সমাজ গড়ে তুলতে এবং সামাজিক পরিবেশে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বসবাস করতে হয়। এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী অগাষ্ট কোঁৎ বলেছেন, ‘‘মানুষের প্রয়োজনের তাগিদেই সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে সমাজের সৃষ্টি হয়েছে।’’ পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে গঠিত সমাজবদ্ধ জীবন যাপনের মাধ্যমে মানুষ বহুমুখী চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের সুযোগ লাভ করে। নিঃসঙ্গ ও একাকী জীবন মানব চাহিদা পূরণের সম্পূর্ণ বিপরীত।
৩. অস্তিত্ব রক্ষা ও নিরাপত্তা বিধান : আদিকাল থেকে মানুষ বন্য জন্তুর আক্রমণ হতে নিজেদের রক্ষা এবং প্রকৃতির প্রতিকূল অবস্থাকে জয় করে নিজেদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের তাগিদে সমাজবদ্ধ জীবন-যাপনে বাধ্য হয়। সমাজবদ্ধ জীবনই মানুষকে প্রতিকুল প্রাকৃতিক অবস্থার মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সুযোগ দান করেছে।
৪. মানব সম্পদ বৃদ্ধি, উন্নয়ন ও সংরক্ষণ : সামাজিক জীবন-যাপনের মাধ্যমে মানুষ স্বীয় ক্ষমতা ও সামর্থ্য যথাযথভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। বিভিন্ন প্রথা-প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজ সম্পদ সৃষ্টি, উন্নয়ন এবং সংরক্ষণের সুযোগের মাধ্যমে উন্নত জীবন যাপনের ইতিবাচক পরিবেশ গড়ে তুলে। সমাজের বাইরে উন্নত ও আদর্শ জীবন-যাপন করা সম্ভব নয়।
৫. সামাজিকীকরণ : হৃদয় সর্বস্ব মানব শিশুকে সামাজিক জীব হিসেবে গড়ে উঠতে সামাজিক পরিবেশ হলো উপযুক্ত স্থান। মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেও সামাজিক পরিবেশের অভাবে তারা মানসিক গুণাবলি অর্জনে সক্ষম হয় না। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত ‘‘ফেরেল মানব’’ (যেসব শিশু আজন্ম সমাজের বাইরে, সম্পূর্ণ এককী নির্জন স্থানে বা ইতর প্রাণীর সাহচর্য্যে বড় হয়েছে, সেসব মানব শিশুকে “ফেরেল মানব” বলা হয়। রোম, সুইডেন, হল্যান্ড, ফ্রান্স, ভারত প্রভৃতি দেশে এ ধরনের একত্রিশটি শিশুর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এদের আচার-আচরণ সম্পূর্ণ ইতর প্রাণীর মতো ছিল।) -এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সামাজিক পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে বলেই মানব শিশু, নিজেকে বৃহত্তর সমাজে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারে।
৬. মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ : মানুষ সমাজ সৃষ্টি করলেও সামাজিক জীব হিসেবে সে যা ইচ্ছা তা করতে পারে না। সামাজিক প্রথা-প্রতিষ্ঠান, রীতি-নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধ মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে পারস্পরিক সহযোগিতায় ঐক্য ও শৃঙ্খলা বজায় রাখে। সামাজিক নিয়ম-কানুনই মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীবের সম্মানে ভূষিত করে।
৭. মৌল মানবিক বাসনার বিনিময় : স্নেহ, প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা, সহানুভূতি, প্রশংসা ইত্যাদি মৌল মানবিক অনুভূতি আদান-প্রদান মানুষের মৌলিক বাসনা। মানুষ সব সময় স্নেহ, ভালবাসা, সহানুভূতি, প্রশংসা ইত্যাদি পাবার কামনা করে। মানুষের এসব মৌলিক মানসিক বাসনার পরিতৃপ্তির উত্তম ক্ষেত্র হলো সমাজ। নিঃসঙ্গ একাকী জীবনের মাধ্যমে এসব কামনা চরিতার্থ করা আদৌ সম্ভব নয়। সামাজিক জীবনই এসব মানবিক অনুভূতিগুলো বিনিময়ের নিশ্চয়তা বিধান করে।
৮. আত্ম-মর্যাদার স্বীকৃতি : মানুষ মাত্রই তার পূর্ণ সত্তার বিকাশ চায়। প্রত্যেক মানুষই তার সুপ্ত প্রতিভা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের মাধ্যমে আত্মমর্যাদার স্বীকৃতি পেতে চায়। সামাজিক পরিবেশেই মানুষ স্বীয় প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে স্বমর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবার সুযোগ লাভ করে। সমাজ জীবনের বাইরে মানব মর্যাদার স্বীকৃতি মেলে না।
পৃষ্ঠা ৮০
৯. সমস্যার সমাধান : মানুষ এবং সমস্যার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। মানুষ থাকলে সমস্যাও থাকবে এবং সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টাও চলতে থাকবে। মানুষ আদিম যুগ হতে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় মানব জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে আসছে। পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতায় সমস্যা সমাধানের উপযুক্ত পরিবেশ হলো সমাজ।
১০. বংশ রক্ষা : বংশ বৃদ্ধি ও রক্ষা করা অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষেরও অন্যতম সহজাত প্রবৃত্তি। সমাজবদ্ধ জীবন-যাপনের মাধ্যমে মানুষ সন্তান জন্মদান ও লালন পালনের সুযোগ লাভ করে। বিবাহ ও পরিবারের মতো সামাজিক প্রতিষ্ঠান সন্তান জন্মদান ও তাদের নিরাপত্তা বিধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরিশেষে বলা যায়, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির সন্তুষ্টি, জীবনের নিরাপত্তা, উন্নত জীবন-যাপন, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশে সমাজের গুরুত্ব অপরিসীম। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার এবং পেজ যথার্থই বলেছেন, ‘‘সমাজে মানুষের জন্ম গ্রহণই মানবজীবনে সমাজের প্রয়োজনীয়তার পরিপূর্ণ পরিচয় বহন করে। স্বাভাবিক মানবিক জীবন-যাপনের জন্য সামাজিক সম্পর্ক থাকা অপরিহার্য।’’
বংশগতি ও পরিবেশের মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠে সামাজিক মানুষ। বংশগতি হলো মানব সত্তার ধারক, আর সামাজিক পরিবেশ হলো সুপ্ত মানব সত্তার বিকাশের ক্ষেত্র। মনীষী ফিক্টে যথার্থই বলেছেন, “মেন বিকাম্স মেন অনলি এমোং মেন” প্রত্যেক মানুষ সুপ্ত সম্ভাবনাগুলো সহজাতভাবে বংশ পরস্পরায় লাভ করে। আর সামাজিক পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়ে মানব প্রকৃতি গড়ে উঠে।
পৃষ্ঠা ৮১
সামাজিক প্রতিষ্ঠান |
ভূমিকা
সামাজিক বিজ্ঞানগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সমাজ গঠনের মূলে রয়েছে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত আচার-ব্যবস্থার সমন্বয়ে গঠিত সুসংঘবদ্ধ কাঠামোই হলো সমাজ। মানুষের প্রতিষ্ঠিত আচার-ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করলে সমাজের প্রকৃতি স্পষ্ট হয়ে উঠে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সমাজ জীবনের কার্যনির্বাহী অঙ্গ বা সমাজ জীবনের কর্মপদ্ধতির মাধ্যম।
সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞা
সাধারণ অর্থে প্রতিষ্ঠান বলতে সামাজিক সংঘকে বুঝানো হয়। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠান বলতে একটি কর্মপদ্ধতিকে বুঝানো হয়। সামাজিক প্রতিষ্ঠান হলো কতগুলো প্রতিষ্ঠিত আচার-আচরণ এবং কার্যপ্রণালী, যেগুলো সুসংগঠিতভাবে পরিচালিত হয়। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার এবং পেজ-এর মতে, ‘‘প্রতিষ্ঠান হলো সেসব প্রতিষ্ঠিত কর্মপদ্ধতি, যেগুলোর মাধ্যমে গোষ্ঠীর কার্যকলাপের বৈশিষ্ট্য সূচিত হয়।’’
ডেভিড জেরি এবং জুলিয়া জেরি সম্পাদিত কলিন্স সমাজবিজ্ঞান অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী, সামাজিক প্রতিষ্ঠান বলতে আদর্শ ও বিধিবিধান দ্বারা নির্দেশিত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সুব্যবস্থিত এবং সুবিন্যস্ত আচরণকে বুঝায়।
সমাজবিজ্ঞানী এইচ.ই. বার্নস এর মতে, ‘‘প্রতিষ্ঠান হলো সমাজকাঠামো এবং যন্ত্রস্বরূপ, যার মাধ্যমে মানব সমাজ সংগঠিত ও পরিচালিত হয় এবং প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপ সম্পাদন করা হয়।’’
অধ্যাপক সি.এ. এলউড এর মতে, ‘‘প্রতিষ্ঠান হলো মানুষের যৌথ জীবনযাত্রার এমন একটি পদ্ধতি, যাতে তারা অভ্যস্ত এবং যা সামাজিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা অনুমোদিত, ব্যবস্থিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’’
উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায়, সামাজিক প্রতিষ্ঠান হলো সমাজ অনুমোদিত কর্মপদ্ধতি, যার মাধ্যমে মানুষ তাদের বহুমুখী প্রয়োজন পূরণের জন্য নানাবিধ কার্যক্রম সংগঠিত, পরিচালিত এবং সম্পাদন করে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো উদ্দেশ্য সাধনের অনুমোদিত ও প্রতিষ্ঠিত কর্মপদ্ধতি। যেমন পরিবার একটি সংগঠন। পরিবারের উদ্দেশ্য সাধনের বিশেষ প্রতিষ্ঠান হলো বিবাহ রীতি, উত্তরাধিকার নীতি, গৃহপ্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। রাষ্ট্র একটি সংগঠন। আর এর অনুমোদিত কর্মপদ্ধতির মাধ্যম হলো, সরকার, সংবিধান, আইন পরিষদ। এগুলো হলো রাষ্ট্র নামক সংগঠনের প্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য
অনেক সময় প্রতিষ্ঠান এবং সমিতিকে এক অর্থে ব্যবহার করা হয়। মূলত প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক রূপ থাকলেও সমিতির সঙ্গে এর বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আলোচনা করলে সংগঠন বা সমিতির সঙ্গে এর পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো এখানে সঙক্ষেপে আলোচনা করা হলো¾
১. প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক : সমাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক। কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের সামাজিক অর্থাৎ সমষ্টিগত কার্যাবলী সম্পাদনের লক্ষ্যে গড়ে উঠে। সামাজিক সম্পর্কের ফল হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান।
২. সর্বজনীন : সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বজনীন ও সর্বব্যাপী। সমাজ গঠনের প্রথম হতে সকল পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। সকল সময়ে এবং সবস্থানে প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান থাকে। যেমন পরিবার, ধর্ম, সম্পদ ইত্যাদি আদিম সমাজ থেকে শুরু করে বর্তমান সমাজে বিদ্যমান আছে।
পৃষ্ঠা ৮২
৩. প্রতিষ্ঠান হলো মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের মাধ্যম : সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের বিভিন্ন মৌল চাহিদা যেমন- আত্মসংরক্ষণের চাহিদা, আত্মবিকাশের চাহিদা, আত্ম প্রকাশের চাহিদা ইত্যাদি পূরণের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এজন্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমাজের কার্যনির্বাহী অঙ্গ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
৪. সামাজিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার : সামাজিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণমূলক হাতিয়ার। ধর্ম, রাষ্ট্র, সরকার, আইন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান মানুষের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। সামাজিক শৃঙ্খলা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রেখে সমাজকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করে সামাজিক প্রতিষ্ঠান।
৫. অপেক্ষাকৃত স্থায়ী : সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত পরিবর্তন হয় না। মন্থর এবং পর্যায়ক্রমে পরিবর্তিত হয়। ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো সহজে পরিবর্তিত হয় না। তবে মানুষের প্রয়োজন, চাহিদা রুচি, জ্ঞান, ধ্যান-ধারণা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ফলে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পরিবর্তন ঘটে।
৬. প্রকৃতিগতভাবে বিমূর্তঃ সামাজিক প্রতিষ্ঠান, বাহ্যিক দৃশ্য বস্ত্ত নয়। এগুলো প্রকৃতিগতভাবে বিমূর্ত। বিবাহ, ধর্ম, আইন ইত্যাদি দৃশ্য বস্ত্ত নয়। এগুলোকে কেন্দ্র করে যেসব আচার আচরণ এবং অনুষ্ঠানাদি সম্পাদিত হয়, সেগুলো পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপযোগ্য। যেমন বিবাহ একটি প্রতিষ্ঠান, যা বিমূর্ত, কিন্তু বিবাহকে কেন্দ্র করে সম্পাদিত অনুষ্ঠানাদি পর্যবেক্ষণযোগ্য।
৭. প্রতিষ্ঠান হলো কার্যপ্রণালী : প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সমিতি বা সংগঠনের কার্যকরী অঙ্গ। প্রত্যেক সমিতি ও সংগঠনের এক বা একাধিক উদ্দেশ্য থাকে। প্রতিষ্ঠান হলো সে সব উদ্দেশ্য সাধনের সমাজ অনুমোদিত কর্মপদ্ধতি। গিসবার্ট বলেছেন, ‘‘সংঘ হলো বস্তু, প্রতিষ্ঠান হলো এর বিভিন্ন পদ্ধতি।’’। যেমন- পরিবার একটি সামাজিক সংঘ। এর লক্ষ্য হলো মানুষের জৈব প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ, প্রজননের মাধ্যমে মানব জাতির ধারাবাহিকতা রক্ষা, পিতৃত্ব অর্জন ইত্যাদি। পরিবারের এসব উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠিত আচার-আচরণ হলো বিবাহ, উত্তরাধিকার, গৃহ ইত্যাদি। এগুলো হলো পরিবার নামক সংঘের প্রতিষ্ঠান।
৮. প্রতিষ্ঠানের সদস্য হওয়া যায় না : প্রতিষ্ঠান কোন সংগঠিত সংঘ বা সমিতি নয় বলে এর সদস্য নেই। প্রতিষ্ঠান হলো সদস্যদের বা সংঘের নিয়ম-পদ্ধতি ও কার্যপ্রণালীর ধরন-প্রকৃতি। সংঘতে আমাদের জন্ম হয়, সেখানে আমরা প্রতিপালিত হই, কিন্তু আমরা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কাজ করি। যেমন- আমরা বিবাহ বা সরকার পদ্ধতির সদস্য না, বরং পরিবার বা রাষ্ট্রের সদস্য।
৯. প্রতিষ্ঠানগুলো পরস্পর নির্ভরশীল : প্রতিষ্ঠানগুলো দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো পরস্পর নির্ভরশীল ও সম্পর্কযুক্ত থেকে সামাজিক সংগঠনগুলোকে সচল এবং সক্রিয় রাখে। যেমন- বিবাহ পরিবারের ভিত্তি স্বরূপ। বিবাহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। আবার পরিবারের সদস্যরা জীবিকা নির্বাহের জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত হয়। যা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপ পরিবারের সদস্যরা যে গৃহে বাস করে তা রাষ্ট্র নামক সংঘের বিভিন্ন আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও সংরক্ষিত। এভাবে আন্তঃ-প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কের মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়।
১০. প্রতিষ্ঠানের কর্মভার হস্তান্তরিত হয় : এক প্রতিষ্ঠানের কর্মভার অন্য প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তরিত হতে পারে। যেমন- বর্তমানে পরিবারের বিভিন্ন কার্যাবলী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করছে। পারিবারিক শিক্ষার দায়িত্ব নার্সারীতে, শিশু লালন-পালনের দায়িত্ব দিবা যত্ন কেন্দ্রে হস্তান্তরিত হচ্ছে।
সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা
মানুষের বহূমুখী প্রয়োজন পূরণ, নিত্যকার কার্যাবলি সম্পাদন এবং মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সৃষ্ট বিধি-বিধান ও কার্যপ্রণালীর প্রতিষ্ঠিত রূপই হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সমাজের শৃঙ্খলা, সংহতি ও কার্যকারিতা সবকিছুর প্রধান নিয়ামক হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সামাজিক গড়নের মূলে রয়েছে সামাজিক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজ টিকে রয়েছে। সমাজ বিজ্ঞানী গিডিংস বলেছেন, ‘‘মানব সমাজের যা কিছু মহৎ ও কল্যাণকর তার সবই সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একযুগ হতে অন্যযুগে বর্তায়।’’
পৃষ্ঠা ৮৩
১. মানবিক প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণ : মানুষের বহুমুখী প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণের তাগিদেই সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব হয়েছে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু প্রয়োজন পূরণ করে না, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি সংরক্ষণ প্রভৃতি মৌলিক কার্যাবলি সম্পাদন করে। প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক সংঘ এবং সমিতি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়। মানুষের বহুমুখী চাহিদা পূরণের উপায় প্রদর্শন করে সামাজিক প্রতিষ্ঠান।
২. মানব আচরণ নিয়ন্ত্রণ : সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের আচার-আচরণ ও কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ মানুষের আচার-আচরণ প্রত্যক্ষভাবে এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পরোক্ষভাবে মানব আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। সমাজে কোনটি উচিত আর কোনটি অনুচিত সে সম্পর্কে সামাজিক প্রতিষ্ঠান নির্দেশ দেয়।
৩. সমাজিক পরিচিতি ও মর্যাদা দান : সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের সামাজিক পরিচিতি ও সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের সামাজিক ভূমিকা ও মর্যাদা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। সমাজ যত উন্নত হবে, ততই তার প্রতিষ্ঠান বিচিত্ররূপ ধারণ করবে। উন্নত সমাজের প্রতিটি দিক এক একটি সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আওতায় পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।
৪. সামাজিক ভূমিকা সহজীকরণ : সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানব আচরণের সমাজ অনুমোদিত উপায় নির্ধারণ করে। ফলে মানুষ সামাজিক প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত এবং সমাজ অনুমোদিত উপায়ে সহজে বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করতে পারে। কর্ম সম্পাদনের সহজ উপায় প্রদর্শনের মাধ্যমে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজ ব্যবস্থার শৃঙ্খলা এবং সংহতি বজায় রাখতে সহায়তা করে।
৫. সামাজিক ঐক্য ও সংহতি বজায় : সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং মিথষ্ক্রিয়ার ধরনগুলো বিধিবদ্ধ করে। মানুষ সামাজিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে কিভাবে মিথষ্ক্রিয়া করবে, তার বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো উপস্থাপন করে, যা সামাজিক ঐক্য ও সংহতি বজায়ের সহায়ক।
৬. সামাজিকীকরণ : প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানব শিশু বৃহত্তর সমাজের মূল্যবোধ, আদর্শ, বিধি বিধান, নিয়ম নীতি অনুসরণ করতে শেখে। প্রতিষ্ঠান সামাজিকীকরণের সুযোগ সৃষ্টি করে শিশুকে বৃহত্তর সমাজের উপযোগী করে গড়ে তুলে।
৭. সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ : সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুনির্দিষ্ট আদর্শ, মূল্যবোধ ও বিধিবিধান দ্বারা মানুষের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এতে সামাজিক সমস্যা সমাধান এবং নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।
পরিশেষে বলা যায়, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজদেহের কার্যনির্বাহী অঙ্গ। কার্যনির্বাহী অঙ্গ হিসাবে সামাজিক সংহতি, ঐক্য, শৃঙ্খলা ও উন্নতি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু ভূমিকা পালনের ওপর নির্ভরশীল। সমাজের উন্নতি, বিকাশ ও স্থায়িত্ব সবকিছুর মূলে রয়েছে সামাজিক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান ছাড়া সমাজ টিকে থাকতে পারে না।
কয়েকটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান
সমাজ একটি বৃহত্তর মানবগোষ্ঠী। বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর বহুমুখী চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের জন্য সমাজে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর লক্ষ্য হলো মানুষের চাহিদা পূরণ, সামাজিক জীব হিসেবে মানুষকে গড়ে তোলা, মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক সংহতি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা ইত্যাদি। নিচে প্রধান প্রধান সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংজ্ঞা, লক্ষ্য ও ভূমিকার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো।
বিবাহ |
বিবাহ হলো একটি সর্বজনীন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যার ভিত্তিতে পরিবারের মতো আদি সামাজিক সংগঠন গড়ে উঠে। সমাজের ক্ষুদ্র একক হলো পরিবার। আর বিবাহ হলো পরিবারের একটি প্রতিষ্ঠান। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানই পরিবারের স্থায়িত্ব এবং সামাজিক স্বীকৃতির ভিত্তি। মানুষের পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্কের প্রধান নিয়ামক হলো বিবাহ। বিবাহের নিরিখে মানুষের যাবতীয় সামাজিক সম্পর্ক নির্ধারিত হয়।
বিবাহের সংজ্ঞা
পৃষ্ঠা ৮৪
বিবাহের এমন কোন সংজ্ঞা নেই, যা দ্বারা মানব সমাজে সংঘটিত সবধরনের বিবাহের ব্যাখ্যা দেয়া যায়। বিবাহ হলো নারী-পুরুষের মধ্যে এমন এক চুক্তির সম্পর্ক, যার মাধ্যমে তারা স্বামী-স্ত্রীরূপে একত্রে যৌন সম্পর্ক স্থাপন এবং সন্তান উৎপাদন ও একই পরিবারে বসবাস করার সামাজিক, ধর্মীয় ও আইনগত স্বীকৃতি লাভ করে।
ডেভিড জেরি এবং জুলিয়া জেরি সম্পাদিত কলিন্স সমাজবিজ্ঞান অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী বিবাহ হলো সামাজিকভাবে স্বীকৃত এবং অনেক সময় বৈধ চুক্তির মাধ্যমে একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যেকার মিলন।
প্রখ্যাত নৃ-বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড ওয়েস্টারমার্ক বিবাহের সংজ্ঞায় বলেছেন, ‘‘বিবাহ হলো এক বা একাধিক পুরুষের সঙ্গে এক বা একাধিক নারীর এমন একটি সম্পর্ক, যা সামাজিক প্রথা বা আইনের দ্বারা অনুমোদিত এবং যা বিবাহিত মানুষগুলোর ও বিবাহের ফলে যেসব সন্তান জন্মগ্রহণ করবে তাদের জন্য কতগুলো নির্দিষ্ট কর্তব্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।’’
সমাজবিজ্ঞানী ম্যালিনোস্কীর মতে, ‘‘সামগ্রিকভাবে বিবাহ হলো যৌন মিলনের অনুমোদন দান অপেক্ষাও সন্তান জন্মদান এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণের একটি চুক্তির সম্পর্ক।’’
আইনগত দৃষ্টিকোণ হতে, ‘‘বিবাহ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, অনুষ্ঠান বা প্রণালী, যা দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর আইনসম্মত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।’’
বিবাহের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলো হলো-
ক. বিবাহ সামাজিক অনুমোদন ও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নারী-পুরুষের মধ্যকার একটি চুক্তির সম্পর্ক;
খ. বিবাহের মাধ্যমে স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক, সন্তানের সামাজিক পরিচিতি ও সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হয়;
গ. বিবাহ অর্থনৈতিক সম্পর্কিত কর্তব্য আরোপ করে;
ঘ. বিবাহ পবিত্র অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ধর্মীয় বাণী ও আচারের দ্বারা সম্পন্ন হয়;
ঙ. সামাজিক দিক হতে বিবাহের চরম উদ্দেশ্য হলো পরিবার গঠন, শুধু ইন্দ্রিয়ের চরিতার্থতা নয়;
চ. বিবাহের পদ্ধতি সমাজ ও ধর্মভেদে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে;
ছ. বিবাহ পারস্পারিক দায়িত্ব ও কর্তব্য আরোপ করে;
জ. নারী পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে বিবাহ;
ঝ. বিবাহ কমবেশি সর্বজনীন এবং সর্বব্যাপী সামাজিক প্রতিষ্ঠান।
বিবাহ কোন অর্থে প্রতিষ্ঠান এবং কোন অর্থে অনুষ্ঠান
পরিবার নামক সামাজিক সংগঠনের উদ্দেশ্য সাধনের অনুমোদিত ও প্রতিষ্ঠিত কর্মপদ্ধতি হিসেবে বিবাহ হলো প্রতিষ্ঠান। কারণ সমাজ অনুমোদিত কর্মপদ্ধতি হিসেবে বিবাহ ছাড়া পরিবার নামক সামাজিক সংগঠন গঠিত হয় না। এরূপ অর্থে বিবাহ হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান।
অন্যদিকে জৈবিক চাহিদা পূরণ, সন্তান জন্মদান ও লালন পালন, বংশ রক্ষা ইত্যাদি উদ্দেশ্য সাধনের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা হিসেবে পরিবার হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান আর পরিবার নামক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সমাজ স্বীকৃত অনুষ্ঠান হলো বিবাহ। কারণ আনুষ্ঠানিক বিবাহের মাধ্যমে সমাজ অনুমোদিত উপায়ে পরিবার গঠিত হয়।
সহজ কথায়, যখন বিবাহ দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর আইনসম্মত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বিবাহ হলো অনুষ্ঠান। আর পরিবার নামক সামাজিক সংগঠনের উদ্দেশ্য সাধনের অনুমোদিত ও প্রতিষ্ঠিত কর্ম পদ্ধতি হিসেবে বিবাহ হলো প্রতিষ্ঠান।
বিবাহের ধরন
সমাজ পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় সমাজ জীবনের বিভিন্ন প্রথা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কম-বেশি পরিবর্তন এসেছে। তারই ধারাবাহিকাতায় বিবাহের প্রকৃতি ও প্রকারের এবং বিবাহ ব্যবস্থার রীতি নীতির মধ্যে দেশ-কালভেদে পরিবর্তন এসেছে।
পৃষ্ঠা ৮৫
পতি-পত্মীর সংখ্যার অনুপাতে বিবাহের ধরন বিভিন্ন হয়। বিবাহের প্রধান দুটি ধরন হলো-
১. একগামিতা
২. বহুগামিতা।
১. একগামিতা : একজন পুরুষ ও একজন নারীর বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবন স্থাপনকে একগামিতা বলা হয়। একজন পুরুষ ও একজন নারী বিবাহের মাধ্যমে দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত করলে তাকে একগামীতা বলা হয়। মানব বিবাহ ও মানব পরিবারের আদিরূপ হিসেবে একগামিতাকে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। বর্তমান সমাজে একগামিতা হলো সর্বজন স্বীকৃত এবং সর্বাধিক জনপ্রিয় বিবাহ ব্যবস্থা। একগামিতা বিবাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে গড়ে উঠা পরিবারকে একগামী পরিবার বলা হয়। বাংলাদেশে একগামিতা বিবাহ প্রচলিত রয়েছে। অনেক দেশে আইনের দ্বারা এক গামিতাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
২. বহুগামিতা : বহুগামিতা হলো এমন এক বিবাহ ব্যবস্থা যাতে একইসময়ে নারী বা পুরুষ একাধিক জনের সঙ্গে বিবাহের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করতে পারেন। এধরনের বহুগামী বিবাহের তিনটি রূপ হলো¾
ক. বহু পতিত্ব,
খ. বহু পত্মীত্ব,
গ. গোষ্ঠী বিবাহ।
বহুগামী বিবাহের উপর্যুক্ত রূপগুলোর শিরোনাম হতে বিবাহের প্রকৃতি বুঝা সহজ হয়।
ক. বহু পতিত্ব : এটি এমন এক ধরনের বিবাহ প্রথা, যাতে একই সময়ে একজন নারী বহু পতির সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়। এর দুটি ধরন রয়েছে।
প্রথমতঃ বহু পতিত্বের পতিরা একই পরিবারের হয়। একই পরিবারভুক্ত সহোদর ভাইগণ একজন নারীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে, এক সঙ্গে বসবাস করে। এ ধরনের বিবাহকে ফ্রেটার্নাল পলিয়ানড্রাই অথবা বলা এডেলফিক পলিয়ানড্রাই হয়। এ ধরনের বিবাহের মাধ্যমে জন্ম নেয়া সকল সন্তান, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সন্তান বলে পরিচিতি লাভ করে। এ ধরনের বহুপতিত্ব বিবাহ তিববতে দেখতে পাওয়া যায়। দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি পার্বত্য অঞ্চলে টোডা উপজাতির মধ্যে এরূপ বিবাহের প্রচলন রয়েছে। এতে পত্নী তার পতিদের পরিবারে বাস করে।
দ্বিতীয়তঃ এমন একধরনের বহুপতিত্ব বিবাহ প্রথা রয়েছে যাতে একজন নারীর বহুপতি থাকে, তবে পতিদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নেই। অভাতৃত্ব মূলক বহু পতিত্ব বিবাহ ব্যবস্থায় পতিরা, পত্নীর ঘরে এসে মিলিত হয় এবং পত্নী তার মায়ের পরিবারে বাস করে। এ ধরনের বহুপতি বিবাহ প্রথাকে নন ফ্রেটার্নাল পলিয়ানড্রাই বলা হয়। এ ধরনের বিবাহ ব্যবস্থায় সন্তান জন্মের পর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পিতা হিসেবে যে কোন একজন পতিকে বেছে নেয়া হয়। ভারতের মালাবার উপকুলে নায়ার উপজাতি সম্পদায়ের মধ্যে অভাতৃত্বমূলক বহুপতিত্ব প্রথার বিবাহ পরিলক্ষিত হয়।
খ. বহুপত্মীত্ব : একজন পুরুষ একসঙ্গে একাধিক নারীর সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হবার বিবাহ প্রথা হলো বহুপত্নীত্ব। বহুপত্নীত্ব বিবাহ প্রথায় সব স্ত্রীর মর্যাদা সমান হয় না। পত্নীরা সবাই সহোদরা ভগ্নী হলে এ প্রথাকে সোরোরাল পলিজিনি বলা হয়। বহুপত্নীক বিবাহ প্রথার প্রচলন আদিম ও উপজাতীয় সমাজের মতো সভ্য সমাজেও প্রচলিত আছে। ১৯৫৫ সালে ভারতে হিন্দু বিবাহ আইন প্রণয়নের পূর্বে ভারতে বহু পত্নীক বিবাহ প্রচলিত ছিল। এধরনের বিবাহের পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। যেমন- পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যাধিক্য, ক্ষেত খামার চাষাবাদ ইত্যাদি অর্থনৈতিক কাজে সহযোগিতা, সামাজিক সর্যাদা লাভে পত্নীর সংখ্যাকে মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করা, সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভের প্রত্যাশা অর্থাৎ কোলিন্য প্রথা, বংশ রক্ষার তাগিদে সন্তান লাভ বা পুত্র সন্তানের প্রত্যাশা, ধর্মীয় অনুমোদন ইত্যাদি বহু পত্নীক বিবাহের কারণ রূপে বিবেচিত।
পৃষ্ঠা ৮৬
গ. গোষ্ঠী বিবাহ : একাধিক নারীর সঙ্গে একাধিক পুরুষের একই সময়ে বিবাহ সম্পাদিত হবার প্রথাকে বলা হয় গোষ্ঠী বিবাহ। গোষ্ঠী বিবাহ প্রথায়, একটি পারিবারিক গোষ্ঠীর সব ভাইয়ের সঙ্গে, অন্য পরিবারিক গোষ্ঠীর সব বোনের বিবাহ হয়। এ ধরনের বিবাহে একটি গোষ্ঠীর সব পুরুষ, অপর একটি গোষ্ঠীর সব নারীর স্বামী। অনুরূপ একটি গোষ্ঠীর সব নারী হলো, অন্য গোষ্ঠীর সব পুরুষের স্ত্রী। এধরনের বিবাহ বহুপতি ও বহুপত্নী বিবাহ প্রথার সংমিশ্রণ। এধরনের গোষ্ঠী বিবাহ সভ্য সমাজে নেই।
আধুনিক বিবাহ প্রথাকে পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে এরেঞ্জড এবং রুমান্টিক দুভাগে ভাগ করা হয়। এরেঞ্জড বিবাহ প্রথায় পিতামাতা বা অভিভাবক বিবাহের পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করেন; অন্যদিকে রুমান্টিক বিবাহ ব্যবস্থায় পাত্র-পাত্রীর স্বাধীন ইচ্ছা ও পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহ হয়। বর্তমানে সব সমাজে এ ধরনের বিবাহ প্রচলিত আছে।
পরিবারের কার্যাবলী ও ভূমিকা
পৃষ্ঠা ৮৭
সমাজ জীবনে বিবাহের ভূমিকা
সমাজের মৌল প্রতিষ্ঠান পরিবার গঠনের মূল ভিত্তি হলো বিবাহ। আর বিবাহ ও পরিবার অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। আধুনিক সভ্য সমাজে বিবাহবিহীন পরিবারের কথা চিন্তা করা যায় না বলে বিবাহের সামাজিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। নিচে বিবাহ প্রথার সামাজিক ভূমিকা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো-
ক. সমাজ স্বীকৃত উপায়ে যৌন সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ : যৌন বাসনা পূরণ এবং সন্তান কামনা মানুষের অন্যতম জৈবিক চাহিদা। যদি নর-নারীর স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক বিধি-বিধান তথা অনুশাসন দ্বারা বৈধ এবং নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে সমাজ ও ব্যক্তি চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যৌন ব্যভিচার অবাধে চলতে থাকলে, সমাজ জীবনের মূলে আঘাত পড়ে। সমাজের নৈতিক ভিত্তি ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। বিবাহ সভ্য সমাজে প্রকৃতির অভিপ্রায়ের সঙ্গে মানুষের অভিপ্রায়ের সন্ধি স্থাপনের ব্যবস্থা করে। ফলে যৌন ব্যভিচারের অভিশাপ হতে সমাজ রক্ষা পায়।
খ. পরিবার গঠনের সমাজ অনুমোদিত উপায় : বিবাহ পরিবার গঠনে দম্পত্তিকে বাধ্য করে। বিবাহ নতুন পরিবারের ভিত্তি রচনা করে। পরিবারের ভিত্তি হলো বিবাহ। আর পরিবার গঠনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম নেয়ায় সন্তানের বংশগত মর্যাদা ও উত্তরাধিকার নিশ্চিত হয়।
গ. সন্তান লালন পালনের দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে অর্পণ : বিবাহের মাধ্যমে পরিবার গঠিত হলে পিতা-মাতার ওপর সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে অর্পণ করা যায়। অবিবাহিত নর-নারীর যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে যে সন্তানের জন্ম হয়, তার লালন পালনের ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে বিভিন্ন অসুবিধা দেখা দেয়।
ঘ. সামাজিকীকরণ : সমাজ স্বীকৃত প্রথায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে, পিতামাতার ওপর সন্তানের সামাজিকীকরণের দায়িত্ব অর্পিত হয়।
ঙ. সামাজিক সম্পর্ক ও সন্তানের পরিচিতি : পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্কের ভিত রচনা করে বিবাহ। সন্তা নের সামাজিক পরিচিতির নিয়ামক হলো বিবাহ। পিতার পরিচয়ে সন্তান পরিচিত হয়। পিতৃ পরিচয় না থাকলে মাতার অবমাননা এবং সন্তান সমাজে অবৈধ সন্তান বলে তিরস্কৃত হয়। সন্তান ও মাতৃত্বের সামাজিক স্বীকৃতি এবং মর্যাদা বিবাহের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে ম্যালিওনস্কি বলেন, ‘‘বিবাহ যৌন মিলনের অনুমোদন নয়, বরং পিতৃত্বের অনুমোদন’’ বিবাহ সমাজে সন্তানের পিতৃত্ব সুনির্ধারিত করে।
চ. আর্থিক সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি : বিবাহ লিঙ্গভেদে শ্রম বিভাগের সুযোগ সৃষ্টি করে। বিবাহ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে উভয়ের কর্তব্য বন্টন ও সম্পাদনের ব্যবস্থা করে। আদিম সমাজে স্বামী-স্ত্রীর কর্মের সুস্পষ্ট বন্টন পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান আধুনিক শিল্পায়িত সমাজেও স্বামী-স্ত্রী পরিবারের বাইরে আর্থিক কাজে অংশগ্রহণ করে অর্থনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধির চেষ্টা করে।
ছ. আবেগ ও বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্দীপনা : বিবাহ জীবনসঙ্গীদের পারস্পরিক স্নেহ-ভালবাসা আদান প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করে। বিবাহ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আবেগ ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে, সহযোগিতা করার সুযোগ এনে দেয়।
জ. সমাজের কল্যাণ : বিবাহ প্রথা একটি সামাজিক প্রথা। সমাজের কল্যাণের জন্যই বিবাহের মাধ্যমে নর-নারীর মিলনকে সমাজ স্বীকৃতি দিয়েছে। কারণ, দৈহিক কামনার বিকৃতি সমাজে নৈতিক অধঃপতনের সূচনা করে। আবার অবদমিত যৌনকামনা অনেক সময় অসুস্থতা ও মানসিক বিকৃতি সৃষ্টি করে। মানুষের যৌন আবেগ যদি বিচার বুদ্ধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয় এবং সৌন্দর্যবোধ, নীতিবোধ ও ধর্মবোধের সঙ্গে সংযুক্ত না থাকে, তাহলে মানুষ পশুতে পরিণত হয়। সুতরাং ব্যক্তিগত এবং সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য বিবাহের প্রয়োজন রয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, বিবাহের সামাজিক ভূমিকা হলো সমাজ অনুমোদিত প্রথায় পরিবার প্রতিষ্ঠা, সন্তান উৎপাদন এবং সন্তানের পিতৃত্বের স্বীকৃতি ও পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নির্ধারণ। বিবাহ পারিবারিক জীবনকে দৃঢ় করে এবং স্থায়িত্ব এনে দেয়।
পৃষ্ঠা ৮৮
দার্শনিক উইল ডুরাণ্ট বিবাহকে সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বিবাহ মানুষের জীবনের শূন্যতা পূরণ এবং নিরাপত্তা দান করে। বিবাহের মাধ্যমে পরিবার গঠিত না হলে, মানব জাতি আদিম বর্বর অবস্থা হতে বর্তমান সভ্যতার পর্যায়ে উন্নীত হতে পারত না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘‘জীব প্রকৃতি ও সমাজ প্রকৃতি- এ দ্বৈরাজ্যের শাসনে মানুষ চালিত এবং বিবাহ জিনিসটা সভ্য সমাজের অন্যান্য সকল ব্যাপারের মতো প্রকৃতির অভিপ্রায়ের সঙ্গে মানুষের অভিপ্রায়ের সন্ধি স্থাপনের ব্যবস্থা।’’
পরিবার |
পরিবার হলো সমাজের ক্ষুদ্রতম মৌলিক সংগঠন, যাকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর মানব সমাজ গড়ে উঠেছে। সমাজে জীবন-যাপন করার জন্য মানুষ যে সব প্রতিষ্ঠিত আচার-ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, সেগুলোর মধ্যে বিবাহ এবং পরিবার সবচেয়ে প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার হলো সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে স্থায়ী, সর্বব্যাপী এবং সর্বজনীন।
পরিবারের সংজ্ঞা
ইংরেজি “ফ্যামিলি” শব্দটি ল্যাটিন ফ্যামুলাস শব্দ থেকে গৃহীত। যার অর্থ এ সারভেন্ট বা একজন চাকর। রোমান আইনে ফ্যামুলাস শব্দটি একদল উৎপাদক, একদল দাস, চাকর এবং অন্যান্য সদস্যদের যারা বংশানুক্রমে অথবা বিবাহের মাধ্যমে সম্পর্কযুক্ত তাদের নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হতো। সুতরাং উৎপত্তিগত অর্থে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা এবং সন্তানাদি ও চাকরদের নিয়ে গঠিত মানবগোষ্ঠী হলো পরিবার।
সাধারণভাবে পরিবার বলতে এমন একটি ক্ষুদ্র সামাজিক সংগঠনকে বুঝায়, যেখানে বৈবাহিক এবং রক্ত সম্পর্কের সূত্রে স্বামী-স্ত্রী তাদের সন্তানসহ একত্রে বসবাস করে।
পরিবারের সংজ্ঞায় ম্যাকাইভার এবং পেজ বলেছেন, ‘‘পরিবার হলো এমন একটি গোষ্ঠী, যাদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট যৌন সম্পর্ক রয়েছে এবং যে সম্পর্ক সন্তান উৎপাদন ও লালন পালনের স্বার্থে যথেষ্ট সুস্পষ্ট এবং স্থায়ী।’’ আলোচ্য সংজ্ঞাটিতে পরিবারের বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বামী-স্ত্রী ও তাদের সুনির্দিষ্ট যৌন সম্পর্ক, সন্তান উৎপাদন ও লালন-পালন এবং পিতা-মাতা ও সন্তানের সম্পর্কের স্থায়িত্বকে উল্লেখ করা হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানী বার্জেস এবং লক পরিবারের একটি বর্ণনামূলক সংজ্ঞা প্রদান করেছেন, যাতে পরিবারের মোটামুটি পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁদের মতে, ‘‘পরিবার এমন একটি মানবগোষ্ঠী যার সদস্যগণ পরস্পরের সঙ্গে বিবাহ বন্ধন, রক্তের সম্পর্ক বা গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্তির দ্বারা আবদ্ধ; যারা একটি একক সংসার গঠন করে; যারা স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, ভ্রাতা-ভগ্নীর যথাযথ সামাজিক ভূমিকায় পরস্পরের সঙ্গে আদান-প্রদান ও যোগাযোগরত এবং যারা একটি সাধারণ সংস্কৃতির স্রষ্টা ও সংরক্ষক।’’
সমাজবিজ্ঞানী ইলিওট এবং ম্যারিল এর মতে, ‘‘পরিবার হলো স্বামী, স্ত্রী এবং সন্তানদের সমন্বয়ে গঠিত জৈবিক সামাজিক একক।’’
পরিবারের বৈশিষ্ট্য
পরিবারের বিভিন্ন সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে এর কতগুলো লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে উঠে। নিচে পরিবারের প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো-
ক. বৈবাহিক বন্ধন ও রক্তের সম্পর্ক : বৈবাহিক বন্ধন ও রক্তের সম্পর্ক দ্বারা পরিবারের সদস্যগণ আবদ্ধ। বিবাহ হলো পরিবার গঠনের মূল ভিত্তি।
খ. বিশ্বজনীনতা : পরিবার হলো সর্বজনীন ও সর্বব্যাপী সামাজিক সংগঠন। সকল সমাজে সকল সময়ে এর অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
গ. আবেগীয় ভিত্তি : পরিবারের মূল ভিত্তি হলো মানুষের কতগুলো আবেগ, প্রেষণা ও প্রবণতা। যেমন- সঙ্গী নির্বাচন, যৌনক্রিয়া, সন্তান প্রজনন, মাতৃস্নেহ, বংশের ধারাবাহিকতা রক্ষার আকাঙ্খা ইত্যাদি।
পৃষ্ঠা ৮৯
ঘ. গঠনমূলক প্রভাবঃ পরিবার মানব শিশুর প্রাথমিক পরিবেশ। মানব শিশুর চরিত্র গঠনে পরিবার গঠনমূলক প্রভাব বিস্তার করে।
ঙ. সমাজকাঠামোর ক্ষুদ্র উপাদান : সামাজিক সংগঠন হিসেবে পরিবার হলো সবচেয়ে ক্ষুদ্র সংস্থা। সমাজকাঠামো গঠনকারী উপাদানগুলোর মধ্যে পরিবার হলো সবচেয়ে সীমিত পরিধিসম্পন্ন উপাদান।
চ. সমাজকাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু : বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দু হলো পরিবার। পরিবারের মতো সামাজিক একককে কেন্দ্র করে সমাজকাঠামো ও অন্যান্য সংস্থা গড়ে উঠে।
ছ. সভ্যগণের ওপর পরিবারের দাবি নিরবচ্ছিন্ন : অন্যান্য সামাজিক সংস্থা হতে সদস্যদের ওপর পরিবারের দাবি নিরবচ্ছিন্নএবং অধিক। পরিবারের জন্য সদস্যরা আজীবন পরিশ্রম করে।
জ. সামাজিক অনুশাসন : পরিবার হলো একটি সামাজিক অনুশাসন । আধুনিক সভ্য সমাজে মানুষ স্বাধীনভাবে সামাজিক উপায়ে পরিবার গঠন করতে পারে, কিন্তু স্বাধীনভাবে পরিবার ত্যাগ বা ভেঙ্গে দিতে পারে না। বিবাহ দ্বারা পরিবার গঠন যেমন সমাজ অনুমোদিত, তেমনি বিবাহ বিচ্ছেদও সমাজ নিয়ন্ত্রিত।
ঝ. পারিবারিক সম্পর্ক স্থায়ী এবং অস্থায়ী উভয় প্রকৃতির : যদিও পরিবার প্রথা সর্বজনীন ও চিরন্তন, কিন্তু পারিবারিক সম্পর্ক অস্থায়ী ও পরিবর্তনশীল। কারণ যে কোন সময় পারিবারিক সম্পর্ক ভেঙ্গে যেতে বা ছিন্ন হতে পারে।
ঞ. আন্তঃমানবিক জটিল সম্পর্ক : প্রতিটি পরিবারই একটি আন্তঃমানবিক সম্পর্কের জটিল জাল। বিবাহজনিত সম্পর্ক, পিতা-মাতা সম্পর্ক, অন্যান্য জ্ঞাতি সম্পর্ক- এ তিন প্রকার সম্পর্ক পরিবারে বিদ্যমান। পরিবারের বিস্তার, সামাজিক সম্পর্কের জটিলতা বৃদ্ধি পায়।
পরিবারের প্রকারভেদ
পরিবার একটি বিশ্বজনীন সামাজিক প্রতিষ্ঠান। স্থান, কাল, সমাজভেদে পরিবার গঠনের বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। বংশানুক্রম, বাসস্থান, উত্তরাধিকার, কর্তৃত্ব, যৌন সম্পর্ক ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে পরিবারের শ্রেণী বিভাগ করা হয়। পরিবারের প্রধান ধরনগুলো হলো-
১. পিতৃশাসিত এবং মাতৃশাসিত পরিবার;
২. একগামী এবং বহুগামী পরিবার;
৩. মাতৃ বংশানুক্রমিক এবং পিতৃবংশানুক্রমিক পরিবার;
৪. পিতৃআবাসিক এবং মাতৃআবাসিক পরিবার;
৫. একক ও যৌথ পরিবার।
পরিবারে উপরিউক্ত ধরনগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
১. পিতৃশাসিত এব মাতৃশাসিত পরিবার : পারিবারিক কর্তৃত্বের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবারের এরূপ বিভাজন করা হয়।
পিতৃশাসিত পরিবার : পরিবারে কর্তৃত্ব যদি পিতা বা স্বামীর ওপর ন্যস্ত থাকে, তা হলে সে পরিবারকে পিতৃশাসিত বা পিতৃতান্ত্রিক পরিবার বলা হয়।
মাতৃশাসিত পরিবার : যখন পারিবারিক কর্তৃত্ব পুরুষের পরিবর্তে স্ত্রীর ওপর ন্যস্ত থাকে, তখন তাকে মাতৃশাসিত বা মাতৃতান্ত্রিক পরিবার বলা হয়।
আধুনিক পরিবারগুলো প্রধানত পিতৃতান্ত্রিক বা পিতৃশাসিত। তবে নারীর স্বতন্ত্র সত্তা ও মর্যাদা সমাজস্বীকৃত বিধায় নারীর কর্তৃত্ব অস্বীকার করা যায় না। এজন্য পরিবার কখনো পূর্ণ মাতৃতান্ত্রিক বা পূর্ণ পিতৃতান্ত্রিক হয় না।
২. একগামী এবং বহুগামী পরিবার : বিবাহের প্রকৃতি অনুযায়ী পরিবারকে এরূপ শ্রেণী বিভাগ করা হয়।
পৃষ্ঠা ৯০
একগামী পরিবার : এক পতি এবং এক পত্নী বিশিষ্ট পরিবারকে বলা হয় একগামী পরিবার। একজন পুরুষ ও একজন নারীর বিবাহ বন্ধনের ভিত্তিতে গড়ে উঠা পরিবারকে বলা হয় একগামী পরিবার। বর্তমানে এধরনের পরিবারের প্রচলন বেশি।
বহুগামী পরিবার : এক পতি ও একাধিক পত্নী অথবা এক পত্নী ও একাধিক পতিকে নিয়ে গঠিত পরিবারকে বলা হয় বহুগামী পরিবার। সহজ কথায় বহুগামী পরিবারের সৃষ্টি হয় একপতি ও একাধিক পত্নী অথবা এক পত্নী ও একাধিক পতির মধ্যে যৌন সম্পর্ক থাকে। বর্তমান সভ্য সমাজে এধরনের পরিবারের তেমন স্বীকৃতি নেই।
৩. মাতৃ বংশানুক্রমিক এবং পিতৃ বংশানুক্রমিক পরিবার : পরিবারকে বংশানুক্রমের ভিত্তিতে এরূপ শ্রেণীবিভাগ করা হয়।
মাতৃবংশানুক্রমিক পরিবার : মাতৃকুলের পরিচয়ে যে পরিবারে সন্তানের পরিচয় নির্ধারিত হয় এবং সন্তান মাতৃকুলের বংশধর হিসেবে স্বীকৃতি পায়, সে পরিবারকে বলা হয় মাতৃ বংশানুক্রমিক পরিবার। এতে মাতৃকুলের ধারা অনুযায়ী উত্তরাধিকার অর্থাৎ কন্যা সন্তান সম্পত্তির অধিকারিণী হয়। বাংলাদেশের গারো সম্প্রদায়ের মধ্যে এটি বিরাজমান।
পিতৃ বংশানুক্রামিক পরিবার : যে পরিবারে সন্তান পিতৃপুরুষের বংশধর হিসেবে পরিচিত হয়, তাকে এরূপ পরিবার বলা হয়। যে পরিবারে সন্তানের পরিচয় পিতৃকুলের ভিত্তিতে অর্থাৎ পুরুষানুক্রমিক ধারা অনুসরণে উত্তরাধিকার নির্ধারণ করা হয়, তাকে পিতৃ বংশানুক্রমিক পরিবার বলা হয়।
৪. পিতৃবাস পরিবার এবং মাতৃবাস পরিবার : যে পরিবারে স্ত্রী, বিবাহের পর স্বামীগৃহে বসবাস করে, সে পরিবারকে বলা হয় পিতৃবাস পরিবার। অন্যদিকে, বিবাহের পর স্বামী যদি স্ত্রীর মাতৃগৃহে বসবাস করে, তবে তাকে মাতৃবাস পরিবার বলা হয়।
৫. একক পরিবার এবং যৌথ পরিবার : যে পরিবার স্বামী, স্ত্রী এবং এক বা একাধিক সন্তানকে নিয়ে গঠিত তাকে একক পরিবার বলা হয়। একক পরিবারের সদস্য সংখ্যা স্বামী-স্ত্রী এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের মধ্যে সীমিত থাকে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী দর্শনের প্রভাবে বর্তমানে একক পরিবারের সংখ্যা অধিক। নব বিবাহিত দম্পতি উভয়ের পরিবার ত্যাগ করে স্বতন্ত্রভাবে বসবাস করে বলে এরূপ পরিবারকে দম্পতি-কেন্দ্রিক পরিবার বলা হয়।
অন্যদিকে, রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে কয়েকটি একক পরিবারের সমষ্টি হলো যৌথ পরিবার। অন্যভাবে বলা যায়, যখন নব বিবাহিত দম্পত্তি পৃথক বাসগৃহের পরিবর্তে স্বামী বা স্ত্রীর পরিবারের অংশ হিসাবে বসবাস করে, তখন তাকে যৌথ পরিবার ব্যবস্থা বলা হয়।
পৃষ্ঠা ৯১
ক নজরে পরিবারের শ্রেণীবিভাগ
পরিবারের কার্যাবলী ও ভূমিকা
পরিবার সমাজের মৌলিক প্রতিষ্ঠান। সমাজ রূপায়নে যেসব ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ সংগঠন প্রভাব বিস্তার করে, সেগুলোর মধ্যে পরিবারের তাৎপর্য ও গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। পরিবার সমাজকে অসংখ্য উপায়ে প্রভাবিত করে। সমাজবিজ্ঞানী জিসবার্ট পরিবারকে সমাজের জন্মকোষ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পরিবার মানব জীবনে এমন সব দায়িত্ব পালন করে, যেগুলো অন্য কোন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান পালন করতে পারে না। পরিবার হলো মানব প্রকৃতির নার্সারী, সামাজিক প্রথার সূতিকাগার এবং আনুগত্যের নার্স। সমাজ জীবনে পরিবারের বহুমুখী ভূমিকা ও কার্যাবলির বিশেষ কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো-
ক. জৈবিক কাজ : পরিবার সমাজ অনুমোদিত উপায়ে স্বামী-স্ত্রীর জৈবিক সম্পর্ক বজায় এবং সন্তান উৎপাদন ও লালন-পালনের দায়িত্ব পালন করে। মানব জাতির ও বংশের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে পরিবার। সামাজিক উপায়ে জৈব চাহিদা পূরণ, সন্তান প্রজনন ও লালন-পালন পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক কার্যাবলি, যা অন্য কোন সংস্থা পালন করতে পারে না।
খ. মনস্তাত্বিক কাজ : মানব শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠন ও মানবিক বিকাশে মমত্ববোধের গুরুত্ব অপরিসীম। পারিবারিক পরিবেশে স্নেহ, আদর, মায়া, মমতা ও ভালবাসার মাধ্যমে শিশুর সুষ্ঠু মানসিক বিকাশ ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব গঠিত হয়। যা পরিবারের মনস্তাত্ত্বিক ভূমিকার অন্তর্ভুক্ত। স্নেহ, প্রীতি এবং ভালবাসা না পেলে মানসিক বৃত্তি বিকশিত হয় না। সমাজবিজ্ঞানী কুলী পরিবারের মতো প্রাথমিক গোষ্ঠীকে “হিউম্যান নার্সারী” বলে আখ্যায়িত করেছেন। শিশুর নিরাপত্তা বিধানে পরিবারের বিকল্প নেই।
গ. অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাবিধানমূলক কাজ : সন্তান লালন-পালনের সঙ্গে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত। বাসস্থানের ব্যবস্থা, খাওয়া-পরা, সেবা-শুশ্রুষার জন্য অর্থের প্রয়োজন। সে জন্য প্রত্যেক সমাজে পরিবারের সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব এবং অধিকার সমাজ দ্বারা স্বীকৃত। আদিম সমাজে অর্থনৈতিক কার্যাবলির মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল পরিবার। বর্তমানেও কৃষিভিত্তিক সমাজে ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বণ্টন ইত্যাদি কার্য সম্পাদন করে পরিবার। কৃষি সমাজে পরিবার হলো উৎপাদনের একক। বর্তমানে কুটির শিল্পের কাজ পারিবারিক পরিবেশেই সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে বর্তমানেও পরিবারগুলো উৎপাদন, আয়, ভোগ ও বণ্টনের একক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রভাবে পরিবারের অর্থনৈতিক ভূমিকা নগর সমাজে হ্রাস পাচ্ছে। তবুও পরিবারই একমাত্র সংস্থা যা এর সদস্যদের
পৃষ্ঠা ৯২
অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান করে। অন্য কোন সংস্থার দ্বারা যা সম্ভব নয়। শিশু, অক্ষম, প্রবীণ প্রতিবন্ধী সদস্যদের নিরাপত্তা দান করে পরিবার।
ঘ. সামাজিকীকরণ : মানব শিশুর সামাজিকীকরণ পরিবারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ইন্দ্রিয় সর্বস্ব মানব শিশু পারিবারিক পরিবেশেই নিজেকে বৃহত্তর সমাজের উপযোগী হিসাবে গড়ে তুলে। পরিবারের মাধ্যমে শিশু বৃহত্তর সমাজের রীতি-নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধ ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হয়। পরিবারের মাধ্যমে শিশু জন্মসূত্রে বিশেষ সামাজিক পরিচিতি ও মর্যাদা লাভ করে। ফলে শৈশব হতে শিশুর মধ্যে অধিকার ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত হয়। পরিবার হলো সামাজিকীকরণের সবচেয়ে কার্যকর এজেন্ট।
ঙ. শিক্ষাদান : পরিবার হলো শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাগার। পরিবারই আনুষ্ঠানিক উপায়ে সন্তানদের নীতিবোধ ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানসহ বিদ্যালয়ে ভর্তি এবং গৃহে নিয়মিত পড়ার ব্যবস্থা করে। অনানুষ্ঠানিক-আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদানে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে সন্তান-সন্ততিদের ধর্মীয় এবং নীতিবোধ ভিত্তিক শিক্ষাদানে পরিবার অনন্য ভূমিকা পালন করে।
চ. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ : সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কার্যকর মাধ্যম হিসেবে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রত্যেক পরিবারের নিজস্ব পারিবারিক মূল্যবোধ, আদর্শ ও নিয়ম-নীতি থাকে। যা পরিবারের সদস্যদের আচার-আচরণকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
ছ. রাজনৈতিক কার্যাবলি : পারিবারিক পরিবেশেই মানুষ নেতৃত্ব, দায়িত্ব-কর্তব্য, নিয়ম, শৃঙ্খলা শিক্ষা লাভ করে। পিতা-মাতা বা পরিবার প্রধানের আদেশ মেনে চলার শিক্ষা পরিবারই দান করে। এগুলো পরিবারের রাজনৈতিক কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত।এভাবে মানব শিশু পরিবারের মাধ্যমে সুনাগরিকতার গুণাবলি অর্জন করে।
জ. চিত্তবিনোদনমূলক কার্যাবলি : পরিবারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো চিত্তবিনোদনমূলক কার্যাবলি। পরিবারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন খেলাধূলা, আমোদ-প্রমোদ, গল্পগুজব প্রভৃতি চিত্তবিনোদনমূলক কার্যাবলি সম্পাদিত হয়। রেডিও, টিভি, ভিসিআর ইত্যাদি যান্ত্রিক মাধ্যমের দ্রুত প্রসার পরিবারকে আধুনিক চিত্তবিনোদনের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। এগুলো পরিবারকেন্দ্রিক ঐতিহ্যবাহী চিত্তবিনোদনমূলক কর্মকান্ডের স্থান দখল করে নিয়েছে।
ঝ. সামাজিক পরিচিতি ও মর্যাদা সংশ্লিষ্ট কার্যাবলী : পরিবার ব্যক্তির আরোপিত মর্যাদা এবং সামাজিক পরিচিতি প্রদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্যাদি সম্পন্ন করে। পরিবারের মাধ্যমে ব্যক্তি আরোপিত মর্যাদা ও পরিচিতি লাভ এবং সে অনুযায়ী সামাজিক ভূমিকা পালন করে। যেমন সমাজ শিশুর নাম ধরে সম্বোধন করে, আর শিশুর নাম পরিবার আরোপ করে। পরিবারের দেয়া নাম শিশুর ভবিষ্যত জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তার পরিচিতি নিশ্চিত করে। এভাবে পরিবার সামাজিক পরিচিতি দান করে।
পৃষ্ঠা ৯৩
সমাজকল্যাণ ও পরিবার
সমাজকল্যাণের দু’টি মৌলিক লক্ষ্য হলো ক. সমাজের মৌলিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারের সামগ্রিক কল্যাণ বিধানের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং খ. ব্যক্তির সুপ্ত ক্ষমতা বিকাশের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, যাতে সে জীবনের সার্বিক অবস্থা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। এ দু’টি লক্ষ্যার্জনের উত্তম মাধ্যম হলো পরিবার। সমাজের মূল অণু হলো পরিবার। পরিবারের সমষ্টিই হলো সমাজ। সমাজের সার্বিক কল্যাণ পরিবারকে উপেক্ষা করে আনয়ন সম্ভব নয়। সুতরাং মৌলিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারের কল্যাণের প্রতি আধুনিক সমাজকল্যাণ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। মানব শিশুর প্রতিভা বিকাশ, সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ, ব্যক্তিত্ব গঠন, নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিবারের বিকল্প নেই।
শিল্পায়ন, নগরায়ণ, সংহতির অনুপ্রবেশ প্রভৃতির প্রভাবে পারিবারিক কাঠামো ও কার্যাবলির মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও উলেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক সম্পর্ক সমতার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসবের প্রভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ, কিশোর অপরাধ প্রবণতা, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, নারী নির্যাতন প্রভৃতি সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। বিবাহ বিচ্ছেদের হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে পরিবারের স্থায়িত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে।
আধুনিক সমাজকল্যাণের কৌশল ও পদ্ধতি প্রয়োগ করে পারিবারিক সমস্যার কার্যকর মোকাবেলা করা সম্ভব। ব্যক্তি সমাজকর্ম ও দল সমাজকর্ম পদ্ধতি প্রয়োগের উত্তম ক্ষেত্র হলো পরিবার। পরিবার ও শিশু কল্যাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে পারিবারিক সমস্যা সমাধানে আধুনিক সমাজকল্যাণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পরিবারের মাধ্যমে সমাজকর্মীরা অনেক কল্যাণমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
জ্ঞাতি সম্পর্ক |
মানুষের জ্ঞাতি সম্পর্ক হলো সমাজকাঠামোর চাবিকাঠি। জ্ঞাতি সম্পর্কের ওপরই নির্ভর করছে মানুষের পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্ক এবং মিথস্ক্রিয়া। মানুষের সামাজিক ভূমিকা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রকৃতি নির্ধারণ করে জ্ঞাতি সম্পর্ক।
জ্ঞাতি সম্পর্ক কি ?
ইংরেজি ওকরহহ অর্থ জ্ঞাতি বা আত্মীয় এবং ওকরহংযরঢ়হ অর্থ জ্ঞাতি সম্পর্ক বা আত্মীয়তার সম্পর্ক। সমাজবিজ্ঞানী রবিন ফক্স জ্ঞাতি সম্পর্কের সংজ্ঞায় বলেছেন, ‘‘জ্ঞাতি সম্পর্ক বলতে শুধু আত্মীয়-স্বজন বা জ্ঞাতি জনের মধ্যকার সম্পর্ককে বুঝায়। জ্ঞাতিরা হলো সে সব ব্যক্তি যারা প্রকৃতপক্ষে, অনুমিতভাবে অথবা কাল্পনিকভাবে রক্ত বা জন্মসূত্রে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।’’
নৃ-বিজ্ঞানী রিভার্স এর মতে, ‘‘বংশ ধারার অর্থাৎ বংশ লতিকার নিরিখে যে সকল সম্পর্ক নির্ণয় করা যায়, তা-ই জ্ঞাতিসম্পর্ক।’’
সহজ কথায়, রক্তের অথবা বিবাহের সম্বন্ধ, যা মানুষকে এক গোষ্ঠীর বন্ধনে আবদ্ধ করে, তাকে জ্ঞাতি সম্পর্ক বলা হয়। রক্তের বন্ধন এবং বিবাহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক সম্পর্ককে সমষ্টিগতভাবে জ্ঞাতি সম্পর্ক দ্বারা নির্দেশ করা হয়।
জ্ঞাতি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কাঠামোগত নীতি
জ্ঞাতি ব্যবস্থা কতগুলো মূলনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যেগুলোকে সমাজবিজ্ঞানী রবিন ফক্স নিচের চারভাগে উপস্থাপন করেছেন। জ্ঞাতি সম্পর্ক স্থাপনের এসব মূলনীতিগুলোকে ‘ফেক্টস্ অফ লাইফ’ বলা হয়।
নীতি-১ : এমন মহিলা, যাদের সন্তান রয়েছে;
নীতি-২ : মহিলাদের অন্তঃসত্ত্বাকারী পুরুষ অর্থাৎ স্বামী;
নীতি-৩ : সাধারণভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগকারী পুরুষ;
নীতি-৪ : মুখ্য জ্ঞাতি বা প্রত্যক্ষ জ্ঞাতি পরস্পরের সঙ্গে বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না।
পৃষ্ঠা ৯৪
জ্ঞাতি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মৌলিক জৈবিক বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করে উপর্যুক্ত নীতিগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে; যে জৈবিক বিষয়গুলোর ওপর জ্ঞাতি সম্পর্ক নির্ভর করে।
জ্ঞাতি সম্পর্ক ব্যবস্থার ধরন : জ্ঞাতি সম্পর্ক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মূল ধরন হলো-
১. রক্তের সম্পর্কের জ্ঞাতি;
২. বিবাহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত জ্ঞাতি।
নিচে এগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো-
১. রক্তের সম্পর্কের জ্ঞাতি : নারী-পুরুষের যৌন মিলনের ফলে সন্তানের জন্ম হয়; যা রক্তের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। আর এরূপ রক্তের সম্পর্কের স্বীকৃতির জন্য মা, ছেলে-মেয়ে, পিতা ইত্যাদি বিশেষ পরিভাষা ব্যবহার করা হয়। রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সম্পর্ককে রক্তের সম্পর্কের জ্ঞাতি অর্থাৎ কনসেনগুয়িনাস কিনশিপ বলা হয়। আর এ ধরনের আত্মীয়দের রক্ত সম্পর্কীয় জ্ঞাতি অর্থাৎ কনসেনগুয়িনাস কিন বলা হয়।
২. বিবাহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত জ্ঞাতি সম্পর্ক : বংশবৃদ্ধির প্রবণতা থেকে বিশেষ ধরনের জ্ঞাতি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। সামাজিকভাবে অনুমোদিত ও বৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে এরূপ আত্মীয়তার সম্বন্ধ গড়ে উঠে। বিবাহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সম্পর্ককে বলা হয় অভভরহধষ শরহংযরঢ় এবং পরস্পর সম্পর্কিত আত্মীয়দের বলা অভভরহধষ শরহ বা বিবাহের মাধ্যমে আবদ্ধ আত্মীয়। এফাইনাল কিন্স সঙ্গে রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ নয়। স্বামী-স্ত্রী হলো এফাইনাল কিন্স এর উদাহারণ।
জ্ঞাতি সম্পর্কের শাখা
আত্মীয়তার সম্পর্কের নৈকট্য এবং দূরত্বের ভিত্তিতে জ্ঞাতি সম্পর্ককে ১. মুখ্য জ্ঞাতি; ২. গৌণ জ্ঞাতি এবং ৩. তৃতীয় পর্যায়ের জ্ঞাতি এ তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়।
১. মুখ্য জ্ঞাতি : অনু পরিবারের সদস্যরা পরস্পর মুখ্য জ্ঞাতি। স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্র, মা-ছেলে, পিতা-কন্যা, মা-মেয়ে, ছোট ভাই-বড় ভাই, ছোট বোন-বড় বোন এবং ভাই-বোন -এ আট ধরনের মুখ্য জ্ঞাতি নৃ-বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন।
২. গৌণ জ্ঞাতি : অণু পরিবারের বাইরে মানুষের তেত্রিশ ধরনের গৌণ জ্ঞাতি রয়েছে। মামা, ভাবী, বোনের স্বামী, চাচা, ফুফু ইত্যাদি গৌণ জ্ঞাতির উদাহরণ।
৩. তৃতীয় পর্যায়ের জ্ঞাতি : তৃতীয় পর্যায়ের জ্ঞাতি বলতে মুখ্য জ্ঞাতির গৌণ জ্ঞাতিদের বুঝায়। স্ত্রীর ভাইদের সন্তান, বোনের স্বামীর ভাই- এ ধরনের জ্ঞাতিরা তৃতীয় পর্যায়ের জ্ঞাতি। নৃ-বিজ্ঞানীরা ১৫১ ধরনের তৃতীয় পর্যায়ের জ্ঞাতির উল্লেখ করেছেন।
জ্ঞাতি সম্পর্ক নির্ণয় বা জ্ঞাতি সম্পর্কের পরিচয় বিভিন্নভাবে হতে পারে। রক্তের সম্পর্ক, বংশানুক্রমিক, কাল্পনিক বন্ধন, প্রথাগত সম্বন্ধ ইত্যাদির দ্বারা। মূলতঃ রক্ত ও বৈবাহিক বন্ধনই জ্ঞাতি সম্পর্ক নির্ধারণের মূল সূত্র। তবে জ্ঞাতি সম্পর্কের মূলে স্বামী-স্ত্রীর যৌন বা বৈবাহিক সম্পর্ক ক্রিয়াশীল হলেও অনেকক্ষেত্রে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিকভাবেও এটি নির্ধারিত হয়। রক্ত বা বংশধারার বাইরেও মানুষ কৃত্রিমভাবে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। যেমন- দত্তক হিসেবে কাউকে সন্তানরূপে গ্রহণ করা। জ্ঞাতি সম্পর্ক পিতার বংশের হতে পারে, আবার মাতৃকুলেরও হতে পারে।
সমাজ জীবনে জ্ঞাতি সম্পর্কের গুরুত্ব
জ্ঞাতি সম্পর্ক সমাজ অধ্যয়নের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সমাজ জীবনে জ্ঞাতি সম্পর্কের গুরুত্ব নিচে উল্লেখ করা হলো-
১. সামাজিকীকরণ এবং দলীয় সংহতি বৃদ্ধি : জ্ঞাতি সম্পর্ক হলো অন্যতম মৌলিক ও সর্বজনীন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যা ব্যক্তির সামাজিকীকরণ এবং দলীয় সংহতি বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানব সমাজে জ্ঞাতি সম্পর্ক একটি নিয়ন্ত্রিত প্রথা। মানুষের সামাজিক আচার-আচরণ ও পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক সম্পর্ক এবং সামাজিক ভূমিকা
পৃষ্ঠা ৯৫
পালনে জ্ঞাতি সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। এজন্য সামাজিক শৃঙ্খলা ও সংহতি বজায় রাখার লক্ষ্যে নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসরত বিভিন্ন জনপদের মানুষের মধ্যে কৃত্রিম জ্ঞাতি সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়। জ্ঞাতি সম্পর্কহীন ব্যক্তির কোন সামাজিক মর্যাদা নেই। সমাজে বসবাস করেও সে অসামাজিক হিসেবে আখ্যায়িত হয়।
২. সমাজ অধ্যয়নের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান : যে কোন সমাজের সমাজকাঠামো অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণে জ্ঞাতিসম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক হলো সমাজকাঠামোর মূল ভিত্তি। আর সামাজিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো জ্ঞাতি সম্পর্ক। জ্ঞাতি সম্পর্ক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাজকাঠামো, পারিবারিক গঠন, সামাজিক রীতি-নীতি ইত্যাদি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। সমাজ জীবনে মানুষের পারস্পরিক আদান-প্রদান এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণের মূল নিয়ামক হলো জ্ঞাতি সম্পর্ক।
৩. সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ সৃষ্টি : আদিম যুগে জ্ঞাতি সম্পর্কের ভিত্তিতে একত্রে মিলেমিশে বসবাস করতে গিয়ে মানুষের মধ্যে গড়ে উঠে গোত্র বা দলীয় জীবন ব্যবস্থা এবং দলীয় বন্ধন। পর্যায়ক্রমে এ বন্ধনই বৃহত্তর সামাজিক সম্পর্কের রূপ লাভ করে। জ্ঞাতি সম্পর্কের বন্ধনই মানুষের মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলা, আদর্শ ও মূল্যবোধ সৃষ্টি করেছে। উন্নততর সামাজিক জীবনের আদর্শ সৃষ্টি এবং আদর্শকে স্থায়ী করতে জ্ঞাতি সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম।
৪. সামাজিক সম্পর্কের উন্নয়ন : বর্তমান যুগে শিল্পায়ন ও নগরায়নের প্রভাবে বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জনপদের মানুষ শহর ও শিল্পাঞ্চলে নির্দিষ্ট এলাকায় একত্রে বসবাস করে। এসব এলাকার জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সাহায্য এবং সহযোগিতার মনোভাব ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টির জন্য কৃত্রিম জ্ঞাতি সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়। পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে বিভিন্ন জ্ঞাতি সম্পর্ক যেমন- চাচা, মামা, খালা ইত্যাদি গড়ে তুলে। ফলে তাদের মধ্যে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়।
৫. প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রভাব : সমাজ জীবনে জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য ও কর্তব্য পালন করতে গিয়ে অনেকক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতি সৃষ্টি হয়। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নীতি অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে কর্তব্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে জ্ঞাতি সম্পর্ক বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। জ্ঞাতির প্রতি অত্যধিক সহানুভূতি প্রদর্শন করতে গিয়ে প্রশাসনিক দায়িত্ব নিরপেক্ষভাবে পালন করা যায় না। আমাদের মত দরিদ্র ও উন্নয়নগামী দেশে চাকুরী বা অন্য কোন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও দক্ষতা মূল্যায়ন না করে জ্ঞাতি সম্পর্কের নৈকট্যের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বজনপ্রীতির মতো সামাজিক দুর্নীতি সৃষ্টি হয়। এজন্য বলা হয়, ‘‘উন্নয়নশীল দেশের আমলাতন্ত্র জ্ঞাতি সম্পর্কের নিকট পরাজিত।’’ এসব দেশে স্বজনপ্রীতি হলো সবচেয়ে প্রভাবশালী নৈতিক কর্ম। জ্ঞাতি সম্পর্কের সূত্র ধরে এসব দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করা হয়। সুতরাং জ্ঞাতি সম্পর্ক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্মকান্ডে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৬. নেতৃত্ব নির্বাচন এবং সামাজিক সংঘ গঠন : আদিম সমাজ থেকে আধুনিক সভ্য সমাজে নেতৃত্ব নির্বাচন এবং সামাজিক সংঘ গঠনে জ্ঞাতি সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। নির্বাচনের সময় জ্ঞাতি সম্পর্কের বন্ধন ভোট পেতে বিশেষভাবে সহায়তা করে। নির্বাচনে প্রার্থীর যোগ্যতার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে জ্ঞাতিসম্পর্কই ভোটদাতাদের বেশি প্রভাবিত করে।
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান যুগের জাতি এবং জাতীয়তাবোধ জ্ঞাতি সম্পর্কেরই সম্প্রসারিত রূপ। জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মর্যাদা ও স্বার্থ রক্ষার মধ্যদিয়ে মানুষের মধ্যে গোষ্ঠী চেতনা সৃষ্টি হয়। গোষ্ঠী চেতনাই কালক্রমে মানুষের জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করণের মাধ্যমে পৃথক জাতি গঠনে সক্ষম করে তুলছে।
জনসমষ্টি |
সামাজিক বিজ্ঞানে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জনসমষ্টি। আধুনিক সমাজকল্যাণে জনসমষ্টি প্রত্যয়টি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। জনসমষ্টিকে কেন্দ্র করে সমাজকর্মের মৌলিক পদ্ধতি জনসমষ্টি সংগঠন ও জনসমষ্টি উন্নয়ন গড়ে উঠেছে।
পৃষ্ঠা ৯৬
জনসমষ্টির সংজ্ঞা
জনসমষ্টি বলতে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে বুঝায়। যাদের ভাষা, সামাজিক রীতি-নীতি, ভাবধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গি এক ও অভিন্ন। যারা কোন বিশেষ স্বার্থের অংশীদার না হয়ে একটি সাধারণ জীবনযাত্রার অংশীদার হয়ে একত্রে বসবাস করে।
অর্থাৎ, ‘‘সমষ্টি হচ্ছে ব্যক্তি বা পরিবারের গোষ্ঠী, যা বিশেষ মূল্যবোধ, সেবা, প্রতিষ্ঠান, স্বার্থ অথবা ভৌগোলিক নৈকট্য সমানভাবে উপভোগ করে।’’
সমাজবিজ্ঞানী অগবার্ন এবং নিমকফ্ জনসমষ্টির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘জনসমষ্টি হলো একই অঞ্চলে বসবাসকারী এক বা একাধিক গোষ্ঠীর সমষ্টি।’’ তাঁদের মতে, একই অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থলের নৈকট্য বা আবাসিক বন্ধন এক জনসমষ্টিকে অন্য জনসমষ্টি হতে পৃথক করে রাখে। এছাড়া জনসমষ্টির অপর বৈশিষ্ট্য হলো একই অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংগঠিত সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা।
সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার এবং পেজ-এর মতে, ‘‘যখন কোন ছোট বা বড় গোষ্ঠীর সদস্যরা এমনভাবে বসবাস করে যে তারা কোন বিশেষ স্বার্থের অংশীদার না হয়ে সাধারণ জীবনের প্রাথমিক প্রয়োজনীয় বিষয়ে অংশগ্রহণ করে, তখন সে গোষ্ঠীকে জনসমষ্টি বলা হয়। জনসমষ্টির বৈশিষ্ট্য হলো, ব্যক্তি জনসমষ্টির মধ্যে পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে।”
জনসমষ্টির বিভিন্ন সংজ্ঞার আলোকে বলা যায়, জনসমষ্টি এমন এক মানব গোষ্ঠী যা ক. অঞ্চল ভিত্তিক, খ. যার সদস্যদের মধ্যে অঞ্চলভিত্তিক একাত্ববোধ রয়েছে, যা তাদের অন্যান্য অঞ্চল হতে স্বতন্ত্র করে, গ. যার মাধ্যমে সদস্যরা সকল সামাজিক উদ্দেশ্য ও অভাব পূরণ করে। জনসমষ্টির উদাহরণ হিসেবে প্রাক-বৃটিশ আমলের স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামগুলোর কথা উল্লেখ করা যায়। যেখানে গ্রামবাসীর সামাজিক জীবন পরিপূর্ণ ছিল এবং কারো সামাজিক অনুশাসন অমান্য করার সাহস ছিল না। বর্তমানে বৃহৎ জনসমষ্টির প্রতীক হলো শহর এবং ক্ষুদ্র সমষ্টি হলো গ্রাম।
জনসমষ্টির বৈশিষ্ট্য
সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার জনসমষ্টির মূল ভিত্তি হিসেবে নির্দিষ্ট অঞ্চল এবং সমষ্টিচেতনা এ দু’টিকে উল্লেখ করেছেন। জনসমষ্টির বিভিন্ন সংজ্ঞার আলোকে এর নিচের বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠে।
ক. জনসমষ্টি হলো সাধারণত একই অঞ্চলে বসবাসকারী অন্তরঙ্গ মানবগোষ্ঠী।
খ. সমষ্টিভুক্ত সকলেই বিশেষ অঞ্চলের অধিবাসী, যা অন্যান্য অঞ্চল হতে কিছুটা স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী।
গ. জনসমষ্টির জনগণের মধ্যে সমষ্টিগত মানসিকতা রয়েছে। পারস্পরিক সহানুভূতি, মমত্ববোধ, স্বাতন্ত্র্যবোধ, একতাবোধ প্রভৃতি উপাদানের সমন্বয়ে সমষ্টিচেতনা বা মানসিকতার সৃষ্টি হয়।
ঘ. সমষ্টিভুক্ত সকলেই যৌথ জীবনের অংশীদার এবং যৌথ জীবনের মধ্যে তারা একসঙ্গে বাস করে।
ঙ. জনসমষ্টি হলো স্বয়ংসম্পূর্ণ স্থায়ী গোষ্ঠী, যার মাধ্যমে জনগণের সকল প্রয়োজন ও অভাব পূরণ হয়। অর্থাৎ সামগ্রিক জীবন বিবৃত হয়।
চ. জনসমষ্টির আয়তন ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ উভয় ধরনের হতে পারে।
জনসমষ্টির প্রাকৃতি
গঠন কাঠামো ও প্রকৃতির দিক হতে জনসমষ্টি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। পি. ফ্যালিন “দ্যা কমিউনিটি এন্ড দ্যা সোস্যাল ওয়ার্কার” (১৯৯৫) গ্রন্থে বলেছেন, যখন একদল লোক একই সাধারণ এলাকায়, অভিন্ন স্বার্থ, পরিচিতি, সংস্কৃতি ও কার্যক্রমের ভিত্তিতে একটি সামাজিক একক গঠন করে, তখন জনসমষ্টির উদ্ভব ঘটে। তিনি এলাকা পরিচিতি বা স্বার্থ এবং ব্যক্তিগত কর্মবেষ্টনীর ভিত্তিতে তিনটি দিক হতে জনসমস্টিকে শ্রেণীবিভাগ করেছেন। তিন ধরনের জনসমষ্টির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো-
পৃষ্ঠা ৯৭
ক. ভৌগলিক বা আঞ্চলিক জনসমষ্টি : ভৌগলিক বা আঞ্চলিক জনসমষ্টিগুলোতে জনগণের চাহিদা পূরণ, সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার ধরন, সমষ্টিগত পরিচিতি প্রভৃতির মধ্যে পার্থক্য থাকে। স্থানীয় জনসমষ্টিগুলো প্রায়শঃ নেইবারহুড্স ‘সিটিস’, ‘টাউনস্’ নামে আখ্যায়িত হয়। ছোট ছোট আঞ্চলিক জনসমষ্টিগুলো অন্যান্য বৃহৎ জনসমষ্টির সঙ্গে যেমন নেইবারহুড্স জনসমষ্টিগুলো শহর জনসমষ্টি অন্তর্ভুক্ত হয়। অতীতে যখন মানুষের গতিশীলতা কম ছিল এবং প্রযুক্তিগত দিক হতে সমাজ অনুন্নত ছিল, তখন জনসমষ্টি আঞ্চলিক বা এলাকাভিত্তিক ছিল। বর্তমান যুগে আঞ্চলিক বা ভৌগলিক সীমানার পাশাপাশি অন্যান্য সীমাহীন অদৃশ্য শক্তির প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে জনসমষ্টি প্রত্যয়টি ব্যাখ্যা করা হয়।
খ. পরিচিতি এবং স্বার্থবাহী জনসমষ্টি : পরিচিতি এবং স্বার্থবাহী জনসমষ্টিগুলোর জন্য ভৌগোলিক বা আঞ্চলিক ভিত্তির প্রয়োজন নেই। মনীষী পি. ফ্যালিন এরূপ সমষ্টিকে ‘নট প্লেস’ জনসমষ্টি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যান্য মনীষীগণ এরূপ জনসমষ্টিকে ‘ফাংশনাল কমিউনিটিস, রিলিশনাল অর এসোসিয়েশানাল কমিউনিটিস, কমিউনিটিস অফ এফিলিয়েশন অর এফিলিয়েটি কমিউনিটিস অফ দ্যা মাইন্ড’ ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করেছেন। এরূপ নির্দিষ্ট ভৌগলিক এলাকাহীন বা কার্যনির্বাহী ভিত্তি হলো সংস্কৃতি, বর্ণ, ধর্ম, জীবনধারা, আদর্শ, লিঙ্গ পরিচিতি, সামাজিক শ্রেণী এবং পেশাগত পরিচিতি।
কার্যনির্বাহী জনসমষ্টির ভিত্তি হলো জনসমষ্টির অন্তর্ভুক্ত জনগণের পরিচিতি এবং স্বার্থ। অভিন্ন সাধারণ বিষয়কে কেন্দ্র করে এরূপ জনসমষ্টি গঠিত হয়।
গ. ব্যক্তিগত কর্মবেষ্টনীভিত্তিক বা ব্যক্তিগত সদস্যভুক্তি বহুমুখী সম্পর্কভিত্তিক জনসমষ্টি : এ জাতীয় সমষ্টিগুলো বহুমুখী ব্যক্তিগত সম্পর্কের অর্থাৎ ব্যক্তির একাধিক জনসমষ্টির সদস্যলাভের ভিত্তিতে গড়ে উঠে। আধুনিক জটিল ব্যবস্থায় মানুষ আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে এবং আঞ্চলিকতার বাইরে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন সম্পর্ক গড়ে তুলে। যেমন একজন পেশাদার সমাজকর্মী, জাতীয় সমাজকর্মী সমিতির সদস্য (যা স্থানবিহীন জনসমষ্টি) যিনি কোন একটি প্রতিবেশি জনসমষ্টিতে (যা স্থানভিত্তিক জনসমষ্টি) বাস করেন এবং তার আশেপাশে যারা বসবাস করছে তাদের সঙ্গে একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। কারণ প্রত্যেক ব্যক্তির সামাজিক সম্পর্কের একটা জনসমষ্টিগতরূপ বা বহুমুখী সম্পর্কের সমাবেশ রয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে জনসমষ্টির বিভিন্ন সম্পর্ক বা ভিন্ন ভিন্ন পরিচিতি রয়েছে।
সুতরাং বলা যায় জনসমষ্টি হলো এক অন্তরঙ্গ মানবগোষ্ঠী। যে মানবগোষ্ঠীর মধ্যে আঞ্চলিক একাত্মবোধ এবং বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে উঠা সংহতি বিদ্যমান। জনসমষ্টি ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ উভয় ধরনের হতে পারে। জনসমষ্টি যেমন অঞ্চলিক ভিত্তিক হতে পারে, তেমনি অঞ্চলহীন অর্থাৎ সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে উঠতে পারে।
জনসমষ্টির উপাদান
ভৌগলিক এলাকা, সমষ্টি চেতনা ছাড়াও জনসমষ্টি গঠনের কতগুলো অপরিহার্য উপাদান রয়েছে। কোন বিশেষ জনগোষ্ঠীকে সমাজতাত্ত্বিক দিক হতে জনসমষ্টি বলা যাবে কিনা, তা এসব উপাদান আলোকে নির্ধারিত হয়।
জনসমষ্টির প্রধান উপাদানগুলো মনীষীদের বক্তব্যের আলোকে নিচে আলোচনা করা হলো।
১. একটি জনগোষ্ঠী : গোষ্ঠী এবং জনসমষ্টি অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। মূলত গোষ্ঠী ব্যতীত জনসমষ্টি গড়ে উঠতে পারে না। এজন্য সমাজতাত্ত্বিকগণ জনসমষ্টির অপরিহার্য উপাদান হিসেবে জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করেছেন। সাধারণ জীবন পদ্ধতির অংশীদার হিসেবে কোন ক্ষুদ্র বা বৃহৎ গোষ্ঠীর সদস্যগণ একত্রে বসবাস করলে তাকে জনসমষ্টি বলা হয়। মনীষী পি. ফ্যালিন তাঁর “দ্যা কমিউনিটি এন্ড দ্যা সোস্যাল ওয়ার্কার” (১৯৯৫) গ্রন্থে বলেছেন, যখন একদল মানুষ অভিন্ন এলাকা, স্বার্থ, পরিচিতি, সংস্কৃতি ও কার্যক্রমের ভিত্তিতে একটি সামাজিক একক গঠন করে তখন জনসমষ্টির আবির্ভাব ঘটে।
২. নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকা বা অঞ্চল : যখন একদল মানুষ একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাস শুরু করে তখন জনসমষ্টি গঠিত হতে পারে। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকইভার এবং পেজ জনসমষ্টির ভিত্তি হিসেবে অঞ্চল এবং জনসমষ্টিগত মানসিকতা এ দুটি মৌলিক উপাদানকে চিহ্নিত করেছে। তাঁরা বলেছেন, “দ্যা বেসিস অফ কমিউনিটি আর লুকেলিটি এন্ড কমিউনিটি সেন্টিম্যান্ট” -জনসমষ্টির ভিত্তি হলো অঞ্চল এবং জনসমষ্টি চেতনা। সুতরাং জনসমষ্টির সঙ্গে নির্দিষ্ট অঞ্চল অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। অঞ্চলের কারণেরই এক জনসমষ্টি অন্য জনসমষ্টি হতে পৃথক সত্তা ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। সুতরাং আঞ্চলিক আওতার ভিত্তিতে জনসমষ্টি জনগণের মধ্যে সমস্বার্থের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়।
পৃষ্ঠা ৯৮
৩. জনসমষ্টি মানসিকতা বা জনসমষ্টি চেতনা : জনসমষ্টির জনগণ এক অন্তরঙ্গ মানবগোষ্ঠী হিসেবে অবস্থান করে। অভিন্ন ও যৌথ জীবনের অংশীদার হিসেবে তারা জনসমষ্টিতে সামগ্রিক জীবন-যাপন করে। একই অঞ্চলে বসবাসের ফলে জনসমষ্টির জনগণের মধ্যে এক ধরনের সামগ্রিক অধিকারবোধ গড়ে উঠে। এ বোধ বা অনুভূতিই হলো জনসমষ্টি চেতনা বা জনসমষ্টি মানসিকতা, যা জনসমষ্টি গঠনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সহজ ভাবে বলা হয় “কমিউনিটি সেন্টিম্যান্ট মিন্স এ ফিলিং অফ বিলোংগিং টুগ্যাদার।”
সমাজতাত্ত্বিকগণ জনসমষ্টি মানসিকতার তিনটি উপাদানের উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো- ক. আমরাবোধ খ. ভূমিকা বোধ এবং গ. নির্ভরতাবোধ।
৪. ঘনিষ্ঠতা : জনসমষ্টির জনগণের মধ্যে এক প্রকার অভিন্নতা বা সাদৃশ্যবোধ বিরাজমান থাকে। অভিন্নতাবোধ জনসমষ্টির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত। জনসমষ্টির সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে ও বিভিন্ন দিকে সাদৃশ্য ও অভিন্নতাবোধ লক্ষ করা যায়। যেমন- ভাষা, রাজনীতি, আচার-আচরণ, ঐতিহ্য, প্রথা প্রভৃতির মধ্যেকার অভিন্নতার কথা উল্লেখ করা যায়। সমাজবিজ্ঞানী আরনল্ড গ্রীন বলেছেন “কমিউনিটি ইজ এ ক্লাসটিয়র অফ পিপল লিভিং উইথিং এ ন্যারো টেরিটোরিয়াল রেডিয়াস, হু শেয়ার এ কমোন ওয়ে অফ লাইফ অভিন্ন জীবনধারা জনসমষ্টির অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যা সমষ্টিকে স্বাতন্ত্র্য বা পৃথক সত্তা দান করে।
৫. স্থায়ীত্ব এবং নির্দিষ্ট শিরোনাম : জনসমষ্টির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো স্থায়ীত্ব এবং নির্দিষ্ট শিরোনাম। নির্দিষ্ট অঞ্চল এবং সমষ্টি চেতনার সঙ্গে স্থায়িত্ব থাকতে হবে। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্থায়ী জীবন ধারার মধ্য দিয়ে জনসমষ্টি গড়ে উঠে। জনসমষ্টি ভৌগোলিক বা আঞ্চলিক অবস্থানের পরিচয়বাহী একটি নির্দিষ্ট শিরোনাম থাকে, যা থেকেই জনসমষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়।
৬. স্বাভাবিকতা : সাধারণত জনসমষ্টি স্বাভাবিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। জনসমষ্টি সমাজব্যবস্থার একটা স্বাভাবিক সংগঠন। এটি কোন কৃত্রিম সংগঠন নয়। জনসমষ্টির উদ্দেশ্য ব্যাপক ও বিস্তৃত। জীবনের সার্বিক প্রয়োজন পূরণের শ্রতিশ্রুতি নিয়ে স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠে জনসমষ্টি। জনসমষ্টির লক্ষ্যণীয় একটি বৈশিষ্ট্য হলো এর কোন আইনগত ভিত্তি নেই। আইনের দিক হতে জনসমষ্টির কোন পৃথক পরিচিতি নেই। উদ্দেশ্যমূলক ভাবে আইনের দ্বারা জনসমষ্টি প্রতিষ্ঠা করা হয় না। আধুনিক সমাজে জনসমষ্টি চেতনার প্রকৃতি ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে। মানুষের বিচিত্র এবং জটিল চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে জনসমষ্টির প্রকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে।