পৃষ্ঠা ১৯১
নবম অধ্যায়
সমাজকর্ম পেশা ও বাংলাদেশে এর বিকাশ
ভূমিকা
সমাজকর্ম একটি সাহায্যকারী পেশা। তবে অনেকে সমাজকর্মকে একটি বিকাশমান পেশা হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে সমাজকর্ম পেশা কি-না তা মূল্যায়নের প্রেক্ষাপট হিসেবে পেশার সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য এবং মানদন্ড কি তা জানা প্রয়োজন। সুতরাং সমাজকর্মের পেশাগত মর্যাদা অর্জনের যথার্থতা মূল্যায়নের প্রারম্ভে পেশার সংজ্ঞা, পেশার মানদন্ড এবং পেশা ও বৃত্তির পার্থক্য আলোচনা করা প্রয়োজন।
পেশা কি ?
পেশার আভিধানিক অর্থ জীবিকা বা জীবন ধারণের বিশেষ উপায়। তবে সব জীবিকা বা জীবন ধারণের উপায়ই পেশা নয়। সহজ কথায়, যে জীবিকার উচ্চমানের বিশেষ তাত্ত্বিক শিক্ষা এবং ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের এবং যেখানে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও কল্যাণ প্রয়োজন তা-ই পেশা। মানব জ্ঞানের কোন একটি নির্দিষ্ট শাখায় উচ্চমানের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানার্জন করে, সে জ্ঞানকে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে অর্থাৎ জীবন ধারণের উপায় হিসেবে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করাকে এক কথায় পেশা বলা হয়।
সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী, ‘‘পেশা হলো নির্দিষ্ট সামাজিক প্রয়োজন বা চাহিদা পূরণে অভিন্ন সাধারণ মূল্যবোধ, দক্ষতা, কৌশল, জ্ঞান এবং বিশ্বাস অনুসরণ ও ব্যবহার করে এমন একদল জনগোষ্ঠী। আলোচ্য ব্যাখ্যানুযায়ী পেশা বলতে সমাজের বিশেষ কোন চাহিদা বা প্রয়োজন পূরণে সেবা প্রদানে নিয়োজিত উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে বুঝানো হয়েছে, যারা অভিন্ন মূল্যবোধ, জ্ঞান, দক্ষতা, বিশ্বাস, নীতি অণুশীলনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। যেমন চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকগণ।
এ.ই. বেন্ -এর সংজ্ঞানুযায়ী, ‘‘পেশা হলো অন্যকে নির্দেশনা, পরিচালনা বা উপদেশ প্রদানের এমন একটি জীবিকা, যার জন্য বিশেষ জ্ঞানার্জন করতে হয়’’।
মূলত পেশা বলতে বিশেষ কোন বিষয়ে নির্দিষ্ট জ্ঞান, দক্ষতা, নৈপুণ্য এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বৃত্তিকে বুঝায়। প্রত্যেক পেশার কতগুলো বৈশিষ্ট্য ও মূল্যবোধ থাকে, যেগুলো এক পেশাকে অন্য পেশা হতে পৃথক সত্তা দান করে। পেশাগত কাজ প্রযুক্তি সম্পন্ন এবং পেশাদার ব্যক্তিদের কতিপয় পেশাগত নীতি ও মূল্যবোধ মেনে চলতে হয়। যেমন চিকিৎসা পেশা, আইন পেশা, প্রকৌশল ইত্যাদি।
পেশার বৈশিষ্ট্য
যে কোন বৃত্তি বা জীবিকা নির্বাহের উপায়কে পেশার মর্যাদা অর্জন করতে হলে তার মধ্যে কতগুলো সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকা অপরিহার্য। এসব বৈশিষ্ট্যের আলোকে কোন বৃত্তি পেশার মর্যাদা অর্জন করেছে কি-না তা মূল্যায়ন করা হয়। এজন্য এগুলোকে পেশার মানদন্ড বলা হয়।
পেশার মানদন্ড সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। বৃত্তি সম্পর্কিত সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আলোকে সমাজবিজ্ঞানী আর্নেস্ট গ্রীনউড পেশার নিচের স্বতন্ত্র পাঁচটি গুণ বা বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন।
১. সুশৃঙ্খল জ্ঞান বা তত্ত্ব;
২. পেশাগত কর্তৃত্ব;
৩. সমাজের স্বীকৃতি;
৪. পেশাগত নৈতিক মানদন্ড;
৫. পেশাগত সংস্কৃতি বা সংগঠন;
সমাজবিজ্ঞানী উইলিয়াম ই. উইকেনডেন পেশার ছয়টি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো-
১. বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও নৈপুণ্য বা দক্ষতা;
২. বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও দক্ষতার ভিত্তিতে পরিচালিত শিক্ষা কার্যক্রম;
৩. পেশাগত যোগ্যতা, নৈপুণ্য এবং চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে পেশার অন্তর্ভুক্ত হওয়া;
৪. পেশাগত নীতি এবং মূল্যবোধ, যার মাধ্যমে পেশাদার ব্যক্তির সামগ্রিক পেশাগত সম্পর্ক ও আচার-আচরণ পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়;
পৃষ্ঠা ১৯২
৫. রাষ্ট্র বা সহকর্মীদের দ্বারা পেশাগত মর্যাদার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি;
৬. পেশাগত সংগঠন।
মনীষী চার্লস ডি গার্ভিন তাঁর “সোস্যাল ওয়ার্ক ইন কনটেমপোৠরি সোসাইটি” (১৯৯৮) গ্রন্থে পেশার বিভিন্ন সংজ্ঞা বিশেষণ করে আটটি মানদন্ড নির্ধারণ করেছেন। এগুলো হলো-
১. সুশৃঙ্খল জ্ঞান;
২. তাত্ত্বিক ভিত্তি;
৩. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশিক্ষণ;
৪. উপার্জনশীল;
৫. পেশাগত নিয়ন্ত্রণ;
৬. আদর্শগত ও নৈতিক নিয়ন্ত্রণ;
৭. পরিমাপযোগ্য বা পর্যবেক্ষণযোগ্য ফল;
৮. উচ্চ পর্যায়ের পেশাগত দক্ষতা;
মনীষী গারভিন ঝূঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সংরক্ষণকে পেশার বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
পেশার বৈশিষ্ট্য ও মানদন্ড সম্পর্কে মনীষীদের মতামতের আলোকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ হতে পেশার সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো-
১. সুশৃঙ্খল জ্ঞান : প্রত্যেক পেশার নির্দিষ্ট বিষয়ে সুশৃঙ্খল সাধারণ জ্ঞান থাকতে হয়। পেশাগত জ্ঞান সংকলিত ও সমন্বিত হতে হয়। পেশাগত বই পুস্তক ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সংকলিত পেশাগত জ্ঞান পেশাদার ব্যক্তিদের মধ্যে সাধারণ জ্ঞান বলে বিবেচিত। যদি কোন বৃত্তিকে পেশার মর্যাদা অর্জন করতে হয়, তাহলে সংকলিত ও সমন্বিত সুশৃঙ্খল জ্ঞান এবং তা বাস্তব অনুশীলনের নৈপুণ্য ও দক্ষতা অর্জন করতে হয়। সুশৃঙ্খল জ্ঞান এবং সে জ্ঞানের অনুশীলন পেশার প্রধান বৈশিট্য।
২. তাত্ত্বিক ভিত্তি : সংকলিত ও সমন্বিত পেশাগত জ্ঞানের বৈজ্ঞানিক তথ্যসমৃদ্ধ তাত্ত্বিক ভিত্তি থাকতে হবে। চিকিৎসা, আইন, প্রকৌশল ইত্যাদি পেশার পেছনে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রধান ভূমিকা পালন করছে। তত্ত্ব পেশার অনুশীলনকে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। সব পেশাদার ব্যক্তির জন্য গভীর তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকা জরুরী। যেমন- যেসব সমাজকর্মী আচরণ সংশোধন ক্ষেত্রে সমাজকর্ম অনুশীলনে নিয়োজিত, তাদেরকে মানব আচরণ সংশ্লিষ্ট তত্ত্বাদি জানা প্রয়োজন। অনুরূপ জনসমষ্টি সংগঠনকর্মীকে, জনসমষ্টি সম্পর্কিত তত্ত্বাদি জানতে হয়।
৩. বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ : পেশাগত মর্যাদা অর্জনের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কলেজ পর্যায়ে সম্পন্ন হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা পেশাগত শিক্ষার মধ্যে বিদ্যমান থাকে।
৪. উপার্জনশীল : প্রত্যেক পেশাই সংশ্লিষ্ট পেশাদার ব্যক্তিকে পেশা অনুশীলনের মাধ্যমে উপার্জন বা জীবিকা নির্বাহের সুযোগ দেয়। পেশাগত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ আয়ের উৎস হিসেবে পেশাগত জ্ঞানকে বাস্তবে ব্যবহার করে। পেশাগত জ্ঞান অনুশীলনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ, পেশার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
৫. পেশাগত নিয়ন্ত্রণ : পেশাগত মর্যাদা লাভের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো পেশা অনুশীলনে নিয়োজিত ব্যক্তিদের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা। এরূপ নিয়ন্ত্রণ সাধারণত আইনগত উপায়ে করা হয়। বিধিবিধান ও আইনের মাধ্যমে পেশাগত পরিচিতি, প্রশিক্ষণ, অনুশীলন ইত্যাদি সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পেশাগত প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, যোগ্যতা ও মান বজায় রাখার জন্য আইনগত ব্যবস্থা থাকে। এ প্রসঙ্গে পেশাগত লাইসেন্স বা রেজিস্ট্রেশন প্রদানের বিষয় উল্লেখ করা যায়। এটি পেশাগত নিয়ন্ত্রণের আইনগত পদক্ষেপ।
৬. পেশাগত আদর্শ ও নৈতিক নিয়ন্ত্রণ : পেশার আদর্শ ও নৈতিক নিয়ন্ত্রণ বলতে পেশাগত আচরণের উচিত-অনুচিতের আদর্শগত ভিত্তিকে বুঝায়। আইনগত নিয়ন্ত্রণ পেশার অন্তর্ভুক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কিন্তু আইনগত নিয়ন্ত্রণ পেশাগত অনুশীলনের নৈতিকমান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। পেশাগত অনুশীলনের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন, পেশাগত আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য প্রত্যেক পেশার আদর্শিক ও নৈতিক নিয়ন্ত্রণ বলবত থাকে। সেবাগ্রহীতার স্বার্থের উর্ধ্বে পেশাদার ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্বার্থ যাতে প্রাধান্য না পায়, তা নিয়ন্ত্রণ করে পেশাগত নৈতিকতা। একজন চিকিৎসক ব্যক্তিগত আর্থিক স্বার্থে বা আর্থিক প্রয়োজনে এ্যাপেনডিক্স অপরেশনের পরামর্শ দিতে পারেন না। অনুরূপ আইন পেশায় নিয়োজিত
পৃষ্ঠা ১৯৩
একজন আইনজ্ঞ বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষ থেকে আর্থিক সুবিধা আদায়ের বিনিময়ে একসঙ্গে আইনী সহায়তা দিতে পারেন না। এ ধরনের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রত্যেক পেশার নৈতিক মানদন্ড ও পেশাগত মূল্যবোধ থাকে।
৭. পরিমাপযোগ্য ও পর্যবেক্ষণযোগ্য ফলাফল : জীবন ধারণের উপায়কে পেশার মর্যাদা অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ মানদন্ড হলো পেশা অনুশীলনের মাধ্যমে সম্পাদিত কাজ বা প্রদত্ত পেশাগত সেবা জনগণ দ্বারা যাচাই, পর্যবেক্ষণ অথবা পরিমাপযোগ্য হতে হবে। পেশাগত সেবার নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকতে হয়। যেমন আইন পেশার কাজ হলো আইনগত সেবা প্রদান এবং আইনগতভাবে বৈধ প্রত্যাশা অর্জনে সফলতা লাভ। চিকিৎসা পেশার লক্ষ্য হলো সুস্থ্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মাধ্যমে সুস্থ্যতা বজায় রাখা।
৮. উচ্চ পর্যায়ের দক্ষতা : পেশাদার কর্মসম্পাদনের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের দক্ষতা ও যোগ্যতা জড়িত। উচ্চ পর্যায়ের দক্ষতা পেশাদার ব্যক্তিকে স্বতন্ত্র ও পৃথকভাবে পেশাগত কর্ম সম্পাদনের যোগ্যতা দান করে। তবে বিশেষ দক্ষতা থাকলেই একজন পেশাগত মর্যাদা পাবে তা হয় না। যেমন একজন উন্নতমানের দক্ষতাসম্পন্ন পানি মিস্ত্রী নিজেকে পেশাগত মর্যাদার অধিকারী বলতে পারেন না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশিক্ষণ এবং তাত্ত্বিক জ্ঞান যেমন গণিত, হাইড্রলিক ধাতুবিদ্যাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ জ্ঞান সনাতন দক্ষ পানি মিস্ত্রী অর্জন করেনি। সুশৃঙ্খল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে বিশেষ ক্ষেত্রে অর্জিত তাত্ত্বিক জ্ঞান অনুশীলনের উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ পেশাগত মর্যাদার অধিকারী।
৯. সমস্যাগ্রস্ত ঝুঁকিপূর্ণদের সংরক্ষণ : প্রত্যেক পেশার ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাকে অরক্ষিত, ক্ষতিগ্রস্ত বা ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। একজন সমাজকর্মী বা চিকিৎসকের নিকট যখন সেবাগ্রহীতা বা রোগী আসেন, তখন তাকে সমস্যাগ্রস্ত এবং অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় সেবাগ্রহীতা পেশাদার ব্যক্তির নিকট আসেন এবং নিজের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বেশির ভাগ পেশার ক্ষেত্রেই লক্ষ্যভুক্ত জনগোষ্ঠী সমস্যাগ্রস্ত বা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। সুতরাং অরক্ষিতদের সংরক্ষণ পেশাগত মর্যাদার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।
উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বৃত্তিকে পেশা বলা যায়। এসব বৈশিষ্ট্যের অভাবে কোন বৃত্তি সত্যিকার অর্থে পেশার মর্যাদা অর্জন করতে পারে না।
পেশা ও বৃত্তির পার্থক্য
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী পেশা এবং বৃত্তি এক অর্থে ব্যবহার করা হয়। বাহ্যিক দিক হতে পেশা এবং বৃত্তিকে সম-অর্থবোধক মনে হলেও উভয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।
পেশা বলতে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য, দক্ষতা, নৈপুণ্য এবং বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন বৃত্তিকে বুঝায়। পেশার কতগুলো বৈশিষ্ট্য এবং মূল্যবোধ থাকে, যেগুলো এক পেশাকে অন্য পেশা হতে পৃথক সত্তা দান করে। যেমন, চিকিৎসকের চিকিৎসা, উকিলের ওকালতি ইত্যাদি হলো পেশা।
আর বৃত্তি বলতে জীবন ধারণের সাধারণ উপায় বা অবলম্বনকেই বুঝানো হয়। এর জন্য তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের অপরিহার্যতা নেই। যেমন- কুলি, মজুর, অদক্ষ কৃষক, গৃহভৃত্য, মাঝি- মাল্লার জীবন ধারণের উপায় ইত্যাদি।
বৃত্তি হচ্ছে জীবন ধারণের সাধারণ উপায়, যার জন্য কোন বিশেষ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা দক্ষতা অর্জন করতে হয় না। কিন্তু পেশার জন্য নির্দিষ্ট বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান এবং পেশাগত দক্ষতা অর্জন অপরিহার্য।
কোন পেশাদার ব্যক্তি ইচ্ছা করলেই পেশা পরিবর্তন করতে পারেন না। যেমন- একজন চিকিৎসক ইচ্ছা করলে আইনজীবী হতে পারেন না। অন্যদিকে বৃত্তি সহজে পরিবর্তন করা যায়। যেমন- একজন দিন মজুর ইচ্ছা করলে তার বৃত্তি পরিবর্তন করে অদক্ষ কৃষি শ্রমিক বা রিক্সাচালক হতে পারে।
পেশার সঙ্গে যে যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রশ্নটি জড়িত, তা একজন সাধারণ বৃত্তিজীবী শ্রমিকের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। কারণ পেশাগত কাজ উচ্চতর জ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পন্ন এবং এর সামগ্রিক দিক সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হয়। পেশাদার ব্যক্তিকে পেশাগত নীতিমালা, পদ্ধতি, মূল্যবোধ মেনে চলতে এবং পেশাগত গুণাগুণ অর্জন করতে হয়, যা বৃত্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
সমাজকর্মের পেশাগত মর্যাদা
পেশাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। তবে পেশার সংজ্ঞার মধ্যে কতগুলো অভিন্ন সাধারণ বৈশিষ্ট্য বা উপাদান থাকে। এসব উপাদান পেশার মানদন্ড হিসেবে বিবেচিত। সার্বিক দৃষ্টিকোণ হতে পেশার সাধারণ মানদন্ডগুলো হলো-
১. সুশৃঙ্খল জ্ঞানভান্ডার;
২. তাত্ত্বিক ভিত্তি;
পৃষ্ঠা ১৯৪
৩. বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রশিক্ষণ;
৪. উপার্জনশীলতা;
৫. অনুশীলনবিদদের ওপর পেশাগত নিয়ন্ত্রণ;
৬. পেশাগত কার্যক্রমের ওপর অভ্যন্তরীণ পেশাগত নৈতিক নিয়ন্ত্রণ;
৭. পরিমাপযোগ্য অথবা পর্যবেক্ষণযোগ্য ফলাফল;
৮. উচ্চ পর্যায়ের দক্ষতা;
৯. অরক্ষিতদের সংরক্ষণ;
১০. পেশাগত কর্তৃত্ব;
পেশার উপরিউক্ত উপাদান ও মানদন্ডের নিরিখে সমাজকর্মের পেশাগত মর্যাদার যৌক্তিকতা এখানে আলোচনা করা হলো-
১. সুশৃঙ্খল জ্ঞানভান্ডার : প্রতিটি পেশার সুশৃঙ্খল এবং প্রচারযোগ্য জ্ঞান থাকতে হয়। সমাজকর্মের সুনির্দিষ্ট জ্ঞানভান্ডার রয়েছে, যে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে সমাজকর্মীদের পেশাগত যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। সমাজকর্মীদের সামাজিক সমস্যা, মানবীয় আচার-আচরণ, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধ এবং সমাজকর্মের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক জ্ঞানার্জন করতে হয়। এসব জ্ঞান অনুশীলনের জন্য সমাজকর্মের নিজস্ব আর্ট ও প্রয়োগ কৌশল রয়েছে। সুতরাং পেশার প্রধান বৈশিষ্ট্য বিশেষ জ্ঞান ও যোগ্যতা সমাজকর্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
২. তাত্ত্বিক ভিত্তি : পেশাগত জ্ঞান অবশ্যই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বভিত্তিক হয়। বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে গড়ে উঠা তাত্ত্বিক কাঠামো পেশাগত জ্ঞানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
সমাজকর্মের অনুশীলনে বিভিন্ন ধরনের তত্ত্ব ব্যবহার করা হয়। তাত্ত্বিক কাঠামো ছাড়া সমাজকর্মীরা সামাজিক ঘটনা ও বিষয়বস্ত্তকে বাস্তবতার আলোকে বিশ্লেষণ করতে পারে না। সমাজকর্মীরা যেসব ক্ষেত্রে পেশাগত সেবা প্রদানে নিয়োজিত, সেসব ক্ষেত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তত্ত্ব ব্যবহার করে থাকে। যেমন অস্বাভাবিক আচরণ সংশোধন ও পরিবর্তনে নিয়োজিতদের বিভিন্ন ধরনের মনোঃসামাজিক ও শিক্ষণ তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে হয়। বাস্তবতার আলোকে সমস্যা বিশ্লেষণ ও সমাধানের নির্দেশনা লাভে সমাজকর্মীদের তত্ত্ব সাহায্য করে।
৩. বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রশিক্ষণ : পেশার মর্যাদা অর্জনের জন্য অবশ্যই কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হয়। সমাজকর্মের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের জন্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নির্দিষ্ট শিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে। বিশ্বের সকল দেশে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সমাজকর্ম শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। বিশ্বব্যাপী সমাজকর্ম শিক্ষার উন্নয়ন এবং দক্ষ সমাজকর্মী গড়ে তোলার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সিলেবাস অনুযায়ী সমাজকর্ম শিক্ষা কার্যক্রম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচালিত হচ্ছে।
৪. উপার্জনশীল : পেশার মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো যেকোন ব্যক্তি অর্জিত পেশাগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ অনুশীলন করে জীবন ধারণের জন্য উপার্জন করতে পারে। পেশাগত জ্ঞান দক্ষতার সঙ্গে অনুশীলন করে জীবনধারণ করা পেশাগত মানদন্ডের অন্তর্ভুক্ত। মানবসেবা প্রদানকারী পেশাদার সমাজকর্মীরা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সেবা প্রদান করে। অর্থাৎ সমাজকর্মকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ রয়েছে।
৫. অনুশীলনবিদদের পেশাগত নিয়ন্ত্রণ : প্রত্যেক পেশার অন্তর্ভুক্ত পেশাদার ব্যক্তিদের আচার-আচরণ ও অনুশীলন কার্যক্রমের ওপর পেশাগত নিয়ন্ত্রণ থাকতে হয়।
সমাজকর্ম মানবসেবা প্রদানকারী পেশাগত কার্যক্রম। পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সামাজিক ভূমিকা পালনে মানুষকে সহায়তা করা সমাজকর্মের মূল লক্ষ্য। এরূপ জনকল্যাণমুখীতা সমাজকর্মকে বিশ্বব্যাপী পেশার মর্যাদা অর্জনে সাহায্য করেছে। সমাজকর্মীদের পেশাগত আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, জার্মানী, সুইডেন ইত্যাদি উন্নত দেশে পেশাগত লাইসেন্স দানের মাধ্যমে অন্যান্য পেশার মতো সমাজকর্মকেও পেশা হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়। সমাজকর্মে রেজিষ্ট্রেশন ও সার্টিফিকেট প্রদান করে পেশাগত নিয়ন্ত্রণ বলবত করা হয়।
৬. পেশাগত সংগঠন : পেশাগত সংগঠন পেশার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিশ্বের প্রায় সবদেশে পেশাগত নিয়ন্ত্রণ, সমাজকর্ম পেশার মান উন্নয়ন এবং স্বার্থ সংরক্ষণে সমাজকর্মের পেশাগত সংগঠন রয়েছে। পেশাগত সংগঠন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাজকর্ম পেশার মান নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন এবং
পৃষ্ঠা ১৯৫
পেশাদার সমাজকর্মীদের স্বার্থ সংরক্ষণে নিয়োজিত রয়েছে। সমাজকর্ম পেশায় নিয়োজিত সমাজকর্মীরা পেশার স্বার্থ সংরক্ষণ এবং পেশার মান নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নে সদা সচেষ্ট।
৭. পেশাগত কার্যক্রমের ওপর অভ্যন্তরীণ বা নৈতিক নিয়ন্ত্রণ : অন্যান্য পেশার মতো সমাজকর্মের নৈতিক মানদন্ড রয়েছে। যেগুলো পেশাদার সমাজকর্মীদের পেশাগত আচার-আচরণ ও কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। সমাজকর্ম পেশায় নিয়োজিতদের এসব নৈতিক মানদন্ড ও ব্যবহারিক নীতিমালা যথাযথ অনুসরণ করতে হয়।
আন্তর্জাতিক সমাজকর্মী ফেডারেশন প্রণীত সমাজকর্মের নৈতিক মানদন্ড বিশ্বব্যাপী অনুসরণ করা হয়। এসব নৈতিক মানদন্ডের আওতায় প্রত্যেক দেশের জাতীয় সমাজকর্মী সমিতি পেশাদার সামজকর্মীদের পেশাগত আচরণ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
৮. পরিমাপযোগ্য বা পর্যবেক্ষণযোগ্য ফলাফল : পেশার এরূপ বৈশিষ্ট্য সমাজকর্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সমাজকর্ম সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পেশাগত সেবা প্রদান করে। ব্যক্তি, দল ও জনসমষ্টি পর্যায়ে সমাজকর্ম অনুশীলনে নিয়োজিত সমাজকর্মীরা সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত লক্ষ্যে সেবা প্রদান করে। জনকল্যাণমুখী পেশা হিসেবে সমাজকর্মের ফলাফল পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপযোগ্য। সমাজকর্মীরা পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা অনুশীলনের মাধ্যমে যে সেবা প্রদান করে তার ফলাফল ব্যক্তিগত, দলীয় বা জনসমষ্টিগত পর্যায়ে পরিমাপযোগ্য। মূল্যায়ন গবেষণা ও জরিপের মাধ্যমে ফলাফল যাচাইয়ের ব্যবস্থা সমাজকর্মে রয়েছে।
৯. উচ্চ পর্যায়ের দক্ষতা : পেশাগত তাত্ত্বিক জ্ঞানকে বাস্তবে অনুশীলনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ফল লাভের নৈপুণ্য হলো দক্ষতা, যা পেশাদার ব্যক্তির জন্মগত প্রতিভা ও পেশাগত জ্ঞানের সমন্বয়ে অর্জিত হয়। পেশাগত যোগ্যতার অর্থ হলো পেশাগত দায়িত্ব সর্বোত্তম পর্যায়ে পালন করা। সমাজকর্ম মানবসেবায় নিয়োজিত একটি পেশাদারী কার্যক্রম। সমাজকর্ম মানব আচরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট; আর মানব আচরণ সদা পরিবর্তনশীল। সর্বোচ্চ পর্যায়ের যোগ্যতা সহকারে সমাজকর্মীদের মানবসেবায় নিয়োজিত হতে হয়।
১০. পেশাগত কর্তৃত্ব : পেশার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো পেশাগত কর্তৃত্ব। পেশাদার ব্যক্তি উচ্চতর জ্ঞান এবং দক্ষতার অধিকারী বিধায়, সাধারণ সেবাগ্রহীতার ওপর কর্তৃত্ব থাকে। এপ্রসঙ্গে মনীষী ট্যালকট পারসন্স-এর বক্তব্য হলো, “বাই ভার্চু অফ এক্সপার্টাইজ এন্ড নলেজ দ্যা প্রোফেশনাল হেজ অথারিটি অভার দ্যা লে পার্সন”। মান সমাজকর্মীগণ পেশাগত কর্তৃত্ব অর্জনে সক্ষম হয়েছে। সমাজকর্মীরা অন্যান্য পেশাদার ব্যক্তি এবং সমস্যাগ্রস্ত সেবাগ্রহীতা ও সুবিধাভোগী কর্তৃক সম্মান অর্জনে সক্ষম হচ্ছেন। মনোচিকিৎসা, হাসপাতাল সমাজসেবা, স্কুল সমাজকর্ম, শিশুকল্যাণ, অপরাধ সংশোধন, শ্রমকল্যাণ ইত্যাদি কার্যক্রমে সমাজকর্মীরা পেশাগত স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে ভূমিকা পালন করেন।
উপরিউক্ত আলোচনা হতে স্পষ্ট হয়ে উঠে, পেশার সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য ও মানদন্ড সমাজকর্মে বিদ্যমান। বর্তমানে সমাজকর্ম আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি মানবসেবা প্রদানকারী পেশা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্সাস ব্যুরো অন্যান্য পেশার মতো সমাজকর্মকেও পৃথক পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, পেশাগত দক্ষতা এবং মানবহিতৈষী দর্শনের ওপর ভিত্তিশীল একটি সাহায্যকারী পেশা হিসেবে সমাজকর্মকে সংজ্ঞায়িত করে থাকেন। পেশাগত মর্যাদার স্বীকৃতি পাবার সার্বিক শর্তগুলো পূরণ করায় মনীষী রেক্স স্কীডমোর বলেছেন, সমাজকর্ম একটি পেশা, কারণ পেশার সব গুণাবলীই এটি পূরণ করছে।
পৃষ্ঠা ১৯৬
পেশা হিসেবে সমাজকর্মের দুর্বলতা
সামগ্রিকভাবে সমাজকর্ম পেশাগত মর্যাদার দিকে উন্নতি করলেও কয়েকটি দিকে উন্নতির প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন। সমাজকর্মের অধিক সুসমন্বিত তত্ত্বের উন্নয়ন প্রয়োজন। তাছাড়া সুনির্দিষ্ট মানদন্ডের আলোকে সমাজকর্ম অনুশীলনের ফলাফল যাচাইয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এসব দুর্বলতার কারণে অনেকের মন্তব্য হলো, সমাজকর্ম পেশাগত উন্নয়নের বিকাশমান পর্যায়ে রয়েছে।
পাশ্চাত্যের উন্নত সমাজে সমাজকর্ম একটি সাহায্যকারী পেশা হিসেবে স্বীকৃত। তবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার বিভিন্নতার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে সমাজকর্মকে পৃথক পেশার স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এর প্রধান কারণ ক. পেশাদার সামজকর্ম সম্পর্কে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা খ. অর্থনৈতিক সমস্যার প্রকটতা গ. সমাজকর্ম শিক্ষার সীমাবদ্ধতা ঘ. মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতাজনিত সমস্যার তীব্রতা এবং ঙ. পেশাগত সংগঠন ও নৈতিক মানদন্ডের অভাব। তাসত্বেও বিশ্বের অনুন্নত ও দরিদ্র দেশের পরিকল্পিত পরিবর্তন সাধনের প্রক্রিয়া হিসেবে পেশাদার সমাজকর্মের বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে।
আধুনিক সমাজকল্যাণের ইতিহাস |
সামাজিক জীব হিসেবে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার ভিত্তিতে বসবাস করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এরূপ সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের সমাজবদ্ধ জীবন ব্যবস্থাই হলো সমাজকল্যাণের সর্বজনীন প্রেরণা এবং উৎস। প্রাকশিল্প যুগে মানুষের পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যে সেবামূলক প্রচেষ্টা চালানো হতো তাকে সমাজকল্যাণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। শিল্প বিপ্লবের পর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার প্রসারের ফলে দ্রুত শিল্পায়ন এবং নগরায়ন প্রক্রিয়া শুরু হলে সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। সমাজ জীবন জটিল আকার ধারণ করে। ফলে সমাজে বহুমুখী জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়। এসব জটিল সমস্যা মোকাবেলায় সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথা-প্রতিষ্ঠান অকার্যকর হয়ে পড়ে। যা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ভিত্তিক আধুনিক সমাজকল্যাণের প্রয়োজন সৃষ্টি করে। মনীষী নোয়েল টাইম্স যথার্থই বলেছেন, আধুনিক সমাজকর্ম আধুনিক সমাজ ব্যবস্থারই ফল।
শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সৃষ্ট জটিল সমস্যা আধুনিক সমাজকল্যাণের প্রয়োজন সৃষ্টি করে। তবে সমাজকর্মকে পেশার পর্যায়ে উপনীত হতে বিশেষ কতগুলো ঘটনা কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এসব ঘটনাগুলোর মধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকায় গণতান্ত্রিক আদর্শের বিকাশ, দান সংগঠন আন্দোলন, ১৮৭৩ সালে আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দা, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯২৯ সালের আমেরিকার চরম অর্থনৈতিক মন্দা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ইংল্যান্ডে ১৩৪৯ সালে প্রণীত শ্রমিক আইন হতে শুরু করে ১৯৪১ সালের বিভারিজ রিপোর্ট পর্যন্ত আইনগুলো সমাজকর্ম পেশার বিকাশে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। সমাজকল্যাণের সুসংগঠিত রূপদানে ইংল্যান্ডের অবদান অধিক হলেও পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশ আমেরিকাতে পরিপূর্ণতা লাভ করে।
ইংল্যান্ডের দান সংগঠন সমিতির অবদান
আধুনিক তথা পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশে ইংল্যান্ড ও আমেরিকার দান সংগঠন সমিতির (সিওএস) অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। সনাতন সমাজকল্যাণ ধারাকে বৈজ্ঞানিক রূপদান এবং পেশার পর্যায়ে উপনীত করতে দান সংগঠন সমিতি (সিওএস) অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৮৬৯ সালে ইংল্যান্ডে এবং ১৮৭৭ সালে আমেরিকায় দান সংগঠন সমিতি (সিওএস) গঠিত হয়। এ সমিতির মূল লক্ষ্য ছিল বিচ্ছিন্ন ও অসংগঠিত ত্রাণ কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। মনীষী থমাস চালমার্স প্রদত্ত তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে সিওএস-এর নীতি গড়ে উঠেছিল। ‘‘দরিদ্রতার জন্য দরিদ্র ব্যক্তি নিজেই দায়ী, দান ব্যক্তির আত্মমর্যাদা ধ্বংস করে এবং দানের ওপর নির্ভরশীল করে তুলে।’’ চালমার্সের এই তত্ত্বের ভিত্তিতে সিওএস পরিচালিত হয়। ইংল্যান্ডের দান সংগঠন সমিতি ক. ত্রাণ কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় সাধন, খ. সাহায্য গ্রহণের পুনরাবৃত্তি রোধ, গ. দরিদ্রদের পুনর্বাসন এবং ঘ. ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সাহায্যদানের মাধ্যমে সমাজকর্মের মৌলিক পদ্ধতি ব্যক্তি সমাজকর্ম ও সমষ্টি সংগঠনের ভিত রচনা করে। এভাবে সিওএস সমাজকল্যাণকে সুসংগঠিত রূপদান করে।
১৮৭৭ সালে ইংল্যান্ডের অনুকরণে আমেরিকাতে সিওএস গঠিত হয়, যা সমাজকর্ম পেশার উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে।
সমাজকর্মে পেশাগত শিক্ষার বিকাশ
ঊনবিংশ শতাব্দীর দুঃস্থ অসহায়দের অবস্থার উন্নয়ন, সামাজিক আইনের আওতায় সমাজসংস্কার সাধন এবং জনগণের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে গড়ে উঠা মানবতাবাদী আন্দোলন সমাজকর্ম পেশার বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ইংল্যান্ড আমেরিকায় দান সংগঠন আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৬৯ সালে ইংল্যান্ডে এবং ১৮৭৭ সালে আমেরিকাতে দান সংগঠন সমিতি গঠিত হয়। দান সংগঠন সমিতির কার্যক্রম সমাজকল্যাণকে পেশাগত মর্যাদা দানে
পৃষ্ঠা ১৯৭
কার্যকর ভূমিকা পালন করে। আমেরিকার দান সংগঠন সমিতির কিছু সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবীগণ সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধানের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজহিতৈষী চিন্তাবিদগণ বিজ্ঞানসম্মত সমাজসেবা কার্যক্রম পরিচালনার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। সমাজকর্মের পেশাগত শিক্ষার সর্বপ্রথম প্রস্তাব উত্থাপন করেন এনা এল. ডয়েস। ১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলন “ইন্টারন্যাশনাল কনগ্রেস অফ চারিটিস কারেকশন্স এন্ড পিলিনথরাপি” সমাজকর্মের পেশাগত শিক্ষার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৮৯৭ সালে ম্যারী রিচমন্ড ‘ট্রেনিং স্কুল অর এপেলিয়েড পিলিনথরাপি’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৯৯৮ সালে ঐ স্কুল এবং নিউইয়র্কের দান সংগঠন সমিতি সমাজসেবায় নিয়োজিত কর্মীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ছয় সপ্তাহের প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করে। যার মাধ্যমে সমাজকর্মের পেশাগত শিক্ষার সূচনা হয়।
পরবর্তীকালে এটি ছয় মাসের কোর্সে উন্নীত করা হয়। এই শিক্ষা কোর্সই পর্যায়ক্রমে ‘নিউ ইয়ার্ক স্কুল অফ সোস্যাল ওয়ার্ক’ উন্নীত হয়। ১৯৪০ সালে এটি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করে। ১৯৬৩ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ সোস্যাল ওয়ার্ক’ রাখা হয়। ১৯১০ সালের মধ্যে আমেরিকার বড় বড় পাঁচটি শহরে স্কুল অফ সোস্যাল ওয়ার্ক’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকে পেশা হিসেবে সমাজকর্মের উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটে। সমাজকর্মের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর পূর্বে সমাজকর্মীরা বিভিন্ন এজেন্সীর নির্বাহী ও অভিজ্ঞ সমাজসেবা বিশারদদের অধীনে শিক্ষানবীশ হিসেবে সমাজ সেবার ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করত। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় সরকার অনুমোদিত সমাজকর্মের পেশাগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮৮টিতে উন্নীত হয়েছিল।
বিশ্বব্যাপী সমাজকর্মের পেশাগত শিক্ষার বিকাশে আমেরিকা এবং জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৫২ সালে আমেরিকায় ‘কউন্সিল অন সোস্যাল ওয়ার্ক এডুকেশন করা হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাজকর্ম শিক্ষার বিকাশে কাউন্সিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাজকর্ম শিক্ষার মান উন্নয়ন, পাঠ্যবিষয় প্রণয়ন ও পর্যালোচনা, গবেষণা ও প্রকাশনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে ‘ইন্টান্যাশনাল এসোসিয়্যাশন অফ স্কুল অফ সোস্যাল ওয়ার্ক- আই.এ.এস.এস.ডাব্লিউ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিষয়ের সিলেবাস প্রণয়ন এবং ডিগ্রীর স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। ১৯৫০ সালের দিকে আমেরিকায় সমাজকর্ম শিক্ষা কার্যক্রম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। জাতিসংঘের সহযোগিতায় আমেরিকার সমাজকর্ম বিশেষজ্ঞগণ বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে সমাজকর্ম শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৩৬ সালে বৃটিশ শাসিত ভারতে আমেরিকার মিশনারীদের সহযোগিতায় বোম্বেতে টাটা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে পেশাগত সমাজকর্মের সূচনা হয়। সাবেক পাকিস্তান আমলে আমেরিকার বিশেষজ্ঞদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯৫৩ সালে বাংলাদেশে পেশাগত সমাজকর্ম শিক্ষার সূচনা হয়েছিল। মূলতঃ আমেরিকার মডেলেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাজকর্মের পেশাগত শিক্ষা প্রচলিত রয়েছে।
সমাজকর্মে পেশাগত সংগঠন
যে কোন পেশার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হলো পেশাগত সংগঠন। সমাজকর্মের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন সংগঠন সমাজকর্মের পেশাগত মর্যাদা অর্জনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
১৯১৮ সালে আমেরিকায় ‘এসোসিয়্যাশন অফ হস্পিটাল সোস্যাল ওয়ার্কার’ গঠনের মাধ্যমে সমাজকর্মের পেশাগত সংগঠনের সূচনা হয়। পরবর্তীতে এর নাম ‘এসোসিয়্যাশন অফ মেডিক্যাল সোস্যাল ওয়ার্কার’ রাখা হয়। পরবর্তীতে অনেকগুলো পেশাগত সংগঠন গড়ে উঠে। নিচে সমাজকর্মের পেশাগত সংগঠনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো।
ক. সমাজকর্ম শিক্ষা কাউন্সিল ঃ বিশ্বব্যাপী সমাজকর্ম শিক্ষার বিকাশ এবং পেশাগত মর্যাদা অর্জনে ঈড়ঁহপরষ ড়হ ঝড়পরধষ ডড়ৎশ ঊফঁপধঃরড়হ-ঈঝডঊ কার্যকর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ১৯৫২ সালে এই কাউন্সিল গঠিত হয়। কাউন্সিলের মূল লক্ষ্য হলো সমাজকর্ম শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং যোগ্যতাসম্পন্ন সমাজকর্মী তৈরিতে সহায়তা প্রদান করা। সমাজকর্ম শিক্ষা কার্যক্রমকে যুগোপযোগী করতে কাউন্সিল প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৬৫ সাল হতে কাউন্সিল ‘দ্যা জার্নাল অফ এডুক্যাশন ফর সোস্যাল ওয়ার্কা’ প্রকাশ করে যাচ্ছে। সমাজকর্ম শিক্ষার ও সেবার মান উন্নয়নে কাউন্সিলের বার্ষিক অধিবেশন নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
পৃষ্ঠা ১৯৮
খ. ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব স্কুল্স অব সোশ্যাল ওয়ার্ক : বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাজকর্ম শিক্ষার মান উন্নয়ন, সিলেবাস প্রণয়ন, গবেষণা ও প্রকাশনা ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদানে এ সংগঠন নিয়োজিত। এটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সিলেবাস এবং সমাজকর্মের ডিগ্রী, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
গ. আমেরিকার জাতীয় সমাজকর্মী সমিতি : আমেরিকাকেন্দ্রীক এ সংগঠন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাজকর্ম পেশার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৫০ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৫৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। এর লক্ষ্য সমাজকর্মের দক্ষতা, সেবার মান এবং সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সাহায্য করা। ঘঅঝড সমাজকর্ম পেশার মান উন্নয়ন এবং পেশাদার সমাজকর্মীদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ‘একাডেমি অফ সার্টিফাইড সোস্যাল ওয়ার্কার’ প্রতিষ্ঠা করেছে। এ একাডেমী সমাজকর্মীদের পেশাগত রেজিষ্ট্রেশন প্রদানের শর্ত ও যোগ্যতা নির্ধারণ করে। এন.এ.এস.ডাব্লিউ সমাজকর্মের পেশাগত নৈতিক মানদন্ড প্রণয়ন করে। এন.এ.এস.ডাব্লিউ -বিশ্বব্যাপী সমাজকর্মের বিকাশ ও সমাজকর্মের মান উন্নয়নে অনেকগুলো পেশাগত পত্রিকা প্রকাশ করছে। এসব পত্রিকাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১. দ্যা সোস্যাল ওয়ার্ক ২. অফ সোস্যাল ওয়ার্ক ৩. সোস্যাল ওয়ার্ক নিসার্চ এন্ড এব্সট্রাক্ট ৪. হেলথ এন্ড সোস্যাল ওয়ার্ক ৫. সোস্যাল ওয়ার্ক ইন এডুক্যাশন।
ঘ. আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পেশাগত সংগঠন : ১৯২৮ সালে প্যারিসে ‘ইন্টারন্যাশনাল পার্মানেন্ট সেক্রাটারিয়েট অফ সোস্যাল ওয়ার্কার’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাজকর্মের পেশাগত সংগঠনের সূত্রপাত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত এটি সক্রিয় ছিল। ১৯২৮ সালে প্যারিসে সর্বপ্রথম সমাজকর্মের ওপর আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অফ সোস্যাল ওয়ার্ক- আই.সি.এস. ডাব্লিউ’ সমাজকর্মের আন্তর্জাতিক ফোরাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ ফোরামের মূল লক্ষ্য হলো বিশ্বের সকল দেশের সমাজকর্মীদের সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ যৌথ প্রচেষ্টায় সমাজকর্ম পেশার সার্বিক উন্নয়ন সাধন। প্রথম পর্যায়ে প্রতি চার বছর পর পর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হতে প্রতি দু’বছর পর সমাজকর্মের আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সমাজকর্ম সম্মেলন সংস্থার প্রধান অফিস নিউইয়র্কে এবং আঞ্চলিক অফিস প্যারিস এবং ভারতের মুম্বাই শহরে অবস্থিত।
১৯৫০ সালে প্যারিসে সমাজকর্মের ওপর অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সংক্ষেপে “ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ সোসাল ওয়ার্কারস” সংক্ষেপে ‘আই.এফ.এস.ডাব্লিউ’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে জার্মানীর মিউনিখ শহরে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন দেশের জাতীয় সমাজকর্মী সংগঠনগুলোর সম্মেলনে ‘আই.এফ.এস.ডাব্লিউ’ চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। আন্তর্জাতিক সমাজকর্মী ফেডারেশন “দ্যা সোস্যাল ওয়ার্কার” নামক ত্রৈমাসিক নিউজ লেটার নিয়মিত প্রকাশ করছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল সোস্যাল ওয়ার্কা’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
সমাজকর্মীদের রেজিস্ট্রেশন প্রদান ব্যবস্থা
যে কোন পেশার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে পেশাগত লাইসেন্স, সার্টিফিকেট এবং রেজিস্ট্রেশন প্রদানের মাধ্যমে। যার ভিত্তিতে কোন ব্যক্তি পেশাগত সেবাদানের সুযোগ লাভ করেন। নার্স, ডাক্তার, উকিল ইত্যাদি পেশার জন্য লাইসেন্স বা রেজিস্ট্রেশন গ্রহণ বাধ্যতামূলক। ফ্রান্স, জার্মানী, অস্ট্রিয়া এবং সুইডেনে সমাজকর্মীদের পেশাগত সেবা প্রদানের জন্য রেজিষ্ট্রেশন গ্রহণ বাধ্যতামূলক। ১৯৩৩ সালে আমেরিকায় “কেলিফর্নিয়া কনফারেন্স অফ সোস্যাল ওয়েলফার” কর্তৃক সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা পাশের পর সমাজকর্মীদের রেজিস্ট্রী সার্টিফিকেট বেসরকারি পর্যায়ে প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং ১৯৪৫ সাল হতে ক্যালিফোর্নিয়ায় সমাজকর্মীদের জন্য রেজিস্ট্রেশন ও সার্টিফিকেট দানের প্রথা প্রবর্তিত হয়। উভয় ক্ষেত্রে সমাজকর্ম পেশার সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অনুসরণ করা না হলে রেজিস্ট্রেশন বাতিলের ব্যবস্থা রাখা হয়।
সমাজকর্ম অনুশীলনের মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে। সার্টিফাইড সোস্যাল ওয়ার্কার্স-দের জন্য স্বেচ্ছাভিত্তিক রেজিষ্ট্রেশন ব্যবস্থা চালু করা হয়। আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯৬২ সালে এন.এ.এস.ডাব্লিউ “একাডেমি অফ সার্টিফাইড সোস্যাল ওয়ার্কার্স-এ.সি.এস.ডাব্লিউ” প্রতিষ্ঠা করা হয়। সমাজকর্ম অনুশীলনরতদের একাডেমীর সদস্যভুক্তির জন্য আবেদন জানানো হয়। সমাজকর্মীদের অনুশীলন লাইসেন্সের ক্ষেত্রে এটি একটি বিশেষ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত। ১৯৬৩ সালে ২০ হাজারের মতো একাডেমীর সদস্যভুক্ত সমাজকর্মী ছিল। ১৯৮০ সালে ৪৬ হাজার তিনশত এবং ১৯৯১ সালে ৫৮ হাজারে উপনীত হয়। সমাজকর্মীরা অন্যান্য পেশাদার ব্যক্তিদের মতো নামের শেষে পেশাগত অর্থবোধক এ.সি.এস.ডাব্লিউ শব্দ ব্যবহার করছে। ১৯৮৮ সালের মধ্যে কলাম্বিয়া, ভার্জিন দ্বীপ এবং আরো ৪৪টি রাজ্যে সমাজকর্মীদের অনুশীলন লাইসেন্স বা সার্টিফিকেট প্রদান সংক্রান্ত আইন প্রণীত হয়। লাইসেন্স এবং সার্টিফিকেট প্রদান সংক্রান্ত কার্যক্রম সমাজকর্মীদের পেশাগত মর্যাদা বৃদ্ধি এবং অধিক কার্যকর সেবা নিশ্চিত করে।
পৃষ্ঠা ১৯৯
আমেরিকার “ডিপার্টমেন্ট অফ লেবার” প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৭৮ সালে সমাজকর্মীর আনুমানিক সংখ্যা ছিল তিন লাখ পয়ত্রিশ হাজার এবং ১৯৯০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে পাঁচ লাখের উপরে উন্নীত হয়।
উল্লেখ্য এ.সি.এস.ডাব্লিউ-এর সদস্যভুক্তির জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা হলো সমাজকর্মে মাস্টার্স, তত্ত্বাবধায়কের অধীনে দু’বছরের পূর্ণকালীন বাস্তব অনুশীলন অভিজ্ঞতা অথবা তিন হাজার ঘন্টা খন্ডকালীন অনুশীলন অভিজ্ঞতা, তিনটি পেশাগত প্রবন্ধ এবং এ.সি.এস.ডাব্লিউ পরীক্ষা পাশ।
সমাজকর্মের পেশাগত নৈতিক মানদন্ড |
সমাজকর্মের নৈতিক নীতিমালা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ঘোষণা
সমাজকর্ম অনুশীলনে সৃষ্ট নৈতিকতা সম্পর্কিত সমস্যাবলী মোকাবেলার প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সমাজকর্মী ফেডারেশন সমাজকর্মের নৈতিক নীতিমালা ঘোষণার প্রয়োজন অনুভব করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক নৈতিক নীতিমালা ঘোষণা করা হয়।
উদ্দেশ্য : সমাজকর্মের নৈতিক নীতিমালা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ঘোষণার উদ্দেশ্যগুলো হলো-
১. সকল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ ও অনুসরণযোগ্য মৌলিক নীতিমালা প্রণয়ন;
২. সমাজকর্ম অনুশীলনে সৃষ্ট নৈতিক সমস্যার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা;
৩. সমাজকর্ম পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নৈতিকতা বিষয়ে সৃষ্ট সমস্যা মোকাবেলার পদ্ধতি চয়নের নির্দেশনা প্রদান।
নীতিমালা
সমাজকর্মীরা মানব উন্নয়নে সেবাপ্রদানে নিচের মূল নীতিমালাগুলোর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন এবং অনুশীলন করবেঃ-
১. প্রত্যেক ব্যক্তি মানুষের নিজস্ব অনন্য সাধারণ মূল্যবোধ রয়েছে, যেগুলো ব্যক্তির নৈতিকতা মূল্যয়নের বিবেচ্য বিষয় বলে স্বীকৃত।
২. প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মবিকাশের অধিকারের সীমা রয়েছে, যা অন্যান্যদের অনুরূপ অধিকারকে অতিক্রম করতে পারে না। সমাজের কল্যাণে অবদান রাখার ক্ষেত্রে ব্যক্তির দায়িত্ব রয়েছে।
৩. গঠন কাঠামো যাই হোক না কেন, প্রত্যেক সমাজেরই তার সদস্যদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কল্যাণের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
৪. সমাজকর্মীদের সামাজিক ন্যায়বিচার নীতি অনুশীলনের একটি অঙ্গীকার রয়েছে।
৫. ব্যক্তি, দল, জনসমষ্টি এবং সমাজের উন্নয়নে সাহায্য করার জন্য সুশৃঙ্খল জ্ঞান এবং দক্ষতা অনুশীলনে একান্তভাবে নিয়োজিত থাকা সমাজকর্মীদের অন্যতম দায়িত্ব। ব্যক্তিগত বা সামাজিক দ্বন্দ্ব এবং সেগুলোর প্রভাব মোকাবেলা ও সমাধান দেয়া তার পেশাগত দায়িত্ব।
৬. সমাজকর্মীরা সেবা প্রার্থীদের লিঙ্গ, বয়স, অক্ষমতা, বর্ণ, শ্রেণী, সম্প্রদায়, ধর্ম, ভাষা, রাজনৈতিক বিশ্বাস অথবা লিঙ্গ পরিচিতি ইত্যাদি কোন কারণে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারবে না। তারা সেবাপ্রার্থীকে বৈষম্যহীনভাবে সম্ভাব্য সর্বোত্তম সেবা প্রদান করবে।
৭. সমাজকর্মীরা ব্যক্তি ও দলের মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে। জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ঘোষিত মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি সমাজকর্মীরা সম্মান প্রদর্শন করবে।
৮. সমাজকর্মীরা পেশাগত ভূমিকা পালনে গোপনীয়তা এবং তথ্যের দায়িত্বপূর্ণ ব্যবহার নীতির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করবে। সমাজকর্মীরা ন্যায়ানুগ গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। এরূপ ন্যায়ানুগ গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে গিয়ে দেশের প্রচলিত আইনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব দেখা দিলেও এনীতি অনুসরণে সমাজকর্মীরা বাধ্য থাকবে।
৯. সমাজকর্মীরা সেবাগ্রহীতার সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতার মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করবে। সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের স্বার্থের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতার সর্বোত্তম স্বার্থে সমাজকর্মী কাজ করবে। সেবাগ্রহীতাকে যতটুকু সম্ভব অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা হবে। প্রস্তাবিত কর্ম প্রক্রিয়ার লাভ এবং ঝুঁকি উভয়দিক সম্পর্কে তাকে অবহিত করতে হবে।
১০. সমাজকর্মীরা সাধারণত সুবিধাভোগী বা সেবাগ্রহীতাদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করে। তবে একদলের স্বার্থে কাজ করতে গিয়ে অন্য দলকে অংশগ্রহণে বলপ্রয়োগ বা বাধ্য করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সচেতন থাকতে হবে।
১১. ব্যক্তি, দল, রাজনৈতিক শক্তি বা ক্ষমতা কাঠামোকে তাদের অনুসারীদের অসামাজিক কার্যকলাপ দ্বারা নির্যাতনের সঙ্গে সমাজকর্ম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
১২. সমাজকর্মীরা আই.এঅ.এস.ডাব্লিউ প্রণীত নৈতিক নীতিমালা নিজ নিজ জাতীয় পেশাগত সংস্থার মাধ্যমে গ্রহণ করে এগুলোর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করবে।
পৃষ্ঠা ২০০
সমাজকর্মীদের আন্তর্জাতিক নৈতিক মান
প্রস্তাবনা : পেশাদার সমাজকর্মের মূল উৎস বিভিন্ন মানবিক, ধর্মীয় এবং গণতান্ত্রিক আদর্শ ও দর্শনের মধ্যে নিহিত। সমাজকর্ম ব্যক্তিক-সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া হতে সৃষ্ট মানবিক চাহিদা পূরণ এবং মানবিক সম্ভাবনা ও প্রতিভা উন্নয়নে সর্বজনীনভাবে অনুশীলন করা হয়। পেশাদার সমাজকর্মীরা যেসব খাতে পেশাগত সেবা প্রদানে নিবেদিত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সেসব খাতগুলো হলো-
ক. মানুষের কল্যাণ ও পরিপূর্ণ বিকাশে সেবা প্রদান;
খ. মানুষ এবং তাদের সামাজিক আচরণ সম্পর্কিত যথার্থ জ্ঞানের উন্নয়ন এবং তার সুশৃঙ্খল ব্যবহার;
গ. ব্যক্তিগত, দলীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাহিদা ও প্রত্যাশাপূরণে সম্পদের উন্নয়ন সাধন;
ঘ. সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সফলতা অর্জন;
নীচে আই.এফ.এস.ডাব্লিউ প্রণীত সমাজকর্মীদের নৈতিক মান পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত। এগুলো হলো-
১. সমাজকর্মীদের নৈতিক আচরণের সাধারণ মানদন্ড;
২. পেশাগত সেবাগ্রহীতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমাজকর্মের মানদন্ড;
৩. এজেন্সী ও সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমাজকর্মের মানদন্ড;
৪. সমাজকর্মীদের (সহকর্মী) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমাজকর্মের মানদন্ড;
৫. পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানদন্ড।
আলোচ্য মানদন্ডগুলো এখানে উল্লেখ করা হলো-
১. সমাজকর্মীদের নৈতিক আচরণের সাধারণ মানদন্ড
ক. প্রত্যেক সেবাগ্রহীতা ব্যক্তি সেবাগ্রহীতা ব্যবস্থা এবং সেসব উপাদান যেগুলো আচরণকে প্রভাবিত ও যেগুলোর জন্য সেবা প্রদান প্রয়োজন, এসবগুলো বিষয় সম্পর্কে জানা ও বুঝার প্রচেষ্টা চালানো।
খ. সমাজকর্ম পেশার মূল্যবোধ, জ্ঞান ও পদ্ধতিগুলোর উন্নয়ন এবং পেশাগত ভূমিকা পালনের সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী যে কোন ধরনের আচরণ হতে বিরত থাকা।
গ. পেশাগত এবং ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার স্বীকৃতি প্রদান।
ঘ. সমাজকর্ম পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রাসঙ্গিক সবধরনের জ্ঞান ও দক্ষতার ব্যবহারে উৎসাহিতকরণ।
ঙ. পেশাগত জ্ঞানের উন্নয়ন ও নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য প্রাসঙ্গিক পদ্ধতির ব্যবহার ও অনুশীলন।
চ. সমাজে মানুষের জীবন মানোন্নয়নের উপযোগী নীতি ও কর্মসূচী উন্নয়নে পেশাগত বিশেষজ্ঞ হিসেবে অবদান রাখা।
ছ. সামাজিক চাহিদা ও প্রয়োজন চিহ্নিতকরণ এবং ব্যাখ্যাদান।
জ. ব্যক্তিগত, দলগত, সমষ্টিগত, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সামাজিক সমস্যা চিহ্নিত এবং সেগুলোর উৎস ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা।
ঝ. সমাজকর্ম পেশার ভূমিকা ও কার্যাবলী নির্ধারণ ও ব্যাখ্যাদান।
ঞ. জনস্বার্থে বিবৃতি প্রদান বা কার্যক্রমগ্রহণ কি ব্যক্তিক পর্যায়ে হবে, না কোন পেশাগত সমিতি, এজেন্সী, সংগঠন বা দলের প্রতিনিধি হিসেবে সম্পাদিত হবে তার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যাকরণ।
২. পেশাগত সেবাগ্রহীতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমাজকর্মের মানদন্ড
ক. চিহ্নিত বা সনাক্তকৃত সেবাগ্রহীতাকে গ্রহণ সমাজকর্মীর মুখ্য দায়িত্ব। তবে অন্যের নৈতিক দাবি ও অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে আরোপিত সীমাবদ্ধতার প্রতি লক্ষ্য রেখে এরূপ দায়িত্ব পালন করতে হয়।
খ. আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক, গোপনীয়তা এবং তথ্যাদির দায়িত্বপূর্ণ ব্যবহারের মতো সেবাগ্রহীতার অধিকার সংরক্ষণ।
গ. সেবাগ্রহীতাদের ব্যক্তিগত লক্ষ্য, দায়িত্ব ও কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়ের পার্থক্যের প্রতি স্বীকৃতি ও সম্মান প্রদর্শন।
ঘ. ব্যক্তি, দল সমষ্টি বা সমাজকে এমনভাবে পেশাগত সেবা প্রদান করতে হবে, যাতে আত্ম-পরিপূর্ণতা এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অন্যের অধিকারের প্রতি সচেতন থেকে, সেবাগ্রহীতার সর্বোচ্চ সম্ভাবনা বিকাশে সফলতা অর্জিত হয়।
পৃষ্ঠা ২০১
৩. এজেন্সী এবং সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমাজকর্মের মানদন্ড
ক. আন্তর্জাতিক সমাজকর্মী ফেডারেশন- আই.এঅ.এস.ডাব্লিউ প্রণীত সমাজকর্মের নৈতিক নীতিমালার সঙ্গে যেসব এজেন্সী ও সংগঠনের নীতি, কর্মপ্রক্রিয়া, সেবা প্রদান ব্যবস্থা সম্পর্কযুক্ত সেসব সংগঠনের সঙ্গে কাজ বা সহযোগিতা করা।
খ. দায়িত্বসহকারে এজেন্সী বা সংগঠনের নির্ধারিত লক্ষ্য এবং কার্যাবলী বাস্তবায়ন করা।
গ. যথাযথ এজেন্সী এবং সাংগঠনিক উপায়ের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতাদের মূল ভূমিকা স্থিতিশীল রাখার জন্য বিকল্প নীতি, কর্ম প্রক্রিয়া এবং অনুশীলনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
ঘ. নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে সেবা প্রদান প্রক্রিয়া পর্যালোচনার মাধ্যমে সেবাগ্রহীতা এবং জনসমষ্টির প্রতি পেশাগত জবাবদিহিতার কার্যকারিতা নিশ্চিত করা।
ঙ. যখন কোন নীতি, কর্মপ্রক্রিয়া এবং অনুশীলনের সঙ্গে সমাজকর্মের নৈতিক নীতিমালার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, তখন অনৈতিক অনুশীলনের পরিসমাপ্তির জন্য সম্ভাব্য সকল নৈতিক উপায় অবলম্বন করা।
৪. সহকর্মীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমাজকর্মের মানদন্ড
ক. অন্যান্য পেশা হতে সমাজকর্মী এবং সমাজকর্ম পেশাদার সহকর্মীদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সম্পাদিত কার্যক্রমকে স্বীকৃতি প্রদান।
খ. দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সমাজকর্মের সহকর্মীসহ অন্যান্য পেশাদার ব্যক্তিদের মতামতের পার্থক্য ও অনুশীলনের স্বীকৃতি প্রদান এবং সমালোচনা প্রকাশ করা।
গ. পারস্পরিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে সমাজকর্মে নিয়োজিত সহকর্মী, অন্যান্য পেশাদার ব্যক্তি এবং সেচ্ছাসেবীদের সকলের সঙ্গে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, ধারণা আদান-প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করা।
ঘ. পেশাগত নৈতিকতা ও মানদন্ডের যেকোন ধরনের বিরোধিতা বা লঙ্গন যথাযথ পেশাগত কর্তৃপক্ষের নিকট উপস্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট সেবাগ্রহীতাদের যথাযত সম্পৃক্ততার নিশ্চয়তা বিধান করা।
ঙ. সহকর্মীদের অনৈতিক বা অন্যায় কার্যাবলী হতে রক্ষা করা।
৫. পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানদন্ড
ক. পেশার মূল্যবোধ, নৈতিক নীতিমালা, জ্ঞান এবং পদ্ধতিসমূহের যথাযথ সংরক্ষণ এবং সেগুলোর যথাযথ ব্যাখ্যাদান ও উন্নয়নে অবদান রাখা।
খ. পেশাগত মানদন্ডের যথাযথ অনুশীলন এবং সেগুলোর উন্নয়নে কাজ করা।
গ. অর্থহীন অযৌক্তিক সমালোচনা হতে পেশাকে রক্ষা করা এবং সমাজকর্ম পেশার অনুশীলনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে বিশ্বাস সৃষ্টি করা।
ঘ. সমাজকর্ম পেশা, এর তত্ত্ব, পদ্ধতি এবং অনুশীলন সম্পর্কে গঠনমূলক সমালোচনা উপস্থাপন করা।
ঙ. প্রচলিত এবং ভবিষ্যত চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণে সমাজকর্মের নতুন পদ্ধতি ও কৌশল উদ্ভাবনে উৎসাহিত করা।
উপরিউক্ত নৈতিক মানদন্ডগুলো সমাজকর্মীকে একটা সামাজিক সীমায় আবদ্ধ করে। আর নৈতিক মানদন্ডগুলো জনগণ এবং তাদের সমস্যা সম্পর্কে সমাজকর্মীর যে দায়িত্ব রয়েছে, তা বুঝতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশার বিকাশ |
ভূমিকা
আধুনিক সমাজকল্যাণ ও পেশাদার সমাজকর্মের উদ্ভব এবং বিকাশ পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে হলেও পরিকল্পিত পরিবর্তন সাধনের উপায় হিসেবে বর্তমানে কিছু উন্নয়নশীল দেশে সমাজকর্ম পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিশ্বের অনুন্নত এবং দরিদ্র দেশগুলোর জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও মৌলিক চাহিদা পূরণের ঘাটতিজনিত সমস্যাবলী মোকাবেলার লক্ষ্যে পেশাদার সমাজকর্মের বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করা যেতে পারে। ষাটের দশকে বাংলাদেশেও সমাজকর্মের বিকাশ ঘটে পাশ্চাত্যের উন্নত দেশের প্রত্যক্ষ সুপারিশে। বৃটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক সমাজকল্যাণের সূচনা হয়েছিল আমেরিকান মিশনারীদের মাধ্যমে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে সৃষ্ট আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকান মিশনারীরা সমাজসেবা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভারতে আসে। ১৯২৫ সালে আমেরিকার একটি প্রোটেষ্ট্যান্ট খ্রীস্টান মিশনারী সংগঠন বোম্বেতে সমাজসেবায় নিয়োজিত ছিল। এ সংগঠনের নাম ছিল “এমিরিকান
পৃষ্ঠা ২০৩
মারাথি মিশন” এই চ্যারিটি সংগঠনে কাজ করার জন্য ১৯২৫ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের ক্লিফোর্ড ম্যানশার্ড নামক এক মিশনারী মুম্বাইতে আগমন করে। ভারতে পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশের অগ্রদূত ছিলেন ক্লিফোর্ড ম্যানশার্ড।
আমেরিকান মিশনারীরা মুম্বাইয়ের বস্তি এলাকায় সমাজসেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নেগপেড নেবারহুড নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। ক্লিফোর্ড ম্যানশার্ড -এর পরিচালনায় সংগঠনটি মুম্বাইয়ের বস্তিবাসীর উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে।
বস্তিতে কাজ করতে গিয়ে ক্লিফোর্ড ম্যানশার্ড প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সমাজকর্মীর প্রয়োজন অনুভব করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সমাজকর্মের পেশাগত শিক্ষার প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৩৬ সালে ক্লিফোর্ড ম্যানশার্ডের নেতৃত্বে বোম্বের “টাটা গ্রজুয়েটেড স্কুল অফ সোস্যাল ওয়ার্ক” প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে ভারতে সমাজকর্মের পেশাগত শিক্ষার সূচনা হয়।
বাংলাদেশে পেশাদার সমাজকর্ম বিকাশের পটভূমি
বাংলাদেশে আধুনিক সমাজকল্যাণ ও পেশাদার সমাজকর্মের সূত্রপাত হয় জাতিসংঘের সহায়তায় এবং বিদেশী বিশেষজ্ঞদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর সরকার উদ্বাস্ত্ত পুনর্বাসন সমস্যা এবং শিল্পায়ন ও নগরায়নজনিত বহুমুখী আর্থ-সামাজিক সমস্যা মোকাবেলার লক্ষ্যে জাতিসংঘের নিকট সাহায্যের আবেদন করে। সে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের কারিগরি সাহায্য কর্মসূচীর আওতায় ১৯৫২ সালে ডঃ জেমস্ আর ডুম্পসন -এর নেতৃত্বে জাতিসংঘের ছয় সদস্য বিশিষ্ট সমাজকর্ম বিশেষজ্ঞ দল এদেশে আগমন করেন। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দল এদেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার জরিপ ও পর্যালোচনা করে পেশাদার সমাজকর্মের প্রবর্তন এবং স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থার বিকাশের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
বাংলাদেশে আধুনিক সমাজকল্যাণের তথা সমাজকর্মের বিকাশকে তিনটি বিশেষ দিক হতে আলোচনা করা যায়। এগুলো হলো- ক. সমাজকর্ম শিক্ষার বিকাশ, খ. আধুনিক সমাজকল্যাণের প্রয়োগ এবং গ. সমাজকল্যাণ প্রশাসনের বিবর্তন।
ক. সমাজকর্ম শিক্ষার বিকাশ : জাতিসংঘের উপদেষ্টাদের সুপারিশ এবং সহায়তায় ১৯৫৩ সালে ঢাকায় তিন মাসের স্বল্পমেয়াদী সমাজকর্ম প্রশিক্ষণ কোর্স প্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশে পেশাদার সমাজকর্ম শিক্ষার সূচনা হয়। তিন মাসের প্রশিক্ষণ কোর্সের সফলতা এবং ক্রমবর্ধমান সামাজিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে নয় মাসের অপর একটি প্রশিক্ষণ কোর্স প্রবর্তন করা হয়।
স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্সের সাফল্যের ভিত্তিতে সরকার দেশে দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন সমাজকর্মী সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ ডঃ জন ও মূর -কে এ ব্যাপারে রিপোর্ট তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি সমাজকর্মের জন্য পৃথক প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৮-৫৯ শিক্ষা বর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কনস্টিটিউয়েন্ট কলেজ হিসেবে সমাজকল্যাণ কলেজ ও গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের আগত উপদেষ্টা বিশেষজ্ঞ ডঃ জন ও মূর প্রণীত সুপারিশমালার ভিত্তিতে কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হয়। প্রথম পর্যায়ে এখানে সমাজকল্যাণে দু’বছর মেয়াদী এম.এ. কোর্স প্রবর্তন করা হয়। ১৯৬৬-৬৭ শিক্ষা বর্ষ হতে এখানে স্নাতক সম্মানসহ সমাজকল্যাণে তিন বছর মেয়াদী কোর্স প্রবর্তন করা হয়। ১৯৭৩ সালে স্বতন্ত্র একটি ইনিস্টিটিউট হিসেবে সমাজকল্যাণ কলেজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আত্মীকরণ করা হয়। তখন থেকে এর নাম ‘‘সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট’’ রাখা হয়। প্রথম পর্যায়ে এ প্রতিষ্ঠানের পঠন-পাঠন ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞগণ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে এটি ‘ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব স্কুল অব সোশ্যাল ওয়ার্ক’ -এর অন্যতম সদস্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৬৪-৬৫ শিক্ষাবর্ষ হতে ‘সমাজকর্ম কলেজ’ প্রতিষ্ঠা এবং বি.এ.(সম্মান) ডিগ্রী প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৬৭ সালে সমাজকর্ম কলেজে সমাজকর্মে এম.এ. কোর্স প্রবর্তন করা হয়। পরবর্তীতে এটি সমাজকর্ম বিভাগ হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আত্মীকরণ করা হয়।
১৯৯১ সাল হতে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্মে সম্মানসহ স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর কোর্স প্রবর্তন করা হয়েছে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পাঠ্যক্রম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সমাজকর্ম শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। স্নাতক সম্মান এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে সমাজকর্ম এবং সমাজকল্যাণ সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্মে বিএসএস এবং এমএসএস ডিগ্রী প্রদান করা হয়।
তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার এদেশে অনুদান কার্যক্রমের অধীনে বিভিন্ন কলেজে স্নাতক পর্যায়ে সমাজকল্যাণ ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে চালু করে। ফলে স্নাতক পর্যায়ে সমাজকল্যাণ শিক্ষা কার্যক্রম দ্রুত প্রসার লাভ করে। পরবর্তীতে দেশের চারটি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সমাজকল্যাণ ঐচ্ছিক
পৃষ্ঠা ২০৪
বিষয় হিসেবে প্রবর্তিত হয়। সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্মরতদের দক্ষতা ও যোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য জাতীয় সামাজসেবা একাডেমী রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনেকগুলো কলেজে সমাজকর্মে স্নাতক সম্মানসহ এম.এ. কোর্স প্রবর্তন করা হয়েছে এবং উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক (পাস এবং সাবসিডিয়ারী কোর্স) পর্যায়ে সমাজকল্যাণ পড়ানো হচ্ছে। উল্লেখ্য যে, কেবলমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে একে সমাজকল্যাণ বলা হয়। রাজশাহী, সিলেট ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে একে সমাজকর্ম বলা হয়।
খ. বাংলাদেশে আধুনিক সমাজকল্যাণের প্রয়োগ : বাংলাদেশে আধুনিক সমাজকল্যাণের বাস্তব প্রয়োগের সূচনা হয় সাবেক পাকিস্তান আমলে। জাতিসংঘের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ১৯৫৩ সালে সমাজকর্মের ওপর স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ কোর্স প্রবর্তন এবং তার বাস্তব প্রয়োগের জন্য ঢাকার কায়েতটুলীতে ১৯৫৫ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ‘শহর সমষ্টি উন্নয়ন’ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ‘শহর সমষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণের মধ্য দিয়ে এদেশে আধুনিক সমাজকল্যাণ তথা পেশাদার সমাজকর্মের বাস্তব প্রয়োগের সূচনা হয়। পরবর্তীতে গোপীবাগ এবং মোহাম্মদপুরে আরো দু’টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ১৯৫৯-৬০ সালে বিভাগীয় শহরসহ বড় বড় শহরে ১২টি শহর সমষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে এটি ‘শহর সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প’ হিসেবে সকল সিটি কর্পোরেশন ও পৌর এলাকায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। ১৯৫৪ সালে জাতিসংঘ এবং রেডক্রসের সহায়তায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসা সমাজকর্ম পরীক্ষামূলকভাবে গ্রহণ করা হয়। ১৯৬১ সালে চিকিৎসা সমাজকর্ম প্রকল্পের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, মিটফোর্ড এবং বক্ষব্যাধি হাসপাতালে প্রয়োগ করা হয়। বর্তমানে এটি ‘হাসপাতাল সমাজ সেবা’ নামে পরিচিত। দেশের সকল মেডিক্যাল কলেজ এবং জেলা পর্যায়ের সকল হাসপাতালে প্রকল্পটি চালু রয়েছে।
বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত এ দু’টি প্রকল্পের মধ্যেই আধুনিক সমাজকল্যাণের বাস্তব প্রয়োগ সীমিত ছিল। ১৯৭৪ সালে ‘গ্রামীণ সমাজসেবা’ নামে পরীক্ষামূলক প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে আধুনিক সমাজকল্যাণের বাস্তব প্রয়োগ গ্রামীণ পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। বর্তমানে এটি জাতীয় কর্মসূচি হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে।
গ. বাংলাদেশে সমাজকল্যাণ প্রশাসনের বিবর্তন ঃ স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলোর উন্নয়ন ও সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের সুপারিশে ১৯৫৬ সালে ঢাকায় প্রাদেশিক সমাজকল্যাণ পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে এদেশে বেসরকারি পর্যায়ে সমাজকল্যাণ প্রশাসনের সূচনা হয়। বর্তমানে এটি জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ নামে পরিচিত। ১৯৬১ সালে স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থা (রেজি ও নিয়ন্ত্রণ) আদেশ জারি করা হয়। ১৯৬২ সালে সমাজকল্যাণ পরিদপ্তর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এদেশে সমাজকল্যাণ প্রশাসন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। সরকারি-বেসরকারি সমাজকল্যাণ কার্যক্রমের পরিচালনার দায়িত্ব সমাজকল্যাণ পরিদপ্তরের ওপর অর্পণ করা হয়। স্বাধীনতার পর সমাজকল্যাণ পরিদপ্তরকে ‘সমাজকল্যাণ বিভাগে’ রূপান্তরিত করা হয়। ১৯৮৪ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি হতে সমাজকল্যাণ বিভাগের নাম পরিবর্তন করে ‘সমাজসেবা অধিদপ্তর’ রাখা হয়। বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি সমাজকল্যাণ কার্যক্রমের প্রশাসন ও সমন্বয়ের দায়িত্ব সমাজসেবা অধিদপ্তর পালন করছে। বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম জনগুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তর হিসেবে এটি স্বীকৃত। সমাজসেবা অধিদপ্তর হতে ‘সমাজকল্যাণ’ নামে মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে পেশা হিসেবে সমাজকর্ম
সমাজকর্ম আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি সাহায্যকারী পেশা। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে সমাজকর্মের পেশাদারী মর্যাদা অর্জন একটি বিতর্কিত বিষয়। পেশার মানদন্ড ও বৈশিষ্ট্যের আলোকে বাংলাদেশে সমাজকর্মের পেশাগত মর্যাদা নিচে আলোচনা করা হলো।
১. বিশেষ জ্ঞান : বাংলাদেশে আধুনিক সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্ম পৃথক সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃত। সামাজিক বিজ্ঞানের বিশেষ শাখা হিসেবে সমাজকল্যাণ এবং সমাজকর্মের নিজস্ব জ্ঞান ভান্ডার রয়েছে। বিভিন্ন বিজ্ঞানের জ্ঞান ও তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে সমাজকর্মের নিজস্ব বিশেষ জ্ঞানভান্ডার গড়ে উঠেছে। আধুনিক সমাজকল্যাণের বা সমাজকর্মের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে কোন লোক নিজেকে পেশাদার সমাজকর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। সুতরাং পেশার প্রথম বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশে সমাজকর্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
২. বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম : বাংলাদেশে সমাজকর্মের যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। এদেশে ১৯৫৮-৫৯ সালে জাতিসংঘের সহায়তায় স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করা হয়। বর্তমানে ঢাকা, রাজশাহী, এবং সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্মে স্নাতক সম্মানসহ স্নাতকোত্তর কোর্স চালু রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন কলেজে স্নাতক সম্মানসহ স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সমাজকল্যাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ের সিলেবাস ‘‘ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব স্কুলস্ অব সোশ্যাল ওয়ার্ক’’-এর মোটামুটি অনুসরণে রচিত অনার্স এবং মাস্টার্স পর্যায়ের
পৃষ্ঠা ২০৫
সিলেবাসে সীমিত সময় পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়কের অধীনে ব্যবহারিক শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে সমাজকর্মের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। যা পেশার বৈশিষ্ট্য অনেকাংশে বহন করছে।
৩. জনকল্যাণমুখিতা : বাংলাদেশে জনকল্যাণমুখী কার্যক্রম হিসেবে সমাজকল্যাণ স্বীকৃত। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বাস্তবায়িত সমাজসেবা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হচ্ছে। দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতাজনিত কারণে সৃষ্ট সমস্যাবলী মোকাবেলা করার জন্য সমাজকর্মের কৌশল, শহর ও গ্রামাঞ্চলে প্রয়োগ করা হচ্ছে। যা বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশার জনকল্যাণমুখিতার পরিচায়ক।
৪. পেশাগত মূল্যবোধ ও ব্যবহারিক নীতিমালা : বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণের পেশাগত মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদন্ড আজও নির্ধারিত হয়নি। সমাজকল্যাণের কার্যকর পেশাগত সংগঠন না থাকায় পাশ্চাত্যের উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের নিজস্ব আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পেশাগত মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদন্ড গড়ে উঠেনি।
৫. পেশাগত সংগঠন : পেশাগত সংগঠন যে কোন পেশার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে সমাজকল্যাণ পেশায় নিয়োজিতদের অদ্যাবধি কোন পেশাগত সংগঠন গড়ে উঠেনি। তবে বিভিন্ন সময়ে পেশাগত সংগঠন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। যেমন ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশার মান উন্নয়ন ও সমাজকর্মীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ‘‘বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকর্মী সমিতি’’ গঠন করা হয়। তবে এটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৮৬ সালে ‘বাংলাদেশ সমাজকর্ম শিক্ষক সমিতি’ নামে একটি পেশাগত সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হলেও এখন এর কার্যক্রম নেই। কার্যকর পেশাগত সংগঠনের অভাবে বাংলাদেশে সমাজকর্ম পৃথক পেশার মর্যাদা অর্জনে সক্ষম হয়নি।
৬. সামাজিক স্বীকৃতি : বাংলাদেশে সমাজকর্মকে পৃথক পেশা হিসেবে অনুশীলন লাইসেন্স দানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্মকে বিষয় হিসেবে সামাজিক বিজ্ঞানের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্মে বিএসএস এবং এমএসএস ডিগ্রী দেয়া হচ্ছে এবং এসব ডিগ্রীধারীদের সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ করা হচ্ছে। বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসে সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্মের ডিগ্রীপ্রাপ্তরা স্বতন্ত্র পেশার মর্যাদা নিয়ে নিয়োগ পাচ্ছে না। সহজভাবে বলা যায় সমাজকর্মকে সামাজিকভাবে জনকল্যাণমুখী কার্যক্রম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কৌশল বাস্তবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না। ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি পেশাদার ব্যক্তিদের মতো রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে সমাজকর্মীদের পৃথক পেশাদার ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।
৭. পেশাগত দায়িত্ব : বাংলাদেশে আধুনিক সমাজকল্যাণে ও সমাজকর্মে ডিগ্রী প্রাপ্ত দক্ষতাসম্পন্ন সমাজকর্মীগণ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকে সমাজকর্মের জ্ঞান মানব কল্যাণে প্রয়োগে সদা সচেষ্ট। সমাজকল্যাণ সেবার মান উন্নয়নে সমাজকর্ম পদ্ধতিসমূহ বাস্তবায়ন উপযোগী সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অভাবে সমাজকর্মীরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে।
উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায়, যে সব মানদন্ড ও বৈশিষ্ট্যের আলোকে কোন বিশেষ বৃত্তিকে পেশার মর্যাদা দেয়া হয়, তার সবগুলো বাংলাদেশে সমাজকর্মের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়নি। তবে পেশার সার্বিক বৈশিষ্ট্যগুলোর কটি বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে সমাজকর্ম স্বতন্ত্র পেশার মর্যাদা লাভ করতে পারেনি। কারণ-
ক. বাংলাদেশে আজও পেশাদার সমাজকর্মীদের কার্যকরী কোন পেশাগত সংগঠন গড়ে উঠেনি।
খ. সমাজকর্ম পেশার মুখপত্র হিসেবে নিয়মিত কোন লিটারেচার প্রকাশিত হয়নি।
গ. বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজকর্মের পেশাগত ব্যবহারিক মূল্যবোধ ও মানদন্ড কি হওয়া উচিত, সে বিষয়ে কোনরূপ সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট ধারণা এখনও গড়ে উঠেনি।
ঘ. বাংলাদেশের অজ্ঞ, নিরক্ষর ও অসচেতন জনগণের পেশাদার সমাজকর্ম সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাব এবং সমাজকল্যাণ সম্পর্কে সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি।
ঙ. পেশাদার সমাজকর্ম প্রয়োগ করার মত সামাজিক এজেন্সী ও প্রতিষ্ঠানের স্বল্পতা।
এসব সীমাবদ্ধতার জন্য বাংলাদেশে পেশাদার সমাজকর্ম সুদীর্ঘকাল পরেও স্বকীয় সত্তা লাভ করতে সক্ষম হয়নি।
পৃষ্ঠা ২০৬
স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ |
সমাজকল্যাণের বৃহত্তর ক্ষেত্রে স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলোকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বলা হয়। বাংলাদেশের মতো অনুন্নত ও দরিদ্র দেশে সরকারি প্রশাসনিক কাঠামোর বাইরে থেকে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণের সংজ্ঞা
সমাজের কোন স্বীকৃত ক্ষেত্রে সেবা প্রদানের লক্ষ্যে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বেচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত সংস্থাকে স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান বলা হয়। ১৯৬১ সালে প্রণীত বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা (নিবন্ধীকরণ এবং নিয়ন্ত্রণ) আইনে স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ সংস্থার কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান করে বলা হয়েছে, ‘‘কোন সমাজসেবা বা কল্যাণমূলক কাজ করার লক্ষ্যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমূহের স্বাধীন ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ইচ্ছায় গঠিত সংগঠন, সমিতি বা কর্মকান্ডকেই স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ বলা হয়।’’ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত দান, চাঁদা এবং সরকারি অনুদান হচ্ছে স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ সংস্থার আয়ের উৎস। যেমন- বাংলাদেশ বহুমুত্র সমিতি, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, বাংলাদেশ যক্ষ্মা নিরোধ সমিতি ইত্যাদি।
স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণের বেশিষ্ট্য হলো। ১. মানবিকতা বোধের ভিত্তিতে স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ কার্যক্রম গড়ে উঠে, ২. আর্থিক সাহায্য ও মানবিক সেবা প্রদানের লক্ষ্যে স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ সংস্থা গঠিত, ৩. সরকারি প্রশাসনিক কাঠামোর বাইরে সংশ্লিষ্ট আইনের আওতায় এসব সংস্থা স্বাধীনভাবে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কাজ করে, ৪. স্বেচ্ছামূলক সমাজল্যাণ সংস্থাগুলো লক্ষ্যদল নির্দিষ্ট করে তাদের মধ্যে সাহায্য ও পুনর্বাসন কার্যাবলী পরিচালনা করে, ৫. বর্তমান বিশ্বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবী বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেতনভুক কর্মী বাহিনীর মাধ্যমে সার্বিক সমাজকল্যাণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে থাকে, ৬. স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলোর প্রশাসনিক জটিলতা ও দীর্ঘসুত্রিতা কম থাকায় দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়, ৭. নিজস্ব সাংগঠনিক ও গঠনতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলো পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।
পেশাদার সমাজকর্ম ও স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণের সাদৃশ্য
সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে নিয়োজিত দুটি ধারা হলো পেশাদার সমাজকর্ম এবং স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ। উভয়ের মধ্যে কর্মপদ্ধতির দিক হতে পার্থক্য থাকলেও কোন কোন ক্ষেত্রে সাদৃশ্য রয়েছে। যেমন-
ক. মানবিকতাবোধ এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের অনুভূতি উভয় সমাজকল্যাণ ধারার দার্শনিক ভিত্তি, মানব হিতৈষী দর্শন ও মানব প্রেম পেশাদার এবং স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণের সর্বজনীন ভিত্তি।
খ. পেশাদান ও স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ উভয় ক্ষেত্রে নিঃস্বার্থ মনোভাব এবং মানবসেবার অনুপ্রেরণা উভয়ের মূল শক্তি।
গ. স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ ধারার ওপর পেশাদার সমাজকর্মের উদ্ভব। শিল্প বিপ্লবের পর সমাজের চাহিদা ও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে পেশাদার সমাজকর্মের উদ্ভব।
ঘ. স্বেচ্ছামূলক ও পেশাদার সমাজকর্ম প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় বাস্তবায়িত হয়।
ঙ. বর্তমানে অনেক উন্নয়নধর্মী স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানে পেশাদার সমাজকর্মীদের নিয়োগ দেয়া হয়।
পেশাদার ও স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণের পার্থক্য
সমাজকল্যাণের বৃহত্তর ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বে দু’টি ধারা বিদ্যমান। একটি হলো পেশাদার এবং অন্যটি হলো স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ। উভয়ের লক্ষ্য হলো দুঃস্থ মানবতার সেবা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ আনয়ন। সমাজের সামগ্রিক
পৃষ্ঠা ২০৭
কল্যাণ আনয়নে পেশাদার এবং স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলো সহায়ক ও পরিপূরক ভূমিকা পালন করে। তা সত্ত্বেও উভয়ের প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও কার্যক্রমের মধ্যে কতগুলো মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।
স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ বলতে, সমাজের কোন বিশেষ ক্ষেত্রে সেবা প্রদানের লক্ষ্যে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সেবা কর্মকে বুঝানো হয়ে থাকে। মানব প্রেম, ধর্মীয় অনুশাসন ও অনুপ্রেরণাই হচ্ছে এগুলোর মূল চালিকা শক্তি।
পক্ষান্তরে, পেশাদার সমাজকর্ম বলতে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য, দক্ষতা, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও নৈপুণ্যভিত্তিক সমাজসেবা প্রক্রিয়াকে বুঝায়। শিল্প-বিপ্লবোত্তর সামাজিক চাহিদা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের প্রেক্ষিতে সনাতন সমাজসেবা ধারার ওপর পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশ ঘটে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, মানব হিতৈষী দর্শন এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ হচ্ছে পেশাদার সমাজকর্মের মূল ভিত্তি।
পেশাদার এবং স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণের প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও কর্ম প্রক্রিয়ার আলোকে উভয়ের মধ্যকার প্রধান প্রধান পার্থক্যগুলো নিচের ছকের মাধ্যমে উল্লেখ করা হলো-
পেশাদার সমাজকল্যাণ | স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ |
১. এটি একটি সাহায্যকারী পেশা। এর জন্য পেশাগত জ্ঞান, দক্ষতা ও কর্মনৈপুণ্য অপরিহার্য। | ১. এটি পেশা নয়। স্বেচ্ছা প্রণোদিত সমাজ সেবা কার্যক্রম বিধায় পেশাগত জ্ঞান, দক্ষতা ও নৈপুণ্য অর্জন ছাড়াই সমাজসেবা করা যায়। |
২. এতে ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যা সমাধানের জন্য সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করা হয়। | ২. এতে বিশেষ পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ ব্যতীত সমাজসেবা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। |
৩. পেশাদার সমাজ কর্মের নির্দিষ্ট ব্যবহারিক মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদন্ড রয়েছে। যেগুলো পেশাদার সমাজ কর্মীদের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালিত করে। | ৩. স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে পেশাগত মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদন্ড অনুসরণের তেমন বাধ্য-বাধকতা নেই। ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং মানবিক দায়িত্ব হচ্ছে এর মূলভিত্তি। |
৪. পেশাদার সমাজকর্মে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রতিকার, প্রতিরোধ এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। | ৪. স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সমস্যার সাময়িক সমাধান দেয়ার চেষ্টা করা হয়। |
৫. স্বাবলম্বন নীতির ভিত্তিতে এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। | ৫. স্বাবলম্বন নীতির প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। |
৬. পেশাদার সমাজকর্মে নিয়োজিত সমাজকর্মীরা সেবার বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করে এবং সমাজকর্মকে পূর্ণকালীন পেশা হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। | ৬. স্বেচ্ছাসেবীগণ অবসর সময়ে খন্ডকালীন কাজ হিসেবে সমাজ সেবায় নিয়োজিত থাকেন বলে পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন না। এটি তার স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কাজ। |
৭. জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী, গরীব সব শ্রেণীর সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির সমস্যা সমাধানে এতে সাহায্য করা হয়। | ৭. সমস্যাগ্রস্ত নির্দিষ্ট শ্রেণীর সমস্যা সমাধানের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। |
৮. সমস্যাগ্রস্ত সাহায্যপ্রার্থীর সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সুপ্ত ক্ষমতা এবং নিজস্ব সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। | ৮. বাহ্যিক ও বস্ত্তগত সাহায্য দানের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়। এতে সুপ্ত ক্ষমতা বিকাশের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। |
৯. সমাজের সুষম কল্যাণের লক্ষ্যে সমস্যার প্রতি সমাগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা হয়। এতে সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতার পুনরুদ্ধার, উন্নয়ন ও সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়। | ৯. এটি বিচ্ছিন্ন ও অসংগঠিত সমাজসেবা কার্যক্রম বিধায় একমুখি দৃষ্টিকোণ হতে সমস্যার সাময়িক সমাধানের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয় না। |
১০. সমাজকর্ম পেশায় যোগ্য, দক্ষ ও নৈপুণ্যসম্পন্ন যে কোন ব্যক্তি পেশাদার সমাজকর্মে নিয়োজিত হতে পারে। | ১০. প্রধানত সম্পদশালী ও বিত্তবানরাই স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণে অংশগ্রহণ করতে পারে। |
১১. সামাজিক খ্যাতি, প্রতিপত্তি ও মর্যাদা লাভের সুযোগ এতে নেই। পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্যই সমাজ সেবায় নিয়োজিত হয়। | ১১. সামাজিক প্রভাব, প্রতিপত্তি, যশ ও খ্যাতি অর্জনের জন্য অনেক সময় স্বেচ্ছামূলক সমাজ সেবায় নিয়োজিত হয়। |
১২. পেশাদারী দৃষ্টিকোণ হতে এতে সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা চালানো হয়। | ১২. স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ও ব্যক্তির ইচ্ছা মাফিক সমস্যা সমাধানে সাহায্য দেয়া হয়। |
সমাজকল্যাণ ও সমাজ উন্নয়নে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ভূমিকা |
মানুষের প্রতি দয়া, সেবা, দান, সাহায্য মানব ইতিহাসে সবসময় বিদ্যমান ছিল এবং বর্তমানেও রয়েছে। দুঃস্থের সেবা এবং আর্তের সহায়তা ঐতিহাসিকভাবে ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সমাজের রূপান্তর এবং বিকাশের সাথে ধর্মীয় ভূমিকা গৌণ হয়ে আসছে। তবে ধর্মীয় চেতনা এবং মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুয় দুঃস্থ অসহায়দের কল্যাণে গড়ে তুলছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান।
বেসরকারি সংস্থাগুলো দু’টি ধারায় কাজ করছে। একদিকে রয়েছে কল্যাণমূলক ধারা, অন্যদিকে রয়েছে সামাজিক পরিবর্তন ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম। বাংলাদেশের মত দরিদ্র ও উন্নয়নগামী দেশে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব নিচের দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা যায়-
১. সরকারি কর্মসূচির প্রদর্শক : স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো প্রশাসনিক কাঠামো নমনীয় বিধায় পরীক্ষামূলক প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতীয় জীবনে এগুলোর গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। এসব পরীক্ষামূলক কর্মসূচির সাফল্য এবং গুরুত্ব উপলব্ধি করে সরকারি পর্যায়ে সেগুলো গ্রহণ করা হয়। যেমন ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়নের পর, তা সরকারি পর্যায়ে গ্রহণ করা হয়। কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন পদ্ধতির অনুসরণে জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি ও দ্বিস্তর বিশিষ্ট সমবায় গৃহীত হয়।
২. সরকারি কর্মসূচির পরিপূরক : দরিদ্র ও অনুন্নত দেশের বহুমুখী সমস্যার প্রতি সরকারি পর্যায়ে দৃষ্টি দেয়া এবং সরকারি কর্মসূচির আওতাভুক্ত করা সম্ভব নয়। সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে সরকারি কর্মসূচি অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানে অপর্যাপ্ত বলে প্রতীয়মান হয়। এসব ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি কর্মসূচির পরিপূরক ও সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। যেমন-বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা সমিতি ও স্বেচ্ছাবন্ধাকরণ সমিতি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ক্ষেত্রে সরকারি কার্যক্রমে সহায়ক ও পরিপূরক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
৩. দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ : স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশাসনিক জটিলতা, অনমনীয়তা, দীর্ঘসূত্রীতা ইত্যাদি সরকারি সংস্থার তুলনায় অনেক কম থাকে। ফলে পরিবর্তিত চাহিদা, প্রয়োজন এবং সমস্যার প্রেক্ষিতে কর্মসূচি গ্রহণ ও পরিবর্তন সহজ হয়। আকস্মিক বিপর্যয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অতি দ্রুত ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে মানুষকে সাহায্য করে। যেমন- ঘূর্ণিঝড় বা অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সময়ে দুর্গত এলাকায় সরকারি সাহায্য পৌঁছার পূর্বে অনেক সময় বেসরকারি সাহায্য কার্যক্রম শুরু হয়।
৪. সামাজিক আইন প্রণয়নে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ : সমাজে প্রচলিত ক্ষতিকর প্রথা, দুর্নীতি ও মানবতা বিরোধী রীতি-নীতির উচ্ছেদ সাধনে অনুকূল জনমত গঠনে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন- ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন, ১৯৮০ সালের নারী নির্যাতন ও যৌতুক বিরোধী আইন প্রণয়নে যথাক্রমে পাকিস্তান মহিলা পরিষদ ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
৫. লক্ষ্যভুক্ত উন্নয়ন : স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলো নির্দিষ্ট এলাকায়, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে সরাসরি সেবামূলক কার্যাবলী পরিচালনা করে। ফলে জনগণের চাহিদা, প্রয়োজন, সম্পদ, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতির প্রতি লক্ষ্য রেখে কর্মসূচি গ্রহণ ও
পৃষ্ঠা ২০৯
বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারিদের সাথে সেবা গ্রহণকারীদের সরাসরি ও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকায় সহজেই মানুষের আস্থা অর্জন সম্ভব হয়। যা সরকারি সংস্থার ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।
৬. সংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদী রোগ নিয়ন্ত্রণ : অনেক সংক্রামক রোগ রয়েছে যেগুলোর জন্য বিশেষ ও দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার প্রয়োজন। এসব ব্যয়বহুল ও দীর্ঘ মেয়াদী রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা সুযোগদানের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন বহুমূত্র রোগের চিকিৎসা প্রদানে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘বহুমূত্র সমিতি’ হলো একক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কর্মরত। যক্ষ্মা সমিতির নামও উল্লেখ করা যায়। চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধার পূর্ণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দুঃস্থ দরিদ্র অক্ষম রোগীদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন- রোগী কল্যাণ সমিতি।
৭. মানব সম্পদ উন্নয়ন : দক্ষ মানব সম্পদ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অপরিহার্য উপাদান। আর মানব সম্পদ উন্নয়নের কার্যকর হাতিয়ার হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজসেবা কার্যক্রম। মানব সম্পদ উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ, নারী ও শিশু উন্নয়ন, সমাজকল্যাণ, যুব উন্নয়ন প্রভৃতি খাতে এনজিওগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
৮. সম্পদের ব্যবহার : স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো অমুনাফামুখী সমাজ সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করে। ফলে এসব সংস্থার প্রশাসনিক অপচয় কম হয়। ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো মানবকল্যাণে নিয়োজিত থাকে বিধায়, সম্পদের যাথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হয়। যা সরকারি সংস্থার মাধ্যমে অনেকাংশে সম্ভব নয়।
৯. নেতৃত্বের বিকাশ : স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণগুলো জনগণের যৌথ ও স্বতঃইচ্ছায় গড়ে উঠে। এগুলো পরিচালনার দায়িত্ব উদ্যোক্তারা পালন করে থাকেন। ফলে তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলীর বিকাশ ঘটে। গতিশীল নেতৃত্বের বিকাশে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
১০. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি : স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো দু’ভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। প্রথমত, বড় বড় দেশী-বিদেশী স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে বিরাট সংখ্যক শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে বিদেশী অর্থে পরিচালিত সংস্থাগুলোতে হাজার হাজার কর্মী নিয়োজিত রয়েছে। দ্বিতীয়ত, টার্গেট গ্রুপগুলোর বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দান ও ঋণ বিতরণের মাধ্যমে স্ব-কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। এভাবে বেকার সমস্যা সমাধানে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১১. দারিদ্র বিমোচন : স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো দরিদ্র ও ভূমিহীনদের টার্গেট গ্রুপ হিসেবে চিহ্নিত করে, তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালায়। দারিদ্র বিমোচনে সরকারি প্রচেষ্টার সম্পূরক হিসেবে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গ্রামীণ ব্যাংক, স্বনির্ভর বাংলাদেশ, প্রশিকা, ব্র্যাক প্রভৃতি সংস্থাগুলো দারিদ্র বিমোচনে বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছে। গ্রামীণ দরিদ্রদের লক্ষ্যভুক্ত দল হিসেবে চিহ্নিত করে দক্ষতা উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্রঋণ সরবরাহ করে উৎপাদনমুখী স্ব-কর্মসংস্থানের প্রচেষ্টা চালায়।
১২. সুবিধাভোগী হিসেবে দরিদ্র নারীদের লক্ষ্যভুক্তকরণ : বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হওয়া সত্ত্বেও আর্থ-সামাজিক দিক থেকে তারা অনগ্রসর। বাংলাদেশের সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনগ্রসর দরিদ্র নারীশ্রেণীকে সুবিধাভোগী শ্রেণী হিসেবে সচেতনভাবে লক্ষ্যভুক্ত করে। বাংলাদেশে দারিদ্র বিমোচনে প্রধান সুবিধাভোগী শ্রেণী হিসেবে নারীদের লক্ষ্যভুক্ত করা সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
১৩. সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে বিত্তবানদের সচেতন করে তুলে : স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো প্রধানত সমাজের বিত্তবান ও সম্পদশালীদের অর্থসাহায্যে গড়ে উঠে। সমাজের অসহায়-দুঃস্থ শ্রেণীর প্রতি বিত্তবান ও সম্পদশালীদের যে দায়িত্ব রয়েছে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কার্যক্রম মানুষের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে। ফলে সমাজের বিত্তবান শ্রেণী সমাজ সেবায় এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত হয়।
পৃষ্ঠা ২১০
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান উন্নয়ন ও কল্যাণের নতুন দর্শন হচ্ছে ‘‘সরকার এবং জগণের যৌথ প্রচেষ্টাতে সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধন সম্ভব। এজন্য দরিদ্র ও উন্নয়নগামী দেশের সামগ্রিক কল্যাণে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
বাংলাদেশে স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলোর সমস্যা
বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা এগুলোর কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর দিক হতে বিরাজমান উল্লেখযোগ্য সমস্যাগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
১. সনাতন কর্মসূচি : বাংলাদেশে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো বেশিরভাগ ত্রাণ বিতরণ, সেলাই প্রশিক্ষণ, বুনন, ইত্যাদি সনাতন কার্যাবলী পরিচালনা করে। এসব কার্যাবলী লক্ষ্যভূক্ত দরিদ্রদের জীবনমান উন্নয়নে দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব রাখতে পারে না। ফলে এসব কর্মসূচির প্রতি দরিদ্র জনগণ তেমন আগ্রহ দেখায় না।
২. বৈদেশিক দাতা নির্ভরতা সরকারি সাহায্য ও অনুদানের ওপর অধিক নির্ভরশীলতা : বর্তমানে জনগণের আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও নিম্ন জীবনযাত্রার ফলে অতীতের মতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না। আর্থিক সমস্যার কারণে বৈদেশিক ও সরকারি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি সাহায্য বন্ধ হলে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
৩. অর্থ আত্মসাৎ করার প্রবণতা : জনগণের অর্থ-সাহায্যে পরিচালিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর অর্থের অপচয় বা আত্মসাৎ করার সুযোগ তেমন থাকে না। কারণ জনগণ এ সব প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলী এবং তাদের প্রদত্ত অর্থের যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন থাকে। কিন্তু সরকারি সাহায্য নির্ভর প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবী পরিচালকগণ এরূপ জবাবদিহিতাকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপেক্ষা করেন। জনগণও এরূপ প্রতিষ্ঠানের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন করে। ফলে অর্থের অপচয়জনিত কারণে প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য অর্জন ব্যাহত হয়।
৪. সনাতন ও সমধর্মী কল্যাণমূলক কাজ : চিন্তা ও পরিশ্রমবিহীন যে সব কাজ অতি সহজে করা যায় যেমন- সেলাই শিক্ষা কেন্দ্র, প্রভৃতি সমধর্মী কল্যাণমূলক কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে বেশির ভাগ স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। যতদিন সরকার অর্থ, সেলাই মেশিন, পড়ার উপকরণ ইত্যাদি সরবরাহ করে, ততদিন এ সব প্রতিষ্ঠান টিকে থাকে।
৫. সামাজিক খ্যাতি ও প্রতিপত্তি লাভের উপায় : বাংলাদেশে বেশিরভাগ স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনে সামাজিক মর্যাদা, নাম, যশ, খ্যাতি ও প্রতিপত্তি লাভের প্রবণতা অনেক সময় কাজ করে থাকে। মানবিকতাবোধ ও সামাজিক দায়িত্ববোধের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠায় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো অকালেই বন্ধ হয়ে যায়।
৬. নেতৃত্বের কোন্দল : গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুসরণে এ দেশে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয় না। ফলে স্বার্থ, ক্ষমতা ও নেতৃত্বের দাবি নিয়ে সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ, হিংসা, রেসারেষি এবং কলহের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় নেতৃত্ব ও ক্ষমতার কোন্দলে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কল্যাণমূলক লক্ষ্য এবং কার্যক্রম হারিয়ে গিয়ে সামাজিক সংঘাতের রূপ নেয়।
৭. রাজনৈতিক প্রভাব : অনেক সময় রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উপায় হিসেবে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। এ সব প্রতিষ্ঠান মানব সেবার পরিবর্তে রাজনৈতিক সেবার প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
৮. সুষ্ঠু সমন্বয় ও যোগাযোগের অভাব : বিচ্ছিন্ন এবং ইচ্ছামাফিক সমাজসেবা করে সমাজের সমস্যা দূর করা সম্ভব নয়। স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠনগুলো প্রায় একই ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে। স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের অর্থহীন প্রতিযোগিতা, কাজের পুনরাবৃত্তি, সময় ও সম্পদের অপচয়জনিত কারণে প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা যেমন হ্রাস পায়, তেমনি অকালে বন্ধ হয়ে যায়।
৯. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুপস্থিতি : স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠাগুলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিচালিত হয় না। ফলে সফল ও গতিশীল নেতৃত্ব গড়ে না উঠায় প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলী ব্যাহত হয়। অনেক সময় সচেতন নেতা বা পরিচালকের অভাবে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
পৃষ্ঠা ২১১
১০. প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব : অর্থনৈতিক সঙ্কট ও অস্বচ্ছলতার জন্য স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলো দক্ষ ও যোগ্য কর্মী তৈরির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে না।
উপর্যুক্ত সমস্যাবলী ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলীর সুষ্ঠু মূল্যায়ন, বিদেশী সাহায্যনির্ভর প্রতিষ্ঠানে, উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের প্রতি কম গুরুত্ব আরোপ প্রভৃতি সমস্যাগুলোর কারণে বাংলাদেশে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অত্যধিক হওয়া সত্ত্বেও গতিশীল ভূমিকা পালনে সক্ষম হচ্ছে না। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেলেও এগুলোর কার্যকারিতা মোটেও বৃদ্ধি পায়নি।
অনুশীলনী
রচনামূলক প্রশ্ন
১. পেশা বলতে কি বুঝ ? পেশার মানদন্ডগুলো কি কি ? আলোচনা কর।
২. বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশার বিকাশ ও বিবর্তন আলোচনা কর।
৩. পেশা ও বৃত্তি কাকে বলে ? পেশা ও বৃত্তির পার্থক্য আলোচনা কর।
৪. পেশার মানদন্ডের আলোকে বাংলাদেশে সমাজকর্মের পেশাগত মর্যাদা মূল্যায়ন কর।
অথবা, বাংলাদেশে সমাজকর্ম কি পেশা ? যুক্তি সহকারে আলোচনা কর।
৫. স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণের সংজ্ঞা দাও। স্বেচ্ছামূলক ও পেশাদার সমাজকল্যাণের পার্থক্য আলোচনা কর।
৬. সমাজ উন্নয়নে স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ সংস্থার ভূমিকা বা অবদান আলোচনা কর।
৭. পেশার সংজ্ঞা দাও। পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশ ও বিবর্তন আলোচনা কর।
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. পেশা কাকে বলে ?
২. পেশার মানদন্ডগুলো কি ?
৩. বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষার বিকাশ সংক্ষেপে লিখ।
৪. স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো কিভাবে সরকারি কর্মসূচির সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করে ?
৫. সমাজকর্মের পেশাগত সংগঠন কি ?
৬. সমাজকর্মের নৈতিক মানদন্ড কি কি ?
৭. পেশা ও বৃত্তির পার্থক্য কি ?
৮. সমাজকর্ম পেশার বৈশিষ্ট্য কি ?