পৃষ্ঠা ৯৯
জনসমষ্টির কার্যাবলী
জনসমষ্টি তার সদস্যদের জন্য কতগুলো নির্দিষ্ট কার্যাবলী সম্পাদন করে। মনীষী কার্ল টেলর “রুলাল লাইফ ইন দ্যা ইউনাইটেড স্টেট” গ্রন্থে বলেছেন (১৯৪৯), “কমিউনিটি ইজ দ্যা ফার্স্ট সোস্যাল গ্রুপ ইন মডার্ন লাইফ দ্যাট এপ্রোচেস সেল্ফ-সাফিশন্সি” এবং জনসমষ্টির ভূমিকা পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং সমষ্টিকে বুঝাতে হলে জনসমষ্টির কাঠামো এবং ভূমিকা একত্রে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। ডাব্লিউ ডি হেরিসন (১৯৯৫) মন্তব্য করেছেন, আন্ডার্স্টেন্ডিং কমিউনিটি উড রিকুয়ার এনালাইসেস অফ স্ট্রাকচার্স এন্ড ফাংশন টুগেদার নট এজ সেপারেট এন্টিটেইজ” জনসমষ্টির আঞ্চলিক ভিত্তিতে গটিত জনসমষ্টিগুলো সম্পাদিত কার্যাবলীকে মনীষী ওয়ারেন (১৯৭৮) পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলো হলো-
ক. উৎপাদন, বন্টন এবং ভোগ;
খ. সামাজিকীকরণ;
গ. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ;
ঘ. সামাজিক অংশ গ্রহণ;
ঙ. পারস্পরিক সমর্থন;
মনীষী এ প্যান্তোজা এবং ডাব্লিউ পেরি জনসমষ্টির উপরিউক্ত ভূমিকাগুলোর সঙ্গে প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ এ দুটি ভূমিকার উল্লেখ করেছেন। এ পর্যায়ে জনসমষ্টির উপর্যুক্ত ভূমিকাগুলো সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করা হলো।
ক. উৎপাদন, বন্টন এবং ভোগ : উৎপাদন, বন্টন এবং ভোগ জনসমষ্টি অর্থনৈতিক কার্যক্রমের পরিধিভুক্ত। জনসমষ্টি অন্যান্য কার্যাবলী উৎপাদন, ভোগ ও বন্টন দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। উৎপাদন, বন্টন এবং ভোগ হলো জনসমষ্টির সেসব কার্যক্রম, যেগুলোর লক্ষ্য জনসমষ্টির জনগণের বস্ত্তগত চাহিদা অর্থাৎ খাদ্য, বন্ত্র, আশ্রয় ইত্যাদি মানবিক মৌল চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা।
খ. সামাজিকীকরণ : জনসমষ্টির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার মধ্যে সামাজিকীকরণ অন্যতম। সামাজিকীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে মানব শিশু প্রচলিত আদর্শ, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, রীতিনীতি ও প্রথা-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিচিত হয় এবং সেগুলো আত্মস্থ করে। সংক্ষেপে যে প্রক্রিয়ায় মানব শিশু নিজেকে বৃহত্তর সমাজের উপযোগীকরে গড়ে তুলে এবং নিজেকে সামাজিক জীবে পরিণত করে, তাকে সামাজিকীকরণ বলা হয়। সহজ কথায় যে প্রক্রিয়ায় মানব শিশুর জৈবিক সত্তা, সামাজিক সত্তায় পরিণত হয় সে প্রক্রিয়াকে সামাজিকীকরণ বলা হয়। সামাজিক জীবনের সঙ্গে ব্যক্তি জীবনের সামঞ্জস্য বিধানই হলো সামাজিকীকরণ। জনসমষ্টিতে প্রচলিত আদর্শ, মূল্যবোধ ও রীতিনীতি সম্পর্কিত জ্ঞানার্জনে সামাজিকীকরণের বিকল্প নেই।
ব্যক্তি নিজেকে ও অন্যকে কিভাবে মূল্যায়ন করছে এবং আন্তঃব্যক্তিক অধিকার ও কর্তব্যকে কিভাবে বিবেচনা করছে, এগুরো তার দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যক্ষণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। সুতরাং ব্যক্তিকে বা জনগোষ্ঠীকে বুঝার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জনসমষ্টির প্রচলিত নীতিমালা, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, আদর্শ প্রভৃতি সম্পর্কে জানা। কারণ এগুলোর মাধ্যমেই জনসমষ্টিতে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয়। জনসমষ্টির প্রচলিত মূল্যবোধ, আদর্শ ও রীতিনীতি সামাজিকীকরণের মাধ্যমে হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
গ. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ : জনসমষ্টির ভূমিকা সামাজিক নিযন্ত্রণের ক্ষেত্রেও পরিব্যাপ্ত। জনসমষ্টির নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা সদস্যদের ওপর বিশেষভাবে কার্যকর হয়।
প্রত্যেক মানুষ স্বকীয় সত্তা ও স্বাতন্ত্র্যবোধের অধিকারী। স্বাতন্ত্র্য এবং স্বার্থচেতনা ব্যক্তি প্রবণতার মধ্যে বিদ্যমান থাকে। সুতরাং ব্যক্তি মানুষের আচার-আচরণ যদি অনিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে সমাজের সংহতি ও শৃংখলা বজায় থাকে না। সদস্যদের মধ্যে সমন্বয, সংহতি ও শৃংখলা বজায় রাখার জন্য সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বলবৎ করা হয়। মূলত সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে সমাজের সদস্যদের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ এবং সমাজের শৃংখলা, সংহতি ও সমন্বয় সাধন করা হয়। জনসমষ্টি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা
বৃটিশ আমলে বাংলাদেশে ১৮৪০ এবং ১৮৫০ সালে আইন প্রণয়ন করে পৌরসভা গঠনের অনুমতির মধ্য দিয়ে স্থানীয় স্বায়ত্বশাসনের গোড়া পত্তন করা হয়। ১৮৬৪ সালে বড় শহরে ‘পৌরসভা’ এবং ১৮৬৮ সালে ছোট শহরে পৌর কমিটি গঠনের বিধান প্রণীত হয়। ১৮৭০ সালের বঙ্গীয় আইন পরিষদে ‘গ্রামীণ চৌকিদারী আইন’ অনুযায়ী ‘পঞ্চায়েত’ গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৮৩ সালে প্রণীত আইনের দ্বারা কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন এবং কয়েকটি ইউনিয়ন নিয়ে একটি ‘ইউনিয়ন কমিটি’ গঠনের বিধান করা হয়।
১৮৮৫ সালে ‘স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন আইন’ বিধিবদ্ধ হয়। ফলে ঐ আইনের বলে প্রত্যেক জেলায় ‘জেলা বোর্ড’ এবং জেলা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন মহকুমায় একটি করে ‘লোকাল বোর্ড’ গঠনের বিধান করা হয়। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামক দেশ সৃষ্টি হয়। তদানীন্তন পাকিস্তানে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো আরো গণতান্ত্রিক রূপ লাভ করে। ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের পৌরসভাতেও মনোনীত সদস্যপদ বাতিল করে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।
১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের তদানীন্তন সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আইয়ুব খান ‘মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ’ জারি করেন। মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রথম স্তরে ছিল ইউনিয়ন ও পৌরসভা। দ্বিতীয় স্তরে ছিল থানা কাউন্সিল, তৃতীয় স্তরে জেলা কাউন্সিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৩ সালের ২২শে মার্চ রাষ্ট্রপতির আদেশবলে ইউনিয়ন পঞ্চায়েতগুলো ‘ইউনিয়ন পরিষদে’ এবং শহর পঞ্চায়েতগুলো ‘পৌরসভারূপে’ চিহ্নিত হয়। বাংলাদেশের স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত সংস্থার নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে ১৯৭৬ সালের স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ, ১৯৭৭ সালের পৌরসভা অধ্যাদেশ এবং ১৯৮৩ সালের ‘স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন অধ্যাদেশ’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৯৬ সালে স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির রিপোর্টে চার স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান গঠনের সুপারিশ করা হয়। গ্রাম পর্যায়ে থাকবে ‘গ্রাম পরিষদ’, ইউনিয়নে ‘ইউনিয়ন পরিষদ’, উপজেলায় ‘উপজেলা পরিষদ’ এবং জেলায় থাকবে ‘জেলা পরিষদ’।
ইউনিয়ন পরিষদ |
পল্লী অঞ্চলের সর্বনিম্ন স্থানীয় সরকার ইউনিট হলো ইউনিয়ন। চৌকিদারী আইন ১৮৭০ এর অধীনে পল্লী সংস্থা গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলে ইউনিয়নের সৃষ্টি হয়। ২০০১ সালের লোক গণনার তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যা চার হাজার ৪৮৪ টি।
ইউনিয়ন পরিষদের গঠন : ১৯৯৭ সালের আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হয় একজন চেয়ারম্যান, নয়জন নির্বাচিত সদস্য এবং তিনজন সরাসরি ভোটে নির্বাচিত (মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন) মহিলা সদস্য নিয়ে। নির্বাচনের উদ্দেশ্যে প্রত্যেকটি ইউনিয়নকে তিনটি ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেক ওয়ার্ড থেকে তিনজন পুরুষ সদস্য, একজন মহিলা সদস্য এবং সমগ্র ইউনিয়ন থেকে একজন চেয়ারম্যান জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হয় বারজন সদস্য-সদস্যার সমন্বয়ে।
ইউনিয়ন পরিষদের সকল কাজ পরিচালনার দায়িত্ব চেয়ারম্যানের হাতে ন্যস্ত থাকে। তিনি ইউনিয়ন পরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করেন। ইউনিয়ন পরিষদের কাজের মেয়াদ পাঁচ বছর। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসিক তিনশত টাকা এবং সদস্যগণ মাসে একশত টাকা করে সম্মানী পান। সার্বক্ষণিক দাপ্তরিক কাজ করেন একজন বেতনভুক্ত সেক্রেটারী।
ইউনিয়ন পরিষদের কার্যাবলি : ইউনিয়ন পরিষদের ভূমিকা ও কাজগুলো হলোঃ
ক. উন্নয়নমূলক কাজঃ বাংলাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য কাজ সম্পাদন করে থাকে।
পৃষ্ঠা ১১১
খ. রাজস্ব সংক্রান্ত কাজ : ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় কর ধার্য ও আদায় এবং সরকারকে বিভিন্ন ধরনের রাজস্ব সংগ্রহে সাহায্য করে থাকে। যেমন চৌকিদারী কর, হাট বাজার, জলমহল, খেয়াঘাট ইত্যাদি ইজারা।
গ. কৃষি সংক্রান্ত কাজ : ইউনিয়ন পরিষদ কৃষি উন্নয়নের জন্য উন্নতমানের বীজ, সার ও কীটনাশক সরবরাহ, সমবায় আন্দোলনের উৎসাহ প্রদান, অধিক খাদ্য ফলাও অভিযান পরিচালনা এবং উৎসাহ প্রদান প্রভৃতি কাজ সম্পন্ন করে থাকে।
ঘ. বিচার সংক্রান্ত কাজ : ইউনিয়ন পরিষদ গ্রামের বিভিন্ন সমস্যা ও মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ অনুযায়ী পরিবার ও বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে ‘সালিশী আদালত’ হিসেবে কাজ করে থাকে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তি স্থাপন ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠাই সলিশী আদালতের মূল লক্ষ্য।
ঙ. শান্তিরক্ষা সংক্রান্ত কাজ : ইউনিয়নের অভ্যন্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ চৌকিদার ও দফাদার নিয়োগ এবং পরিচালনা এবং গ্রামীণ পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন ও পরিচালনা করে থাকে।
চ. সেবামূলক কাজ : ইউনিয়ন পরিষদ দুঃস্থ, অনাথ এবং বিপদগ্রস্ত লোকদেরকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করে থাকে।
ছ. সরকারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন : ইউনিয়ন পরিষদ নিজ নিজ ইউনিয়নের সমস্যাগুলো থানা পরিষদকে জ্ঞাত করায়। থানা পরিষদের মাধ্যমে সরকার এসব সমস্যা সম্পর্কে জানতে পারে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট হয়।
পৌরসভা |
পৌরসভা হচ্ছে শহরের জনগণের স্থানীয় সমস্যাগুলো সমাধান এবং উন্নয়নমূলক কাজ করার জন্য স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে মাত্র ১০৭টি পৌরসভা ছিল। ২০০১ সালের লোক গণনার তথ্যানুযায়ী পৌরসভার সংখ্যা ২২৩টি। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৬৪টি, রাজশাহী বিভাগে ৫৭টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৮টি, খুলনা বিভাগে ২৮টি, বরিশাল বিভাগে ২২টি এবং সিলেট বিভাগে ১৪টি পৌরসভা রয়েছে।
পৌরসভার গঠন ঃ একজন চেয়ারম্যান, কয়েকজন কমিশনার ও সরকার কর্তৃক মনোনীত কয়েকজন মহিলা কমিশনার নিয়ে পৌরসভা গঠিত হয়। চেয়ারম্যান ও কমিশনারগণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। পৌরসভার মনোনীত মহিলা কমিশনার কোনক্রমেই নির্বাচিত কমিশনারদের মোট সংখ্যার দশ ভাগের এক অংশের বেশি হবেন না। পৌরসভায় নির্বাচিত সদস্যকে ‘কমিশনার’ বলা হয়। পৌরসভার নির্বাচন হয় প্রত্যক্ষ ভোটে।
পৌরসভার কার্যাবলি
১. জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত কার্যাবলি : পৌরসভা নিজ নিজ পৌর এলাকায় জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণ, আবর্জনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, রোগ-জীবাণু ধ্বংসকারী ওষুধপত্র সরবরাহ, বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি নিরোধের ব্যবস্থা, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মাতৃসদন, শিশু মংগল কেন্দ্র নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত কাজ সম্পাদন করে থাকে।
২. শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত কার্যাবলি : পৌর এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, এগুলোকে অর্থ সাহায্য প্রদান, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য হোস্টেল নির্মাণ, মেধাবী ও দরিদ্র ছাত্রদের বৃত্তি প্রদান, যাদুঘর স্থাপন, পার্ক, উদ্যান, মিলনায়তন স্থাপন, বিভিন্ন স্থানে রেডিও, টেলিভিশন সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণ, ঐতিহাসিক স্থানসমূহ সংরক্ষণ ইত্যাদি শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত কাজ পৌরসভা করে থাকে।
৩. সমাজকল্যাণ : অনাথ ও দুঃস্থদের জন্য কল্যাণ কেন্দ্র, এতিমখানা ইত্যাদি স্থাপন ও পরিচালনা; ভিক্ষাবৃত্তি, জুয়াখেলা ও মদ্যপান বন্ধের ব্যবস্থা, মৃতদেহের সৎকার প্রভৃতি পৌরসভার অন্যতম কাজ।
৪. উন্নয়নমূলক কার্যাবলি : পৌরসভা বয়স্কদের শিক্ষার ব্যবস্থা, সাধারণ মিলনায়তনের সংরক্ষণ, জনগণের জন্য পার্ক, উদ্যান ও খেলার মাঠ নির্মাণ ও সংরক্ষণ; পথঘাট ও রাস্তার পার্শ্বে বৃক্ষরোপণ ও এদের সংরক্ষণ, জাতীয় দিবসসমূহ উদযাপন করা,
পৃষ্ঠা ১১২
বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ভূমিকম্প, অগ্নিকান্ডের সময় সাহায্য, ফলমূল, শাক-সব্জির চাষ বাড়ানো, কুটির শিল্পের উন্নতি, সমবায় আন্দোলনের প্রসার, লাইব্রেরি, ক্লাব স্থাপন ইত্যাদি উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদন করে থাকে।
৫. পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন : জনসাধারণের জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য নতুন কূপ খনন, নলকূপ স্থাপন এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা পৌরসভার অন্যতম দায়িত্ব।
৬. খাদ্য ও পানীয় সামগ্রী নিয়ন্ত্রণ : পৌরসভা খাদ্য ও পানীয় সামগ্রীর সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, বাজার স্থাপন, পৌর এলাকায় বিশেষ ধরনের খাদ্য ও পানীয় প্রস্ত্তত, নিয়ন্ত্রণ বা আমদানির ক্ষেত্রে লাইসেন্স প্রদান করে থাকে।
৭. জননিরাপত্তা বিধান সংক্রান্ত কার্যাবলি : পৌরসভা নিজ নিজ পৌর এলাকার জনগণের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য নৈশ প্রহরী নিয়োগের ব্যবস্থা, অপরাধমূলক এবং বিপজ্জনক খেলা ও পেশা নিয়ন্ত্রণ, গোরস্থান, শ্মশান নির্মাণ, বন্যা ও দুর্ভিক্ষের সময় ত্রাণের ব্যবস্থা ইত্যাদি জননিরাপত্তা সংক্রান্ত কাজগুলো করে থাকে।
সিটি কর্পোরেশন |
গঠন : বাংলাদেশের ছ’টি মহানগরীতে ছ’টি ‘সিটি কর্পোরেশন’ বিদ্যমান। এগুলো হলো- ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, বরিশাল এবং সিলেট। এগুলো অতীতে পৌরসভা নামে পরিচিত ছিল। নির্বাচিত ও মনোনীত সদস্য নিয়ে সিটি কর্পোরেশন গঠিত। সিটি কর্পোরেশনের সদস্যদেরকে কমিশনার বলা হয়। সিটি কর্পোরেশনের প্রধানকে মেয়র বলা হয়। মেয়রকে কাজে সাহায্যের জন্য একজন ডেপুটি মেয়র থাকেন। আইন দ্বারা অযোগ্য নয় এরূপ ব্যক্তি মেয়র, ডেপুটি মেয়র ও সদস্য হতে পারবেন। সিটি কর্পোরেশনের মেয়াদ বা কার্যকাল ৫ বছর।
কার্যাবলি
জনস্বাস্থ্য রক্ষা সংক্রান্ত : মহানগরী এলাকার জনস্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের ওপর ন্যস্ত। সিটি কর্পোরেশন রাস্তাঘাট, নালা, নর্দমা, আবাসিক এলাকা, বস্তি এলাকা পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা করে। বিভিন্ন স্থানে শৌচাগার নির্মাণ ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা, প্রস্রাবখানা নির্মাণ, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, মহামারী ও সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিষেধকের ব্যবস্থা, ময়লা ও আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিন নির্মাণ ও জমাকৃত আবর্জনা পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করে। সিটি কর্পোরেশন জনস্বাস্থ্যের জন্য হাসপাতাল, স্বাস্থ্যক্লিনিক, মাতৃসদন, শিশুসদন, ডিসপেনসারি ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনার ব্যবস্থা করে থাকে।
খাদ্য ও পানীয় দ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ : মহানগরীতে ভেজালমুক্ত খাদ্যদ্রব্য, হোটেল, রেস্তোরাঁয় উন্নতমানের খাবার সরবরাহ, পচা ও বাসী খাবারের সরবরাহ নিষিদ্ধ করার ব্যবস্থা, মাদক দ্রব্যের উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয় রোধ করার ব্যবস্থা এবং আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
পানি সরবরাহ ও পানি নিষ্কাশন : মহানগরীর জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, কূপ ও নলকূপ খনন, শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, ড্রেন পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা করে।
নগর পরিকল্পনা : মহানগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য সিটি কর্পোরেশন রাস্তাঘাট, পার্ক, মুক্তাঙ্গন, আবাসিক এলাকা নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ, রাস্তার পাশে বৃক্ষরোপণ, অভ্যর্থনা গেট নির্মাণ, পার্কের চারপাশে আকর্ষণীয় প্রাচীর নির্মাণ এবং আবাসিক এলাকার নিরাপত্তা বিধানের জন্য নিয়ন্ত্রণ গেট নির্মাণ ও প্রহরীর ব্যবস্থা করে থাকে।
গৃহনির্মাণ নিয়ন্ত্রণ : সিটি কর্পোরেশন মহানগর এলাকায় ঘরবাড়ি নির্মাণে অনুমতি প্রদান; বিনা অনুমোদনে নির্মিত বাড়িঘর, দোকান পাট, হোটেল, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি ভেঙে দেয়ার এবং অবৈধ দখলদারী উচ্ছেদের ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।
রাস্তাঘাট ও যানবাহন সংক্রান্ত : মহানগরীর রাস্তাঘাট নির্মাণ ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, রাস্তাঘাটের ওপর হতে দোকানদার ও অবৈধ দখলদারী উচ্ছেদ, মোটরগাড়ি, বাস, ট্রাক ছাড়া অন্যান্য যানবাহনের লাইসেন্স প্রদান ও রাস্তায় চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে।
পৃষ্ঠা ১১৩
সাহায্য ও পুনর্বাসন : সিটি কর্পোরেশন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য ও পুনর্বাসন করা, বন্যা, খরা, মহামারী দুর্ভিক্ষ, ঘুর্ণিঝড় ইত্যাদির হাত হতে মহানগরীর জনজীবনকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করে থাকে।
জীবজন্তু সংক্রান্ত কাজ : সিটি কর্পোরেশন গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন, গবাদিপশু রেজিস্ট্রিকরণ, বিপজ্জনক পশু আটক ও হত্যা, মৃতপশুর দেহ অপসারণ, হাঁস মুরগির খামার স্থাপন ইত্যাদি কাজ করে থাকে।
বন, বৃক্ষ রোপণ, পার্ক ও উদ্যান সংক্রান্ত : মহানগর এলাকায় বন সংরক্ষণ, উন্মুক্ত স্থানে বৃক্ষরোপণ, পার্ক নির্মাণ ও উদ্যান তৈরির মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন জনসাধারণের অবকাশ বিনোদনের ব্যবস্থা করে।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত : মহানগরীর নিরক্ষরতা দূরীকরণ, নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন, বয়স্কদের শিক্ষাদান, হোস্টেল নির্মাণ, বৃত্তি প্রদান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুদান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, পাঠাগার স্থাপন ও পরিচালনা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি উন্নয়নের জন্য তথ্যকেন্দ্র, আর্টগ্যালারী, যাদুঘর, মিলনায়তন, মুক্তাঙ্গন, মুক্তমঞ্চ নির্মাণ ও পরিচালনা করে থাকে।
জনকল্যাণমূলক কাজ : মহানগরীর গরীব-দুঃখী মানুষের সাহায্য, অনাথ আশ্রম ও জনকল্যাণ কেন্দ্র স্থাপন, ভিক্ষাবৃত্তি ও পতিতা বৃত্তি রোধ ও পুনর্বাসন, জুয়াখেলা, মাদকাশক্তি ও অসামাজিক কাজ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করে থাকে।
শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা : মহানগরীতে সন্ত্রাস দমন, চুরি-ডাকাতি ও হাইজ্যাক রোধ ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা করে থাকে।
বিচার সংক্রান্ত কাজ : সিটি কর্পোরেশন মহানগরীর শান্তিরক্ষার জন্য ছোটখাটো বিচার কাজ এবং বিবাদ মীমাংসা ও মহল্লায় শান্তিরক্ষী মোতায়েন করে শান্তিরক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে।
পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবন- এ তিনটি জেলার জনগণের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি এরশাদ-এর শাসনামলে ১৯৮৯ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদে ‘পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ’ গঠন করে, একটি বিল পাস হয়। ১৯৮৯ সালের ৬ই মার্চ রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে তা আইনে পরিণত হয়।
উপজাতীয় জনগণের সর্বাঙ্গীন উন্নতি, শাসনব্যবস্থার সামগ্রিক কাঠামোর মধ্যে বিশেষ এলাকা হিসেবে পার্বত্য এলাকাকে চিহ্নিত করে এখানকার প্রশাসন ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে উপজাতীয়দের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখা এবং বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডে ব্যাপকভাবে উপজাতীয়দের সম্পৃক্ত করাই এ আইনের উদ্দেশ্য।
পরিষদের গঠন
পার্বত্য এলাকার তিনটি স্থানীয় পরিষদের কার্যকাল হবে প্রথম অধিবেশনের তারিখ থেকে তিন বছর। পরিষদ তিনটির চেয়ারম্যান হবেন উপজাতীয়দের মধ্য থেকে। রাঙামাটি জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠিত হবে ১ জন চেয়ারম্যান, বিশজন উপজাতীয় সদস্য এবং দশজন অ-উপজাতীয় সদস্য নিয়ে। খাগড়াছড়ি জেলা স্থানীয় সরকার গঠিত হবে একজন চেয়ারম্যান, একশজন উপজাতীয় সদস্য ও নয়জন অ-উপজাতীয় সদস্য নিয়ে। বান্দরবন জেলা স্থানীয় সরকার গঠিত হবে একজন চেয়ারম্যান, উনিশজন উপজাতীয় এবং এগারোজন অ-উপজাতীয় সদস্য নিয়ে। তিনটি জেলার উপজাতীয় সদস্যগণ আগে নির্ধারিত হারে বিভিন্ন উপজাতি কর্তৃক নির্বাচিত হবেন।
পরিষদের সকল সভায় চেয়ারম্যান সভাপতিত্ব করবেন। তাঁর অনুপস্থিতে সভায় উপস্থিত উপজাতীয় সদস্যগণের মধ্য থেকে কোন সদস্য সভাপতিত্ব করবেন। পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা বলে গণ্য হবেন। জেলা প্রশাসক পদাধিকারবলে পরিষদের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পরিষদে সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজাতীয় প্রধানগণ বিশেষ মর্যাদা প্রাপ্ত হবেন। ১৯৮৯ সালের ২৫ জুন তিনটি পার্বত্য জেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠিত হয়।
পৃষ্ঠা ১১৪
পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদের কার্যাবলি
স্থানীয় সরকার পরিষদের কাজ হলো-
১. জেলায় আইনশৃঙ্খলা সংরক্ষণ ও তার উন্নতি বিধান।
২. উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা, বাস্তবায়ন ও এর সমন্বয় সাধন।
৩. জেলার শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন।
৪. স্বাস্থ্যরক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ।
৫. কৃষি ও বন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন।
৬. পশুপালন ও মৎস্য সম্পদের উন্নয়ন।
৭. সমাজকল্যাণমূলক কাজ সম্পাদন।
৮. ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সংগঠন, পরিচালনা ও সংরক্ষণ।
৯. জেলার শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার।
সমাজকল্যাণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার গুরুত্ব
সমাজকল্যাণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার গুরুত্ব নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো-
১. স্থানীয় ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান : আধুনিক সমাজকল্যাণ স্থানীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সমস্যার সমাধানে বিশ্বাসী। এতে বিশ্বাস করা হয়, বাহ্যিক সাহায্যের মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী সমাধান আশা করা যায় না। সুতরাং স্থানীয় সমস্যা সমাধানে স্থানীয় সংস্থাগুলোর ভূমিকার গুরুত্ব অপরিসীম। এসব সংস্থার মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন অধিক সুবিধাজনক ও কার্যকর।
২. দুঃস্থ শ্রেণীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি : সমাজের দুঃস্থ ও নিম্ন শ্রেণীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধিতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষমতাহীন শ্রেণীর অংশায়ন তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়ক।
৩. ক্ষমতা কাঠামোর ব্যবহার : স্থানীয় উন্নয়নে স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামোর ব্যবহার সমাজল্যাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সরকার গ্রামীণ আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ এনে দেয়।
৪. অংশীদারিত্বমূলক উন্নয়ন : আধুনিক সমাজকল্যাণের অংশীদারিত্বমূলক উন্নয়নের সফল বাস্তবায়নের কার্যকর মাধ্যম হলো স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা।
৫. সমাজসেবা কার্যাবলীর সফল বাস্তবায়ন : বাংলাদেশে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে গ্রামীণ সমাজসেবা এবং পৌর সমাজসেবা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর সমর্থন ও সহযোগিতার গুরুত্ব অপরিসীম। পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের সক্রিয় সহযোগিতা ও সমর্থন ব্যতীত এসব প্রকল্পের যথাযথ বাস্তবায়ন আশা করা যায় না।
সুতরাং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো সমাজকল্যাণের জ্ঞান ও কৌশল প্রয়োগ করে স্থানীয় সংস্থাগুলোকে অধিক গণমুখী ও কল্যাণমুখী করে গড়ে তোলা যায়। বিশেষ করে দল সমাজকর্ম এবং জনসমষ্টি সমাজকর্ম পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে অধিক কার্যকর করার সুযোগ রয়েছে।
পৃষ্ঠা ১১৫
স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান |
বর্তমান বিশ্বে সমাজকল্যাণের দু’টি ধারা প্রচলিত রয়েছে। একটি হলো স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ কার্যক্রম এবং অন্যটি হলো সরকারি সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান। সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো পরিপূরক ভূমিকা পালন করছে। নিচে সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সমাজসেবা প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো।
সরকারি সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান
যে সব সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় নীতি ও পরিকল্পনার আওতায় সরকারি প্রশাসন কর্তৃপক্ষ দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত, সেগুলোকে সরকারি সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান বলা হয়। সরকারি সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় ব্যয়ভার সরকারি খাত হতে নির্বাহ করা হয়। এসব সংস্থা সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। সরকারি সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরকারের জনকল্যাণ নীতি এবং লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়। যেমন- বাংলাদেশ সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত সরকারি শিশু সদন।
সেচ্ছাসেবী সংস্থা
সমাজকল্যাণের কোন ক্ষেত্রে সেবা প্রদানের লক্ষ্যে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ও স্ব-উদ্যোগে এবং সরকারের স্বীকৃতিকে প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানকে স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থা বলা হয়। সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী, “স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হলো এমন সব সংগঠন, যেগুলোর তহবিল বেসরকারি উৎস হতে সংগৃহীত এবং লক্ষ্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে অনগ্রসর শ্রেণীকে স্বাস্থ্য ও সমাজসেবাসহ অন্যান্য সেবা প্রদান। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহের প্রবণতা হলো বিশেষ প্রয়োজন ও সমস্যা সমাধানে সেবা প্রদান। সেবা প্রদানের বিশেষ ক্ষেত্রসমূহের মধ্যে রয়েছে-স্বাস্থ্য ও হাসপাতাল সেবা (যেমন-বাংলাদেশ বহুমূত্র সমিতি, বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি, বাংলাদেশ যক্ষ্মা সমিতি) বিশেষ দল বা শ্রেণীকে সাহায্য করা (যেমন- প্রবীণ হিতৈষী সংঘ)। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মূল লক্ষ্য হলো, সরকারি এজেন্সীর বাইরে মানবিক সেবা প্রদান।
স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ হচ্ছে জনগণের স্ব-ইচ্ছায় পরিচালিত স্বতঃস্ফূর্ত সমাজসেবা কার্যাবলির সমষ্টি। সরকারি কর্মসূচির বাইরে সমাজের অনগ্রসর শ্রেণীর কল্যাণে সমাজসেবা কার্যাবলির বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জনগণের স্ব-উদ্যোগে গড়ে উঠা সংস্থা স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ সংগঠন নামে পরিচিত।
পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের সমাজকল্যাণ বিভাগের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘সমাজের কোন স্বীকৃত ক্ষেত্রে সেবা প্রদানের লক্ষ্যে জনগণের সবতঃস্ফূর্ত এবং স্বেচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত সংস্থাকে স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ বলা হয়।’ বাংলাদেশে ১৯৬১ সালে প্রণীত স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থা (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) আইনে স্বেচ্ছামূলক সংস্থার কার্যকরী সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ঐ আইনে প্রদত্ত সংজ্ঞানুযায়ী, ‘‘কোন সমাজসেবা বা কল্যাণমূলক কাজ করার লক্ষ্যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমূহের স্বাধীন ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ইচ্ছায় গঠিত সংগঠন, সমিতি বা কার্যক্রমকেই স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ বলা হয়।’’
সুতরাং বলা যায়, স্বেচ্ছামূলক সংস্থা হলো কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের স্ব-ইচ্ছায় ও স্ব-উদ্যোগে গৃহীত সমাজসেবা কার্যাবলি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গড়ে উঠা সংগঠন। জনগণের স্বতস্ফূর্ত দান, চাঁদা ও সরকারি অনুদান স্বেচছাসেবী সংস্থার
পৃষ্ঠা ১১৬
আয়ের প্রধান উৎস। যেমন-বাংলাদেশ বহুমূত্র সমিতি, বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ইত্যাদি।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো-
ক. এগুলো ধর্মীয় মুল্যবোধ এবং মানবিক চেতনার ভিত্তিতে গড়ে উঠে। ধর্মীয় অনুপ্রেরণার ও মানব প্রেমই হলো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মূল চালিকাশক্তি।
খ. এসব সংস্থা জনগণের মধ্যে লক্ষ্যদল নির্বাচন করে সাহায্য ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করে।
গ. সরকারি প্রশাসনের বাইরে সংশ্লিষ্ট আইনের আওতায় বাধ্যতামূলক নিবন্ধনের মাধ্যমে এসব সংস্থা কাজ করে।
ঘ. স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রশাসনিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা সরকারি সংস্থার তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম।
ঙ. আর্থিক সাহায্য ও মানবিক সেবাপ্রদানের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গঠিত হয়।
চ. সেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো নিজস্ব গঠনতন্ত্র ও সাংগঠনিক কাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।
ছ. বর্তমানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কর্মরত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো বেতনভুক কর্মচারী নিয়োগের মাধ্যমে পেশাদারী দৃষ্টিকোণ হতে সমাজসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সুবিধা-অসুবিধা
সরকারি সমাজসেবা প্রতিষ্ঠানের তুলানায় স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থার যেমন কতগুলো সুবিধা রয়েছে, তেমনি কতকগুলো অসুবিধাও আছে। নিচে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সুবিধা-অসুবিধাগুলো উল্লেখ করা হলো-
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সুবিধা
১. স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোতে প্রশাসনিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা সরকারি সংস্থার তুলনায় অনেক কম। ফলে প্রয়োজন ও সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
২. স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো সরকারি সংস্থার সহায়ক ও পরিপূরক ভূমিকা পালন করে।
৩. স্থানীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সমস্যা সমাধানে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
৪. স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো পরীক্ষামূলক ছোট ছোট প্রকল্প বাস্তবায়ন করে উন্নয়নের মডেল বা আদর্শ উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
৫. স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মচারীদের সঙ্গে সেবা গ্রহণকারীদের সরাসরি ও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকায় তারা সহজে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে।
৬. স্বেচছাসেবী সংস্থাগুলো জনগণের সংগঠিত প্রচেষ্টায় পরিচালিত হয় বলে সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত হয়। এতে প্রশাসনিক ব্যয় অনেক কম বলে সম্পদের অপচয় হ্রাস পায়।
৭. স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো জনগণের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং সমাজ সচেতনতা সৃষ্টি ও নেতৃত্বের বিকাশ ঘটায়।
৮. স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো জনগণের অর্থে জনগণের সংগঠিত প্রচেষ্টায় পরিচালিত হয় বিধায় এগুলোতে দুর্নীতির সুযোগ কম থাকে।
পৃষ্ঠা ১১৭
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর অসুবিধা
১. স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলোর কার্যাবলির ধারাবাহিকতা না থাকায় সমস্যার স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধানে অক্ষম।
২. স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শিথিল ও নমনীয় থাকায় অর্থ আত্মসাতের প্রবণতা বেশি থাকে।
৩. সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিপত্তি লাভের সুযোগ থাকায় অনেক সময় ব্যক্তিগত স্বার্থে সম্পদশালী ও বিত্তবান শ্রেণী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়ে তুলে।
৪. সরকারি সংস্থার মতো নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা বলবৎ না থাকায় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো সংগঠনের স্বেচ্ছাচারিতার শিকারে পরিণত হয়।
৫. স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্য এবং ত্রাণকার্য পরিচালনা করে, যা মানুষের কর্মস্পৃহা নষ্ট এবং পরনির্ভরশীল মানসিকতা সৃষ্টি করে।
পরিশেষে বলা যায়, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর কতগুলো অসুবিধা থাকা সত্বেও বাংলাদেশের মতো দরিদ্র ও অনুন্নত দেশে সরকারি প্রশাসনিক কাঠামোর বাইরে সরকারি স্বীকৃতির মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলো আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ২০০১-২০০২ সাল পর্যন্ত বেসরকারি সংস্থার মোট সংখ্যা ছিল ১৬৭১টি এবং এসব সংস্থার প্রকল্প সংখ্যা ছিল ৭৪৬টি। অক্টোবর ২০০৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ১৮৮২টি এনজিও কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশে দরিদ্রদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকারি প্রচেষ্টার সম্পূরক হিসেবে কর্মরত রয়েছে। জুন, ২০০৩ সাল পর্যন্ত সমাজসেবা অধিদপ্তরে নিবন্ধিত স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংগঠনের সংখ্যা ছিল ২৭ হাজার ৫৫১টি।
বাংলাদেশ সোসাইটি এক্ট, সমবায় বিভাগ, মহিলা ও যুব মন্ত্রণালয়ের অধীনেও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিবন্ধন দেয়া হয়। বাংলাদেশে প্রায় এক লাখের অধিক দেশি-বিদেশি তহবিলপুষ্ট এনজিও রয়েছে।
অনুশীলনী
রচনামূলক প্রশ্ন
১. সমাজ কাকে বলে ? মানব জীবনে সমাজের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।
২. সামাজিক প্রতিষ্ঠান কাকে বলে ? মানব জীবনে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা আলোচনা কর।
৩. পরিবার কাকে বলে ? পরিবারের প্রধান কার্যাবলি আলোচনা কর।
৪. বিবাহের সংজ্ঞা দাও ? বিবাহের সামাজিক ভূমিকা ও তাৎপর্য আলোচনা কর।
৫. ধর্ম কি ? সমাজকল্যাণে ধর্মের ভূমিকা আলোচনা কর।
৬. স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান বলতে কি বুঝ ? সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের পার্থক্য কি ?
৭. রাষ্ট্র কি ? বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার সন্বন্ধে আলোচনা কর।
৮. স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞা দাও। সমাজসেবার ক্ষেত্রে অথবা সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা বর্ণনা কর।
পৃষ্ঠা ১১৮
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. জ্ঞাতি সম্পর্ক কি ?
২. জনসমষ্টি কি ?
৩. স্থানীয় সরকার কি ?
৪. সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য লিখ।
৫. সমাজ বলতে কি বুঝ ?
৬. সামাজিক প্রতিষ্ঠান ধারণা ব্যাখ্যা কর।
৭. বিবাহ কি ?
৮. স্থানীয় সরকার কি ?
৯. স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান বলতে কি বুঝ ?
১০. জনসমষ্টির বৈশিষ্ট্য কি ?