পৃষ্ঠা ১৫০
ষষ্ঠ অধ্যায়
ভারতীয় উপমহাদেশের বিশিষ্ট সমাজসেবী ও সংস্কারকদের অবদান

ভূমিকা
আধুনিক সমাজকল্যাণের বিকাশ সাম্প্রতিককালের হলেও এর দার্শনিক ভিত্তি সুদূর অতীতে গ্রোথিত। আধুনিক সমাজকল্যাণের বিকাশে যেমন বিভিন্ন ধর্মের অবদান অপরিসীম; তেমনি যুগে যুগে আগত ক্ষণজন্মা মনীষীদের সমাজসংস্কার ও সমাজসেবামূলক কার্যাবলির অবদান কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানবহিতৈষী সমাজসংস্কারক এবং সমাজ সেবীদের সমন্বিত প্রচেষ্টার ফল হলো আধুনিক সমাজকল্যাণ। সমাজকল্যাণে সমাজসংস্কারক ও সমাজসেবীদের গৌরবময় অবদান মূল্যায়ন করতে গিয়ে এম.এস. গোর বলেছেন, ‘ভারতবর্ষের অতীত সকল আর্থ-সামাজিক এবং কল্যাণমূলক কার্যক্রমই সমাজসংস্কারকদের তৎপরতা দ্বারা অনুপ্রাণীত ও প্রভাবিত হয়েছে।’ ভারতীয় উপমহাদেশে যেসব মনীষী সমাজসংস্কার এবং সমাজসেবার ক্ষেত্রে গৌরবময় ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন তাঁদের মধ্যে হাজী মুহম্মদ মুহসিন, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নওয়াব আবুদুল লতিফ, বেগম রোকেয়া, নওয়াব ফয়জুন্নেছা, এ.কে. ফজলুল হক প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সমাজসংস্কার এবং সমাজসেবার ক্ষেত্রে এসব মনীষীদের অবদান পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো।
হাজী মুহম্মদ মুহসিন (জন্মঃ ১৭৩২, মৃত্যুঃ ১৮১২) |
ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজ সেবার ক্ষেত্রে যে সব মনীষীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে, তাঁদের মধ্যে দানবীর হাজী মুহম্মদ মুহসিন অন্যতম। তাঁর দানশীলতা, উদারতা, পরোপকারিতার জন্য তাঁকে ‘বঙ্গের হাতেম তাই’ অবিধায় ভূষিত করা হয়ে থাকে।
ব্যক্তিগত জীবন ঃ পশ্চিম বাংলার হুগলী জেলার এক সম্ভ্রান্ত ও সম্পদশালী মুসলিম পরিবারে ১৭৩২ সালে দানবীর হাজী মুহম্মদ মুহসিন জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হাজী ফয়জুল্লাহ ছিলেন একজন খ্যাতনামা ব্যবসায়ী। পূর্বপুরুষরা ছিলেন পারস্য দেশের ব্যবসায়ী। গৃহশিক্ষকের নিকট তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। পরবর্তীকালে তিনি মুর্শিদাবাদে গমন করেন। সেখানে স্বল্প সময়ের মধ্যে স্বীয় প্রতিভাবলে আরবী, ফার্সি ও সংস্কৃতবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জনসহ পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্থ করেন। এরপর তিনি আধ্যাত্মিক ও জাগতিক জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদীর্ঘ ত্রিশ বৎসর যাবত ইরান, তুরস্ক, মিশর সহ মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশ ভ্রমণ করেন। পরিশেষে মক্কায় হজ্জ পালন করে ১৭৮৯ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
দেশে প্রত্যাবর্তনের কিছুদিন পরই তাঁর নিঃসন্তান বৈমাত্রিক বোন মন্নুজান পরলোকগমন করলে মন্নুজানের বিশাল সম্পত্তি হাজী মুহম্মদ মুহসিনের মালিকানার অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি সবসময় অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করতেন। তিনি আজীবন অবিবাহিত থেকে তাঁর বিশাল সম্পত্তির সমুদয় শিক্ষা বিস্তার ও মানব কল্যাণে দান করে যান।
সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে হাজী মুহম্মদ মুহসিনের অবদানর ঃ দানবীর হাজী মুহম্মদ মুহসিন সমাজসেবার ক্ষেত্রে যে অবদান রেখে গিয়েছেন, তা শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং সমাজসেবা এ ক্ষেত্রে দু’টি দৃষ্টিকোণ হতে আলোচনা করা যায়।
শিক্ষাক্ষেত্রে মুহসিনের অবদানঃ ১৭৮৯ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করে হাজী মুহম্মদ মুহসিন ব্রিটিশ শাসনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া উপলব্ধি করেন। তিনি বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে বুঝতে পেরেছিলেন একমাত্র শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি এবং শিক্ষা বিস্তার ব্যতীত জনগণের অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। এজন্য বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে তাঁর সম্পত্তির বিরাট অংশ ‘‘ওয়াক্ফ’’ করে যান। গরীব ও মেধাবী ছাত্রদের আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে সাহায্য করার জন্য ১৮০৬ সালে এক লাখ ছাপ্পান্ন হাজার টাকার সম্পত্তি তহবিলে ‘‘মুহসিন ট্রাস্ট’’ গঠন করেন। অধঃপতিত দরিদ্র মুসলমান সমাজে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের যে উদ্দেশ্যে মুহসিন ট্রাস্ট গঠিত হয়েছিল তা পূরণ হয়নি। কারণ সকল সম্প্রদায়ের ছাত্ররা শিক্ষার জন্য ট্রাস্ট হতে অর্থ লাভ করত। অবশেষে ১৮৭৩ সালে নওয়াব আবদুল লতিফ, স্যার উইলিয়াম হান্টার প্রমুখ মনীষীদের প্রচেষ্টায় মুহসিন ট্রাস্টের অর্থ শুধু বাংলার মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারে ব্যয় করার ব্যবস্থা করা হয়। অদ্যাবধি ‘‘মুহসিন ট্রাস্টের বৃত্তি’’ দান প্রচলিত রয়েছে। তিনি
পৃষ্ঠা ১৫১
অমুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদেরও শিক্ষা লাভের জন্য মুক্তহস্তে প্রদান করতেন। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অনন্য অবদান হচ্ছে ‘‘হুগলী কলেজ’’ এবং ‘‘হুগলী মাদ্রাসা’’। ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত বাংলার অধপতিত মুসলমান সমাজে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তাঁর দান চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষায় উৎসাহিত করার জন্য হাজী মুহম্মদ মুহসিন যে অবদান রেখে গিয়েছেন তার একটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হলো। ১৮৮৭ সালে হাজী মুহম্মদ মুহসিন তখনকার এক লাখ টাকা দিয়ে একটি তহবিল গঠন করেন। এই তহবিলের টাকা তিনি বৃটিশ আমলের পরীক্ষার পরিচালক বোর্ডের অর্থাৎ সরকারের হাতে তুলে দেন। তহবিলের ঘোষণায় বলা হয় ম্যাট্রিক পরীক্ষায় কোন মুসলিম ছাত্র প্রথম হলে এ তহবিল থেকে তাকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ বৃত্তি হিসেবে দেয়া হবে। ১৮৮৭ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত কোন মুসলিম ছাত্র ম্যাট্রিক এবং বর্তমানের মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করতে পারেনি। ফলে ১১৩ বছর আগের সেই এক লাখ টাকা সুদীর্ঘ ১১৩ বছর পর ভারতের পশ্চিম বঙ্গ সরকারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেদিনীপুর জেলার কাজী আজিজুল ইসলাম নামের জনৈক মুসলিম ছাত্র প্রথম স্থান অধিকার করে ঐ তহবিল থেকে বিপুল অর্থ লাভ করে।
ইসলামী শিক্ষার জন্য তিনি বহু মসজিদ, মক্তব ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষকদের বেতন এবং গরীব অসহায় ছাত্রদের কুরআন-হাদীস বিতরণ এবং খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা নিজে বিনামূল্যে করতেন।
সমাজসেবার ক্ষেত্রে মুহসিনের অবদান ঃ চিকিৎসা ও জনসেবার ক্ষেত্রেও হাজী মুহসিনের অবদান অপরিসীম। দরিদ্রদের চিকিৎসার সুবিধার্থে হুগলীতে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। তাঁর বিভিন্ন জনহিতকর কার্যাবলির অমর কীর্তি ও নিদর্শনগুলোর মধ্যে হুগলীর ‘ইমাম বাড়া’ অন্যতম।
ট্রাস্ট গঠন ঃ ১৮০৬ সালে দানবীর মহসীন একটা ট্রাস্ট গটন করেন। তিনি তাঁর সম্পত্তিকে নয়টি শেয়ারে ভাগ করেন। তিনটি শেয়ার ধর্মীয় কাজে ব্যবহারের জন্য; চারটি শেয়ার পেনশন, বৃত্তি ও দাতব্য কাজে ব্যয়ের নিমিত্তে এবং দুটি শেয়ার মোতাওয়াল্লীদের বেতন হিসেবে রাখা হয়।
১৭৬৯-৭০ সালের সরকারি দলিল থেকে জানা যায়। সে সময় মহাদুর্ভিক্ষে মুহাম্মদ মহসিন বহু লঙ্গরখানা স্থাপন এবং সরকারি সাহায্য তহবিলে অর্থ প্রদান করেছিলেন।
হাজী মুহসিন ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ এবং নিষ্ঠাবান মুসলমান হলেও তার মধ্যে কোনরূপ ধর্মীয় কুসংস্কার ছিল না। তিনি ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকল বিপদগ্রস্ত ও অভাবগ্রস্তকেই মুক্ত হস্তে দান করতেন। তার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে আগত ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁরই বৃত্তির টাকায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠত হয়েছে।
খুলনা ও যশোরের লোনা পানি পান করার উপযোগী ছিল না এবং শস্য নষ্ট হতো দারুনভাবে। জমিদারীর আয়ের এক অংশ দিয়ে তিনি এ অঞ্চলের প্রজাদের পানির কষ্ট দূর করার জন্য বহু দিঘী ও পুকুর খনন করেন। লবণাক্ত পানির কবল থেকে ফসল রক্ষার্থে বাঁধ ও ভেড়ি নির্মাণ করেন।
জনকল্যাণের জন্য উৎসর্গকৃত দানপত্র বা তৈলতনামা আরবী, ফার্সি ভাষায় লিপিবদ্ধ আকারে হুগলীর ইমাম বাড়ার রেকর্ড রুমে ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদসহ সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে, যা দানবীর হাজী মুহম্মদ মুহসিনের সমাজসেবার অমর স্বাক্ষর বহন করছে।
রাজা রামমোহন রায় ( জন্মঃ ১৭৭২; মৃত্যুঃ ১৮৩৩ ) |
বৃটিশ শাসিত ভারতের যেসব মুক্ত বুদ্ধিসম্পন্ন মানবতাবাদী মনীষী সমাজসংস্কারে গৌরবোজ্জ্বল অবদান রেখে গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় অন্যতম। তাঁর অবদান হিন্দু ধর্ম সংস্কার, শিক্ষা বিস্তার, সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে অমর হয়ে রয়েছে।
ব্যক্তিগত পরিচয় ঃ ১৭৭২ সালের ২২শে মে অবিভক্ত বাংলার হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে রাজা রামমোহন রায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান এবং জ্ঞানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল অপরিসীম। বর্ণভেদ প্রথায় জর্জরিত গোঁড়া হিন্দু
পৃষ্ঠা ১৫২
সমাজে জন্মগ্রহণ করেও তিনি ইসলাম, হিন্দু, খ্রিস্ট এবং বৌদ্ধ ধর্মের ওপর প্রচুর লেখাপড়া করেন। এসব ধর্মজ্ঞান তাঁকে একেশ্বরবাদী হতে সহায়তা করে। তিনি ইংরেজি, ফরাসি এবং আরবি ভাষায় পড়ালেখা করেন। এ সবের মূল লক্ষ্য ছিল প্রগতিশীল সমাজ গঠনে এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চেতনাবোধ জাগ্রত করতে জনগণকে অনুপ্রাণিত করা। ১৮৩০ সালে দিল্লীর সম্রাট দ্বিতীয় আকবরের নিকট হতে তিনি রাজা উপাধি লাভ করেন। এ সময় হতে তিনি সামাজিক আভিজাত্য ও মর্যাদার প্রতীক ধারণ করে রাজা রামমোহন রায় নামে পরিচিত হন। ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরে রাজা রামমোহন রায় প্রাণ ত্যাগ করেন।
রাজা রামমোহনের অবদান ঃ সমাজসংস্কার ও সমাজ সেবার ক্ষেত্রে রামমোহন রায়ের অবদানকে হিন্দু ধর্ম সংস্কার, সমাজসংস্কার, শিক্ষা বিস্তার এবং রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি - এ চারটি দৃষ্টিকোণ হতে আলোচনা করা যায়।
ক. ধর্মীয় সংস্কার ঃ রাজা রামমোহন রায় ইসলাম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের বিভিন্ন তত্ত্বগত জ্ঞান লাভ করেন। ফলে তিনি পৌত্তলিকতা বিরোধী একেশ্বরবাদী ও সংস্কারমুক্ত উদার চিন্তাধারার অধিকারী হয়ে উঠেন। ১৮১৩ সালে আরবি ও ফার্সি ভাষায় সংস্কারমুক্ত একেশ্বরবাদী ধর্মীয় মতবাদ ব্যাখ্যা সম্বলিত তুহফাত-উল-মুয়াহিদ্দীন (এবং একেশ্বরবাদ প্রচারের লক্ষ্যে মানজারাতুল আধিয়ান প্রকাশ করেন।
হিন্দুদের ধর্মীয় জীবনে অশিক্ষা, অজ্ঞতা এবং বর্ণভেদ প্রথার প্রভাবে যে সব কুসংস্কার ও কুপ্রথা প্রচলিত ছিল সেগুলো উচ্ছেদ সাধনের চেষ্টা চালান। ১৮১৫ সালে বেদান্ত অনুযায়ী ব্রহ্মের উপাসনা এবং হিন্দু সমাজকে পৌত্তলিকতার হাত থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে তিনি ‘আত্মীয় সভা’ গঠন করেন। সর্বব্যাপী ভগবানের ঐক্য প্রচারই আত্মীয়সভা গঠনের মূল লক্ষ্য ছিল।
রাজা রামমোহন রায় তাঁর নতুন ধর্মমত প্রচার এবং সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৮২৮ সালের ২০শে আগষ্ট ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে ধর্মীয় সংস্কারের ক্ষেত্রে নবযুগের সূচনা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্ম সমাজ গঠনের মাধ্যমেই তাঁর ধর্ম সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। বিভিন্ন ধর্ম জ্ঞান তাঁকে একেশ্বরবাদী হতে সহায়তা করে এবং ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত করে।
খ. সমাজসংস্কার : সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের সবচেয়ে বড় অবদান হলো নিষ্ঠুর সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ সাধন। হিন্দু সমাজে মৃত স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর সহমরণের প্রথাই সতীদাহ প্রথা নামে পরিচিত। ধর্মান্ধতার এক নিষ্ঠুর প্রকাশ ছিল সতীদাহ প্রথা। ধর্মের দোহাই দিয়ে ও মৃত স্বামীর নরক বাসের ভয় দেখিয়ে বিধবা পত্নীকে জোর করে নিষ্ঠুর এক পৈশাচিক পদ্ধতিতে সতীদাহ অনুষ্ঠিত হতো। ধর্মের দোহাই দিয়ে এ নিষ্ঠুর সতীদাহ প্রথার মাহাত্ম বর্ণনা করে বলা হয়েছে- ‘‘পতির চিতায় পুড়ে মরলে সতী সাধ্বী স্ত্রীর মানুষের গায়ে যত লোম আছে তত বছর অর্থাৎ সাড়ে তিন কোটি বছর পতিসহ সুখে স্বর্গে বাস করবে এবং তার পতির পিতৃ-মাতৃ উভয় কুলের তিন পুরুষ পাপমুক্ত হবে। সহমরণে যাওয়ার মতো পত্নীর আর কোন মহৎ কর্তব্য নেই। এ জন্মে এটি অবহেলা করলে পরজন্মে তার পশুজন্ম হবে।’’ ধর্মের দোহাই দিয়ে ১৮১৫ সাল হতে ১৮২৮ সালের মধ্যে শুধু বঙ্গদেশে ৮,১৩৪ টি সতীদাহ ঘটনা ঘটে। ১৮১৮ সাল হতে ১৮২০ সালের মধ্যে যারা সতী হয়েছিল, তাদের মধ্যে তিনজনের বয়স আট বছর এবং তেতালিশ জনের বয়স নয় হতে ষোল বছরের মধ্যে ছিল। ১৭৯৯ সালে নদীয়ার এক কুলীন ব্রাহ্মণের ২৩জন স্ত্রীর, তার সঙ্গে সহমৃত্যু হয়।
রাজা রামমোহন রায় নিষ্ঠুর সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়কে সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তুলেন। যার ফলে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠে। অবশেষে লর্ড বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর সতীদাহ উচ্ছেদ আইন পাশ করেন। সতীদাহকে ঐ আইনে সরাসরি নিন্দনীয় নরহত্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
সতীদাহ উচ্ছেদ আইন পাশের পর পরই প্রাচীনপন্থী হিন্দুগণ এর বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলে এবং ঐ আইন প্রত্যাহারের জন্য আবেদন জানায়। বেন্টিঙ্ক প্রাচীনপন্থী হিন্দুদের আবেদন অগ্রাহ্য করেন। ফলে তারা বিলাতে প্রিভি কাউন্সিলের নিকট আপীল করেন। রাজা রামমোহন রায় ব্যক্তিগতভাবে সতীদাহ উচ্ছেদ আইনের সমর্থনে লন্ডনে প্রিভি কাউন্সিলের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় প্রাচীনপন্থী হিন্দুদের আপীল অগ্রাহ্য হয়। এভাবে রাজা রামমোহন রায় অমানবিক সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ সাধনে সক্ষম হন।
পৃষ্ঠা ১৫৩
এছাড়া বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ এবং শিশুকন্যা হত্যার মতো কুসংস্কার ও কু-প্রথা দূরীকরণের লক্ষ্যে তিনি আন্দোলন গড়ে তুলেন। যার ফলে সমাজ থেকে এসব কুপ্রথা দূর হয়। সমাজে নারীদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি নিরলস প্রচেষ্টা চালান।
গ. শিক্ষা বিস্তার : রাজা রামমোহন রায় জনগণের মঙ্গল ও উন্নয়নের স্বার্থে ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করেছিলেন। এজন্য ১৮২৩ সালে প্রস্তাবিত সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি বিরোধিতা এবং পাশ্চাত্যের শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে বেদান্ত কলেজ স্থাপন করেন। কলকাতায় ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠায় তিনি ব্রিটিশ সরকারকে বিশেষভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করেন। ব্রাহ্ম সমাজের মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারের জন্য কয়েকটি ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন।
ঘ. রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবদান : ভারতে রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি এবং জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রামমোহন রায় আন্দোলন গড়ে তুলেন। নাগরিক অধিকার রক্ষার সর্বপ্রথম প্রতিবাদ উত্থাপনে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক তথ্য ও চিন্তাধারা প্রচারের জন্য তিনি ১৮২১ সালে ‘সংবাদ কৌমুদী’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ইউরোপ ও পাশ্চাত্যের মতো জাতীয়তাবাদী চেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৮২২ সালে ফার্সী ভাষায় ‘মীরাতুল আখবার’ প্রকাশ করেন। ১৮২৩ সালে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের নিকট প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ জানান। ১৮৩০ সালে দিল্লীর সম্রাট দ্বিতীয় আকবর তাঁকে বিলেতে পাঠালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপ ও ভারতীয়দের দুরাবস্থা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অত্যন্ত বলিষ্ঠ এবং সোচ্চার কণ্ঠে তুলে ধরেন। এতে ভারতের রাজনৈতিক মুখপাত্র হিসেবে তিনি রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে সক্ষম হন।
পরিশেষে বলা যায় ধর্ম, শিক্ষা, সমাজ ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান ভারতীয় সমাজসংস্কারের ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করেছিল। রাজা রামমোহন রায়ের আন্দোলন এবং কর্ম প্রচেষ্টার অনুপ্রেরণায় পরবর্তীতে বহু হিন্দু মুসলমান মানবতাবাদী ভারতীয়দের কল্যাণে এগিয়ে এসেছিলেন। এদিক হতে রাজা রামমোহন রায়কে ভারতীয় উপমহাদেশে সংস্কার আন্দোলনের অগ্রদূত হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ভারতে আধুনিক যুগের প্রবর্তক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর( জন্মঃ ১৮২০; মৃত্যুঃ ১৮৯১ ) |
যেসব মানবতাবাদী মহাপুরুষ এবং আধুনিক চিন্তাধারার ধারক ও বাহক মানবকল্যাণের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন, তাদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অন্যতম। সাধারণ দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও নিজ প্রতিভা এবং কর্মগুণে তিনি মহান সমাজসংস্কারক ও পন্ডিত হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হন।
ব্যক্তিগত পরিচয় : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর পশ্চিম বাংলার মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় কলকাতায় সামান্য বেতনে চাকুরি করতেন। গ্রামীণ পরিবেশে গুরুগৃহে তাঁর শিক্ষা জীবনের সূচনা হয়। আট বছর বয়সে শিক্ষা লাভের জন্য তিনি পিতার সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন। বারো বছর বয়সে তিনি সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন।
বয়সের তুলনায় তাঁর শিক্ষা অগ্রগতি ছিল অতুলনীয়। তাঁর ধীশক্তি, মেধা ও প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ শিক্ষকগণ ১৮৩৯ সালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘‘বিদ্যাসাগর’’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৮৪১ সালে সংস্কৃত কলেজের পাঠ শেষ করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে একুশ বছর বয়সে হেডপন্ডিত হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। পরবর্তীতে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে স্থায়ীভাবে কর্মজীবন শুরু করেন। কর্মজীবনের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত তিনি শিক্ষার সাথে জড়িত ছিলেন।
পৃষ্ঠা ১৫৪
বহুমুখী প্রতিভা এবং বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী উনবিংশ শতাব্দীর ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ মহামানব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৯১ সালে পরলোক গমন করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সামগ্রিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে সমাজ সেবা ও সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান ফুটে উঠে। সমাজকল্যাণের দৃষ্টিকোণ হতে তাঁর কর্মধারাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়- (ক) শিক্ষা বিস্তার (খ) সমাজসংস্কার (গ) সমাজ সেবা।
ক. শিক্ষা বিস্তারে অবদান : ঈশ্বরচন্দ্র নিজে শিক্ষিত, পন্ডিত ও সুসাহিত্যিক ছিলেন। তাই সমাজ জীবনে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব তিনি সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কর্মজীবনে তিনি যেমন শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতায় আজীবন নিয়োজিত ছিলেন, তেমনি শিক্ষা বিস্তারের জন্য ব্যাপক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করেন। তাঁর শিক্ষা বিস্তারমূলক কার্যক্রমের মধ্যে স্বীয় উদ্যোগে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন অন্যতম। বঙ্গীয় শিক্ষা পরিষদের সভাপতি বেথুন সাহেবের সহায়তায় নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি কলকাতা বেথুন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৫৩ সালে নিজ ব্যয়ে মেদিনীপুরে একটি অবৈতনিক দিবা এবং নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৬৪ সালে নিজ অর্থ ব্যয়ে এবং স্বীয় তত্বাবধানে কলকাতার মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন গড়ে তুলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৮৭৯ সালে এটি কলেজে পরিণত হয়। বর্তমানে এটি ‘বিদ্যাসাগর কলেজ’ নামে পরিচিত। লোকশিক্ষা কার্যক্রমের শিক্ষা পরিদর্শকের দায়িত্ব পালনের সময় তিনি শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেন। সরকারী শিক্ষা সংস্কার কমিটির সদস্য হিসেবে যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে চির অম্লান হয়ে রয়েছে। শিক্ষা বিস্তার ও সমাজসংস্কারই ছিল তাঁর সাহিত্য কর্মের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। শিক্ষা সংস্কারকে তিনি নিজ জীবনের ডার্লিং অবজেক্ট বা প্রিয়তম উদ্দেশ্য বলে বর্ণনা করেছেন।
খ. সমাজসংস্কার ঃ বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার কার্যাবলির মধ্যে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ উচ্ছেদ এবং হিন্দু বিধবা বিবাহ প্রচলন অন্যতম। সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আইন প্রবর্তন এবং তৎকালীন হিন্দু সমাজে বাল্য বিবাহের ব্যাপক প্রচলন থাকায় বাল্য বৈধব্যের সংখ্যা অধিক হারে বেড়ে যায়। দ্বিতীয় বিবাহের সুযোগ না থাকায় বিধবারা সামাজিক, আর্থিক ও পরিবারিক ক্ষেত্রে অমানবিক অবস্থায় মানবেতর জীবন-যাপন করত। এর বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘‘বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম। এ জন্মে এটি অপেক্ষা অধিকতর আর কোন সৎকর্ম করতে পারব তার সম্ভাবনা নেই। এ বিষয়ের জন্য সর্বস্বান্ত হয়েছি এবং আবশ্যক হলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরামুখ নই। আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নই। নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যা উচিত আবশ্যক বোধ হলে তা করব। লোকের বা কুটুমদের ভয়ে কদাচ সংকুচিত হব না।’’ ১৮৫৫ সালের ১৭ই নভেম্বর বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় বিধবা বিবাহ আইনের খসড়া পেশ করা হলে ভারতের সর্বত্র এর স্বপক্ষে ও বিপক্ষে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবা বিবাহ আইনের সমর্থনে যুক্তি সহকারে আবেদন পেশ করা হয়। অবশেষে ১৮৫৬ সালের ২৬শে জুলাই লর্ড ডালহৌসীর সহায়তায় হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়নে বিদ্যাসাগর সক্ষম হন। তিনি তাঁর লেখনী শক্তি দ্বারা জনমত গঠন এবং আইন প্রণয়নে সরকারকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। স্বীয় পুত্রের সঙ্গে এক বিধবার বিবাহ দিয়ে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। কুলীন ব্রাহ্মণদের স্বার্থে হিন্দু সমাজে প্রচলিত বাল্য বিবাহ এবং বহুবিবাহ প্রচলনের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার ছিলেন বিদ্যাসাগর। দ্বি-বিবাহ ও বাল্যবিবাহ রহিতকরণ এবং বিধবা বিবাহে উৎসাহ প্রদানে ১৮৭২ সালের সিভিল ম্যারেজ এক্ট প্রণয়নে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
গ. সমাজসেবার ক্ষেত্রে অবদান : সমাজসেবার ক্ষেত্রে তিনি দয়ার সাগর হিসেবে খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৮৬৭ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা ও উড়িষ্যার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় তথায় শিবির স্থাপন করে দুর্গত জনগণের মধ্যে অর্থ ও দ্রব্য সামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। দুঃস্থ, অসহায় মানুষের কল্যাণে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৮৭২ সালে গঠিত “হিন্দু ফেমিলি এনুইটি ফান্ড” এর প্রতিষ্ঠাতা পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি ১৮৭৫ সাল
পৃষ্ঠা ১৫৫
পর্যন্ত সমাজ সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। কথিত হয় যে, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর বেতন এবং রয়ালটি বাবদ প্রাপ্ত অর্থের অর্ধাংশ দুঃপীড়িতদের সাহায্যের জন্য সংরক্ষিত থাকতো।
পরিশেষে বলা যায়, হিন্দু সমাজের গোঁড়ামী, বর্ণ বৈষম্য, কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে ব্যাপক সামাজিক সংস্কার সাধন এবং নারীদের অধিকার ও মর্যাদা সহকারে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে আজীবন সংগ্রাম করে গিয়েছেন বিদ্যাসাগর। সমাজসংস্কার ও সমাজসেবার ইতিহাসে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
পৃষ্ঠা ১৫৫
স্যার সৈয়দ আহমদ খান ( জন্মঃ ১৮১৭ ; মৃত্যুঃ ১৮৯৮ ) |
বৃটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম জাগরণের অন্যতম অগ্রদূত হলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান। অধঃপতিত এবং পশ্চাদপদ মুসলমানদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে স্যার সৈয়দ আহমদ খান অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
ব্যক্তিগত পরিচয় : মুসলিম জাগরণের মহানায়ক স্যার সৈয়দ আহমদ খান ১৮১৭ সালের ১৭ অক্টোবর দিল্লীর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। একুশ বছর বয়সে মাদ্রাসা শিক্ষা শেষ করে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় তিনি সাব-জজ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। স্যার সৈয়দ আহমদ ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সুতরাং স্বাধীনতা যুদ্ধের দায় দায়িত্ব মুসলমানদেরকে বহন করতে হবে। এ কারণে তিনি ইংরেজদের সহায়তা ও বৃটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। কর্মজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এদেশের মুসলমানদের অধঃপতনের হাত হতে মুক্ত করার প্রধান উপায় হলো তাদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলন এবং বৃটিশদের মন হতে মুসলিম বিদ্বেষ দূর করা। এমতাবস্থায় স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলমানদের স্বার্থে বৃটিশ সরকার ও মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালান। ১৮৯৮ সালের ২৭শে মার্চ মুসলিম জাগরণের মহানায়ক স্যার সৈয়দ আহমদ পরলোকগমন করেন।
শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে অবদান : হতাশা, বঞ্চনা, অজ্ঞতা ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য স্যার সৈয়দ আহমদ খান ব্যাপক শিক্ষামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষা ও সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে স্যার সৈয়দ আহমদের অবদানগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-
আলীগড় আন্দোলন : ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে যে সব আন্দোলন পশ্চাদপদ মুসলমানদের অজ্ঞতা, অশিক্ষা এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল, সেগুলোর মধ্যে আলীগড় আন্দোলন অন্যতম। স্যার সৈয়দ আহমদ খানের শিক্ষা ও সংস্কারমূলক কার্যক্রমের সামগ্রিক রূপ হলো আলীগড় আন্দোলন। ইংরেজদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রচলন এবং ইংরেজ প্রশাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে সহায়তা করার লক্ষ্যে স্যার সৈয়দ আহমদ খান কতগুলো বাস্তব ও সুদূরপ্রসারী কার্যক্রম গ্রহণ করেন। আলীগড়ভিত্তিক এসব সুদূরপ্রসারী শিক্ষা ও সমাজসংস্কারমূলক কার্যক্রমই ইতিহাসে আলীগড় আন্দোলন নামে পরিচিত।
স্যার সৈয়দ আহমদ খানের আলীগড় আন্দোলনের পটভূমি পর্যালোচনা করলে কতগুলো বাস্তব কারণ স্পষ্ট হয়ে উঠে। এগুলো হলো-
ক. ইংরেজরা মুসলমানদের কাছ থেকে এদেশের শাসন ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল। সেজন্য তারা মুসলমানদের শাসন ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বনদ্ধী এবং দাবীদার মনে করত। এজন্য মুসলমানরা তাদের রোষানলে পতিত হয়।
খ. মুসলমানরাও ব্রিটিশদের কাছে স্বাধীনতা হারানোর প্রেক্ষিতে তাদেরকে শত্রু মনে করে এড়িয়ে চলতো।
গ. মুসলমানগণ হৃত স্বাধীনতা উদ্ধারের লক্ষ্যে ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। ফলে তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়ে।
ঘ. ইংরেজ ও মুসলমানদের মধ্যে বিরাজমান বৈরি সম্পর্কের সুযোগে হিন্দু সমাজ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পদে পদে উন্নতি লাভ করতে থাকে।
উপরিউক্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের প্রভাবে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে মুসলমানগণ চরম বিপর্যয়ের মধ্যে দিনাতিপাত করতে থাকে। এমতাবস্থায় স্যার সৈয়দ আহমদ বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করে বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজ-মুসলিম সুসম্পর্ক স্থাপনই অধঃপতিত মুসলমানদের উন্নতির অন্যতম পূর্বশর্ত। এজন্য প্রয়োজন মুসলমানদের
পৃষ্ঠা ১৫৬
মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলন। তাই তিনি প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথ পরিহার করে ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।
আলীগড় আন্দোলনের লক্ষ্যগুলো ছিল -
ক. ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, অশিক্ষা, অজ্ঞতা এবং অধঃপতনের হাত থেকে মুসলমানদের রক্ষা করা।
খ. মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশ শাসকদের যে অবিশ্বাস এবং বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব বিরাজমান ছিল, তা দূর করে উভয়ের মধ্যে উত্তম সম্পর্ক স্থাপন করা।
গ. মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলন করা।
ঘ. শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও আর্থিক দিক দিয়ে মুসলমানদের হিন্দুদের সমকক্ষ করে তোলা।
ঙ. মুসলমানদের বৃটিশ প্রশাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা।
শিক্ষা ও সমাজসংস্কারমূলক কার্যক্রম : আলীগড় আন্দোলনের সূচনালগ্নে স্যার সৈয়দ আহমদ খান ‘দ্যা লয়েল মোহামিড্যান অফ ইন্ডিয়া’ এবং ‘দ্যা কাউস অফ ইন্ডিয়ান মিউটিনি’ নামক গ্রন্থে ইংরেজ ও মুসলমানদের মধ্যকার ভুল বুঝাবুঝির অবসানের চেষ্টা করেন। স্যার সৈয়দ আহমদ খানের আলীগড় কেন্দ্রিক শিক্ষা ও সমাজসংস্কারমূলক প্রধান প্রধান কার্যক্রমগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে তুলে ধরা হলো¾
১. বিজ্ঞান সমিতি : স্যার সৈয়দ আহমদ খানই সর্বপ্রথম মুসলমানদের দুর্দশা লাঘবে ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ১৮৬৪ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ একটি অনুবাদ সমিতি প্রতিষ্ঠা করে ইতিহাস, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থাবলি মুসলমানদের শিক্ষার স্বার্থে অনুবাদের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে এটি ‘সাহিত্য ও বিজ্ঞান পরিষদ’ নামে পরিচিত হয়। এ সমিতি মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্যের শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রচারের প্রধান কেন্দ্র ছিল।
২. তাহযিব-উল-আখলাক পত্রিকা প্রকাশ : মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার, নারী শিক্ষার প্রতি উদাসীনতা প্রভৃতির কঠোর সমালোচনা এ পত্রিকার মাধ্যমে করা হতো। মুসলমানদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিই এর মূল লক্ষ্য ছিল।
৩. ভারতীয় মুসলমানদের শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি : মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্যের শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে এটি স্থাপন করা হয়। এ সমিতির মাধ্যমেই ১৮৭৫ সালের মে মাসে “মোহামিড্যান এনগ্লো অরিয়েন্টাল কলেজ” স্থাপিত হয়। ১৮৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে আলীগড় কলেজ-এর ভিত্তি স্থাপন করা হয়। এটি ১৯২০ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপনীত হয়। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে মুসলমানদের উচ্চ এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪. মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন : মুসলমানদের মধ্যে উন্নত চিন্তাধারার প্রচার, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং ইংরেজি শিক্ষা সম্পর্কে গোঁড়া মুসলমানদের বিদ্বেষভাব দূর করার লক্ষ্যে ১৮৮৬ সালে মোহামেডান এডুকেশন্যাল কনফারেন্স বা মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন গঠন করা হয়। এর মাধ্যমে বিভিন্ন সভা সমিতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে পাশ্চাত্য শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলা হয়। আলীগড়ের বাণীকে সারা ভারতে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে বার্ষিক অধিবেশন হিসেবে সৈয়দ আহমদ খান মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের আয়োজন করেন।
স্যার সৈয়দ আহমদ আলীগড়কে শুধু শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে নয়, বরং চরিত্র গঠনের কেন্দ্র হিসেবেও দেখতে চেয়েছিলেন। এ কারণেই আলীগড়ে শিক্ষিত মুসলমান যুবকগণ উপমহাদেশের মুসলমানদের নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত এমনকি রাজনৈতিক উন্নতির জন্যও সক্রিয় আন্দোলন করতে পেরেছিলেন।
স্যার সৈয়দ আহমদের আলীগড় কেন্দ্রিক অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কার্যাবলির মধ্যে ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন’ এবং ‘আলীগড় ইনস্টিটিউট গেজেট’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকা অন্যতম। ঐ পত্রিকাখানার একই কলাম উর্দু এবং ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হওয়ায়
পৃষ্ঠা ১৫৭
বৃটিশ শাসকদের এ দেশের প্রকৃত অবস্থা এবং বৃটিশদের সম্পর্কে এদেশবাসী জানার সুযোগ লাভ করে। শাসক এবং শাসিতের মাঝে বিরাজমান ভুল বুঝাবুঝির অবসানই ছিল এটির মূল লক্ষ্য।
স্যার সৈয়দ আহমদের আলীগড় কেন্দ্রিক আন্দোলনের ফলাফল মূল্যায়ন করলে স্পষ্ট হয়ে উঠে, অধিকার বঞ্চিত ও হতাশাগ্রস্ত মুসলমানদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে। আলীগড় আন্দোলনই মুসলিম জাতীয়তার উন্মেষ ঘটিয়ে স্বাধীকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণে মুসলমানদের অনুপ্রাণিত করে। মুসলমানদের পৃথক ও একক স্বাধীন সত্তা লাভের পটভূমি রচনা করেছিল আলীগড় আন্দোলন। আলীগড় আন্দোলনের অনুকরণেই অবিভক্ত বাংলার মুসলমানদের কল্যাণে নওয়াব আবদুল লতিফ ১৮৬৩ সালে মোহামেডান লিটারেরী সোসাইটি গঠন করেন।
বেগম রোকেয়া ( জন্মঃ ১৮৮০ ; মৃত্যুঃ ১৯৩২ খ্রিঃ ) |
বিংশ শতকের প্রথম দিকে অশিক্ষা, অজ্ঞতা, ধর্মীয় গোঁড়ামী ও কুপমন্ডুকতার প্রভাবে প্রভাবান্বিত অবরোধবাসিনী মুসলিম নারী জাগরণে যার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়, তিনি হচ্ছেন মহিয়সী বেগম রোকেয়া। তিনি তাঁর জীবনের ব্রত হিসেবে মুসলিম নারী সমাজের উন্নয়ন ও কল্যাণকে গ্রহণ করেছিলেন। ঊনিশ শতকের মুসলিম নারী সমাজ এবং বিশ শতকের আধুনিক শিক্ষার আলোকচ্ছটায় দীপ্ত মুসলিম নারী সমাজের মধ্যে তুলনা করলে বেগম রোকেয়ার নারী জাগরণ ও উন্নয়নের স্বার্থকতা স্পষ্ট হয়ে উঠে। তিনি ছিলেন সাহিত্যিক , শিক্ষাব্রতী, সমাজসংস্কারক এবং নারী জাগরণ ও নারীর অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত। সমাজসংস্কারের ইতিহাসে তিনি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূতী হিসেবে স্বীকৃত ও স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
ব্যক্তিগত পরিচিতি : রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর এক জমিদার পরিবারে বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জহির উদ্দিন মুহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের এবং মাতার নাম রাহাতুন্নেছা চৌধুরী। আনুমানিক ১৭ বছর বয়সে ৩৮ বছর বয়স্ক বিপত্নীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয়। স্বামী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। সমাজ সচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন স্বামী শাখাওয়াত হোসেনের প্রভাব রোকেয়ার জীবনে ছিল সুদূরপ্রসারী এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদার ও মুক্ত মনের অধিকারী স্বামীর উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় বেগম রোকেয়া জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভে সক্ষম হয়েছিলেন। বিয়ের পর তাঁকে ভাগলপুরে নিয়ে আসা হয়। ১৯০৯ সালে সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বেগম রোকেয়ার দাম্পত্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
বেগম রোকেয়ার জন্ম এমন এক সময়ে, যখন সমাজে পর্দার কড়াকড়ি এবং মুসলিম পরিবারে ইংরেজি ও বাংলা ভাষার চর্চা নিষিদ্ধ ছিল। বেগম রোকেয়ার অদম্য আগ্রহ এবং বড় ভাই ইব্রাহীম সাবির, বড়বোন করিমুন্নেছা ও স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের ঐকান্তিক সহযোগিতায় ঘরে বসেই তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে লেখাপড়া শেখেন। শিক্ষার্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ এবং সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে স্বামীর উৎসাহ, অনুপ্রেরণা এবং সহযোগিতা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অসুস্থতা এবং বিরামহীন কর্মজীবনের বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার মোকাবেলায় বেগম রোকেয়া ভেঙ্গে পড়েন। অবশেষে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর ৫২ বৎসর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সমাজসংস্কার ও সমাজ সেবার ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার অবদান : বেগম রোকেয়ার সামগ্রিক কর্মধারা এবং দর্শন পর্যালোচনা করলে কয়েকটি বিশেষ দিক স্পষ্ট হয়ে উঠে। মুসলিম নারী জাগরণের ক্ষেত্রে যেমন তার অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে, তেমনি সমাজসংস্কার ও সমাজ কল্যাণের ক্ষেত্রেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তিনি একাধারে মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূতী, শিক্ষাব্রতী, সমাজসেবী, সাহিত্যকর্মী এবং সমাজসংস্কারক হিসেবে ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন। মুসলিম নারী মুক্তি আন্দোলন ও জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে বেগম রোকেয়ার চিন্তা ও কর্মধারা পর্যালোচনা করলে দু’টি বিশেষ দিক স্পষ্ট হয়ে উঠে।
১. নারী শিক্ষার ব্যাপক ব্যবস্থা ও সম্প্রসারণ এবং ২. অবরোধ প্রথার অবসান।
পৃষ্ঠা ১৫৮
নারী শিক্ষায় ও নারী জাগরণে বেগম রোকেয়ার অবদান : বেগম রোকেয়া মুসলমানদের যাবতীয় দৈন্য দুর্দশার প্রধান কারণ হিসেবে নারী শিক্ষার প্রতি অবহেলা প্রদর্শনকে চিহ্নিত করেছেন। স্বামী সাখাওয়াত হোসেন জীবিত অবস্থায় ভাগলপুরে মেয়েদের স্কুল স্থাপনের ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর ১৯০৯ সালের ১লা অক্টোবর মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরে বেগম রোকেয়া ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। পারিবারিক কারণে অল্প কিছুদিনের মধ্যে ভাগলপুর থেকে কলকাতা লোয়ার সার্কুলার রোডে স্কুলটি স্থানান্তর করতে বাধ্য হন। ১৯১১ সালে কলকাতায় স্কুলটি স্থায়ীভাবে স্থাপন করার মাধ্যমে বেগম রোকেয়া মুসলিম নারীদের আধুনিক শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করেন। ১৯১৭ সালে স্কুলটি মধ্য ইংরেজি গার্লস স্কুলে এবং ১৯৩১ সালে উচ্চ ইংরেজি গার্লস স্কুলে রূপান্তরিত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে পরিবারের সদস্যদেরকে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝাতে চেষ্টা করেন। ১৯১৭ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ বড়লাটের স্ত্রী স্কুলটি পরিদর্শনে এসে অবরোধ বাসিনী বাঙ্গালি মুসলিম নারীর কীর্তি দেখে অভিভূত হন। পরবর্তীতে তাঁর প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় স্কুলটি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। ১৯২৯ সালে বেগম রোকেয়ার প্রচেষ্টায় কলকাতায় ‘মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
কি ধরনের নারীশিক্ষা সমাজের জন্য প্রযোজ্য সে সম্পর্কে বেগম রোকেয়া নিজেই বলেছেন, ‘‘শিক্ষা অর্থে আমি প্রকৃত শিক্ষার কথাই বলি। গোটা কতক পুস্তক পাঠ করতে পারা বা দু’ছত্র কবিতা লিখতে পারা শিক্ষা নয়। আমি চাই সে শিক্ষা যা তাদিগকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করে তুলবে। তাদিগকে আদর্শ কন্যা, আদর্শ ভগিনী ও আদর্শ গৃহিনী এবং আদর্শ মাতারূপে গড়ে তুলবে। তারা যেন অন্নবস্ত্রের জন্য কারো গলগ্রহ না হয়।’’
নারী সমাজের সমস্যা এবং তার সমাধানের পথ সম্পর্কে তার পরিচ্ছন্ন জ্ঞানের গভীরতা উপরিউক্ত মন্তব্যগুলো হতে স্পষ্ট হয়ে উঠে। তিনি শুধু নারী শিক্ষা প্রসারই চাননি, সমাজসংস্কারের মাধ্যম হিসেবেও শিক্ষাকে বিবেচনা করেছেন। নারী জাগরণের ও প্রগতির ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে যারা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গিয়েছেন তাঁদের অনেকেই ঐ স্কুলের ছাত্রী ছিলেন।
অবরোধ ও পর্দা প্রথা সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, অবরোধ এবং পর্দা দু’টি ভিন্ন জিনিস। অবরোধ হচ্ছে ঘরে বন্দী, ধর্মীয় গোঁড়ামী এবং পর্দার ব্যাপারে অহেতুক বাড়াবাড়ি। অন্যদিকে পর্দা হচ্ছে নারীর স্বাভাবিক পবিত্রতা রক্ষার অন্যতম মাধ্যম। যার সঙ্গে উন্নতি বা শিক্ষার কোন বিরোধ নেই।
নারী অধিকার ও সমাজকল্যাণে বেগম রোকেয়ার অবদান : বেগম রোকেয়া শুধু নারী শিক্ষার প্রসার এবং অবরোধ প্রথার বিলোপ সাধনের মধ্যেই তার কর্মধারা সীমিত রাখেননি। তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রে যথাযোগ্য ভূমিকা গ্রহণে মুসলিম নারী সমাজকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালান। মহিলাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলির বিকাশ এবং সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯১৬ সালে তিনি ‘‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’’ বা ‘মুসলিম মহিলা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলির মধ্যে ১. দরিদ্র বালিকাদের শিক্ষার সুযোগ দান, ২. বিধবা ও আশ্রয়হীন মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, ৩. দুঃস্থ মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে কুটির শিল্প স্থাপন, ৪. অবিবাহিতা মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে সহায়তা দান। বহু বিধবা নারী এ সমিতি হতে অর্থ সাহায্য পেয়েছে। বহু বয়োপ্রাপ্ত দরিদ্র কুমারী সমিতির সাহায্যে সৎ পাত্রস্থ হয়েছে এবং বহু দুঃস্থ বালিকা সমিতির অর্থে শিক্ষালাভ করেছে। ৫. সমিতি ভারতবর্ষে নারীর রাজনৈতিক অধিকার সম্বন্ধে মতামত তুলে ধরে। নারীর শিক্ষা, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এবং আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠায় আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম সেসময় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে।
সমবেত এবং সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় মুসলিম নারীদের অগ্রগতি ও কল্যাণ সাধনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম। অবরোধবাসিনী মুসলিম নারী সমাজ অবরোধের দেয়াল অতিক্রম করে এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বীয় অধিকার আদায়ে এগিয়ে আসে। ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মহিলা সম্মেলনে আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম সমিতি অংশগ্রহণ করে বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
বেগম রোকেয়া বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ‘নিখিল ভারত মুসলিম মহিলা সমিতি’ এবং ‘বেঙ্গল উইম্যান্স এডুকেশন্যাল কনফারেন্স’- এর আজীবন সদস্য ছিলেন। পতিতাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ‘নারীতীর্থ সংস্থা’ এর তিনি কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন।
পৃষ্ঠা ১৬০
রোকেয়ার সাহিত্যকর্ম ও সমাজসেবা : বেগম রোকেয়ার সাহিত্য কর্মকে তৎকালীন মুসলিম নারী জাগরণ ও নারীমুক্তি আন্দোলনের পরিবর্তনের বাহক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তার সাহিত্য কর্মের মূল লক্ষ্য ছিল নির্যাতিত, অবহেলিত, অজ্ঞ ও অশিক্ষিত নারী সমাজকে উদ্বুদ্ধ করা। তিনি বিভিন্ন রূপক ব্যবহার করে নারী সমাজের কর্ম প্রতিভা, কর্মশক্তি, সমস্যা ও তার সমাধান লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেন। এছাড়া অসংখ্য প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে নারী সমাজকে নিয়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তা ভাবনার পরিচয় তার লেখার মধ্যে ফুটে উঠেছে। পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর, সুলতানার স্বপ্ন ইত্যাদি গ্রন্থে নারী সমাজের দুঃখ-দুর্দশার নিখুঁত চিত্র অংকন করেছেন। তাঁর সাহিত্য নারী মুক্তির পথ নির্দেশনা দান করেছে। তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের ভবিষ্যত বংশ রক্ষার জন্য দুটো বিষয় দরকারী। একটি স্ত্রী শিক্ষার বহুল প্রচার এবং অন্যটি বাল্য বিবাহ রহিত করা।
জাতির বৃহত্তর কল্যাণে নারী সমাজকে অশিক্ষা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও অবরোধের অভিশাপ থেকে উদ্ধারের জন্য বেগম রোকেয়া বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ও জাগরণের বাণী নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। সমাজের নানাবিধ কুপ্রথা ও কুপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে মুসলিম মহিলাদের মধ্যে তিনিই প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। নারী পুরুষকে সমাজের দু’টি চক্ষু হিসেবে বিবেচনা করে নারীদের কল্যাণকে জীবনের মূলব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। বেগম রোকেয়া তাঁর সামগ্রিক কার্যাবলির জন্যই মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূতী অবিধায় ভূষিত হয়েছেন।
নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তৎকালীন স্টেটসম্যান পত্রিকা মন্তব্য করেছিল, অর্থাৎ নারী শিক্ষার জন্য তিনি তার সমগ্র জীবন ও সব সম্পদ উৎসর্গ করেছিলেন। সামাজিক কূপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে বেগম রোকেয়ার অভিযান খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সমাজকল্যাণের স্বপ্ন তাকে সংগ্রামে প্ররোচিত করেছিল। সে সংগ্রামের পরিণামে রক্ষণশীলতার পরাজয় ঘটেছে, এটাই তার সার্থকতার চরম নিদর্শন।
পৃষ্ঠা ১৬০
এ.কে. ফজলুল হক ( জন্মঃ ১৮৭৩, মৃত্যুঃ ১৯৬২ খ্রিঃ ) |
ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বিশাল ব্যক্তিত্ব শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। তিনি শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক নামে পরিচিত। রাজনৈতিক, শিক্ষা, নিপীড়িত ও শোষিত জনগণের মুক্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর বহুমুখী অবদান ইতিহাসে তাঁকে অমরত্ব দান করেছে। তিনি ছিলেন জাতীয় জাগরণের নিবেদিত সৈনিক, কৃষক মুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ, দানশীলতা ও সমাজসেবায় অনুকরণীয় আদর্শ। তিনি সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সাহসী সৈনিকের মত জনগণের আশা-আকাঙ্খা বুঝতে পেরেছিলেন এবং তাদের প্রিয় নেতা হিসেবে স্ব-শ্রেণীতে অবস্থান করেই স্বীয় ভূমিকা নির্ধারণ ও পালনে সক্ষম হয়েছিলেন।
ব্যক্তিগত পরিচিতি : ১৮৭৩ সালের ২৬শে অক্টোবর বৃহত্তর বরিশাল জেলার চাখার গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক জন্মগ্রহণ করেন। প্রকৃতপক্ষে এ.কে. ফজলুল হক বর্তমান ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে মামার বাড়ীতে জন্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু পিত্রালয় চাখার গ্রামেই তিনি লালিত পালিত হন। এজন্য চাখার গ্রামকে তাঁর জন্মস্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তার পিতার নাম কাজী ওয়াজেদ আলী এবং মাতার নাম বেগম সৈয়দুন্নেছা। পিতা ওয়াজেদ আলী একজন নামকরা আইনজীবী ছিলেন। ছোট বেলা হতেই তিনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। অপরিসীম সাহস ও শক্তিমত্তা তাঁকে ছোট বেলা থেকেই সুপরিচিত করেছিল। ফজলুল হক অত্যন্ত মেধাবী ও প্রখর প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে ১৮৮৯ সালে তিনি ডিভিশনাল স্কলারশীপ নিয়ে প্রবেশিকা (এন্ট্রান্স) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে রসায়ন, পদার্থ ও অঙ্কশাস্ত্র এ তিনটি বিষয়ে অনার্স পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন, যা ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে হতবাক করে দেয়। ১৮৯৫ সালে মাত্র ছয় মাসের প্রস্ত্ততি নিয়ে অঙ্কশাস্ত্রে মাস্টার ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তীতে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও ফার্সিতে অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন।
কর্মজীবনের শুরুতে তিনি প্রখ্যাত আইনজীবী আশুতোষ মুখার্জীর সহকারী হিসেবে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত হন। পরবর্তীতে আইন ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে নিজ জন্মস্থান বরিশালে অধ্যাপনায় আত্মনিয়োগ করেন। অতঃপর বরিশালে কিছুদিন আইন ব্যবসা করেন। আইন ব্যবসায় সুনাম অর্জিত না হওয়ায় ১৯০৬ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি গ্রহণ করেন। বরিশালে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত থাকাকালীন সময়ে তিনি ‘সাপ্তাহিক বালক’ নামক পত্রিকা সম্পাদনা করে জনগণের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের চেষ্টা করেন। চাকরি জীবনের সংকীর্ণ বাঁধা ধরা ছকের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পেরে সরকারী চাকরি ত্যাগ করে ১৯১১ সালে আইন ব্যবসায় ফিরে আসেন।
রাজনৈতিক জীবন : ১৯১১ সালে আইন ব্যবসার সঙ্গে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগ দেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত হন। অসাধারণ সাংগঠনিক প্রতিভার অধকারী এ. কে. ফজলুল হক স্বল্প সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বরণ মালা লাভ করেন। ১৯১২ সালে তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯১৩ সালে তিনি বেঙ্গল ও ইন্ডিয়ান লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৬ সালে তিনি খিলাফত আন্দোলনে যোগদান করে মানুষের কল্যাণে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করেন। ১৯১৮ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২০ সালে গান্ধীর নেতৃত্বে ইংরেজদের
পৃষ্ঠা ১৬১
বিরুদ্ধে কংগ্রেস অসহযোগ আন্দোলন শুরু এবং মুসলমানদের খেলাফত আন্দোলন সমর্থন করেন। অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়ায় ফজলুল হক ১৯২০ সালের নির্বাচনে অংশ নেননি। ১৯২১ সালে তিনি খুলনার উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বনিদ্ধতায় বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯২৩ সালে অনুষ্ঠিত ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে ফজলুল হক বরিশাল সদর থেকে সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯২৪ সালের ১লা জানুয়ারী তদানীন্তন বৃটিশ গভর্ণর আবুল কাশেম ফজলুল হককে বাংলার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রী নিযুক্ত করেন। ১৯২৪ সালের আগষ্ট মাসে তিনি মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯২৪ সালে ইসলামিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজের বর্তমান নাম মওলানা আজাদ কলেজ। ১৯৩৫ সালে লক্ষ্মৌতে মুসলিম লীগের সম্মেলনে তেজদীপ্ত ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণ শুনে লক্ষ্মৌবাসী তাঁকে ‘‘শেরে বাংলা’’ (বাংলার বাঘ) উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কৃষক-প্রজা পার্টি হতে তিনি ঊনচল্লিশ জন সদস্যসহ নির্বাচিত হন এবং অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তিনি ছিলেন বাংলার সর্ব প্রথম নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা ফজলুল হক ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে এ. কে. ফজলুল হক অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন। এ নির্বাচনের আগে তিনি ‘কৃষক-শ্রমিক পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তাঁর দল যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে সমবেতভাবে অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হলে তাঁর নেতৃত্বে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। শেরে বাংলা ফজলুল হক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মূলতঃ তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ইতিবৃত্ত বহুমুখী ঘটনা সম্ভারের দলিল। সুদীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক কর্মময় জীবনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল এ. কে. ফজলুল হক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সমাজকল্যাণে শেরে বাংলা ফজলুল হকের অবদান : শেরে বাংলা ফজলুল হক ছিলেন বাংলার মানুষের অকৃত্রিম দরদী বন্ধু, জাতীয় জাগরণের নিবেদিত সৈনিক, কৃষক মুক্তি আন্দোলনের পথিকৃত এবং দানশীলতা ও সমাজসেবার অনুকরণীয় আদর্শ। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সার্বক্ষণিকভাবে মানবতাবাদী সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। সমাজকল্যাণের প্রেক্ষাপটে এ. কে. ফজলুল হকের অবদান শিক্ষা, কৃষক মুক্তি এবং সমাজসেবা- এ তিনটি দৃষ্টিকোণ হতে আলোচনা করা যায়।
শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান : শেরে বাংলা ফজলুল হক তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে নিয়োজিত রেখেছিলেন শিক্ষা বিস্তারের কাজে। তাঁর শিক্ষা বিস্তারের মূল লক্ষ্য ছিল এ দেশে একটি শক্তিশালী মুসলিম শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠন। উপমহাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা মুসলমানদের হাত থেকে ইংরেজদের হাতে চলে যাবার পর প্রায় দেড়শত বছর যাবত মুসলমানরা ইংরেজদের সাথে অসহযোগিতা ও তাদের সবকিছু বর্জন করতে থাকে। ফলে তারা শিক্ষার আলো থেকে যেমন বঞ্চিত হতে থাকে, তেমনি রাষ্ট্র পরিচালনার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা হারাতে থাকে। এ সুযোগে অন্যান্য সম্প্রদায় বিশেষত হিন্দু সমাজ ইংরেজদের সহযোগিতা প্রদান করে। সে কারণে তুলনামূলকভাবে মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষায় অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। ফলে এ সময় বাংলায় গড়ে উঠা অত্যন্ত শক্তিশালী মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে বাঙ্গালি মুসলমানরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। এমনি সময়ে রাজনীতিতে আবির্ভূত হন ফজলুল হক। কৃষকদের অর্থনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হবার সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে বাঙ্গালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে
পৃষ্ঠা ১৬২
তোলার চেষ্টা করেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন দাবী উত্থাপনের পাশাপাশি তিনি ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষা বিস্তারে সচেষ্ট হন। ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি বেশ কয়েকবার মন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। প্রতিবারই তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নিজ দায়িত্বে রেখেছিলেন। বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে তাঁর অবদানগুলোর মধ্যে নিচেরগুলো প্রধান।
১৯০৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের’ অন্যতম সংগঠক ছিলেন ফজলুল হক। ১৯১২ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদে উত্থাপিত ‘শিক্ষা পরিকল্পনা বিল’ এদেশে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। ১৯১২ সালে তিনি মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বাংলার গভর্ণরের কাছ থেকে বৃত্তি ও আর্থিক সাহায্য আদায় করার লক্ষ্যে ‘সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এডুকেশনাল এসোসিয়েশন’ গঠন করেন। কলকাতায় ‘কারমাইকেল ও টেলর হোষ্টেল’ নির্মাণে ফজলুল হক সক্রিয় সহযোগিতা করেন। স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রতিষ্ঠিত আলীগড়ে ‘এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ’-কে ১৯২০ সালে ‘আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে’ উন্নীত করা এবং ১৯২১ সালে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠায় তিনি নেতৃস্থানীয় উদ্যোক্তার ভূমিকা পালন করেন।
১৯২৪ সালে ফজলুল হক শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে কলকাতায় ‘ইসলামীয়া কলেজ’ (বর্তমান মাওলানা আবুল কালাম কলেজ) এবং মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদের আর্থিক সাহায্য দানের জন্য ‘মুসলিম এডুকেশনাল ফান্ড’ গঠন করেন। মুসলমানদের শিক্ষার জন্য পৃথক পরিদপ্তর প্রতিষ্ঠা শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁর অন্যতম অবদান। ১৯৩৭ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকার প্রাক্কালে মুসলমান মেয়েদের জন্য ‘লেডী ব্রাবোর্ন কলেজ’ স্থাপন করেন। সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে ইসলাম ধর্মের জন্য ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। তাঁর আমলেই ‘স্কুল ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড’ গঠনের বিল আনীত হয়। মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে আসন সংরক্ষণের নিশ্চয়তা বিধানে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৩৮ সালে তাঁর নিযুক্ত মাওলানা বক্স শিক্ষা কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী সারা বাংলায় অবৈতনিক প্রাইমারী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁর অক্ষয় কীর্তি।
শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তিনি মুসলমানদের জন্য চাকরির শতকরা ৫০ ভাগ সংরক্ষিত রাখার নির্দেশ দেন এবং বাংলা সরকারের অফিসগুলোতে কঠোরভাবে কার্যকর করেন।
এ.কে. ফজলুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল, বরিশালে চাখার ফজলুল হক কলেজ, রাজশাহীতে আদিনা ফজলুল হক কলেজ ইত্যাদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ঢাকার ইডেন কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান বাংলা একাডেমী, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ, তেজগাঁও কৃষি কলেজ প্রভৃতি শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের স্বাক্ষর বহন করছে। শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর মিশনারী উদ্যম ও উৎসাহ লক্ষ্য করে তৎকালীন ডি.পি.আই. হরনেল সাহেব শেরে বাংলা ফজলুল হককে ‘নেথাম অব বেঙ্গল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
কৃষক-শ্রমিকদের কল্যাণে ফজলুল হকের অবদান : ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক গোষ্ঠী ১৭৫৭ সালের যুদ্ধের পর এদেশে তাদের শাসন ও শোষণ ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করার জন্য জমিদার, মহাজন, আমলা, মজুতদার প্রভৃতি শ্রেণী সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত বাংলার জমিদার ও মহাজনদের শোষণ এবং ঋণভারে জর্জরিত কৃষকদের রক্ষা
পৃষ্ঠা ১৬৩
করার লক্ষ্যে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক যে আন্দোলন শুরু করেন তা-ই ইতিহাসে ‘কৃষক ঋণমুক্তি আন্দোলন’ নামে পরিচিত।
কৃষক ঋণমুক্তি আন্দোলনের পটভূমি : ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিস কুখ্যাত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জমিদার, মজুতদার ও মহাজন শ্রেণীর সৃষ্টি করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের মাধ্যমে জমিদার ও মহাজনরা কৃষক শ্রেণীর ওপর একচেটিয়া শোষণের সুযোগ লাভ করে। জীবন ধারণের তাগিদে নিঃস্ব ও অসহায় কৃষক শ্রেণী জমিদার এবং মহাজনদের কাছ থেকে অধিক সুদে ঋণ গ্রহণে বাধ্য হয়। চক্রবৃদ্ধি সুদের যাতাকলে এবং জমিদার ও মহাজনদের প্রতারণার নিষ্পেষণে কৃষক শ্রেণী তাদের ভিটে মাটি সর্বস্ব হারিয়ে মানবেতর জীবন-যাপনে বাধ্য হয়। অত্যাচারিত, শোষিত এবং ঋণভারে জর্জরিত কৃষকদের অমানবিক অবস্থা থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে এ.কে. ফজলুল হক কৃষক ঋণমুক্তি আন্দোলন শুরু করেন।
উদ্দেশ্য : কৃষক ঋণ মুক্তি আন্দোলনের প্রধান প্রধান উদ্দেশ্যগুলো ছিল¾
১. বাংলার কৃষক-প্রজা শক্তিকে সংঘবদ্ধ করা।
২. ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত জমিদার ও অভিজাত শ্রেণীর অত্যাচারের হাত হতে কৃষকদের রক্ষা করা।
৩. কৃষকদের ঋণভারের দায় থেকে মুক্ত করা।
৪. বন্ধকী জমি, ঘর-বাড়ি, ভিটে-মাটি উদ্ধার করা।
৫. জমি হস্তান্তর অধিকার বা ভূমিস্বত্ব প্রথা প্রবর্তন করা।
৬. সর্বনাশা সুদের ব্যবসার উচ্ছেদ সাধন করা।
কার্যক্রম : কৃষক ঋণমুক্তি আন্দোলনের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে এ. কে. ফজলুল হক ১৯১৫ সালে ‘নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি’ গঠন করেন। তিনি নিজ জন্মস্থান বরিশাল জেলা থেকে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯২৬ সালে মানিকগঞ্জের ঘিওরে ঐতিহাসিক কৃষক-প্রজা সম্মেলনের আয়োজন করেন। তাতে তিনি কৃষক ঋণমুক্তি আন্দোলনের চূড়ান্ত কার্যক্রম ঘোষণা করেন। ১৯২৭ সালে ফজলুল হক ‘‘কৃষক-প্রজা পার্টি’’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এটি ছিল তাঁর কৃষক প্রজা শক্তিকে সংঘবদ্ধ করার দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার একটি ফসল। অত্যাচারী মহাজনদের শোষণ থেকে কৃষক শ্রেণীকে রক্ষার জন্য এ.কে. ফজলুল হক তাঁর সর্বশক্তিকে নিয়োগ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৯৩৫ সালের সংবিধানের গণতান্ত্রিক অধিকার সম্প্রসারণ করা হয়। ফলে ৪০ লাখ কৃষক প্রজা ভোটাধিকার লাভ করেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে তীব্র প্রতিদ্বনিদ্ধতার মাধ্যমে কৃষক প্রজা পার্টি বিজয় লাভ করে। ফলে, বাংলার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত জমিদার ও অভিজাত শ্রেণীর হাত থেকে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের হাতে চলে আসে।
১৯৩৭ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে তিনি বঙ্গীয় কৃষি ঋণ আইন পাশ করেন। বঙ্গীয় কৃষি ঋণ আইনের আওতায় বাংলাদেশে ষাট হাজার ঋণ সালিশী বোর্ড স্থাপিত হয়। এতে সাত থেকে আট কোটি কৃষক প্রজার ঋণ মুক্তি, দায় মুক্তি এবং জমি বন্ধকী মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। জমিদারদের স্থলে প্রজারা তাদের ভূমির স্বত্ব ফিরে পায়। ১৯৪০ সালে বঙ্গীয় কুসীদজীবী আইন পাস করে ভবিষ্যত মহাজনদের শোষণ থেকে কৃষক শ্রমিকদের মুক্তির নিশ্চয়তা বিধান করেন।
পৃষ্ঠা ১৬৪
জমিদারী উচ্ছেদ ও প্রজাস্বত্ব আইনের পটভূমি রচনার প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে ব্রিটিশ সরকার স্যার ফ্রান্সিস্ ফ্লাউডিকে সভাপতি করে ১৯৩৮ সালে ৫, নভেম্বর ‘ল্যান্ড রেভিনিউ’ নিযুক্ত করেন। ১৯৪০ সালে ২১, মার্চ কমিশন চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করে। উলেখ্য উক্ত কমিশন ফ্লাউউড কমিশন নামে পরিচিত ছিল। এর ফলস্বরূপ ১৯৫০ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হয় এবং প্রজারা তাদের ভূমির স্বত্ব ফিরে পায়।
এক নজরে কৃষকদের কল্যাণে গৃহীত ব্যবস্থা
১৯৩৭-১৯৪১ সালের হক মন্ত্রীসভা আমলে কৃষকদের কল্যাণে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন সেগুলো হলো-
ক. বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ডেটরাস এক্ট ১৯৩৮, কার্যকর করে উচ্চহারে সুদ প্রদান থেকে কৃষকদের রক্ষা এবং বাংলার সব এলাকায় ঋণ সালিশি বোর্ড স্থাপন করেন।
খ. বেঙ্গল মানি লেন্ডার্স এক্ট ১৯৩৮ এবং বেঙ্গল টেন্যান্সি (এমেন্ডম্যান্ট) এক্ট পাশ করে কৃষকদের উন্নয়নের পথ উন্মুক্ত করেন।
গ. ১৯৩৮ সালে স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডিকে সভাপতি করে ল্যান্ড রেভিনিউ কমিশন গঠন করেন, যা বিখ্যাত ফ্লাউড কমিশন নামে পরিচিত। এ কমিশনের রিপোর্ট বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কিত সবচেয়ে মূল্যবান দলিল।
ঘ. ১৯৩৮ সালে, ১৮৮৫ সালের প্রজাসত্ব আইন সংশোধন করে, খাজনা বৃদ্ধির সকল ধারা দশ বছরের জন্য স্থগিত করেন। রায়তদের ওপর প্রথাগতভাবে আরোপিত সব ধরনের সেলামী কর বিলোপ সাধন করে। জমিদারদের হস্তান্তর ফি না দিয়ে রায়তরা জমি হস্তান্তর অধিকার লাভ করে। আলোচ্য প্রজাসত্ব আইন বকেয়া খাজনার সুদের হার শতকরা ১২.৫ ভাগ থেকে ৬.২৫ ভাগে হ্রাস করে। নদী ভাঙ্গনে ভূমি হারানোর বিশ বছরের মধ্যে চার বছরের খাজনা দিয়ে রায়তরা নদী সিকস্তি (নদী ভাঙ্গনের ফলে লুপ্ত জমি পুন জেগে উঠা) জমির মালিকানা অধিকার লাভ করে।
ফলাফল : কৃষক ঋণমুক্তি আন্দোলনের সার্বিক বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে উঠে বাংলার কৃষক-শ্রমিক-প্রজাদের কল্যাণে, এ আন্দোলন সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রবর্তিত ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এদেশের কৃষক প্রজাদের যে নিঃস্ব ও অসহায় অবস্থায় ফেলে; কৃষক ঋণমুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক সে অসহনীয় অবস্থার অবসান ঘটান। এ প্রসঙ্গে বি. ডি. হাবিবুল্লাহ তাঁর ‘শেরে বাংলা’ নামক গ্রন্থে মন্তব্য করেন, ‘‘আব্রাহাম লিংকনের’’ দাস প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলনের চেয়েও অনেক বেশি কল্যাণকর কাজ ছিল বাংলার ষাট হাজার ঋণ সালিশী বোর্ড সৃষ্টি। বিলেতে উইলবার ফোর্স দাস প্রথা রহিতকরণের যে ব্যবস্থা করেন, তাতে যে পরিমাণ কল্যাণ নিহিত ছিল, তার চেয়ে বেশি কল্যাণপ্রসূ হলো হক মন্ত্রীমন্ডলীর ষাট হাজার ঋণ সালিশী বোর্ড। এতে আট কোটি প্রজার দাসত্ব ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খল একসঙ্গে শেষ হয়।’’
সুতরাং বলা যায়, কৃষক ঋণমুক্তি আন্দোলন শুধু দীর্ঘদিনের শোষণ, নির্যাতন ও অত্যাচারের হাত হতেই কৃষকপ্রজাদের মুক্ত করেনি, ভবিষ্যতে শোষণের জাঁতাকল থেকেও মুক্তিদানের নিশ্চয়তা বিধান করেছে।
সমাজ সেবার ক্ষেত্রে ফজলুল হকের অবদান : শেরে বাংলা ফজলুল হক দানশীলতা ও সমাজসেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি গরীব দুঃখীদের মুক্ত হস্তে দান করতেন। তিনি হিসেব করে দান করতেন না। খাদেমুল ইনসান সমিতি, আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম প্রভৃতি সমাজ সেবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি
পৃষ্ঠা ১৬৫
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৫৮ সালে ‘‘পূর্ব-পাকিস্তান সেনা সমিতি’’ নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত জনগণকে সাহায্য দানের ব্যবস্থা করেন।
পরিশেষে বলা যায়, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের কর্মময় জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপই মানব সেবায় উৎসর্গীকৃত ছিল। তার সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি রাধিকারঞ্জন গুহ মন্তব্য করেছেন, ‘‘শেরে বাংলা যদি আমেরিকায় জন্ম নিতেন তবে হতেন জর্জ ওয়াশিংটন, যদি রাশিয়ায় জন্ম নিতেন তবে হতেন লেনিন, চীনে হলে হতেন ডঃ সানিয়েত সেন, জার্মানিতে হলে হতেন বিসমার্ক, ফ্রান্সে জন্ম নিলে হতেন নেপোলিয়ন এবং ইংল্যান্ডে জন্ম নিলে হতেন লর্ড পামারস্টোন, ডিস্রেলী অথবা চার্চিল।’’
অনুশীলনী
রচনামূলক প্রশ্ন
১. হাজী মুহম্মদ মুহসিন কে ছিলেন ? সমাজসেবা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে হাজী মুহম্মদ মুহসিনের অবদান মূল্যায়ন কর।
২. সতীদাহ প্রথা বলতে কি বুঝ ? সতীদাহ প্রথা নিরোধ আইন প্রবর্তনে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান আলোচনা কর।
৩. ঈশ্বরচন্দ্র কে ছিলেন ? সমাজসংস্কার ও সমাজসেবায় তাঁর অবদান আলোচনা কর।
৪. শিক্ষা ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান মূল্যায়ন কর।
৫. সমাজসংস্কার আন্দোলন কি ? আলীগড় আন্দোলন কি ? ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারে আলীগড় আন্দোলনের ভূমিকা আলোচনা কর।
৬. মুসলিম নারীজাগরণে ও নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার অবদান আলোচনা কর।
৭. ‘‘কৃষক ঋণ মুক্তি আন্দোলন’’ কি ? বাংলার কৃষক-প্রজাদের কল্যাণে এ আন্দোলনের অবদান মূল্যায়ন কর।
৮. নারী শিক্ষায় বেগম রোকেয়ার অবদান কি ?
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. ব্রাহ্ম সমাজ কি ?
২. সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আইন কত সালে করা হয় ?
৩. স্যার সৈয়দ আহমদের আলীগড় আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও ফলাফল লিখ।
৪. সমাজ সেবার ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার একটি অবদান লিখ।
৫. শিক্ষা বিস্তারে এ.কে. ফজলুল হকের ২টি অবদান লিখ।
৬. সমাজ সেবার ক্ষেত্রে এ.কে. ফজলুল হকের ২টি অবদান লিখ।
৭. সমাজসেবী ও সমাজসংস্কারকের পার্থক্য কি ?
৮. শিক্ষাক্ষেত্রে হাজী মুহম্মদ মুহসিনের অবদান কি ?
৯. কৃষক-শ্রমিক কল্যাণের ক্ষেত্রে ফজলুল হকের অবদান কি ?
১০. সমাজসংস্কারে রাজা রাম মোহনের অবদান কি ?
১১. শিক্ষা ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান স্মরণীয় কেন ?