Logo Sponsored by Chowdhury and Hossain, Advanced Publications

Somaj Kollan 1st Part Fifth Chapter


পৃষ্ঠা ১৪০
পঞ্চম অধ্যায়
সমাজকল্যাণ দর্শন ও মূল্যবোধ
 

সমাজকল্যাণ দর্শনের ধারণা
দর্শনের ধারণা
দর্শন হলো জীবন ও জগত সম্পর্কিত সামগ্রিক ব্যাখ্যা। জগত ও জীবনের স্বরূপ উদঘাটনের প্রচেষ্টাই দর্শন। সমাজবিজ্ঞানী ওয়েবার দর্শনের সংজ্ঞায় বলেছেন, ‘‘দর্শন হলো প্রকৃতির বিষয়ে এক সামগ্রিক দৃষ্টিলাভের অনুসন্ধান, বস্ত্তর সার্বিক ব্যাখ্যা দেয়ার প্রচেষ্টা।
দর্শন হলো জীবন ও জগত সম্পর্কে সুস্পষ্ট, সুসংহত এবং মানুষের সঙ্গে এ জগতের সম্পর্ক বিষয়ক জ্ঞান দান করা। জগত ও জীবন সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস ও ধারণাগুলোর যৌক্তিকতা বিচার করে বিশ্বজগত সম্পর্কে একটি যুক্তিযুক্ত ও সুসংঘবদ্ধ ধারণা দেয়া এবং মানব জীবনের প্রকৃত অর্থ নিরূপণই দর্শনের কাজ।
মানব জ্ঞানের সবদিকই দর্শনের পরিধিভুক্ত। দার্শনিক পটভূমি বা ভিত্তি ছাড়া কোন বিজ্ঞান  গড়ে উঠতে পারে না। এজন্য সমাজবিজ্ঞানী অগাষ্ট কোঁৎ ‘‘দর্শনকে সকল বিজ্ঞানের বিজ্ঞান’’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ কোন বিজ্ঞানই শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়নি। দার্শনিক ভিত্তি ব্যতীত কোন বিজ্ঞান, মতবাদ, তত্ত্ব বা সংগঠিত পদ্ধতি গড়ে উঠতে পারে না। প্রত্যেক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই কতগুলো বিষয়কে স্বতসিদ্ধ সত্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। যেগুলোকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় ‘পূর্ব অনুমান’ বলা হয়। বিভিন্ন বিজ্ঞানে ব্যবহৃত মৌলিক নীতি ও ধারণাগুলোকে স্বীকার্য সত্য হিসেবে গ্রহণ করেই বিজ্ঞান এগিয়ে চলে। এরূপ পূর্ব অনুমান বা স্বতসিদ্ধ স্বীকার্য সত্যই হলো সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানের দার্শনিক ভিত্তি।
সমাজকল্যাণ দর্শন
জগত ও জীবনের স্বরূপ উদঘাটনের প্রচেষ্টা সবকালে, সবজাতি, সববিজ্ঞানী এবং সবচিন্তাবিদ করে আসছেন। ফলে দর্শন কোন বিশেষ ক্ষেত্রে বা নির্দিষ্ট বিজ্ঞানের মধ্যে সীমিত নয়। সকল বিজ্ঞানেরই নিজস্ব দার্শনিক পটভূমি রয়েছে। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো আধুনিক সমাজকল্যাণের নিজস্ব দার্শনিক পটভূমি রয়েছে। সমাজকর্ম তথা সমাজকল্যাণের দার্শনিক মূল্যবোধ এবং দার্শনিক ভিত্তি সম্পর্কে ডাব্লি‌উ.এ.ফ্রিডল্যান্ড বলেছেন, ‘‘সমাজকল্যাণ বা সমাজকর্মের মৌলিক মূল্যবোধ রাস্তার পাশে সদ্য ফোটা কোন ফুল নয়। বরং এর মূল উৎস মানবসভ্যতা বিকাশের মৌলিক বিশ্বাসের গভীরে নিহিত। আমাদের সভ্যতা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সাম্য বিকাশের স্বাধীনতা, চয়নের স্বাধীনতা, নির্মল প্রতিযোগ্যতা, নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের ও যোগাযোগের স্বাধীনতা হতে বিকাশ লাভ করেছে।’’ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ আনয়নের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটনের প্রচেষ্টা হতে সমাজকল্যাণ দর্শনের উদ্ভব। বিজ্ঞানসম্মত ও পরিকল্পিত সাহায্য দান প্রক্রিয়া হিসেবে কল্পনাপ্রসূত কার্যক্রমের স্থান সমাজকল্যাণে নেই। সামাজিক পরিবেশে মানুষের আচার-আচরণের যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করে সমাজকল্যাণ। এজন্য সমাজকল্যাণে কতগুলো বিষয়কে স্বতঃসিদ্ধ সত্য হিসেবে পূর্ব থেকে গ্রহণ করা হয়। এসব স্বতঃসিদ্ধ সত্যগুলোই আধুনিক সমাজকল্যাণের দার্শনিক ভিত্তি। যে সব আদর্শ, বিশ্বাস, ধারণা, মৌলিক নীতি ও স্বীকার্য সত্যের ওপর আধুনিক সমাজকল্যাণের সামগ্রিক সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত, সেগুলোর সমষ্টিগত রূপ হলো সমাজকল্যাণ দর্শন।
আধুনিক সমাজকল্যাণ এবং সমাজকর্ম দর্শন হলো সমাজবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে পারস্পরিক নির্ভরতা, সাহায্য ও সহযোগিতা, ধর্মীয় অনুশাসন, মানব প্রেম এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার ভিত্তিতে পরিচালিত সমাজসেবা কার্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কতগুলো চিন্তাধারার সমষ্টি। অন্যভাবে বলা যায়, সমাজকল্যাণ দর্শন হলো সমাজের কল্যাণ বিষয়ক এমন একটি সামগ্রিক ধারণা, যা সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সমাজকল্যাণ দর্শনের লক্ষ্য হলো সমাজসেবা সম্পর্কিত প্রচলিত বিশ্বাস ও ধারণাগুলোর যৌক্তিকতা বিচার বিশ্লেষণ করে একটা যুক্তিযুক্ত এবং সুসংবদ্ধ ধারণা দেয়া। আধুনিক সমাজকল্যাণের স্বরূপ ও প্রকৃতি নিরূপণের

পৃষ্ঠা ১৪১
মাধ্যমে সনাতন সমাজসেবা প্রচেষ্টার সঙ্গে এর সম্পর্ক নির্ধারণ করা সমাজকল্যাণ দর্শনের কাজ। সমাজকল্যাণের দার্শনিক রূপরেখা চিরায়ত ধর্মীয় নীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক মানবিক আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। সমাজকল্যাণ দর্শন সার্বিক মানব কল্যাণের আদর্শ নির্ধারণ করে। যে আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে মানব কল্যাণের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সমাজকল্যাণ দর্শন এমন কতগুলো সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেগুলো জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকল মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের নির্দেশনা দান করে। যেমন- মানুষের মর্যাদার স্বীকৃতি, আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, সকলের সমান অধিকারের সুযোগ দান, সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ হতে সমাজ তথা মানবিক কল্যাণকে বিশ্লেষণ, সম্পদের সদ্ব্যবহার প্রভৃতি আধুনিক সমাজকল্যাণের দার্শনিক মূল্যবোধ হিসেবে পরিচিত। সমস্যা সমাধানের প্রতিটি পর্যায়ে এসব স্বতঃসিদ্ধ মূল্যবোধগুলোকে সচেতনভাবে অনুসরণ করা হয়।
সমাজকল্যাণে বিশ্বাস করা হয়- ‘‘সমাজ গঠনের মূল অণু হলো ব্যক্তি। আর প্রতিটি ব্যক্তিই বিশেষ মর্যাদা ও পৃথক সত্বার অধিকারী। ব্যক্তি তার পৃথক সত্বা ও মর্যাদা বজায় রাখতে সদা সচেষ্ট।’’ সুতরাং ব্যক্তির মর্যাদা ও পৃথক সত্বার স্বীকৃতি প্রদান ছাড়া যেমন তার কল্যাণ সাধন সম্ভব নয়, তেমনি সমাজের কল্যাণ অসম্ভব। এজন্য সমাজকল্যাণে স্বীকার্য সত্য হিসেবে মানুষের পৃথক সত্বা ও স্বতন্ত্র মর্যাদাকে স্বীকার করে নেয়া হয়।
সমাজকল্যাণ দর্শনের ভিত্তি
সমাজকল্যাণের মূল বিষয়বস্ত্ত সমাজ এবং তার কল্যাণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। কিন্তু সমাজ পরিবর্তনশীল। সমাজ পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক সমস্যা এবং চাহিদার পরিবর্তন ঘটে। এজন্য সমাজকল্যাণের সুনির্দিষ্ট ও সর্বজনীন দর্শন গড়ে উঠেনি। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই সমাজকল্যাণ কার্যক্রম সেদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতির ভিত্তিতে গড়ে উঠে। এজন্য সমাজকল্যাণ দর্শনের মধ্যে সর্বজনীন ঐক্য পরিলক্ষিত হয়নি। তাছাড়া মানুষের চাহিদা, প্রয়োজন, দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারার পরিবর্তনের সঙ্গে সমাজকল্যাণ দর্শনের পরিবর্তন ঘটে।
প্রাথমিক পর্যায়ে সমাজকল্যাণ ছিল মানুষের পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতা নির্ভর আত্মরক্ষামূলক কার্যক্রমের মধ্যে সীমিত। কালক্রমে সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসন এবং মানব প্রেমের চেতনা যুক্ত হয়ে বদান্যতা নির্ভর সমাজকল্যাণ কার্যক্রম গড়ে উঠে। ধর্মের আবির্ভাব সমাজকল্যাণের নতুন দার্শনিক ভিত্তি গড়ে তুলতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চিরায়ত ধর্মীয় নীতি এবং মানবপ্রেমের আদর্শ সমাজকল্যাণ দর্শনের রূপরেখা প্রণয়নের দিক নির্দেশনা প্রদান করে। সুতরাং সমাজকল্যাণ চিরায়ত ধর্মীয় নীতি ও আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত বিধায় সর্বজনীন সমাজকল্যাণ দর্শন গড়ে না উঠলেও অভিন্ন কতগুলো দার্শনিক মূল্যবোধ গড়ে উঠেছে। যেগুলোর ভিত্তিতে সমাজকল্যাণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
শিল্পবিপ্লব মানব সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে। শিল্প বিপ্লবোত্তর সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজকল্যাণ দর্শনের রূপরেখাও পরিবর্তিত হয়। এ সময় বুদ্ধিভিত্তিক জাগরণ ও মানবতাবাদী আন্দোলন সমাজকল্যাণ দর্শনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। সমাজের জটিল ও বহুমুখী সমস্যা সমাধানের তাগিদে সমাজকল্যাণে ধর্মীয় ও মানবপ্রেমের আদর্শের চেয়ে মানবিক ও বুদ্ধিভিত্তিক আদর্শের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সূচিত পরিবর্তনের ঢেউ মানুষের চিন্তার জগতেও আলোড়ন সৃষ্টি করে। যা মানুষকে অনেক বেশি সমাজ সচেতন করে তুলে। দারিদ্র এবং অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে। অতীতে দারিদ্রতাকে ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষের কপালের ফের বলে মনে করে অসহায়ভাবে মেনে নেওয়া হত। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের ফলে যখন একদিকে প্রাচুর্য অন্যদিকে দারিদ্র বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখন একে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায় এ নিয়ে মনীষীগণ চিন্তা-ভাবনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে শুরু করেন। সমাজচিন্তাবিদ ও মানব হিতৈষী মনীষীদের প্রচেষ্টায় সমাজকল্যাণ সংগঠিত ও পরিকল্পিত রূপ লাভ করে। বর্তমান বিশ্বে সমাজকল্যাণ হলো সুনির্দিষ্ট দার্শনিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে পরিচালিত সুসংগঠিত সমাজসেবা কার্যক্রম।

পৃষ্ঠা ১৪২

পরিশেষে বলা যায়, সামাজিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সমাজকল্যাণ দর্শন পরিবর্তিত হলেও এর কতগুলো সর্বজনীন ভিত্তি রয়েছে। চিরায়ত মানবতাবোধ, ধর্মীয় অনুশাসন, মানবপ্রেম এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের চেতনা ও তাগিদ হলো সমাজকল্যাণ দর্শনের সার্বজনীন ভিত্তি।
সমাজকল্যাণের বিকাশে প্রধান প্রধান ধর্মের অবদান
আধুনিক সমাজকল্যাণের বিকাশে বিভিন্ন ধর্মের মূল্যবোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সমাজকল্যাণের দার্শনিক ও নৈতিক ভিত্তি ধর্মীয় দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। মানবতাবোধের বিকাশ, মানবিক চেতনা সৃষ্টি এবং পারস্পরিক বিপদে-আপদে সাহায্যদানের প্রেরণা ধর্মই মানুষের মধ্যে জাগ্রত করেছে। মানব কল্যাণের চিরন্তন বাণী নিয়ে প্রতিটি ধর্মের আবির্ভাব। ধর্মীয় অনুশাসন এবং প্রেরণাই মানুষকে আর্তমানবতার সেবায় উদ্বুদ্ধ করেছে। অধিকাংশ লেখকের মতে, ধর্মীয় অনুশাসন ও মানবতাবোধের অনুপ্রেরণায় সংগঠিত দানশীলতাই কালক্রমে বৈজ্ঞানিক দানশীলতায় পরিণত হয়ে পেশার সৃষ্টি করে। সমাজের প্রয়োজনে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুশাসনের ভিত্তিতে পরিচালিত সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথা-প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংগঠিত রূপ দানের ফলশ্রুতিতে আধুনিক সমাজকল্যাণের বিকাশ ঘটে। এজন্য বলা হয়, ‘‘আধুনিক সমাজকল্যাণ নতুন আবিষ্কৃত কোন বস্ত্ত নয়, ধর্মীয় জীবন দর্শনের গভীরে এর মূল গ্রোথিত’’। বর্তমান বাংলাদেশে প্রচলিত প্রধান চারটি ধর্ম হলো ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্ট ধর্ম। সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে চারটি ধর্মের অবদান পৃথকভাবে আলোচনা করা হলো।
সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের অবদান
বিশ্বে প্রচলিত ধর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ইসলাম। ইসলাম শুধু ধর্মই নয়, সামগ্রিক জীবন দর্শন ও পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নাম ইসলাম। মানব জীবনের সামগ্রিক দিকই ইসলামী জীবন দর্শনের পরিধিভুক্ত। সমাজকল্যাণের বিকাশে এবং দার্শনিক ভিত্তি গড়ে তুলতে ইসলামের ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের অবদানের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো¾
ক.     পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে ইসলাম মানব জীবনের সামগ্রিক কল্যাণ ও উন্নয়নে বিশ্বাসী। ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জীবন এক অবিভাজ্য সত্বা। মানবজাতির সামগ্রিক কল্যাণের বাণী নিয়ে ইসলামের আবির্ভাব। ইহলৌকিক পাপ মোচন এবং পারলৌকিক মুক্তি ও কল্যাণ লাভের আশায় মানুষ আর্ত-মানবতার সেবার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করে আসছে। ইসলামের এরূপ সর্বজনীন শিক্ষা সমাজকল্যাণের বিকাশে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
আধুনিক সমাজকল্যাণ মানব জীবনের অখন্ড সত্তায় বিশ্বাসী। এতে মানব জীবনকে সামগ্রিক দিক হতে বিচার করে। সমাজের সামগ্রিক কল্যাণে এটি সচেষ্ট।
খ. ইসলাম ধর্মে মানুষের মর্যাদার পূর্ণ স্বীকৃতি রয়েছে। মহান আল্লাহ্ মানুষকে পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ইসলাম মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব বা ‘‘আশরাফুল মাখলুকাত’’ বলে ঘোষণা করেছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘‘আমি আদম সন্তানদের মর্যাদা দান করেছি, জলে-স্থলে তাদেরকে চলাচলে বাহন দিয়েছি; তাদেরকে পবিত্র বস্ত্তর রিযিক দান করেছি এবং আমার অসংখ্য সৃষ্টির ওপর তাদেরকে উল্লেখযোগ্য শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’’
আধুনিক পেশাদার সমাজকল্যাণে মানুষের মর্যাদা ও ব্যক্তি সত্তার পূর্ণ স্বীকৃতি দেয়া হয়। এতে বিশ্বাস করা হয় যে মানুষের মর্যাদা ও পৃথক সত্বার স্বীকৃতি দান ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত কল্যাণের অপরিহার্য পূর্বশর্ত। মানব মর্যাদায় বিশ্বাস ও স্বীকৃতি সমাজকল্যাণের অন্যতম মৌলিক মূল্যবোধ এবং ব্যবহারিক নীতি।
গ. ইসলাম মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না। ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ স্বাধীনতা ইসলাম মানুষকে দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ্ ততক্ষণ পর্যন্ত কোন জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজের
পৃষ্ঠা ১৪৩
ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট হয়। মহানবী (সঃ) বলেছেন, ‘‘কাঠ কুড়িয়ে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করো, কিন্তু ভিক্ষা করো না।’’
ইসলাম মানুষের পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার এবং আত্মনির্ভরশীলতায় বিশ্বাসী। ইসলামের এরূপ আত্মনির্ভরশীল দৃষ্টিভঙ্গি সমাজকল্যাণের ব্যবহারিক নীতি এবং নৈতিক মানদন্ড বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সমাজকল্যাণে মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার দান এবং স্বনির্ভরতা অর্জনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। এতে মানুষকে নিজ ক্ষমতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার দেয়া হয়।
ঘ. ইসলাম মানুষে মানুষে বৈষম্য স্বীকার করে না। ইসলামের দৃষ্টিতে বর্ণ বা রক্তের ভিত্তিতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বিবেচিত হয় না। এ প্রসঙ্গে হযরত মুহাম্মদ (স) বলেছেন, ‘‘সাদা মানুষ কালো মানুষের উচ্চে নয়, আর কালো মানুষও হলুদ মানুষের উচ্চে নয়। আল্লাহর চোখে সবাই সমান।’’ মহানবী (সঃ) আরো বলেছেন, ‘‘সকল মানুষই পানি, ঘাস, আগুন ও উত্তাপের ব্যবহারের অধিকারে সমানভাবে অংশীদার।’’ ইসলাম ধর্মের অনুশাসন মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করে প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধার ওপর সকলের সম-অধিকার নিশ্চিত করেছে।
আধুনিক পেশাদার সমাজকল্যাণে মানুষের সমান অধিকারের পূর্ণ স্বীকৃতি দেয়া হয়। প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধায় সকলের সমান সুযোগ দানের প্রতি সমাজকল্যাণ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে, যাতে প্রতিটি মানুষ নিজ ক্ষমতা ও যোগ্যতা বিকাশের পূর্ণ সুযোগ লাভ করে।
ঙ. ইসলাম মানব সেবাকে সবচেয়ে মহাপুণ্য বলে আখ্যায়িত করেছে। ইসলামের বিধান অনুযায়ী দানশীলতা ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়। সমাজের দুঃস্থ অসহায়দের প্রতি সম্পদশালীদের যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে তা প্রকাশ পেয়েছে। যাকাত ধনীদের কর্তব্য এবং দরিদ্রদের অধিকার। যাকাত ছাড়া সদকাহ্, দান ইত্যাদির প্রতি ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। পবিত্র কোরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণা, ‘‘হে নবী! জানিয়ে দিন, মুসলমানগণ যেন তাদের পিতামাতা, নিকট আত্মীয়, এতিম, মিসকিন ও নিঃস্ব পথিকদের জন্য সম্পদ ব্যয় করে।’’ [সূরাহ বাক্বারাহ, আয়াত-৫১২]। মানব সেবার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে পবিত্র হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, ‘‘যে প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজে পেট পুরে আহার করে, সে প্রকৃত মুসলমান নয়।’’ এভাবে মানবসেবাকে ইসলাম মানুষের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড হিসেবে ঘোষণা করেছে।
ইসলামের মানবসেবার চিরায়ত বিধি-বিধান আধুনিক সমাজকল্যাণ দর্শনের বিকাশে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনি সনাতন সমাজসেবাকে প্রাতিষ্ঠানিক ও সংগঠিত রূপ দানে সহায়তা করে।
চ. ইসলামের অনুশাসন এবং অনুপ্রেরণাই রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে দুঃস্থ, অসহায়দের কল্যাণে সংগঠিত কার্যক্রমের শুভ সূচনা হয়। মাধ্যমে মানব সেবায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যাকাতের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক গুরুত্ব ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী। যাকাত দানের মাধ্যমে মানুষ পারস্পরিক ভাতৃত্ববোধ, সহানুভূতি, সহনশীল, মিতব্যয়িতা, সমাজের প্রতি কর্তব্য পালন সম্পর্কে সচেতনতা ইত্যাদি গুণাবলি অর্জন করে। এসব গুণাবলি সমাজ জীবনের সংহতি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। যাকাত সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ঘোষণা করেন, ‘‘যাকাত দেয়া প্রতিটি মুসলমানের জন্য যেমন একটি কর্তব্য, তেমনি যাকাত প্রাপ্যদের জন্য এটি একটি অধিকার। ইসলামী অনুশাসন এবং বিধি-বিধান অনুসরণ করেই খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে আদর্শ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা হয়। আধুনিক সমাজকল্যাণের সংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানে যা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক সমাজ কল্যাণের দার্শনিক এবং ব্যবহারিক দিকের বিকাশে ইসলাম ধর্মের অনুশাসন ও অনুপ্রেরণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজকল্যাণের আধুনিক ও সংগঠিত রূপ লাভের পেছনে ইসলাম ধর্মের অনুশাসন, অনুপ্রেরণা, মানবীয় দর্শন এবং মানব কল্যাণের সর্বজনীন নীতি ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করে।

 
পৃষ্ঠা ১৪৪
সমাজকল্যাণে হিন্দু ধর্মের অবদান
বিশ্বে প্রচলিত ধর্মগুলোর মধ্যে হিন্দু ধর্ম প্রাচীনতম। আর্যদের ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’ হিন্দু ধর্মের মূল উৎস। এজন্য হিন্দু ধর্মকে বৈদিক ধর্ম বা সনাতন ধর্ম বলা হয়। আদি বৈদিক যুগে হিন্দু ধর্মে বর্ণভেদ প্রথা ছিল না এবং একেশ্বরবাদ প্রচলিত থাকায় সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ বিরাজমান ছিল। কালক্রমে ব্রাহ্মণবাদের যুগে হিন্দু ধর্মে কঠোর বর্ণভেদ প্রথার উদ্ভব হয় হিন্দু ধর্মের সংস্কারক শ্রীচৈতন্য, স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণ, রাজা রায়মোহন রায়, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীদের প্রচেষ্টায় হিন্দু ধর্ম অধিকতর মানব কল্যাণমুখী হয়ে উঠে। এখানে সমাজক্যাণে হিন্দু ধর্মের অবদানের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক উল্লেখ করা হলো-
ক.     হিন্দু ধর্মে আর্তমানবতার সেবার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এতে ত্যাগ, বিনয়, উৎসর্গ, দান ইত্যাদি মানবিক গুণাবলির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ভগবত গীতায় দানশীলতাকে সর্বোত্তম কাজ বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এতে দানপ্রথাকে অর্থদান, অভয়দান, বিদ্যাদান-এ তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। বৈদিক ধর্মে ‘অন্নহীনে অন্নদান’ পরম পুণ্যের কাজ বলে বিবেচনা করা হতো।
খ. হিন্দু ধর্মে মানব প্রেমের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। হিন্দুধর্মের কল্যাণময়ী মানব প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে হিন্দু সম্প্রদায় আর্ত-মানবতার সেবায় নিয়োজিত হয়। সর্বজনীন মানব প্রেমের প্রবক্তা স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন, ‘‘নারায়ণ তথা ভগবান দরিদ্রদের মাঝে অবস্থান করেন। দরিদ্রদের সেবার মাধ্যমেই নারায়ণের সেবা করা সম্ভব।’’ তাঁর মতে, ‘‘জীব সেবাই ঈশ্বর সেবা।’’ শ্রী চৈতন্যের মতে, ‘‘জীব প্রেম ও বিশ্বপ্রেম ঈশ্বর প্রেমেরই সমতুল্য। কেবলমাত্র প্রেমের মাধ্যমেই ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব।’’
হিন্দু ধর্মের প্রখ্যাত ব্যাখ্যাদাতা ও শাস্ত্রকার শ্রী অতুলচন্দ্র সেন লিখেছেন, যজ্ঞবান লোক (যজ্ঞ অর্থ সেবা) যে অন্ন পাক করেন তা নিজের উদর পূর্তির জন্য নয়। দেবতা, অতিথি প্রভৃতিকে দান করার পর, যা অবশিষ্ট থাকে তা-ই তিনি ভোগ করেন। অন্নদান করার পর যা অবশিষ্ট থাকে তা অমৃত। অমৃত ভোজন করে, যজ্ঞবান ব্যক্তি সকল পাপ হতে মুক্ত হন। আর যজ্ঞহীন দুরাচারগণ নিজেদের ভোজনের নিমিত্তেই অন্ন পাক করে। এরা পাপান্ন ভোজন করে।
এভাবে হিন্দু ধর্মের মানব সেবাধর্মী মৌলিক নীতিগুলো হিন্দু সম্প্রদায়কে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
গ. একমাত্র মানুষের প্রতি মানুষের প্রেমই মানব সমাজকে মুক্তি প্রদান করতে সক্ষম। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রেম-দর্শন বর্ণ-বৈষম্য হিন্দু সমাজে সাম্যতা আনয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
ঘ. হিন্দু ধর্মের অন্যতম সমাজকল্যাণ প্রথা হচ্ছে দেবোত্তর। দেবোত্তর প্রথার মাধ্যমে বহু সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান মানবতার সেবায় প্রাচীনকাল হতে অদ্যাবধি নিয়োজিত রয়েছে। হিন্দু ধর্মের অনুশাসন ও অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অনাথ আশ্রম, বিধবাশ্রম, টোল, মন্দির প্রভৃতি ঐতিহ্যগত সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান আর্ত-মানবতার সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে।
উপরিউক্ত আলোচনা হতে স্পষ্ট হয়ে উঠে দুঃস্থ মানবতার সেবায় হিন্দু ধর্মের যেমন প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে, তেমনি হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের মানবতার সেবায় উৎসাহিত করার বিভিন্ন বিধি-বিধানও রয়েছে। দান, উৎসর্গ,

পৃষ্ঠা ১৪৫

দেবোত্তর প্রথা, সৎ গুণাবলির বিকাশ প্রভৃতি ধর্মীয় প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আদিকাল হতে হিন্দুধর্ম মানব কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে।
বৌদ্ধ ধর্মের অবদান
হিন্দু ধর্মের কঠোর বর্ণবাদ প্রথার প্রতিবাদস্বরূপ মানুষের সমানাধিকার, সর্বজনীন কল্যাণ এবং সেবার নীতি নিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব। মানব প্রেমের জন্যই গৌতম বুদ্ধ রাজ সিংহাসন ত্যাগ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। বিশ্বের প্রাচীণ ধর্মসমূহের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম অন্যতম। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও উপদেশকে কেন্দ্র করে এধর্মের উদ্ভব। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ ব্রাহ্মবাদ ও বর্ণবাদকে চরমভাবে ঘৃণা করতেন। ‘‘অহিংসা পরম ধর্ম’’ এটি বৌদ্ধ ধর্মের মূল মন্ত্র। সমাজকল্যাণের বিকাশে বৌদ্ধ ধর্মের অবদান সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো-
ক.     গৌতমবুদ্ধ বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জগত ও জীবনকে অবলোকন করে চারটি মহান সত্যে উপনীত হন। এ চারটি মহান সত্য হচ্ছে ক. সকলই দুঃখময়, খ. দুঃখের কারণ আছে, গ. দুঃখের নিরোধ সম্ভব, ঘ. দুঃখ নিরোধের উপায় আছে। দুঃখ নিরোধের উপায় হিসেবে বুদ্ধদেব আটটি উপায়ের কথা বলেছেন। এগুলো হচ্ছে- সৎ জীবন, সৎ কর্ম, সৎ বাক্য, সৎ চিন্তা, সৎ চেষ্টা, সৎ ইচ্ছা, সৎ দৃষ্টি। বৌদ্ধ ধর্ম অনুযায়ী আটটি মার্গ অবলম্বনে দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। বুদ্ধের চিন্তা-ভাবনা মানুষের দুঃখকে কেন্দ্র করে আবতির্ত।
.     বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্ব পর্যালোচনা করে বলা যায়, এটি একটি প্রত্যক্ষবাদী, প্রয়োজনবাদী এবং মানবতাবাদী দর্শন। প্রত্যক্ষবাদী অর্থে বৌদ্ধধর্মে প্রত্যক্ষনির্ভর নয়, এমন সত্বার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। প্রয়োজনবাদী অর্থে কিভাবে দুঃখ জয় করে পরম শান্তি ও কল্যাণ লাভ করা যায়, তার প্রায়োগিক দিক নির্দেশনা এতে রয়েছে। মানবতাবাদী অর্থে বৌদ্ধ ধর্মে জাতিভেদ ও বর্ণবৈষম্য স্বীকৃত নয়। গৌতম বুদ্ধের শিষ্যদের মধ্যে সকল বর্ণের সমান অধিকার ছিল।
.     বৌদ্ধ ধর্ম একটি উচ্চমার্গীয় আধ্যাত্নিক শৃংখলা ও মহৎ জীবন ব্যবস্থা বা সুক্ষ্ণ নীতি বোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। বৌদ্ধধর্ম একান্তই যুক্তি নির্ভর। মহামতি বুদ্ধ বলেছেনঃ আমার কথা তোমরা গ্রহণ করবে কেবল যুক্তি দিয়ে বিচার করে, আমার প্রতি তোমাদের শ্রদ্ধার কারণে নয়। বুদ্ধের অন্যতম মতবাদ হলো-কর্মবাদ’। কর্মবাদ হচ্ছে বিশ্বের কার্যকরণ তত্ত্ব, যার মূল কথা কর্মানুযায়ী ফললাভ। সুতরাং দুঃখ মানুষের নিজ কর্মের ফল। স্বীয় প্রচেষ্টা ও কর্মের দ্বারা মানুষ দুঃখ নির্মূল করতে পারে।
ঘ. বৌদ্ধ ধর্মের কল্যাণময়ী দর্শন হতে স্পষ্ট হয়ে উঠে মানুষের সমানাধিকার, সার্বিক কল্যাণ এবং সেবার মহান নীতির ওপর বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠিত। বুদ্ধদেবের বাণী থেকে এ ধর্মের কল্যাণময়ী রূপ ফুটে উঠে। তিনি তাঁর শিষ্যদের বলতেন, ‘‘ভিক্ষুগণ তোমরা বহুর কল্যাণার্থে বিশ্বের প্রতি মমতা সহকারে মানুষের সেবা ও কল্যাণ সাধনে বের হও।’’ প্রকৃত ধর্মের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বুদ্ধদেব মত পোষণ করেন, ‘‘প্রকৃত ধর্ম হচ্ছে অপরকে যথাসাধ্য কম কষ্ট দেয়া। অন্যের মঙ্গল সাধন এবং প্রেম, করুণা, সত্য ও পবিত্রতার যথাসাধ্য অনুশীলন।’’ এতে প্রতীয়মান হয় যে, ধর্ম বলতে সামগ্রিক পার্থিক জীবন বিধানকে বৌদ্ধধর্মে বুঝানো হয়ে থাকে। পার্থিব জীবনের সার্বিক কল্যাণের প্রতি বৌদ্ধ ধর্মে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।

পৃষ্ঠা ১৪৬

প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্মের মহান নীতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বহু কল্যাণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সম্রাট হর্ষবর্ধন মানব কল্যাণে যে অবদান রেখেছেন, তার প্রেরণা যুগিয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের মহান আদর্শ।
পরিশেষে বলা যায়, হিংসা, দ্বেষ ও বর্ণ-বৈষম্য দূর, সকলের সমান সুযোগ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সবশ্রেণীর মানুষের সার্বিক কল্যাণ বৌদ্ধধর্মের সর্বজনীন নীতি, যা আধুনিক সমাজকল্যাণের বিবর্তনে এবং বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
খ্রিস্ট ধর্মের অবদান
আধুনিক সমাজকল্যাণের বিবর্তন ও বিকাশে খ্রিস্ট ধর্মের অবদান বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। মানব প্রেম, মানব সেবা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও অহিংসার প্রতি এতে অত্যধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। খ্রিস্টধর্মে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করাকে চরমভাবে ঘৃণা করা হয়। ‘‘খোদার রাজ্যে সবাই সমান’’ এটি হচ্ছে খ্রিস্ট ধর্মের মূলমন্ত্র এবং ‘‘স্রষ্টার পিতৃত্বের অধীনে বিশ্বের সকল মানুষের ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা’’ এ ধর্মের মূল লক্ষ্য।
খ্রিস্ট ধর্মের প্রবর্তক যিশু মানবপ্রেমের জন্য জন্মভূমি ত্যাগ করেন এবং অসহনীয় দুঃখ কষ্ট বরণ করেন। খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে, এ বিশ্ব হলো স্রষ্টার পিতৃত্বের অধীনে মানুষের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। এতে মানুষে মানুষে পার্থক্য স্বীকার করা হয় না। খ্রিষ্ট ধর্মে মানব সেবার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মহান যিশু বলতেন, ‘‘ঈশ্বরকে ভালবাস, তোমার প্রতিবেশীকে ভালবাস। প্রতিবেশী অর্থ স্বদেশবাসী নয়, বিশ্ববাসী। যারা সবাই এক ঈশ্বরের সন্তান।’’ এতে বলা হয়েছে, ‘‘সুঁচের ছিদ্রের মধ্য দিয়ে উষ্ট্রের গমনাগমন সম্ভব হলেও ধনীদের পক্ষে স্রষ্টার রাজ্যে প্রবেশ সম্ভব হবে না।’’ তাই দেখা যায়, প্রথম কেউ যীশুখ্রিস্টের শিষ্য হতে চাইলে তাকে তার সমুদয় সম্পদ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করতে হতো। খ্রিস্টধর্মে আর্ত-মানবতার সেবা করার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে, ‘‘মানুষের সেবা করার মাধ্যমেই স্রষ্টার সেবা করা যায়।’’ খ্রিস্ট ধর্মের মানবতাবাদী অনুশাসন খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে মানবতার কল্যাণে এগিয়ে আসতে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে আসছে। খ্রিস্টধর্মের মানবতাবাদী দর্শনের মূল বক্তব্য হচ্ছে- ‘‘স্রষ্টাই পরম আরাধ্য ও কাম্য। প্রেমের মাধ্যমেই স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব।’’
আধুনিক সমাজকল্যাণের ঐতিহাসিক বিবর্তনের প্রেক্ষাপট আলোচনা করলে স্পষ্ট হয়ে উঠে , প্রাক্-শিল্প যুগে ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খ্রিস্টান সম্প্রদায় খ্রিস্ট ধর্মের অনুপ্রেরণা ও অনুশাসনের প্রভাবে আর্ত-মানবতার সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গীর্জা ও ধর্মযাজকদের মাধ্যমে যাবতীয় সমাজ সেবামূলক কার্যাবলি পরিচালিত হতো। চ্যারিটি ও দানশীলতার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত দান সংস্থাসমূহকে শিল্প সমাজের সমস্যা মোকাবেলা করার যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা হতে বিজ্ঞানসম্মত সমাজকল্যাণের সূচনা হয়। বর্তমানে সারাবিশ্ব জুড়ে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সমাজ সেবা প্রতিষ্ঠান খ্রিস্টানদের অর্থে পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো দরিদ্র ও অনুন্নত দেশের আর্ত-মানবতার সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। খ্রিস্টধর্মের মানবতাবাদী দর্শনই এসব সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মূল অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।

পৃষ্ঠা ১৪৭

সুতরাং বলা যায়, আধুনিক সমাজকল্যাণ দর্শনের বিকাশে যেমন খ্রিস্টধর্মের বিভিন্ন নীতি ও নির্দেশাবলির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, তেমনি সমাজকল্যাণকে সংগঠিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে। খ্রিস্ট ধর্মের মানব সেবা মূলক ধর্মীয় নীতি ও মূল্যবোধগুলো পাশ্চাত্যের উন্নত বিশ্বে আধুনিক পেশাদার সমাজকল্যাণের মূল্যবোধ গড়ে উঠতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে। পাশ্চাত্যে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে যখন খ্রিস্ট ধর্মকে স্বীকৃতি দেয়া হয়, তখন থেকে দুঃস্থ, অসহায়, আশ্রয়হীন ও অক্ষমদের সাহায্যের জন্য চার্চ, গীর্জা এবং ধর্মযাজকদের মাধ্যমে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। বিশ্বে খৃস্ট ধর্মাববলম্বীরাই আর্তমানবতার সেবায় সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে চলেছে।
এ প্রসঙ্গে মনীষী এফ.ই. জনসন যথার্থই বলেছেন, আধুনিক সমাজসেবার প্রায় সবগুলোর মূল উৎস হলো ধর্মীয় সংগঠন; এজন্য চার্চকে সমাজকর্মের জনক বলা যেতে পারে।
সমাজকল্যাণে ধর্মের প্রভাব
সমাজকাঠামোর অবিচ্ছেদ্য উপাদান হলো ধর্ম। ধর্মীয় আচার ব্যবস্থা সমাজকাঠামোর প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদনের মাধ্যম হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ধর্ম মানব  সভ্যতার মর্মস্থলে অবস্থিত। ধর্ম ব্যর্থ হলে মানব সভ্যতা বিপন্ন হয়ে পড়ে। ধর্মীয় প্রথা প্রতিষ্ঠান মানব সমাজে এমন কতগুলো কার্যাবলী সম্পাদন করে, যা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান সম্পাদন করতে পারে না। ধর্ম হলো সমাজের উৎপত্তিস্থল। সমাজবিজ্ঞানী ডুর্খেইম মন্তব্য করেছেন, “দ্যা আইডিয়া অফ সোসাইটি ইজ দ্যা সোল অফ রেলিজিয়ন।” আধুনিককালে ধর্মের শিথিলতা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় বাস্তব জীবনে মহাবিপর্যয়ের সংকেত বহন করছে। মানব জীবনের সামগ্রিকদিকই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ধর্ম ও কর্মের সমন্বয় সাধনের মধ্য দিয়েই মানব জীবন পরিপূর্ণতা লাভ করে।
সমাজকল্যাণে ধর্মীয় প্রভাবের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ দিক নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো¾
  1. সামাজিক বিক্ষোভ এবং অসন্তুষ্টি হ্রাস ‍: ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার ব্যবস্থার সাহায্যে মানুষ তার দুঃখ, অভাব অভিযোগ, বঞ্চনা, পরাজয়, ব্যর্থতা, হতাশা ইত্যাদি গ্লানি ভুলে থাকতে পারে বলে সামাজিক বিক্ষোভ ও অসন্তুষ্টি স্বাভাবিকভাবেই কম হয়। এর ফলে প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ ও আদর্শ সম্পর্কে বিশেষ কোন তর্কের সৃষ্টি হয় না এবং এগুলো সহজভাবে স্বীকৃতি লাভে সমর্থ হয়, যা সমাজকল্যাণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।
  2. মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি ‍: পরিবর্তনশীল আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে ব্যর্থ হয়ে মানুষ অসহায়বোধ করে। ধর্ম এক অতীন্দ্রিয় এবং অপরিবর্তনীয় জগতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ বজায় রাখতে সাহায্য করে। সমাজের কল্যাণ বিধানে এরূপ নিরাপত্তাবোধের গুরুত্ব অপরিসীম।
  3. অপরাধবোধ থেকে মুক্তিদান ‍: আর্থ-সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক সময় মানুষ সামাজিক বিধি বহির্ভূত আচরণ এবং সামাজিক অনুশাসন লঙ্গন করে বিবেকের দংশন অনুভব ও মানসিক

পৃষ্ঠা ১৪৮
অশান্তি ভোগ করে। ধর্মের প্রায়শ্চিত্তমূলক বিধিবিধান এবং নির্দেশাবলী মানুষকে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি দিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপনের সুযোগ করে দেয়। ফলে মানুষ কল্যাণধর্মী জীবন যাপনে সক্ষম হয়।
  1. অর্থবহ সামাজিক জীবনের নির্দেশনা দান ‍: ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষের অহংবোধ বিকাশে সহায়তা করে। বিশ্বব্রহ্মান্ডকে তাদের নিকট অর্থবহ করে তুলে। ধর্ম অতীত এবং অন্তহীন ভবিষ্যতের মধ্যে মানুষকে বিধিবন্ধনহীন ভাব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ হতে রক্ষা পেতে সাহায্য করে। সমাজকল্যাণে এরূপ অর্থবহ সামাজিক জীবন যাপনের নির্দেশনার গুরুত্ব  অপরিসীম। মৃত্যুজনিত শূন্যতা পূরণ এবং মৃত্যুই মানব জীবনের শেষ নয় -এ প্রত্যাশা ধর্মই মানুষকে দিয়ে থাকে।
  2. সামাজিক সংহতি বিধান ‍: সামাজিক সংহতি বজায় রাখা সমাজকল্যাণের অপরিহার্য শর্ত। সামাজিক সংহতি এবং ঐক্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। একদিকে প্রচলিত মূল্যবোধ, সামাজিক রীতি-নীতি ধর্মের সমর্থন লাভ করে মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে। অন্যদিকে, একই প্রকার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান অনুসরণ করার ফলে সমধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সংহতি গড়ে উঠে। এরূপ সামাজিক সংহতি ও ঐক্য কল্যাণমুখী সমাজ গঠনের সহায়ক।
  3. সহজ সরল জীবন যাপনের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি ‍:  ধর্ম মানুষকে সহজ সরল জীবনযাপনের নির্দেশনা দান করে এবং সৎ উপায়ে অর্জিত স্বল্প সম্পদের মাধ্যমে পরিতৃপ্ত হবার মানসিকতা গড়ে তুলতে অনুপ্রেরণা যোগায়। ফলে সমাজে সম্পদ লাভের অসম প্রতিযোগিতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, অপরাধ প্রবণতা ইত্যাদি হ্রাস পায়, যা সমাজকল্যাণের ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করে।
  4. পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহানুভূতি সৃষ্টি ‍: ধর্মীয় অনুশাসন ও অনুপ্রেরণা মানুষকে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা দানে উৎসাহিত করে। সমাজের দুঃস্থ, অসহায়, অক্ষম ও বিপদগ্রস্তদের সাহায্য দানের প্রেরণা ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুশাসনের ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়ে আসছে দান, সদকাহ, যাকাত, ওয়াক্ফ, এতিমখানা, দেবোত্তর প্রথা, এতিমখানা প্রভৃতি চিরায়ত ঐতিহ্যগত সমাজসেবা কার্যক্রম। বিশ্বব্যাপী স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ কার্যক্রমের ক্ষেত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রভাব প্রধান চালিকা শক্তি।
  5. মানবকল্যাণে অনুপ্রেরণা ‍: পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার মৌলিক ভিত্তি হলো ধর্মীয় অনুশাসন ও অনুপ্রেরণা। ধর্মীয় বিধানই মানুষকে আর্তমানবতার কল্যাণে এগিয়ে আসার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি ধর্মে মানব সেবার জন্য প্রত্যক্ষ ও সরাসরি নির্দেশ দিয়েছে। অনেক ধর্মে মানবকল্যাণে দান করাকে বাধ্যতামূলক করেছে। যেমন ইসলামের যাকাত ব্যবস্থা।
৯.     ধর্ম সমাজকল্যাণ দর্শনের সর্বজনীন ভিত্তি ‍: সংঘবদ্ধ জীবনের প্রথম পর্যায়ে অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনেই মানুষ পরস্পরকে বিপদে-আপদে সাহায্য ও সহযোগিতা করতো। সমাজ বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা ও মানবিক চেতনা সমাজকল্যাণে মানুষকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। সমাজকল্যাণ দর্শনের বিকাশে পারস্পরিক প্রয়োজন ও নির্ভরশীলতা, মানবতাবোধ, মানবিক চেতনা, কল্যাণমুখী রাজনৈতিক চিন্তাধারা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও ধর্মীয় অনুশাসন এবং ধর্মীয় অনুপ্রেরণা সমাজকল্যাণ দর্শনের সর্বজনীন ভিত্তি হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে। মানবতাবোধের বিকাশ, মানবিক চেতনা সৃষ্টি এবং পারস্পরিক বিপদ-
পৃষ্ঠা ১৪৯

আপদে সাহায্যদানের প্রেরণা ধর্মই মানুষের মধ্যে জাগ্রত করেছে। মানবকল্যাণের চিরন্তন বাণী নিয়েই প্রতিটি ধর্মের আবির্ভাব। ধর্মীয় অনুশাসনের তাগিদে স্মরণাতীতকাল হতে মানুষ সমাজের দুঃস্থ, অসহায় ও বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে।
১০. মানবকল্যাণে আত্মোৎসর্গ করার শিক্ষাদান ‍: সকল ধর্মের প্রচারকগণই তাঁদের অনুসারীদের মানবকল্যাণে আত্মোৎসর্গ করার তাগিদ দিতেন। ধর্ম প্রচারকদের শিক্ষা ও আদর্শে অনুপ্রাণীত হয়ে মানুষ যেমন স্রষ্টাকে চিনেছে, তেমনি সৃষ্টির সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার তাগিদ অনুভব করতে শেখেছে। ধর্মীয় শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা ক্ষুধার্তকে অন্নদান, অসহায়কে সাহায্যদান, আশ্রয়হীনকে আশ্রয়দান, বিপদগ্রস্তকে পরিত্রাণ দান এবং অক্ষমকে সহানুভূতি প্রদর্শন প্রভৃতি কল্যাণধর্মী মানবিক অনুভূতি সব সমাজে পরিলক্ষিত হয়। যেগুলো সকল দেশে সমাজকল্যাণের মূল ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত।
১১.    প্রাতিষ্ঠানিক সমাজসেবা কার্যাবলীর ভিত্তি স্থাপন ‍: পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মের সমাজসেবামূলক প্রথা-প্রতিষ্ঠান; যেমন- যাকাত, ওয়াক্ফ, সদকাহ্, দেবোত্তর প্রথা, চ্যারিটি, মসজিদ মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা ইত্যাদি প্রাচীনকাল হতে দুঃস্থ মানবতার কল্যাণে যে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে, তাই কালক্রমে সমাজকল্যাণের আধুনিকরূপ লাভে বিশেষভাবে সাহায্য করে। ‘‘দরিদ্র, আর্ত-পীড়িত, অসহায়দের সেবা করার মাধ্যমে পরলোকে মোক্ষলাভ এবং পার্থিব জীবনে অনুষ্ঠিত পাপের লাঘব’’ -এরূপ ধর্মীয় দর্শনই ধর্মপ্রাণ ও বদান্য ব্যক্তিদের মানবতার সেবায় প্রেরণা যোগায়। ধর্মীয় অনুশাসন এবং প্রেরণাই এতিমখানা, লঙ্গরখানা, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দুঃস্থনিবাস, অনাথ আশ্রম প্রভৃতি সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান স্থাপনে মানুষকে অনুপ্রাণীত করেছে।
আমেরিকার মনীষী এফ.ই. জনসন সুসংগঠিত ব্যবস্থা হিসেবে সমাজকল্যাণের বিকাশে ধর্মের তাৎপর্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘প্রায় সবধরনের আধুনিক সমাজসেবা কার্যক্রমের মূল ধর্মীয় সংগঠনের মধ্যে প্রোথিত।’’
সমাজকল্যাণ দর্শনের বিকাশে বিভিন্ন ধর্মের বিধি-বিধানের অবদান অস্বীকার করা যায় না; ক. ইসলাম ধর্মে ‘‘সে-ই শ্রেষ্ঠ মানুষ যে অপরের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখে’’। খ. হিন্দু ধর্মের ‘‘আর্ত-দরিদ্রদের সেবার মাধ্যমে ভগবানের সেবা করা;’’ গ. বৌদ্ধধর্মের ‘‘জীবে দয়া করাকে মুক্তি বা নির্বাণ লাভের অন্যতম পন্থা;’’ ঘ. খ্রিস্টধর্মের ‘‘মানবসেবা ও মানব প্রেমের মাধ্যমে খোদার রাজ্য প্রতিষ্ঠা।’’- এসব সর্বজনীন ধর্মীয় অনুশাসন সমাজকল্যাণ বিকাশে মৌলিক নির্দেশনা হিসেবে ভূমিকা পালন করে।

অনুশীলনী

রচনামূলক প্রশ্ন
১. সমাজকল্যাণ দর্শন বলতে কি বুঝ ? সমাজকল্যাণ দর্শনের মূল ভিত্তি আলোচনা কর।
২. সমাজকল্যাণ দর্শনের বিবর্তন অথবা বিকাশে ইসলাম ধর্মের অবদান সংক্ষেপে আলোচনা কর।
৩. ‘‘আধুনিক সমাজকল্যাণের মূল ধর্মীয় জীবনদর্শনের গভীরে প্রোথিত’’-আলোচনা কর।
৪. ইসলাম ধর্মের সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সমাজকল্যাণ দর্শনের সম্পর্ক আলোচনা কর।
৫. সমাজকল্যাণের বিকাশে খ্রিস্ট ধর্মের মূল্যবোধের প্রভাব আলোচনা কর।
৬. সমাজকল্যাণের বিকাশে বৌদ্ধ ধর্মের অবদান আলোচনা কর।
৭. সমাজকল্যাণের বিকাশে হিন্দু ধর্মের মূল্যবোধের প্রভাব আলোচনা কর।
৮. সমাজকল্যাণ দর্শনের বিবর্তন সংক্ষেপে আলোচনা কর।
সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও
১. সমাজকল্যাণ দর্শনের সর্বজনীন ভিত্তি কি কি ?
২. সমাজকল্যাণের বিকাশে ইসলামের একটি অবদান আলোচনা কর।
৩. হিন্দু ধর্মগ্রন্থ গীতায় উল্লেখিত দানশীলতা কয় ভাগে বিভক্ত ?
৪. গৌতম বুদ্ধের চারটি মহান সত্য কি কি ?
৫. খ্রিস্ট ধর্মের মানবতাবাদী মূল বক্তব্য কি কি ?
৬. সমাজকল্যাণ দর্শন কি?

View Foundation Digital Talking Library is developed and maintained by Sigma Enterprise.
Theme designed by Imtiaz
All rights are reserved. Any kind of reproduction of any mp3 files and text files is prohibited. If any organization or any person is found copying or reproducing any of the material will be punished under copy right law.