পৃষ্ঠা ১৬৬
সপ্তম অধ্যায়
সমাজকর্মে মূল্যবোধ

ভূমিকা
সমাজকর্ম একটি সাহায্যকারী পেশা। স্বীকৃত পেশা হিসাবে সমাজকর্ম মূল্যবোধ নিরপেক্ষ নয়। এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সমাজকর্মী ফেডারেশনের মন্তব্য হলো, ‘‘সমাজকর্ম হলো মূল্যবোধ, তত্ত্ব এবং অনুশীলন-এ তিনটির আন্তঃসম্পর্কিত একটি ব্যবস্থা। সমাজকর্ম অভিধানে সমাজকর্মকে মানুষকে সাহায্য করার ব্যবহারিক বিজ্ঞান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো সমাজ কর্মকেও কম-বেশি মানবিক মূল্যবোধের আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী জর্জ সিমসন-এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘‘যে কোন বিজ্ঞানকেই কমবেশি মানবিক মূল্যবোধের আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। একেবারে মূল্যবোধ নিরপেক্ষ হওয়া কোন বিজ্ঞানীর পক্ষেই সম্ভব নয়। বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণভাবে মূল্যবোধ নিরপেক্ষ হতে হলে একে শুধু কতগুলো অতি প্রাকৃত ইথার সমুদ্রের ভাসমান নিরাকার সত্তাকে নিয়ে চলতে হবে। অধিকন্তু বিজ্ঞানীরা প্রধানত মানুষ। আর মানুষের কল্যাণেই তারা নিয়োজিত। বস্ত্তত যেখানে মানুষ থাকবে সেখানে মানুষের মূল্যবোধও থাকবে।’’ পেশাদার সমাজকর্মের সামগ্রিক সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া ও কর্মপদ্ধতি কতগুলো মূল্যবোধকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। সমাজকর্ম হলো মূল্যবোধ নির্দেশিত পেশা।
মূল্যবোধ কি ?
মূল্যবোধ একটি আপেক্ষিক প্রত্যয়। এটি কোন সমাজেই লিপিবদ্ধ থাকে না। সমাজের রীতি নীতি, আদর্শ ও অনুমোদিত ব্যবহারের মাধ্যমে মূল্যবোধ গড়ে উঠে। ফলে সমাজ ভেদে মূল্যবোধের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এমনকি একই মূল্যবোধ সমাজভেদে ইতিবাচক ও নেতিবাচক রূপ লাভ করে।
মূল্যবোধ বলতে, মানুষের এমন এক বিশ্বাস বোধ ও মানদন্ডকে বুঝায়, যার মাধ্যমে কোন ঘটনা বা অবস্থার ভালমন্দ বিচার করা হয়। সমাজকর্ম অভিধানের সংজ্ঞানুযায়ী, “মূল্যবোধ হলো সেসব প্রথা, আচরণের মানদন্ড এবং নীতি যেগুলো কোন একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, একটি দলের সদস্য অথবা ব্যক্তি প্রত্যাশিত বা বাঞ্ছিত বলে বিবেচনা করে’’। মেটা স্পেনসারের মতে, ‘‘মূল্যবোধ হলো একটা মানদন্ড, যা আচরণের ভাল মন্দ বিচারের এবং সম্ভাব্য বিভিন্ন লক্ষ্য হতে কোন একটি পছন্দ করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।’’
মূল্যবোধ হলো মানুষের ইচ্ছা ও বিশ্বাসবোধের একটি প্রধান মানদন্ড, যার আদর্শে মানুষের আচার ব্যবহার, রীতি-নীতি, কার্যক্রম ইত্যাদি পরিচালিত এবং যার মাধ্যমে সমাজে মানুষের কর্মকান্ডের ভালমন্দ বিচার করা হয়। মনীষী মিলটন রোকেছ সুনির্দিষ্টভাবে মূল্যবোধের সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর মতে, মূল্যবোধ হলো এক ধরনের বিশ্বাস, যা ব্যক্তি মানুষের সার্বিক বিশ্বাস ব্যবস্থার কেন্দ্রে অবস্থান করে একজনের কি করা উচিত এবং কি করা উচিত নয় সে সম্পর্কে বিশ্বাসবোধের জন্ম দেয়।
সমাজ জীবনে ব্যক্তিগত, দলীয়, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক, পেশাগত ইত্যাদি পর্যায়ের মূল্যবোধ পরিলক্ষিত হয়। ব্যক্তিগত পর্যায়ের মূল্যবোধ ব্যক্তির বিশ্বাসবোধ, রুচিবোধ, ধ্যান ধারণা ও নীতিবোধকে নির্দেশ করে। যেগুলো পরোক্ষভাবে ব্যক্তির আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে। দলীয় লক্ষ্য, আদর্শ ও নীতিবোধের প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠা বিচারবোধ বা দৃষ্টিভঙ্গি দলীয় মূল্যবোধের পরিচয় বহন করে। সামাজিক রীতি-নীতি, আদর্শ এবং সমাজ অনুমোদিত ব্যবহারের সমন্বয়ে সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে উঠে। আর প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাগত মূল্যবোধ হলো প্রতিষ্ঠান বা নির্দিষ্ট পেশার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আদর্শভিত্তিক নীতিমালার সমষ্টি, যেগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাগত কার্যক্রম সক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
পৃষ্ঠা ১৬৭
সমাজকর্ম অনুশীলনে মূল্যবোধের শ্রেণী বিভাগ
সমাজকর্ম মূল্যবোধ নির্দেশিত পেশা, মূল্যবোধ নিরপেক্ষভাবে সমাজকর্ম অনুশীলন করা যায় না। সমাজকর্ম অনুশীলনের পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যবোধকে মনীষীরা বিভিন্ন দিক হতে শ্রেণী বিভাগ করেছেন। সমাজকর্ম অনুশীলনে অনুসৃত মূল্যবোধগুলোকে তিনটি দিক হতে আলোচনা করা যায়।
১. পরম মূল্যবোধ ঃ যেসব মূল্যবোধ সামাজিক দল বা গোষ্ঠীর দীর্ঘ মেয়াদী উদ্দেশ্যে পৌঁছার সাধারণ নির্দেশনা দান করে, সেসব মূল্যবোধকে পরম মূল্যবোধ বলা হয়। “ইনসাইক্লোপিডিয়া অফ সোস্যাল ওয়ার্ক -এর ব্যাখ্যানুযায়ী, “আল্টিমেট ভেলুজ আর ব্রডলি কনছিভ্ড এন্ড প্রুভ্ড জেনারেল গাইডেন্স টু এ গ্রুপ্স লং-টার্ম এইম্স”। এগুলো বৃহত্তর পরিসরে অনুসৃত চূড়ান্ত মূল্যবোধ। সমাজকর্মে কর্মে মূল্যবোধের উদাহরণ হলো মানব মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শন, সাম্য মানুষের মধ্যে বৈষম্য না করা ইত্যাদি।
২. সুনির্দিষ্ট মূল্যবোধ ঃ যেসব মূল্যবোধ অধিক সুনির্দিষ্ট এবং স্বল্পকালীন লক্ষ্য নির্দেশ করে, সেগুলো সুনির্দিষ্ট মূল্যবোধ। ইনসাইক্লোপিডিয়া অফ সোস্যাল ওয়ার্ক (১৯৯৫) গ্রন্থের ব্যাখ্যানুযায়ী, “প্রক্সিমেট ভেলুজ আর মোর স্পেসিফিক এন্ড সাজেস্ট শর্ট টার্ম গোল্স” সমাজকর্মে এসব মূল্যবোধগুলো সেবাগ্রহীতার স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্যকর গৃহায়নের অধিকার সংশ্লিষ্ট নীতি, মানসিক চিকিৎসাধীন রোগীর বিশেষ ধরনের চিকিৎসা গ্রহণ না করার অধিকার প্রভৃতি এজাতীয় মূল্যবোধ।
৩. কর্ম সম্পাদনের উপায় হিসেবে মূল্যবোধ ঃ যেসব মূল্যবোধ নির্দিষ্ট লক্ষ্যার্জনের উপায় বা হাতিয়ার হিসেবে অনুসরণ করা হয়, সেগুলোকে ইন্সট্রুমেন্টাল ভেলুজ বলা হয়। ইনসাইক্লোপিডিয়া অফ সোস্যাল ওয়ার্ক -এর ব্যাখ্যানুযায়ী, “ইন্সট্রুমেন্টাল ভেলুজ স্পেসিফি ডিজার্বল মীন্স টু ডিজার্বল এন্ড। সমাজকর্মে এরূপ মূল্যবোধের উদাহরণ হলো, সেবাগ্রহীতার গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার এবং সম্মতি বা মতামত প্রদানের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ইত্যাদি।
সমাজকর্ম মূল্যবোধ
সাহায্যকারী পেশা হিসেবে সমাজকর্মের নিজস্ব কতগুলো পেশাগত মূল্যবোধ রয়েছে, যেগুলো সমাজকর্মীদের পেশাগত আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালিত করে। যেসব আদর্শ, বিশ্বাস, ধারণা, মৌলিক নীতিমালা ও স্বীকার্য সত্যের ওপর পেশাদার সমাজকর্মের সামগ্রিক সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া পরিচালিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয় সেগুলোর সমষ্টিই হলো সমাজকর্মের মূল্যবোধ। সমাজকর্মের মূল্যবোধ চিরায়ত ধর্মীয় নীতি এবং বুদ্ধিভিত্তিক মানবিক আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে।
মনীষী গ্রেস কয়লী সংক্ষেপে এবং সহজভাবে সমাজকর্মের দার্শনিক ভিত্তি তুলে ধরেছেন। তাঁর ভাষায় সমাজকর্মের মৌলিক দর্শন হলো ক. এ রেস্পেক্ট অর হিউম্যান পারসনালিটি এবং খ. এ বেলিফ ইন ডেমোক্রেসি। সমাজকর্মে মানব সত্তা হলো এক স্বতঃসিদ্ধ অন্তর্নিহিত দার্শনিক মূল্যবোধ। সমাজকর্মে মানব মর্যাদা ও তার অন্তর্নিহিত মানবিক সত্তার প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি সমাজকর্মীরা সদা সচেতন থাকে।
সমাজকর্মের অন্তর্নিহিত সর্বজনীন মূল্যবোধ হলো মানবসত্তার মর্যাদা। এই সর্বজনীন মূল্যবোধটি বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন পর্যায়ে প্রকাশ পায়। সমাজকর্মের মূল্যবোধ হিসেবে মানব সত্তার মর্যাদা যে কটি পর্যায়ে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো হলো ব্যক্তির মর্যাদার স্বীকৃতি, ব্যক্তির অন্তর্নিহিত সত্তার স্বীকৃতি, ব্যক্তির সহজাত চেতনা ও সংহতির স্বীকৃতি, ব্যক্তির স্বাধীনতার ও অধিকারের স্বীকৃতি। এগুলোকে ভিত্তি করেই সমাজকর্মের মূল্যবোধ গড়ে উঠেছে।
মানবহিতৈষী এবং গণতান্ত্রিক আদর্শ হতে সমাজকর্মের বিকাশ। সমাজকর্ম মূল্যবোধের ভিত্তি হলো সকল মানুষের সাম্য, অন্তর্নিহিত সত্তা ও মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শন। এক শতাব্দী পূর্ব থেকে সমাজকর্মের যাত্রা শুরু। মানব চাহিদা পূরণ এবং মানব প্রতিভা বিকাশের প্রতি
পৃষ্ঠা ১৬৮
সমাজকর্ম অনুশীলনে প্রথম থেকে গুরুত্বারোপ করা হয়। মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার সমাজকর্ম কার্যাবলীর যথার্থতা ও যৌক্তিকতা মূল্যায়নে ভূমিকা পালন করে। মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার সমাজকর্মের মৌলিক নীতি, যেগুলো ছাড়া মানুষের কল্যাণ আশা করা যায় না। (সূত্র ইন্টারনেট)
সমাজকর্মের সাধারণ মূল্যবোধগুলো হলো- ১. ব্যক্তি মর্যাদার স্বীকৃতি, ২. সকলের সমান সুযোগ দান, ৩. আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, ৪. স্বনির্ভরতা অর্জন, ৫. গণতান্ত্রিক অধিকার, ৬. শ্রমের মর্যাদা, ৭. সামাজিক দায়িত্ববোধ, ৮. ব্যক্তি স্বাধীনতা, ৯. সম্পদের সদ্ব্যবহার, ১০. পারস্পরিক সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ। সমাজকর্মের অনুশীলনে এসব মূল্যবোধগুলোর ব্যাখ্যা এবং প্রায়োগিক তাৎপর্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে আলোচনা করা হলো।
১. ব্যক্তির সহজাত মূল্য ও মর্যাদার স্বীকৃতি ঃ সমাজের মূল অণু হলো ব্যক্তি। ব্যক্তির সমষ্টিই সমাজ। সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিরই পৃথক মর্যাদা ও সত্তা রয়েছে। প্রত্যেকেই তার অন্তর্নিহিত পৃথক সত্তা ও মর্যাদার স্বীকৃতি পেতে চায়। সমাজকর্মে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার পৃথক সত্তা ও মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। সমাজকর্মে বিশ্বাস করা হয় সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তিই বিশেষ মর্যাদা ও মূল্যের অধিকারী। ব্যক্তির মর্যাদা ও পৃথক সত্তার স্বীকৃতিদান ছাড়া যেমন মানুষের কল্যাণ আনয়ন সম্ভব নয়, তেমনি সমাজের কল্যাণ সাধন অসম্ভব। এজন্য সমাজকর্মে সাহায্যপ্রার্থীকে তার অন্তর্নিহিত মূল্য ও মর্যাদার স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়।
সমাজকর্মের বাস্তব অনুশীলনের ক্ষেত্রে ব্যক্তির মর্যাদা ও পৃথক সত্তার স্বীকৃতি দানের তাৎপর্য হলো, ক. ব্যক্তি মর্যাদার স্বীকৃতি সাহায্যার্থীর সুপ্ত ক্ষমতা বিকাশে সহায়ক, খ. এতে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি সক্রিয় সহযোগিতা ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের অনুপ্রেরণা লাভ করে, গ. পেশাগত সম্পর্ক স্থাপনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়, ঘ. সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং স্বাবলম্বন অর্জনের স্পৃহা জাগ্রত হয়, ঙ. সাহায্যপ্রার্থীর পৃথক সত্তা ও মর্যাদার প্রেক্ষাপটে সমাজকর্মী সমস্যা সমাধান পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ ব্যক্তি মর্যাদার স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে সমাজকর্মীরা ব্যক্তি স্বতন্ত্রীকরণে সক্ষম হন। এসব বাস্তব উপযোগিতার কারণে ব্যক্তি মর্যাদার স্বীকৃতি দান সমাজকর্মের বিশেষ মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচিত।
২. সকলের সমান সুযোগ দান : সমাজকর্মে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে সকল মানুষকে সমমর্যাদা ও সমঅধিকার দান করা হয়। এতে সকল মানুষকে সমদৃষ্টিকোণ হতে বিবেচনা করা হয়। বিশেষ ব্যক্তি বা শ্রেণীকে গুরুত্ব না দিয়ে সবার প্রতি সমান গুরুত্ব দেয়া হয়, যাতে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনরূপ বৈষম্য সৃষ্টি না হয়। সমাজকর্মের লক্ষ্য হলো সামাজিক বৈষম্য ও ভেদাভেদ সৃষ্টি না করে সকল মানুষের কল্যাণ আনয়নে সাহায্য করা। এজন্য সমাজকর্মীরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় বিশেষ কোন শ্রেণীকে উপেক্ষা করে অন্য শ্রেণীকে গুরুত্ব দিতে পারে না। সর্বস্তরের মানুষ যাতে নিজ নিজ ক্ষমতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী প্রাপ্ত সম্পদ এবং সুযোগ সুবিধায় সম-অধিকার ভোগ করতে পারে তার প্রতি সমাজকর্মে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।
সমাজকর্মের বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে সকলের সমান সুযোগ দানের মতো মূল্যবোধের তাৎপর্য হলো- ক. এতে সকল স্তরের মানুষ সুপ্ত প্রতিভা ও ক্ষমতা বিকাশে সমান সুযোগ লাভ করে, খ. প্রত্যেকে সামর্থ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী নিজ নিজ ভাগ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, গ. প্রাপ্ত সম্পদ ও সুযোগ সুবিধা ভোগের ক্ষেত্রে সকলের সমান সুযোগ দানের নিশ্চয়তা বিধানের মাধ্যমে মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার বিকাশ ঘটানো যায়, যা সামাজিক উন্নয়নে সকলের স্বতঃস্ফূর্ত ও কার্যকরী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। এসব বাস্তব উপযোগিতার কারণে সমাজকর্মে সকলের সমান সুযোগদানের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।
৩. আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার : মানুষকে নিজের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ দানই আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার দান। সমাজকর্ম মানুষকে তার চাহিদা, পছন্দ, সামর্থ্য ও ক্ষমতা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সে অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তোলার অধিকার দানে বিশ্বাসী। পেশা হিসেবে এতে মানুষকে
পৃষ্ঠা ১৬৯
এমনভাবে সাহায্য করা হয়, যাতে তারা স্বীয় সামর্থ্য ও সম্পদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করতে সক্ষম হয়। সমাজকর্ম জোরপূর্বক কোন সিদ্ধান্ত বা সমাধান মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়ার নীতিতে বিশ্বাসী নয়। সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির সমস্যার প্রকৃতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, দেশের প্রচলিত আইন এবং সাহায্যদানকারী প্রতিষ্ঠানের আদর্শ ও নীতিমালা ইত্যাদি বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সুযোগ নির্ধারণ করা হয়। যেমন- অপরাধ সংশোধন কার্যক্রমে বা মানসিক বিকারগ্রস্তদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটে নির্ধারণ করা হয়।
আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার দান সমাজ কর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পেশাগত মূল্যবোধ। এ মূল্যবোধের বাস্তব গুরুত্ব ও তাৎপর্য হলো- ক. আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার দান মানুষকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে, খ. সমাজের সার্বিক কল্যাণ ও উন্নয়নে সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা বিধান করে, গ. মানুষের আত্মোপলব্ধি বৃদ্ধি এবং মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলে, ঘ. আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সুযোগদানের মাধ্যমে সমাজকর্মী সাহায্যপ্রার্থীর সামর্থ্য ও ক্ষমতার যথাযথ মূল্যায়ন করতে সক্ষম হন এবং সে অনুযায়ী সমস্যা সমাধান পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন, ঙ. সাহায্যপ্রার্থীর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াকে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
৪. স্বনির্ভরতা : পেশাদার সমাজকর্মের সামগ্রিক কার্যক্রম স্বাবলম্বন নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত। এতে বিশ্বাস করা হয়, সমাজস্থ প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কোন না কোন ধরনের সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে। যা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষকে স্বনির্ভর করে তোলা সম্ভব। সমাজকর্মে মানুষকে এমনভাবে সাহায্য করা হয়, যাতে তারা বাহ্যিক সাহায্যের ওপর নির্ভর না করে প্রত্যেকে নিজেদের ক্ষমতা ও সম্পদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারে।
সমাজকর্মের বাস্তব অনুশীলনে স্বনির্ভরতা অর্জন মূল্যবোধের যথাযথ অনুসরণের ফলে মানুষের পরনির্ভরশীল মানসিকতার পরিবর্তে আত্মনির্ভরশীল মানসিকতা সৃষ্টি হয়। এতে মানুষ নিজের সামর্থ্য ও সম্পদের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে আত্মবিশ্বাসী ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠে।
৫. গণতান্ত্রিক অধিকার : সমাজকর্ম মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করায় বিশ্বাসী নয়। সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়ে মানুষের মতামত, চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগদানের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের ইচ্ছা ও মতামতকে যথাযথ মর্যাদা দেয়া হয়। সমাজকর্মে বিশ্বাস করা হয় মানুষ নিজেই নিজের সমস্যা, সম্পদ ও সমাধান সম্পর্কে বেশি অবগত। জোরপূর্বক কোন সিদ্ধান্ত বা সমাধান চাপিয়ে দেয়ার নীতিতে সমাজকর্ম বিশ্বাসী নয়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে সমাজকর্মীরা সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় সাহায্যপ্রার্থীর অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা দান করে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। যা সমাজের সকল পর্যায়ের মানুষের অধিকার সংরক্ষণ ও কল্যাণ বিধানে সহায়তা করে।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যথাযথ প্রয়োগ মানুষের আত্মোপলব্ধি ও প্রত্যক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ব্যক্তি স্বার্থ সংরক্ষণে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক অধিকারের মাধ্যমে ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথ খুঁজে পায়। আত্মসাহায্য, স্ব-উদ্যোগ এবং দায়িত্ববোধ প্রভৃতি মানবিক গুণাবলি বিকাশের উত্তম পদ্ধতি হলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যথাযথ অনুশীলন। এসব কারণে সমাজকর্মের গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ হিসেবে গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকৃত।
৬. শ্রমের মর্যাদা : মানব জীবনের সামগ্রিক কল্যাণ ও উন্নতির অপরিহার্য শর্ত হলো শ্রমের মর্যাদা দান। শ্রম যে প্রকৃতিরই হোক না কেন তা আত্মসম্মানের পক্ষে হানিকর নয় বরং মানব সমাজের উন্নতির শ্রেষ্ঠ উপায়। যে জাতি শ্রমের প্রতি যত বেশি শ্রদ্ধাশীল ও মর্যাদাশীল, সে জাতি ততবেশি উন্নত। শ্রমবিমুখ জাতি মর্যাদাহীন। শ্রমের যথার্থ মূল্যায়ন মানবিক মূল্যবোধের উৎকর্ষ সাধনের সহায়ক।
পেশাদার সমাজকর্মে শ্রমের মর্যাদার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। সমাজকর্মে সব ধরনের শ্রম ও পেশার প্রতিই সম মর্যাদা প্রদর্শন করা হয়। কোন শ্রমকেই অবজ্ঞা বা সম্মান হানিকর বিবেচনা করা হয় না। শ্রমের মর্যাদা দান ব্যতীত ব্যক্তি সত্তার বিকাশ সাধন সম্ভব নয়। ব্যক্তি জীবনের পরিপূর্ণতা আনয়নে এবং সামাজিক উন্নতিতে শ্রমের মর্যাদার প্রভাব অপরিহার্য। আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে
পৃষ্ঠা ১৭০
স্বনির্ভরতা অর্জনের ক্ষেত্রে শ্রমের মর্যাদার মতো মূল্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। সবধরনের শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবার মানবিক অনুভূতি জাগ্রত করতে সমাজকর্মীরা সদা সচেষ্ট।
৭. সামাজিক দায়িত্ববোধ : সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষ সমাজ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। বিনিময়ে সমাজের প্রতিও কতগুলো কর্তব্য পালন করে। সমাজের প্রতি মানুষের কর্তব্য পালনের অনুভূতিই সামাজিক দায়িত্ববোধ। সমাজকর্মে বিশ্বাস করা হয় মানুষ সমাজ থেকে যেমন বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগ করে, তেমনি সমাজের প্রতিও তাকে কতগুলো দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ এবং সকলের সমবেত দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করে। সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষের যে সব দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করে। সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষের যে সব দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, সমাজকর্মীরা সেগুলো সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলে, যাতে সামাজিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মানুষ স্বীয় অধিকার ভোগ করতে সক্ষম হয়।
সামাজিক দায়িত্ববোধ সমাজকর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ। কারণ সমাজের একজনের যা কর্তব্য ও দায়িত্ব অন্যজনের তা অধিকার। সুতরাং মানুষ যদি নিজ নিজ সামাজিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করে, তাহলে অন্যরা তাদের অধিকার হতে বঞ্চিত হয়। সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ সমাজস্থ মানুষের সামাজিক দায়িত্ববোধ বা দায়িত্ব সচেতনতার ওপর নির্ভরশীল। যে সমাজের মানুষ যত বেশি দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতন, সে সমাজ তত বেশি সুশৃঙ্খল। সামাজিক শৃঙ্খলা, সংহতি ও ঐক্য সামাজিক দায়িত্ববোধের ওপর নির্ভরশীল বলে সমাজকর্ম অনুশীলনে এ মূল্যবোধের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।
৮. ব্যক্তি স্বাধীনতা : সমাজের সদস্য হিসেবে একে-অপরের কার্যাবলির ওপর হস্তক্ষেপ না করে স্ব-ইচ্ছা অনুসারে কাজ করার নামই স্বাধীনতা। সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তি তার ইচ্ছা অনুসারে কাজ করতে চায়। সুতরাং ব্যক্তিকে যতটা সম্ভব ইচ্ছানুসারে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন করা প্রয়োজন।
ব্যক্তি স্বাধীনতা হলো এমন ধরনের সুযোগ-সুবিধা, যে সুযোগ-সুবিধার সদ্ব্যবহার দ্বারা কোন ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্বের চরম বিকাশ সাধন করতে সক্ষম হয়। এতে ব্যক্তি তার স্বাভাবিক মানসিক বৃত্তিগুলোর বিকাশ সাধনে অন্যের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয় না। সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়ে ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়। সমাজকর্ম ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপে বিশ্বাসী নয়। সমাজকর্মের আদর্শ ও নীতিমালার আওতায় সাহায্যপ্রার্থীকে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়, যাতে সাহায্যপ্রার্থী প্রাপ্ত সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার সদ্ব্যবহার দ্বারা হৃত ক্ষমতা পুনরুদ্বারে সক্ষম হয়। ব্যক্তি স্বাধীনতা ব্যতীত মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ এবং স্বাবলম্বন অর্জনে সক্ষম করে তোলা সম্ভব নয়। ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হলে প্রতিভা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্য সমাজকর্মের গুরুত্বপূর্ণ পেশাগত মূল্যবোধ হিসেবে ব্যক্তি স্বাধীনতা স্বীকৃত।
৯. সম্পদের সদ্ব্যবহার : সম্পদের সদ্ব্যবহার সমাজকর্মের অন্যতম ব্যবহারিক মূল্যবোধ। সম্পদের সদ্ব্যবহার বলতে সমাজে প্রাপ্ত বস্ত্তগত এবং অবস্ত্তগত সম্পদের সম্ভাব্য সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের সর্বাধিক কল্যাণ আনয়নকে বুঝায়। ব্যক্তিগত, দলগত এবং সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় বস্ত্তগত ও অবস্ত্তগত সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের প্রতি সমাজকর্মে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। সমাজকর্মে বিশ্বাস করা হয়, বাহ্যিক সাহায্যের মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী সমাধান এবং মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলা যায় না। ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির নিজস্ব সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের নিশ্চয়তা বিধানের ওপরই নির্ভর করে স্বনির্ভরতা। সমাজকর্ম অনুশীলনের ক্ষেত্রে সমাজের প্রাপ্ত বস্ত্তগত এবং অবস্ত্তগত (মানব) সম্পদের যথাযথ ও কার্যকর ব্যবহারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। স্বাবলম্বন অর্জনে প্রাপ্ত সম্পদের সদ্ব্যবহারের বিকল্প নেই।
পৃষ্ঠা ১৭১
সমাজকর্ম একটি সক্ষমকারী প্রক্রিয়া এতে ব্যক্তি, দল ও সমষ্টিকে এমনভাবে সাহায্য করা হয়, যাতে তারা নিজস্ব সম্পদ ও সামর্থ্যের সম্ভাব্য সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করতে সক্ষম হয়। এজন্য সমাজকর্মের বিশেষ মূল্যবোধ হিসেবে সম্পদের সদ্ব্যবহার স্বীকৃত।
১০. পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা : সমাজকর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পেশাগত মূল্যবোধ হলো পারস্পরিক সহনশীলতা এবং শ্রদ্ধাবোধ। পারস্পরিক সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ সুষ্ঠু সমাজ গঠন ও পরিচালনার অপরিহার্য শর্ত। যে সমাজের মানুষ সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধের গুণে গুণান্বিত নয়, সে সমাজ সুশৃঙ্খল হতে পারে না। কারো কথা বা আচরণ বিরক্তিকর ও আপত্তিকর হলেও তা সহ্য করার মত ধৈর্য অর্জন করাই সহনশীলতা। আর মানুষের সামাজিক পরিচিতি ও মর্যাদা অনুযায়ী সম্মান প্রদর্শনই হলো শ্রদ্ধাবোধ।
সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ মানুষের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমিত এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করে। সমাজে সহযোগিতামূলক এবং সমবায়িক মনোভাব সৃষ্টির নিয়ামক হলো পারস্পরিক সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ। সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পেশাগত সম্পর্ক। পেশাগত সম্পর্ক স্থাপনের ভিত্তিরচনা করে পারস্পরিক সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ। পারস্পরিক সহনশীলতা ও শ্রদ্বাবোধের মতো মানবিক গুণে গুণান্বিত না হলে সমাজকর্মীদের পক্ষে যথাযথভাবে সামাজিক ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয় না। সমাজকর্মী এবং সাহায্যপ্রার্থীর পারস্পরিক সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধের ওপর সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার সাফল্য নির্ভর করে। এজন্য সমাজকর্মের গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ হিসেবে পারস্পরিক সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ স্বীকৃত। সমাজকর্মীরা সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধের মতো মানবিক গুণাবলি বিকাশে মানুষকে সাহায্য করে।
পরিশেষে বলা যায়, সমাজকর্মের পেশাগত মূল্যবোধগুলো পেশাদার সমাজকর্মীদের সমস্যা সমাধানের দিক নির্দেশনা দান করে। এগুলোর যথাযথ অনুসরণের ওপর সমাজকর্ম অনুশীলনের সফলতা ও ব্যর্থতা বিশেষভাবে নির্ভর করে।
সমাজকর্মে মূল্যবোধগুলোর প্রায়োগিক তাৎপর্য
সাহায্যকারী পেশা হিসেবে সমাজকর্ম হলো সমস্যা সমাধানের সক্ষমকারী প্রক্রিয়া। এতে বিশেষ কতগুলো পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে মানুষকে সক্ষম করে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হয়। সমাজকর্মের মূল্যবোধগুলো সমাজকর্মীদের পেশাগত আচার-আচরণকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করে। সমাজকর্মের মূল্যবোধগুলো সামাজিক পরিবেশে মানুষকে বুঝতে, সমাজকর্ম অনুশীলনের মাধ্যমে উত্তম সেবা প্রদানে এবং পেশাগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বিশেষভাবে সাহায্য করে। সমাজকর্মের মূল্যবোধগুলোর প্রায়োগিক তাৎপর্যের উল্লেখযোগ্য দিক নিচে উল্লেখ করা হলো-
ক. সমাজকর্মের মূল্যবোধগুলো সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় সাহায্যপ্রার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করে।
খ. পেশাগত সম্পর্ক স্থাপনের মূলভিত্তি রচনা করে।
গ. সাহায্যপ্রার্থীর সুপ্ত ক্ষমতা ও প্রতিভা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে।
ঘ. সমাজকর্মের মূল্যবোধগুলোর যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে সমাজকর্মীরা সেবাগ্রহীতা ক্ষমতা ও সমস্যার যথাযথ মূল্যায়ন করে সমস্যা সমাধান পরিকল্পনা প্রণয়নে সক্ষম হন।
ঙ. সমাজকর্মের মূল্যবোধের যথাযথ অনুসরণ সেবাগ্রহীতাকে আত্মবিশ্বাসী ও আত্মপ্রত্যয়ী হতে সাহায্য করে।
চ. মানুষের মধ্যে পরনির্ভরশীল মানসিকতার পরিবর্তে স্বনির্ভর মানসিকতা গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করে।
পৃষ্ঠা ১৭২
ছ. সমাজকর্মীদের পেশাগত আচার-আচরণকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রণ করার নির্দেশনা দান করে।
জ. মানুষের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ সাধনে সহায়তা করে।
ঝ. প্রাপ্ত সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার সুষম বন্টনের পরিবেশ সৃষ্টি করে। ফলে সমাজের প্রতিটি সদস্য নিজেদের ক্ষমতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী স্বীয় অধিকার ভোগ করতে সক্ষম হয়। যা প্রাপ্ত সম্পদ ও সুযোগ সুবিধার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে।
পরিশেষে বলা যায়, সমাজকর্মের যথাযথ অনুশীলনের সাধারণ নির্দেশনা হলো সমাজকর্মের পেশাগত মূল্যবোধ। মূল্যবোধগুলো স্বীকৃত অবস্থায় থেকে সমাজকর্মের লক্ষ্যার্জনে প্রত্যক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আমেরিকার জাতীয় সমাজকর্মী সমিতি কর্তৃক গৃহীত সমাজকর্ম মূল্যবোধ
আমেরিকার জাতীয় সমাজকর্মী সমিতি সমাজকর্মের কতগুলো সাধারণ মূল্যবোধ গ্রহণ করেছে। সমাজকর্ম অনুশীলনের এসব সাধারণ মূল্যবোধগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো-
১. ব্যক্তির মূল্য ও মর্যাদা;
২. মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন;
৩. ব্যক্তির পরিবর্তন সাধন ক্ষমতার মূল্যায়ন;
৪. সেবাগ্রহীতার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার;
৫. গোপনীয়তা;
৬. মানুষকে তাদের প্রতিভা ও সম্ভাবনা উপলব্ধির সুযোগ প্রদান;
৭. সাধারণ মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের প্রচেষ্টা চালানো;
৮. সামাজিক পরিবর্তন এবং সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার;
৯. মৌল চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত সম্পদ ও সেবা প্রদানের প্রচেষ্টা;
১০. সুবিধাভোগীদের ক্ষমতায়ন;
১১. সমান সুযোগ-সুবিধা;
১২. বৈষম্য না করা;
১৩. মানব বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন;
১৪. অন্যের নিকট পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা প্রচারের ইচ্ছা;
উপর্যুক্ত মূল্যবোধগুলো সমাজকর্ম অনুশীলনে সমাজকর্মীদের পেশাগত দায়িত্ব ও আচরণের নির্দেশনা দান করে।
অনুশীলনী
রচনামূলক প্রশ্ন
১. সমাজকর্মের মূল্যবোধ বলতে কি বুঝ ? সমাজকর্মের মূল্যবোধগুলো কি কি ? সংক্ষেপে আলোচনা কর।
২. সমাজকর্মের অনুশীলনে সমাজকর্মের মূল্যবোধগুলোর প্রায়োগিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।
৩. সামাজিক মূল্যবোধ কাকে বলে ? সমাজকর্মের দার্শনিক মূল্যবোধ আলোচনা কর।
পৃষ্ঠা ১৭৩
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. সমাজকর্মের যেকোন পাঁচটি মূল্যবোধের নাম লিখ।
২. মূল্যবোধের একটি সংজ্ঞা দাও।
৩. সমাজকর্মের মূল্যবোধগুলোর প্রায়োগিক তাৎপর্য ও গুরুত্বের মধ্য থেকে যে কোন দুইটি উল্লেখ কর।
৪. মূল্যবোধ কি ?
৫. ব্যক্তি মর্যাদার স্বীকৃতি বলতে কি বুঝায় ?
৬. শ্রমের মর্যাদা বলতে কি বুঝায় ?
৭. স্বনির্ভরতা বলতে কি বুঝায় ?
৮. ব্যক্তি স্বাধীনতা কি ?
৯. সামাজিক দায়িত্ববোধ বলতে কি বুঝায় ?
১০. সম্পদের সদ্ব্যবহার কি ?
১১. পারস্পরিক সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধের প্রয়োজন কি ?
১২. আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার কি ?