পৃষ্ঠা ১৭৪
অষ্টম অধ্যায়
শিল্প বিপ্লব

বিপ্লব কি?
শিল্প বিপ্লবের স্বরূপ উপলব্ধির জন্য ‘বিপ্লব’ প্রত্যয়টির পটভূমিকার প্রতি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। মানব সমাজের চিরাচরিত অবস্থানসমূহের ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী মৌলিক পরিবর্তন ও পুনর্গঠনই বিপ্লব। জীবনের কোন ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন অংশের পরিবর্তনের নাম বিপ্লব নয়। কোন এক বিশেষ সরকারের পতন এবং নতুন সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়া বিপ্লব নয়।
বিপ্লবের যুক্তিসঙ্গত অর্থ হলো এক আকস্মিক ও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন, সমাজে ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে এক বিরাট ব্যতিক্রম। আধুনিক সমাজতত্ত্ববিদদের মতে, ‘‘সমাজ জীবনের বিভিন্ন দিককে পুনর্গঠিত করার নামই বিপ্লব।’’ সামরিক অভ্যুত্থান, গণবিক্ষোভ ও বিদ্রোহকে সামাজিক বিপব নামে আখ্যায়িত করা এক অর্থে নিরর্থক। আলফ্রেড মিউসেল -এর মতে, বিপ্লবের নিগূঢ় তাৎপর্য হচ্ছে এটি কেবল সামাজিক কাঠামোর ক্ষেত্রেই একটা প্রচন্ড ও গভীর সংশোধন বা পরিবর্তন এনে দেবে না; বরং বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক বিপুল পরিবর্তন সাধন করবে। সুতরাং বলা যায়, মানব সমাজের চিরাচরিত অবস্থাসমূহের সামগ্রিক কল্যাণমুখী, ব্যাপক ও স্থায়ী মৌলিক পরিবর্তন বা নবরূপায়নই বিপ্লব। যা সমাজের সামগ্রিক দিকের বিপুল পরিবর্তন আনয়ন করে।
বিপ্লবের প্রকাশ আকস্মিক হলেও তা মানব সমাজের কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। প্রত্যেক বিপ্লবের পেছনে দীর্ঘদিনের প্রস্ত্ততি লোকচক্ষুর অন্তরালে সক্রিয় থাকে। মাটির নিচে যুগ যুগান্তরের রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ফলে যেমন গলিত পদার্থসমূহ বিস্ফোরক হয়ে আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ বা ভূকম্পনের সৃষ্টি হয়, তেমনি প্রতিটি বিপ্লবের পশ্চাতে থাকে দীর্ঘ দিনের প্রস্ত্ততি, প্রচেষ্টা ও প্রক্রিয়া।
শিল্প বিপ্লব কি?
শিল্প বিপ্লব প্রত্যয়টির নামকরণ করেছিলেন প্রখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক এরনল্ড টয়েনবী। শিল্প বিপ্লব কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। 1এটি হলো অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে সংঘটিত সুদূরপ্রসারী কতগুলো যুগান্তকারী পরিবর্তনের সমন্বিত রূপ। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ইংল্যান্ড এবং পরে অন্যান্য দেশে উৎপাদন ব্যবস্থায় যে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে, তার প্রভাবে একটা গোটা যুগের অবসান হয়ে অন্য একটা নতুন যুগের আবির্ভাব ঘটে। ঐতিহাসিক টয়েনবি একে শিল্প বিপ্লব নামে আখ্যায়িত করেছেন।
জেরি এবং জেরি প্রণীত কলিন্স সমাজবিজ্ঞান অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী, ‘‘শিল্প বিপ্লব হলো পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত এবং সামাজিক ক্ষেত্রের ব্যাপক পরিবর্তন, যা ১৭৬০ সাল থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে সংঘটিত হয়। যার ফলে ইংল্যান্ডে নতুন যান্ত্রিক ও প্রযুক্তিভিত্তিক অর্থব্যবস্থার সূচনা হয়।
প্রফেসর উইলিয়াম এর মতে, “অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষাংশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্রুত বিকাশ এবং উৎপাদনখাতে সেগুলোর প্রয়োগের ফলে জীবনযাপন পদ্ধতিতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা দেয়, তাকে শিল্প বিপ্লব বলা হয়।।
দ্যা নিউ এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা-তে উল্লিখিত সংজ্ঞানুযায়ী, ‘‘শিল্প বিপ্লব হলো কৃষিভিত্তিক ও হস্তশিল্প নির্ভর অর্থব্যবস্থা থেকে শিল্প ও যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে শুরু হয় এবং সেখান থেকে বিশ্বের অন্যান্য অংশে বিস্তার লাভ করে।’’
পৃষ্ঠা ১৭৫
মূলত ‘‘১৭৮০ সাল থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে একটা সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘসময় ব্যাপী সামাজিক বিপ্লব বিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং চিন্তা ধারায় যে আমূল পরিবর্তন বয়ে আনে, তাকেই অর্থনীতি ও ইতিহাসের ভাষায় শিল্প বিপ্লব বলা হয়। এ ধরনের পরিবর্তন মানব সভ্যতার ইতিহাসে পূর্বে কখনও দেখা যায়নি বলেই একে শিল্প বিপ্লব বলে বিশেষিত করা হয়।’’
নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তি আবিষ্কার এবং উৎপাদন, যোগাযোগ ও যাতায়াত ক্ষেত্রে আবিষ্কারগুলোর সফল প্রয়োগের ফলে ইংল্যান্ডের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। যার প্রভাবে ইউরোপের অন্যান্য দেশে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রয়োগে সমাজ ব্যবস্থায় দ্রুত ও সর্বাত্মক পরিবর্তন সাধিত হবার ফলে একে শিল্প বিপ্লব নামে আখ্যায়িত করা হয়।
শিল্প বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য
শিল্প বিপ্লবের শিল্প-সামাজিক গতি প্রকৃতি ও প্রভাব বিশ্লেষণ করলে নিচের বৈশিষ্ট্যগুলো পরিলক্ষিত হয়-
১. উৎপাদনে প্রাকৃতিক শক্তির ব্যবহার : শিল্প বিপ্লব হলো মানুষের বিরাট প্রাকৃতিক শক্তি ভান্ডারকে আয়ত্ত এবং ব্যবহার করার একটি বৈজ্ঞানিক ঘটনা। এর ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মনুষ্য ও পশু শক্তির পরিবর্তে গ্যাস, তেল, কয়লা, বিদ্যুত প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
২. যান্ত্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার সূচনা : শিল্প বিপ্লব গৃহকেন্দ্রিক ক্ষুদ্রাকৃতির উৎপাদন প্রক্রিয়ার পরিবর্তে, বৃহৎ আকারে যান্ত্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার সূচনা করে।
৩. সামাজিক সম্পর্কের বিন্যাস : উৎপাদন পদ্ধতির আমূল পরিবর্তনের ফলে সমাজে নতুন নতুন সামাজিক সম্পর্ক ও সামাজিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়।
৪. পুঁজিবাদের বিকাশ : শিল্প বিপ্লব পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ ঘটায়। সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থাকে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করে। শিল্প বিপ্লবের ফলে কৃষি উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে শিল্প উৎপাদন পদ্ধতি গড়ে উঠে। সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্ক ও ভূমি দাসের স্থলে পুঁজিবাদী উৎপাদক সম্পর্ক এবং শিল্প মালিক ও শ্রমিক সম্পর্কের উদ্ভব ঘটায়।
৫. নতুন সভ্যতার সূচনা : শিল্প বিপ্লব মানব সভ্যতাকে সরাসরি সীমা রেখা টেনে প্রাক-শিল্প যুগ এবং শিল্প-বিপ্লবোত্তর যুগ-এ দু’ভাগে ভাগ করে দেয়।
৬. জীবনধারার পরিবর্তন : শিল্প বিপ্লব উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনযাত্রার ব্যাপক পরিবর্তন আনে এবং সমাজ জীবনকে বৈচিত্র্যময় করে তুলে। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়। উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ভিত্তিক নতুন নতুন শিল্পপণ্য মানুষের আরাম আয়েসের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
৭. নগর সভ্যতার প্রসার : শিল্প বিপ্লব নগরায়নের ক্ষেত্রেও বিপ্লব বয়ে আনে। এতে নগরের প্রসার এবং নগর এলাকায় জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
মূলত শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে উৎপাদন পদ্ধতি ও উৎপাদন এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অভুতপূর্ব যে পরিবর্তন এসেছে, তার মধ্যে শিল্প বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য নিহিত।
সমাজ জীবনে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব
শিল্প বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী ও দীর্ষমেয়াদী প্রভাব মানুষের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও চিন্তাধারার জগতে আমূল পরিবর্তন বয়ে আনে। এর প্রভাবে বদলে যায় পৃথিবীর মৌল কাঠামো এবং মানুষের জীবন প্রণালীতে আসে বিরাট এক ভিন্নতা। শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে উৎপাদন ও বন্টনের ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়, তা মানব সভ্যতা ও সামাজিক জীবনের রূপ বদলে দেয়। প্রাক-শিল্পসমাজ এবং শিল্প-বিপ্লবোত্তর সমাজের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করলে, শিল্প বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠে।
সমাজ জীবনে শিল্প বিপ্লবের প্রভাবকে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক এ দু’টি দৃষ্টিকোণ হতে বিশ্লেষণ করা হয়।
আর্থ-সামাজিক জীবনে শিল্প বিপ্লবের ইতিবাচক প্রভাব
আর্থ-সামাজিক জীবনে শিল্প বিপ্লবের প্রধান ইতিবাচক প্রভাবগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো-
পৃষ্ঠা ১৭৬
১. শিল্পায়ন ও বৃহদাকারের উৎপাদন ব্যবস্থা : শিল্প বিপ্লব শিল্পায়নের সূচনা করে, যা উৎপাদন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন বয়ে আনে। প্রাকৃতিক শক্তি চালিত যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি প্রবর্তনের ফলে গৃহকেন্দ্রিক ক্ষুদ্রাকৃতির উৎপাদনের পরিবর্তে বৃহদাকারে উৎপাদন ব্যবস্থা চালু হয়। এতে ক. উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি এবং উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায়, খ.
উৎপাদনের অনিশ্চয়তা দূর হয়, গ. মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ও ভোগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং ঘ. উৎপাদিত দ্রব্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। ফলে মানুষ সহজে তাদের প্রয়োজন পূরণের সুযোগ লাভ করে।
২. মানবকল্যাণে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার : প্রাক-শিল্প যুগে দীর্ঘদিন যাবত গাছ-পালা, পশু-পাখি, কৃষিদ্রব্য মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আহার ও শক্তি যোগাত। শিল্প বিপ্লব মানুষের সামনে বিরাট এক নতুন দিগন্ত উম্মোচিত করে। মনুষ্য ও পশু শক্তির পরিবর্তে কয়লা, তেল, বিদ্যুৎ, পরমাণু ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তিকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মানুষ নিজেদের উন্নয়ন ও কল্যাণে লাগাবার কৌশল আবিষ্কার করে। এজন্য বলা হয় -শিল্প বিপ্লব মানুষের বিরাট প্রাকৃতিক শক্তি ভান্ডারকে আয়ত্ত করার এবং তা নিশ্চিতভাবে ব্যবহার করার একটি সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক ঘটনা।
৩. যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন : শিল্প বিপ্লবের ফলে সনাতন যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তে যান্ত্রিক যোগাযোগ পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়। সনাতন যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়। ফলে ভৌগলিক দূরত্ব হ্রাস পায় এবং জনজীবন সহজ, দ্রুততর ও আরামপ্রদ হয়। আন্তুর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। এতে মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নত এবং শ্রমের গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
৪. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি : শিল্প বিপ্লবের ফল হলো শিল্পায়ন ও নগরায়নের প্রসার। শিল্পায়নের ফলে বহুমুখী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। শিল্পভিত্তিক পেশার উদ্ভব হবার ফলে শ্রমের চলনশীলতা এবং মাথাপিছু শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। পেশাগত দিক হতে কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পায়। শিল্পের স্থানীয়করণের ফলে নগরায়ণ ত্বরান্বিত হয়। শিল্প নগরের ক্রমবর্দ্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা পূরণের প্রয়োজনে নতুন নতুন বাণিজ্যিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। এতে কর্ম সংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়। পেশা ও বৃত্তির বহুমুখীতা শিল্প বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘমেয়াদী ইতিবাচক ফল।
৫. পেশার পরিবর্তন ও সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ : শিল্প বিপ্লবের ফলে বংশানুক্রমে আরোপিত কৃষি পেশার পরিবর্তন ঘটে। শিল্প ভিত্তিক সমাজে মানুষ সহজেই পেশা পরিবর্তনের সুযোগ পায়। এতে মানুষের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এছাড়া শিল্প বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট শ্রমবিভাগ, শ্রমিকদের দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুসারে কাজ পেতে সাহায্য করে।
৬. শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন : শিল্প বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট শ্রম বিভাগ, শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতা এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে। ১৮৭০ সালে দু’জন শ্রমিক একটি ক্রেনের সাহায্যে যে পরিমাণ পাথর উঠাতে পারতো, ঠিক সে পরিমাণ পাথর উঠাতে যন্ত্রের প্রয়োগের পূর্বে ৩৬০ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হতো। পুরানো পদ্ধতিতে একজন কারিগর দিনে তিনজোড়া জুতো বানাতে পারে। আর নতুন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে একই কারিগর ৩০০ জোড়া জুতো বানাতে পারে। একটি শিল্প সমৃদ্ধ সমাজের একজন শ্রমিক তার দু’মাসের আয় দিয়ে সারা বছর আহার ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে।
শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন প্রসঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানী অগবার্ন এবং নিমকফ বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতি সাধারণ শ্রমিক যে সব সুযোগ সুবিধা পায়, প্রাক-শিল্পযুগে রাজন্যবর্গ তার অনেক কিছু পেতেন না। তখন রাজাদের মোটরগাড়ী, রেডিও, রেফ্রিজারেটর ছিল না।
৭. প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের প্রচলন : শিল্প বিপ্লব মানুষকে বিরাট প্রাকৃতিক সম্পদ ও শক্তি ভান্ডারকে নিজেদের কল্যাণে নিশ্চিতভাবে ব্যবহারের সুযোগ এনে দেয়। এতে মানুষের মৌল চাহিদা পূরণের প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা দূর হয়। উৎপাদন, যাতায়াত ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক শক্তি ব্যবহার শুরু হয়।
পৃষ্ঠা ১৭৭
৮. আধুনিক সমাজকল্যাণের বিকাশ : শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সৃষ্ট বহুমুখী জটিল সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে, সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত সমাজসেবা কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক সমাজকল্যাণের বিকাশ ঘটে। এজন্য বলা হয় শিল্প বিপ্লবই বিংশ শতাব্দীতে আধুনিক সমাজকল্যাণের প্রয়োজন সৃষ্টি করে। শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সৃষ্ট
সমস্যা মোকাবেলায় শিশু কল্যাণ, শ্রম কল্যাণ, অপরাধ সংশোধন, চিকিৎসা সমাজকর্ম, সামাজিক নিরাপত্তা প্রভৃতি নতুন নতুন কার্যক্রমের বিকাশ ঘটে। সমাজকল্যাণের পেশাগত পরিবর্তন শিল্প বিপ্লবের ফল।
৯. নগরায়ণ ও নগর সভ্যতার বিকাশ : শিল্প বিপ্লবের ফলে বড় বড় নগরের পত্তন হয়। শিল্পের স্থানীয়করণের প্রভাবে নগরায়ণ প্রক্রিয়া দ্রুত হয়। গ্রামীণ জনগণ ক্রমান্বয়ে শহরে স্থানান্তরিত হয়। এতে নগর সভ্যতার বিকাশ ঘটে। ১৭৯০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লোকসংখ্যার ৯৭ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে অথবা অনধিক আট হাজার জনসংখ্যা বিশিষ্ট এলাকায় বাস করতো। ১৯৫১ সালে সেখানে প্রতিটি পঞ্চাশ হাজারের অধিক জনসংখ্যা বিশিষ্ট ১৫৮ টি শহর এবং ১৬৮ টি নগর কেন্দ্রিক এলাকা ছিল। ১৯৫৫ সালে ইংল্যান্ডের জনসংখ্যার মাত্র ২০ শতাংশ গ্রামে বাস করতো।
১০. বাণিজ্যিক অর্থনীতির সূচনা : বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ হতে শিল্প বিপ্লবের দু’টি দিক চিহ্নিত করা যায়। একটি হলো বাণিজ্যিক বিপ্লব এবং অন্যটি হলো সামাজিক বিপব (ঝড়পরধষ ৎবাড়ষঁঃরড়হ)। শিল্প বিপ্লবের পূর্বে মানুষের প্রয়োজন পূরণের নিমিত্তে অর্থনীতি পরিচালিত হতো। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর বাণিজ্যিক অর্থনীতির সূচনা হয়। শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে বদ্ধ অর্থনীতি, বাণিজ্যিক অর্থনীতির দিকে মোড় নেয়।
সার্বিক দৃষ্টিকোণ হতে বলা যায়, শিল্প বিপ্লব মানব জীবনে অন্ধকার, বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণের সুযোগ এনে দিয়েছে। যান্ত্রিক প্রশিক্ষণ, শিল্প-কলা, প্রকাশনা শিল্প, শিক্ষার নতুন নতুন পদ্ধতি, যান্ত্রিক যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা মানব সভ্যতাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়েছে।
সমাজে শিল্প বিপ্লবের নেতিবাচক প্রভাব
শিল্প বিপ্লবের সার্বিক নেতিবাচক প্রভাব বর্ণনা প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী নিমকফ এবং অগবার্ন বলেছেন, শিল্প বিপ্লবের কারণে যে শিল্পায়ন হয়েছে, সমাজে তার প্রভাব অবিমিশ্র আশীর্বাদ নয়। তা মানুষের সাথে মানুষের, মানুষের সাথে পরিবারের, পরিবারের সাথে সমাজের , শহরের সাথে গ্রামের নানারকম মানবীয় পরিবর্তন সূচনা করে। শিল্প বিপ্লব কুটির শিল্পকে ধ্বংস করেছে, যৌথ পরিবারের ভাঙ্গন সূচিত করেছে, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটিয়েছে।
সমাজ জীবনে শিল্প বিপ্লবের নেতিবাচক প্রভাবগুলো নিচে উল্লেখ করা হলোঃ
১. অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা : শিল্প বিপ্লবের ফলে যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির সূচনা হয়। এতে গৃহকেন্দ্রিক কুটির শিল্প ধ্বংসের ফলে, অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। আবার প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে অনেক শ্রমিক, যান্ত্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণে ব্যর্থ হয়ে বেকারে পরিণত হয়। ১৮৭০ সালে দুজন লোক একটি ক্রেনের সাহায্যে যে পরিমাণ পাথর উঠাতে পারতো, ঠিক সে পরিমাণ পাথর উঠাতে শিল্প বিপ্লবের পূর্বে ৩৬০ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হতো। সনাতন পদ্ধতিতে একজন কারিগর দিনে তিন জোড়া জুতো বানাতে পারতো। আর নতুন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেই একই কারিগর ৩০০ জোড়া জুতো বানাতে পারতো। এভাবে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে আর্থিক নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়।
২. পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন ও শিশু এবং প্রবীণদের নিরাপত্তাহীনত : শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সমাজের মৌলিক প্রতিষ্ঠান পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে পরিবর্তনের সূচনা হয়। যুগের চাহিদা অনুযায়ী যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার গড়ে উঠে। ফলে বৃদ্ধ, অক্ষম, শিশুদের নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। শিল্প বিপ্লবের পূর্বে যৌথ পরিবার তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতো।
শিল্প বিপ্লবের ফলে সমাজ জীবনে যে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটেছে, সে পরিবর্তনের প্রভাব থেকে পরিবার মুক্ত নয়। শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে শিল্পায়ন দ্রুত হয়, যাতে শ্রমের গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। কর্মসংস্থানের আশায় শ্রমজীবি মানুষ গ্রাম ছেড়ে
পৃষ্ঠা ১৭৮
শহরে বা শিল্পাঞ্চলে গমন করে। বাসস্থানের স্বল্পতা, স্বল্প মজুরী এবং নির্দিষ্ট আয় ইত্যাদি কারণে পরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে শহরে বসবাস করা সম্ভব হয় না। ফলে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার সৃষ্টি হয়। ফার্ডিনেন্ড লুন্ডবার্গ তাঁর “দ্যা কামিং ওয়ার্ল্ড ট্রান্সফরম্যাশন গ্রন্থে বলেছেন, পরিবার সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হবার মুখে। আলভিন টফলার ১৯৭০ সালে সর্বাধিক বিক্রিত তাঁর “ফিউচার শক” গ্রন্থে বলেছেন, ‘‘শিল্পায়ন সমাজকে এতবেশি বেগবান এবং চলিঞ্চু করে তুলে, যা লোকজনের
ভৌগলিক সচলতা বৃদ্ধি পাওয়া অনিবার্য হয়ে উঠে। স্বভাবতই বৃহদায়তন পরিবার এরূপ সচলতার পথে অন্তরায়। সুতরাং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যৌথ পরিবার ভেঙ্গে দম্পতি কেন্দ্রিক পরিবারে পরিণত হয়।
৩. পেশাগত দুর্ঘটনা বৃদ্ধি : শিল্প বিপ্লবের ফলে যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতিতে শ্রমিকদের ঝুকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হতে হয়। এতে পেশাগত দূর্ঘটনার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। পেশাগত দুর্ঘটনার শিকার হয়ে শ্রমিক শ্রেণী অকাল মৃত্যু, বিকলাঙ্গতা ও কর্মক্ষমতা হারিয়ে আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। প্রাক শিল্প যুগে কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা খুবই কম ছিল। শিল্প বিপ্লবের অব্যবহিত পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন এক সময় ছিল, যখন প্রতি বছর প্রতি হাজারে ৩৫ হতে ৪০ জন শ্রমিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতো। বছরে প্রায় এক কোটি দুর্ঘটনা সংঘটিত হতো, যাতে প্রায় তিন লাখ শ্রমিক মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
৪. স্বাস্থ্যহীনতা এবং পেশাগত সংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব : শিল্প বিপ্লব যে যন্ত্রের আবিষ্কার করে সে যন্ত্র চালাতে গিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের প্রভাবে শ্রমিক শ্রেণী বিভিন্ন ধরনের পেশাগত সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। শিল্পায়ন পেশাগত দুর্ঘটনা ও সংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটায়। শিল্পায়নের ফলে শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয় বলে পেশাগত দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অকাল মৃত্যু, বিকলাঙ্গতা ও কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ প্রসঙ্গে মনীষী রেডক্লীফ বলেছেন, ‘‘শ্রম বাঁচানোর যে যন্ত্র আবিষ্কার হলো, সেটি চালাতে শ্রমিকদের নাক দিয়ে প্রতিদিন যাচ্ছে প্রচুর কয়লার ধোঁয়া, জীবনী শক্তি হচ্ছে ক্ষয়।’’ শিল্প বিপ্লবের পূর্বে এরূপ পেশাগত সংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ছিল না বললেই চলে।
৫. শিশুদের নিরাপত্তাহীনতা : শিল্প বিপ্লবের ফলে যে যন্ত্রের আবিষ্কার হয়, তাতে শিশু শ্রমিকদের নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়। যা শিল্প বিপ্লবের আগে সম্ভব ছিল না। ১৭৯৫ সালে ডঃ এইকেন লিখেছেন, ‘‘যন্ত্রের আবিষ্কার শ্রম বাঁচিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে পরিবার থেকে শিশুকে।’’
শিল্পপতিরা দরিদ্র দেশগুলো হতে পেশাদার দালালের মাধ্যমে নাম মাত্র খাওয়ার বিনিময়ে শিশু শ্রমিক নিয়ে আসত। শিশু কিশোরদের দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করানো হতো। ক্রীতদাসের মত প্রহার করা হতো। অস্বাস্থ্যকর কারখানাগুলোতে শিশু শ্রমিকরা গাদাগাদি করে পশুর মত রাত্রি যাপন করতো। সুতরাং শিল্প বিপ্লব শিশুদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে।
৬. পরস্পর বিরোধী শ্রেণীর উদ্ভব : শিল্প বিপ্লবের ফলে সমাজে নতুন শ্রেণী সম্পর্ক গড়ে উঠে। ভূ-স্বামীদের স্থান দখল করে পুঁজিপতি ও শিল্পপতিগণ। সমাজে শিল্প-শ্রমিক ও মজুরদের আবির্ভাব ঘটে। পুঁজিপতিদের শোষণের ফলে শ্রেণী বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। ফলে সমাজে স্বার্থকেন্দ্রিক পরস্পর বিরোধী শ্রেণীর উদ্ভব হয়। যা সামাজিক সংঘাত ও দ্বন্দ্বের সম্ভাবনাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করে।
৭. সামাজিক সমস্যার জটিলতা ও বহুমুখীতা : প্রাক-শিল্প যুগে সমাজব্যবস্থা ছিল সহজ সরল। তখন মানুষের সমস্যা ছিল অর্থকেন্দ্রিক। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের ফলে এর সাথে যুক্ত হয় সামাজিক ও মনস্তাত্বিক সমস্যা। এতে সামাজিক সমস্যা বহুমুখী ও জটিল রূপ ধারণ করে। সমাজের বহুমুখী আর্থ-সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির ক্ষেত্রে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী।
৮. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা : শিল্প বিপ্লবের ফলে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। এতে ভৌগলিক দূরত্ব হ্রাস পেলেও সামাজিক দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। শিল্প ও শহরাঞ্চলে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ হতে আগত বিভিন্ন পেশার ও মর্যাদার লোক একত্রে বসবাস করে। তাদের মধ্যে মানসিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য বিদ্যমান থাকে। ফলে তারা একত্রে এমনকি একই বিল্ডিংয়ে বসবাস করা সত্বেও সামাজিক দিক হতে সম্পর্কহীন বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করে। বিপদে-আপদে পারস্পরিক সাহায্য ও সহানুভূতির মনোভাব থাকে না। যার প্রভাবে সামাজিক বন্ধনের শিথিলতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়।
৯. অপরাধ প্রবণতা : অপরাধ একধরনের ক্ষণস্থায়ী অস্বাভাবিক আচরণ, যা সমাজ ও প্রচলিত আইন কর্তৃক স্বীকৃত নয়। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাবে মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা দেখা দেয়। শিল্প বিপ্লবোত্তর শিল্পায়ন ও শহরায়নের প্রভাবে সৃষ্ট প্রতিকূল পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বিভিন্নভাবে অপরাধ প্রবণতা সৃষ্টি করে।
শহর ও শিল্পাঞ্চলের গ্রামীণ সমাজের মতো পারিবারিক ও সামাজিক পরিচিতি এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর হয় না। এমতাবস্থায় সামাজিক ও পারিবারিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে মানুষ সহজে নানারকম অসামাজিক ও অপরাধমূলক কার্যকলাপে নিয়োজিত হতে পারে।
১০. গৃহায়ন ও বস্তি সমস্যা : শিল্পায়ন ও শহরায়নের প্রভাবে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর মধ্যে গৃহায়ন সমস্যা অন্যতম। গৃহায়ন সমস্যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে গড়ে উঠে বস্তির মানবেতর জীবন ব্যবস্থা। শিল্প ও শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থানের আশায় যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়, সেহারে গৃহায়ন হয় না। ফলে বাধ্য হয়ে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবি মানুষ বস্তির মানবেতর পরিবেশে আশ্রয় গ্রহণ করে।
পৃষ্ঠা ১৭৯
সমাজকর্মের বিকাশে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব
সমাজকর্মের মূল উৎস হিসেবে শিল্প বিপ্লবকে চিহ্নিত করা হয়। শিল্প বিপ্লব যেমন মানব সভ্যতার সামগ্রিক রূপ বদলে দেয়, তেমনি পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, সনাতন সমাজসেবা কার্যক্রমকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার প্রয়োজন সৃষ্টি করে, যা হতে পেশাদার সমাজ কর্মের উদ্ভব হয়। মানব সভ্যতার মতো সমাজকল্যাণ ধারাকেও শিল্প বিপ্লব দু’ভাগে ভাগ করেছে। একটি মানবতাবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসনের ভিত্তিতে পরিচালিত প্রাক শিল্প যুগের ঐতিহ্যগত সমাজকল্যাণ ধারা। আর অন্যটি হলো শিল্প বিপ্লবোত্তর সমাজব্যবস্থার জটিল সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনে উদ্ভূত পেশাদার সমাজকল্যাণ তথা সমাজকর্মের ধারা। সমাজকর্মের বিকাশে শিল্প বিপ্লবের প্রভাবের বিশেষ দিকগুলো এখানে উল্লেখ করা হলো-
১. বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজকল্যাণ দর্শনের উদ্ভব : শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এ পরিবর্তনের ঢেউ মানুষের চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। শিল্প বিপ্লব উৎপাদন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনয়নের সঙ্গে সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সূচনা করে। যেমন শ্রমিক-মালিক বিরোধ, শিল্প শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা, পেশাগত দুর্ঘটনা, বাসস্থান সমস্যা, বসিত্ম ও নগর সমাজের প্রসার, নতুন নতুন সামজিক শ্রেণীর উদভব, মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব প্রভৃতি।
শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সৃষ্ট পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহ্যগত ও গতাণুগতিক সেবা ব্যবস্থা অনেকটা অকার্যকর এবং অপ্রতুল হয়ে পড়ে। প্রয়োজন দেখা দেয় সমস্যা ও সমাজের চাহিদাভিত্তিক সেবা ব্যবস্থা। উদ্ভব হয় নতুন চাহিদাভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের সেবা কার্যক্রম। এভাবে শিল্প সমাজের জটিল ও বহুমুখী সমস্যা সমাধানের তাগিদে সমাজকল্যাণে ধর্মীয় এবং মানবপ্রেমের আদর্শের চেয়ে মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আদর্শের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়।
২. সমস্যা সমাধানে বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ : শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সমাজকাঠামো জটিল আকার ধারণ করে। ফলে সামাজিক সমস্যাগুলো প্রকৃতিগত দিক হতে জটিল হয়ে উঠে। শিল্প বিপ্লবের পর অর্থনৈতিক সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয় সামাজিক, মানসিক, নৈতিক এবং নিরাপত্তাজনিত সমস্যা। পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের ব্যর্থতাজনিত কারণে বহুমুখী জটিল সমস্যা সৃষ্টি হয়। এসব জটিল ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বহুমুখী সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে, ধর্মীয় অনুশাসন ও মানবিক আদর্শভিত্তিক সমাজসেবার পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিভিত্তিক সমাজসেবা কার্যক্রমের প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে সামাজিক সমস্যা বিশ্লেষণ ও মোকাবেলায় সমাজ বিজ্ঞানীদের মধ্যে বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে।
৩. বিজ্ঞানসম্মত সুসংগঠিত সমাজসেবার বিকাশ : শিল্প-বিপ্লবোত্তর বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সুসংগঠিত ও সুপরিকল্পিত সামজকল্যাণ ধারার উদ্ভব হয়। মনীষী টিমস্ যথার্থই বলেছেন, ‘আধুনিক সমাজকর্ম, আধুনিক সমাজ ব্যবস্থারই ফল। ধর্মীয় অনুপ্রেরণা ও মানবতাবোধের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। আধুনিক রাষ্ট্রে যারা সমাজসেবার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে, তারা সেগুলো নাগরিক অধিকার হিসেবেই ভোগ করছে। তারা কারো দয়া বা করুণার পাত্র নয়।’’ শিল্প বিপ্লবই আধুনিক সমাজকল্যাণের প্রয়োজন সৃষ্টি করেছে। শিল্প সমাজের প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতেই সমাজকল্যাণের নতুন নতুন ধারণার উদ্ভব হয়েছে। ধর্মীয় অনুশাসন ও মানবতাবোধের অনুপ্রেরণায় সংগঠিত দানশীলতা শিল্প বিপ্লবের পর পর্যায়ক্রমে বৈজ্ঞানিক দানশীলতায় পরিণত হয়ে সমাজকর্ম পেশার বিকাশ ঘটায়।
৪. সামগ্রিক উন্নয়ন ও স্বাবলম্বনের প্রতি গুরুত্বারোপ : শিল্প বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট সমস্যার মোকাবেলা করতে গিয়ে সাময়িক ও স্বাবলম্বন নীতি বর্জিত এলাকাভিত্তিক সমাজসেবা কার্যক্রমের পরিবর্তে সর্বজনীন কল্যাণ, সামগ্রিক উন্নয়ন এবং স্বাবলম্বন নীতির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত সমাজকল্যাণের সূচনা হয়। প্রাক-শিল্প যুগের প্রতিকারমূলক সামাজকল্যাণ ধারার সঙ্গে প্রতিরোধ এবং উন্নয়নমূলক সমাজকল্যাণ ধারণার প্রসার ঘটে।
৫. পদ্ধতিগত সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য অর্জন : শিল্প-বিপ্লবোত্তর জটিল সামাজিক সমস্যার মোকাবেলা করতে গিয়ে সমাজকল্যাণে বিশেষ কতগুলো পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়। ব্যক্তি, দল ও সমষ্টিগত পর্যায়ে সৃষ্ট সমস্যার প্রকৃতিগত পার্থক্যের
পৃষ্ঠা ১৮০
পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন সমাধান কৌশল প্রয়োগের প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে সমাজকল্যাণ পদ্ধতিগত সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য অর্জনে সক্ষম হয়।
৬. সমাজকল্যাণের পেশাদারী মর্যাদা অর্জন : শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সমাজকল্যাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হচ্ছে এর পেশাদারী মর্যাদা অর্জন এবং প্রায়োগিক সামাজিক বিজ্ঞানের স্বীকৃতি লাভ। শিল্প বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট জটিল ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত সমস্যা সমাধানকল্পে সমাজকল্যাণে পেশাগত শিক্ষা কার্যক্রমের সূত্রপাত ঘটে। শিল্প বিপ্লব সনাতন সমাজকল্যাণ ধারাকে সংগঠিত করে প্রাতিষ্ঠানিক এবং পদ্ধতিগত ধারায় রূপান্তরিত করেছে।
৭. বিশেষ ধরনের কল্যাণমূলক কর্মসূচির উদ্ভব : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাবে সংঘটিত শিল্প বিপ্লব মানুষের জীবন ধারার মধ্যে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন সাধন করছে। অব্যাহত পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন বহুমুখী চাহিদা। যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমাজসেবার ক্ষেত্রে আসছে শিশুকল্যাণ, পরিবারকল্যাণ, ডে-কেয়ার, সামাজিক নিরাপত্তা,, প্রবীণ কল্যাণ, অপরাধ সংশোধন ইত্যাদি কর্মসূচি।
আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত সমাজকল্যাণের ঐতিহাসিক পটভূমি আলোচনা করলে স্পষ্ট হয়ে উঠে শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সৃষ্ট জটিল সামাজিক সমস্যা মোকাবেলার প্রয়োজনে আধুনিক সমাজকল্যাণের উদ্ভব। শিল্প বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট সমস্যাদির জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মীয় অনুশাসন এবং মানবিক দর্শনের ভিত্তিতে পরিচালিত সমাজসেবা কার্যক্রম অপর্যাপ্ত বলে প্রতীয়মান হওয়ায় সুপরিকল্পিত এবং সুসংগঠিত সমাজসেবার প্রয়োজন অনুভূত হয়, যার ফলে আধুনিক সমাজকল্যাণের উদ্ভব।
সমাজকর্ম শিক্ষার বিকাশে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব
যে কোন পেশার অপরিহার্য উপাদান হলো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন ছাড়া পেশার পরিপূর্ণতা আসে না।
সমাজকর্ম শিক্ষা হলো সমাজকর্মীদের পেশাগত অভিজ্ঞতা অর্জন এবং প্রস্ত্ততি গ্রহণের আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ, যাতে প্রশিক্ষানার্থী পেশাগত ভূমিকা পালনের তাত্ত্বিক জ্ঞান ও ব্যবহারিক অনুশীলন দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব ছিল সুদুরপ্রসারী ও দীর্ঘমেয়াদী। শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সৃষ্ট সামাজিক, আর্থিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মানসিক প্রভৃতি বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি হয়, যেগুলো মোকাবেলার প্রয়োজনে পেশাদার সমাজকর্ম শিক্ষার প্রয়োজন অনুভূত হয়। এজন্য শিল্প বিপ্লবকে পেশাদার সমাজকর্মের মতো পেশাগত শিক্ষারও মূল উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
শিল্প বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী প্রভাব মানুষের চিন্তা ধারার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন বয়ে আনে। মানুষ হয়ে উঠে যুক্তিবাদী, বৈজ্ঞানিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। ফলে মানুষ সমস্যাকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যায়- এসময়ের মধ্যে সমাজকর্ম সুসংগঠিত সাহায্য কার্যক্রম হতে মানব জ্ঞানের পেশাগত শাখায় বিবর্তিত হয়। প্রথমদিকে সাহায্য কার্যক্রম স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। স্বেচ্ছাসেবীরা তাদের জ্ঞান ও কর্মদক্ষতা প্রশিক্ষণার্থী ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্জন করতো। সময়ের বিবর্তনে সমাজকর্মের পেশাগত শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রসারিত হয়। সমাজকর্মের অভিন্ন সাধারণ অনুশীলন কাঠামো গড়ে উঠে। শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে শিল্পায়ন ও শহরায়ন দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে। ধনী দরিদ্রের বৈষম্য ব্যাপক আকার ধারণ করে। বেকারত্ব, নিরাপত্তাহীনতা, পারিবারিক ভাঙ্গন, স্থানান্তর প্রভৃতি সমস্যা মোকাবেলার লক্ষ্যে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে সাহায্য কার্যক্রম গড়ে উঠে। সমাজকর্মের পেশাগত শিক্ষার সূচনায় এসব সমাজসেবা কার্যক্রমে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবীরা অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। এপ্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, যেকোন পেশাগত শিক্ষা কার্যক্রম তিনটি পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে বিকাশ লাভ করে।
প্রথম পর্যায়ে, স্বেচ্ছাসেবী ও বিভিন্ন সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান ও এজেন্সীর বেতনভুক কর্মীরা, সমাজকর্ম বিশারদদের অধীনে শিক্ষানবীশ হিসেবে সমাজকর্মের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এ পর্যায় সমাজকর্ম শিক্ষার সূচপর্ব হিসেবে চিহ্নিত।
পৃষ্ঠা ১৮১
দ্বিতীয় পর্যায়ে, আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনায় স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করা হয়।
তৃতীয় পর্যায়ে, প্রশিক্ষণ কোর্সগুলো শিক্ষা কর্মসূচিতে রূপামত্মরিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আত্মীকরণ করা হয়।
শিক্ষানবীশ হিসেবে সমাজকর্মীদের প্রশিক্ষণ : সমাজকর্মের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর পূর্বে স্বেচ্ছাসেবী ও বেতনভুক সমাজকর্মীরা বিভিন্ন সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান ও এজেন্সীর নির্বাহী এবং অভিজ্ঞ সমাজকর্ম বিশারদদের অধীনে শিক্ষানবীশ হিসেবে সমাজকর্মের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতো। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ইংল্যান্ডের মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলাদের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে দরিদ্র পরিবার পরিদর্শনের জন্য ফ্রেন্ডলি ভিজিটর্স হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। আধুনিক সুসংগঠিত পেশাদার সমাজকর্ম অনুশীলন এসব বন্ধুপ্রতীম পরিদর্শকদের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে এসব পরিদর্শকগণ বেতনভুক কর্মচারী হিসেবে সি.ও.সি এর নিয়োগ লাভ করে। এরাই সমাজকর্মী হিসেবে কালক্রমে পরিচিতি লাভ করে। এদের প্রধান কাজ ছিল দরিদ্রদের গৃহ পরিদর্শন, সমস্যার কারণ নির্ণয়, সমস্যা সমাধানের নির্দেশনা প্রদান এবং দুঃস্থদের বস্ত্তগত সাহায্য প্রদান। এসব কর্ম সম্পাদনের জন্য তাদেরকে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহের অভিজ্ঞ কর্মীদের নিকট শিক্ষানবীশ হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে হতো। এধরনের প্রশিক্ষণ হতে সমাজকর্ম শিক্ষার সূচনা হয়।
সমাজকর্মের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা : ঊনিশ শতকের শেষার্ধে দরিদ্র ও নির্ভরশীলদের প্রদত্ত সেবার মান ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সামাজিক এজেন্সীগুলো সমাজকর্ম শিক্ষা বিবর্তনে বিশেষ অবদান রাখে।
শিল্প বিপ্লবের প্রভাবজনিত সমস্যা মোকাবেলায় ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক মন্দা, গণবেকারত্ব এবং ১৮৬০ সালের বাণিজ্যিক মন্দার প্রাক্কালে বহু দান সংগঠন সমিতি গড়ে উঠে। সরকারি-বেসরকারি সাহায্য কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়। এমতাবস্থায় মানবহিতৈষীদের প্রচেষ্টায় আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে দান সংগঠন সমিতি গঠিত হয়।
আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দা ও দুর্ভিক্ষের প্রভাবে সৃষ্ট সমস্যা মোকাবেলার জন্য সি.ও.সি এর নেতৃবৃন্দ স্বেচ্ছাসেবীদের জায়গায় বেতনভুক কর্মী নিয়োগের চিন্তাভাবনা করেন। এসব বেতনভুক কর্মচারীদের মাধ্যমে কার্যকর সেবা প্রদান নিশ্চিত করার জন্য কিছু আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন দেখা দেয়।
সমাজসেবার ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মনীষী মেরী ই. রিচমন্ড ১৮৯৭ সালে নেশনাল কনফারেন্স অন চ্যারিটিস এন্ড কারেকশন -এ একটি ট্রেনিং স্কুল ইন এপ্লিয়েড ফিল্যনথ্রপি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উপস্থাপন করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালে ছয় সপ্তাহের গ্রীষ্মকালীন প্রশিক্ষণ কোর্স শুরু করে। এরূপ প্রশিক্ষণ কোর্সের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে অন্যান্য শহরে অনুরূপ কোর্স খোলা হয়। পরবর্তীতে নিউ ইয়র্ক স্কুল অফ পিলেনথরাপি এক বছরের সমাজকর্ম শিক্ষা কর্মসূচি আরম্ভ করে। যা পর্যায়ক্রমে নিউ ইয়র্ক স্কুল অফ সোস্যাল ওয়ার্ক এ পরিণত হয়। ১৯৬২ সালের দিকে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আত্মীকৃত হয়ে কলোম্বিয়া ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ সোস্যাল ওয়ার্ক এ পরিণত হয়।
শিল্পায়ন ও নগরায়ণ |
শিল্পায়ন
শিল্প বিপ্লবের ফলশ্রুতিই হচ্ছে শিল্পায়ন। শিল্পায়ন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যাকে উৎপাদন পদ্ধতিতে প্রয়োগ করে সনাতন উৎপাদন প্রক্রিয়াকে যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, বিজ্ঞানভিত্তিক যান্ত্রিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বৃহৎ আকারের উৎপাদন পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রক্রিয়াকেই শিল্পায়ন বলা হয়।
শিল্পায়ন বলতে প্রধানত নিচের দু’টো বিষয়কে বুঝানো হয়ে থাকে।
ক. উৎপাদন, যোগাযোগ ও যাতায়াত ক্ষেত্রে সনাতন যন্ত্রপাতির পরিবর্তে আধুনিক প্রযুক্তি এবং যন্ত্রের ব্যবহার।
পৃষ্ঠা ১৮২
খ. উৎপাদন, যাতায়াত এবং যোগাযোগ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মনুষ্য ও পশুশক্তির পরিবর্তে কয়লা, তেল, বিদ্যুৎ, পরমাণু প্রভৃতি শক্তি প্রয়োগ।
সুতরাং বলা যায়, উৎপাদন, যাতায়াত ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে প্রাকৃতিক শক্তিচালিত আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রক্রিয়াই শিল্পায়ন।
শিল্পায়নের বৈশিষ্ট্য : শিল্পায়নের ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যেসব লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন হয়, সেগুলোকে শিল্পায়ানের বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শিল্পায়নের বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো-
১. প্রাকৃতিক শক্তিনির্ভর যান্ত্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রবর্তন;
২. যান্ত্রিক শক্তিচালিত বৃহৎ আকারের উৎপাদন পদ্ধতির প্রবর্তন। যেমন হস্তশিল্পের পরিবর্তে যন্ত্রের প্রবর্তন, গৃহ শিল্পের পরিবর্তে কারখানার প্রতিষ্ঠা এবং শিল্প পরিচালনায় নতুন নতুন যান্ত্রিক আবিষ্কারের প্রয়োগ;
৩. কৃষিভিত্তিক পেশার পরিবর্তে শিল্পভিত্তিক পেশার বিকাশ;
৪. শ্রম বিভাগ এবং শিল্পের বিশেষীকরণের সুযোগ সৃষ্টি;
৫. নগরায়ণ প্রক্রিয়া দ্রুত সম্প্রসারণ;
৬. বস্ত্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ;
৭. সামাজিক ক্ষেত্রে বহুমুখী ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত জটিল সমস্যার উদ্ভব;
৮. সমাজ জীবনে প্রকৃতি-নির্ভর সনাতনী মানসিকতার পরিবর্তন;
৯. সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পারিবারিক ভূমিকার পরিবর্তন এবং সমাজ জীবনে রাষ্ট্রীয় প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি।
নগরায়ণ
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী নগরায়ণ বলতে গ্রামীণ মানুষের বসবাসের জন্য ক্রমান্বয়ে শহরমুখী ধাবিত হবার প্রবণতাকে বুঝানো হয়। প্রকৃত অর্থে নগরায়ণ বলতে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বুঝায়, যাতে কৃষিভিত্তিক পেশা বা জীবন ব্যবস্থা হতে অকৃষিভিত্তিক পেশায় বা জীবন পদ্ধতিতে মানুষ স্থানান্তরিত হয়। গ্রামীন জীবন হতে নগরের জীবন পদ্ধতি গ্রহণের প্রক্রিয়াই নগরায়ণ।
সমাজকর্ম অভিধানে নগরায়ণ প্রত্যয়টিকে দু’টি দিক হতে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
প্রথমত, ‘‘নগরায়ণ হলো এমন একটি সামাজিক প্রবণতা যার মাধ্যমে মানুষ শহরবাসী অথবা উপশহরের অধিবাসীদের জীবনধারা, আবাসিক ধরন এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ গ্রহণ করে।’’
দ্বিতীয়ত, ‘‘নগরায়ণ কোন গ্রামীন এলাকার এমন ধরনের বস্ত্তগত উন্নয়নকে বুঝায়, যাতে ঐ এলাকায় শহরে প্রাপ্ত বিষয়াদি অর্থাৎ সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়।’’
ডেভিড জেরি এবং জুলিয়া জেরি প্রণীত কলিন্স সমাজবিজ্ঞান অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী-
প্রথমত : নগরায়ণ হলো কোন দেশের শহরের জনসংখ্যার পরিসংখ্যানগত পরিমাপ। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ে গ্রামীন জনসংখ্যার শহরে স্থানান্তরের আনুপাতিক পরিসংখ্যানগত পরিমাপ হলো নগরায়ণের হার।
দ্বিতীয়ত : নগরায়ণ হলো সামাজিক প্রক্রিয়া এবং সামাজিক সম্পর্ক, যা গ্রামীন জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তে নগর জীবন ব্যবস্থার ফল হিসেবে উদ্ভূত। নগরায়ণ প্রক্রিয়ায় জ্ঞাতী সম্পর্কের পরিবর্তে বৈষয়িক, স্বল্প স্থায়ী এবং বাহ্যিক সম্পর্কের প্রতি গুরুত্বারোপ করে।
বিশ্বের ৫২টি দেশের লোক গণনার রিপোর্ট পর্যালোচনা করে জাতিসংঘের রিপোর্টে নগরায়ণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, দেশের জনসংখ্যার একটি ক্রমবর্ধমান অংশ শহরে বসবাস করার প্রক্রিয়াই নগরায়ণ।
সমাজবিজ্ঞানী ওয়ারেন এস. থম্পসনের মতে, নগরায়ণ হচ্ছে কৃষি প্রধান সমষ্টি হতে বৃহত্তর সমষ্টিতে স্থানান্তর প্রক্রিয়া। যেখানকার লোকের পেশা সরকারি বা বাণিজ্যিক অফিস বা শিল্প প্রতিষ্ঠানে চাকরি।
পৃষ্ঠা ১৮৩
সমাজবিজ্ঞানী মিচেলের মতে, ‘‘নগরায়ণ হচ্ছে শহুরে হওয়ার পদ্ধতি, কৃষি পেশা থেকে অন্য পেশা, যা শহরের সবাই করে এবং সাথে ব্যবহারিক রীতি-নীতির পরিবর্তন।’’
নগরায়ণের উপাদান
নগরায়ণের গতি, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে সমাজবিজ্ঞানীরা নগরায়ণের দু’টি উপাদান চিহ্নিত করেছেন।
১. বিকর্ষণমূলক উপাদান
গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র, অসহায় দুঃস্থ শ্রেণীর লোক প্রাকৃতিক এবং সামাজিক কারণে ন্যূনতম মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে সক্ষম হয় না। ফলে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের তাগিদে বাধ্য হয়ে গ্রাম ত্যাগ করে শহরাঞ্চলে গমন করে। সমাজ বিজ্ঞানীগণ একে বিকর্ষণ বা ধাক্কা বলে অভিহিত করেছেন।
বিকর্ষণ বা ধাক্কা সংশ্লিষ্ট নগরায়নের উপাদানগুলো হচ্ছে- ক. পল্লী অঞ্চলে লোকসংখ্যার অনুপাতে চাষযোগ্য ভূমির স্বল্পতা, কাজ কর্মের সুযোগ সুবিধার অভাব এবং খাদ্য সংকট। খ. যে হারে গ্রামীণ এলাকায় লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে হারে পল্লী এলাকায় শিল্প কারখানা স্থাপিত না হওয়া এবং লোকসংখ্যার অনুপাতে উন্নয়নখাতে সরকারি বিনিয়োগের স্বল্পতা; গ. গ্রামীণ শিক্ষিত সম্প্রদায় পিতৃপুরুষের কৃষি সংশ্লিষ্ট দৈহিক শ্রম নির্ভর বৃত্তি অনুসরণ করতে উৎসাহবোধ করে না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাদের সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন করে এবং পরিবর্তিত মূল্যবোধ অনুযায়ী তারা কায়িক পরিশ্রম অর্থাৎ গ্রামীণ পর্যায়ে কৃষি কাজে নিয়োজিত হতে উৎসাহবোধ করে না। গ্রামীণ বৃত্তি এবং প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষার দ্বন্দ্বের ফলে এসএসসি বা এইচএসসি পাশের পর তারা বাধ্য হয়ে শহরমুখী হয়; ঘ. বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বেকারত্বের প্রভাবে বাধ্য হয়ে গ্রামীণ জনগণ শহরে গমন করে।
২. আকর্ষণমূলক উপাদান
গ্রামাঞ্চলের আর্থিক দিক হতে উচ্চ শ্রেণী এবং শিক্ষিত জনগোষ্ঠী শহরের আধুনিক সুযোগ সুবিধা ভোগ এবং উপযুক্ত কর্মসংস্থানের জন্য শহরে আগমন করে। শহরের উন্নত জীবন-যাপন প্রণালীই তাদের গ্রাম থেকে শহরমুখী হতে আকৃষ্ট করে। একে সমাজ বিজ্ঞানীগণ আকর্ষণমূলক উপাদান বলে চিহ্নিত করেছেন।
আকর্ষণমূলক উপাদানগুলো হচ্ছে- ক. নগর ও শহর এলাকার প্রাচুর্য এবং বহুমুখী কর্মের সুযোগ-সুবিধা অপেক্ষাকৃত বেশি থাকায় শহরের প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হয়; খ. নগর অঞ্চলের আমোদ-প্রমোদ এবং বিলাসবহুল জীবন-যাপনের সুযোগ সুবিধা; গ. শহুরে সম্প্রদায়ের গ্রামীণ আত্মীয়-স্বজনদের শহরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা; ঘ. অধিক সরকারি সাহায্য লাভ বা সরকারিভাবে পুনর্বাসিত হওয়ার আশায় গ্রামীন উদ্বাস্ত্ত ও নিঃস্ব শ্রেণীর শহরে বসতি স্থাপন; ঙ. গ্রামীণ সমাজে শিক্ষা গ্রহণের বিশেষ পর্যায়ে এসে, উচ্চ শিক্ষার তেমন সুযোগ থাকে না। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ এবং শিক্ষার পর কর্মসংস্থানের আকর্ষণে শহরমুখী হয়।
প্রাকৃতিক উপাদান : প্রাকৃতিক সম্পদ আবিষ্কার হলে সংশ্লিষ্ট স্থানকে কেন্দ্র করে নগরায়ণের সূচনা হয়। অন্যদিকে, যারা শহরের স্থায়ী বাসিন্দা তাদের মধ্যে জন্মহার বৃদ্ধি পেলে নগরের জনসংখ্যার অনুপাত বৃদ্ধি পায়। ফলে নগরায়ণের আকর্ষণমূলক বা বিকর্ষণমূলক উপাদানের প্রভাব ছাড়াও শহরের জনসংখ্যার অনুপাত বৃদ্ধি পেতে পারে।
নগরায়ণ এবং শিল্পায়নের সম্পর্ক
‘নগরায়ণ’ এবং ‘শিল্পায়ন’ প্রত্যয় দু’টি সাধারণভাবে একই সঙ্গে ব্যবহৃত হলেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যদিও উভয়ের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ এবং পরস্পর পরস্পরকে প্রভাবিত করে। শিল্পায়ন হচ্ছে, এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে উৎপাদন, যাতায়াত ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে শক্তিচালিত যন্ত্রের প্রয়োগ করা হয়। সনাতন উৎপাদন পদ্ধতি থেকে যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতিতে উত্তরণই হচ্ছে শিল্পায়ন।
পক্ষান্তরে, নগরায়ণ হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যাতে দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা গ্রাম ছেড়ে শহরে বসতি স্থাপন করে। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যাতে এক ধরনের জীবন পদ্ধতি হতে অন্য ধরনের জীবন পদ্ধতি মানুষ গ্রহণ করে থাকে।
আলোচ্য সংজ্ঞাদ্বয় হতে স্পষ্ট হয়ে উঠে নগরায়ণ এবং শিল্পায়ন ধারণা দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। তবে বাস্তবে উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিরাজমান। শিল্পায়ন ব্যতীত নগরায়ণ হতে পারে। তবে শিল্পায়ন নগরায়ণের গতিকে ত্বরান্বিত করে। সাধারণত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ একই সাথে ঘটে অথবা একটির গতি অপরটিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। প্রাক-শিল্প যুগেও নগরায়ণ প্রক্রিয়া বিদ্যমান ছিল। প্রাক-শিল্প যুগের এবং শিল্প বিপ্লবের পরবর্তীকালের নগরায়ণ প্রক্রিয়ার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। যেমন-প্রাক-শিল্প নগরগুলো
অভিজাত শ্রেণী দ্বারা শাসিত হত। তখন নগরগুলোতে শাসক ও শোষিত-এ দু’ শ্রেণীরই অস্তিত্ব ছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু শিল্প নগরে অভিজাত শ্রেণীর পরিবর্তে উদ্ভব হয় পুঁজিপতির। শিল্প নগর গড়ে উঠার সাথে শহুরে উচ্চবিত্ত শ্রেণী, মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়।
শিল্পায়নের ফলে শিল্পের স্থানীয়করণ প্রক্রিয়ার সূচনা হয়। এটি নগরায়ণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। যেমন-বাংলাদেশের খুলনা জেলার খালিশপুরে, চট্টগ্রামের বাড়বকুন্ডে, সিলেটের ছাতকে শিল্পায়নের ফলেই নগরায়ণ হয়েছে।
পক্ষান্তরে, শহরকে কেন্দ্র করেও শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার সূত্রপাত ঘটে। শিল্পের স্থানীয়করণের কারণগুলোর মধ্যে বাজারের নৈকট্য, বন্দর ও যোগাযোগের সুবিধা প্রধান। যেমন- নারায়ণগঞ্জ, তেজগাঁ এবং টঙ্গিতে শিল্পায়ন তথা শিল্পের স্থানীয়করণ ঢাকা এবং বন্দর এলাকার নৈকট্য বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্ট হয়ে উঠে, শিল্পায়ন এবং নগরায়ণ পরস্পর নির্ভরশীল। একটি অপরটিকে প্রভাবিত করে। আধুনিক যুগে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত।
পৃষ্ঠা ১৮৪
শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে সৃষ্ট সামাজিক সমস্যাবলি
শিল্পায়ন ও নগরায়ণ মানব জীবনে বহুমুখী কল্যাণ বয়ে এনেছে। যাতায়াত, যোগাযোগ ও উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নয়নের মাধ্যমে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ মানব সভ্যতাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে চলেছে। শিল্পায়ন ও নগরায়ণ সমাজ জীবনে অনেক কল্যাণকর দিক উন্মোচিত করলেও এদুটো অবিমিশ্র আশীর্বাদ নয়। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ যেমন উন্নয়নের গতি সঞ্চার করে, তেমনি বয়ে আনে বহুমুখী জটিল সমস্যা।
শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে সৃষ্ট অভিন্ন সমস্যাগুলো এপর্যায়ে আলোচনা করা হলো-
১. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা : নগরায়ণ এবং শিল্পায়নের ফলে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। এতে ভৌগোলিক দূরত্ব হ্রাস পেলেও সামাজিক দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। নগর ও শিল্পায়নের জ্ঞাতী সম্পর্কের পরিবর্তে বৈষয়িক কৃত্রিম সম্পর্কের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। শিল্প ও শহরাঞ্চলে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ হতে বিভিন্ন পেশার ও মর্যাদার লোক একত্রে বসবাস করে। তাদের মধ্যে মানসিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য বিদ্যমান থাকে। ফলে তারা একত্রে একই এলাকায় এমনকি একই বিল্ডিংয়ে বসবাস করা সত্ত্বেও সামাজিক দিক হতে সম্পর্কহীন বিচ্ছিন্ন জীবন যাপনে করে। সামাজিক বিচ্ছিনতাবোধ শহর ও শিল্পাঞ্চলের লোকদের অর্থহীন প্রতিযোগী জীবন-যাপনে বাধ্য করে। বিপদে আপদে পারস্পরিক সাহায্য ও সহানুভূতির মনোভাব থাকে না। যার প্রভাবে সামাজিক বন্ধনের শিথিলতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়।
নগরায়ণ ও শিল্পায়ন মানুষকে যান্ত্রিক এবং বস্ত্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করে তুলে। জীবন ধারাগত পার্থক্য থাকায় তাদের মধ্যে সামাজিক বিষয়ে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কম হয়। দীর্ঘদিন একত্রে বসবাস এবং কর্মজীবন অতিবাহিত করেও শহরের লোক পরস্পর পরস্পরের প্রতিবেশী হতে পারে না। শহরে সবাই নাম গোত্রহীন। গ্রামীণ সমাজে মানুষ বংশানুক্রমে একই এলাকায় বসবাস করে। তাদের সামাজিক পরিচিতি ও সামাজিক সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। গ্রামীণ লোকদের নিজস্ব রীতি-নীতি, আচার, আচরণ, আদর্শ ও মূল্যবোধ সামাজিক বন্ধনকে ঘনিষ্ঠ করে তুলে। যা শহর ও শিল্পাঞ্চলে আশা করা যায় না। গ্রামীণ মানুষ শহরে স্থানান্তরের ফলে গ্রামীণ জীবন হতে তারা ক্রমান্বয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এভাবে শহর ও শিল্পাঞ্চলের মানুষ দু’দিক থেকে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং সম্পর্কহীনতা ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
২. পারিবারিক ভাঙ্গন ও নিরাপত্তাহীনতা : নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে সমাজ জীবনে যে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটেছে, সে পরিবর্তনের প্রভাব থেকে পরিবার মুক্ত নয়। নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে শ্রমের গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। কর্মসংস্থানের আশায় শ্রমজীবী মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে বা শিল্পাঞ্চলে গমন করে। বাসস্থানের স্বল্পতা, স্বল্প মজুরী এবং নির্দিষ্ট আয় ইত্যাদি কারণে পরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে শহরে বসবাস করা সম্ভব হয় না। ফলে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার সৃষ্টি হয়। আলভিন টফলার তাঁর “ফিউচার শক” গ্রন্থে বলেছেন, ‘‘শিল্পায়ন সমাজকে এত বেশি বেগবান এবং চলিষ্ণু করে তুলে যে, লোকজনের ভৌগোলিক সচলতা বৃদ্ধি পাওয়া অনিবার্য হয়ে উঠে। স্বভাবতই বৃহদায়তন পরিবার এরূপ সচলতার পথে অন্তরায়। সুতরাং যৌথ পরিবার ভেঙ্গে দম্পতি কেন্দ্রিক পরিবারে পরিণত হয়।
পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তনের ফলে পরিবারের ভূমিকারও পরিবর্তন ঘটে। ফলে পরিবারের ওপর নির্ভরশীল প্রবীণ, প্রতিবন্ধী এবং শিশু-কিশোরদের নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। যেমন-
ক. যৌথ পরিবার যে সব প্রবীণ, প্রতিবন্ধী, বিধবা, এতিম ও অসহায় সদস্যদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব পালন করত, পারিবারিক ভাঙ্গনের ফলে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়।
পৃষ্ঠা ১৮৫
খ. যৌথ পরিবার শিশু কিশোরদের সামাজিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। বয়োজ্যেষ্ঠদের আচার-আচরণ অনুকরণের মাধ্যমে শিশুরা পারিবারিক পরিবেশে নিজেদের বৃহৎ সমাজের উপযোগী করে গড়ে তুলতে সক্ষম হতো। পারিবারিক ভাঙ্গনের
ফলে শিশু-কিশোরদের সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ ও ব্যক্তিত্ব গঠন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। ফলে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়।
গ. নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী উভয়ে কর্মে নিয়োজিত থাকে। ফলে সন্তান সন্ততিদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। এরূপ নিরাপত্তাহীনতা সুষ্ঠু ব্যক্তিত্ব গঠনের পরিপন্থী।
ঘ. নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রভাবে পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। একক পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সমতার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ফলে পরিবারের স্থায়িত্বের অভাব পরিলক্ষিত হয়। দাম্পত্যকলহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদের হার দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এতে সন্তান সন্ততিদের সঙ্গে পিতা-মাতার সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং তাদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ জাগ্রত হয় না।
এভাবে নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রভাবে সৃষ্ট পারিবারিক ভাঙ্গন শিশু-কিশোর, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী, অসহায় সদস্যদের নিরাপত্তাহীনতার শিকারে পরিণত করে।
৩. অপরাধ প্রবণতা : অপরাধ হলো এক ধরনের ক্ষণস্থায়ী অস্বাভাবিক আচরণ, যা সমাজ ও প্রচলিত আইন কর্তৃক স্বীকৃত নয়। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাবে মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা দেখা দেয়। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের প্রভাবে সৃষ্ট প্রতিকূল পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বিভিন্নভাবে অপরাধ প্রবণতা সৃষ্টি করে। যেমন-
ক. নগর ও শিল্পাঞ্চলে গ্রামীণ সমাজের ন্যায় পারিবারিক ও সামাজিক পরিচিতি এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর হয় না। শহরে সবাই নাম গোত্রহীন। এখানে ব্যক্তিগত জীবনের ওপর পাড়া প্রতিবেশীর কোন কিছু বলার অধিকার নেই। এমতাবস্থায় সামাজিক ও পারিবারিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে মানুষ সহজে নানারকম অসামাজিক ও অপরাধমূলক কার্যকলাপে নিয়োজিত হতে পারে। যেমন- গ্রামীণ এলাকায় সামাজিক বা পরিবারিক পরিচিতির কারণে প্রকাশ্যে ছিনতাই করা সম্ভব নয়। কিন্তু শহরাঞ্চলে পারিবারিক বা সামাজিক পরিচিতিহীন অবস্থায় ছিনতাই করা তেমন কঠিন ব্যাপার নয়।
খ. শিল্পায়ন ও নগরায়ণের উপ-জাত হলো পতিতা বৃত্তি। আয়ের স্বল্পতা ও গৃহ-সমস্যার কারণে নিম্ন আয়ের লোকদের পক্ষে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করা সম্ভব নয়। ফলে যৌন চাহিদা পূরণের তাগিদে শহরের লোক অবৈধ উপায় অবলম্বন করে। যার ফলশ্রুতিতে পতিতা বৃত্তির মতো অসামাজিক প্রথা শহুরে সমাজে স্থায়ীরূপ লাভ করেছে।
গ. শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে সৃষ্ট পারিবারিক ভাঙ্গন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, বেকারত্ব, অসম অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা, দাম্পত্য কলহ, যান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থা মানুষের মধ্যে হতাশা ও ব্যর্থতা সৃষ্টি করে। এসব হতাশা ও ব্যর্থতা হতে মুক্তি পাবার জন্য মানুষ মদ, জুয়া, প্রতারণা প্রভৃতি অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
ঘ. শহরের কর্মজীবী পিতা-মাতার সন্তানরা মা-বাবার সাহচর্য ও আদর-যত্ন থেকে বঞ্চিত। ফলে তাদের সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের অভাবে ব্যক্তিত্বের যথাযথ বিকাশ ঘটে না। এছাড়া পারিবারিক নিয়ন্ত্রণের অভাবে শিশু-কিশোররা সহজে সঙ্গদোষে অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠে।
ঙ. শহর ও শিল্পাঞ্চলের জনবসতি অত্যন্ত ঘন বিধায় মানুষ অতিসহজে অপরাধ করে নিরাপদ আশ্রয় লাভ করতে পারে। যা শহরের মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি করে।
পৃষ্ঠা ১৮৬
চ. শিল্পাঞ্চল ও শহর এলাকায় বহুমুখী সেবামূলক প্রতিষ্ঠান কর্মরত থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানের সার্বিক কার্যক্রম অর্থের বিনিময়ে পরিচালিত। শহরের সামগ্রিক অর্থ-নির্ভর জীবন ব্যবস্থা মানুষের মধ্যে ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা ইত্যাদি অপরাধমূলক কার্যক্রমের জন্ম দেয়।
ছ. শহর ও শিল্পাঞ্চলের মানুষের জীবন বিরাট বৈপরিত্যে পরিপূর্ণ। একদিকে থাকে যেমন ধনাঢ্য কোটিপতি ও শিল্পপতি; অন্যদিকে রয়েছে নিঃস্ব সহায় সম্বলহীন শ্রমিক শ্রেণী। একদিকে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান, অন্যদিকে অশিক্ষিত, অজ্ঞ, জনসমষ্টির সমাবেশ। এরূপ বিপরীতমুখী জনসমাবেশের ফলে শহরাঞ্চলে সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। ফলে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, রাহাজানী প্রভৃতি নাশকতামূলক কর্মকান্ডের পটভূমি রচিত হয়।
সুতরাং বলা যায়, নৈতিক অধঃপতন এবং অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির আবাসস্থল হলো শহর ও শিল্পাঞ্চল।
৪. গৃহায়ন ও বস্তি সমস্যা : সাধারণভাবে গৃহ বলতে মানুষের স্থায়ী বসবাসের স্থানকে বুঝায়। যেখানে মানুষ নিরাপদে বিশ্রাম, আরাম এবং প্রাকৃতিক প্রতিকূল অবস্থা হতে নিরাপদ আশ্রয় লাভ করে। আর গৃহায়ন বলতে মানুষের জন্য বাসস্থানের সংস্থান করাকে বুঝায়। গৃহায়ন মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার শিল্পায়ন ও নগরায়ণের প্রভাবে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর মধ্যে গৃহায়ন অন্যতম। গৃহায়ন সমস্যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে শিল্পাঞ্চল ও শহরাঞ্চলে গড়ে উঠে বস্তির মানবেতর জীবন ব্যবস্থা। শিল্প ও শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থানের আশায় যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়, সে হারে গৃহায়ন হয় না। ফলে বাধ্য হয়ে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ বস্তির মানবেতর পরিবেশে আশ্রয় গ্রহণ করে।
শহরের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ প্রচন্ড অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাসিত্মতে বাস করে। ১৯৮৯ সালে ঢাকার ১১৫০ টি বস্তির ওপর পরিচালিত জরিপের তথ্যানুযায়ী বস্তিবাসীর সংখ্যা আট লাখ আশি হাজার ছিল। ১৯৯৬ সালে বেসরকারি সাহায্য সংস্থা ‘‘কোয়ালিশন ফর আরবান পুওর’’ পরিচালিত জরিপের তথ্যানুযায়ী ঢাকায় মোট ২১৫৬টি বস্তিতে ২০ লাখ লোক বাস করে।
গৃহায়ন সমস্যা ও বস্তির মানবেতর পরিবেশ শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং জনস্বাস্থ্যের প্রতি মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করছে। শহরের বস্তির নোংরা পরিবেশ অপরাধ প্রবণতা ও সংক্রামক ব্যাধির সূতিকাগার হিসেবে প্রভাব বিস্তার করছে। বস্তির নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং জীবনের নিম্নমান সংক্রামক ব্যাধি বিকাশের ঊর্বর ক্ষেত্র। পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষার অভাব, পারিবারিক অশান্তি ও দাম্পত্য কলহ, যৌন অশোভনতা প্রভৃতি শিশু-কিশোরদের সুষ্ঠু ব্যক্তিত্ব গঠন এবং বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়।
৫. স্বাস্থ্য সমস্যা : প্রাকৃতিক ও জনসম্পদ যে কোন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের অন্যতম মৌলিক উপাদান। শুধু প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যই কোন দেশে সমৃদ্ধি ডেকে আনতে পারে না। কারণ প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে উপযোগ সৃষ্টি করতে হলে দক্ষ ও কুশলী জনশক্তির প্রয়োজন অত্যাবশ্যক। জনসাধারণের কর্ম নৈপুণ্য, কর্মস্পৃহা, কর্মক্ষমতা এবং মানসিক ধ্যান ধারণা তাদের শারীরিক গঠন ও সুস্থতার ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। এজন্য স্বাস্থ্য যেমন ব্যক্তিগত সম্পদ, তেমনি জাতীয় সম্পদ। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির মৌলিক উপাদান হলো স্বাস্থ্য।
স্বাস্থ্যহীনতা হচ্ছে এমন একটি শারীরিক ও মানসিক অস্বাভাবিক অবস্থা, যা কোন ব্যক্তিকে তার সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে অক্ষম করে তুলে। মানুষের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক অবস্থার সামঞ্জস্যহীনতাই স্বাস্থ্যহীনতা। কারণ সুস্থতার সঙ্গে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক অবস্থা অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত।
পৃষ্ঠা ১৮৭
আধুনিক শিল্প সমাজে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন সাধন করা হচ্ছে। অন্যদিকে, শিল্পায়ন ও নগরায়ণের প্রভাবে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। শিল্পায়ন ও নগরায়ণজনিত কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা নিচে উল্লেখ করা হলো।
ক. শিল্পায়ন পেশাগত দুর্ঘটনা ও সংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটায়। শিল্পায়নের ফলে শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয় বলে অনেক সময় পেশাগত দুর্ঘটনার শিকার হয়ে তারা অকাল মৃত্যু বা কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এছাড়া পেশাগত রোগে আক্রান্ত এবং অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশের প্রভাবে শহর ও শিল্পাঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে শ্রমিকরা অকাল মৃত্যু বরণ করে।
খ. শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা এবং নগর গড়ে উঠে। শিল্প স্থাপন এবং শহরের সম্প্রসারণের ফলে দেশের বনজসম্পদ ধ্বংস হয়। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। এছাড়া শিল্প-কারখানার নির্গত ধোঁয়া, বিষাক্ত গ্যাস, বর্জ্য পদার্থ প্রভৃতি পরিবেশ দূষণ করার ফলে স্বাস্থ্য সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। সম্প্রতি শিল্প কারখানার আনবিক বর্জ্য পদার্থ সারাবিশ্বের জনস্বাস্থ্যের প্রতি মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করছে।
গ. শহরাঞ্চল ও শিল্পাঞ্চলে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেহারে পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানীয় জলের সরবরাহ ও স্বাস্থ্যকর আবাসের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। ঘন বসতিপূর্ণ শিল্প ও শহর এলাকার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ স্বাস্থ্যহীনতার অন্যতম কারণ।
ঘ. শিল্প ও শহরাঞ্চলে গৃহায়ন সমস্যা অত্যন্ত প্রকট। যার ফলে মানুষ বস্তির নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। বস্তির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সংক্রামক ব্যাধির সূতিকাগার হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এছাড়া আমাদের ন্যায় অনুন্নত ও দরিদ্র দেশের ভাসমান জনগোষ্ঠী শহর ও শিল্পাঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে। এরা যেখানে সেখানে মল-মূত্র ত্যাগ করে পরিবেশকে দূষিত করে তুলে। যা জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকির সৃষ্টি করে।
ঙ. শিল্পায়ন ও নগরায়ণ যৌণতাকে স্থায়ী প্রতিষ্ঠানের রূপদান করেছে। শহর ও শিল্পাঞ্চলের নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ যৌণপল্লীতে গমন করে। যৌণপল্লীতে গমন এবং যৌন স্বেচ্ছাচারিতার প্রভাবে তারা মারাত্মক সংক্রামক যৌন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। পরবর্তীতে এসব যৌন ব্যাধি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে সংক্রামিত হয়ে গোটা সমাজদেহে ছড়িয়ে পড়ে।
পরিশেষে বলা যায়, শিল্পায়ন ও নগরায়ণ মানব সভ্যতাকে যেমন এগিয়ে নিয়েছে; তেমন সৃষ্টি করেছে বহুমুখী জটিল আর্থ-সামাজিক ও মানবিক সমস্যা, যা মানুষের জীবনকে করে তুলেছে কৃত্রিম ও বস্ত্তবাদী।
শিল্পায়ন ও নগরায়ণের প্রভাবে সৃষ্ট পরিবর্তনজনিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা
সামাজিক পরিবর্তন সব সময় মঙ্গলজনক নয়। অসম পরিবর্তনজনিত অসঙ্গতি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার অন্যতম প্রধান উৎস। সমাজবিজ্ঞানী ওগবার্ণ -এর মতে, ‘‘নিয়ত পরিবর্তনশীল মানব সংস্কৃতি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মানুষের আদিম প্রকৃতির সামঞ্জস্য বিধান না হবার ফলে সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হয়।’’ সমাজ বহির্ভূত আকস্মিক কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যখন অপরিকল্পিত পরিবর্তন ঘটে, তখন পরিবর্তিত সামাজিক অবস্থার সঙ্গে মানুষ সহজে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে বিভিন্ন ধরনের আর্থ-সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়। আবার যখন সামাজিক পরিবর্তন ঘটে, তখন সমাজের সব অংশ সমানভাবে প্রভাবিত হয় না। সমাজের বিভিন্ন অংশে অসম পরিবর্তনজনিত যে অসঙ্গতি দেখা দেয়, তার প্রভাবে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়। সামাজিক পরিবর্তনজনিত কতিপয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা নীচে আলোচনা করা হলো।
১. সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতা : সামাজিক পরিবর্তনজনিত আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতা অন্যতম। সমাজবিজ্ঞানী ওগবার্ণ তাঁর ‘সোস্যাল চেঞ্জ’ গ্রন্থে প্রথম সমাজের বিভিন্ন অংশে যে অসম সামাজিক পরিবর্তনজনিত অসঙ্গতি ঘটে
পৃষ্ঠা ১৮৮
তার উল্লেখ করেন। যখন কোন সামাজিক পরিবর্তন ঘটে, তখন সমাজের সব অংশকে সমানভাবে প্রভাবিত করে না। ওগবার্ণের মতে, মানব সংস্কৃতির বস্ত্তগত উপাদানসমূহ যত সহজে পরিবর্তিত হয়, অবস্ত্তগত উপাদানসমূহ তত সহজে দ্রুত পরিবর্তিত
হয় না। ফলে বস্ত্তগত উপাদানসমূহের সঙ্গে অবস্ত্তগত উপাদানসমূহের অসম পরিবর্তনজনিত অসঙ্গতি দেখা দেয়। এতে সমাজে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।
শিল্পায়ন ও নগরায়ণের প্রভাবে যে হারে বস্তুগত অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে, সে হারে অবস্তুগত অর্থাৎ মানুষের আচার-আচরণ, মূল্যবোধ, আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয় না। ফলে সমাজ জীবনে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বিবাহ বিচ্ছেদ, দাম্পত্য কলহ, যৌতুক প্রথা, যুব অসন্তোষ, নেশাগ্রস্ততা প্রভৃতি সমস্যার মূল কারণ অসম সামাজিক পরিবর্তন।
২. পারিবারিক ভাঙ্গন : সামাজিক পরিবর্তনজনিত সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে পারিবারিক ভাঙ্গন অন্যতম। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বিদ্যা, শিল্পায়ন ও নগরায়ণ সমাজ জীবনে সুদূর প্রসারী পরিবর্তন বয়ে আনছে। সমাজের মৌলিক প্রতিষ্ঠান পরিবার এরূপ পরিবর্তনের প্রভাব মুক্ত নয়। শিল্পায়নজনিত সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাবে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে দম্পতি কেন্দ্রিক একক পরিবার গঠিত হচ্ছে। ফলে পারিবারিক ভূমিকার পরিবর্তন ঘটছে। প্রবীণ, অক্ষম, প্রতিবন্ধী এবং শিশু কিশোরদের নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। শিশু কিশোরদের সামাজিকীকরণ ব্যাহত হয়।
সমাজবিজ্ঞানী ব্ল্যাক তাঁর “ডিজওর্গানাইজেশন : পারসোনাল এন্ড সোস্যাল” গ্রন্থে বিবাহ বিচ্ছেদ, স্বেচ্ছায় স্বামী গৃহ ত্যাগ, সন্তানদের প্রতি পিতামাতার উদাসীনতা প্রভৃতিকে পারিবারিক পরিবর্তনের ফল হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
৩. বেকারত্ব : সামাজিক পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর মধ্যে বেকারত্ব অন্যতম। যান্ত্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রভাবে উৎপাদন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। উৎপাদন, যাতায়াত ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে মনুষ্য এবং পশু শক্তির পরিবর্তে প্রাকৃতিক শক্তি ব্যবহার করা হয়। গৃহকেন্দ্রিক শ্রমবহুল উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তে বৃহৎ আকারের যান্ত্রিক উৎপাদন প্রবর্তিত হয়। ফলে বহু শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। আবার পরিবর্তিত উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণের প্রয়োজনীয় দক্ষতা না থাকায় অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে।
৪. মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব : সমাজকাঠামোর অবিচ্ছেদ্য উপাদান হলো সামাজিক মূল্যবোধ। সমাজের পরিবর্তনের ফলে সামাজিক মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটে। সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যদি নতুন মূল্যবোধ গড়ে না উঠে তাহলে যেমন সমস্যার সৃষ্টি হয়, তেমনি প্রচলিত ক্ষতিকর মূল্যবোধের পরিবর্তন না হলেও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় সামাজিক পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট নতুন সামাজিক মূল্যবোধ এবং সমাজের প্রচলিত সনাতন মূল্যবোধের দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতেও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত সমস্যার প্রধান কারণ অসম সামাজিক পরিবর্তন।
৫. সামঞ্জস্য বিধানের ব্যর্থতা : সামাজিক পরিবর্তন হলো সমাজকাঠামো এবং কাঠামো সম্পর্কিত কার্যাবলীর পরিবর্তন। আবার যেসব আদর্শ, মূল্যবোধ, সামাজিক রীতিনীতি, সামাজিক কাঠামোকে সুসংহত এবং সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে সে সবের পরিবর্তনকেও সামাজিক পরিবর্তন বলা হয়। অপরিকল্পিত বা আকস্মিকভাবে সামাজিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়, তখন পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে মানুষ সহজে সামঞ্জস্য বিধানে সক্ষম হয় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক সংঘাত, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ প্রভৃতি সমাজ বহির্ভুত কারণে সৃষ্ট অপ্রত্যাশিত সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষ সহজে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে ব্যর্থ হয়ে যথাযথ সামাজিক ভূমিকা পালন করতে পারে না। অন্যদিকে, এসব পরিবর্তনজনিত কারণে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান স্ব স্ব ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলেও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
পৃষ্ঠা ১৮৯
৬. সামাজিক সম্পর্কের অবনতি : শিল্পায়ন, নগরায়ণ, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ, বস্ত্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতির প্রভাবে সামাজিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রতিনিয়ত অবাঞ্ছিত পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। ফলে পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্ক ও সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ছে।
ফলে সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়ে সমাজের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও বিরোধ দেখা দেয়, যা গোটা সমাজের সংহতি বিনষ্ট করে দিতে পারে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বর্ণ-বৈষম্য, উগ্র স্বজাত্যবোধ এবং উগ্র সমষ্টিগত চেতনা প্রভৃতি কারণে সৃষ্ট অপ্রত্যাশিত সামাজিক পরিবর্তন সমাজে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে।
পরিশেষে বলা যায়, সামাজিক কাঠামোর বিভিন্ন অংশ পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। সুতরাং সামাজিক কাঠামোর কোন বিশেষ অংশে পরিবর্তন হলে সামাজিক ভারসাম্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে এবং যার প্রভাবে আবার সমাজে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন এবং সামাজিক অসংগতি দেখা দেয়। সমাজের একদিকের অসম পরিবর্তন, অন্যান্য দিকের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
শিল্পায়ন ও নগরায়নজনিত সমস্যা মোকাবেলায় আধুনিক সমাজকল্যাণের গুরুত্ব
শিল্প বিপ্লবের ফলে শিল্পায়ন এবং নগরায়নের প্রসার ঘটে। আর শিল্পায়ন ও শহরায়নের প্রভাবে সৃষ্ট জটিল ও বহুমুখী সমস্যা মোকাবেলার প্রয়োজনে আধুনিক সমাজকল্যাণের উদ্ভব। শিল্প বিপ্লবের সুদূর প্রসারী ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মানসিক ক্ষেত্রে বহুমুখী ও বিচিত্র ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। যেগুলো সমাধানে মানুষকে সাহায্য করার প্রয়োজনে আধুনিক সমাজকল্যাণের উদ্ভব। শহরায়ন ও নগরায়ণ জনিত সমস্যা মোকাবেলায় আধুনিক সমাজকল্যাণের গুরুত্ব এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
১. সামাজিক গবেষণা : শিল্পায়ন ও শহরায়ন জনিত সমস্যার পরিকল্পিত সমাধানে আধুনিক সমাজল্যাণ গবেষণা কৌশল প্রয়োগ করে। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে সমস্যার কারণ, প্রভাব, সমস্যাগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ, উপায় ইত্যাদি বিষয়ে সামগ্রিক তথ্য সংগ্রহের প্রচেষ্টা চালায় সমাজকল্যাণ।
২. সামাজিক নীতি প্রণয়ণে সহায়তাকরণ : শিল্পায়ন ও শহরায়ণের প্রভাবে সৃষ্ট সমস্যা মোকাবেলায় কার্যকর সামাজিক নীতি প্রণয়নে সাহায্য করে আধুনিক সমাজকল্যাণ। আইন প্রণেতা, জনপ্রশাসন সংস্থা যেমন শিক্ষা, সমাজসেবা বিভাগ, বেসরকারী তহবিল দাতা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি কর্তৃপক্ষকে সামাজিক নীতি সংশোধন, পরিবর্তন ও উন্নয়নের প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে সমাজকর্মীরা সহায়তা করে। শহরায়ন ও শিল্পায়নজনিত সমস্যা মোকাবেলায় বাস্তবমুখী নীতি প্রণয়নে পেশাদার সমাজকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৩. মানুষকে নিজেদের সামর্থ্য শক্তিশালী করণে সাহায্য করা : শিল্পায়ন ও শহরায়নের প্রভাবে যে পরিবর্তন আসে, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের অভাবে মানুষ নিজেদের সামর্থ্যের দ্বারা সেগুলো মোকাবেলা করতে পারে না। এমতাবস্থায় পেশাদার সমাজকর্মীগণ শহরায়ন ও শিল্পায়নজনিত সমস্যা মোকাবেলায় এমনভাবে সাহায্য করে যাতে মানুষ নিজেদের সামর্থ্য অধিক কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। এপ্রসঙ্গে মনীষী পিনকাস এবং মিনহাম বলেছেন মানুষের দৈহিক, আবেগীয়, আর্থ-সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় সমাজকর্মীর ভূমিকা হলো মানুষকে নিজ সমস্যা সমাধান ও মোকাবেলায় সামর্থ্য শক্তিশালীকরণ এবং অধিক কার্যকর ব্যবহারে সাহায্য করা।
৪. বিশেষ সেবা প্রদান : শহরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে পারিবারিক ভাঙ্গন, পরিবেশ দূষণ, পেশাগত সংক্রামক ব্যধির আবির্ভাব, বেকারত্ব, আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। এসব সমস্যা মোকাবেলার জন্য বিশেষ সেবার প্রয়োজন দেখা হয়। আধুনিক সমাজকল্যাণে প্রবীণ, শিশু, প্রতিবন্ধী, অপরাধ প্রবণদের জন্য বিশেষ সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে পরিবর্তিত পরিবেশে সামঞ্জস্য বিধানে তাদেরকে সহায়তা করা হয়।
পৃষ্ঠা ১৯০
৫. পেশাগত দৃষ্টিকোণ হতে সেবা প্রদান : শিল্পায়ন ও শহরায়নের প্রভাবে সৃষ্ট জটিল ব্যক্তিগত এবং সামাজিক সমস্যা মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন দক্ষতা সম্পন্ন পেশাদার সমাজকর্মীর। আধুনিক সমাজকল্যাণে পেশাগত দক্ষতা সম্পন্ন সমাজকর্মীদের মাধ্যমে এজেন্সীগুলো সাহায্য প্রদান করে। শিল্পায়ন ও শহরায়নজণিত সমস্যা মোকাবেলায় পেশাদার সমাজকর্মীদের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ অনেক সময় স্বেচ্ছাসেবীদের জটিল সমস্যা সমাধানে সাহায্য করার মতো জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব থাকে।
৬. বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও তত্ত্বের প্রয়োগ : আধুনিক সমাজকল্যাণ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার জ্ঞান ও তত্ত্ব প্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা চালায়। আর শিল্পায়ন ও শহরায়ণ জনিত সমস্যা মোকাবেলায় বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও তত্ত্বের অনুশীলন একান্ত প্রয়োজন।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় শিল্পায়ন ও শহরায়ণ জনিত সমস্যা সমাধান এবং নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে আধুনিক সমাজকল্যাণের উদ্ভব। স্বাভাবিকভাবে শিল্পায়ন ও শহরায়ণের ফলে সৃষ্ট সমস্যা মোকাবেলায় আধুনিক সমাজকল্যাণের গুরুত্ব অপরিসীম।
অনুশীলনী
রচনামূলক প্রশ্ন
১. শিল্প বিপ্লব কাকে বলে ? সমাজ জীবনে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব আলোচনা কর।
২. শিল্প বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলো আলোচনা কর।
৩. শিল্পায়ন ও নগরায়ণ বলতে কি বুঝ ? শিল্পায়ন ও শহরায়নের ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলো আলোচনা কর।
৪. শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে কিভাবে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও অপরাধ প্রবণতা সৃষ্টি হয় আলোচনা কর।
৫. শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে কিভাবে স্বাস্থ্যহীনতা এবং গৃহসমস্যার সৃষ্টি হয় আলোচনা কর।
৬. শিল্পায়ন ও নগরায়ণের সম্পর্ক আলোচনা কর।
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. শিল্প বিপ্লবের একটি ইতিবাচক প্রভাব বর্ণনা কর।
২. নগরায়ণ কাকে বলে ? এর বৈশিষ্ট্য কি কি ?
৩. শিল্পায়ন বলতে কি বুঝায় ?
৪. শিল্প বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য লিখ।
৫. সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতা কি ?
৬. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা কি ?
৭. স্বাস্থ্য সমস্যা কি ?