পৃষ্ঠা ১১৯
চতুর্থ অধ্যায়
সমাজকল্যাণের ঐতিহাসিক পটভূমি

ভূমিকা
মানব সভ্যতার বিকাশে শিল্প বিপব অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। শিল্প বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব মানুষের আর্থ-সামাজিক ও চিন্তাধারার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন বয়ে আনে। শিল্প বিপ্লব মানব সভ্যতাকে সরাসরি সীমারেখা টেনে ‘প্রাক-শিল্প যুগ’ এবং ‘শিল্প বিপ্লবোত্তর যুগ’- এ দু’টি ভাগে বিভক্ত করে দেয়। মানব সভ্যতার মতো সমাজসেবার ধারাকে শিল্প বিপ্লব দু’টি ভাগে বিভক্ত করে। একটি হলো, মানব প্রেম ও ধর্মীয় অনুশাসনের ভিত্তিতে পরিচালিত প্রাক-শিল্প যুগের বা ঐতিহ্যগত সনাতন সমাজকল্যাণ ধারা। আর অন্যটি হলো, ‘‘শিল্প-বিপ্লবোত্তর সমাজের জটিল আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনে উদ্ভুত বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক সমাজকল্যাণ ধারা’’। আধুনিক সমাজকল্যাণের পেশাগত দিক হলো সমাজকর্ম।
প্রাক-শিল্প যুগের সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথা এবং প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তি ও বিকাশের সঠিক বিবরণ দেয়া কঠিন। তবে প্রাচীনকাল হতে যে বিভিন্ন ধরনের সমাজসেবামূলক কার্যক্রম সমাজে বিদ্যমান ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্য সনাতন সমাজকল্যাণের মূলভিত্তি।
সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণের ধারণা
সনাতন সমাজকল্যাণঃ প্রাক-শিল্প যুগের বিচ্ছিন্ন ও অসংগঠিত সমাজসেবা প্রথা-প্রতিষ্ঠানগুলোর সনাতন বা ঐতিহ্যগত সমাজকল্যাণ প্রথা হিসাবে পরিচিত। ধর্মীয় অনুশাসন ও মানবতাবোধের ভিত্তিতে পরিচালিত বদান্যতা নির্ভর যে সব সমাজসেবামূলক প্রথা-প্রতিষ্ঠান সুদূর প্রাচীনকাল হতে গৃহীত ও পরিচালিত হয়ে আসছে, সেগুলোকে সনাতন সমাজকল্যাণ বলা হয়। মানুষের সহজাত মানবতা, ধর্মীয় অনুশাসন ও বিশ্বাস এবং মানবপ্রেম সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথা-প্রতিষ্ঠানের মূলচালিকাশক্তি। সনাতন সমাজকল্যাণের দৃষ্টান্ত হলো- দান প্রথা, যাকাত, এতিমখানা, ওয়াক্ফ, দেবোত্তর প্রথা, লঙ্গরখানা ইত্যাদি। ধর্মীয় অনুপ্রেরণা এবং মানব প্রেমের প্রকৃষ্ট নিদর্শন স্বরূপ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথাগুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ এবং চিরায়ত প্রথা হিসেবে সমাজে প্রচলিত রয়েছে।
সনাতন সমাজকল্যাণ ধারা প্রধানত সেসব শ্রেণীর লোকদের সাহায্য করার প্রতি গুরুত্বারোপ করে, যারা নিজেদের দায়িত্ব বহনে অক্ষম। সনাতন সমাজকল্যাণ ব্যবস্থাগুলো সমগ্র জনগণের জন্য সাহায্যাদি বা সেবা প্রদান করে না।
আধুনিক সমাজকল্যাণ ধারাঃ শিল্প-বিপ্লবোত্তর সমাজের জটিল ও বহুমুখী সমস্যা মোকাবেলার লক্ষ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক সুসংগঠিত সমাজসেবা কার্যক্রম আধুনিক সমাজকল্যাণের পরিচয় বহন করছে। আধুনিক সমাজকল্যাণ বলতে পেশাদার সমাজকর্মকে বুঝায়। আধুনিক সমাজকল্যাণ বলতে, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, মানব হিতৈষী দর্শন এবং পেশাগত দক্ষতার ওপর ভিত্তিশীল সুসংগঠিত সমাজসেবা কার্যক্রমকে বুঝায়। সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং সামাজিক চাহিদা হলো আধুনিক সমাজকল্যাণের মূল চালিকাশক্তি। আধুনিক সমাজকল্যাণ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ওপর ভিত্তিশীল কতগুলো পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষকে সাহায্য করে, যাতে তারা তাদের সুপ্ত ক্ষমতার বিকাশ ও আওতাধীন সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে জীবনের সার্বিক অবস্থা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। আধুনিক সমাজকল্যাণের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও উচ্চতর দক্ষতা নির্ভর সাহায্যদানের সংগঠিত রূপ এবং সকল মানুষের সামগ্রিক কল্যাণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ। এতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল মানুষের সামগ্রিক কল্যাণের প্রতি সমান গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আধুনিক সমাজকল্যাণের এরূপ সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য একে সনাতন সমাজকল্যাণ ধারা হতে পৃথক সত্তা ও স্বকীয় মর্যাদা দান করেছে।
সনাতন সমাজকল্যাণের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য
সনাতন সমাজকল্যাণের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ হতে এগুলোর মধ্যে পার্থক্য থাকলেও সবগুলো উদ্দেশ্যই এক এবং অভিন্ন। আর তা হলো আর্তমানবতার সেবার মাধ্যমে ইহলৌকিক পাপ মোচন এবং পারলৌকিক পূণ্য অর্জন। এছাড়া লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলো হলো
ক. ধর্মীয় অনুশাসন ও মানব প্রেমের ভিত্তিতে সনাতন সমাজকল্যাণ কার্যক্রম পরিচালিত।
খ. সম্পদশালী দানশীল ও মানবহিতৈষী ব্যক্তির ইচ্ছানির্ভর অসংগঠিত এবং বিচ্ছিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম। সনাতন সমাজকল্যাণ ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং করুণা নির্ভর।
গ. আর্থিক সাহায্যদানের মাধ্যমে সমস্যার সাময়িক সমাধানের প্রচেষ্টা চালানো হয়।
পৃষ্ঠা ১২০
ঘ. সনাতন সমাজকল্যাণ কার্যক্রমে স্বাবলম্বনের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না।
ঙ. সাহায্য কার্যক্রমে বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান ও দক্ষতার অনুপস্থিতি।
চ. বিশেষ শ্রেণীর কল্যাণে ও সীমিত পরিসরে সনাতন সমাজসেবা কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়।
ছ. সনাতন সমাজকল্যাণ ধারায় বিচ্ছিন্ন ও অসংগতি সমাজসেবার পাশাপাশি সংগঠিত সমাজসেবারও উপস্থিতি রয়েছে। যেমন- যাকাত, বায়তুল মাল, ধর্মগোলা ইত্যাদি।
সনাতন সমাজকল্যাণ ও আধুনিক সমাজকল্যাণের সম্পর্ক
সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণ উভয়েই আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত দু’টি সাহায্যদান প্রক্রিয়া। উভয় সমাজকল্যাণ ধারার মধ্যে প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও কর্মপদ্ধতির দৃষ্টিকোণ হতে যেমন পার্থক্য রয়েছে, তেমনি কতিপয় ক্ষেত্রে সম্পর্কও রয়েছে। নিচে সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণের পারস্পরিক সম্পর্কের বিশেষ কিছু দিক উল্লেখ করা হলো।
ক. সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণ উভয়ের লক্ষ্য আর্ত মানবতার সেবার মাধ্যমে সমাজের কল্যাণ সাধন।
খ. সনাতন সমাজকল্যাণ যেমন সমাজসেবী ও মানবহিতৈষী ব্যক্তিদের নিঃস্বার্থ সেবামূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতার ওপর নির্ভরশীল; তেমনি আধুনিক সমাজকল্যাণ পেশাদার সমাজকর্মীদের নিঃস্বার্থ সেবামূলক মনোভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল।
গ. মানবহিতৈষী দর্শন এবং মানব প্রেম উভয় সমাজকল্যাণ ধারার সর্বজনীন ভিত্তি।
ঘ. আধুনিক সমাজকল্যাণের ব্যাপক পরিধিতে সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথা-প্রতিষ্ঠানগুলো সহায়ক ও পরিপূরক ভূমিকা পালন করছে।
ঙ. প্রাক-শিল্প যুগের সনাতন সমাজকল্যাণ ধারার ওপর ভিত্তি করেই শিল্প-বিপ্লবোত্তর সমাজের চাহিদা ও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক সমাজকল্যাণের বিকাশ।
পরিশেষে বলা যায়, সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণের মূল দর্শন সনাতন সমাজকল্যাণের গভীরে প্রোথিত। সর্বজনীন ধর্মীয় অনুশাসন ও মানবপ্রেমের ভিত্তিতে পরিচালিত সনাতন সমাজকল্যাণ ধারা আধুনিক সমাজকল্যাণের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সমজসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণের পার্থক্য
আধুনিক সমাজকল্যাণ বলতে পেশাদার সমাজকর্মকে বুঝানো হয়। সুতরাং পেশাদার সমাজকর্ম অর্থে আধুনিক সমাজকল্যাণ এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। সনাতন এবং আধুনিক সমাজকল্যাণের প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও কর্মপদ্ধতির প্রেক্ষাপটে উভয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। উভয়ের মৌলিক পার্থক্য হলো সনাতন সমাজকল্যাণ ধর্মীয় অনুশাসন ও মানবপ্রেমের ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যক্তির ইচ্ছানির্ভর অসংগঠিত সমাজসেবা কার্যক্রম এবং অন্যদিকে, আধুনিক সমাজকল্যাণ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, মানবহিতৈষী দর্শন এবং উচ্চতর পেশাগত দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল সাহায্যকারী পেশা। নিচে উভয় ধরনের সমাজকল্যাণের বিশেষ পার্থক্যগুলোর তুলনামূলক চিত্র উল্লেখ করা হলো-
সনাতন সমাজকল্যাণ | পেশাদার আধুনিক সমাজকল্যাণ |
১. পারস্পরিক প্রয়োজন, ধর্মীয় অনুশাসন ও মানবপ্রেমে অনুপ্রাণিত স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অসংগঠিত সমাজসেবা কার্যক্রম। ২. স্বাবলম্বন নীতি বর্জিত সাময়িক অর্থনির্ভর সাহায্যদান প্রক্রিয়া। যা মানুষকে অনেকক্ষেত্রে পরনির্ভরশীল ও পরমুখাপেক্ষী করে তুলে। ৩. বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও উচ্চতর দক্ষতারভিত্তিতে পরিচালিত না হওয়ায় স্থিতিশীল এবং কার্যকরভাবে সমস্যা সমাধানে অক্ষম। ৪. বস্ত্তগত সমস্যার প্রতিকারধর্মী সাময়িক সাহায্যদান প্রক্রিয়া ৫. সাধারণত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ৬. বিশেষ জ্ঞান ও পেশাগত দক্ষতার প্রয়োজন তেমন নেই। ৭. সমস্যাগ্রস্ত সাহায্যার্থীর সুপ্ত ক্ষমতার ও অন্তর্নিহিত সত্তা বিকাশের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয় না। ৮. সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় সাহায্যার্থীর অংশগ্রহণ ও সহযোগীতার সুযোগ নেই। ৯. এতে সাহায্য প্রার্থীর সঙ্গে পেশাগত সম্পর্কের পরিবর্তে দাতা ও গ্রহীতার সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। ১০. এটি অপেশাদার সমাজসেবা বিধায় পেশাগত নীতি ও মূল্যবোধ অনুসরণ হয় না। | ১. সামাজিক দায়িত্ব, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, মানবহিতৈষী দর্শন ও পেশাগত দক্ষতার ওপর ভিত্তিশীল সুসংগঠিত সমাজসেবা কার্যক্রম। ২. স্বাবলম্বন নীতির ভিত্তিতে সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালিত। স্বাবলম্বন অর্জনে মানুষকে সাহায্য করাই এর লক্ষ্য। ৩. সমস্যার স্থায়ী ও কার্যকর সমাধানে সদা সচেষ্ট। ৪. সমস্যা সমাধানের প্রতিকার, প্রতিরোধ ও উন্নয়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ৫. সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পেশাদার সমাজকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত। ৬. বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। ৭. অন্তর্নিহিত সত্তা বিকাশের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। ৮. সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়ে সমস্যাগ্রস্ত সাহায্যার্থীর অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়, যাতে সে তার ক্ষমতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয়। ৯. এতে সাহায্যার্থীর সঙ্গে পেশাগত সম্পর্ক স্থাপন এবং তা বজায় রাখার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। ১০. পেশাদারী সমাজসেবা হিসেবে সুনির্দিষ্ট পেশাগত নীতি ও মূল্যবোধ অনুসরণ করতে হয়। |
| |
আধুনিক সমাজকল্যাণে সনাতন সমাজকল্যাণের গুরুত্ব
আধুনিক সমাজকল্যাণের বিকাশে সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক সমাজকল্যাণের মূল দর্শন সনাতন সমাজকল্যাণের গভীরে প্রোথিত। শিল্প বিপ্লবের পর সৃষ্ট সমস্যা মোকাবেলায় সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথাগুলোর কার্যকারিতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। এমতাবস্থায় সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথাগুলোকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা হতে আধুনিক সমাজকল্যাণের বিকাশ। আধুনিক সমাজকল্যাণে সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথাগুলোর গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিচে আলোচনা করা হলো।
ক. আধুনিক সমাজকল্যাণের ভিত্তি ঃ প্রাক-শিল্প যুগের সনাতন সমাজকল্যাণ ধারণার ভিত্তিতে শিল্প-বিপ্লবোত্তর সমাজের চাহিদা ও প্রয়োজন মোকাবেলার লক্ষ্যে আধুনিক সমাজকল্যাণের উদ্ভব। পরিবর্তনশীল জীবন ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মানবকল্যাণের সনাতন প্রথাগুলোকে বিজ্ঞানসম্মত করে তোলার প্রচেষ্টা হতে আধুনিক সমাজকল্যাণের বিকাশ। আধুনিক সমাজকল্যাণের সর্বজনীন ভিত্তি হিসেবে সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথাগুলো স্বীকৃত।
খ. প্রাতিষ্ঠানিক সমাজকল্যাণ ধারা ঃ সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথাগুলো ব্যক্তিনির্ভর অসংগঠিত সমাজসেবা হলেও সংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক সমাজসেবার দৃষ্টান্তের উপস্থিতি এগুলোর মধ্যে লক্ষ্যে করা যায়। ওয়াকফ, দেবোত্তর, ধর্মগোলা, শ্রমাগার, এতিমখানা ইত্যাদি সনাতন প্রথাগুলোর মধ্যে সংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক সমাজসেবার দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। সমাজকল্যাণের বৃহত্তর ক্ষেত্রে এসব সংগঠিত সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথাগুলোর কার্যকর ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে।
গ. স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঃ সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথাগুলোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থা। জনকল্যাণের ঐতিহ্যগত দান প্রথার ভিত্তিতে পরিচালিত স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলো সমাজকল্যাণের বৃহত্তর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। দান প্রথার ভিত্তিতে গড়ে উঠে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো এতিম, প্রতিবন্ধী, প্রবীণ, অক্ষমদের মতো বিশেষ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক সেবা প্রদান করছে।
ঘ. পেশাদার সমাজকর্ম বিকাশের ভিত রচনা ঃ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে সনাতন সমাজসেবা কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন এবং সেগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় দান সংগঠন আন্দোলন গড়ে উঠে। যার ফল হিসেবে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হয় অসংখ্য দান সংগঠন সমিতি। দান সংগঠন সমিতিগুলো প্রচলিত সনাতন সমাজসেবার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল প্রয়োগ করে। দান সংগঠন সমিতির এরূপ প্রচেষ্টার ফলে পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশ ঘটে।
ঙ. সমাজকল্যাণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সৃষ্টি ঃ সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দান প্রথা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপ ও আমেরিকায় সামাজিকভাবে দান প্রথা দ্রুত প্রসার লাভ করে। এসময় উন্নত দেশের নেতৃস্থানীয় দানশীল ব্যক্তিদের অনুদানের ভিত্তিতে দুঃস্থ অসহায় মানুষের অবস্থা উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাহায্য সংস্থা গড়ে উঠে। অনুন্নত দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে সম্পদশালীদের
পৃষ্ঠা ১২১
প্রদত্ত অনুদানের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার বিকাশ ঘটে। রেডক্রস, অক্সফাম প্রভৃতি সাহায্য সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবকল্যাণে নিয়োজিত। এগুলো সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। মানবতাবোধ এবং ধর্মীয় অনুশাসন ও অনুপ্রেরণা হলো এসব আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর সর্বজনীন দার্শনিক ভিত্তি।
পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক সমাজকল্যাণের জ্ঞান, নীতি ও দক্ষতা প্রয়োগ করে দান, ওয়াক্ফ, দেবোত্তর, এতিমখানা ইত্যাদি সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথাগুলোকে পরিকল্পিত উপায়ে পরিচালনা করলে লক্ষ্যভুক্ত জনগোষ্ঠীর টেকসই এবং স্থিতিশীল উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
সনাতন সমাজকল্যাণের সীমাবদ্ধতা
ধর্মীয় অনুশাসন ও মানবপ্রেমের ভিত্তিতে পরিচালিত সনাতন সমাজকল্যাণ আর্ত-মানবতার সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এগুলোর কতগুলো দুর্বল দিক রয়েছে। আধুনিক সমাজকল্যাণের তুলনায় সনাতন সমাজকল্যাণের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার প্রধান দিকগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো।
১. অসংগঠিত ও বিচ্ছিন্ন সমাজসেবা কার্যক্রম : সনাতন সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা হলো অসংগঠিত ও বিচ্ছিন্ন সমাজসেবা কার্যক্রম। সনাতন সমাজসেবা কার্যক্রম ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল বিধায় আধুনিক শিল্প সমাজের জটিল সমস্যা মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
২. বদান্যতা নির্ভর সাহায্য কার্যক্রম : ধর্মীয় অনুশাসন ও মানবপ্রেমের অনুপ্রেরণায় পরিচালিত সনাতন সমাজকল্যাণ কার্যক্রম সম্পদশালী ও দানশীল ব্যক্তিদের বদান্যতার প্রতীক। এসব কার্যক্রমে দুঃস্থ-অসহায়দের কল্যাণের চেয়ে দাতার স্বার্থের প্রাধান্য অধিক পরিলক্ষিত হয়।
৩. সমস্যার সাময়িক সমাধান : বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং উচ্চতর পেশাগত দক্ষতার ভিত্তিতে পরিচালিত নয় বিধায় সনাতন সমাজকল্যাণ ব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রথা-প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সমস্যার সাময়িক সমাধানের প্রচেষ্টা চালানো হয়। পরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা সমাধানের অক্ষমতা সনাতন সমাজকল্যাণ ব্যবস্থার গুরুত্বপুর্ণ সীমাবদ্ধতা।
৪. স্বাবলম্বন নীতি বর্জিত সাহায্য কার্যক্রম : সনাতন সমাজকল্যাণ ব্যবস্থাগুলো স্বাবলম্বন নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত নয়। সাময়িক আর্থিক সাহায্যদানের মধ্যে সীমিত থাকায় এগুলো দরিদ্রদের মধ্যে প্রায়শঃ শ্রমবিমুখতা ও পরনির্ভরশীল মানসিকতা সৃষ্টি করে। সনাতন সমাজকল্যাণ কার্যক্রম সুবিধাভোগীদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ এবং স্বাবলম্বন স্পৃহা সৃষ্টির পরিপন্থী।
৫. সামগ্রিক কল্যাণ বিধানে অক্ষমতা : সনাতন সমাজকল্যাণের পরিধি সমাজের দুঃস্থ-অসহায়দের আর্থিক সমস্যা সমাধানের মধ্যে সীমিত। মানব জীবনের সকল সমস্যা যেমন এর পরিধিভুক্ত নয়, তেমনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ সকল মানুষের কল্যাণও এর অন্তর্ভুক্ত নয়। সকল মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ আনয়নে অক্ষমতা সনাতন সমাজকল্যাণের অন্যতম দুর্বল দিক।
৬. ব্যক্তিনির্ভর : সনাতন সমাজকল্যাণ প্রধানত ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা এবং উদ্যোগেই গৃহীত ও পরিচালিত হয়। সেজন্য সেবাদানকারী ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তা, চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর এসব কার্যক্রম নির্ভরশীল। সমাজসেবার ক্ষেত্রে এরূপ ব্যক্তিনির্ভর উদ্যোগ মানুষের সর্বজনীন কল্যাণের পরিপন্থী।
৭. বিশেষ শ্রেণীর কল্যাণ : সনাতন সমাজকল্যাণ ধারা সমাজের বিশেষ শ্রেণীর বস্ত্তগত কল্যাণে নিয়োজিত। সকল মানুষের কল্যাণের দিকটি এতে গুরুত্ব পায় না।
পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক শিল্প সমাজের জটিল ও বহুমুখী সমস্যা সমাধানে সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথাগুলো অক্ষম; বহুলাংশে অপারগ হলেও আর্তমানবতার কল্যাণে এগুলোর অবদান খাটো করে দেখা যায় না। দরিদ্র, অক্ষম ও অসহায় শ্রেণীর কল্যাণে এগুলো অদ্যাবধি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। আধুনিক সমাজকল্যাণের জ্ঞান, দক্ষতা ও কৌশল প্রয়োগ করা হলে সনাতন সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠানগুলো মানব কল্যাণে সুদূরপ্রসারী অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
সনাতন সমাজকল্যাণের দৃষ্টান্ত
দান |
পৃষ্ঠা ১২২
সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দান প্রথা অন্যতম। বিশ্বের সব সমাজে এবং সকল ধর্মে এর নিদর্শন পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন নামে দান প্রথা পরিচিত হলেও এর মূল লক্ষ্য হলো আর্ত-পীড়িত অসহায় মানুষের কল্যাণে সাহায্য করা। খ্রিস্ট ধর্মে ‘চ্যারিটি’, হিন্দু ধর্মে ‘দান’ এবং ইসলাম ধর্মে ‘খয়রাত’, ‘সাদকাহ’ প্রভৃতি দান প্রথার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
দান প্রথা কি ?
দানের ইংরেজি প্রতি শব্দ হলো ‘চ্যারিটি’ যা ল্যাটিন শব্দ চ্যারিটিয়েস হতে এসেছে। চ্যারিটিয়েস অর্থ হলো মানবপ্রেম। চ্যারিটি -র আক্ষরিক অর্থ হলো, লাভ ফর ওয়ান্স ফিলো হিউমেন্স ‘‘অসহায় ও সমস্যাগ্রস্ত মানুষের কল্যাণার্থে নিঃশর্তভাবে সাহায্য করার মাধ্যমে যে মানবপ্রেম প্রকাশ পায়, তাকে চ্যারিটি বা দান বলা হয়।’’
সমাজকর্ম অভিধানের সংজ্ঞানুযায়ী, যেসব জনগোষ্ঠী দুঃস্থ, তাদের জন্য দ্রব্য সামগ্রী ও নিঃস্বার্থ সেবা প্রদান হলো দান।
দান হলো নিঃশর্তভাবে অপরের কল্যাণে কোন কিছু স্বত্ব ত্যাগ করে প্রদান করার প্রথা। ধর্মীয় অনুশাসন এবং মানবপ্রেমের অনুপ্রেরণা দান প্রথার মূল ভিত্তি। সম্পদশালী এবং মানবহিতৈষী দানশীল ব্যক্তির ইচ্ছানির্ভর অসংগঠিত ও অপরিকল্পিত বৈষয়িক সাহায্য প্রদান হলো দান প্রথার প্রধান বৈশিষ্ট্য। দান প্রথার মূল লক্ষ্য আর্ত-পীড়িত, দুঃস্থ-অসহায় মানুষের কল্যাণে সাহায্য করা। ধর্মীয় অনুপ্রেরণা এবং মানবপ্রেমের সর্বজনীন আদর্শ মানুষকে দানশীল হতে উদ্বুদ্ধ করে। দান প্রথার মাধ্যমে মানুষ ইহলৌকিক প্রশান্তি এবং পারলৌকিক মুক্তি লাভের বাসনা চরিতার্থ করে।
দান প্রথার সীমাবদ্ধতা
সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথা হিসেবে দান প্রথা আর্ত-মানবতার সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও আধুনিক সমাজকল্যাণের দৃষ্টিকোণ হতে এর কতগুলো দুর্বল দিক রয়েছে। যেমন-
ক. দান প্রথা ব্যক্তির ইচ্ছানির্ভর বিচ্ছিন্ন ও অসংগঠিত সেবামূলক কার্যক্রম। অসহায় মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও করুণা প্রদর্শনের মাধ্যমে এর প্রকাশ ঘটে।
খ. দান প্রথা অসংগঠিত, বিচ্ছিন্ন এবং দানশীল ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল বলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান দেয়া যায় না।
গ. দান প্রথা বদান্যতানির্ভর বিধায় দাতার উদ্দেশ্যই এতে মুখ্য হয়ে দেখা দেয়। দান গ্রহীতার প্রয়োজন ও সমস্যার প্রতি কম গুরুত্ব দেয়া হয়।
ঘ. দান প্রথা স্বাবলম্বন নীতি বর্জিত বিধায় মানুষের কর্মস্পৃহা নষ্ট করে পরনির্ভরশীল মানসিকতা গড়ে উঠতে সাহায্য করে। এটি মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ ও ব্যক্তিত্ব গঠনের পরিপন্থী।
ঙ. দান প্রথা আর্থিক বা বৈষয়িক সাহায্যদানের মাধ্যমে সমস্যার সাময়িক সমাধান দেয় মাত্র।
সমাজকল্যাণে দান প্রথার গুরুত্ব
আধুনিক সমাজকল্যাণের দৃষ্টিতে দান প্রথার কিছু দুর্বলতা পরিলক্ষিত হলেও সমাজকল্যাণের বিকাশে এর অবদান অস্বীকার করা যায় না। দান প্রথার সহানুভূতি ও করুনাই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় ‘‘দান সংগঠন আন্দোলন’’ গড়ে উঠতে অনুপ্রেরণা যোগায়। যার ফলশ্রুতিতে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত সমাজকল্যাণ ধারার সূচনা হয়।
সামাজিক সমস্যা সমাধান, দুঃস্থ অসহায় মানুষের প্রয়োজন পূরণ এবং জনকল্যাণের ঐতিহ্যগত পদ্ধতি হলো দান প্রথা, যা ব্যক্তিগত দান, স্বেচ্ছা উদ্যোগ এবং অলাভজনক সংগঠনের কার্যক্রমের ওপর ভিত্তিশীল। অভাবগ্রস্তদের সাহায্য ও সেবা প্রদানে জনগণকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে সমাজের কল্যাণ সাধনের প্রচেষ্টা চালানো দান প্রথার মূল লক্ষ্য। দান প্রথা মানব ইতিহাসের মত সুপ্রাচীন সমাজসেবা প্রথা। মানুষের সহজাত মানবতাবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশাসন হলো দান প্রথার সর্বজনীন ভিত্তি। ইসলামের যাকাত ব্যবস্থা, খ্রিস্টধর্মের চ্যারিটি দান প্রথার বাস্তব দৃষ্টান্ত।
দান যেমন ব্যক্তিগত পর্যায়ে পরিচালিত হয়, তেমনি সংগঠনের মাধ্যমেও দুঃস্থ অসহায় মানুষের কল্যাণসাধন করে। এতিম, প্রতিবন্ধী, প্রবীণ, অক্ষম প্রভৃতি অসহায় শ্রেণীর মানুষের কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য কার্যক্রম দান প্রথার মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে দান প্রথার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে উঠেছিল। এ প্রসঙ্গে ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার দান সংগঠন সমিতির নাম বিশেষভাবে উলেখ করা যায়। দান সংগঠন সমিতি সমাজসেবার ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল প্রয়োগ করে। যার ফল হিসেবে পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশ ঘটে। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা সামাজিক দান প্রথা প্রভাবিত হলেও
পৃষ্ঠা ১২৩
বর্তমানে এটি ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক সংগঠন রয়েছে, যেগুলো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল দুঃস্থ অসহায় মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রয়েছে।
আধুনিক বিশ্বে দান প্রথার মাধ্যমে গড়ে উঠা সংগঠনসমূহ দুঃস্থ মানুষের জন্য উপার্জনশীল কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন ধরনের সাহায্য দিয়ে থাকে। সামাজিকভাবে দান সংগঠনগুলো প্রধানত সেসব শ্রেণীর লোকদের সাহায্য করে, যারা নিজেদের দায়িত্ব বহনে অক্ষম। সমাজের সব মানুষের কল্যাণ সাধনে দান সংগঠন নিয়োজিত নয়। ঐতিহ্যগতভাবে দান প্রথার ভিত্তিতে পরিচালিত সমাজসেবা কার্যক্রম অভাবী লোকদের যাদের মধ্যে রয়েছে প্রবীণ, অক্ষম, প্রতিবন্ধী, শিশুসহ বিভিন্ন দুঃস্থ অসহায় শ্রেণী, যারা নিজেদের দায়িত্ব গ্রহণে অক্ষম তাদের সাহায্য করে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে যখন ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশে দান প্রথা দ্রুত বিকাশ লাভ করে, তখন নেতৃস্থানীয় দানশীল ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় নিম্নশ্রেণীর জনগোষ্ঠীর অবস্থার উন্নয়নের জন্য সমাজসংস্কারের সূচনা হয়। সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যমে দুঃস্থ-অসহায় মানুষের কল্যাণ সাধনের প্রচেষ্টা শিল্পোন্নত সমাজে বিশেষ সাফল্য লাভ করে। তারই ধারাবাহিকতায় উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশের উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা বিকাশ লাভ করে। এসব এজেন্সীর মধ্যে অনেকগুলো বহুজাতিক সংগঠনের রূপ লাভ করে, যেমন- অক্সফাম। অনেকগুলো সাহায্য সংস্থা দুঃস্থ ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যে দ্রব্য সাহায্য ও সেবা প্রদানে নিয়োজিত। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে সমাজকল্যাণে সামাজিক উন্নয়ন পদ্ধতির উন্নতি ঘটে।
বাংলাদেশে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুশাসনে অনুপ্রাণিত হয়ে জনগণ প্রতি বছর স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ দান করে। সংগঠিত ও পরিকল্পিত উপায়ে এসব দান সংগ্রহ এবং বিনিয়োগ করা হলে, আর্তমানবতার কল্যাণে দান প্রথা বর্তমানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম। তাছাড়া আমাদের মতো অনুন্নত ও দরিদ্র দেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি অত্যন্ত সীমিত বলে দান প্রথা দুঃস্থ, অসহায় ও দরিদ্র শ্রেণীর সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
পৃষ্ঠা ১২৫
যাকাত
সনাতন সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যাকাত অন্যতম। যাকাত একদিকে ইসলামের মৌলিক এবাদত, অন্যদিকে কণ্যাণমুখী ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। সনাতন সমাজকল্যাণের সুসংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্য যাকাতের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠে।
যাকাত কি ?
আরবী ‘যাকাত’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ‘বৃদ্ধি’ এবং ‘পবিত্রতা’। যাকাত বিশ্বের একমাত্র ধর্মীয় বাধ্যতামূলক কর যা অন্যকোন ধর্মে নেই।
পবিত্রতা অর্থে যাকাত : মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই অর্থলিপ্সু ও কৃপণ স্বভাবের হয়ে থাকে। সে নিজের উপার্জিত সম্পদ নিঃস্বার্থভাবে অন্যকে দিতে চায় না। তাই আল্লাহর নির্দেশকে তার পার্থিব মোহের ওপর প্রাধান্য দিয়ে, অর্থ ব্যয় করলে একদিকে যেমন তার অন্তর কৃপণতা ও অর্থলিপ্সা হতে পবিত্র হয়, তেমনি তার সম্পদ কলুষমুক্ত হয়ে পবিত্র হয়। এ দৃষ্টিকোণ হতে যাকাত অর্থ পবিত্রতা।
বৃদ্ধি অর্থে যাকাত : সমাজে ধন-সম্পদের আবর্তন ও বিস্তার সাধনের লক্ষ্যেই ধনীদের ওপর যাকাত ফরয করা হয়েছে। সমাজের সম্পদশালী শ্রেণী যাকাত দান করে দরিদ্র ও অসহায় শ্রেণীর অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান ছাড়াও সমবেত প্রচেষ্টায় এবং পরিকল্পিত উপায়ে দরিদ্রদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এতে সম্পদ ধনী শ্রেণীর মধ্যে কুক্ষিগত না হয়ে সমাজের অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দরিদ্র ও দুঃস্থ শ্রেণীর অর্থাগমের ব্যবস্থা হয়। এদিক হতে যাকাত অর্থ বৃদ্ধি।
ইসলামী অর্থনীতির পরিভাষায়, ‘‘ঋণ ও যাবতীয় প্রয়োজন নির্বাহের পর নির্দিষ্ট পরিমাণ (নিসাব পরিমাণ) কোন অর্থ কারো নিকট পূর্ণ এক বছর যাবত সঞ্চিত থাকলে, তার নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর নির্দেশিত পথে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যয় করার বিধানই যাকাত।’’
অন্যভাবে বলা যায়, ‘‘ইসলামী শরীয়তের বিধান অনুযায়ী কোন মুসলমানের সম্পদ যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের পর বার্ষিক নির্দিষ্ট উদ্বৃত্ত থাকলে, নির্দিষ্ট হারে নির্দিষ্ট শ্রেণীর মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে বিতরণ করার বিধানই যাকাত।’’ পবিত্র হাদিস অনুযায়ী সঞ্চিত ধন সম্পদের ওপর পূর্ণ এক বছর ঘুরে না আসা পর্যন্ত যাকাতদান ফরজ হয় না।
যাকাত আদায়ের খাত : যাকাত মুসলিম সমাজের ধনীদের নিকট হতে আদায় এবং সে সমাজের দরিদ্রদের মধ্যে বন্টন করা হয়।
নিম্নোক্ত পাঁচ শ্রেণীর সম্পদের ওপর যাকাত দান ফরজ।
১. স্বর্ণ, রৌপ্য ও নগদ অর্থ ২. গৃহপালিত পশু ৩. উৎপন্ন ফসল ৪. ব্যবসায়িক পণ্য ৫. খনিজ দ্রব্য।
১. স্বর্ণ, রৌপ্য ও নগদ অর্থ :
ক. স্বর্ণ : যে কোনভাবে সাড়ে সাত তোলা (বিশ মিছকাল) স্বর্ণ জমা থাকলে, তার ওপর শতকরা আড়াই ভাগ স্বর্ণ বা সমপরিমাণ মূল্য যাকাত হিসেবে দান করা বাধ্যাতামূলক।
খ. রৌপ্য : যে কোন ভাবে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য থাকলে তার শতকরা আড়াই ভাগ বা সম-পরিমাণ মূল্য যাকাত হিসেবে দান করতে হবে।
যদি স্বর্ণ ও রৌপ্য উপরোক্ত পরিমাণ না থাকে, তাহলে উভয়ের পরিমাণ সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপের মূল্যের সমান হলে, তার ওপর যাকাত দেয়া বাধ্যতামূলক।
গ. নগদ অর্থ : নগদ অর্থ, ব্যাংক, বীমা প্রভিডেন্ট ফান্ড, বৈদেশিক মুদ্রা বা জমা অর্থের ওপর যাকাত দান ফরজ।
২. গৃহপালিত পশু : বংশ বৃদ্ধি বা লাভের উদ্দেশ্যে পশু পালন করলে গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার যাকাত দিতে হবে। গৃহপালিত পশুর সংখ্যার ওপর যাকাত নির্ধারিত হয়।
ক. প্রতি ৩০ টি গরু বা মহিষের জন্য একটি এক বছরের অধিক বয়সের বাছুর যাকাত দান ফরজ।
খ. প্রতি ৪০ টি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বার জন্য একটি এক বছর বয়সের ছাগল যাকাত হিসেবে দিতে হয়।
৩. উৎপন্ন ফসল : বিনা সেচে বা প্রাকৃতিক সেচের মাধ্যমে ফসল ফললে তার দশ ভাগের এক ভাগ এবং যান্ত্রিক সেচের ফলে উৎপন্ন ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দান ফরজ।
পৃষ্ঠা ১২৬
৪. ব্যবসায়িক পণ্য : ব্যবসায়িক পণ্য বা মূলধনের পরিমাণ সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের মূল্যের সমান হলে তার শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দান করতে হয়।
৫. খনিজ দ্রব্য : কোন জমিতে খনিজ দ্রব্য, গুপ্তধন বা অনুরূপ সম্পদ পাওয়া গেলে তা ব্যবহারের পূর্বে সাড়ে পাঁচ ভাগের এক ভাগ যাকাত হিসেবে দান করা ফরজ।
যাকাত ব্যয়ের খাত : পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘‘যাকাতের অর্থ দরিদ্র ও মিসকীনদের জন্য, যাকাত আদায়কারী কর্মচারীদের জন্য, ইসলামের প্রতি মন আকৃষ্ট করার জন্য, দাসত্ব মুক্তির জন্য, ঋণমুক্তির জন্য আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের জন্য ব্যয়িত হবে।’’ পবিত্র কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী যাকাত প্রাপ্যরা হচ্ছে- ১. ফকীর অর্থাৎ দরিদ্র ও নিঃস্ব শ্রেণী, ২. ইসলামের প্রতি মন আকৃষ্ট করার প্রয়োজনে এবং নব্য মুসলিম, ৩. দাসত্ব মোচনের জন্য, ৪. ঋণগ্রস্তদের ঋণমুক্ত করার জন্য, ৬. বিপদগ্রস্ত অর্থাৎ অভাবগ্রস্ত পথিক, ৭. যাকাত সংগ্রহকারী কর্মচারী ৮. যারা অর্থাভাবে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে অংশগ্রহণ করতে অক্ষম।
সমাজকল্যাণে যাকাতের গুরুত্ব
যাকাতের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক গুরুত্ব ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী। যাকাত দানের মাধ্যমে মানুষ পারস্পরিক ভাতৃত্ববোধ, সহানুভূতি, সহনশীল, মিতব্যয়িতা, সমাজের প্রতি কর্তব্য পালন সম্পর্কে সচেতনতা ইত্যাদি গুণাবলি অর্জন করে। এসব গুণাবলি সমাজ জীবনের সংহতি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। যাকাত সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ঘোষণা করেন, ‘‘যাকাত দেয়া প্রতিটি মুসলমানের জন্য যেমন একটি কর্তব্য, তেমনি যাকাত প্রাপ্যদের জন্য এটি একটি অধিকার। যাকাতের মাধ্যমে সামাজিক সংহতি ও সমন্বয় বজায় থাকে।’’ যাকাত দান ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়। এটি ইসলামে বাধ্যতামূলক।
যাকাতের বহুমুখী আর্থ-সামাজিক গুরুত্বের বিশেষ দিকগুলো নিচে আলোচনা করা হলোঃ
১. সম্পদের সুষম বন্টন : যাকাতের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রাপ্ত সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার সুষম বন্টনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। এতে সম্পদ সমাজের মুষ্টিমেয় লোকদের মধ্যে কুক্ষিগত হতে পারে না।
২. সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা : সামাজিক ক্ষেত্রে যাকাত দারিদ্রতা দূর করে সামাজিক সংহতি, প্রগতি ও উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার উত্তম পন্থা হলো যাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা।
৩. নৈতিক উন্নয়নে সহায়ক : যাকাত সম্পদশালীদের লোভ-লালসা এবং সম্পদ লাভের আকাঙ্খাকে অবদমিত করে। সমাজের অসহায়, বঞ্চিত ও নিঃস্ব শ্রেণীর কল্যাণে সম্পদশালীদের সচেতন করে তুলে। এভাবে যাকাত মানুষের নৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪. অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক : যাকাত মানুষের মধ্যে আল্লাহভীতি জাগ্রত করে। ফলে সমাজে অন্যায়-অবিচার ও শোষণের প্রবণতা হ্রাস পায়। এতে সমাজের শৃঙ্খলা বৃদ্ধি এবং সমাজে অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পায়।
৫. অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে : যাকাত অলস অর্থকে চালু বা গতিশীল করে। যাকাত ব্যবস্থা চালু থাকলে অলসভাবে অর্থ জমা এবং তা থেকে প্রতি বছর যাকাত দান করে জমানো টাকা হ্রাস করার প্রবণতা লোপ পায়। ফলে মানুষ স্বাভাবিকভাবে জমানো টাকা অলসভাবে ফেলে না রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হয়। এতে যেমন শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হয়, তেমনি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, বেকার সমস্যা হ্রাস, উৎপাদন বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ পুঁজি গঠন ইত্যাদি বহুমুখী অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
৬. দরিদ্রদের আর্থিক পুনর্বাসন : ইসলামী বিধান মোতাবেক পরিকল্পিত উপায়ে যাকাত সংগ্রহ এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে সমাজের অসংখ্য দরিদ্র শ্রেণীকে আর্থিক দিক দিয়ে পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।
পৃষ্ঠা ১২৭
৭. সামাজিক নিরাপত্তা : সমাজের দুঃস্থ অসহায় শ্রেণীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তা বিধানে যাকাতের বিকল্প নেই। যাকাতের মাধ্যমেই ইসলামী রাষ্ট্রে খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। যাকাত ব্যবস্থা বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
বাংলাদেশে যাকাতের গুরুত্ব
মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে ইসলামী বিধান মোতাবেক যাকাত সংগ্রহ এবং বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে দারিদ্র ও ভিক্ষাবৃত্তির মতো সমস্যা পর্যায়ক্রমে সমাধান করা সম্ভব। যাকাতের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে অভাবগ্রস্ত ব্যক্তির অভাব মোচন।
বাংলাদেশে কোন প্রকার বাধ্যবাধকতা ছাড়াই ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে মুসলমানগণ প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিচ্ছিন্নভাবে যাকাত হিসেবে দান করে থাকেন। সাধারণত অর্থ বন্টন নিম্নমানের বস্ত্রদানের মধ্যেই যাকাত প্রদান সীমিত থাকে। যাকাত সংগ্রহ এবং বিতরণের সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকায়, যাকাতের বিপুল পরিমাণ অর্থ দারিদ্র মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। (১৯৮৪ সালের এক হিসেবে দেখা যায় বাংলাদেশে সাদামাটাভাবে যাকাত আদায় করা গেলে নিচের খাতগুলো হতে বার্ষিক ৩৭৫ কোটি টাকা যাকাত বাবদ সংগ্রহ করা যায়। এ তথ্য অনেক আগের হলেও যাকাত বাবদ যে বিপুল ব্যয় হয় সে ধারণা এতে স্পষ্ট হয়ে উঠে। ধান-চাল বাবদ ১৫০ কোটি টাকা। পাট, আখ ও অন্যান্য অর্থকারী ফসল হতে ৫০ কোটি টাকা। স্বর্ণ ও নগদ অর্থ থেকে ১২৫ কোটি টাকা। ব্যবসায়ী পণ্য থেকে ৫০ কোটি টাকা। উপ-সম্পাদকীয় ঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ মে, ১৯৮৪।)
বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে যাকাত হিসেবে প্রদত্ত বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ এবং পরিকল্পিত উপায়ে দুঃস্থ অসহায়দের কল্যাণে বিনিয়োগ করা হলে দারিদ্রমুক্ত সমাজ গঠন অসম্ভব নয়। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকার এক অর্ডিন্যান্স জারি করে ‘‘জাতীয় যাকাত বোর্ড’’ গঠনের বিধান রেখেছে। যাকাত বোর্ডের মাধ্যমে দুঃস্থ অসহায়দের পুনর্বাসনে ঢাকার অদূরে টঙ্গীতে একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। যাকাত বোর্ডের কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণের মধ্যে তেমন আগ্রহ সৃষ্টি না হওয়ায় বোর্ড তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। জাতীয় যাকাত বোর্ডের প্রতি জনগণের আস্থা এবং চেতনতা সৃষ্টি করা গেলে বাংলাদেশে যাকাত দরিদ্র ও দুঃস্থদের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।
সদকা |
সদ্কা ইসলামী সমাজব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমাজসেবামূলক প্রথা। বিশ্বের সকল মুসলিম সমাজে সদ্কা সুদূর অতীত হতে প্রচলিত রয়েছে। সদ্কা যাকাতের মতো বাধ্যতামূলক নয়। সদকা ইসলামী শরীয়তের বিধান অনুযায়ী নফল ইবাদত।
সদ্কা কি?
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় সদ্কা দান প্রথারই বিশেষ রূপ। সৃষ্টির সেবার মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য লাভের উপায় হিসেবে মুসলমানগণ দুঃস্থ-অসহায় মানুষকে বৈষয়িক যা দান করে তা-ই সদ্কা। অন্যভাবে বলা যায়, নিজের অধিকারের ওপর অন্যের অধিকারকে প্রাধান্য দিয়ে কোন কিছু দান করার নামই সদ্কা। ইসলামে স্বেচ্ছায় দান এবং বাধ্যতামূলকভাবে প্রদত্ত দান উভয়কে সদ্কা হিসেবে বিবেচনা করা হয়্। তবে সদ্কা বলতে স্বেচ্ছায় আর্থিক সাহায্য প্রদানকেই বুঝানো হয়।
সনাতন সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা হিসেবে সদকার গুরুত্ব
সমাজের দুঃস্থ-অসহায় শ্রেণীর কল্যাণে সদ্কা প্রচলিত রয়েছে। সদ্কার মাধ্যমে সমাজের দুঃস্থ, অসহায় দরিদ্রদের প্রতি সম্পদশালীদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এজন্য ইসলাম ধর্মে সদ্কার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইসলামের বিধান মোতাবেক মানুষের দু’টি কর্তব্য রয়েছে। প্রথমত, স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য (হক্কুল্লাহ) এবং দ্বিতীয়ত, সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য (হক্কুল ইবাদ)। সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য পালনের মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য লাভের প্রধান উপায় সদ্কা বা দান।
পৃষ্ঠা ১২৮
ইসলামী সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ হতে সদকার গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিচে তুলে ধরা হলো-
প্রথমত, যাকাত হচ্ছে বাধ্যতামূলক দান। সাধারণত ফরজ আদায় করতে গিয়ে মানুষ যাকাত দিয়ে থাকে। যাকাতের সঙ্গে মানুষের আন্তরিকতা, ত্যাগের মনোভাব, সমবেদনা ইত্যাদি মহৎ গুণাবলি না-ও থাকতে পারে।
দ্বিতীয়ত, অনেক সময় সমাজে এমন অবস্থা বা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতে পারে, তখন শুধু যাকাতের অর্থে সে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব না-ও হতে পারে। এ অবস্থায় যদি মানুষ সাধারণ দানে উৎসাহিত না হয়, তাহলে সমাজের অধিকাংশ লোক ন্যূনতম মৌল চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়।
তৃতীয়ত, ধনী সম্প্রদায়ের ওপর যাকাত ব্যতীতও গরীবদের প্রতি অতিরিক্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, এ অনুভূতি সদ্কার মাধ্যমে জাগিয়ে তোলা যায়।
চতুর্থত, যাদের ওপর যাকাত ফরজ নয় অথচ তারা স্বচ্ছল, দরিদ্র ও দুঃস্থদের প্রতি তাদের যে কর্তব্য রয়েছে, সেটি সমাজকে স্মরণ করানোর জন্যই ইসলাম সদকা বা দানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে।
পরিশেষে বলা যায়, এমন অনেক সদ্কা রয়েছে যেগুলো সম্মিলিতভাবে সংগ্রহ ও বিতরণের ব্যবস্থা করা হলে সেগুলো সমাজের কল্যাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম। যেমন সাদাকাতুল ফিতর। এটি খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আদায় ও বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল্। ইমাম বুখারী (রঃ) লিখেছেন, ইসলামী খিলাফতের যুগে এ সদকা বায়তুল মালে জমা করে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী এলাকার গরীবদের মধ্যে বিতরণ করা হত। বর্তমানে বাংলাদেশে এ জাতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে, সদকার অর্থ গরীবদের কল্যাণে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
পৃষ্ঠা ১২৯
ওয়াক্ফ
সনাতন সমাজকল্যাণের প্রাতিষ্ঠানিক রূপের পরিচায়ক হলো ওয়াক্ফ। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ওয়াক্ফ। বর্তমান যুগেও সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
ওয়াক্ফ কি ?
আরবী শব্দ ‘ওয়াকফ’ এর শাব্দিক অর্থ হলো ‘আটক’। ইমাম আবু হানিফার (রঃ) মতে, ‘‘ওয়াক্ফ শব্দের অর্থ হলো কোন নির্দিষ্ট বস্ত্ততে ওয়াকিফ অর্থাৎ ওয়াক্ফকারীর মালিকানা আটক করে তার আয় দরিদ্রদের দান করা বা অন্য কোন সৎ উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা।’’
ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদের মতানুযায়ী ‘‘ওয়াক্ফ অর্থ উৎসর্গীকৃত বস্ত্ততে ওয়াক্ফকারীর মালিকানার পরিসমাপ্তি এবং তা আল্লাহর অন্তর্নিহিত মালিকানা দ্বারা আটক হওয়া, যাতে এর আয় মানব জাতির কল্যাণের জন্য নিয়োগ করা যেতে পারে।’’ ইসলামী বিধান অনুযায়ী, ‘‘কোন মুসলমান কর্তৃক তার সম্পত্তি বা সম্পত্তির কোন অংশ জনহিতকর বা ধর্মীয় কাজে স্থায়ীভাবে স্বত্ত্ব ত্যাগ করে দান করার প্রথাই ওয়াক্ফ।’’ এটি যাকাতের মতো বাধ্যতামূলক নয়। ওয়াক্ফের আইনগত ভিত্তি রয়েছে। এটি ইসলামী আইনে স্বীকৃত।
ওয়াক্ফের বৈশিষ্ট্য বা শর্ত
কোন মুসলমান কর্তৃক সম্পত্তি ওয়াক্ফ করার বৈশিষ্ট্য বা শর্তগুলো হলো-
১. ওয়াক্ফকারী সাবালক এবং সুস্থ মনের অধিকারী হতে হবে।
২. সম্পত্তি হস্তান্তর আইন অনুযায়ী সম্পত্তিতে ওয়াক্ফকারীর মালিকানা থাকতে হবে।
৩. ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে ওয়াক্ফ করতে হবে।
৪. ওয়াক্ফের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট হতে হবে।
৫. ওয়াক্ফ সম্পত্তি স্থাবর-অস্থাবর উভয়বিধ হতে পারে।
৬. ওয়াক্ফ সম্পত্তি বলতে মূল ওয়াক্ফ সম্পত্তি এবং তার আয়, বিক্রয় বা বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্জিত যে কোন সম্পত্তিকে বুঝায়।
ওয়াক্ফের শ্রেণী বিভাগ
প্রকৃতিগত দিক হতে ওয়াক্ফ দু’ধরনের হয়ে থাকে। ১. ওয়াক্ফ-ই-খায়রী ২. ওয়াক্ফ-ই-আহলী।
ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ হতে ওয়াক্ফকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
১. ওয়াক্ফ-ই-খায়রী, ২. ওয়াক্ফ-ই-আহলী, ৩. ওয়াক্ফ-ই-লিল্লাহ। নিচে এগুলোর সংজ্ঞামূলক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো-
১. ওয়াক্ফ-ই-খায়রী : যখন কোন মুসলিম তার সম্পত্তি বা সম্পত্তির আয় সম্পূর্ণরূপে কোন জনহিতকর বা জনকল্যাণকর কাজে দান করেন, তখন তাকে ওয়াক্ফ-ই-খায়রী বলা হয়। এ জাতীয় ওয়াক্ফ সম্পত্তির মাধ্যমে হাসপাতাল,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এতিমখানা প্রভৃতি কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়ে থাকে।
২. ওয়াক্ফ-ই-আহলী : যখন কোন ওয়াক্ফকারী তার বংশধর বা আত্মীয়-স্বজনদের কল্যাণে সম্পত্তি বা সম্পত্তির অংশবিশেষ ওয়াক্ফের মাধ্যমে দান করেন, তখন তাকে ওয়াক্ফ-ই-আহলী বলা হয়। আমাদের দেশে পিতৃ-মাতৃহীন নাতী-নাত্নীদের দাদা কর্তৃক এরূপ ওয়াক্ফ করা হয়।
৩. ওয়াক্ফ-ই-লিল্লাহ : যখন সম্পূর্ণ ধর্মীয় কাজে কোন মুসলমান তার সম্পত্তি ওয়াক্ফ করেন, তখন তাকে ওয়াক্ফ-ই-লিল্লাহ বলা হয়। মসজিদ, ঈদগাহ, কবরস্থান ইত্যাদি এ জাতীয় ওয়াক্ফের অন্তর্ভুক্ত।
পৃষ্ঠা ১৩০
ওয়াক্ফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা : এদেশের মুসলমান ওয়াক্ফ কার্যকর আইন ১৯১৩ সালের ৭, মার্চ ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তন করা হয়। বাংলাদেশে ওয়াক্ফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১৯৬২ সালে ওয়াক্ফ অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়।
ওয়াক্ফ সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক মোতাওয়ালী নামে পরিচিত। ওয়াক্ফের আইনগত ভিত্তি থাকায় ওয়াক্ফ সম্পত্তি বা প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিচালনার স্বার্থে সরকার প্রয়োজনবোধে হস্তক্ষেপ করতে পারেন। বাংলাদেশে সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে ওয়াক্ফ প্রশাসক সমুদয় ওয়াক্ফ এস্টেট ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে থাকে।
সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশে ওয়াক্ফের গুরুত্ব : বাংলাদেশের এতিম, দুঃস্থ, অসহায়দের রক্ষণাবেক্ষণ, শিক্ষা এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে অসংখ্য ওয়াক্ফ প্রতিষ্ঠান কর্মরত রয়েছে। এগুলো সমাজসেবা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে মোট ওয়াক্ফ এস্টেটের সংখ্যা ১,৫০,৫৫৩টি (১৯৮৬ সালের ওয়াক্ফ প্রশাসকের জরিপ অনুযায়ী)। ১৯৮৭ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিচালিত জরিপের তথ্যানুযায়ী দেশে এক লক্ষ ৫০ হাজার ৫৯৩টি ওয়াক্ফ এস্টেট রয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী ওয়াক্ফ এস্টেটের সংখ্যা দু‘লাখের মতো। এর মধ্যে মাত্র ১৫ হাজার ওয়াক্ফ প্রশাসকের তালিকাভুক্ত। স্বেচ্ছাপ্রদত্ত বিবরণ অনুয়ায়ী বার্ষিক আয় ৭ কোটি টাকার মতো (২৮শে ডিসেম্বর ১৯৯১. ধর্ম প্রতিমন্ত্রীয় তথ্য)। এসব ওয়াক্ফ এস্টেটের মধ্যে এতিমখানা, হাসপাতাল, স্কুল, মক্তব, মাদ্রাসা, মসজিদ, দরগাহ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশে ওয়াক্ফ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা, কদম মোবারক এতিমখানা, ইসলামীয়া চক্ষু হাসপাতাল, হামদর্দ ল্যাবরেটরীজ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আমাদের মতো দরিদ্র ও অনুন্নত দেশে সরকারি কার্যক্রমের সহায়ক হিসেবে ওয়াক্ফ প্রথা সমাজকল্যাণ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। দুঃস্থ, এতিম ও অসহায়দের সামাজিক নিরাপত্তা দানে ওয়াক্ফের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
অন্যদিকে ২০০১ সালের জুন মাসে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী দেশে ছোট বড় প্রায় তিন লাখ ওয়াক্ফ ষ্টেট রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১৯ হাজার বাংলাদেশ ওয়াক্ফ প্রশাসনের তালিকাভুক্ত রয়েছে। সরকারি তালিকাভুক্ত ১৯ হাজার ওয়াক্ফ এষ্টেটের লক্ষাধিক একর সম্পত্তি দীর্ঘদিন ধরে বেদখলে রয়েছে। বাংলাদেশে প্রধান ওয়াক্ফ এষ্টেটের মধ্যে রয়েছে ঢাকায় নওয়াব বাড়ী ওয়াক্ফ ষ্টেট, শাহজাদী ওয়াক্ফ এষ্টেট, আইনুদ্দীন হায়দার ও ফয়জুন্নেছা ওয়াক্ফ এষ্টেট, গোলাম রসুল ওয়াক্ফ এষ্টেট, চট্টগ্রামের বার আউলিয়া ওয়াক্ফ এষ্টেট, এরশাদ আলী ওয়াক্ফ এষ্টেট, সিলেটের খান বাহাদুর ওয়াক্ফ এষ্টেট অন্যতম। এসব এষ্টেটের কোনটির জমির পরিমাণ ১২ থেকে ২০ হাজার একরের মতো। এসব ওয়াক্ফ এষ্টেটের বিপুল পরিমাণ সম্পদ জোরপূর্বক ভোগদখল করায় ঐতিহ্যগত সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়াকফের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
দেবোত্তর |
সনাতন সমাজকল্যাণ প্রথাগুলোর মধ্যে হিন্দু ধর্মের দেবোত্তর প্রথা অন্যতম। দেবোত্তর প্রথার আইনগত ভিত্তি রয়েছে। এটি হিন্দু আইনে স্বীকৃত।
দেবোত্তর কি?
হিন্দু ধর্মের বিধান অনুয়ায়ী পাপমোচন,স্বর্গলাভ এবং ভগবানের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে দেবতা বা কোন বিগ্রহের নামে কোন হিন্দুর সম্পত্তি আংশিক বা সম্পূর্ণ উৎসর্গ করাকে দেবোত্তর বলা হয়। ধর্মীয় শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান, অনাথ আশ্রম, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ এবং মানব সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যেই সম্পত্তি দেবোত্তর প্রথায় উৎসর্গ করা হয়। দেবোত্তরের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হলো এমর্মে সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রদান যে, সম্পত্তিটি নির্দিষ্ট উদ্দ্যেশ্য পৃথক করে রাখা হয়েছে।
দেবোত্তরের শ্রেণীবিভাগ
হিন্দু ধর্মের বিধান অনুযায়ী দেবোত্তর দু’ধরনের হয়ে থাকে।
১. আংশিক দেবোত্তর এবং ২. সার্বিক দেবোত্তর।
পৃষ্ঠা ১৩১
১. আংশিক দেবোত্তর : কোন বিশেষ উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যে সাময়িকভাবে সম্পত্তি উৎসর্গ করার প্রথাই আংশিক দেবোত্তর। এ জাতীয় দেবোত্তর সাধারণত দেবোত্তরকারীর পরিবার পরিজনদের মধ্যে সীমিত থাকে। আংশিক দেবোত্তর সম্পত্তির দেখাশুনার জন্য দেবোত্তরকারী কর্তৃক সেবায়েত নিয়োগ করা হয়ে থাকে।
২. সার্বিক দেবোত্তর : ধর্মীয় জনহিতকর কাজে স্থায়ী সম্পত্তি দান করাকে হিন্দু ধর্মের বিধান অনুযায়ী সার্বিক দেবোত্তর বলা হয়। সার্বিক দেবোত্তর সম্পত্তি দেখাশুনার জন্য সরকার মনোনীত সেবায়েত নিয়োগ করা হয়।
বাংলাদেশে দেবোত্তর সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা : দেবোত্তর হিন্দু আইনে স্বীকৃত। হিন্দু আইন অনুযায়ী এটি পরিচালিত। দেবোত্তর সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনকারীকে সেবায়েত বলা হয়। আইনি প্রয়োজন ব্যতীত কোন সেবাইত দেবোত্তর সম্পত্তি হস্তন্তর করতে পারে না। বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে ওয়াক্ফ প্রশাসক দেবোত্তর সম্পত্তির সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। দেবোত্তর সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের কোনরূপ জটিলতা দেখা দিলে ওয়াক্ফ প্রশাসক হস্তক্ষেপ করতে এবং সম্পত্তির সরকারি পর্যায়ে সেবায়েত নিয়োগ করতে পারেন। অসদাচরণের জন্য সেবাইতকে অপসারণ করা যেতে পারে। আদালত তাকে হিসাব উপস্থাপনের জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।
সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেবোত্তর প্রথার তাৎপর্য ও গুরুত্ব
হিন্দু ব্যক্তি কোন বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা ও পূজা, ব্রাক্ষণ বা দরিদ্রভোজন এবং দুর্গোপূজার মতো ধর্মীয় উৎসব ইত্যাদি ধর্মীয় দাতব্য উদ্দেশ্যে সম্পত্তি দান করেন। হিন্দু অধ্যুষিত ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষা, চিকিৎসা, উপাসনালয় এবং অসহায় দুঃস্থদের কল্যাণে প্রাচীনকাল হতে দেবোত্তর প্রথা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। দেবোত্তর সম্পত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা, অনাথ আশ্রম ভারত এবং বাংলাদেশে ধর্ম ও কর্মের সমন্বয় সাধন করে সমাজ সেবায় নিয়োজিত রয়েছে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র ও সমস্যা জর্জরিত দেশে সনাতন সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেবোত্তর প্রথার তাৎপর্য ও গুরুত্ব সমাজকল্যাণে আজও বিদ্যামান। সমাজকল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক সেবা কার্যক্রম পরিচালনায় দেবোত্তর প্রথার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি হিন্দু ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজসেবামূলক প্রথা।
বায়তুল মাল |
আরবে খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে প্রচলিত সনাতন সমাজকল্যাণের সুসংগঠিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্যের স্বাক্ষর বহন করছে বায়তুল মাল। বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকদের সার্বিক কল্যাণ ও নিরাপত্তা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসাবে স্বীকার করে নেয়া হয়। খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থার মাধ্যমে বায়তুলমাল বিশ্বের প্রথম কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মডেল উপস্থাপন করেছে।
বায়তুল মাল কি?
আরবী ‘‘বায়ত’’ শব্দের অর্থ ‘ঘর’ বা ‘আগার’ এবং ‘মাল’ শব্দের অর্থ সম্পদ। সুতরাং বায়তুলমালের শাব্দিক অর্থ হলো সম্পদাগার। সাধারণত রাষ্ট্রীয় কোষাগারকেই বায়তুলমাল বলা হয়। মূলতঃ বায়তুল মাল বলতে ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা সরকারি তহবিলকে বুঝায়। বায়তুলমাল ইসলামী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় জনকল্যাণের লক্ষ্যে গঠিত একটি মৌলিক প্রতিষ্ঠান। জনকল্যাণ এবং ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনাদি পূরণের জন্য বায়তুলমাল গঠিত।
বায়তুল মালের পটভূমি
হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে সর্বপ্রথম বায়তুল মাল বাস্তব রূপ লাভ করলেও মদীনায় প্রথম যেদিন ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়, সেদিন হতেই বায়তুল মালের সূচনা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে বায়তুল মালের কোনরূপ ধন সম্পদ সঞ্চিত রাখার অবকাশ ছিল না। কারণ তখন রাষ্ট্রের এবং সাধারণ নাগরিকদের প্রয়োজনের তুলনায় ধনসম্পদ অত্যন্ত নগণ্য ছিল বলে, সম্পদ হস্তগত হবার সঙ্গে সঙ্গে নবী করিম (সঃ) অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। এ সম্পর্কে নবী করিম (সঃ)-এর বাণী হচ্ছে-
পৃষ্ঠা ১৩২
‘‘আমি তোমাদিগকে দানও করি না, নিষেধও করি না, আমি তো বন্টনকারী মাত্র। আমাকে যেরূপ আদেশ করা হয়েছে, আমি সেভাবেই জাতীয় সম্পদ বন্টন করে থাকি।’’
হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর আমলেও জাতীয় প্রয়োজনের তীব্রতা হেতু বায়তুল মালে ধন-সম্পদ জমা হতো না। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের (রাঃ) আমলে বায়তুল মালে প্রচুর সম্পদ জমা হতে থাকে। ফলে প্রদেশগুলোতে বায়তুলমাল স্থাপিত হয়। এ সময়ে বায়তুলমাল একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বায়তুল মালের আয়-ব্যয় ইসলামের বিধান মোতাবেক পরিচালিত হত। ইসলামী রাষ্ট্রে বায়তুলমাল ছিল কিন্তু বর্তমানে এব্যবস্থা বিশ্বের কোথাও প্রচলিত নেই।
বায়তুল মালের আয়ের উৎস
বায়তুলমালে যেসব খাত হতে সম্পদ জমা হতো সেগুলো হচ্ছে-
ক. মুসলমানদের ভূমি রাজস্ব ও খনিজ সম্পদের রয়ালটি।
খ. বিনাযুদ্ধে প্রাপ্ত ধনসম্পদ, গণিমাতের মাল, অমুসলিমদের অধিকারভুক্ত জমির খাজনা।
গ. দেশের সমষ্টিগত প্রয়োজন পূরণের জন্য আদায়কৃত চাঁদা বাবদ লব্ধ অর্থ।
ঘ. মালিক বা উত্তরাধিকারবিহীন ধনসম্পত্তি।
ঙ. অমুসলিম নাগরিকদের কাছ থেকে আদায়কৃত জিজিয়া কর ইত্যাদি।
বায়তুলমালের ভূমিকা
বায়তুলমাল রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সম্পত্তি। এতে সঞ্চিত সম্পদে ইসলামী রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমান অধিকার স্বীকৃত। বায়তুল মালের সঞ্চিত সম্পদের ওপর একজন অন্যজন অপেক্ষা অধিক অধিকার লাভের দাবী করতে পারে না। ইসলাম ধর্মের বিধানের আওতায় বায়তুল মালের ব্যয় বন্টিত হত। নিচে বায়তুল মালের প্রধান ভূমিকা উল্লেখ করা হলো-
ক. ইসলামী রাষ্ট্রের কোন একজন যাতে মৌলিক চাহিদা পূরণ হতে বঞ্চিত না হয়, তার ব্যবস্থা করা বায়তুলমালের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব।
খ. বায়তুলমালের মাধ্যমেই জনগণের কল্যাণ ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব বলে স্বীকার করে নেয়া হয়।
গ. সরকারী কর্মচারীগণ নিজেদের চাকরির জামানতে বায়তুলমাল হতে বিনাসুদে ঋণ গ্রহণ করতে পারত। বস্ত্তত ঋণদান সমিতির ইতিহাসে ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালই সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠান।
ঘ. যাকাতের অর্থে নির্দিষ্ট আট শ্রেণীর জনগণের চাহিদা পূরণ না হলে, বায়তুলমাল হতে সাহায্য করা হতো।
ঙ. জনগণের নিজ নিজ প্রয়োজন পূরণের জন্য যেমন বিনাসুদে ভোগ্য ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হত; তেমনি উৎপাদনকারী কার্যে বিনিয়োগের জন্য খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে বায়তুলমাল হতে উৎপাদন ঋণ দেয়া হতো।
সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা হিসেবে বায়তুলমালের তাৎপর্য
বায়তুল মালের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের উলেখযোগ্য দিকগুলো এখানে আলোচনা করা হলো-
১. রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে জনকল্যাণ : সংগঠিত ও পরিকল্পিত উপায়ে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে জনগণের কল্যাণ সাধনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বায়তুলমাল। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা বায়তুলমালের দর্শনের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে বায়তুলমাল একদিকে দুঃস্থ, অসহায়, অক্ষম দরিদ্রদের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, অন্যদিকে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে এবং রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তা দানের মাধ্যমে সবশ্রেণীর জনগণের কল্যাণ সাধনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বায়তুলমাল ব্যবস্থাই খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে ইসলামী রাষ্ট্রকে বিশ্বের প্রথম কল্যাণ রাষ্ট্রের মডেল হিসেবে উপস্থাপন করে। কারণ বর্তমান কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার বৈশিষ্ট্যের সবগুলো পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করে বায়তুল মাল ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
পৃষ্ঠা ১৩৩
২. দরিদ্র আইন ও নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রদর্শক : বিশ্বের সকল দরিদ্র আইন এবং নিরাপত্তা কর্মসূচীর পথ প্রদর্শক এবং ভিত্তি হিসেবে বায়তুলমালকে আখ্যায়িত করা যায়। বায়তুলমালের আদর্শ ও দর্শনের ভিত্তিতেই পৃথিবীর সবদেশে জণকল্যাণ বিভাগগুলো পুরোপুরি না হলেও আংশিকভাবে বায়তুল মাল ব্যবস্থার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
৩. সামাজিক নিরাপত্তা : বায়তুলমাল ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও পরিচালনায় সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করে বায়তুলমাল।
৪. অর্থনৈতিক উন্নয়ন : অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে কোন রাষ্ট্রের জনকল্যাণের অপরিহার্য উপাদান। বায়তুল মাল হতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে উৎপাদন ঋণ প্রদানের ব্যবস্থার মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করে। অর্থনৈতিক উৎপাদনে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য বায়তুল মাল হতে উৎপাদনী ঋণ দেয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হয়।
৫. মৌল চাহিদা পূরণে সুদমুক্ত ঋণ : নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারী, যারা নিজ আয়ে আর্থিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে অক্ষম হতো, তাদেরকে চাকুরীর জামানতে সুদমুক্ত ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সুদ মুক্ত ভোগ্য ঋণ নিম্ন শ্রেণীর মৌল চাহিদা পূরণ ও আর্থিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। ইসলামী রাষ্ট্রে কোন একজন নাগরিক যাতে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ হতে বঞ্চিত না হয়, তার ব্যবস্থা করে বায়তুল মাল।
৬. সম্পদের সুষম বন্টন : বায়তুল মাল রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করে। ফলে অর্থ নৈতিক বৈষম্যজনিত সমস্যা থেকে সমাজ মুক্ত হয়।
৭. মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা : বায়তুল মাল ব্যবস্থা ইসলামী রাষ্ট্রে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্রীয় সম্পদে সকল নাগরিকের সমান অধিকার এরূপ সর্বজনীন সত্যের ভিত্তিতে বায়তুল মালের সার্বিক কার্যাবলী পরিচালিত হতো। এরূপ সমানাধিকার নীতি প্রবর্তিত হওয়ায় সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়, যা সকল নাগরিকের মানবাধিকার সংরক্ষণ করে।
৮. জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা : রাষ্ট্রীয় সুশাসন প্রতিষ্ঠার পূর্ব শর্ত হলো রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীর ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার নীতি প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আর্থিক আয় ব্যয়ের ক্ষেত্রে এরূপ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার গুরুত্ব অপরিসীম। বায়তুল মালের সার্বিক কার্যাবলী জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় বা অপব্যবহারের কোন সুযোগ ছিল না। কল্যাণমুখী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য উপাদান হলো এরূপ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশে দরিদ্র শ্রেণী, নিম্ন বেতনভুক্তকর্মচারী ও ক্ষুদ্র কৃষকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং ঋণ সমস্যা সমাধানে বায়তুল মাল ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। এদেশের ধর্মভীরু মুসলমানগণ প্রতি বছর সদকা, যাকাত, ফেতরা, দান, কোরবানীর চামড়া ইত্যাদি খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে। এসব অর্থ সংগ্রহ করে বায়তুল মালের মতো তহবিল সৃষ্টি করা গেলে ভিক্ষাবৃত্তি, পতিতা পুনর্বাসন, অক্ষম প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসন ইত্যাদি সমস্যার সমাধান অনেকাংশে সম্ভব। বায়তুলমালের আদর্শ ও নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত সেবামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজের বৃহত্তর কল্যাণ সাধন সম্ভব। সুতরাং সমাজকল্যাণ প্রথা হিসেবে বায়তুলমালের ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
পৃষ্ঠা ১৩৪
ধর্মগোলা
ধর্মগোলা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সনাতন সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান। বৃটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৃটিশ প্রবর্তিত দ্বৈতশাসন ও কুখ্যাত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং বিশ্বযুদ্ধজনিত কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করার লক্ষ্যে ধর্মগোলা গঠন করা হয়। স্থানীয় পর্যায়ে দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যাভাব মোকাবেলার মহান লক্ষ্যে ধর্মগোলা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
ধর্মগোলা কি?
ধর্মগোলা হলো একটি বিশেষ ভান্ডার, যাতে মওসুমের সময় স্থানীয় ভিত্তিতে উদ্বৃত্ত শস্য সংগ্রহ করে মজুদ রাখা হত এবং দুর্ভিক্ষ বা খাদ্যাভাব দেখা দিলে দুর্গতদের মধ্যে তা বিতরণ করা হতো। অনেক সময় খাদ্যশস্য বিনাসুদে ঋণ হিসেবে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হতো এবং মওসুমের সময় তা পরিশোধ করে দিতে হতো। দুর্ভিক্ষ ও আপতকালীন সময়ে অনাহারে অকাল মৃত্যু রোধ করাই ছিল ধর্মগোলার মূল লক্ষ্য।
ধর্মগোলার পটভূমি
বৃটিশ শাসিত ভারতে বিভিন্ন সময়ে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে লক্ষ লক্ষ লোক অনাহারে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ব্রিটিশ প্রবর্তিত দ্বৈত-শাসন ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজনিত কারণে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায়শ দুর্ভিক্ষ দেখা দিত। এর মধ্যে ১৭৭০ সালের (বাংলা ১১৭৬ সাল) এবং ১৯৪২-৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। কুখ্যাত ‘‘ছিয়াত্তরের মম্বন্তর’’ নামে পরিচিতি ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষে এদেশের এক-তৃতীয়াংশ লোক অনাহারে ও পীড়ায় মৃত্যুবরণ করে। ১৯৪২-৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এদেশে দুর্ভিক্ষ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিল। দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা থেকে মানুষকে রক্ষা করার চিন্তা ভাবনা থেকেই ধর্মগোলার সৃষ্টি। দুর্ভিক্ষ ও আপতকালীন সময়ে অনাহারে অকাল মৃত্যু রোধ করার লক্ষ্যে ১৯৪২-৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ধর্মগোলা গড়ে তোলা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজনিত খাদ্য সমস্যার মোকাবেলা করার জন্য জেলা ও মহকুমা কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে ইউনিয়ন বোর্ডগুলো ধর্মগোলা গঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। জনগণের নির্বাচিত ‘গ্রামীণ ফুড কমিটি’ ধর্মগোলার সার্বিক দায়িত্ব পালন করত। থানা সার্কেল অফিসার এবং ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টগণ ধর্মগোলা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করতেন।
সমাজকল্যাণে ধর্মগোলার গুরুত্ব
ধর্মগোলা একটি বিশেষ শস্যভান্ডার হিসেবে বিবেচিত হলেও, সমাজকল্যাণে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অস্বীকার করা যায় না। সমাজকল্যাণে ধর্মগোলা ধারণাটির তাৎপর্য বিভিন্ন দিক হতে আলোচনা করা হলো-
১. সমাজকল্যাণ নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ : ধর্মগোলা ছিল একটি সমষ্টিগত শষ্যভান্ডার। যা জনগণের পারস্পরিক সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মগোলা তদানীন্তন দুর্ভিক্ষ ও তীব্র খাদ্য সমস্যা মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ‘‘স্থানীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সমস্যার মোকাবেলা’’ এ নীতির ওপর ভিত্তি করে ধর্মগোলার উদ্ভব। যা আধুনিক সমাজ কল্যাণেরও অন্যতম দর্শন বা নীতি হিসেবে স্বীকৃত। বর্তমানে
পৃষ্ঠা ১৩৫
ধর্মগোলা না থাকলেও সরকারি উদ্যোগে ধান সংগ্রহ অভিযানকে পরিমার্জিত বা আধুনিক রূপ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
২. স্থানীয় উদ্যোগে সমস্যা নিয়ন্ত্রণ : অবিভক্ত বাংলার সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ধর্মগোলা ধারণাটির গুরুত্ব আজও বিদ্যমান। বাংলাদেশে বিরাজমান খাদ্য সমস্যার সমাধান বাহ্যিক সাহায্যের মাধ্যমে দেয়া সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন স্থানীয় উদ্যোগকে সংগঠিত করা। স্থানীয় উদ্যোগে ধর্মগোলার মতো প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে খাদ্য সমস্যার মোকাবেলায় ধর্মগোলার গুরুত্ব অপরিসীম। সুতরাং সরকারি তত্ত্বাবধানে সুষ্ঠু নীতিমালার ওপর ধর্মগোলার মতো প্রতিষ্ঠান গঠন করা গেলে আজও এটি খাদ্য সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম।
৩. খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা : যেকোন প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট দুর্যোগকালীন সময়ে খাদ্য সমস্যা মোকাবেলার লক্ষ্যে আপতকালীন শস্যভান্ডার গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে প্রচলিত খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ধর্মগোলার ধারণা ও নীতি অনুসরণ করা যায়।
৪. কৃষকদের ঋণদানের সহজ ব্যবস্থা : বাংলাদেশের পল্লীর কৃষকদের বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তীক কৃষকদের প্রধান সমস্যা হলো উৎপাদনী মূলধনের অভাব। এজন্য কৃষি মৌসুমে গ্রামীণ কৃষকরা উচ্চ সুদের হারে ঋণ গ্রহণ করে। ফসল কাটার পর এসব ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে তারা নিঃস্ব হয়ে পড়ে। ধর্মগোলার মতো প্রতিষ্ঠান এরূপ সমস্যা মোকাবেলায় কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে। ধর্মগোলার মতো প্রতিষ্ঠান হতে সহজ শর্তে কৃষি ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা গেলে কৃষি উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
৫. সামাজিক দায়িত্ববোধ সৃষ্টি : ধর্মগোলা শুধু আপতকালীন খাদ্যসমস্যা মোকাবেলার ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, এ ব্যবস্থা সম্পদশালী ও ধনী কৃষকদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে। সুযোগ ও বিপদকালীন সময়ে এলাকায় জনগণের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে উৎসাহিত করতে ধর্মগোলা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সম্পদশালী কৃষকগণ তাদের উদ্বৃত্ত শস্য ধর্মগোলায় জমা করতে গিয়ে তাদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ জন্ম নেয় ও সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
লঙ্গরখানা |
যেসব সনাতন সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান আধুনিক যুগেও দুর্গত মানবতার সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে লঙ্গরখানা অন্যতম। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক সংঘাতের শিকার বা দুর্ভিক্ষ কবলিত অনাহারক্লিষ্ট দুর্গত মানুষকে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য লঙ্গরখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়।
লঙ্গরখানা কি?
সাধারণত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ভিক্ষ কবলিত দুর্গত মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্রসামগ্রী সরবরাহের জন্য যে অস্থায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে, তাকে লঙ্গরখানা বলা হয়। দুর্ভিক্ষ, খাদ্যাভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতি কারণে যখন মানুষের নূন্যতম জীবনধারণ ব্যাহত হয়, তখন জরুরী ভিত্তিতে খাদ্য ও পানীয় বিনামূল্যে সরবরাহের জন্য যে অস্থায়ী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়, তা-ই লঙ্গরখানা নামে পরিচিত। দুর্গত ও অনাহারক্লিষ্ট অভুক্তদের অকাল মৃত্যুর হাত হতে রক্ষা করাই এর মূল লক্ষ্য।
পৃষ্ঠা ১৩৬
লঙ্গরখানার গুরুত্ব
মধ্যযুগে দুর্গত ও বিপদগ্রস্ত পথিকদের সাহায্যের জন্য ফকির, দরবেশ ও ধর্মপ্রচারকদের খানকার এবং সন্ন্যাসীদের আশ্রমের নিকট লঙ্গরখানা খোলা হতো। দুর্ভিক্ষ পীড়িত, অসহায়, দুঃস্থ এবং বিপদগ্রস্তদের জন্য ফিরোজ শাহ তুঘলক, শেরশাহ প্রমুখ প্রজাহিতেষী শাসকগণ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে লঙ্গরখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বৃটিশ শাসনামল হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট সঙ্কটকালীন সময়ে লঙ্গরখানা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী জলোচ্ছাস, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্বাস্তুদের জীবন রক্ষা ১৯৭৪ সালের বন্যা ও দুর্ভিক্ষের সময় এবং প্রতি বছর প্রলয়ংকরী বন্যার সময় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে স্থাপিত লঙ্গরখানা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট অনাহারী অভুক্ত মানুষদের জরুরী ভিত্তিতে খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে লঙ্গরখানার বিকল্প নেই। চরম ক্ষুধা এবং নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে থাকার আশার আলো দান করে লঙ্গরখানা। তাই সনাতন সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আজও লঙ্গরখানার গুরুত্ব সমভাবে অনুভূত হয়ে আসছে।
সরাইখানা |
সনাতন সমাজকল্যাণের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হলো সরাইখানা। মধ্যযুগে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা মোটেও উন্নত ছিল না। পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যাতায়াত করতে হতো। এছাড়া বিপদ সঙ্কুল পথে যাতায়াত করতে হতো বলে পথিকদের রাত্রিযাপন, বিশ্রাম, খাওয়া-দাওয়া এবং অসুস্থতার জন্য আশ্রয়স্থলের প্রয়োজনীয়তা অনুভত হওয়ায় সরাইখানা স্থাপন করা হয়।
সরাইখানার অর্থ
প্রাচীন ও মধ্যযুগের পথিক এবং পর্যটকদের বিনামূল্যে আশ্রয়, খাদ্য, পানীয় সরবরাহের জন্য সরকারী-বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত সাময়িক আশ্রয় কেন্দ্রকে সরাইখানা বলা হয়। পথিক ও পর্যটকদের রাত্রিযাপন, থাকা-খাওয়া এবং অসুস্থতায় সেবা প্রদানের লক্ষ্যে সরাইখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সরাইখানার ভূমিকা
মধ্যযুগের ফকির-দরবেশ, ধর্মপ্রচারক এবং প্রজাদরদী শাসকগণ পথিক ও ভক্তদের সুবিধার্থে সরাইখানা স্থাপন করতেন। এগুলো হুজরাখানা ও মুসাফিরখানা নামে পরিচিত। এসব সরাইখানায় বিনা খরচে খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম ও অসুস্থদের সেবাদানের ব্যবস্থা করা হতো। ইসলাম ধর্মের প্রচারকগণ তাদের খানকার পাশে সরাইখানা নির্মাণ করে নব্যমুসলিমদের আশ্রয়দানের ব্যবস্থা করতেন। শেরশাহ নির্মিত গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের পাশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় হিন্দু-মুসলমানদের জন্য পৃথক সরাইখানা পথিকদের সুবিধার্থে নির্মাণ করা হয়ে ছিল।
আধুনিক বিশ্বে সরাইখানা না থাকলেও সরাইখানার অনুকরণে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোকে সরাইখানার পরিমার্জিত বা আধুনিক সংস্করণ বলা যায়। যেমন-পর্যটকদের জন্য নির্মিত আবাসিক হোটেল, সার্কিট হাউস, রেস্ট হাউজ ইত্যাদি। এগুলোর মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে সরাইখানাতে বিনা খরচে খাদ্য, আশ্রয় ও সেবাদানের ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু বর্তমানে এ জাতীয় সেবাদান হ্রাসকৃত মূল্যে এবং অনেকটা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত হয়ে থাকে। সরাইখানার মূল চালিকা শক্তি মানবপ্রেম তথা মানবিকতাবোধ। পক্ষান্তরে, বর্তমানে সরাইখানার মতো
পৃষ্ঠা ১৩৭
প্রতিষ্ঠাগুলোর মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে আংশিক সহযোগিতা এবং অলাভজনক বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতি। এগুলোর বেশিরভাগ সরকারি কর্মকর্তা, পরিদর্শক এবং পর্যটকদের সেবা প্রদানে নিয়োজিত।
এতিমখানা |
সনাতন সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে অসহায় পরিত্যক্ত এতিম শিশু-কিশোরদের রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে এতিমখানা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বিশ্বের সব দেশেই প্রাচীনকাল হতে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজের সম্পদশালী শ্রেণী ও ধর্মপ্রাণ মনীষীগণ এতিমখানা বা অনাথ আশ্রম পরিচালনা করে আসছেন। এতিমখানা হলো শিশুকল্যাণে নিয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।
এতিমখানা কি?
এতিমখানা এমন একটি সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান যেখানে এতিম পরিত্যক্ত অনাথ শিশু-কিশোরদের রক্ষণাবেক্ষণ ও ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা হয়। সমাজের কর্মক্ষম সদস্য হিসেবে এতিম-অনাথ শিশুদের গড়ে উঠতে এতিমখানা সাহায্য করে। শিশুকল্যাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে এতিমখানার উদ্দেশ্যগুলো হলো-
১. এতিম অসহায় শিশুদের নিরাপদ আশ্রয় ও ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা।
২. শিশুর সুষ্ঠু বিকাশ ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
৩. ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র গঠনে সাহায্য করা, যাতে এতিম শিশুরা সমাজের দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে গড়ে উঠতে সক্ষম হয়।
৪. অনাথ শিশু-কিশোরদের সামাজিক পরিবেশে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলা।
এতিমখানার গুরুত্ব
এতিম, অসহায়, পরিত্যক্ত শিশু-কিশোররা সমাজের মানুষ। প্রতিকূল অবস্থার শিকার হয়ে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সুতরাং তাদের রক্ষণাবেক্ষণ ও লালন-পালন সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে সব সমাজেই স্বীকৃত। বিশ্বের প্রতিটি ধর্মেই অসহায় এতিমদের লালন-পালনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এতিমখানা হলো সণাতনী অনাথ আশ্রমের মুসলিম সংস্করণ। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম একটি সেবাদান ব্যবস্থা। ইসলাম ধর্মে এতিমদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সামাজিক এবং ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের তাগিদে বিশ্বের সবদেশে এতিমখানা বা অনাথ আশ্রম সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ইসলামী মূল্যবোধ ও আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বহু এতিমখানা বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত হচ্ছে। ইসলাম ধর্মের প্রচারকদের পুণ্য স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর লক্ষ্যে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট বহু এতিমখানা পরিচালিত হচ্ছে। এতিম ও পরিত্যক্ত শিশুদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি পর্যায়ে এতিমখানা প্রতিষ্ঠা এবং বেসরকারি এতিমখানাগুলোকে সরকারি অনুদান দিয়ে সহযোগীতা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে সরকারি এতিমখানাগুলোকে ‘‘শিশু সদন’, ‘শিশু পরিবার’ এবং ‘বেবী হোম’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের বেবীহোমে রেখে লালন-পালন করা হয় এবং পাঁচ বছর পূর্ণ হলে তাদের শিশু সদনে স্থানান্তর করা হয়।
পৃষ্ঠা ১৩৮
২০০৭ সালের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ৮৫টি সরকারি শিশু পরিবারের মাধ্যমে ১০ হাজার ৭৫ জন এতিম শিশুর ভরণপোষণ, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত নিবন্ধনকৃত এতিমখানায় ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট হিসেবে মাসিক ৪০০ টাকা হারে ৩৯,৫৮৩ জন এতিমের মধ্যে ১৯ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়।
সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার যৌথ প্রচেষ্টায় এতিম শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণ তথা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিগত কয়েক বছরের অনুদানপ্রাপ্ত এতিমখানার পরিসংখ্যান নিচে দেয়া হলোঃ
অর্থবছর | এতিমখানার সংখ্যা | বরাদ্দকৃত আসন সংখ্যা | অনুদানের পরিমাণ |
১৯৯৫-৯৬ ১৯৯৬-৯৭ ১৯৯৭-৯৮ ১৯৯৮-৯৯ ২০০১-০২ ২০০২-০৩ | ১০৯০ ১১৬৫ ১৩০৭ ১২৬৫ ১৫৫৭ ১৯৩০ | ১৭,৮১২ ১৮,৭৫০ ২০,৩১২ ২০,৬২৫ ২৩,৯৫৮ ২৫,৮৩৩ | ৮,৫৪,৯৭,৬০০ ৯,০০,০০,০০০ ৯,৭৪,৯৭,৬০০ ৯,১০,০৪,৮০০ ১১,৪৯,৯৮,৪০০ ১২,৪০,০০,০০০ |
বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী সাহায্য সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় বেসরকারি পর্যায়ে অনেকগুলো অনাথ আশ্রম পরিচালিত হচ্ছে। এসব আশ্রমে পারিবারিক পরিবেশে এতিমদের লালন-পালন এবং শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। যেমন- এস.ও.এস. সাহায্য সংস্থা কর্তৃক অনাথ শিশুদের জন্য পরিচালিত ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা এবং চট্টগ্রামের ‘শিশুপল্লী’। বর্তমানে এতিমখানাগুলোর লক্ষণীয় দিক হচ্ছে বহু এতিমখানায় এতিমদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র ও অনুন্নত দেশে এতিমখানা হচ্ছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যা এতিম, পরিত্যক্ত এবং অনাথ শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
অনুশীলনী
রচনামূলক প্রশ্ন
১. সনাতন সমাজকল্যাণ বলতে কি বুঝ? সনাতন সমাজকল্যাণের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
২. যাকাত কাকে বলে? সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাকাতের গুরুত্ব আলোচনা কর।
পৃষ্ঠা ১৩৯
৩. ওয়াক্ফ কাকে বলে? ওয়াক্ফ কত প্রকার ও কি কি? ওয়াক্ফের অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব আলোচনা কর।
৪. বায়তুল মাল বলতে কি বুঝ? সমাজকল্যাণে বায়তুল মালের তাৎপর্য আলোচনা কর।
৫. সনাতন ও আধুনিক সমাজকল্যাণের পার্থক্য আলোচনা কর।
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. দান প্রথা কাকে বলে?
২. দান প্রথার ত্রুটিসমূহ কি কি?
৩. সদ্কাহ বলতে কি বুঝ?
৪. যাকাত ও ওয়াক্ফের পার্থক্য কি ?
৫. ওয়াক্ফ ও দেবোত্তর প্রথার পার্থক্য কি?
৬. ধর্মগোলা বলতে কি বুঝ?
৭. লঙ্গরখানা ও এতিমখানার পার্থক্য কি?
৮. সরাইখানা ও এতিমখানার পার্থক্য কি?
৯. ওয়াক্ফ কত প্রকার ও কি কি?
১০. ওয়াক্ফ কি?
১১. লঙ্গরখানা কি?
১২. যাকাতের গুরুত্ব কি?
১৩. লঙ্গরখানা ও সরাইখানার পার্থক্য কি?
১৪. এতিমখানার প্রয়োজনীয়তা কি?