পৃষ্ঠা ৬২
দ্বিতীয় অধ্যায়
সমাজকল্যাণের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কিত বিষয়সমূহ

ভূমিকা
পেশাদার সমাজকর্ম অর্থে আধুনিক সমাজকল্যাণ প্রত্যয়টি ব্যবহার করা হয়। আর সমাজকর্ম হলো মানুষকে সাহায্য করার প্রায়োগিক বিজ্ঞান।
পেশাগত অর্থে আধুনিক সমাজকল্যাণ একটি সমন্বয়ধর্মী ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞান। পেশাদার সমাজকর্ম অর্থে সমাজকল্যাণ-এর জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি বিভিন্ন বিজ্ঞান হতে গ্রহণ করে সংশ্লেষণের মাধ্যমে নিজস্ব একটি বিজ্ঞান গড়ে তুলেছে। সামাজিক সমস্যার সমাধান দিতে হলে প্রথমে সমাজের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অর্জিত জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে সমস্যার প্রকৃতি, বিস্তৃতি, গভীরতা, সমস্যার সাথে অন্যান্য সমস্যার সম্পর্ক ও প্রভাব নির্ণয় করতে হয়। সমাজকর্ম অন্যান্য বিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জন করে সমস্যার পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে সমস্যা নিয়ন্ত্রণ বা সমাধানের প্রচেষ্টা চালায়। অন্যান্য বিজ্ঞানের নীতি ও তত্ত্ব সরাসরি এতে প্রয়োগ করা হয় না। আধুনিক সমাজকল্যাণ নিজস্ব পদ্ধতি ও কৌশলের মাধ্যমে অন্যান্য বিজ্ঞানের জ্ঞান সমস্যা সমাধানে প্রয়োগ করে থাকে। আধুনিক সমাজকল্যাণের সমস্যা সমাধানের অনুসৃত পদ্ধতি হচ্ছে সমাজকর্ম পদ্ধতি। সমাজকর্মের জ্ঞানের ভিত্তি সম্পর্কে ডব্লিউ.এ. ফ্রিডল্যান্ডার যথার্থই বলেছেন, ‘‘সমাজকর্ম এর জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, চিকিৎসা, মনোঃচিকিৎসা, নৃতত্ত্ব, জীববিদ্যা, ইতিহাস শিক্ষা এবং দর্শন হতে গ্রহণ করে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে নিজস্ব একটি বিজ্ঞান গড়ে তুলেছে।’’ এজন্য বলা হয়, ‘‘সমাজকর্ম বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ওপর ভিত্তিশীল একটি ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞান, যা অন্যান্য বিজ্ঞান থেকে জ্ঞানার্জন করেও স্বকীয় সত্তায় বিদ্যমান।’’ মানব জ্ঞানের অন্যান্য শাখার সঙ্গে আধুনিক সমাজকল্যাণের স্বাতন্ত্র্য এবং সাদৃশ্য রয়েছে। অন্যান্য বিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজকল্যাণের সম্পর্ক আলোচনায় প্রেক্ষাপট হিসেবে সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের সম্পর্ক আলোচনার গুরুত্ব অপরিসীম।
সামাজিক বিজ্ঞান এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক
বিজ্ঞানের প্রধান দু’টি শাখা হলো প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞান। এ দু’টি আবার বিভিন্ন উপশাখায় বিভক্ত। পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, জীবাণুবিদ্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, লোক প্রশাসন, সমাজকল্যাণ ইত্যাদি সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। প্রাকৃতিক বিষয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানগুলো গড়ে উঠেছে। আর সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে সামাজিক বিজ্ঞানগুলো গড়ে উঠেছে।
সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে যেসব বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে সেগুলোকেই সামাজিক বিজ্ঞান বলা হয়। অক্সপোর্ড এডভান্স অভিধানের ‘সামাজিক বিজ্ঞান হলো কতগুলো বিষয়ের সমষ্টি যেগুলো মানুষকে অধ্যয়ন করে। সমাজকাঠামো, মানুষের আচার-আচরণ, পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া এবং সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করাই সামাজিক বিজ্ঞানগুলোর মূল লক্ষ্য। সমাজবিজ্ঞানী ইয়াং এবং ম্যাক এর মতে, সামাজিক বিজ্ঞান বলতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংকলিত সুশৃংখল জ্ঞানকে বুঝায় যে জ্ঞান মানুষের মিথষ্ক্রিয়ার ধরন ও বিষয়বস্ত্ত নিয়ে আলোচনা করে। সামাজিক সম্পর্কের জটিলতা এবং বিস্তৃত পরিধির পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক বিজ্ঞানের নতুন নতুন শাখার উদ্ভব হয়েছে। প্রতিটি সামাজিক বিজ্ঞানই মানব সমাজ এবং সমাজস্থ মানুষের সামাজিক সম্পর্কের এক একটি বিশেষ দিক নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে।
সমাজ একটি যৌগিক একক সামগ্রিক সত্তা। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও নির্ভরশীল বিভিন্ন অংশের সমন্বয়ে সমাজ গঠিত। সমাজের কোন এক দিককে বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্লেষণ করা যায় না। সুতরাং সমাজের বিভিন্ন দিককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা সামাজিক বিজ্ঞানগুলোর মধ্যে সম্পর্ক থাকাই স্বভাবিক। এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, ‘‘সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের ভেতর কোন বাস্তব আলাদা সত্তা নেই। বরং আলোচ্য বিষয়ের বিভিন্নতা দিয়েই এক সামাজিক বিজ্ঞানকে অপরটি থেকে পৃথক করা হয়ে থাকে’’। সামাজিক বিজ্ঞানগুলো মানবকল্যাণের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক বিজ্ঞানগুলো সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া উপলব্ধি এবং নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
পৃষ্ঠা ৬৩
ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে আধুনিক সমাজকল্যাণের সঙ্গে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের অর্জিত জ্ঞানকে বিশেষ কতগুলো পদ্ধতি ও কৌশলের মাধ্যমে সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনের লক্ষ্য সমাজকল্যাণে ব্যবহার করা হয়।
সমাজকল্যাণ ও নৃ-বিজ্ঞান |
আধুনিক সমাজকল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কিত সামাজিক বিজ্ঞানগুলোর মধ্যে নৃ-বিজ্ঞান অন্যতম। ১৯৫৪ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা নৃতত্ত্ববিদদের সামাজিক বিজ্ঞানের জ্যোর্তিবিজ্ঞানী বলে আখ্যায়িত করেছে। নৃ-বিজ্ঞান ও সমাজকল্যাণের পারস্পরিক সম্পর্ক ও পার্থক্য আলোচনার পটভূমি হিসেবে নৃ-বিজ্ঞানের সংজ্ঞা, প্রকৃতি ও বিষয়বস্ত্তর সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো।
নৃ-বিজ্ঞান কি?
নৃ-বিজ্ঞানের ইংরেজী প্রতিশব্দ হলো এনথ্রোপলোজি উৎপত্তি গ্রীক শব্দ এনথ্রোপস্ এবং লজিয়া থেকে। গ্রীক শব্দ এনথ্রোপলোজি এর অর্থ হলো ‘মানুষ’ এবং লজিয়া শব্দের অর্থ হলো ‘পাঠ’। সুতরাং এনথ্রোপলোজি শব্দের অর্থ হলো মানুষ সম্পর্কিত পাঠ বা মানব বিজ্ঞান। মানুষের বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠই হলো নৃ-বিজ্ঞান। মানুষের উৎপত্তি, দৈহিক গঠন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্রমবিকাশ সম্পর্কিত বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠই নৃ-বিজ্ঞান।
মানুষের দু’টি সত্তা রয়েছে। একটা হলো জীব সত্তা এবং অন্যটি হলো সামাজিক সত্তা। নৃ-বিজ্ঞান মানুষের দু’টি সত্তা নিয়ে আলোচনা করে। সুতরাং জীব হিসেবে এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীব হিসেবে মানব সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে যে বিজ্ঞান আলোচনা করে তা-ই নৃ-বিজ্ঞান। সহজ কথায় ‘‘নৃ-বিজ্ঞান হলো জীব হিসেবে মানুষ ও তার সামাজিক কর্মকান্ডের বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা।’’ নৃ-বিজ্ঞান একদিকে যেমন প্রাণী রাজ্যে মানুষের স্থান ও বিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করে, অন্যদিকে সামাজিক প্রেক্ষাপটে সাংস্কৃতিক জীবনের আলোচনা করে। বিষয়বস্ত্তর ব্যাপকতার কারণে নৃ-বিজ্ঞানকে দৈহিক নৃ-বিজ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞান এ দু‘টি ভাগে ভাগ করা হয়। অন্য একটি প্রধান বিভাগ হলো ভাষাতত্ত্ব।
১. দৈহিক নৃ-বিজ্ঞান : দৈহিক নৃ-বিজ্ঞান মানুষের উৎপত্তি, বিকাশ ও তার দৈহিক গঠন প্রণালী নিয়ে আলোচনা করে। পৃথিবীর বিভিন্ন মানব গোষ্ঠীর বর্ণ-পরিচয় এবং তাদের ওপর পরিবেশের প্রভাব নিয়ে দৈহিক নৃ-বিজ্ঞান পরীক্ষা নিরীক্ষা চালায়। মানব দেহের গঠন প্রণালী, প্রাণী রাজ্যে মানুষের স্থান, প্রাণী হিসেবে মানুষের প্রকৃতি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয়, মানুষের নরগোষ্ঠীগত পরিচয় ও প্রাণীর ক্রমবিকাশের ধারা নিয়ে আলোচনা করে দৈহিক নৃ-বিজ্ঞান।
২. সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞান : সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানে মানুষের অর্জিত, ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করা হয়। সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানে আদিম মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদি নিয়ে গবেষণা করা হয়। এতে আদিম উৎপাদন পদ্ধতি, পরিবার ও বিবাহ প্রথা, সরকার, আইন, জাদুবিদ্যা, শিল্পকলা, সামাজিক প্রথা-প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি অর্জিত ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। আদিম মানুষের গোটা সাংস্কৃতিক জীবনই সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানের পরিধিভুক্ত। এজন্য একে সামাজিক নৃ-বিজ্ঞান হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানী প্রাচীন ও আধুনিক সাংস্কৃতিক জগতের সাধারণ ও ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্যের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন। এ প্রসঙ্গে ই.এ. হোবেল বলেছেন, ‘‘সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানী প্রাচীন পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা আদিম ও সভ্য সমাজের তুলনামূলক পর্যালোচনা করেন। এভাবে তিনি মানব চরিত্রের কোনগুলো সাধারণ এবং কোনগুলো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তা নির্ণয় করেন।’’
৩. ভাষাতত্ত্ব : নৃ-বিজ্ঞানের বিশেষ বিভাগ হলো ভাষতত্ত্ব। এ বিভাগে বিভিন্ন ভাষার প্রকৃতি ও গঠন কাঠামোর তুলনামূলক অধ্যয়ন করা হয়।
বাচনধ্বনি, ভাষাগত উচ্চরণ, ব্যাকরণ, বাক্য, শব্দের গঠন নিয়ে আলোচনা করা হয়। ভাষাতত্ত্বে বিভিন্ন ভাষাভিত্তিক জনগোষ্ঠী এবং এগুলোর ঐতিহাসিক দিক আলো করে। নৃ-তত্ত্বের বিশেষ শাখা হিসেবে ভাষাতত্ত্বে ভাষা এবং সামাজিক-
পৃষ্ঠা ৬৪
সাংস্কৃতিক গঠনের পারস্পরিক সম্পর্ক নিযে অধ্যয়ন করা হয়। অর্থাৎ ভাষা এবং সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেকার সম্পর্ক আলোচনা করে। বিভিন্ন ধর্মীয় ও নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সামাজিক শ্রেণী এবং পেশাগত গোষ্ঠীর ভাষাগত বৈশিষ্ট্য এবং সেগুলোর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করে ভাষাতত্ত্ব। বিভিন্ন নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ভাষাগত বেশিষ্ট্য এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক গঠন কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কের অধ্যয়ন করে ভাষাতত্ত্ব।
সমাজকল্যাণ ও নৃ-বিজ্ঞানের মধ্যেকার সম্পর্ক
আধুনিক সমাজকল্যাণ (পেশাদার সমাজকর্ম অর্থে) বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ওপর ভিত্তিশীল একটি ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞান। যার লক্ষ্য হলো মানব জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা হতে অর্জিত জ্ঞান সংশ্লেষণের মাধ্যমে নিজস্ব কৌশল ও পদ্ধতিতে মানব কল্যাণে প্রয়োগ করা। সুতরাং বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো নৃ-বিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজকল্যাণের সম্পর্ক রয়েছে।
সমাজকল্যাণ ও নৃ-বিজ্ঞনের পারস্পরিক সম্পর্কের বিশেষ দিকগুলো নিচে আলোচনা করা হলো ঃ
১. উভয়ে সামাজিক বিজ্ঞান : সমাজকল্যাণ ও নৃ-বিজ্ঞান সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। উভয় বিজ্ঞানই মানুষের সামাজিক সম্পর্ক, সমাজকাঠামো, প্রথা-প্রতিষ্ঠান, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। সুতরাং সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ হতে নৃ-বিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজকল্যাণের সম্পর্ক বিদ্যমান।
২. অভিন্ন বিষয়বস্ত্ত : সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের ক্রমবিকাশ এবং মানব সংস্কৃতি নিয়ে নৃ-বিজ্ঞান আলোচনা করে। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের দৈহিক গঠন এবং মানুষের সৃষ্ট সংস্কৃতিই হলো নৃ-বিজ্ঞানের উপজীব্য। পক্ষান্তরে, সমাজকল্যাণ সামাজিক জীব হিসেবে সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন পর্যায়ে সৃষ্ট সমস্যা এবং তার সমাধান নিয়ে আলোচনা করে। সমাজ এবং সমাজস্থ মানুষের কল্যাণই হলো সমাজকল্যাণের প্রতিপাদ্য বিষয়। সুতরাং বিষয়বস্ত্তর দিক হতে নৃ-বিজ্ঞান এবং সমাজকল্যাণ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। উভয়ের উপজীব্য বিষয় হলো সমাজ এবং সমাজের মানুষ।
৩. অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি : নৃ-বিজ্ঞান এবং সমাজকল্যাণ মানুষের সামগ্রিক ও পূর্ণাঙ্গ অধ্যয়নের নীতিতে বিশ্বাসী। উভয়ে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ হতে মানুষকে বিশ্লেষণ করে। নৃ-বিজ্ঞান মানুষের সামগ্রিক পাঠে বিশ্বাসী। এ প্রসঙ্গে নৃ-বিজ্ঞানী ই.এ. হোবেলের উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘‘কোন অংশকেই সম্পূর্ণ বা সঠিকভাবে সমগ্রক থেকে পৃথক করে বুঝা যায় না।’’ এজন্য মানুষের জৈবিক ও সাংস্কৃতিক উভয় দিকই নৃ-বিজ্ঞানে পাঠ করা হয়। সমাজকল্যাণও মানুষের সামগ্রিক কল্যাণে বিশ্বাসী। মানুষের আর্থ-সামাজিক, দৈহিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি সামগ্রিক দিকের কল্যাণই সমাজকল্যাণের পরিধিভুক্ত। সুতরাং উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি সাদৃশ্যপূর্ণ। উভয় বিজ্ঞান গোটা সমাজের প্রেক্ষাপটে পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমাজ এবং সমাজের মানুষকে বিশ্লেষণ করে।
৪. সমাজকল্যাণের জ্ঞানের উৎস নৃ-বিজ্ঞান : নৃ-বিজ্ঞান সমাজকর্মীদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ধারা, প্রচলিত প্রথা-প্রতিষ্ঠান, সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ, সামাজিক সংগঠন প্রভৃতি সম্পর্কে বাস্তব এবং বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান দান করে। মানুষের আচার-আচরণ ও ব্যক্তিত্বের ওপর দৈহিক গঠনের প্রভাব সম্পর্কে বস্ত্তনিষ্ঠ জ্ঞান দান করে দৈহিক নৃ-বিজ্ঞান। নৃ-বিজ্ঞান অধ্যয়নের মাধ্যমে সমাজকর্মীরা সমাজ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বস্ত্তনিষ্ঠ জ্ঞানার্জনে সক্ষম হয়।
৫. সামাজিক সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে নৃ-বিজ্ঞান : নৃ-বিজ্ঞানের বিশেষ শাখা হলো ফলিত নৃ-বিজ্ঞান। ফলিত নৃ-বিজ্ঞানের কাজ হলো ক. কোন সমাজের অগ্রসরতার কারণ নির্ণয়, খ. উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যর্থ হবার কারণ উদ্ঘাটন ও সুপারিশ প্রদান, গ. আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতামূলক আচার -বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক ধারা চিহ্নিতকরণ, ঘ. পরিকল্পিত উপায়ে সামাজিক পরিবর্তন ত্বরান্বিত করা ইত্যাদি। ফলিত নৃ-বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হলো মানব কল্যাণ। সুতরাং ফলিত নৃ-বিজ্ঞানের জ্ঞান সামাজিক সমস্যা বিশ্লেষণে ও সমাধানে সমাজকর্মীদের নির্দেশনা দান করে। এ প্রসঙ্গে ইউনেস্কোর মন্তব্য উল্লেখ করা যায়। ইউনেস্কোর মন্তব্য হলো, “দ্যা এনথ্রোপলোজি ইজ দ্যা এছট্রনোমার অফ দ্যা সোস্যাল সাইন্স।
৬. নৃ-বিজ্ঞানের গবেষণা পদ্ধতি সমাজকল্যাণের লক্ষ্যার্জনে সহায়তা করে : বাংলাদেশের মত দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্য ও জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণা পরিচালনায় নৃ-বিজ্ঞানে ব্যবহৃত প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও
পৃষ্ঠা
পৃষ্ঠা ৬৫
পর্যবেক্ষণমূলক নৃ-তাত্ত্বিক পদ্ধতির মাধ্যমে গবেষণা করে সমাজকর্মীরা নির্দিষ্ট সমাজের সামগ্রিক দিক সম্পর্কে পুর্ণাঙ্গ ও বস্ত্তনিষ্ঠ জ্ঞানার্জনে সক্ষম হন। যা সমস্যা সমাধানে বাস্তব ও কার্যকরী পরিকল্পনা প্রণয়নে সমাজকর্মীদের সহায়তা করে। সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমাজকর্মীদের বিশেষভাবে সহায়তা করে নৃ-বিজ্ঞান।
নৃ-বিজ্ঞান ও সমাজকল্যাণের মধ্যে পার্থক্য
সমাজকল্যাণ ও নৃ-বিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও মানব জ্ঞানের দুটি শাখা হিসেবে উভয়ের মধ্যে কতিপয় পার্থক্য রয়েছে। যেমন-
১. সমাজকল্যাণের তুলনায় আধুনিক নৃ-বিজ্ঞানের পরিধি ব্যাপক। যেমন- দৈহিক নৃ-বিজ্ঞানীকে মানুষের দৈহিক গঠন ও বিবর্তনের ধারা অধ্যয়ন করতে হয়-যা সমাজকর্মীদের করতে হয় না। সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানী আদিম ও চলমান সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু আদিম সংস্কৃতি সমাজকল্যাণের আলোচনার পরিধিভুক্ত নয়।
২. সমাজকল্যাণ একটি ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে। কিন্তু নৃ-বিজ্ঞান তুলনামূলক তাত্ত্বিক। সাম্প্রতিক ফলিত নৃ-বিজ্ঞান নামে একটি বিশেষ শাখা ক্রমান্বয়ে বিকাশ লাভ করছে।
৩. সমাজকল্যাণের বৃহত্তর লক্ষ্যার্জনে নৃ-বিজ্ঞানের জ্ঞান সমাজকর্মীদের জন্য আবশ্যক। নৃ-বিজ্ঞানের অর্জিত জ্ঞান সমাজকর্মীরা নিজস্ব পদ্ধতির মাধ্যমে মানব কল্যাণে প্রয়োগ করে। কিন্তু, সমাজকল্যাণের জ্ঞান নৃ-বিজ্ঞানীদের জন্য অপরিহার্য নয়।
৪. নৃ-বিজ্ঞান মানুষকে জীবসত্তা ও সামাজিক সত্তা এ দু‘টি দৃষ্টিকোণ হতে বিশ্লেষণ করে। কিন্তু সমাজকল্যাণে মানুষের সামাজিক সত্তার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।
৫. অনুশীলন ক্ষেত্রে নৃ-বিজ্ঞানে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে গবেষণা পরিচালনা করা হয়। সুতরাং এর গবেষণা পদ্ধতি প্রত্যক্ষ পরিচয়ভিত্তিক। অন্যদিকে, সমাজকল্যাণের গবেষণার ক্ষেত্রে প্রশ্নমালা ও পরিসংখ্যানের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ফলে সমাজকল্যাণের গবেষণা অনেক বেশি নিয়ম মাফিক।
৬. নৃ-বিজ্ঞান প্রধানত ক্ষুদ্র সমাজ নিয়ে গবেষণা করে। অন্যদিকে, সমাজকল্যাণে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ উভয় সমাজ নিয়ে গবেষণা করতে হয়।
পরিশেষে বলা যায়, সমাজকল্যাণ ও নৃ-বিজ্ঞানের মধ্যে বিষয়বস্ত্ত এবং আলোচনার পদ্ধতিগত দিক হতে পার্থক্য থাকলেও সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে উভয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সমাজকর্মীর নিকট নৃ-বিজ্ঞানের প্রধান তাৎপর্য হলো, এটি বর্তমান সমাজের সঙ্গে অতীত, সমাজের তুলনামূলক আলোচনা করার জন্য নানাবিধ তথ্য দিয়ে সাহায্য করে।
সমাজকল্যাণ ও সমাজবিজ্ঞান |
সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাগুলোর মধ্যে সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজকল্যাণের সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি নিবিড় এবং ঘনিষ্ঠ। সমাজকল্যাণের সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনার প্রারম্ভে সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা, বিষয়বস্ত্ত, পরিধি সম্পর্কে ধারণা নেয়া প্রয়োজন।
সমাজবিজ্ঞান কি?
সমাজবিজ্ঞানকে বলা হয়, “দ্যা সাইন্স অফ সোসাইটি”। সমাজবিজ্ঞানী কিংসলে ডেভিস সমাজের সাধারণ বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানকে আখ্যায়িত করেছেন। যে বিজ্ঞান মানব সমাজ এবং সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে বস্ত্তনিষ্ঠ আলোচনা করে সেটি সমাজবিজ্ঞান।
বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার সামাজিক সম্পর্কের ওপর জোর দিয়ে বলেছেন, ‘‘সমাজবিজ্ঞানই একমাত্র বিজ্ঞান, যা সমাজ এবং সামাজিক সম্পর্ক বিষয়ে পাঠ করে। এ সংজ্ঞাতে মানুষের
পৃষ্ঠা ৬৬
সমাজ এবং সামাজিক সম্পর্কের পাঠকে সমাজবিজ্ঞান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কারণ সামাজিক সম্পর্কের জটিল রূপ হলো সমাজ। সামাজিক সম্পর্ক অধ্যয়নের মাধ্যমে সমাজ সম্পর্ক ধারণা লাভ করা যায়।
সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার এর মতে, ‘‘সমাজবিজ্ঞান এমন একটি বিজ্ঞান, যার উদ্দেশ্য হলো সামাজিক কার্যাবলির মধ্যে একটি কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের ব্যাখ্যা দান করা।
এ সংজ্ঞাটিতে সামাজিক ক্রিয়া এবং বিভিন্ন সামাজিক ক্রিয়ার কার্যকরণ সম্পর্কের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। কারণ সামাজিক কার্যাবলির মাধ্যমেই মানুষের আচরণ, সামাজিক সম্পর্ক ও সামাজিক প্রক্রিয়া উপলব্ধি করা যায়।
সমাজবিজ্ঞানী বটোমোর এর মতে, ‘‘সামাজিক কাঠামো সম্পর্কিত মৌল ধারণা বা প্রত্যয় সমাজবিজ্ঞানের পথ নির্দেশনা করে’’ এতে সমাজ বিজ্ঞানের মৌল বিষয় হিসেবে সমাজকাঠামো অথবা সামাজিক গড়নকে চিহ্নিত করা হয়েছে। মূলতঃ সামাজিক কাঠামোকে মৌল প্রত্যয় হিসেবে গ্রহণ করে সমাজকে বিশ্লেষণ করা হলে সমাজের সামগ্রিক রূপ অনুধাবন করা সম্ভব হয়।
বিভিন্ন সংজ্ঞার আলোকে বলা যায়, সমাজবিজ্ঞান হলো এমন একটি সামাজিক বিজ্ঞান, যা সমাজের গঠন প্রণালী এবং পরিবর্তনশীল সমাজকাঠামো সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত ও বস্ত্তনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করে। সমাজকাঠামো, সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সামাজিক কার্যাবলি প্রভৃতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাজ সম্পর্কে পুর্ণাঙ্গ ও বস্ত্তনিষ্ঠ জ্ঞানদান করা সমাজবিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য। সমাজবিজ্ঞানের পরিধি গোটা সমাজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। সমাজের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠই সমাজবিজ্ঞান। সমাজের সামগ্রিক দিকই এর আলোচনা ক্ষেত্র। সমাজকাঠামো, সামাজিক সম্পর্ক, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং সমাজের উৎপত্তি, বিবর্তন, বিকাশ সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করে সমাজবিজ্ঞান। মানুষের যে কোন সামাজিক আচরণই সমাজবিজ্ঞানের আলোচনার পরিধিভুক্ত। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক যতদূর বিস্তৃত, সমাজবিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্রও ততদূর বিস্তৃত।
সমাজকল্যাণ ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যেকার সম্পর্ক
সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকল্যাণের পারস্পরিক সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বিষয়বস্ত্ত, লক্ষ্য, পরিধি ও প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের বিশেষ দিকগুলো নিচে আলোচনা করা হলো-
১. প্রকৃতিগতভাবে উভয়ে সামাজিক বিজ্ঞান : সমাজবিজ্ঞান এবং সমাজকল্যাণ সামাজিক বিজ্ঞানের দু’টি বিশেষ শাখা। সমাজ এবং সামাজিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে উভয়ের বিষয়বস্ত্ত গড়ে উঠেছে। মানুষের সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত বিধায় সামাজিক বিজ্ঞানগুলোর সম্পর্কও অবিচ্ছেদ্য। সুতরাং সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ হতে সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকল্যাণের পারস্পরিক সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। শুধু বিষয়বস্ত্তর দিক হতে উভয় বিজ্ঞানকে পৃথক নামে আখ্যায়িত করা হয়।
২. অভিন্ন বিষয়বস্ত্ত : সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকল্যাণের বিষয়বস্ত্ত সমাজ এবং সামাজিক মানুষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। সমাজ ও সামাজিক সম্পর্কের বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ করে গোটা সমাজ সম্পর্কে বস্ত্তনিষ্ঠ ও পুর্ণাঙ্গ জ্ঞান দান করে সমাজবিজ্ঞান। সমাজবিজ্ঞানী হ্যানরী ফেয়ারচাইল্ড বলেছেন, সমাজবিজ্ঞান হলো মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ এবং মানবীয় পরিবেশের অধ্যয়ন। আর সমাজকল্যাণ মানুষ এবং পরিবেশের মিথষ্ক্রিয়া থেকে সৃষ্ট সমস্যা অর্থাৎ মানুষের সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন পর্যায়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধান নিয়ে আলোচনা করে। সমাজের সামগ্রিক কল্যাণকে কেন্দ্র করে সমাজকল্যাণের বিষয়বস্ত্ত আবর্তিত। সুতরাং সমাজ এবং সমাজস্থ মানুষকে কেন্দ্র করে উভয়ের বিষয়বস্ত্ত আবর্তিত। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজকল্যাণের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
৩. সমাজকল্যাণ ও সমাজবিজ্ঞানের লক্ষ্য অভিন্ন : সমাজবিজ্ঞানী স্যামুয়েল কোনিগ বলেছেন, ‘‘মানবিক সংগঠন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ এবং এসবের ব্যাখ্যা করা সমাজবিজ্ঞানের প্রধান লক্ষ্য হলেও মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি বিধান হলো সমাজবিজ্ঞানের চূড়ান্ত লক্ষ্য।’’
পৃষ্ঠা ৬৭
আর ব্যক্তি, দল, সমষ্টির সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী সমাজ গঠন মানুষকে সহায়তা করা সমাজকল্যাণের মূল লক্ষ্য। সুতরাং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দৃষ্টিকোণ হতে উভয় বিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক বিদ্যমান। উভয়ের লক্ষ্য হলো সমাজস্থ মানুষের কল্যাণ সাধনে সহায়তা করা।
৪. সমাজকল্যাণের জ্ঞানের উৎস সমাজবিজ্ঞান : যে কোন সামাজিক সমস্যা সার্থকভাবে মোকাবেলা করার পূবশর্ত হলো সমস্যা সম্পর্কে বস্ত্তনিষ্ঠ জ্ঞানার্জন। সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে বস্ত্তনিষ্ঠ জ্ঞান লাভের জন্য সমাজকর্মীদের সমাজবিজ্ঞান অধ্যয়ন করতে হয়।
সমাজবিজ্ঞানের বস্ত্তনিষ্ঠ জ্ঞান ছাড়া সামাজিক সমস্যা সার্থকভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সমাজবিজ্ঞানী স্যামুয়েল কোনিগ উভয়ের সম্পর্কের এ দিকটি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, জীববিজ্ঞান জীবাণু বিজ্ঞানের সঙ্গে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এবং গণিত ও পদার্থ বিদ্যার সঙ্গে প্রকৌশল বিদ্যার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। জীববিজ্ঞানের বা জীবাণু বিজ্ঞানের তত্ত্বগত এবং পরীক্ষামূলক গবেষণা ছাড়া যেমন মানবদেহের রোগ চিকিৎসা সম্ভব নয়; তেমনি সমাজবিজ্ঞানের অনুসন্ধান কার্যছাড়া সামাজিক সমস্যা কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সুতরাং মানব দেহের গঠনতত্ত্বের জ্ঞান ছাড়া শরীরের রোগ চিকিৎসা করা যেমন অসম্ভব; তেমনি সমাজদেহের গঠনতত্ত্ব সম্পর্কিত জ্ঞান ভিন্ন সামাজিক চিকিৎসক হিসেবে সমাজকর্মীদের পক্ষে সামাজিক ব্যাধি মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
৫. সমাজবিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিক হলো সমাজকল্যাণ : মানবিক সংগঠন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা এবং এসবের ব্যাখ্যা করা সমাজবিজ্ঞানের কাজ। সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে বস্ত্তনিষ্ঠ জ্ঞান লাভ করার প্রতি সমাজবিজ্ঞানে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ও বস্ত্তনিষ্ঠ জ্ঞান মানব কল্যাণে প্রয়োগ করে সমাজকল্যাণ। এদিক থেকে সমাজবিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিক হিসেবে সমাজকল্যাণকে আখ্যায়িত করা যায়। সমাজবিজ্ঞান তাত্ত্বিক বিষয় হিসেবে যেখানে শেষ হয়; সমাজকল্যাণ সেখান থেকে যাত্রা শুরু করে একটি ব্যবহারিক বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
৬. সমাজবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে সমাজকল্যাণ : সমাজবিজ্ঞান প্রদত্ত বস্ত্তনিষ্ঠ জ্ঞান সমাজকল্যাণ নিজস্ব কৌশল ও পদ্ধতির মাধ্যমে মানব কল্যাণে প্রয়োগ করে। সুতরাং সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞানকে মানব কল্যাণে প্রয়োগ করে বিজ্ঞান হিসেবে পরিপূর্ণতা দানে সমাজকল্যাণ সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
সমাজকল্যাণ ও সমাজবিজ্ঞানের পার্থক্য
সমাজকল্যাণ ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্যগুলো হলো-
ক. সমাজবিজ্ঞানের তুলনায় সমাজকল্যাণ নবীন। শিল্প সমাজের বহুমুখী ও জটিল সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষিতে সামাজিক বিজ্ঞানের বিশেষ শাখা হিসেবে সমাজকল্যাণের উদ্ভব।
খ. সমাজবিজ্ঞান গোটা সমাজকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বিশ্লেষণ করে। অন্যদিকে সমাজের মঙ্গলকর দিক নিয়ে সমাজকল্যাণের পরিধি ব্যাপৃত। এতে সমাজের কল্যাণে অস্বাভাবিক অবস্থা দূর করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। সুতরাং সমাজকল্যাণের তুলনায় সমাজবিজ্ঞানের পরিধি ব্যাপক।
গ. সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই সমাজকল্যাণ ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। প্রকৃতিগতভাবে সমাজবিজ্ঞান তাত্ত্বিক এবং সমাজকল্যাণ ব্যবহারিক।
ঘ. সমাজকল্যাণের লক্ষ্যার্জনে সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক জ্ঞান অপরিহার্য। কিন্তু সমাজ বিশ্লেষণে সমাজবিজ্ঞানীদের সমাজকল্যাণের জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব থাকলেও অপরিহার্য নয়।
পরিশেষে বলা যায়, সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে আলোচনা পদ্ধতি, পরিধি, বিষয়বস্ত্ত ইত্যাদির পার্থক্য থাকলেও সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ আনয়নে উভয়ে সহায়ক ও পরিপূরক ভূমিকা পালন করে। সমাজবিজ্ঞানের ব বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান ছাড়া সমাজকল্যাণের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।
সমাজকল্যাণ ও মনোবিজ্ঞান |
পৃষ্ঠা ৬৮
প্রায়োগিক দিক হতে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজকল্যাণের সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে বেশি। মনোবিজ্ঞান এবং এর বিভিন্ন শাখার জ্ঞান সমাজকল্যাণের লক্ষ্য অর্জনে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
মনোবিজ্ঞান কি ?
মনোবিজ্ঞান হলো আচরণের বিজ্ঞান। ইংরেজী সাইক্লোজি শব্দটি গ্রীক শব্দ সাইকি বা ‘মন’ বা ‘আত্মা’ এবং লোগস যার অর্থ ‘বিজ্ঞান’ হতে উদ্ভূত। সুতরাং উৎপত্তিগত অর্থে মনোবিজ্ঞান হলো ‘মন’ বা ‘আত্মার’ বিজ্ঞান। ‘মন’ বা ‘আত্মা’ যেহেতু দেখা যায় না এবং ধরা ছোঁয়ার বাইরে, সেহেতু এটি কোন গবেষণার বিষয় হতে পারে না। এর কোন সঠিক সংজ্ঞাও নির্দেশ করা যায় না। তাই আমেরিকার আচরণবাদী বিজ্ঞানী জন বি. ওয়াটসন মনোবিজ্ঞানকে আচরণের বিজ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাঁর মতে, মানুষ যা কিছু করে সবই হলো তার আচরণ । আর আচরণ হলো কোন বিশেষ উদ্দীপকের প্রতি প্রাণী বা মানুষের প্রতিক্রিয়া।
আধুনিক মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ‘‘মনোবিজ্ঞান হলো এমন একটি বিজ্ঞান, যা প্রাণী ও মানুষের আচরণ নিয়ে আলোচনা করে।’’ বাহ্যিক আচরণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে, মনোজগত সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে মনোবিজ্ঞান। ‘‘মানুষ বিশেষ পরিস্থিতিতে কেন বিশেষ আচরণ করে’’-এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করে মনোবিজ্ঞান। বাহ্যিক আচার-আচরণের পেছনে প্রভাব বিস্তারকারী আচরণের প্রক্রিয়াগুলো হলো প্রত্যক্ষণ, প্রেষণা, শিক্ষণ, আবেগ, চিন্তন, অনুভূতি, বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি। এগুলো মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্ত্তর পরিধিভুক্ত।
মনোবিজ্ঞানের শাখা : বর্তমানে মনোবিজ্ঞানীগণ মানব আচরণের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করছেন। যার ফলে মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উদ্ভব হয়েছে। মনোবিজ্ঞানের প্রধান শাখাগুলো হলো, শিশু মনোবিজ্ঞান, শিক্ষা মনোবিজ্ঞান,শিল্প মনোবিজ্ঞান, অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞান, চিকিৎসামূলক মনোবিজ্ঞান এবং সামাজিক মনোবিজ্ঞান। মনোবিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা মানব আচরণের বিশেষ দিককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। মনোবিজ্ঞানের বিষয় বস্ত্তর বেশির ভাগ গড়ে উঠেছে ব্যক্তি মানুষের প্রতি গুরুত্বারোপের মধ্য দিয়ে। সমাজকল্যাণের সঙ্গে মনোবিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় সম্পর্ক বিদ্যমান।
পৃষ্ঠা ৬৮
মনোবিজ্ঞানের পরিধি : আধুনিক মনোবিজ্ঞানীদের মতে মনোবিজ্ঞান হলো মানুষ ও প্রাণীর আচরণ সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান। সুতরাং মনোবিজ্ঞানের মূল বিষয় হলো আচরণ। প্রাণীর বাহ্যিক আচরণ এবং আচরণের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াগুলো মনোবিজ্ঞানের পরিধিভুক্ত। বাহ্যিক আচরণের ভিত্তিতে আচরণের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষণ, প্রেষণা, আবেগ, ব্যক্তিত্ব, শিক্ষন, অনুভূতি, প্রেষণা সহজাত প্রবণতা ইত্যাদি বিশ্লেষণের চেষ্টা করে মনোবিজ্ঞান। মানব বৃদ্ধি, বিকাশ ও আচরণের ওপর পরিবেশের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করে মনোবিজ্ঞান। মানব আচরণের স্বাভাবিকতা ও অস্বভাবিকতা নিয়ে গবেষণা করে মনোবিজ্ঞান। প্রাণীদের আচরণ নিয়ে গবেষণা করে মানুষের আচরণ সম্বন্ধে অনুমান গঠন করে মনোবিজ্ঞান। সুতরাং মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্ত্তর মূল কেন্দ্র বিন্দু হলো বিচিত্র এবং বহুমুখী মানব আচরণ।
সমাজকল্যাণ ও মনোবিজ্ঞানের মধ্যেকার সম্পর্ক
সমাজকল্যাণের সঙ্গে মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সমাজকল্যাণের বৃহত্তর লক্ষ্যার্জনে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান বিশেষভাবে সহায়তা করে। সমাজকল্যাণের সঙ্গে মনোবিজ্ঞানের সম্পর্কের বিশেষ দিকগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
১. উভয়ের বিষয়বস্ত্ত হলো মানব আচরণ : সমাজকল্যাণ ও মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্ত্ত মানব আচরণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। মনোবিজ্ঞান মানুষের বাহ্যিক আচরণ বিশ্লেষণ করে মানবীয় আচরণের পেছনে যে অভ্যন্তরীণ চালনাশক্তি রয়েছে তার অনুসন্ধান করে। আর সমাজকল্যাণ মানুষের পারস্পরিক আচার-আচরণ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে সৃষ্ট সমস্যা এবং তার সমাধান নিয়ে আলোচনা করে। মানবিক ও সামাজিক সমস্যার জন্য কি ধরনের মানব আচরণ দায়ী সে সম্পর্কে অনুসন্ধান চালায় সমাজকল্যাণ। সুতরাং মানব আচরণ নিয়ে উভয়ের বিষয়বস্ত্ত আবর্তিত বিধায় সমাজকল্যাণ ও মনোবিজ্ঞানের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
২. সমাজকল্যাণের জ্ঞানের উৎস হলো মনোবিজ্ঞান : সমাজকল্যাণ হলো সুসংগঠিত সাহায্যদান পদ্ধতি। মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ, সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতার উন্নয়ন এবং পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে সহায়তা করা সমাজকল্যাণের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্যার্জনের জন্য সমাজকর্মীদের মানবীয় আচরণ সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছেন, ‘‘মানুষের বাহ্যিক আচরণ ও সামাজিক সম্পর্ক বুঝতে হলে তার মানসিক বৃত্তি ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।’’ সুতরাং জ্ঞানের অন্যতম উৎস হিসেবে মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজকল্যাণের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। মানব বিকাশ ও আচরণ সমাজকর্মীদের জ্ঞানের অপরিহার্য অঙ্গ, যা মনোবিজ্ঞান অধ্যায়নে অর্জন করা যায়।
মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব যেমন- ব্যক্তিত্বের তত্ত্ব, শিক্ষণ তত্ত্ব, মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব, বুদ্ধি অভীক্ষা প্রভৃতি সমাজকল্যাণের মৌলিক উপাদানের উৎস।
৩. কল্যাণমূলক পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নে সহায়তা করে মনোবিজ্ঞান : যে কোন কল্যাণমূলক পরিকল্পনা ও কর্মসূচির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নির্ভর করে, যাদের কল্যাণে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় তাদের সক্রিয় সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের ওপর। এজন্য সমাজকল্যাণে পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়নকালে মানবীয় আচরণ ও পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সমাজকর্মীদের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হয়। মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান সমাজকর্মীদের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহায়তা করে।
পৃষ্ঠা ৬৯
৪. সমাজকর্মীদের সহায়তা দান করে মনোবিজ্ঞান : মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান থেকে সমাজকর্মীরা স্বীয় আবেগ, অনুভূতি ও আচরণ সম্বন্ধে জানতে পারে এবং সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির আচরণের শর্তাবলি সম্বন্ধে অবগত হতে পারে। ফলে সমাজকর্মী নিজের আবেগ, অনুভূতি ও আচরণকে সঠিকভাবে পরিচালিত করে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সঙ্গে উপযুক্ত আচরণ এবং পেশাগত সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে।
৫. মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার জ্ঞান সমাজকল্যাণকে সমৃদ্ধ করে : মানব আচরণের বিভিন্ন দিককে কেন্দ্র করে মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা গড়ে উঠেছে, যেমন-চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান, শিশু মনোবিজ্ঞান, অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞান, শিল্প ও শিক্ষা মনোবিজ্ঞান, সামাজিক মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি। আধুনিক সমাজকল্যাণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন শিশুকল্যাণ, চিকিৎসা ও স্কুল সমাজকর্ম, অপরাধ সংশোধন ও শ্রমকল্যাণ, প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন ইত্যাদি কর্মসূচিতে মনোবিজ্ঞানের সংশ্লিষ্ট শাখার জ্ঞান প্রয়োগ করা হয়।
৬. সামাজিক মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজকল্যাণের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য : মনোবিজ্ঞানের বিশেষ শাখা হলো সামাজিক মনোবিজ্ঞান। এতে ব্যক্তির ওপর সমাজের প্রভাব এবং ব্যক্তি কিভাবে সমাজকে প্রভাবিত করে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। সমাজে ব্যক্তির আচরণ অধ্যয়নের বিজ্ঞান হলো নৃ-তত্ত্ব। সামাজিক পরিবেশে মানুষের ব্যক্তিত্ব এবং আচরণ কিভাবে প্রভাবিত হয়, তা অধ্যয়ন করে সামাজিক মনোবিজ্ঞান। সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষের ব্যক্তিত্ব, আচার-আচরণ, পারস্পরিক সম্পর্ক ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ সামাজিক মনোবিজ্ঞান সমাজকর্মীদের বিশেষভাবে সহায়তা করে। আধুনিক সমাজকল্যাণের পদ্ধতিগত সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া সমাজ মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। কারণ ব্যক্তি, সমাজ ও সংস্কৃতির মিলন কেন্দ্র হলো সমাজ মনোবিজ্ঞান। এ প্রসঙ্গে মনোবিজ্ঞানী আর লিনটন তাঁর “দ্যা কালচার ব্যাকগ্রাউন্ড অফ পার্সোনালিটি” গ্রন্থে বলেছেন, ‘‘ব্যক্তির আচরণ নিয়ে আলোচনা করে মনোবিজ্ঞান, সমাজকে ব্যাখ্যা করে সমাজবিজ্ঞান, সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করে সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞান। আর এ তিনটি বিষয়ের মিলন কেন্দ্র হলো মনোবিজ্ঞানের বিশেষ শাখা সমাজ মনোবিজ্ঞান।’’ সমাজ মনোবিজ্ঞান ও সমাজকল্যাণ উভয়ে সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষের আচার-আচরণ, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে। সুতরাং উভয়ের সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক।
৭. মনোবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে সমাজকল্যাণ : সমাজকল্যাণ নিজস্ব কৌশল ও পদ্ধতির মাধ্যমে মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন পরীক্ষালব্ধ তত্ত্ব মানব কল্যাণে প্রয়োগ করে, যা মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানের পরিপূর্ণতা আনয়নে সহায়তা করে। সুতরাং সমাজকল্যাণও মনোবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
সমাজকল্যাণ ও মনোবিজ্ঞানের পার্থক্য
প্রায়োগিক দিক হতে সমাজকল্যাণ অর্থাৎ সমাজকর্ম ও মনোবিজ্ঞানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও উভয়ের মধ্যে কতিপয় পার্থক্য রয়েছে। যেমন-
ক. মনোবিজ্ঞান মানুষ এবং মানুষ সদৃশ অন্যান্য প্রাণীর আচরণ পর্যালোচনা করে। এটি আচরণের মৌলিক বিজ্ঞান হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে সমাজকল্যাণ মানবীয় আচরণ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কিত জ্ঞানকে মানব কল্যাণে প্রয়োগ করে। এটি একটি সমন্বয়ধর্মী ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞান। এতে শুধু মানব আচরণ নিয়ে আলোচনা করা হয় না। বরং আচরণ সম্পর্কিত জ্ঞান অনুশীলন করা হয়।
পৃষ্ঠা ৭০
খ. মানুষের আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যক্তিগত, দলীয় ইত্যাদি দিকের কল্যাণের স্বার্থে মানব আচরণের সামগ্রিক দিক নিয়ে সমাজকল্যাণে আলোচনা করা হয়। কিন্তু মনোবিজ্ঞানে মানুষের বাহ্যিক আচরণ এবং এর পিছনে বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা হয়। সুতরাং সমাজকল্যাণের পরিধি তুলনামূলকভাবে ব্যাপক।
গ. মনোবিজ্ঞানের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে গবেষণা করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সমাজকল্যাণের এরূপ সুযোগ নেই। মনোবিজ্ঞান মানুষ সদৃশ প্রাণীর আচরণ নিয়ে পরীক্ষাগারে গবেষণার মাধ্যমে মানব আচরণ সম্পর্কে সূত্র আবিষ্কার করে। এ ধরনের সূত্র উদ্ভাবনের সুযোগ সমাজকল্যাণে নেই।
ঘ. মনোবিজ্ঞান মানুষের বাহ্যিক আচরণ বিশ্লেষণ করে অভ্যন্তরীণ শক্তি অনুসন্ধান করে। আর সমাজকর্মীরা মানুষ এবং সামাজিক পরিবেশের প্রেক্ষাপটে মানুষের আচার-আচরণ বিশ্লেষণ করে। মানুষ ও পরিবেশের মিথষ্ক্রিয়ার প্রতি গুরুত্ব দেয় সমাজকল্যাণ।
ঙ. একজন মনোবিজ্ঞানী ব্যক্তি আচরণের সঙ্গে সম্পর্কিত জৈবিক এবং সামাজিক উপাদানগুলো অধ্যয়ন করেন। অন্যদিকে একজন সমাজকর্মী ব্যক্তি আচরণের সঙ্গে জৈবিক এবং সামাজিক উপাদানের প্রতি দৃষ্টি দিলেও সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির সামাজিক ভূমিকা ও সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে বেশি অধ্যয়ন করেন।
উপরিউক্ত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তি, দল ও জনসমষ্টির সমস্যা সমাধানে এবং সামাজিক উন্নয়নে উভয়ে সহায়ক ও পরিপূরক ভূমিকা পালন করে। সমাজকল্যাণ কার্যক্রমের বিভিন্ন পর্যায়ে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান সমাজকর্মীদের প্রজ্ঞার সঙ্গে চলতে সহায়তা করে।
সমাজকল্যাণ ও অর্থনীতি |
সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা অর্থনীতি। সামাজিক সম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে অর্থনীতির বিকাশ। মানবকল্যাণের অপরিহার্য উপাদান হলো সম্পদ। মানবকল্যাণের সঙ্গে সম্পদ বা অর্থের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সুতরাং সম্পদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা সামাজিক বিজ্ঞানের বিশেষ শাখা অর্থনীতির সঙ্গে সমাজকল্যাণের সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক।
অর্থনীতির সংজ্ঞা
অর্থনীতি সামাজিক বিজ্ঞানের সে শাখা, যাতে সম্পদ উৎপাদন, বন্টন, ভোগ, বিনিয়োগ সংক্রান্ত মানুষের কার্যাবলি আলোচনা করা হয়। ১৮৯২ সালে প্রকাশিত “ইকনোমিকমিক্স অফ ইনডাষ্ট্রিজ” গ্রন্থে অধ্যাপক মার্শাল অর্থনীতির সংজ্ঞায় বলেছেন, ‘‘অর্থশাস্ত্র মানব জাতির দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কার্যাবলি নিয়ে আলোচনা করে’’। কিভাবে মানুষ আয় করে এবং কিভাবে তা ব্যয় করে তার পর্যালোচনা করাই অর্থনীতির কাজ। মার্শালের সংজ্ঞানুযায়ী অর্থনীতির আলোচ্য বিষয় হলো সম্পদ এবং মানুষ। সম্পদ আহরণ এবং সম্পদের ব্যবহার সংক্রান্ত মানুষের কার্যাবলির অনুশীলনই অর্থশাস্ত্র।
অর্থনীতির অধিক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেছেন অধ্যাপক এল. রবিন্স। তাঁর মতে, ‘‘মানুষের অভাব এবং বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সীমিত সম্পদের সম্পর্ক বিষয়ক মানব আচরণ সম্বন্ধে যে শাস্ত্র আলোচনা করে তা-ই অর্থশাস্ত্র।’’
অধ্যাপক রবিন্স-এর সংজ্ঞায় মানব জীবনের তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথমত, মানুষের অভাব অসীম এবং অভাববোধ হতে মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলি ও কর্মপ্রচেষ্টার উদ্ভব হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মানুষের অসীম অভাব পূরণের জন্য যে সম্পদ রয়েছে সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত সীমিত। তৃতীয়ত, উৎপাদনের সীমিত উপকরণগুলো বিকল্প ব্যবহারযোগ্য।
পৃষ্ঠা ৭১
সুতরাং বলা যায়, অর্থশাস্ত্র এমন একটি সামাজিক বিজ্ঞান, যা মানুষের সেসব কার্যাবলি নিয়ে আলোচনা করে যেগুলো বিনিময়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং অর্থের দ্বারা পরিমাপযোগ্য। কিভাবে উৎপাদনের সীমিত উপকরণের বিকল্প ব্যবহারের সাহায্যে মানুষের অসীম অভাব পূরণ করা যায়, তার বিশ্লেষণ করাই অর্থশাস্ত্রের আলোচ্য বিষয়। সম্পদের উৎপাদন, ভোগ, বিনিময় ও বন্টন সংক্রান্ত মানুষের কার্যাবলিই অর্থনীতির মূল বিষয়বস্ত্ত্। সম্পদকে কেন্দ্র করে সমাজের মানুষের যে কর্মধারা পরিচালিত ও সম্পাদিত হয় অর্থনীতি তারই আলোচনা করে। এজন্য জন স্টুয়ার্ট মিল ‘‘সম্পদের উৎপাদন ও বন্টন সংক্রান্ত ব্যবহারিক বিজ্ঞান’’ হিসেবে অর্থশাস্ত্রকে আখ্যায়িত করেছেন।
সমাজকল্যাণ ও অর্থনীতির সম্পর্ক
অর্থনীতি ও সমাজকল্যাণ সামাজিক বিজ্ঞানের দু’টি গুরত্বপূর্ণ শাখা। উভয়ে সমাজবদ্ধ মানুষের কল্যাণ নিয়ে আলোচনা করে। সমাজ বহির্ভূত মানুষের আচার-আচরণ সমাজকল্যাণ ও অর্থনীতির বিবেচ্য নয়। মানুষের আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য বিধায় উভয় শাস্ত্রের মধ্যে যোগসূত্র গড়ে উঠেছে।
নিচে সমাজকল্যাণ ও অর্থনীতির বিষয়বস্তু, লক্ষ্য, নীতি ও বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষাপটে উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের বিশেষ দিকগুলো আলোচনা করা হলো-
১. অভিন্ন লক্ষ্য : সীমিত সম্পদের বহুমুখী বিকল্প ব্যবহার দ্বারা মানুষের অসীম অভাব পূরণের উপায় নিয়ে আলোচনা করাই অর্থনীতির মূল লক্ষ্য। পক্ষান্তরে, সমাজকল্যাণের লক্ষ্য হলো মানুষের আওতাধীন সম্পদ ও সামর্থ্যের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের সার্বিক কল্যাণ আনয়নে সহায়তা করা। সুতরাং অর্থনীতি ও সমাজকল্যাণ উভয়ের লক্ষ্য হলো মানব কল্যাণ।
২. অভিন্ন নীতি : অর্থনীতি ও সমাজকল্যাণ উভয়ে স্বাবলম্বন নীতিতে বিশ্বাসী। সীমিত সম্পদের বিকল্প ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ কিভাবে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারে, তার নির্দেশনা দান করে অর্থনীতি। অন্যদিকে, সমাজকল্যাণের সামগ্রিক সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া স্বাবলম্বন নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত। সুতরাং নীতিগত দিক হতে অর্থনীতি ও সমাজকল্যাণ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
৩. সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে সমাজকল্যাণ ও অর্থনীতি সহায়ক ভূমিকা পালন করে : যে কোন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের অপরিহার্য দু’টি দিক হলো অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন। ভারসাম্যপূর্ণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ব্যতীত সমাজের সার্বিক কল্যাণ আশা করা যায় না। অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্বারা দেশের প্রাপ্ত সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে জাতীয় আয়, উৎপাদন ক্ষমতা দীর্ঘ সময়ের জন্য বৃদ্ধি করা হয়। আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে সমাজকাঠামোতে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সম্পদের সুষম বন্টনের ব্যবস্থা করা, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার পরিবর্তন হলো সামাজিক উন্নয়ন। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন হলো একটি অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। একটি অপরটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যেমন- অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে যদি জাতীয় আয় ও মাথাপিছু আয় বাড়াতে হয়, তবে সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাস এবং শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দ্বারা মানব সম্পদ উন্নয়ন ও সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন করতে হবে। এজন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অর্থবহ করে তোলার জন্য সামাজিত উন্নয়ন অপরিহার্য। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে উভয় বিজ্ঞান সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৪. সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে অর্থনীতি : সমাজকল্যাণ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা হতে জ্ঞানার্জন করে। সমাজকল্যাণের বহুমুখী জ্ঞানের অন্যতম উৎস হলো অর্থনীতি। অর্থনীতির মৌলিক জ্ঞান ছাড়া সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ
পৃষ্ঠা ৭২
ও সমাধানে মানুষকে সাহায্য করা সম্ভব নয়। কারণ মানুষের অর্থনৈতিক আচরণ সামাজিক আচরণ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। প্রত্যেক সামাজিক সমস্যারই একটা অর্থনৈতিক দিক রয়েছে। এছাড়া যে কোন সামাজিক সমস্যার অন্যতম উৎস হলো মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা। আর মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে সাহায্য করার জন্য প্রয়োজন সীমিত সম্পদের বিকল্প ব্যবহার সম্পর্কিত জ্ঞান। যা অর্থনীতি অধ্যায়নের মাধ্যমে সমাজকর্মীরা অর্জন করতে পারে।
৫. কল্যাণমুখী ও বিকাশমুখী অর্থনীতির ধারণা উভয়ের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠতর করেছে: আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সার্বিক অথনৈতিক কর্মকান্ডের মূল লক্ষ্য হলো জনকল্যাণ। বর্তমানে অর্থনীতি একদিকে অর্থনৈতিক সমস্যার বিশ্লেষণ করে, অন্যদিকে সমস্যা সমাধানের পথ নির্দেশ করে। কল্যাণমুখী এবং বিকাশমুখী অর্থনীতি উৎপাদনের স্বল্প উপকরণসমূহের বিলিবণ্টন এবং কর্মসংস্থান ও আয়ের নির্ধারক বিষয়সমূহ নিয়ে আলোচনা করে। মানব কল্যাণ অর্থনীতির বিশেষ দিক হিসেবে প্রাধান্য পাওয়ায় সমাজকল্যাণের সঙ্গে এর সম্পর্ক ক্রমশ নিবিড় হচ্ছে।
অর্থনীতি ও সমাজকল্যাণের পার্থক্য
সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ হতে সমাজকল্যাণ ও অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্ক থাকলেও উভয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন-
১. অর্থনীতি মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলি বা অর্থের সঙ্গে মানব আচরণ নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু সমাজকল্যাণ সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ নিয়ে আলোচনা করে। মানব আচরণের সবদিকই সমাজকল্যাণের পরিধিভুক্ত। সুতরাং সমাজকল্যাণের পরিধি ব্যাপক।
২. অর্থনীতির ক্ষেত্রে মানুষের নৈতিকতা বা নীতিবোধের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। যেমন অধ্যাপক পিগু মন্তব্য করেছেন, ‘‘অর্থশাস্ত্র যা হয়েছে বা হতে পারে, সে সংক্রান্ত প্রত্যক্ষ বিজ্ঞান। কি হওয়া উচিত সে সংক্রান্ত আদর্শমূলক বিজ্ঞান নয়।’’ অধ্যাপক স্টীগলার মন্তব্য করেছেন, ‘‘একজন ভোগকারীর মদ পান না করে দুধ পান করা উচিত কিনা তা দার্শনিকের বিচার্য বিষয় হতে পারে,কিন্তু অর্থশাস্ত্রবিদের নয়।’’ পক্ষান্তরে, সমাজকল্যাণ মানুষের নীতিবোধ ও আদর্শের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়। সমাজস্থ মানুষের আদর্শ, মুল্যবোধ ও নৈতিকতা বিরোধী অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সমাজকল্যাণ স্বীকৃতি দেয় না।
৩. অর্থনীতি মানুষের যাবতীয় সমস্যাকে একমুখী অর্থাৎ অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ হতে বিশ্লেষণ করে। অন্যদিকে, সমাজকল্যাণ মানবিক সমস্যাগুলোকে বহুমুখী এপ্রোচ হতে বিশ্লেষণ করে।
৪. সমাজকল্যাণের তুলনায় অর্থনীতি অনুশীলন পদ্ধতি অধিক গাণিতিক।
৫. সমাজকল্যাণ একটি ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞান কিন্তু অর্থনীতি একটি তাত্ত্বিক সামাজিক বিজ্ঞান। তবে সাম্প্রতিক ফলিত অর্থনীতি নামে অর্থনীতির বিশেষ শাখা ক্রমান্বয়ে বিকাশ লাভ করছে।
পরিশেষে বলা যায়, অর্থনীতি ও সমাজকল্যাণের মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্বেও উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কারণ মানুষের অর্থনৈতিক আচরণ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সমাজ জীবনের অন্যান্য দিক হতে বিচ্ছিন্ন নয়। অর্থনৈতিক আচরণ মানুষের সামাজিক পরিবেশ, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি মানবিক প্রবণতা দ্বারা প্রভাবিত। তেমনি অর্থনৈতিক আচরণ অর্থাৎ উৎপাদন সম্পর্ক দ্বারা সামাজিক আচরণ বিশেষভাবে প্রভাবিত।
সমাজকল্যাণ ও পৌরনীতি |
পৃষ্ঠা ৭৩
সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো পৌরনীতি। মানুষের রাজনৈতিক আচার-আচরণ ও সম্পর্ককে কেন্দ্র করে পৌরনীতির বিষয়বস্ত্ত গড়ে উঠেছে। সমন্বয়ধর্মী সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে মানব বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার ন্যায় পৌরনীতির সঙ্গেও সমাজকল্যাণের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যামান।
পৌরনীতি সংজ্ঞা
ইংরেজী ‘সিভিক্স -এর প্রতিশব্দ হলো পৌরনীতি। ‘সিভিক্স ল্যাটিন শব্দ সিভিস এবং সিভিটাস থেকে এসেছে। শব্দদ্বয়ের অর্থ হলো যথাক্রমে ‘নাগরিক’ এবং ‘নগর রাষ্ট্র’। সুতরাং উৎপত্তিগত অর্থে যে বিজ্ঞান নাগরিক ও নগর রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোচনা করে তাকেই পৌরনীতি বলা হয়। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্র এবং নাগরিকের ধারণা পরিবর্তিত হওয়ায় পৌরনীতির সংজ্ঞারও পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে পৌরনীতিকে নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান বলা হয়।
এফ.আই. গ্লাউড এর মতে, ‘‘যে সকল প্রতিষ্ঠান, অভ্যাস এবং কার্যাবলির মাধ্যমে মানুষ তার রাজনৈতিক সমাজের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে এবং রাজনৈতিক সমাজ থেকে অধিকারসমূহ ভোগ করে, সেসব প্রতিষ্ঠান, অভ্যাস ও কার্যাবলির পর্যালোচনাই হলো পৌরনীতি।’’
ই.এম. হোয়াইট এর মতে, ‘‘পৌরনীতি হলো জ্ঞানভান্ডারের সে প্রয়োজনীয় শাখা, যা নাগরিকের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত এবং স্থানীয়, জাতীয় ও মানবতার সাথে জড়িত প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করে।
সংক্ষেপে বলা যায় সামাজিক বিজ্ঞানের যে অংশ নাগরিকের অধিকার, কর্তব্য, রাষ্ট্রের কার্যাবলি, সরকার, সরকারের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করে, তা পৌরনীতি। পৌরনীতি নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান।
পৌরনীতির পরিধি ঃ নাগরিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের আলোচনা পৌরনীতির বিষয়বস্ত্ত। পৌরনীতির প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো রাষ্ট্র, সরকার ও আইন। পৌরনীতি হলো নাগরিকতার বিজ্ঞান। সুতরাং নাগরিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিষয় পৌরনীতির বিষয়বস্ত্তর অন্তর্ভুক্ত। নাগরিক জীবনের রাজনৈতিক দিক হলো পৌরনীতির প্রধান আলোচ্য বিষয়। নাগরিক জীবনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করে পৌরবিজ্ঞান। নাগরিকদের স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রূপ সম্পর্কে আলোচনা করে পৌরনীতি। এছাড়া সমাজজীবনের বিকাশ, বিবর্তন, অর্থনৈতিক জীবনের পরিবর্তন সামাজিক ও নৈতিক দিক নিয়ে পৌরনীতি আলোচনা করে। মূলত মাগরিক জীবনের সামগ্রিক দিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবন ব্যবস্থার বিভিন্ন দিকের বৈজ্ঞানিক আলোচনা পৌরনীতির বিষয়বস্ত্তর পরিধিভুক্ত।
সমাজকল্যাণ ও পৌরনীতির মধ্যেকার সম্পর্ক
সামাজিক বিজ্ঞানের দু’টি বিশেষ শাখা হলো পৌরনীতি এবং সমাজকল্যাণ। রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে উভয়ের বিষয়বস্ত্ত আবর্তিত। সুতরাং সামাজিক বিজ্ঞানের দিক হতে সমাজকল্যাণ ও পৌরনীতি পরস্পর সম্পর্কিত। শুধু বিষয়বস্ত্তর গুরুত্বারোপের পরিপ্রেক্ষিতে উভয়ে পৃথক নামে পরিচিত। পৌরনীতি ও সমাজকল্যাণ উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের বিশেষ দিকগুলো নিচে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে আলোচনা করা হলো-
১. পৌরনীতি ও সমাজকল্যাণ উভয়ের বিষয়বস্ত্ত সাদৃশ্যপূর্ণ : রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে মানুষের আচার-আচরণ, অধিকার ও কর্তব্য এবং সরকার ও রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক প্রভৃতি দিক নিয়ে আলোচনা করে পৌরনীতি। অন্যদিকে সমাজকল্যাণ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতায় বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসাবে মানুষের আচার-আচরণ এবং সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে। সুতরাং উভয় বিজ্ঞানের উপজীব্য বিষয় হলো মানুষ। মানুষের কল্যাণকে কেন্দ্র করে উভয়ের আলোচনা ক্ষেত্র বিস্তৃত। সমাজকল্যাণ ও পৌরনীতির আলোচ্য বিষয় সাদৃশপূর্ণ হওয়ায় উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
পৃষ্ঠা ৭৪
২. উভয়েই সামাজিক জীবনকে সমৃদ্ধ করে : সমাজকল্যাণ ও পৌরনীতি উভয়ে মানব কল্যাণের পথ নির্দেশনা এবং জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করে। পৌরবিজ্ঞান দায়িত্বশীল সুনাগরিকতার শিক্ষা দেয়। আর সমাজকল্যাণ মানুষকে তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। সুতরাং মানুষকে নিজ নিজ অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে সুখী এবং সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে সহায়তা করা উভয় বিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য।
৩. সমাজ কল্যাণের জ্ঞানের উৎস হলো পৌরনীতি : সমাজকল্যাণের মূল লক্ষ্য হলো সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন পর্যায়ে সুষ্ঠুভাবে সামাজিক ভূমিকা পালনে মানুষকে সাহায্য করা। রাজনৈতিক সম্পর্ককে উপেক্ষা করে মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক সম্পর্কের তাত্ত্বিক জ্ঞান ব্যতীত রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতায় সমাজকর্মীদের পক্ষে মানুষকে সাহায্য করা সম্বব নয়। ‘‘অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর সম্পর্কযুক্ত’’ এবং ‘‘দায়িত্ব পালনের মধ্যে দিয়েই অধিকার ভোগ করতে হয়’’-এরূপ জ্ঞান পৌরনীতি অধ্যয়নের মাধ্যমেই সমাজকর্মীরা অর্জন করতে পারে ।
৪. কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা উভয়ের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠতর করে তুলেছে : বর্তমানে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা সম্প্রসারণের ফলে রাষ্ট্রীয় কার্যাবলির মূল লক্ষ্য হিসেবে জনকল্যাণকে চিহ্নিত করা হয়। যুগের পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা হ্রাস পেয়ে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে পালন করতে হয়। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় বহুমুখী সমাজকল্যাণ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। ফলে পৌরনীতির বিষয়বস্ত্ত সম্প্রসারিত হয়ে সমাজকল্যাণের বিষয়বস্ত্তর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত হয়ে পড়েছে।
৫. উভয় শাস্ত্র পরস্পর সহায়ক ও পরিপূরক : যে কোন দেশের সামগ্রিক কল্যাণ ও উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। রাজনৈতিক শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার বিভিন্ন উপাদান সম্পর্কে পৌরনীতি মৌলিক জ্ঞান সরবরাহ করে সমাজকল্যাণকে সমৃদ্ধ করছে। অন্যদিকে,আধুনিক সমাজকল্যাণ বিভিন্ন সমস্যা ও সেগুলোর সমাধান সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত এবং বস্ত্তনিষ্ঠ জ্ঞান সরবরাহের মাধ্যমে পৌরনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতন মানুষের কল্যাণে উভয় বিজ্ঞান সহায়ক ও পরিপূরক ভূমিকা পালন করছে।
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান বিশ্বে নাগরিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার জটিলতা ক্রমান্বয়ে জটিলতর হচ্ছে। এ সম্পর্কে সুশৃঙ্খল ও বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞানার্জন ব্যতীত মানবিক সমস্যা সমাধানের আশা করা যায় না। পৌরবিজ্ঞানের জ্ঞান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতায় সমাজকর্মীদের প্রজ্ঞার সাথে পেশাগত দায়িত্ব পালনে সহায়তা করে।
পৌরনীতি ও সমাজকল্যাণের পার্থক্য
পৌরনীতি এবং সমাজকল্যাণের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও বিজ্ঞানের পৃথক শাখা হিসেবে উভয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন-
ক. পৌরনীতি রাষ্ট্রকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করে রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ হতে বিশ্লেষণ করে। অন্যদিকে সমাজকল্যাণ রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করে।
পৃষ্ঠা ৭৫
খ. পৌরনীতি হলো নাগরিকতার বিজ্ঞান। নাগরিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে এর বিষয়বস্ত্ত ব্যাপৃত। আর সমাজকল্যাণ সমাজস্থ মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ নিয়ে আলোচনা করে। গোটা সমাজই এর উপজীব্য ও আলোচনার ক্ষেত্র। সুতরাং সমাজকল্যাণের পরিধি পৌরনীতির তুলনায় ব্যাপক।
গ. সমাজ জীবনের এমন অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বহির্ভূত বিধায় পৌরনীতিতে তেমন আলোচিত হয় না। ব্যক্তিগত বিশ্বাস, প্রথা, প্রবণতা, নীতিবোধ ইত্যাদি চিরকালই সামাজিক রীতিনীতির আলোকে নিয়ন্ত্রিত হয়। মানব জীবনের এসব বাস্তব ও বৃহত্তর দিকগুলো সমাজকল্যাণের আলোচনার পরিধিভুক্ত।
ঘ. পৌরনীতি একটি তাত্ত্বিক বিজ্ঞান। পৌরনীতি রাষ্ট্র এবং নাগরিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বস্ত্তনিষ্ঠ আলোচনা করে। অন্যদিকে, আধুনিক সমাজকল্যাণ একটি ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞান। এতে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার জ্ঞান নিজস্ব কৌশল ও পদ্ধতির মাধ্যমে মানব কল্যাণে ব্যবহার করা হয়।
ঙ. পৌরনীতি মানব কল্যাণের বিভিন্ন দিককে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ হতে বিশ্লেষণ করে। আর সমাজকল্যাণ মানবিক অধকার, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সামাজিক দায়িত্ববোধের পরিপ্রেক্ষিতে মানব কল্যাণকে বিশ্লেষণ করে।
অনুশীলনী
রচনামূলক প্রশ্ন
১. নৃ-বিজ্ঞান কি? সমাজকল্যাণের সঙ্গে নৃ-বিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা কর।
২. সমাজকল্যাণের সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা কর।
৩. সমাজবিজ্ঞান কি? সমাজকর্মীদের জন্য সমাজবিজ্ঞান পাঠ প্রয়োজন কেন? বা, সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান সমাজকল্যাণে আবশ্যক কেন?
৪. মনোবিজ্ঞান কি? সমাজকল্যাণের সঙ্গে মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা কর।
৫. সমাজকর্মীদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান কিভাবে সাহায্য করে?
৬. অর্থনীতির সংজ্ঞা দাও। সমাজকল্যাণের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক আলোচনা কর। অথবা, সমাজকল্যাণ কিভাবে অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত আলোচনা কর। বা, সমাজকর্মীর জন্য অর্থনীতির জ্ঞান প্রয়োজন কেন?
৭. সমাজকল্যাণ ও পৌরনীতির সম্পর্ক আলোচনা কর।
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞান কি?
২. সামাজিক মনোবিজ্ঞান বলতে কি বুঝ?
৩. সামাজিক বিজ্ঞান কাকে বলে?
৪. সমাজকর্মীদের নিকট সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা কি?
৫. সামাজিক মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজকল্যাণের সম্পর্ক কি ?