Logo Sponsored by Chowdhury and Hossain, Advanced Publications

Sonartori Read



সোনার তরী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
          রাশি রাশি ভারা ভারা
          ধান কাটা হল সারা,
          ভরা নদী ক্ষুরধারা
                                  খরপরশা-
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা |

একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা।
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা ।
          পরপারে দেখি আঁকা
          তরুছায়ামসী-মাখা
          গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
                                  প্রভাতবেলা-
এপারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা ।

গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
          ভরা পালে চলে যায়,
          কোনো দিকে নাহি চায়,
                                  ঢেউগুলি নিরুপায়
                                  ভাঙে দু ধারে-
          দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।

ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে?
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
          যেয়ো যেথা যেতে চাও
          যারে খুশি তারে দাও-
          শুধু তুমি নিয়ে যাও
                                  ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।

যত চাও তত লও তরণী-পরে।
আর আছে-আর নাই, দিয়েছি ভরে।
          এতকাল নদীকূলে
          যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
          সকলি দিলাম তুলে
                                  থরে বিথরে-
এখন আমারে লহো করুণা করে।

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই-ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
          শ্রাবণগগন ঘিরে
          ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
          শূন্য নদীর তীরে
                                  রহিনু পড়ি-
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।


শব্দার্থ ও টীকা
ভরসা                               -       আশা, আশ্বাস, নির্ভরশীলতা, আস্থা।
ভারা ভারা                         -       বোঝা বোঝা, বহু বোঝা হয় এমন।
ক্ষুরধারা                            -       ক্ষুরের মতো ধারালো যে প্রবাহ বা স্রোত।
খরপরশা                           -       শাণিত বা ধারালো বর্শা। এখানে ধারালো বর্শার মতো।
আমি                                -       সাধারণ অর্থে কৃষক। প্রতীকী অর্থে কবি নিজে।
আমি একেলা                      -       কৃষক কিংবা কবির নিঃসঙ্গ অবস্থা প্রকাশ করছে।
চারিদিকে বাঁকা
জল করিছে খেলা                 -       ধানক্ষেতটি ছোট দ্বীপের মতো। তার চারপাশে ঘূর্ণায়মান স্রোতের উদ্দামতা। নদীর ‘বাঁকা' জলস্রোতে পরিবেষ্টিত ছোট জমিটুকুর আশু বিলীয়মান হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে এ অংশে। বাঁকা জল এখানে কালস্রোতের প্রতীক।
তরুছায়ামসী-মাখা                -         গাছপালার ছায়ার কালচে রং মাখা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে
কে আসে পারে                    -       এক অপ্রত্যাশিত মাঝি হিংস্র জলস্রোত অবলীলাক্রমে পাড়ি দিয়ে ছোট নৌকা বেয়ে এগিয়ে আসে। কে এই মাঝি? রবীন্দ্রনাথের মতে এই মাঝি আসলে মহাকালের প্রতীক।
দেখে যেন মনে হয়
চিনি উহারে                       -       কৃষকের ধারণা, নৌকার মাঝি সম্ভবত তাঁর পূর্ব পরিচিত।
কোনো দিকে নাহি চায়             -         যে মাঝিকে মনে হয়েছিল পূর্ব পরিচিত বলে, তাঁর আচরণে অপরিচয়ের নির্বিকারত্ব ও নিরাসক্তি।
ওগো, তুমি কোথা যাও
কোন বিদেশে?                    -       নির্বিকার মাঝিকে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কৃষকের চেষ্টা।
বারেক ভিড়াও তরী
কূলেতে এসে                      -       মাঝিকে তরী ভেড়ানোর জন্যে কৃষকের সনির্বন্ধ অনুনয়।
আর আছে?-আর নাই,
দিয়েছি ভরে                        -       ছোট জমিতে উৎপন্ন ফসলের সমস্তটাই তুলে দেয়া হয় নৌকায়।
থরে বিথরে                         -       স্তরে স্তরে, সুবিন্যস্ত করে।
এখন আমারে
লহো করুণা করে                  -       কৃষকের অনুনয়ে আছে ঐ তরীতে ঠাঁই পাওয়ার আকুল ইচ্ছা। কারণ তা না হলে নিষ্ঠুর স্রোতে তাঁর বিলীয়মান হওয়ার আসন্ন আশঙ্কা।
ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই
ছোটো সে তরী                     -       মহাকালের প্রতীক এই তরণীতে কেবল সোনার ফসলরূপ মহৎ সৃষ্টিকর্মের ঠাঁই হয়। কিন্তু ব্যক্তিসত্তাকে অনিবার্যভাবে হতে হয় মহাকালের নিষ্ঠুর কালগ্রাসের শিকার।
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি                          -       নিঃসঙ্গ অপূর্ণতার বেদনা নিয়ে আসন্ন ও অনিবার্য মৃত্যুর প্রতীক্ষার ইঙ্গিত। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মহাকাল আমার সর্বস্ব লইয়া যায় বটে, কিন্তু আমাকে ফেলিয়া যায় বিস্মৃতি ও অবহেলার মধ্যে। ... সোনার তরীর নেয়ে আমার সোনার ধান লইয়া যায় খেয়াপারে, কিন্তু আমাকে লয় না।'

 


উৎস ও পরিচিতি
‘সোনার তরী’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনার তরী' কাব্যগন্থের নামকবিতা। এ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত কবিতাটি নিয়ে বহু আলোচনা, ব্যাখ্যা ও তর্কবিতর্ক হয়েছে।
একটি ছোট ক্ষেত। চারপাশে প্রবল স্রোতের বিস্তার। সোনার ধান নিয়ে একলা কৃষক। অবলীলায় তরী বেয়ে আসা নেয়ে- এ কয়েকটি চিত্রকল্প ও সেগুলোর অনুষঙ্গে রচিত এক অনুপম কবিতা ‘সোনার তরী’।
ক্ষুরধার বর্ষার নদীস্রোত হিংস্র হয়ে খেলা করছে দ্বীপসদৃশ ধানক্ষেতের চারপাশে। সেখানে রাশি রাশি সোনার ধান কেটে নানা আশঙ্কা নিয়ে একেলা অপেক্ষমাণ এক কৃষক। এমন সময় অপ্রত্যাশিতভাবে ভরাপালে তরী বেয়ে আসে এক নেয়ে বা মাঝি। নিঃসঙ্গ কৃষক আশার আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, যখন তার মনে হয় মাঝিটি যেন তার চেনা। কিন্তু নির্বিকারভাবে অজানা দেশের দিকে চলে যেতে থাকে সেই মাঝি। নিঃসঙ্গ কৃষক কাতর অনুনয় করে মাঝি যেন কূলে তরী ভিড়িয়ে তার সোনার ধানটুকু নিয়ে যায়। তারপর সে ধান যেখানে খুশি, যাকে খুশি সে ইচ্ছেমত বিলিয়ে দিতে পারে। অবশেষে ঐ সোনার তরীতে তার ভারা ভারা ফসল নিয়ে মাঝি চলে যায়, কিন্তু ছোট তরীতে কৃষকের স্থান হয় না। সোনার ধান নিয়ে তরী চলে যায় অজানা দেশে। আর শনূ নদীতীরে অপূর্ণতার বেদনা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কৃষক একা।
এ কবিতায় একই সঙ্গে অন্তলীন হয়ে আছে একটি জীবনদর্শন। মহাকালের চিরন্তর স্রোতে মানুষ অনিবার্য বিষয়কে এড়াতে পারে না, কেবল টিকে থাকে তার সৃষ্ট সোনার ফসল। এমনিভাবে কবির সৃষ্টকর্ম কালের সোনার তরীতে স্থান পেলেও ব্যক্তিকবির স্থান সেখানে হয় না। এক অতৃপ্তির বেদনা নিয়ে তাকে অপেক্ষা করতে হয় অনিবার্যভাবে মহাকালের শূন্যতায় বিলীন হওয়ার জন্য।

ছন্দ
কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত জন্দে রচিত। ৮ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। পূর্ণ পর্ব ৮ মাত্রার, অপূর্ণ পর্ব ৫ মাত্রার। আপাতভাবে কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত বলে মনে হয়। কিন্তু সর্বশেষ স্তবকের ‘শূন্য' শব্দটি আমাদের দেখিযে দেয় যে, এটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতা। ‘শূন্য' মাত্রাবৃত্তে ৩ মাত্রা। সে হিসেবে ‘শূন্য নদীর তীরে' ৮ মাত্রার পর্ব; অক্ষরবৃত্ত ছন্দ হলে ১ মাত্রা কম পড়ত।
অনুশীলনমূলক কাজ
ভাষা অনুশীল q সাপেক্ষ সর্বনাম
কখনও কখনও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত একাধিক সর্বনাম পদ একই সঙ্গে ব্যবহৃত হয়ে দু'টি বাক্যের সংযোগ সাধন করে থাকে। এদেরকে বলা হয় সাপেক্ষ সর্বনাম। যেমন, ‘সোনার তরী' কবিতায় :
                  যত চাও তত লও
এ রকম :
                  যতা চেষ্টা করবে ততই সাফল্যের সম্ভাবনা।
                  যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা
                  যত গর্জে তত বর্ষে না।
এ ধরনের আরও কয়েকটি সর্বনামের উদাহরণ :
                  যেই কথা সেই কাজ।
                  যেমন কর্ম তেমন ফল।
                  যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল।
নির্ধারক বিশেষণ
দ্বিরুক্ত শব্দ ব্যবহার করে যখন একের বেশি কোনো কিছুকে বোঝানো হয় তাকে নির্ধারক বিশেষণ বলে। যেমন, ‘সোনারতরী' কবিতায় : রাশি রাশি ভারা ভারা ধান।
এ রকম আরও উদাহরণ :
                                লাল লাল কৃষ্ণচূড়ায় গাছ ভরে আছে
                                নববর্ষ উপলক্ষে ঘরে ঘরে সাড়া পড়ে গেছে।
                                এত ছোট ছোট উত্তর লিখলে হবে না।
বুৎপত্তি নির্দেশ
গরজে                            < গর্জে                                  ঠাঁই                               <         স্থান
বরষা                             < বর্ষা                                   সোনা                             <         স্বর্ণ।
বরশা                             < বর্শা।

দীর্ঘ-উত্তর প্রশ্ন
১. ‘সোনার তরী’ কবিতার ভাববস্ত্ত গুছিয়ে লেখ।
২. ‘সোনার তরী’ কবিতায় যে চিত্র অাঁকা হয়েছে তা বর্ণনা কর। এ চিত্রের অন্তরালে রবীন্দ্রনাথ কোন গভীর ভাবকে ব্যক্ত করতে চেয়েছেন?

বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১. ‘সোনার তরী’ কবিতায় কবি ‘ক্ষুরধারা’, ‘চারি দিকে বাঁকা জল’, ‘মসীমাখা’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে কোন পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছেন?
২. আসন্ন দুর্যোগের মুখে দাঁড়িয়ে একলা কৃষক কোন ঘটনায় আনন্দে উদ্বেল হয়েছে? সে কাকে কী অনুনয় করেছে?
৩. কৃষকের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হয়েছিল? ‘শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি’- কথাটি দিয়ে কৃষকের কোন মনোভাব ব্যক্ত করা হয়েছে?
৪. ‘সোনার তরী’ কবিতায় ‘আমি একেলা’ বলতে ‘নিঃসঙ্গ কৃষক’ না বুঝিয়ে যদি ‘কবির ব্যক্তিসত্তা’কে বোঝানো হয়, তবে এ কবিতার কী অর্থ দাঁড়ায়?

ভাষাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১. শিষ্ট চলিত গদ্যে রূপান্তরিত কর :
    ক) চারি দিকে বাঁকা জল ... আমি একেলা।
    খ) ওগো তুমি ... কূলেতে এসে।
    গ) শ্রাবণগগন ঘিরে ... সোনার তরী।
২. নির্ধারক বিশেষণ কাকে বলে? ‘সোনার তরী’ কবিতা থেকে একটি উদাহরণসহ মোট পাঁচটি নির্ধারক বিশেষণের প্রয়োগ দেখাও।
৩. নিচের সমোচ্চারিত শব্দগুলোর অর্থ পার্থক্য দেখিয়ে বাক্য রচনা কর :
    বরশা, বরষা, ক্ষুরধার, ক্ষুরধারা, কূল, কুল।
৪. সাপেক্ষ সর্বনাম কাকে বলে? এ ধরনের সর্বনামের তিনটি উদাহরণের দু’টি করে প্রয়োগ দেখাও।

ব্যাখ্যা
সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা লেখ :
১. একখানি ছোটো খেত ... করিছে খেলা
২. ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ... গিয়েছে ভরি।

View Foundation Digital Talking Library is developed and maintained by Sigma Enterprise.
Theme designed by Imtiaz
All rights are reserved. Any kind of reproduction of any mp3 files and text files is prohibited. If any organization or any person is found copying or reproducing any of the material will be punished under copy right law.