পৃষ্ঠা ২২
দ্বিতীয় অধ্যায়
বাংলাদেশের কতগুলো সামাজিক সমস্যা

ভূমিকা
কোন সমাজই সামগ্রিকভাবে পরিপূর্ণ নয়। সমাজ বিকাশের কোন পর্যায়েই সমাজ সমস্যামুক্ত ছিল না। সব সমাজে কোন না কোন ধরনের সমস্যা বিদ্যমান ছিল। কারণ সমাজ গঠনের অপরিহার্য উপাদান হল মানুষ। আর একাধিক মানুষ থাকলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া থাকবে। আর পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া থেকে স্বাভাবিকভাবেই সমস্যা সৃষ্টি হবে এবং সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টাও চলতে থাকবে। সামাজিক সমস্যা সমাধানের অব্যাহত প্রচেষ্টাই সমাজকে আদিম পর্যায় হতে বর্তমান পর্যায়ে উপনীত করেছে। সুতরাং বলা যায়, সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টাই সামাজিক পরিবর্তনের মূল নিয়ামক। সামাজিক সমস্যা না থাকলে সমাজ স্থবির হয়ে পড়তো।
সামাজিক সমস্যার ধারণা
সমাজ এবং সমস্যা পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। সমাজ থাকলে সমস্যাও থাকবে। তবে সব সমস্যাকে, সামাজিক সমস্যা বলা যায় না। ‘সামাজিক’ এবং ‘সমস্যা’ এ দুটি শব্দ প্রয়োগের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করলে সামাজিক সমস্যা প্রত্যয়টি উপলব্ধি করা সহজ হয়।
ইংরেজি প্রব্লাম শব্দের বাংলা পরিভাষা ‘সমস্যা’। গ্রীক শব্দ প্রব্লামাহতে ইংরেজি প্রব্লাম শব্দের উৎপত্তি; যার অর্থ হলো, এমন একটি নিক্ষেপিত ঘটনা, যা মানুষের চিন্তাভাবনার বা মনোযোগ আকর্ষণের চাপ সৃষ্টি করে। যখন মানুষ কোন নিক্ষেপিত ঘটনা দ্বারা অন্তরায় বা বাঁধার সম্মুখীন হয়, তখন সেটি সমস্যা রূপে বিবেচিত হয়। যখন সমস্যার সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্ক, প্রচলিত জীবনধারা, সামাজিক আদর্শ ও সামাজিক মূল্যবোধ সংশ্লিষ্ট থাকে, তখন সমস্যাকে সামাজিক শব্দ দ্বারা বিশেষিত করে ‘সামাজিক সমস্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী নিস্বেট এবং মার্টন এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য । তারা বলেছেন, সামাজিক সমস্যার সঙ্গে সমাজের লোকদের পারস্পরিক সম্বন্ধ এবং প্রচলিত জীবন ধারাগত আদর্শ বা মূল্যবোধ জড়িত থাকে বলে সামাজিক শব্দ দ্বারা সমস্যাকে বিশেষিত করা হয়।
সামাজিক সমস্যা হলো কোন সমাজের অধিক সংখ্যক লোকের অবাঞ্ছিত ও আপত্তিজনক আচরণ, যে আচরণ পরিবর্তনের প্রয়োজন জনগণ অনুভব করে। সামাজিক সমস্যা মানুষের পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্ক ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়া থেকে উদ্ভূত। বিচ্ছিন্ন এবং ব্যক্তিগত সমস্যাকে সামাজিক সমস্যা বলা হয় না।
সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা
সামাজিক সমস্যা হলো সামাজিক সম্পর্ক ও মিথষ্ক্রিয়া থেকে সৃষ্ট একটি অস্বাভাবিক ও অবাঞ্ছিত অবস্থা। যে অস্বাভাবিক অবস্থা সমাজের সামগ্রিক মঙ্গল ও কল্যাণের পরিপন্থী বলে গণ্য, সে অবস্থাকে সাধারণভাবে সামাজিক সমস্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়। সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে সামাজিক সমস্যা প্রত্যয়টির সংজ্ঞা দিয়েছেন। মনীষীদের সংজ্ঞাসমূহ সামাজিক সমস্যার সাধারণ ব্যাখ্যা প্রদান ও প্রকৃতি নির্ণয়ে বিশেষ সহায়ক।
রবার্ট এল বার্কার প্রণীত সমাজকর্ম অভিধানের (১৯৯৫) ব্যাখ্যানুযায়ী, সামাজিক সমস্যা হলো জনগণের মধ্যেকার এমন একটি অবস্থা, যার প্রভাবে কিছু লোকের মূল্যবোধ ও আদর্শের বিচ্যুতি ঘটে মানুষের আবেগীয় অথবা আর্থিক দুর্গতির কারণ হয়। সামাজিক সমস্যার উদাহরণ হলো অপরাধ, সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র, বর্ণবাদ, মাদকের অপব্যবহার, সীমিত সম্পদের অসম বণ্টন। মনীষী সিএম কেস এর মতে, ‘‘সামাজিক সমস্যা হলো এমন একটি সামাজিক অবস্থা, যা সমাজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সচেতন ও যোগ্য পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং যে অবস্থা সম্পর্কে যৌথ কার্যক্রম গ্রহণের আবেদন ও অনুভূতি সৃষ্টি হয়।’’ সমাজবিজ্ঞানী এলকে ফ্রাঙ্ক আমেরিকান জার আল অব সোসিওলোজীতে প্রকাশিত সোসাল প্রব্লাম নামক প্রবন্ধে সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাঁর মতে ‘‘সামাজিক সমস্যা বলতে এমন একটি সামাজিক অসুবিধা কিংবা অসংখ্য লোকের অসদাচরণকে বুঝায়, যাকে শোধরানো কিংবা দূর করা দরকার।’’
সমাজবিজ্ঞানী পিবি হর্টন এবং জেআর লেসলী তাঁদের গ্রন্থে বলেছেন ‘‘সামাজিক সমস্যা হলো সমাজ জীবনের এমন একটি অস্বাভাবিক অবস্থা, যা সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে এবং যার সম্পর্কে যৌথ সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে কিছু করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়” । আলোচ্য সংজ্ঞাটি সামাজিক সমস্যার প্রকৃতি বিশ্লেষণে তাৎপর্য বহন করছে। এতে সামাজিক সমস্যাকে সমাজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোকের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তারকারী অবাঞ্ছিত ও অপ্রত্যাশিত অবস্থা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যার সম্পর্কে সমাজের মানুষ সচেতন। ফলে তারা যৌথ প্রয়াসের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু একটা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
পৃষ্ঠা ২৩
সামাজিক সমস্যার ব্যাপক এবং নির্দিষ্ট স্বরূপ নির্ধারণ করে ডেভিড ড্রেসলার বলেছেন, ‘‘সামাজিক সমস্যা হলো মানুষের সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া থেকে সৃষ্ট এমন একটি অবস্থা, যে অবস্থাকে সমাজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক অস্বাভাবিক বা অবাঞ্ছিত বলে বিবেচনা করে এবং প্রতিকার বা প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে দূরীকরণে তারা বিশ্বাসী হয়।’’
সমাজবিজ্ঞানীদের প্রদত্ত বিভিন্ন সংজ্ঞার আলোকে বলা যায়, ‘‘সামাজিক সমস্যা হলো এমন একটি অবাঞ্ছিত বা অস্বাভাবিক অবস্থা যা সমাজের প্রতিষ্ঠিত রীতি-নীতি ও কল্যাণ বিরোধী এবং যে অস্বাভাবিক অবস্থা সমাজ কাঠামোতে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও জীবনযাত্রা ব্যাহত করে। যার প্রতিকারের জন্য সমাজের মানুষ যৌথ কার্যক্রম গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।’’
সমাজের কোন অবস্থা বা পরিস্থিতিকে সামাজিক সমস্যা বলে চিহ্নিত করা হবে, তা একটি বিমূর্ত বিচার্য বিষয়। কারণ স্থান-কালভেদে সামাজিক সমস্যার ধারণা পরিবর্তিত হয়। এক সমাজের জন্য যা সমস্যা, অন্য সমাজে তা সমস্যা নাও হতে পারে। আবার এক সময় যাকে সমস্যা বলে বিবেচনা করা হতো, সময়ের পরিবর্তনে তাকে সমস্যা নাও বলা যেতে পারে। সুতরাং স্থান ও কাল বিবেচনা না করে সামাজিক সমস্যা বিশ্লেষণ যুক্তিযুক্ত এবং অর্থবহ হতে পারে না। সুতরাং সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা সামাজিক দিক হতে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
সামাজিক সমস্যার বৈশিষ্ট্য
সামাজিক সমস্যার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য নিচে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো। এসব বৈশিষ্ট্যগুলো সামাজিক সমস্যার প্রকৃতি নির্ধারণে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
১. সমাজের বৃহত্তর অংশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব : বিচ্ছিন্ন কোন অবস্থাকে সামাজিক সমস্যা বলা যায় না। সমাজের বৃহৎ অংশের ওপর বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিগত সমস্যার প্রভাব না পড়া পর্যন্ত, তা সামাজিক সমস্যারূপে গণ্য হয় না। সমাজের সামগ্রিক মঙ্গলের পরিপন্থী বলে গণ্য হলে, তাকে সামাজিক সমস্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়। যেমন প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন শিক্ষার্থী প্রত্যাশিত ফল লাভে ব্যর্থ হয়ে উপর্যুক্ত চাকরী না পেয়ে বেকার হলে, তা বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিগত সমস্যা বলে বিবেচিত। কিন্তু যদি শিক্ষা ব্যবস্থা সামাজিক প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম হবার প্রভাবে শিক্ষিত বেকারত্ব সৃষ্টি হয় তবে তা সামাজিক সমস্যা রূপে গণ্য হবে।
২. পরিমাপযোগ্যতা : সমাজ বিজ্ঞানী ফান্সিস ই ম্যারিল সামাজিক সমস্যার অপরিহার্য উপাদান হিসেবে অস্বাভাবিক অবস্থাকে পরিমাপযোগ্য হতে হবে বলে মত পোষণ করেছেন। যে অবস্থার বিরূপ প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া পরিমাপযোগ্য নয়, তাকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। সমস্যার গতি প্রকৃতিই সমস্যা পরিমাপের নির্দেশনা দান করে। পরিমাপযোগ্য বলেই সামাজিক সমস্যা সমাধানযোগ্য।
৩. সামাজিক মূল্যবোধ ও আদর্শের পরিপন্থী : যখন কোন অস্বাভাবিক অবস্থা প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ ও আদর্শের প্রতি হুমকির সৃষ্টি করে, তখন তাকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সমাজ বিজ্ঞানী ফান্সিস ম্যারিল প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করাকে সামাজিক সমস্যার অপরিহার্য উপাদান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
৪. পরিবর্তনশীলতা : সমাজ পরিবর্তনশীল। সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সামাজিক সমস্যার গতি-প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। সময় ও স্থানভেদে সামাজিক সমস্যার প্রকৃতিতে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন পূর্বে যে অবস্থাকে দারিদ্র বলা হতো, এখন সে অবস্থাকে বলা হয় না। আবার পাশ্চাত্যের উন্নত দেশে দারিদ্র বলতে যে অবস্থাকে বুঝানো হয়, বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশে সে অবস্থাকে বুঝানো হয় না। সুতরাং সামাজিক পরিবর্তনের ফলে সামাজিক সমস্যারও গতি-প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। আবার মানুষের ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধের পরিবর্তন হলেও সামাজিক সমস্যার ধারণাগত পরিবর্তন ঘটে। যেমন, এক সময় দাস এবং সতীদাহ প্রথার প্রবর্তন সমাজে অনুমোদিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মানুষের ধ্যান-ধারণা পরিবর্তিত হওয়ায়, দাস এবং সতীদাহ প্রথা একটি সমস্যায় পরিণত হয়।
৫. ক্রমাগত প্রতিক্রিয়া ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা : সমাজের বিভিন্ন অংশ পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত ও নির্ভরশীল। সমাজের একদিকে অসংহতি বা বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে, অন্যদিকের ওপর এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ একদিককে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সমস্যা এককভাবে সমাজে বিরাজ করে না, সমাজের অন্যান্য দিকেও এর প্রভাব পড়ে। আবার স্বাস্থ্যহীনতার ফলে কর্মক্ষমতা হ্রাস পেয়ে উপার্জন ব্যাহত হলে মানুষ দারিদ্রের শিকার হতে পারে। এভাবে সামাজিক সমস্যার ক্রমাগত প্রতিক্রিয়া ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার প্রভাবে সমাজে বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি হয়। কোন সমস্যা একক এবং বিচ্ছিন্নভাবে সমাজে বিরাজ করে না। একটি সামাজিক সমস্যা অন্যটির কারণ হিসেবে বিরাজ করে।
৬. সমস্যার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিক বিদ্যমান থাকে : প্রতিটি সামাজিক সমস্যার দুটি কারণ বিদ্যমান থাকে। একটি হচ্ছে পরিবেশগত এবং অপরটি মনস্তাত্ত্বিক। এগুলো সামাজিক সমস্যা সৃষ্টিতে প্রবণতা সৃষ্টিকারী এবং অব্যবহিত উপাদান হিসেবে কাজ করে।
পৃষ্ঠা ২৪
৭. বিশেষ সামাজিক সমস্যা সর্বজনীন : আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিভিন্নতা ও পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক সমস্যাও বিভিন্ন হয়। তবে মানুষের কতকগুলো মৌল চাহিদা সর্বজনীন এবং এগুলোকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সামাজিক সমস্যাগুলোও সর্বজনীন। যেমন দরিদ্রতা, অপরাধ প্রবণতা প্রভৃতি সমাজে সবসময় বিদ্যমান ছিল, বর্তমানেও রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। শুধু মাত্রাগত দিক হতে এসব সমস্যার পরিবর্তন হয়।
৮. যৌথ প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত : যে কোন অস্বাভাবিক অবস্থাকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না, যতক্ষণ পর্যন্ত অস্বাভাবিক ও ক্ষতিকর অবস্থা দূরীকরণের বা মোকাবেলা করার লক্ষ্যে যৌথ প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত না হয়। অর্থাৎ পরিস্থিতি সম্পর্কে জনগণের উদ্বেগ ও সচেতনতা সৃষ্টি না হলে, তাকে সমস্যা বলা যাবে না। যেমন- সতীদাহ প্রথা প্রচলিত হবার পর এটি সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়নি। কিন্তু যেদিন থেকে মানুষ সতীদাহ প্রথার অমানবিক দিক সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে এবং এর বিরুদ্ধে কিছু একটি করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, সেদিন হতে সতীদাহ প্রথা একটি সমস্যারূপে পরিগণিত হয়।
৯. সমাজভেদে সামাজিক সমস্যার পার্থক্য : সমাজভেদে সামাজিক সমস্যার গতি-প্রকৃতিতে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সামাজিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপটে সামাজিক সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকায় সমাজভেদে সামাজিক সমস্যার মধ্যেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন- আমেরিকায় যে অবস্থাকে বস্তি বলা হয়, বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশে সে অবস্থাকে বস্তি বলা হয় না।
১০. সমাধানযোগ্যতা : সামাজিক সমস্যার লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমস্যার গতি-প্রকৃতিই সমাধানের দিক নির্দেশ করে। কোন সামাজিক সমস্যা অসমাধানযোগ্য নয়। সমস্যার মধ্যেই নিহিত থাকে সমাধানের উপকরণ। অসমাধানযোগ্য বলে বিবেচিত অবস্থাকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে গণ্য করা যায় না। যেমন প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট বন্যা, নদীর ভাঙ্গন সামাজিক সমস্যা নয়। কিন্তু এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবে সৃষ্ট দরিদ্রতা, স্বাস্থ্যহীনতা সামাজিক সমস্যা রূপে গণ্য।
সামাজিক সমস্যার শ্রেণী বিভাগ
সামাজিক সমস্যার প্রকৃতি ও কারণের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যখন কোন বিশেষ অবস্থা মানুষের সামাজিক ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে বাঁধা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তখন তা সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়। সামাজিক ভূমিকা পালনে দু’দিক হতে বাঁধার সৃষ্টি হয়। প্রথমত, বাহ্যিক ও পারিপার্শ্বিক অর্থাৎ সামাজিক পরিবেশগত অবস্থা থেকে। অন্যটি, মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা হতে নিরাশা, হতাশা ও উত্তেজনা সৃষ্টি। সুতরাং বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ হতে সামাজিক সমস্যাকে ১. পরিবেশগত সামাজিক সমস্যা, যেটি সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে সৃষ্ট এবং ২. মানসিক সমস্যা, যা মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত- এ দু’ভাগে ভাগ করা যায়।
সমাজবিজ্ঞানী এইচএ পিলপ্স তাঁর গ্রন্থে সামাজিক সমস্যার কারণের পরিপ্রেক্ষিতে চার শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। তার মতে, প্রতিটি সমাজেই মানুষের ধনসম্পদ, মনোঃদৈহিক ভারসাম্য রক্ষা, দলগত ও ব্যাক্তিগত সামঞ্জস্য বিধানের কতকগুলো আদর্শ (ঘড়ৎস) থাকে। এসব আদর্শের বিচ্যুতি থেকে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক সমস্যাকে নিচের চার শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
১. অর্থনৈতিক সমস্যা : যেমন- দারিদ্র, বেকারত্ব, পরনির্ভরশীলতা, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদি।
২. জৈবিক সমস্যা : যেমন- বিকলাঙ্গতা, শারীরিক রোগ, দৈহিক ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি।
৩. মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা : স্নায়ুরোগ, ক্ষীণমেধা, নেশাগ্রস্ততা, মানসিক বিকৃতি, আত্মহত্যা প্রবণতা, ব্যক্তিত্বের সামঞ্জস্যহীনতা।
৪. সাংস্কৃতিক সমস্যা : গৃহ সমস্যা, বিবাহ বিচ্ছেদ, বিধবা ও প্রবীণদের সমস্যা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, অবৈধ মাতৃত্ব, অপরাধ প্রবণতা ইত্যাদি।
বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ হতে সমাজবিজ্ঞানী আরকে মার্টন সামাজিক সমস্যাকে দু’টি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন-
১. সামাজিক বিশৃঙ্খলা : যেমন- বেকার সমস্যা, দারিদ্র, গৃহ সমস্যা, রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত, শ্রমিক সমস্যা ইত্যাদি।
২. বিচ্যুতি আচরণ : যেমন- তালাক, অপরাধ, দুর্নীতি, যৌতুক প্রথা, বুদ্ধিহীনতা, পতিতাবৃত্তি ইত্যাদি।
সামাজিক সমস্যার কারণ
যে কোন সমস্যা সমাধানের পূর্বশর্ত হচ্ছে সমস্যার উৎস সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান লাভ করা। সমস্যার মূল উৎস না জেনে সমস্যার হয়তো সাময়িক সমাধান দেয়া সম্ভব, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সমাধান আশা করা যায় না। সামাজিক সমস্যার মূল উৎস হল সমাজ। ত্রুটিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা থেকেই সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। সমাজবিজ্ঞানীদের প্রদত্ত মন্তব্য হতে সামাজিক সমস্যার বহুমুখী উৎস ও কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সামাজিক সমস্যার কারণ নির্ণয়ের প্রেক্ষাপট হিসেবে সমাজবিজ্ঞানীদের মতামত উল্লেখ করা প্রয়োজন। যা সামাজিক সমস্যার উৎস ও কারণ নির্ণয়কে সহজবোধ্য করে তুলবে।
সমাজবিজ্ঞানী অগবার্ণ এবং নিমকফ সামাজিক সমস্যার তিনটি মৌল কারণের উল্লেখ করেছেন। যেমন-
পৃষ্ঠা ২৫
ক. প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সমাজস্থ মানুষের বা তাদের জীবনধারার অসঙ্গতি ঘটলে সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে বন্যা, ভূমিকম্প, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় মানুষ খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হলে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
খ ব্যক্তির সহজাত প্রকৃতির সঙ্গে সমষ্টিগত জীবনের বা জীবনধারার সমন্বয়ের অভাব হলে সমস্যার উদ্ভব হয়।
গ. মানব সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে অসম পরিবর্তনজনিত অসঙ্গতি হতে সামাজিক সমস্যা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
সমাজবিজ্ঞানী গিলিন এবং অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, ‘‘বিশ্বজগতের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে সমাজের সামঞ্জস্য বিধানের ব্যর্থতা হতে সব সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হয়।’’
সমাজবিজ্ঞানী উলফ) তাঁর গ্রন্থে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে সামাজিক সমস্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ‘‘অতিরিক্ত জনসংখ্যার ফলে যখন মানুষের মৌল চাহিদা পূরণ অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হয়।’’
সমাবিজ্ঞানী সিএম কেইস গ্রন্থে সামাজিক সমস্যার উৎস হিসেবে চারটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন। ১. প্রতিকূল প্রাকৃতিক অবস্থা ২. জনসংখ্যার ত্রুটিপূর্ণ প্রকৃতি ৩. অসংগঠিত ও ত্রুটিপূর্ণ সামাজিক বিন্যাস ৪. বিভিন্ন শ্রেণীর আদর্শ ও মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব।
সামাজিক সমস্যার কারণ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীদের মন্তব্য হতে প্রতীয়মান হয়, সামাজিক সমস্যার একক ও সর্বজনীন কারণ নির্ণয় সম্ভব নয়। প্রত্যেক সমাজবিজ্ঞানীই সামাজিক সমস্যার কারণ হিসেবে প্রাকৃতিক, জৈবিক, মানসিক এবং সাংস্কৃতিক উপাদানের যে কোন একটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তা সত্ত্বেও সামাজিক সমস্যার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের আলোকে কতিপয় প্রধান কারণ আলোচনা করা হলো।
১. ত্রুটিপূর্ণ জনসংখ্যার গঠন এবং জনসংখ্যাস্ফীতি : সমাজবিজ্ঞানী জনসংখ্যাকে সামাজিক সমস্যার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, অতিরিক্ত জনসংখ্যার প্রভাবে যখন মানুষের মৌল চাহিদা পূরণ সম্ভব হয় না, তখন মৌল চাহিদা অপূরণজনিত কারণে বিভিন্ন সমস্যার উদ্ভব হয়। অনুন্নত দেশে সীমিত শিল্পায়নের ফলে উৎপাদন যে হারে বৃদ্ধি পায়, সে তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক বেশি হওয়ায় মানুষের সার্বিক চাহিদা পূরণ ব্যাহত হয়ে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করে। আবার, জনসংখ্যার ত্রুটিপূর্ণ গঠন কাঠামো (যেমন বয়স, লিঙ্গ, অঞ্চল) সামাজিক সমস্যা সৃষ্টিতে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। যেমন- বাংলাদেশে বেকারত্ব, দরিদ্রতা, স্বাস্থ্যহীনতা, পুষ্টিহীনতাসহ অসংখ্য সমস্যার প্রধান কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জনসংখ্যার ত্রুটিপূর্ণ গঠন কাঠামো।
২. সামাজিক পরিবর্তন : সমাজ পরিবর্তনশীল এবং সামাজিক পরিবর্তন বিভিন্নভাবে সংঘটিত হয়। সমাজের সবক্ষেত্রে সমহারে পরিবর্তন আসে না। অসম পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার সঙ্গে মানুষ সামঞ্জস্য বিধানে ব্যর্থ হয়, তখন সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হয়। অপরিকল্পিত সামাজিক পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা হ্রাস ও ভূমিকা পালনের ব্যর্থতা হতে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
৩. জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ সমাজ বহির্ভূত যেসব কারণে সমাজে অপরিকল্পিত ও অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন আসে, তার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্যতম। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, জলোচ্ছাস, নদীর ভাঙ্গন ও ভূমিকম্পের প্রভাবে যে ধন-সম্পত্তির ক্ষতি হয়, তা বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করে। যেমন- প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে ধারাবাহিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপুল পরিমাণ জানমালের ক্ষতি হচ্ছে। তার প্রভাবে বিরাজমান সামাজিক সমস্যা জটিল আকার ধারণ এবং নতুন সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে। এ ছাড়া নদীর ভাঙ্গনে প্রতি বছর অসংখ্য লোক দারিদ্রের শিকার হচ্ছে। দারিদ্র, পুষ্টিহীনতা, স্বাস্থ্যহীনতা, দুঃস্থ ও অসহায় শিশুদের সমস্যা, অপরাধ প্রবণতা প্রভৃতি সমস্যার অন্যতম কারণ হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
৪. সমস্যার ক্রমাগত প্রতিক্রিয়া : সমাজ হলো সামাজিক সমস্যার মূল উৎস। সমাজের বিভিন্ন দিককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে সামাজিক সমস্যা। আর সমাজের বিভিন্ন দিক পরস্পর নির্ভরশীল এবং অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত বিধায় সমাজের বিভিন্ন দিককে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সমস্যাসমূহ পরস্পর সম্পর্কিত। সমাজের কোন একদিকে অসংগতি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে অন্যান্য দিকের ওপর এর প্রভাব পড়ে। সামাজিক সমস্যার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও ক্রমাগত প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে সমাজে বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি হয়। ফলে একটি সমস্যা একাধারে নিজে যেমন সমস্যারূপে বিরাজ করে, তেমনি অন্যান্য সমস্যার কারণ হিসেবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। জনগণের মাথাপিছু আয় কম এবং জীবনযাত্রার মান হ্রাস পেলে দারিদ্র সমস্যার সৃষ্টি হয়। আবার স্বাস্থ্যহীনতা, পুষ্টিহীনতা, নিরক্ষরতা, অজ্ঞতা, ভিক্ষাবৃত্তি, অপরাধ প্রবণতা প্রভৃতি বহুমুখী সমস্যার অন্যতম কারণ হলো দারিদ্র। অন্যদিকে নিরক্ষরতা বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা। নিরক্ষরতার কারণে অজ্ঞতা, দারিদ্র, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যহীনতা প্রভৃতি সমস্যার সৃষ্টি হয়। এভাবে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও ক্রমাগত প্রতিক্রিয়ার ফলে সমাজে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়।
৫ অসম সাংস্কৃতিক পরিবর্তনঃ মানুষের জীবন প্রণালী বা জীবনধারার পরিপূর্ণ রূপ হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতির দু’টি দিক রয়েছে। একটি হলো বস্তুগত এবং অন্যটি অবস্তুগত। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে বিদেশি প্রযুক্তি আমদানি ও কারিগরি সহযোগিতার মাধ্যমে আধুনিকীকরণের
পৃষ্ঠা ২৬
প্রক্রিয়া চালু করা হয়। মানুষের মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণের পূর্বে উন্নত দেশের অনুকরণে ও সহায়তায় উন্নত প্রযুক্তি প্রবর্তন এবং প্রয়োগের চেষ্টা করা হয়। ফলে বস্তুগত উন্নয়ন ও অবস্তুগত উন্নয়ন অর্থাৎ আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্যহীনতার পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক সংহতি ব্যাহত হয়। বিদেশি প্রযুক্তি আমদানি এবং লাগসই দেশীয় প্রযুক্তির প্রভাবে বাংলাদেশের মতো অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে যে পরিবর্তন আসে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের অক্ষমতাজনিত কারণে সৃষ্ট সাংস্কৃতিক শূন্যতা নানা ধরনের সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করে। সমাজবিজ্ঞানী এর মতে, মানব সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের অসম পরিবর্তনজনিত অসঙ্গতি হতে সামাজিক সমস্যা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। তাঁরা সাংস্কৃতিক শূন্যতাকে সামাজিক অসংগতির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
৬. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : যে কোন দেশের উন্নয়ন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাতের ফলে বিভিন্ন সামাজিক প্রতষ্ঠান যখন সুষ্ঠুভাবে স্ব-স্ব ভূমিকা পালনে অক্ষম হয়, তখন সমাজে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও সমস্যা সৃষ্টির অনুকূল প্রভাব বিরাজ করে। এছাড়া যুদ্ধ ও রাজনৈতিক সংঘাতের ফলে যে সম্পদ ও জনশক্তি ধ্বংস হয়, তার প্রভাবেও সমাজে সমস্যার সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ১৯৯৭-২০০২ পরিকল্পিত উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
৭ সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার অসম বন্টন : সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির মৌলিক কারণসমূহের মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে সম্পদের অসম বন্টন। মনীষী কার্লমার্কসের মতে, অর্থনৈতিক বৈষম্যই সামাজিক বিশৃঙ্খলার অন্যতম প্রধান কারণ। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্পদের অসম বন্টনের ফলে ধনী দেশসমূহ বিপুল পরিমাণ অর্থ সামরিক খাতে ব্যয় করছে। পক্ষান্তরে, দরিদ্র ও অনুন্নত দেশগুলোর বৃহৎ জনগোষ্ঠী ন্যূনতম মৌল চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
৮ মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব : মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের নিয়ামক হচ্ছে মূল্যবোধ। সমাজের পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠী ও দলের নিজস্ব মূল্যবোধ, আদর্শ এবং জীবনধারা রয়েছে। বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মূল্যবোধগত দ্বন্দ্বের ফলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। আবার সমাজের পরিবর্তনের ফলে প্রচলিত মূল্যবোধ ও আদর্শের পরিবর্তন ঘটে এবং নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টি হয়। নতুন এবং সনাতন মূল্যবোধের মধ্যে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, তার প্রভাবে সমাজে অনেক সমস্যা দেখা দেয়। এ ছাড়া মূল্যবোধের অবক্ষয় সমাজে বিভিন্ন সমস্যার প্রবণতা সৃষ্টি করে।
৯ শিল্পায়ন ও নগরায়নের প্রভাব : শিল্পায়ন এবং নগরায়নের প্রভাবে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। পতিতাবৃত্তি, বস্তি জীবনের উদ্ভব, সাংস্কৃতিক শূন্যতা প্রভৃতি নগরায়ন ও শিল্পায়নের প্রত্যক্ষ ফল। নগরায়ন ও শিল্পায়নের প্রভাবে দ্রুতহারে বস্তুগত পরিবর্তন হলেও সামাজিক পরিবর্তন সে অনুপাতে হয় না। যা সামাজিক সমস্যার জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
১০. রাজনৈতিক দর্শনের অনুপ্রবেশজনিত দ্বন্দ্ব : বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক ব্লকের বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র ও অনুন্নত দেশসমূহে নিজেদের প্রভাব এবং মতাদর্শ বজায় রাখার জন্য সদা সচেষ্ট। রাজনৈতিক দর্শনের অনুপ্রেবেশজনিত দ্বন্দ্বের প্রভাবে দরিদ্র দেশগুলোতে রাজনৈতিক সংঘাতের সূত্রপাত হয়। বিশ্বায়নের যুগে উগ্র জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রীয় দর্শনের অনুপ্রবেশজনীত কারণে উন্নয়নশীল দেশে সামাজিক সমস্যার ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। যার প্রভাবে সমাজে মৌল চাহিদা পূরণজনিত ব্যর্থতা হতে বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি হয়।
১১. বর্ণবৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতা : সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্য এবং সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব বিশেষ ভূমিকা পালন করে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতীয়তাবোধ সামাজিক সমস্যার উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। যেমন- পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলে, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, কাশ্মীর, বসনিয়া প্রভৃতি দেশের কথা উল্লেখ করা যায়। হিন্দু ধর্মের কঠোর বর্ণভেদ প্রথা এবং আফ্রিকা ও ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ দ্বন্দ্ব হতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। পূর্বেই বলা হয়েছে, সামাজিক সমস্যা হলো বর্তমান জটিল ও গতিশীল সমাজের সৃষ্ট অস্বাভাবিক অবস্থা। যেখানে মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ দ্রুত পরিবর্তিত হলেও, সামাজিক মূল্যবোধ, আদর্শ ও মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে না। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিবর্তন না হয়ে বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১২. প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতা : প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মৌল উপাদান। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের অভাবে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়া এদেশে উল্লেখ করার মতো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। ভূমি ও পানি সম্পদ সীমিত। পানি সম্পদের উৎস প্রতিবেশী দেশে অবস্থিত বিধায় এক্ষেত্রে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বিরাজমান। সামাজিক সমস্যার সঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
১৩. সামাজিক উত্তেজনা : সামাজিক সমস্যা উদ্ভবের অন্যতম কার্যকর প্রভাবক হলো সামাজিক উত্তেজনা, সামাজিক টানাপোড়ন ও দ্বন্দ্ব। সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রভাবে সৃষ্ট উত্তেজনা বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। আর এরূপ দ্বন্দ্ব থেকে শ্রেণী বৈষম্য, বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।
পৃষ্ঠা ২৭
সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ ও সমাধান
সামাজিক সমস্যার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পরিমাপযোগ্যতা বা সমাধানযোগ্যতা। তবে দারিদ্র, নিরক্ষরতা, অজ্ঞতা, পুষ্টিহীনতা ইত্যাদি সর্বজনীন। সামাজিক সমস্যা একেবারে সমাধান করা যায় না। সামাজিক সমস্যা সমাধান ও নিয়ন্ত্রণে যৌথ কার্যক্রম গ্রহণের গুরুত্ব অপরিসীম। সামাজিক সমস্যা বহুমুখী কারণের ফলে সৃষ্টি হয়। সুতরাং সমন্বিত উপায়ে বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা মোকাবেলা ও নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। নিচে সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ বা মোকাবেলার বিশেষ কতগুলো পদ্ধতির উল্লেখ করা হলো।
প্রাকৃতিক এবং সামাজিক গবেষণা : সামাজিক সমস্যা মোকাবেলার বিজ্ঞানসম্মত কৌশল হলো সামাজিক গবেষণা। সামাজিক সমস্যার কারণ, প্রভাব, প্রকৃতি, সমস্যা মোকাবেলার বিকল্প উপায়, সম্পদের প্রাপ্যতা প্রভৃতি দিক সম্পর্কে গবেষণা পরিচালনা করে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। পরিকল্পিত উপায়ে সমস্যা নিয়ন্ত্রণ ও সমাধানের পূর্বশর্ত হলো গবেষণা।
সামাজিক সমস্যা সমাধান এবং ভবিষ্যতে সামাজিক সমস্যা উদ্ভবের উৎস নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন প্রাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদসহ সব ধরনের সম্পদের যথাযথ ব্যবহার। প্রাকৃতিক সম্পদ আবিষ্কার, সম্পদের বহুমুখী ব্যবহার, উৎপাদন বৃদ্ধি, নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন প্রভৃতিক্ষেত্রে ধারাবাহিক গবেষণা পরিচালনা করা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ দূষণ রোধ, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা বহুমাত্রিক সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রাকৃতিক ও সামাজিক গবেষণা সমস্যা মোকাবেলার বিজ্ঞানসম্মত এবং কার্যকর কৌশল।
সামাজিক উত্তেজনা সৃষ্টিকারী উপাদানের নিয়ন্ত্রণ : সামাজিক সমস্যার প্রধান কারণ হলো সামাজিক উত্তেজনা। পারিবারিক, শ্রেণীগত, সাম্প্রদায়িক, বর্ণগত ইত্যাদি পর্যায়ে সৃষ্ট উত্তেজনা হতে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। সামাজিক উত্তেজনা সৃষ্টিকারি উপাদান দূরীকরণের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা উদ্ভবের সম্ভাবনা হ্রাস করা যায়। বিশেষ করে সমসাময়িক সমাজের সাম্প্রদায়িক, বর্ণগত, লিঙ্গগত এবং আঞ্চলিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সামাজিক সমস্যা প্রশমনে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী উপাদান নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব অপরিসীম। লিঙ্গ বৈষম্য, সম্পদের অসম বন্টনজনিত হতাশা ও ক্ষোভ, সম্পদ ও সুযোগ সুবিধার অসম বন্টন ইত্যাদি দূরীকরণ প্রয়োজন। উল্লেখ্য, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি উত্তেজনার উপাদান প্রশমনের প্রধান উপায়।
আইনগত নিয়ন্ত্রণ : সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবেলার কার্যকরী এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো সামাজিক আইন। সামাজিক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে শাস্তি এবং পুনর্বাসনমূলক ব্যবস্থার দ্বারা সামাজিক সমস্যা হ্রাস করা সম্ভব। নিরক্ষরতা, অপরাধী, কিশোর অপরাধ প্রবণতা, পতিতা, ভিক্ষুক ইত্যাদি ধরনের সমস্যা সামাজিক আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বর্তমানে বিশ্বের কল্যাণমুখী রাষ্ট্রগুলোতে পারিবারিক, বৈবাহিক, উত্তরাধিকার, তালাক, বাল্যবিবাহ, বিধবা বিবাহ, বহুবিবাহ ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্যা নিয়ন্ত্রণে সামাজিক আইন বলবত করা হয়। এছাড়া ভিক্ষাবৃত্তি, যৌনবৃত্তি, মাদকাসক্তি, কিশোর অপরাধ, অপরাধ, এতিম, প্রতিবন্ধি প্রভৃতি বিশেষ ধরনের সামাজিক সমস্যার প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য সামাজিক আইন প্রণয়ন করা হয়। সামাজিক আইনের সহায়তায় কল্যাণ রাষ্ট্রে সমস্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়। সমাজের অনুন্নত ও নিম্নশ্রেণীর জন্য গৃহায়ন, শিক্ষা, চিত্তবিনোদন, স্বাস্থ্যসেবা প্রভৃতি সুযোগ সুবিধা সামাজিক সমস্যা লাঘব করে। সামাজিক আইন সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকারের শক্তিশালী মাধ্যম।
আচরণের মধ্যে পরিবর্তন: সামাজিক সমস্যার উৎস হিসেবে চিহ্নিত মানব আচরণ বিশেষ করে পরিবার, বিবাহ, আন্তঃসম্প্রদায় সম্পর্ক, মাদকাসক্তি প্রভৃতি সংশ্লিষ্ট নেতিবাচক ও বিচ্যুত আচরণ পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চালানো। শিক্ষা, প্রচারণা, সংস্কার, যুব শ্রেণীর মধ্যে সামাজিক শিক্ষার প্রসার প্রভৃতি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে নেতিবাচক আচরণ নিয়ন্ত্রণ, ভবিষ্যত সামাজিক সমস্যা লাঘবে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন :সমাজকাঠামো সামাজিক সমস্যার প্রধান উৎস। সমাজকাঠামোর পরিকল্পিত পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বর্ণ প্রথা, সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক বৈষম্য প্রভৃতি প্রতিকারের জন্য সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রতিবেশী কেন্দ্র, জনসমষ্টি কেন্দ্র প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ইতিবাচক মিথষ্ক্রিয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা। যেসব সামাজিক প্রথা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক আচার-আচরণ সংগঠিত হয় সেগুলোর নেতিবাচক প্রভাব পরিবর্তন সাধন সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ ও বিমোচনের সহায়ক।
বাসত্মবসম্মত সামাজিক নীতি ও সামাজিক পরিকল্পনা : সামাজিক নীতি হলো সামাজিক সমস্যা মোকাবেলার যৌথ প্রচেষ্টা। অন্যদিকে, সামাজিক নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যম হলো সামাজিক পকিল্পনা। বাস্তব তথ্যভিত্তিক সামাজিক নীতি এবং সামাজিক পরিকল্পনা সামাজিক সমস্যা সমাধান ও প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। স্থিতিশীল ও দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণের পরিবেশ সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো সামাজিক নীতি ও সামাজিক পরিকল্পনা। সামাজিক নীতি ও পরিকল্পনার ভিত্তিতে গৃহীত সমন্বিত সমাজসেবা কার্যক্রম বাসত্মবায়ন ছাড়া পরিকল্পিত উপায়ে সমস্যা মোকাবেলা সম্ভব নয়। বিচ্ছিন্ন ও পরিকল্পিত কর্মসূচি দ্বারা সামাজিক সমস্যার স্বল্প মেয়াদী সমাধান সম্ভব।
সমাজসেবা: সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ ও বিমোচনের গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো সরকারি-বেসরকারি সংগঠনের মাধ্যমে সমাজসেবা কার্যক্রম বাস্তবায়ন। যাতে মানুষের মধ্যে মৌল চাহিদা পূরণজনিত ব্যর্থতা, হতাশা ও উত্তেজনা সৃষ্টি না হয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গৃহায়ন, উন্নত পরিবেশ
পৃষ্ঠা ২৮
প্রভৃতি খাতে সেবা প্রদান সামাজিক সমস্যা হ্রাসের সহায়ক। সরকারি আর্থিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক সমাজসেবামূলক কার্যাবলী সামাজিক সমস্যা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা: সমাজ চিন্তাবিদদের মতে বর্তমান যুগের ধর্মহীনতা, নাস্তিকতা এবং বস্ত্তবাদ হলো সামাজিক সমস্যার মূল উৎস। সমাজ চিন্তাবিদদের মতে বাধ্যতামূলক ধর্মীয় শিক্ষা সামাজিক সমস্যা বিমোচনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজবিজ্ঞানী পি. এ. সরোকিন এবং আরনল্ড টয়েনবীর মতে ধর্মীয় মূল্যবোধ গ্রহণ ও অনুসরণ সামাজিক সমস্যা বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের ব্যবহার ও সম্পৃক্তকরণ: সমাজ চিন্তাবিদ, রাজনীতিবিদ, গবেষক, শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী, অর্থনীতিবিদ, মনোবিদসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। বিশেষ পর্যায়ে গৃহীত যৌথ ও সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা মোকাবেলার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যার কারণ ও উৎস অনুসন্ধান, সেগুলো প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে প্রাপ্ত সম্পদ ও সুযোগ সুবিধার সম্ভাব্য সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হয়।
সামাজিক নিরাপত্তা : রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় জাতীয় পর্যায়ে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ, যাতে যে কোন ধরনের দূর্যোগকালীন সময়ে সর্বস্তরের জনগণ আর্থিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার সুযোগ লাভের নিশ্চয়তা পায়। পরিকল্পিত সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া সামাজিক সমস্যার কার্যকর মোকাবেলা প্রায় অসম্ভব। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইংল্যান্ডে সৃষ্ট ব্যাপক সামাজিক বিপর্যয় মোকাবেলায় বিখ্যাত সমাজসেবক ও অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম বিভারিজ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির রূপরেখা প্রদান করেছিলেন। যে রূপরেখার আলোকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গৃহীত সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইংল্যান্ডের সমাজ জীবনকে সমস্যামুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির উৎস নিয়ন্ত্রণের বাস্তব ব্যবস্থা হলো সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম।
ইতিবাচক সামাজিক প্রক্রিয়া গঠন : দ্বন্দ্ব, সহযোগিতা, প্রতিযোগিতা, উপযোজন ইত্যাদি সামাজিক প্রক্রিয়ার শক্তিশালী মাধ্যম। সামাজিক সমস্যার প্রধান কারণ নেতিকবাচক সামাজিক প্রক্রিয়া। বেশির ভাগ সামাজিক সমস্যার প্রধান কারণ সামাজিক উত্তেজনা ও টানাপোড়ন। সুতরাং সমাজের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক স্বাভাবিক বুঝাপড়া এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান দেয়া যায়। সংহতিপূর্ণ সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার প্রক্রিয়া বৃদ্ধি সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবেলার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সহযোগিতা, সামঞ্জস্যবিধান, উপযোজন, সাদৃশ্যকরণ প্রভৃতি ইতিবাচক সামাজিক মিথস্ক্রিয়া সামাজিক সমস্যা লাঘবের সহায়ক। সামাজিক শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে সব ধরনের নেতিবাচক সামাজিক প্রক্রিয়া দূর করা প্রয়োজন।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ: সামাজিক সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ত্রুটিপূর্ণ জনসংখ্যা কাঠামো। জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাবে মানুষ যখন ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়, তখন মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থতাজনিত কারণে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয়। সুতরাং দেশের সম্পদ ও সুযোগ সুবিধার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার রোধ করে জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং জীবনের মানোন্নয়ন করা না গেলে সামাজিক সমস্যার সমাধান আশা করা যায় না।
প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার: অর্থনৈতিক উন্নয়নের অপরিহার্য উপাদান হলো সম্পদ। যেকোন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সম্পদ মূল নিয়ামক শক্তি। প্রাকৃতিক সম্পদের উপযুক্ত ও সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হয়। এতে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি এবং জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। যা সামাজিক সমস্যা সমাধানের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।
মানব সম্পদ উন্নয়ন : অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের একমাত্র সূচক নয়। জনসংখ্যার বৃহৎ অংশকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন। নিরক্ষরতা, দক্ষতা, অপুষ্টি, দারিদ্র, অনুন্নত ও অস্থাস্থ্যকর পরিবেশ প্রভৃতি উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। এজন্য প্রয়োজন সার্বিক মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরি। যাতে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অংশগ্রহণ করতে পারে। সুতরাং মানব সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষা, স্থাস্থ্য, নারী ও শিশুকল্যাণ, যুব উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা প্রভৃতি খাতসমূহের উন্নয়নের প্রতি জোর দেওয়া প্রয়োজন। মানব সম্পদ উন্নয়ন সামাজিক সমস্যা মোকাবেলা করার কার্যকর হাতিয়ার।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন: সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়নের স্বার্থে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। সামাজিক সমস্যা মোকাবেলার জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, ব্যাংক, অর্থনৈতিক মৌলিক সুবিধা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। অন্যদিকে, স্কুল, কলেজ, কারিগরি জ্ঞান, প্রশাসনিক দক্ষতা, জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন প্রভৃতি সামাজিক অবকাঠামো তৈরি প্রয়োজন। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা বৃদ্ধির বুনিয়াদ তৈরি প্রয়োজন।
পরিশেষে বলা যায়, সামাজিক সমস্যার বহুমুখী কারণ রয়েছে। সুতরাং সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় যৌথ ও সমন্বিত বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যৌথ উপায়ে সমন্বিত বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ব্যতীত সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
পৃষ্ঠা ২৯
সামাজিক সমস্যা সমাধানে পেশাদার সমাজকর্মের ভূমিকা
পেশাদার সমাজকল্যাণের মূল বিষয়বস্ত্ত সামাজিক সমস্যা। সামাজিক সমস্যা মোকাবেলার সংগঠিত বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া হিসেবে পেশাদার সমাজকল্যাণের বিকাশ।
আধুনিক পেশাদার সমাজকল্যাণের বিবর্তনের ঐতিহাসিক ধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শিল্প-বিপ্লবোত্তর সমাজের জটিল আর্থ-সামাজিক সমস্যা মোকাবেলার প্রয়োজনে আধুনিক সমাজকল্যাণের উদ্ভব। প্রাক-শিল্প যুগের ধর্মীয় অনুশাসন ও মানবিক দর্শনের ভিত্তিতে পরিচালিত সমাজকল্যাণ কার্যক্রম প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত বলে প্রতীয়মান হওয়ায় সমাজ চিন্তাবিদগণ সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত সমাজসেবার প্রয়োজন উপলব্ধি করেন। তার ফলে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত সমাজকল্যাণের বিকাশ ঘটে। আধুনিক পেশাদার সমাজকল্যাণ সুসংগঠিত ও পরিকল্পিতভাবে কতগুলো পদ্ধতির মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা সমাধানে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সামাজিক সমস্যা সমাধানে আধুনিক সমাজকল্যাণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচে উল্লেখ করা হলো :
সামাজিক জরিপ ও গবেষণা : গতিশীল ও পরস্পর নির্ভরশীল আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণের পূর্বে সমস্যার কারণ, পরিধি, প্রভাব, সম্পদ, সামর্থ প্রভৃতি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের গুরুত্ব অপরিসীম। সামাজিক সমস্যার সঠিক তথ্য সংগ্রহের জন্য আধুনিক সমাজকল্যাণে সামাজিক জরিপ ও গবেষণার মতো বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হয়।
সামাজিক নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন : পরিকল্পিত উপায়ে সামাজিক সমস্যা মোকাবেলার লক্ষ্যে বাস্তবধর্মী সামাজিক নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে সমাজকর্মীরা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
সমস্যা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলা : জনগণকে তাদের সমস্যা, সম্পদ ও সামর্থ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা আধুনিক সমাজকল্যাণের ভূমিকার অন্তর্ভুক্ত। এতে মানুষকে এমনভাবে সাহায্য করা হয়, যাতে মানুষ তাদের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়নে স্বতঃস্ফূর্ত ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। এক্ষেত্রে আধুনিক সমাজকল্যাণের সহায়ক পদ্ধতি সামাজিক কার্যক্রম প্রয়োগ করা হয়।
আত্মসাহায্যের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান : বাহ্যিক সাহায্যের মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধান আশা করা যায় না। সামাজিক সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রয়োজন স্থানীয় সম্পদের সর্বোত্তর ব্যবহারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। আধুনিক সমাজকল্যাণ স্থানীয় ভিত্তিতে প্রাপ্ত সম্পদ ও সামর্থের সম্ভাব্য সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। সমাজকল্যাণে সামাজিক সমস্যা সমাধানে দেশীয় প্রযুক্তি ও কৌশল প্রয়োগের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।
মৌল চাহিদা পূরণের ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি : মৌল চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির অন্যতম প্রধান উৎস। আধুনিক সমাজকল্যাণ প্রাপ্ত সম্পদের সদ্ব্যবহার এবং সুষম বন্টন নিশ্চিত করার মাধ্যমে মানুষের মৌল চাহিদা পূরণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি এবং সামাজিক সমস্যা প্রতিরোধ করতে প্রয়াসী।
সামঞ্জস্য বিধান : সামাজিক সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য বিধানে মানুষের ব্যর্থতা ও অক্ষমতা। আধুনিক সমাজকল্যাণের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া হলো সমাজকর্ম। সমাজকর্ম কতগুলো মৌলিক ও সহায়ক পদ্ধতি প্রয়োগ করে মানুষকে পরিবর্তিত অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য বিধানে সাহায্য করে।
প্রতিরোধ, প্রতিকার ও উন্নয়নমূলক দৃষ্টিভঙ্গি :সমাজের সার্বিক ও প্রত্যাশিত কল্যাণ সাধনের জন্য প্রয়োজন সামাজিক সমস্যার প্রতিকার, প্রতিরোধ এবং উন্নয়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। আধুনিক সমাজকল্যাণে সমাজের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে সমস্যা মোকাবেলায় প্রতিকার, প্রতিরোধ ও উন্নয়নমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করা হয়।
সমাজকর্ম পদ্ধতি প্রয়োগ : সামাজিক সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান নির্ভর করে সমস্যা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ, কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়নের উপযুক্ত ও দক্ষ প্রশাসন এবং জনগণের সচেতনতা ও সহযোগিতার ওপর। এসব ক্ষেত্রে পেশাদার সমাজকল্যাণের সহায়ক পদ্ধতি সামাজিক গবেষণা, সমাজকল্যাণ প্রশাসন ও সামাজিক কার্যক্রম বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সমাজকর্ম পেশাগত দৃষ্টিকোণ হতে জটিল ও বহুমুখী সামাজিক সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত সমাধানে সচেষ্ট। এতে ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যার প্রকৃতি এবং বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিশেষ পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করে সামাজিক সমস্যা মোকাবেলার প্রচেষ্টা চালানো হয়।
বাংলাদেশে প্রধান কয়েকটি সামাজিক সমস্যা
বাংলাদেশে সামাজিক সমস্যার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য বিচিত্র এবং বহুমুখী। দীর্ঘদিনের পরিকল্পিত বিদেশি শাসন ও শোষণের প্রভাবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বুনিয়াদ সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর গড়ে উঠতে পারেনি, যার প্রভাবে সামাজিক সমস্যা উদ্ভবের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন-এর তথ্যানুযায়ী গড় আয়ু, শিশু মৃত্যুর হার, স্বাক্ষরতা, শিক্ষা, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে বাংলাদেশ
পৃষ্ঠা ৩০
উন্নীত হয়েছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এমন কতগুলো সামাজিক সমস্যা বিরাজমান রয়েছে, যেগুলো সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে বাঁধাগ্রস্ত করে তুলছে।
বাংলাদেশে সামাজিক সমস্যার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশের সমস্যাগুলো প্রকৃতিগত দিক হতে বিচিত্রধর্মী ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বাংলাদেশে বিরাজমান সামাজিক সমস্যাগুলোর বৈশিষ্ট্য নিচে উল্লেখ করা হলো।
অর্থকেন্দ্রিক : বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যাসমূহ বহুমাত্রিক হলেও বেশির ভাগ সমস্যা মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা হতে সৃষ্ট। সেজন্য বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যাগুলো প্রকৃতিগতভাবে অর্থকেন্দ্রিক। মাথাপিছু নিম্ন আয় এবং আর্থিক অস্বচ্ছলতার জন্য দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী ন্যূনতম মৌল চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে নেতিবাচক সামাজিক অবস্থার শিকার হচ্ছে।
ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক উপাদানের প্রভাব : ভৌগোলিক এবং প্রাকৃতিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যা সৃষ্টিতে প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক উপাদানের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ধারাবাহিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যার স্থায়ী কারণরূপে বিরাজ করছে।
সাংস্কৃতিক ও মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি : বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যা প্রকৃতিগতভাবে অর্থকেন্দ্রিক হলেও শিল্পায়ন, আধুনিকায়ন এবং নগরায়নের ফলে সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার প্রকটতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আধুনিকায়ন, নগরায়ন এবং শিল্পায়নজনিত অসম সামাজিক পরিবর্তন ও জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসম প্রতিযোগিতার ফলে হতাশা, ব্যর্থতা, সামাজিক মর্যাদা ও ভূমিকার দ্বন্দ্ব, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, সামাজিক উত্তেজনা প্রভৃতি সমস্যার প্রকটতা বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সমস্যার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও বহুমাত্রিকতাঃ বাংলাদেশে বিরাজমান সমস্যাগুলোর লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, ক্রমাগত প্রতিক্রিয়া এবং বহুমাত্রিকতা। বাংলাদেশের কোন সমস্যাই একক এবং বিচ্ছিন্নভাবে সমাজে বিরাজ করছে না। প্রতিটি সমস্যা পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত এবং একটি অন্যটির প্রভাবক কারণরূপে সমাজে বিরাজ করছে।
সামাজিক শ্রেণীভিত্তিক সমস্যার বিভিন্নতা : বাংলাদেশে সামাজিক শ্রেণী এবং স্তরবিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক সমস্যাগুলোর প্রকৃতি বিভিন্ন ধরনের। যেমন- উচ্চ শ্রেণীতে সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার প্রকটতা অধিক। কিন্তু নিম্ন এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমস্যাগুলো প্রধানত মৌল চাহিদা পূরণের ব্যর্থতাজনিত কারণে সৃষ্ট। বর্তমানে জনসংখ্যাস্ফীতিকে বাংলাদেশের প্রধান জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও বাস্তবে দারিদ্র হলো এদেশের মূল সমস্যা। দারিদ্রের দুষ্টচক্রের প্রভাব থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসতে পারছে না।
প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি সমস্যা : বাংলাদেশে সামাজিক সমস্যার তালিকায় নতুন সংযোজন হলো প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সমস্যা। প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এ সমস্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির প্রভাবে মানুষের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাবার জন্য প্রবীণদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সামাজিক সমস্যা ও সামাজিক অনাচার পরস্পর সম্পর্কিত : বাংলাদেশে সামাজিক সমস্যা এবং সামাজিক অনাচারের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন। যেমন দারিদ্র, জনসংখ্যাস্ফীতি, দুর্নীতি, ভিক্ষাবৃত্তি একাধারে সামাজিক সমস্যা এবং সামাজিক অনাচার হিসেবে বিবেচিত।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব : বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের শিকার হচ্ছে। যার প্রভাবে সামাজিক সমস্যা উদ্ভবের পরিবেশ ও ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জাতিসংঘের আত্মরাষ্ট্রীয় জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রামত্ম প্যানেলের তৃতীয় সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী সমুদ্র পৃষ্ঠে পানির উচ্চতা ৪৫ সে.মি. বাড়লে বাংলাদেশের ১১ শতাংশ ভূখন্ড সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হবে।
বাংলাদেশে বিরাজ মান প্রধান সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে দারিদ্র, জনসংখ্যাস্ফীতি, নিরক্ষরতা, বেকার সমস্যা, অপুষ্টি, প্রবীণ সমস্যা, মাদকাসক্তি, অপরাধ, কিশোর অপরাধ, সামাজিক ভূমিকা ও মর্যাদার দ্বন্দ্ব ইত্যাদি সমস্যাগুলো অন্যতম। অন্যদিকে সামাজিক অনাচারের মধ্যে দুর্নীতি, ভিক্ষাবৃত্তি, যৌতুক প্রথা, নারীর প্রতি সহিংসতা, শিশু ও নারী পাচার ইত্যাদি প্রধান। এ পর্যায়ে বাংলাদেশে বিরাজমান প্রধান সামাজিক সমস্যা এবং সেগুলো নিয়ন্ত্রণে গৃহীত কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো।
পৃষ্ঠা ৩১
দারিদ্র
বাংলাদেশে বিরাজমান সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে দারিদ্র অন্যতম। দারিদ্র শুধু সমস্যা নয়, অন্যান্য আর্থ-সামাজিক সমস্যার মৌলিক উৎসও বটে। বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশে দারিদ্র হলো অনুন্নতির প্রধান কারণ। প্রফেসর র্যাগনার নার্কসের মন্তব্য হল ‘‘একটি দেশ দরিদ্র, কারণ সে দরিদ্র’’। দরিদ্র দেশের সকল দিকেই উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতাগুলো একদিকে যেমন দারিদ্রের কারণ, অন্যদিকে দারিদ্রের ফলও বটে।
দারিদ্রের সংজ্ঞা
দারিদ্র এমন একটি আপেক্ষিক অবস্থা, যা নির্দিষ্ট সময়ে একটি সমাজের জীবনমান এবং সম্পদের পরিপ্রেক্ষিতে পরিমাপ করা হয়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দারিদ্র একটি তুলনামূলক আপেক্ষিক প্রত্যয় চূড়ান্ত নয়। কারণ শত বছর আগে দারিদ্র বলতে যে অবস্থাকে বুঝানো হতো, বর্তমানে ঠিক সে অবস্থাকে বুঝানো হয় না। আবার পাশ্চাত্যের শিল্পোন্নত দেশে দারিদ্র যে অর্থ বহন করে, বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশে সেরূপ অর্থ বহন করে না।
সাধারণ অর্থে, ‘‘দারিদ্র হলো এমন একটি আর্থ-সামাজিক অবস্থা, যে অবস্থায় মানুষ জীবন ধারণের মৌল প্রয়োজনগুলো পূরণে সমাজ নির্ধারিত ন্যূনতম মান অর্জনে অক্ষম।’’ ডেভিড জেরি এবং জুলিয়া জেরি প্রণীত এর ব্যাখ্যানুযায়ী, ‘‘দারিদ্র হলো সমৃদ্ধ জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত বস্তুগত এবং সাংস্কৃতিক সম্পদের অভাব ।
উইলিয়াম পি স্কট প্রণীত, গ্রনেথর ব্যাখ্যানুযায়ী, ‘‘দারিদ্র হলো অপেক্ষাকৃত স্থায়ী নিম্নমানের জীবন যাপন ব্যবস্থা, যে জীবন মান কোন ব্যাক্তির বা গোষ্ঠীর স্বাস্থ্য, নৈতিকতা এবং আত্ম-মর্যাদাবোধকে উত্তরোত্তর দুর্বল করার মতো স্থায়ী”। দারিদ্র হলো আপেক্ষিক পরিভাষা, যা দ্বারা সমাজের সাধারণ জীবন মান, সম্পদের বণ্টন, সামাজিক মর্যাদা আরোপ ব্যবস্থা এবং সামাজিক প্রত্যাশার বৈষম্য নির্দেশ করা হয়।’’ সমাজবিজ্ঞানী গিলিন তাঁর গ্রন্থে বলেছেন, ‘‘যাদের জীবনযাত্রার মান তাদের সমাজ নির্ধারিত জীবনযাত্রার মানের চেয়ে নিচে তারাই দরিদ্র। সেজন্য তারা সমাজ জীবনে মানবিক ও দৈহিক নৈপুণ্য প্রমাণ করতে অক্ষম। অপর্যাপ্ত আয় অথবা অর্থহীন অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে দারিদ্রের উদ্ভব হয়।’’
ব্যাপক অর্থে, দারিদ্র বলতে জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানসিক বঞ্চনাকে বুঝায়, যা বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম সম্পদের নিয়ন্ত্রণ এবং যথাযথ পরিমাণ মালিকানা না থাকার ফলে উদ্ভূত হয়।
পৃষ্ঠা ৩২
বাংলাদেশে দারিদ্র পরিমাপ পদ্ধতি
বাংলাদেশে ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে প্রথম খানা ব্যয় জরিপ পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা ব্যয় জরিপে দেশের দারিদ্র পরিমাপের জন্য খাদ্য-শক্তি গ্রহণ এবং প্রত্যক্ষ ক্যালরী গ্রহণ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। দারিদ্র পরিমাপে জনপ্রতি প্রতিদিন ২১২২ কিলো ক্যালরীর নীচে খাদ্য গ্রহণকে অনাপেক্ষ দারিদ্র এবং ১৮০৫ কিলো ক্যালরীর নীচে খাদ্য গ্রহণকে চরম দারিদ্র হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ও ব্যয় নির্ধারণ জরিপে দৈনিক মাথাপিছু ক্যালরী গ্রহণের মাপকাঠিতে মাথা গণনা অনুপাতে দারিদ্রকে নিচের দু’টি দৃষ্টিকোণ হতে সংজ্ঞায়িত করেছে।
দারিদ্র সীমা-১ : যাদের দৈনিক মাথাপিছু ২১২২ কিলোক্যালরী খাদ্যশক্তি উৎপাদনকারী খাদ্যসামগ্রী ক্রয় বা যোগাড় করার আর্থিক সক্ষমতা নেই, তাদের এ শ্রেণীর অনাপেক্ষ দারিদ্র সীমায় অবস্থানকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
দারিদ্র সীমা-২ : যাদের দৈনিক মাথাপিছু ১৮০৫ কিলোক্যালরী খাদ্যশক্তি উৎপাদনকারী খাদ্যসামগ্রী ক্রয় বা যোগাড় করার আর্থিক সক্ষমতা নেই, তাদের এ শ্রেণীর দারিদ্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ শ্রেণীর দরিদ্রদের চরম দারিদ্রে অবস্থানকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক দারিদ্র রেখার নতুন সংজ্ঞায় মাথাপিছু দৈনিক আয় এক ডলার ২৫ সেন্টকে দারিদ্র রেখা নির্ধারণ করা হয়েছে।
দারিদ্রের প্রকৃতি ও শ্রেণী বিভাগ
প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী দারিদ্রকে তিনটি দৃষ্টিকোণ হতে সংজ্ঞায়িত করা যায়।
সাধারণ দারিদ্র অবস্থাঃ এ দৃষ্টিকোণ হতে যাদের জীবনযাত্রার মান সমাজের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মানের নিচে, তাদেরকে দারিদ্র বলা হয়। এটি একটি তুলনামূলক অবস্থা। এতে দারিদ্র শেণীর মৌল চাহিদাগুলো কোন রকমে পূরিত হলেও তারা স্বচ্ছল জীবনযাপন করতে পারে না।
নিরঙ্কুশ দারিদ্র অবস্থাঃ নিরঙ্কুশ দারিদ্র বলতে জীবন মানের সে অবস্থাকে বুঝান হয়, যাতে মানুষ সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান বজায় রাখতে সক্ষম হয় না। বাংলাদেশে যারা দৈনিক ২১২২ কিলো ক্যালোরীর চেয়ে কম খাদ্যশক্তি গ্রহণ করে তাদেরকে একশ্রেণীর দারিদ্র বলে ধরা হয়েছে।
চরম দারিদ্র অবস্থাঃ চরম অর্থে দরিদ্রতা বলতে সে অবস্থাকে বুঝায়, যাতে মানুষ জীবন ধারণের ন্যূনতম মৌল চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে চরম অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে যারা দৈনিক মাথাপিছু ১৮০৫ কিলো ক্যালরী বা তার চেয়ে কম গ্রহণ করে তাদের চরম দারিদ্র বলা হয়।
বাংলাদেশে দারিদ্রের মাত্রাসমূহ
বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ হতে দারিদ্রের দুটি মাত্রা হলো আয়-দারিদ্র এবং মানব দারিদ্র।
আয়-দারিদ্র বলতে, যারা দৈনিক মাথাপিছু ন্যূনতম ক্যালরী সমৃদ্ধ খাদ্য ক্রয়ের মতো পর্যাপ্ত আয় থেকে বঞ্চিত, তাদেরকে বুঝানো হয়। বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞানুযায়ী যাদের দৈনিক মাথাপিছু আয় এক ডলার ২৫ সেন্টের কম তারা আয় দারিদ্রের অন্তর্ভুক্ত।
মানব দারিদ্র বলতে জনসংখ্যার সে অংশকে বুঝায়, যারা ন্যূনতম মানবিক সামর্থ্য যেমন- স্বাস্থ্য, পুষ্টি, প্রজনন ও শিক্ষাগত দিক থেকে সামর্থ্য বঞ্চিত। মানব দারিদ্রের মাত্রাকে বৃহত্তর পরিসরে যথা স্বাস্থ্য সুবিধা বঞ্চিত দরিদ্র; শিক্ষা বঞ্চিত দরিদ্র এবং পুষ্টি (খাদ্য নিরাপত্তাসহ) বঞ্চিত দরিদ্র এ তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
দারিদ্রের জীবন চক্র
মনীষী নার্কসের দারিদ্রের দুষ্ট চক্র ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক পর্যায়ে দারিদ্রের প্রভাব তুলে ধরেছে। দরিদ্র দেশের দরিদ্র মানুষের জীবন চক্রটি নিচে উপস্থাপন করা হলো। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে একজন দরিদ্র মানুষ স্বল্প আয় বা নিম্ন জীবনমান থেকে শুরু করে, জীবন চক্রের কয়েকটি সোপান অতিক্রম করে, পুনরায় আবার দারিদ্রাবস্থায় ফিরে আসছে। এভাবে দরিদ্র শ্রেণী ভবিষ্যত সন্তানদেরকেও দারিদ্রের মধ্যে রেখে যাচ্ছে। দরিদ্র মানুষের জীবন বৃত্ত
পৃষ্ঠা ৩৩
পৃষ্ঠা ৩৪
দারিদ্রের দুষ্ট চক্র
একজন দরিদ্র মানুষের জীবন চক্রের মতো দরিদ্র দেশও দরিদ্রাবস্থা থেকে শুরু করে পুনরায় দরিদ্রাবস্থায় ফিরে আসে। এরূপ ধারণার ভিত্তিতে অর্থনীতিবিদ র্যাগনার নার্কস দারিদ্রের দুষ্ট চক্র তত্ত্ব প্রদান করেন। দারিদ্রের দুষ্ট চক্রের প্রভাব চারটি মাত্রায় বিশ্লেষণ করে চিত্রে দেখানো হলো
দারিদ্রের দুষ্ট চক্র
দারিদ্রের দুষ্ট চক্রের আলোকে দারিদ্রের প্রধান প্রভাবগুলো উল্লেখ করা হলো
১. বেকারত্বের উচ্চহারঃ দারিদ্রের দুষ্ট চক্রের উপর্যুক্ত চিত্রে উপস্থাপিত প্রথম মাত্রায় দেখানো হয়েছে একটি দরিদ্র দেশের আয় স্বল্প হবার কারণে সঞ্চয় কম। সঞ্চয়ের স্বল্পতার কারণে স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগ কম হবে। আর বিনিয়োগ হ্রাস পেলে স্বাভাবিকভাবে শ্রমের চাহিদা কমে গিয়ে বেকারত্ব দেখা দেয়। বেকারত্বের উচ্চ হার উৎপাদনশীলতাকে কমিয়ে দেবে। ফলে দেশটি স্বল্প আয়ের মাত্রায় নেমে আসবে। এভাবে দারিদ্রের দুষ্টচক্রের একটি মাত্রা সম্পূর্ণ হয়।
২. উচ্চ জন্মহারঃ দারিদ্রের দুষ্ট চক্রের দ্বিতীয় মাত্রায় নির্দেশ করা হয়েছে একটি দেশের স্বল্প আয় হতে উচ্চ জন্মহার দেখা দেয়, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে অধিক শ্রমের সরবরাহ নিশ্চিত করে। অতিরিক্ত শ্রমের সরবরাহের ফলে বেকারত্ব সৃষ্টি হয়। বেকারত্বের উচ্চহার দেশটিকে স্বল্প উৎপাদনশীলতা এবং স্বল্প আয়ের দিকে তাড়িত করে। এভাবে দারিদ্রের দুষ্টচক্রের একটি মাত্রা চক্রাকারে সম্পূর্ণ হয়।
৩. শিক্ষার অভাবে উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাসঃ উপস্থাপিত চক্রের তৃতীয় মাত্রায় দেখানো হয়েছে স্বল্প আয়ের প্রভাবে শিক্ষার সুযোগ হ্রাস পায়। ফলে শিক্ষার অভাবে উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার অভাব দেখা দেয় এবং দেশটি স্বল্প উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে পুনরায় স্বল্প আয়ে প্রত্যাবর্তন করে। এভাবে দারিদ্রের দুষ্ট চক্রের তৃতীয় মাত্রা সম্পন্ন হয়।
পৃষ্ঠা ৩৫
৪. ভগ্ন স্বাস্থ্যঃ দারিদ্রের প্রভাবে আয় কম হয় বলে পুষ্টিকর খাদ্যসহ স্বাস্থ্য রক্ষার প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ সম্ভব হয় না। পুষ্টিকর খাদ্যসহ পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে দরিদ্রদের স্বাস্থ্যহীনতা, ভগ্নস্বাস্থ্য, দুর্বলতা ইত্যাদি দেখা দেয়। ভগ্নস্বাস্থ্যের প্রভাবে কর্মস্পৃহা হ্রাস এবং কর্মক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে শ্রমের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেয়ে জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
দরিদ্র দেশগুলো এভাবে দারিদ্রের দুষ্ট চক্রের আবর্তে চক্রাকারে নিয়ত ঘুরপাক খাচ্ছে। দারিদ্রের দুষ্টচক্রের প্রভাবে বহুমুখী এবং বহুমাত্রায় আর্থ-সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হয়। বাংলাদেশে দারিদ্রের সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে মনীষী লিভিং স্টোন বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) অধিকাংশ জনসাধারণের সমস্ত চিন্তা ও কর্মধারাকে একটি নিষ্ঠুর বাস্তব সত্য নিরন্তর আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আর সে নিষ্ঠুর বাস্তব সত্য হচ্ছে দারিদ্রের নিস্পেষণ’’।
বাংলাদেশে দারিদ্র পরিস্থিতি
বাংলাদেশ বিশ্বের জনবহুল দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি প্রকাশিত মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০০৯ এর তথ্যানুযায়ী ১৮২টি দেশের মধ্যে ১৪৬তম স্থানে। মধ্যম পর্যায়ের মানব উন্নয়ন ৭৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৩তম অবস্থানে। জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০০৭ এ ১৩৫টি দেশের মানব দারিদ্র সূচক পরিমাপ করা হয়। মানব দারিদ্র সূচকের দিক হতে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম ছিল।
দারিদ্রকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়, যথা আয়-দারিদ্র এবং মানব-দারিদ্র। বাংলাদেশে ১৯৯১-৯২ সাল থেকে দু’হাজার সালের মধ্যে আয়-দারিদ্রের হার ৫৮.৮ শতাংশ থেকে ৪৮.৯ শতাংশে নেমে আসে। অপরদিকে ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে আয়-দারিদ্রের হার ৪৮.৯ শতাংশে থেকে ৪০.০ শতাংশে নেমে এসেছে।
দু’হাজার সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত শহর ও পল্লী উভয় এলাকায় দারিদ্রের হার প্রায় সমভাবে হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশে আয়-দারিদ্রের প্রবণতা
২০০৫ | ২০০০ | বার্ষিক পরিবর্তন (%) (২০০০-২০০৫) | ১৯৯১/৯২ | বার্ষিক পরিবর্তন (%) (১৯৯১/৯২-২০০০) | |
জাতীয় | ৪০.০ | ৪৮.৯ | -৩.৯ | ৫৮.৮ | -১.৮ |
শহর | ২৮.৪ | ৩৫.২ | -৪.২ | ৪৪.৯ | -২.২ |
পল্লী | ৪৩.৮ | ৫২.৩ | -৩.৫ | ৬১.২ | -১.৬ |
উৎসঃ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০০৫। উদ্ধৃতঃ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১০, পৃ-১৭৯।
১. অনপেক্ষ দারিদ্রঃ মাথা-গণনা অনুপাতে ২০০৫ সালে প্রত্যক্ষ ক্যালরি গ্রহণ পদ্ধতিতে জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশে অনপেক্ষ দারিদ্র ছিল ৪০.৪ শতাংশ, পল্লী অঞ্চলে ৩৯.৫ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ৪৩.২ শতাংশ। এ পদ্ধতিতে ২০০০ থেকে ২০০৫ সালে অনপেক্ষ দারিদ্র ৪.১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তবে মোট দারিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২০০০ সালে ছিল ৫.৫৮ কোটি, যা ২০০৫ এ বৃদ্ধি পেয়ে ৫.৬০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে।
২. চরম দারিদ্রঃ মাথা-গণনা অনুপাত ২০০৫ সালে প্রত্যক্ষ ক্যালরি গ্রহণ পদ্ধতিতে জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশে চরম দারিদ্র ছিল ১৯.৫ শতাংশ, পল্লী অঞ্চলে ১৭.৯ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ২৪.৪ শতাংশ। এ পদ্ধতিতে জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশে চরম দারিদ্র ০.৫ শতাংশ, পল্লী অঞ্চলে ০.৮ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ০.৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ২০০০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত চরম দারিদ্র ২০.০ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ১৯.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ চরম দারিদ্র ০.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো খানা আয় ও ব্যয় জরিপের তথ্যের আলোকে নিচের সারণী হতে বাংলাদেশে দারিদ্রের চিত্র পাওয়া যায়।
ক্যালরী গ্রহণ ভিত্তিক দারিদ্র ও চরম দারিদ্র (%)
দারিদ্রের ধরন | ২০০০ | ২০০৫ | |
দারিদ্র (২১২২ কিলো ক্যালরী শক্তি বা তার কম) | জাতীয় | ৪৪.৩ | ৪০.০ |
পল্লী | ৪২.৩ | ৪৯.৫ | |
শহর | ৫২.৫ | ৪৩.২ | |
চরম দারিদ্র (১৮০৫ কিলো ক্যালরী বা তার চেয়ে কম) | জাতীয় | ২০.০ | ১৯.৫ |
পল্লী | ১৮.৭ | ১৭.৯ | |
শহর | ২৫.০ | ২৪.৪ |
উৎসঃ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো; উদ্ধৃতঃ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১০, পৃ-১৮০।
পৃষ্ঠা ৩৬
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক জীবনে দারিদ্রের প্রভাব
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধক হল দারিদ্র। চক্রাকারে ক্রিয়াশীল দারিদ্রের দুষ্টচক্রের বিরূপ প্রভাব থেকে বাংলাদেশের কোনদিকই মুক্ত নয়। ব্যাপক গণদারিদ্রের প্রভাবে বাংলাদেশে সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে দারিদ্রের বিরূপ প্রভাবের বিশেষ দিকগুলো সংক্ষিপ্ত শিরোনামসহ নিচে উল্লেখ করা হল।
১. জনসংখ্যা বৃদ্ধিঃ বাংলাদেশের প্রধান জাতীয় সমস্যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দারিদ্রের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত জনসংখ্যা সম্পর্কিত এক সেমিনারে বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশে জনসংখ্যাস্ফীতির কারণ হিসেবে দরিদ্রতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান এবং সন্তান জন্মদান প্রবণতার মধ্যে বিপরীতমুখী সম্পর্ক বিদ্যমান। দারিদ্রের দুষ্টচক্রের একটি মাত্রা নির্দেশ করে একটি দেশের স্বল্প আয় থেকে উচ্চ জন্মহার প্রবণতা দেখা দেয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির জন্য অধিক সন্তান কামনা করে। এছাড়া অজ্ঞতা ও নিরক্ষরতার প্রভাবে দরিদ্র শ্রেণী জনসংখ্যা সমস্যার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন নয় বলে অধিক সন্তানকে সমস্যা বলে তেমন গুরুত্ব দেয় না। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে দারিদ্রের প্রভাব বিদ্যমান।
২. কৃষি উন্নয়নে প্রতিবন্ধকঃ কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়নের অন্যতম প্রতিবন্ধক হচ্ছে দারিদ্র। দরিদ্রতার প্রভাবে দেশের কৃষক সমাজ আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারছে না। এমনকি অর্থাভাবে হালচাষের বলদ পর্যন্ত দরিদ্র কৃষকরা যোগাড় করতে সক্ষম হচ্ছে না। ফলে কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
৩. অপর্যাপ্ত শিল্পায়নঃ দারিদ্রের প্রভাবে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় কম বলে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ও মূলধন গঠনের হার অত্যন্ত কম। মূলধন কম বলে বিনিয়োগও কম। এরূপ চক্রাকারে ক্রিয়াশীল দারিদ্রের প্রভাবে বাংলাদেশে নতুন শিল্প স্থাপন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কর্মসংস্থানের অভাবে বেকরত্ব বৃদ্ধি পেয়ে অন্যতম সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিরাজ করছে।
৪. নিরক্ষরতা বৃদ্ধিঃ দরিদ্রতার প্রভাবে বাংলাদেশে শিক্ষার হার প্রত্যাশা অনুযায়ী বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বাংলাদেশের দরিদ্র জনগণ তাদের আয়ের সিংহভাগ খাদ্য ও বস্ত্রের জন্য ব্যয় করছে। ২০০৫ সালের তথ্যানুযায়ী শহরে মাসিক মাথাপিছু গড় ব্যয় ৮৫৩৩ টাকার মধ্যে ভোগব্যয় ৮৩১৫ টাকা। অন্যদিকে গ্রামের মোট ৫৩১৯ টাকা ব্যয়ের মধ্যে ভোগ ব্যয় ৫১৬৫ টাকা।[1] আয়ের সিংহভাগ ভোগব্যয়ের প্রভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ন্যূনতম মান অর্জনে জনগণ ব্যর্থ হচ্ছে।
৫. সামাজিক অনাচার ও অপরাধ বৃদ্ধিঃ ভিক্ষাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তি, অপরাধ ও কিশোর অপরাধ প্রবণতা, সন্ত্রাস, দূর্নীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে দারিদ্রের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। দরিদ্রতার প্রভাবে জনগণ বৈধ উপায়ে মৌল চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে অবৈধ ও অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। যৌতুক প্রথা, দাম্পত্য কলহ, পারিবারিক ও সামাজিক দ্বন্দ-কলহের ক্ষেত্রে দারিদ্রের ঋণাত্মক প্রভাব রয়েছে।
৬. স্বাস্থ্যহীনতা ও অপুষ্টিঃ দারিদ্রের প্রভাবে বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ইত্যাদি মৌল চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ করতে পারছে না। পুষ্টিকর খাদ্য ও যথাযথ চিকিৎসার অভাবে বাংলাদেশে অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যহীনতা হ্রাস প্রত্যাশা অনুযায়ী হচ্ছে না। দারিদ্রের প্রভাবে মানুষ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এতে রোগ ব্যাধি বিস্তার এবং মানসিক ও নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেয়।
৭. বেকারত্বঃ দারিদ্রের দুষ্ট চক্রের প্রভাবে সঞ্চয় ও মূলধন গঠনের অভাবে উৎপাদন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পায় না। আবার দারিদ্রের প্রভাবে শিক্ষালাভের সুযোগ কম থাকায় প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। বেকারত্ব, স্বাস্থ্যহীনতা, অপুষ্টি, ভিক্ষাবৃত্তি, অপরাধ প্রবণতা, পতিতাবৃত্তি, যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতন, নিরক্ষরতা প্রভৃতি সমস্যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দারিদ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত।