Logo Sponsored by Chowdhury and Hossain, Advanced Publications

Somaj Kollan Second Part First Chapter


পৃষ্ঠা
মৌল মানবিক চাহিদার ধারণা ও তাৎপর্য
 

ভূমিকা
সামাজিক জীব হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে বহুমুখী প্রয়োজন পূরণ করতে হয়। প্রয়োজনসমূহ যথাযথভাবে পূরণ না হলে, সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়। যে জন্য সব ধরনের মানবসেবা প্রত্যক্ষভাবে মানবিক চাহিদা পূরণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কারণ প্রত্যেক মানুষের রয়েছে নিজস্ব বিশেষ চাহিদা। আর এসব চাহিদা পূরণে মানুষ ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পর্যায়ে সদা সচেষ্ট। প্রত্যেক ব্যক্তির প্রয়োজনের পর্যায় পৃথক ও ভিন্ন ধরনের। অনেকে সম্পদের স্বল্পতা সত্ত্বেও সন্তোষজনকভাবে নিজের চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়। আবার অনেকে সম্পদের প্রাচুর্যতা সত্ত্বেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে মানবিক চাহিদা সন্তোষজনকভাবে পূরণ করতে পারে না। সামাজিকভাবে প্রত্যেক মানুষের প্রতিটি মানবীয় চাহিদা পূরণের মতো সামাজিক কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এজন্য দেখা যায়, সমাজে প্রত্যেক মানুষ অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজের প্রচেষ্টায় সন্তোষজনক মানবিক চাহিদা পূরণের উপায় বের করার প্রত্যাশা করে। যখন মানুষ এরূপ করতে ব্যর্থ হয়, তখন বিভিন্ন সমাজসেবা ব্যবস্থার মাধ্যমে মানবিক চাহিদা পূরণের জন্য তাদেরকে সাহায্য করা হয়।
চাহিদা কি?
মৌল মানবিক চাহিদা প্রত্যয়টি সংজ্ঞায়িত করার আগে চাহিদা ধারণাটি ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। চাহিদা এমন একটি ধারণা, যা বিভিন্ন দিক হতে বিশ্লেষণ করা যায়। সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী, “চাহিদা হলো সেসব দৈহিক, মানসিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক চাহিদা; যেগুলো মানুষের বাঁচার, কল্যাণের এবং পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য আবশ্যক” মনীষী এফ ইলেন নিটিং চাহিদার সংজ্ঞায় বলেছেন, ‘‘চাহিদা হলো এমন যে কোন চিহ্নিত অবস্থা, যে অবস্থায় মানুষ ব্যক্তি হিসেবে অথবা পরিবারের সদস্য হিসেবে নিজের পূর্ণ ক্ষমতা বিকাশে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়।’’
মানবিক চাহিদার বিভিন্ন দিকগুলো :
১. শারীরিক প্রয়োজন: যেমন- খাদ্য, আশ্রয়, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সংরক্ষণ;
২. ব্যক্তিগত পরিপূর্ণতার প্রয়োজন: এসব প্রয়োজনের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, চিত্তবিনোদন, মূল্যবোধ, নীতিবোধ, ধর্ম এবং সাফল্য;
৩.       আবেগীয় প্রয়োজন: সমাজের কোন দল বা গোষ্ঠীর অঙ্গিভূত বা অংশস্বরূপ অনুভব করা, পারস্পরিক স্বীকৃতি ও সঙ্গপ্রিয়তা;
৪. পর্যাপ্ত আত্মপ্রত্যয়ের প্রয়োজন: এরূপ প্রয়োজনের মধ্যে রয়েছে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ এবং স্বকীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ।
মৌল মানবিক চাহিদার সংজ্ঞা
প্রাণী জগতের মধ্যে অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষের প্রকৃতি, মর্যাদা, অবস্থান, বুদ্ধিবৃত্তি ও জীবনধারা বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। যার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের জীবন ধারণ ও মানবিক সত্তা বিকাশের জন্য বিশেষ কতগুলো প্রয়োজন পূরণ করতে হয়। সামাজিক জীব হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য মানুষকে যেমন কতগুলো জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে হয়, তেমনি সামাজিক সত্তা রক্ষা করার জন্য জৈবিক চাহিদার বাইরে কতগুলো অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন পূরণ করতে হয়। জৈবিক প্রয়োজন মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা ও কর্মপ্রবাহের শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক হলেও, সামাজিক প্রয়োজন পূরণের প্রচেষ্টা মানুষের কর্মচেতনার প্রধান উৎস। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, যৌন তাড়ণা প্রভৃতি জৈবিক চাহিদা যেমন মানুষকে কর্মশক্তি ও গতিশীলতা দান করে, তেমনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আশ্রয়, বস্ত্র, চিত্তবিনোদন মানুষের মধ্যে কর্মে নিয়োজিত হবার প্রেষণা সৃষ্টি করে। সামাজিক জীব হিসেবে এগুলো শুধু মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
সুতরাং, মৌল মানবিক চাহিদার সাধারণ সংজ্ঞায় বলা যায়, ‘‘মৌল মানবিক চাহিদা বলতে সেসব চাহিদাগুলোকে বুঝায়, যেগুলো মানব প্রকৃতি হতে উদ্ভূত এবং এসব চাহিদা পূরণ ব্যতীত কোন ব্যক্তি সামাজিক মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করতে পারে না।’’ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানুষের মানবিক গুণাবলীর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য এসব চাহিদা পূরণ অত্যাবশক বিধায় এগুলোকে মৌল মানবিক চাহিদা হিসেবে বিশেষায়িত করা হয়। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণ এবং সামাজিকতা রক্ষার জন্য সর্বজনীন অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যসামগ্রীর সমষ্টিকে মৌল মানবিক প্রয়োজন বলা হয়।
ডেভিড জেরি এবং জুলিয়া জেরি প্রণীত কলিন্স সমাজবিজ্ঞান অভিধানের সংজ্ঞানুযায়ী, ‘‘মৌল মানবিক চাহিদা এমন একটি ধারণা, যাতে সকল মানুষ তাদের মানবিক গুণাবলীর কারণে মৌল চাহিদা হিসেবে এগুলো পূরণে অংশগ্রহণ করে। সমাজ জীবনে পরিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণের অত্যাবশ্যক পূর্বশর্ত হিসেবে মৌল চাহিদাগুলো পূরণ বিবেচিত।
মৌল মানবিক চাহিদার প্রকারভেদ
সামাজিক দৃষ্টিকোণ হতে সমাজ বিজ্ঞানীরা মৌল মানবিক চাহিদাগুলোকে ছয়ভাগে ভাগ করেছেন। সমাজবিজ্ঞানী টোলে তাঁর গ্রন্থে ছয়টি মৌল চাহিদার উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিত্তবিনোদন।
বাংলাদেশেসহ বিশ্বের সকল দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজিক নিরাপত্তাসহ উপর্যুক্ত ছয়টি প্রয়োজন পূরণকে মৌল মানবিক চাহিদা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসা, সামাজিক নিরাপত্তা ও চিত্তবিনোদনকে মৌল প্রয়োজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া




পৃষ্ঠা
হয়েছে।[1] স্বশাসন অর্থাৎ স্বাধীনতা  এবং নিরাপত্তা  এ দুটি মৌল মানবিক চাহিদা হিসেবে বিবেচিত। কারণ স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা মানুষের সহজাত গুণাবলী বিকাশের অপরিহার্য পূর্বশর্ত।
মৌল মানবিক চাহিদাগুলোর তাৎপর্য
মানুষের সহজাত মানবিক গুণাবলী হতে মৌল মানবিক চাহিদাগুলোর উদ্ভব। মানব সমাজে বসবাসযোগ্য পূর্বশর্ত হিসেবে সর্বজনীন মৌল মানবিক চাহিদাগুলো বিবেচিত। সামাজিক জীব হিসেবে মানব জীবনে মৌল মানবিক চাহিদাগুলোর তাৎপর্য সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলে।
১. সামাজিকতা ও অস্তিত্ব রক্ষা: মানুষের অস্তিত্ব ও সামাজিকতা রক্ষায় মৌল চাহিদার পূরণ অপরিহার্য। মানুষ স্বাভাবিক উপায়ে এগুলো পূরণে ব্যর্থ হলে অস্বাভাবিক উপায়ে পূরণের ব্যবস্থা করে। যেমন সমাজে বৈধ বা স্বাভাবিক উপায়ে খাদ্যের মতো মৌল চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে, মানুষ অবৈধ বা অস্বাভাবিক উপায়ে যেমন, ভিক্ষা বা চুরির মাধ্যমে অথবা অখাদ্য খেয়ে জীবন ধারণের চেষ্টা করে। বস্ত্রের অভাবে গাছের ছাল, পশুর চামড়া ইত্যাদি দ্বারা সামাজিকতা রক্ষার চেষ্টা করে।
২. অভিন্নতা ও সার্বজনীনতাঃ সবদেশের সকল মানুষের মৌল চাহিদা অভিন্ন, সর্বজনীন এবং চিরন্তন। কারণ মানুষ তাদের মানবিক গুণাবলীর জন্য মৌল চাহিদাগুলো পূরণে অংশগ্রহণ করে। সহজাত মানবিক গুণাবলী বিকাশের জন্য মানুষকে এগুলো পূরণ করতে হয়।
৩. যুগপৎভাবে পূরণঃ মানুষের বেঁচে থাকা এবং সামাজিকতা রক্ষার জন্য মৌল মানবিক চাহিদাগুলো যুগপৎভাবে পূরণ করতে হয়। যেমন খাদ্যের চাহিদা পূরণের সঙ্গে যুগপৎভাবে বস্ত্র, আশ্রয় ও স্বাস্থ্য চাহিদা পূরণ করতে হয়।
৪. সহজাত মানব প্রকৃতি হতে উদ্ভবঃ মানুষের সহজাত প্রকৃতি হতেই মৌল মানবিক চাহিদাগুলোর উদ্ভব হয়েছে। প্রাণী জগতের মধ্যে মানুষ সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে। জন্মগত অসহায়ত্বের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অন্যন্য প্রাণীর মতো কোন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা স্রষ্টা মানুষকে দান করেননি। প্রকৃতি প্রদত্ত এমন কোন ক্ষমতা নিয়ে মানুষ জন্মগ্রহণ করে না, যার সাহায্যে সে নিজেকে জন্মগতভাবে স্বয়ংক্রিয় উপায়ে সামাজিক জীবে পরিণত করতে পারে। মৌল চাহিদাগুলোর যথাযথ পূরণ মানুষকে তার স্বভাবজাত অসহায়ত্ব থেকে রক্ষা করে সামাজিক জীবে পরিণত করে।
৫. মৌল মানবিক চাহিদাগুলো পরস্পর নির্ভরশীলঃ মৌল মানবিক চাহিদাগুলো পরস্পর নির্ভরশীল, যেমন বেঁচে থাকার জন্য মানব উপযোগী খাদ্যের চাহিদা পূরণ নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। আবার সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে খাদ্যের চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা দেয়া যায় না।
মৌল মানবিক চাহিদা এবং মানবিক চাহিদার পার্থক্য
মৌল মানবিক চাহিদার বিকল্প ধারণা হলো মানবিক চাহিদা। এজন্য উভয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। মৌল মানবিক চাহিদা এবং মানবিক চাহিদার মধ্যেকার উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নিচের ছকে দেখানো হলো:




মৌল মানবিক চাহিদা এবং মানবিক চাহিদার পার্থক্য
মৌল মানবিক চাহিদা

মানবিক চাহিদা

১. মৌল মানবিক চাহিদা একটি সর্বজনীন এবং পরিপূর্ণভাবে সামাজিক জীবনে অংশগ্রহণের অপরিহার্য পূর্বশর্ত।
২. মানবিক চাহিদাগুলো সর্বজনীন নয়, বরং সামাজিকভাবে সংগঠিত।
২. মৌল মানবিক চাহিদা একটি পরিপূর্ণ  ধারণা।
২. মানবিক চাহিদা একটি আপেক্ষিক বা তুলনামূলক ধারণা।
৩. মানুষের সহজাত মানবিক গুণাবলী হতে মৌল মানবিক চাহিদাগুলোর উদ্ভব। এটি কোন ব্যক্তিগত বা সাংস্কৃতিক অভিরুচির বিষয় নয়, বরং যেকোন সমাজে বসবাসের জন্য সর্বজনীনভাবে সকল মানুষের এবং সকল সমাজে বসবাসের জন্য মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ অত্যাবশ্যক।
৩. মানবিক চাহিদাগুলো ব্যক্তিগত বিষয় বা সাংস্কৃতিক অগ্রাধিকারভিত্তিক অভিরুচি সংশ্লিষ্ট বিষয় এগুলো আপেক্ষিক বিধায় উচ্চক্রম অনুযায়ী চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়।
মৌল মানবিক চাহিদাগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ

পৃষ্ঠা
১. খাদ্য : মৌল মানবিক চাহিদা হিসেবে খাদ্য বলতে মানবোপযোগী খাদ্যদ্রব্যকে বুঝানো হয়। খাদ্যের মতো মৌল চাহিদা প্রাণীজগতের সব প্রাণীর জন্য অত্যাবশ্যক। এমনকি প্রাক-জন্মাবস্থায় পর্যন্ত খাদ্যের প্রয়োজন। মানব দেহের গঠন, ক্ষয়পূরণ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য খাদ্য অপরিহার্য। মৌল চাহিদা হিসেবে খাদ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, মানুষ স্বাভাবিক উপায়ে খাদ্যের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে অস্বাভাবিক উপায়ে তা পূরণের চেষ্টা করে। মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা এবং মানবিক ও দৈহিক বিকাশের জন্য খাদ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। খাদ্য বলতে সুষম খাদ্যকে বুঝানো হয় অর্থাৎ মানবোপযোগী সুষম খাদ্য। মানবোপযোগী খাদ্য বলতে মানুষের ধর্ম, বর্ণ, সমাজ, সংস্কৃতি, রীতি নীতি স্বীকৃত সুষম খাদ্যকে বুঝানো হয়।
২. বস্ত্র : মানব সভ্যতার ধারক ও বাহক হিসেবে যেমন বস্ত্র অপরিহার্য, তেমনি প্রকৃতির প্রতিকূল অবস্থা হতে নিজেদের রক্ষা করার জন্যও মানব জীবনে বস্ত্রের প্রয়োজন। এজন্য খাদ্যের সঙ্গে সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের সামাজিকতা রক্ষার জন্য বস্ত্রের গুরুত্ব্ অপরিসীম। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ অনাহারে থাকতে পারে, কিন্তু বস্ত্রহীন অবস্থায় সমাজে একমুহূর্ত বসবাস করতে পারে না। বস্ত্রের ব্যবহারই মানুষকে অন্যান্য প্রাণী হতে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দান করেছে। মানুষের সামাজিক সম্পর্ক বজায় রেখে স্বাভাবিক ও সভ্য জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখতে বস্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম।
বস্ত্রের চাহিদা অপূরিত থাকলে মানুষ সামাজিকতা রক্ষা করতে পারে না । ফলে সমাজের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। প্রকৃতির প্রতিকূল অবস্থা হতে মানুষ নিজেকে রক্ষা করতে পারে না বলে, বস্ত্রের অভাবে রোগব্যাধি দেখা দেয়। সুতরাং দেখা যায়, বস্ত্রের অভাবে যেমন মানুষের সামাজিকতা রক্ষা তথা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হয়, তেমনি জনস্বাস্থ্যের প্রতিও হুমকির সৃষ্টি হয়।
৩. বাসস্থান : বাসস্থান বলতে মানুষের বসবাসের স্থানকে বুঝানো হয়। মানুষের আদি ও অকৃত্রিম মৌল প্রয়োজন হলো বাসস্থান। মৌল মানবিক চাহিদা হিসেবে বাসস্থানের গুরুত্ব ব্যাপক ও বহুমুখী। প্রকৃতির প্রতিকূল অবস্থা যেমন শীত-তাপ, রোদ-বৃষ্টি ইত্যাদি হতে আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তা লাভ; সমাজ এবং সভ্যতাকে স্থায়ী ও স্থিতিশীল রূপ দেয়ার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের পরিবেশ সৃষ্টি; স্থায়ী ও নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যকর বাসস্থানের অভাবে পুষ্টিকর খাদ্য ও উন্নত বস্ত্র পরিধান করেও স্বাস্থ্যহীনতার শিকার হবার সম্ভাবনা; সামাজিক আচার-আচরণ, রীতি-নীতি অর্থাৎ সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বাসস্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। সামাজিক কর্তব্য এবং দায়িত্ব পালন ও অধিকার ভোগের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সমাজে স্থায়ীভাবে বসবাস করা, যাযাবর জীবন-যাপনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাসস্থান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজের মৌল প্রতিষ্ঠান পরিবার, বাসস্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে। সুতরাং বলা যায় স্থায়ী আবাস সমাজ গঠনের মূল ভিত্তি।
বাসস্থানের অভাবে মানুষ স্বাস্থ্যহীনতার শিকার হয়। গৃহহীন মানুষ সমাজে পরগাছার মতো ভাসমান অবস্থায় জীবনযাপন করে। বাসস্থান না থাকলে সমাজের স্বাভাবিক শৃংখলা রক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। সুষ্ঠু বাসস্থানের অভাবে পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষা করা যায় না। ফলে সামাজিকীকরণ ব্যাহত হয়ে শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং শিশু কিশোররা ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে গড়ে ওঠে। বাসস্থানের অভাব, সামাজিক সমস্যা সৃষ্টিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।
৪. শিক্ষাঃ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের পরে শিক্ষাকে সারা বিশ্বে অন্যতম মৌল-মানবিক প্রয়োজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। শিক্ষাই মানুষকে প্রাণী জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করে। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের দৈহিক, মানবিক ও আত্মিক উন্নতির সাথে জাগতিক সমস্যার সমাধানে যে কলাকৌশল মানুষকে সাহায্য করে তাই শিক্ষা। মনীষী ফ্রেডারিক হাবার্টের মতে, শিক্ষা হচ্ছে মানুষের বহুমুখী প্রতিভা এবং অনুরাগের সুষম প্রকাশ ও নৈতিক চরিত্র গঠন। জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণায় শিক্ষাকে মৌল চাহিদার মর্যাদা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘‘শিক্ষা মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে, যা তাকে আধুনিক ও উৎপাদনক্ষম করে তুলে এবং আত্মনির্ভরশীল হওয়ার মাধ্যমে অন্ন, বস্ত্র, পুষ্টি ও আশ্রয়ের মতো অপরিহার্য মৌল চাহিদাগুলো অর্জনযোগ্য ও পারঙ্গম হতে সক্রিয় ভূমিকা পালনে সহায়তা করে।’’ পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে মানুষকে সক্ষম করার প্রধান উপায় হলো শিক্ষা। সুতরাং দেখা যায়, শিক্ষা অন্যান্য মৌল চাহিদা হতে ব্যতিক্রম। অন্যান্য মৌল চাহিদা পূরণের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে শিক্ষা। মানুষের সহজাত মানবীয় প্রতিভা ও অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা বিকাশের মাধ্যম হলো শিক্ষা।
শিক্ষা আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং মানব সভ্যতার বিকাশের প্রধান উপকরণ। মানব সম্পদ উন্নয়নের সর্বোত্তম খাত হলো শিক্ষা। শিক্ষার্জনের মাধ্যমে মানুষ নিজের প্রতিভা ও ক্ষমতা বিকাশের সুযোগ লাভ করে। যা তাকে নিজের ও সমাজের উন্নয়নে অর্থবহ ভূমিকা পালনে সক্ষম করে তুলে। শিক্ষার অভাবে নিরক্ষরতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার প্রভৃতি মানুষকে আছন্ন করে ফেলে যার ফলে মানুষ নিজের অধিকার এবং কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারে না। শিক্ষার অভাবে সৃষ্ট নিরক্ষরতা ব্যক্তিগত ও জাতীয় উন্নয়নে বহুমুখী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। মানব সম্পদ উন্নয়নের প্রধান উপায় শিক্ষা। দারিদ্র, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যহীনতা, পুষ্টিহীনতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার প্রভৃতি বহুমুখী সমস্যার প্রধান কারণ হলো নিরক্ষরতা।
শিক্ষাকে জাতির মেরুদন্ড বলে আখ্যায়িত করা হয়। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। শিক্ষার অভাবে মানুষ স্বীয় অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারে না। শিক্ষার অভাবে অজ্ঞতা, অদৃষ্টবাদিতা, রক্ষণশীলতা, স্বাস্থ্যহীনতা, পুষ্টিহীনতা, ভিক্ষাবৃত্তি, দরিদ্রতা, কর্মবিমুখতা ইত্যাদি বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি হয়।
৫. স্বাস্থ্যঃ  স্বাস্থ্য মানুষের অন্যতম মৌল মানবিক চাহিদা । মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্ঠিগত উন্নয়নের প্রধান সহায়ক হল স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্যহীনতার ফলে মানুষের কর্মক্ষমতা লোপ পায় । এতে মাথাপিছু উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় । এজন্য
পৃষ্ঠা

স্বাস্থ্যকে ব্যক্তিগত ও জাতীয় সম্পদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বিশ্ব ‍স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞানুযায়ী ,স্বাস্থ্য বলতে শারিরিক, মানসিক এবং সামাজিক অবস্থার সুস্থতাকেই বোঝানো হয় ।
দেশের আর্থ-সামাজিক তথা সার্বিক উন্নয়নের প্রধান সহায়ক হচ্ছে সুস্থ, সবল ও কর্মনৈপুণ্যসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি। স্বাস্থ্যহীনতার দরুণ জনগণের গুণগত মান ও কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। যা দেশের উৎপাদনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। স্বাস্থ্যহীনতার ফলে পরনির্ভরশীলতা, ভিক্ষাবৃত্তি, অপরাধ প্রবণতা, শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস, আয়ুষ্কল হ্রাস, দরিদ্রতার প্রসার, শ্রম বিমুখতা ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি হয়।
৬. চিত্তবিনোদনঃ চিত্তবিনোদন আধুনিক শিল্প সমাজের গুরুত্বপূর্ণ মৌল চাহিদা হিসেবে সবদেশে স্বীকৃত। চিত্তবিনোদন হচ্ছে অবসরকালীন সময়কে অর্থবহ করে তোলার অন্যতম হাতিয়ার, যা মানুষের কর্মস্পৃহাকে পুনঃউজ্জীবিত করে। মানুষের সহজাত আনন্দ বিলাসী মনই মানব সভ্যতাকে ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধশালী করে চলেছে। সৃজনশীল কাজ ও গঠনমূলক চিন্তার খোরাক জোগায় নির্মল আনন্দ ও চিত্তবিনোদন। গঠনমূলক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ দেয় চিত্তবিনোদন। সৃজনশীল জীবনধারার সহায়ক হচ্ছে নির্মল চিত্তবিনোদন। চিত্তবিনোদন সময়ের শূন্যতা পূরণ নয়, সময় কাটানোও নয়, বরং এর লক্ষ্য হচ্ছে সময়কে অর্থবহ ও জীবন্ত করে তোলা। নির্মল চিত্তবিনোদনের মাধ্যমে সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ, পরিবর্তিত অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান, সুপ্ত প্রতিভা ও নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশ, সুস্থ দেহ এবং মনের বিকাশ সম্ভব। এজন্য মানব জীবনে চিত্তবিনোদনের গুরুত্ব অপরিসীম। অর্থনৈতিক দিক হতে চিত্তবিনোদনের প্রত্যক্ষ মূল্য ধরা না পড়লেও মানুষের শারীরিক ও মানবিক চাহিদা পূরণের জন্য এর গুরুত্ব রয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানী সামনার এবং কেলার খেলাধূলাকে মানুষের আত্মবিকাশের উপায় হিসেবে বিবেচনা করেছেন। গঠনমূলক চিত্তবিনোদন মানব শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশ ঘটানোর সঙ্গে সামাজিক আইন কানুনের প্রতি নিষ্ঠা, মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন ও গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়। চিত্তবিনোদনের অভাবে সৃষ্ট সমস্যাসমূহের মধ্যে অলসতা, মানসিক অবসাদগ্রস্ততা, অনীহা, কর্মবিমুখতা, অপরাধ প্রবণতা, কুচিন্তা, হতাশা, অসামাজিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি, উচ্ছৃঙ্খলতা এবং সৃজনশীল প্রতিভা হ্রাস পেয়ে বৃহত্তর সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
৭. সামাজিক নিরাপত্তা : মৌল মানবিক চাহিদা হিসেবে সামাজিক নিরাপত্তা আধুনিক বিশ্বের সবদেশে স্বীকৃত। শুধু তাই নয়, এটি মৌল মানবাধিকার হিসেবেও স্বীকৃত। বেকারত্ব, ব্যধি, পঙ্গুত্ব ও প্রবীনত্বের কারণে সৃষ্ট অক্ষমতা, বিধবা কিংবা অনুরূপ মানুষের আওতাবহির্ভূত অন্যান্য কারণে সৃষ্ট আর্থিক অনিশ্চয়তা মোকাবেলা সাহায্য লাভের অধিকার নিশ্চিত, মৌল চাহিদা পূরণের পূর্বশর্ত। সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা মৌল চাহিদা পূরণের জন্য অপরিহার্য বিধায় এটি অধিকার হিসেবেও স্বীকৃত। সামাজিক নিরাপত্তা হলো আর্থিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার সুসংগঠিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যত আর্থিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার নিশ্চয়তা বিধান করে সামাজিক নিরাপত্তা। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রে সুসংগঠিত ও সুপরিকল্পিত সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে।
                                                                                                                                                                 উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ হলে যেমন সামাজিক শৃঙ্খলা ও প্রগতি নিশ্চিত   হয়, তেমনি মৌল চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা থেকে দেখা দেয় বহুমুখী সামাজিক সমস্যা ও বিশৃঙ্খলা।
মানব জীবনে মৌল চাহিদা পূরণের প্রয়োজনীয়তা
সামাজিক জীব হিসেবে বেঁচে থাকা এবং সুষ্ঠুভাবে সামাজিক ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে মানব জীবনে মৌল চাহিদাগুলো পূরণের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের জীবন ধারণ, দৈহিক বিকাশ এবং সভ্যতা ও মর্যাদাসম্পন্ন জীবনযাপনের অপরিহার্য  উপকরণ হল মৌল মানবিক চাহিদা। মানব জীবনে মৌল চাহিদাগুলো পূরণের কোন বিকল্প নেই। মৌল চাহিদাগুলো পূরণের গুরুত্বকে নিচের দৃষ্টিকোণ হতে আলোচনা করা যায়।
১. জীবন ধারণ এবং দৈহিক বিকাশের জন্য : সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা এবং দৈহিক গঠন ও বিকাশের জন্য মৌল চাহিদাগুলো পূরণ অপরিহার্য। শরীরের ক্ষয়পূরণ, পরিপোষণ, বৃদ্ধিসাধন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি প্রভৃতির জন্য খাদ্য অপরিহার্য। শুধু বেঁচে থাকার জন্য মানুষ খাদ্য গ্রহণ করে না। সুখ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য খাদ্যের প্রয়োজন।
আবার সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে মানুষ সুস্থ্য ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে না। সুস্থ্য পরিবেশে বসবাস এবং প্রতিকূল পরিবেশ হতে নিজেদের রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর বাসস্থান ও স্বাস্থ্যসম্মত বস্ত্র পরিধান। সুষম ও পরিমিত খাদ্যের অভাবে যেমন স্বাস্থ্যহীনতা, পুষ্টিহীনতা, দৈহিক বিকাশ ব্যাহত হয়; তেমনি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ মানব জীবনকে বিপন্ন করে তুলে। সুতরাং মানুষের বেঁচে থাকার এবং সুস্থ্য-সবল দৈহিক গঠন ও বিকাশের জন্য মৌল মানবিক চাহিদাগুলো পূরণের তাৎপর্য অপরিসীম।
২. মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য : প্রাণী জগতের মধ্যে মানুষ সবচেয়ে উন্নততর ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণী। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি, অবস্থান এবং মর্যাদা বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। মৌল মানবিক চাহিদাগুলো পূরণের মাধ্যমে মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। প্রাণী জগতের মধ্যে মানুষ সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে। জন্মগত অসহায়ত্বের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য অন্যান্য প্রাণীর মতো কোন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা মানুষের নেই। মৌল মানবিক চাহিদাগুলোই মানুষকে তার স্বভাবজাত অসহায়ত্ব থেকে রক্ষা করে সামাজিক
পৃষ্ঠা

জীব হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে। শিক্ষা, চিত্তবিনোদন, পুষ্টিকর খাদ্য এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস মানুষের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের অপরিহার্য উপাদান। শিক্ষার মতো মৌল চাহিদা মানুষের বহুমুখী প্রতিভা এবং বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মানুষের বুদ্ধিময় সত্তার বিকাশে মৌল চাহিদা পূরণের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রত্যেক মানুষ কোন না কোন প্রতিভা ও সৃজনশীল ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। মানুষের মানবিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য সুষমখাদ্য, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, উপযুক্ত শিক্ষা এবং গঠনমূলক চিত্তবিনোদনের চাহিদা পূরণের তাৎপর্য অপরিসীম
৩. সামাজিক মর্যাদা রক্ষার জন্য : মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের সামাজিক সত্তার বিকাশ সাধনে মৌল মানবিক চাহিদাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজে মর্যাদা সহকারে বেঁচে থাকা এবং সুষ্ঠুভাবে সামাজিক ভূমিকা পালনের জন্য মৌল মানবিক চাহিদাগুলো পূরণ অপরিহার্য। মৌল মানবিক চাহিদাগুলো পূরণের মাধ্যমে হৃদয়সর্বস্ব মানুষ নিজেকে সামাজিক জীবে পরিণত করতে সক্ষম হয়। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষার মত মৌল মানবিক চাহিদা যথাযথ পূরণ না হলে, সামাজিক মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। যেমন বস্ত্রের অভাবে মানুষ সভ্য ও মর্যাদাসম্পন্ন জীবনযাপন করতে পারে না। বাসস্থানের অভাবে মানুষ বস্তির মানবেতর পরিবেশে অথবা ভাসমান অবস্থায় বসবাস করে, যা মানব মর্যাদার জন্য হানিকর। খাদ্যের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে মানুষ যখন ইতর প্রাণীর খাদ্য খেয়ে জীবন ধারণের চেষ্টা করে, তখন মানব মর্যাদা ব্যাহত হয়। অনুরূপভাবে শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থতা হতে মুর্খতা ও অজ্ঞতা দেখা দেয়। মুর্খ ও অজ্ঞ লোকের সামাজিক মর্যাদা নেই বললেই চলে। আবার স্বাস্থ্যহীনতার প্রভাবে মানুষ কর্মক্ষমতা হারিয়ে পরনির্ভরশীল জীবনযাপনে বাধ্য হয়। যা মানুষের আত্মমর্যাদার পরিপন্থী। সুতরাং সামাজিক পরিচিতি ও মর্যাদা অনুযায়ী সমাজে বসবাসের ক্ষেত্রে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম।
৪. ভবিষ্যত বিপর্যয় মোকাবেলার জন্য : আধুনিক শিল্প সমাজে সকল মানুষই কোন না কোন ঝুঁকির সম্মুখীন। পেশাগত দুর্ঘটনা, অকাল মৃত্যু, পঙ্গুত্ব, প্রবীন বয়সের অক্ষমতা, অপ্রত্যাশিত ব্যয়, বিধবা, কর্মহীনতা ইত্যাদি আর্থিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি মোকাবেলায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সহায়তা করে। ভবিষ্যত বিপর্যয়কালীন সময়ে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে সামাজিক নিরাপত্তার গুরুত্ব অপরিসীম। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশে সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা মৌল চাহিদা পূরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। প্রত্যেক মানুষের নিজের এবং নিজ পরিবারের স্বাস্থ্য ও কল্যাণের নিমিত্তে পর্যাপ্ত জীবনমান রক্ষার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং প্রয়োজনীয় সেবামূলক কার্যাবলীর সুযোগ এবং বেকারত্ব, অসুস্থতা, অক্ষমতা, প্রবীনত্ব অথবা অনিবার্য কারণে জীবন যাপনের অন্যান্য অক্ষমতার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অধিকার সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত বিষয়।
সমাজের সদস্য হিসেবে প্রত্যেকের সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। সামাজিক জীব হিসেবে মানব ব্যক্তিত্ব বিকাশ এবং সামাজিকীকরণের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা। সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না থাকলে ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রয়োজনীয় মৌল মানবিক চাহিদাগুলো পূরণের সুযোগ-সুবিধার অভাব দেখা দেয়।
বিশ্বের অনুন্নত এবং দরিদ্র দেশগুলো সম্পদ ও সুযোগ সুবিধার অভাবে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। সামাজিক নিরাপত্তা ক্ষেত্রে এসব দেশের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা লাভকে অধিকার হিসেবে জাতিসংঘ সনদে উল্লেখ করা হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, সুষ্ঠু, সুশৃংঙ্খল এবং উন্নত সমাজ গঠনে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ বিশেষ তাৎপর্য  বহন করে। কারণ মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা হতে সামাজিক ও মানবিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। সেগুলো সামাজিক শৃঙ্খলা ও সংহতির প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে।



পৃষ্ঠা
সমাজকল্যাণে মৌল মানবিক চাহিদার গুরুত্ব
মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ এবং সামাজিক সমস্যার মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। যে সমাজে মৌল মানবিক চাহিদাগুলো সুষ্ঠুভাবে পূরণের সুযোগ সুবিধা বেশি, সে সমাজে সামাজিক সমস্যার প্রবণতা অনেক কম। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টির মূল উৎস হলো মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা ও অক্ষমতা।
মানুষের জীবনধারণ এবং সামাজিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ হলে যেমন সামাজিক শৃংখলা ও প্রগতি নিশ্চিত হয়, তেমনি মৌল চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা হতে সামাজিক সমস্যা ও বিশৃংখলা দেখা দেয়। এজন্য সামাজিক সমস্যার মৌলিক উৎস হিসেবে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতাকে বিবেচনা করা হয়।
মৌল মানবিক প্রয়োজন সমাজকল্যাণের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। সমাজকল্যাণ সামাজিক সমস্যা সমাধানে মানুষকে সাহায্য করে। সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টির সর্বজনীন উৎস হলো, মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা ও সামর্থের অভাব। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা ও বিকাশ সাধনের জন্য অপরিহার্য চাহিদার সমষ্টি হলো মৌল মানবিক চাহিদা। এগুলো মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এতো বেশি প্রয়োজনীয়, বৈধ উপায়ে না হলে, মানুষ অবৈধ উপায়ে মৌল মানবিক প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা করে। ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন সমস্যা, ব্যাহত হয় মানুষের সার্বিক কল্যাণ। সমাজকল্যাণের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সামাজিক সমস্যা সমাধানে মানুষকে সহায়তা দান। এজন্য প্রয়োজন সমস্যার কারণ ও উৎস সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানার্জন। সমাজকল্যাণে মৌল মানবিক চাহিদা বিষয়টি অধ্যয়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সামাজিক সমস্যার মূল উৎস সম্পর্কিত জ্ঞান ছাড়া, সমস্যার সমাধান আশা করা যায় না।
যে কোন দেশ ও সমাজের সার্বিক কল্যাণ নির্ভর করে, সে দেশের জনগণের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের সুযোগ-সুবিধার ওপর। তাই সমাজকর্মীদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে মৌল মানবিক চাহিদা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা এবং এসব চাহিদা পূরণের সম্ভাব্য উপায় উদ্ভাবন করা। সুতরাং বলা যায়, সামাজিক সমস্যার সমাধান ও নতুন সমস্যার উদ্ভব প্রতিরোধ করে সমাজের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য সমাজকল্যাণে মৌল চাহিদা সম্পর্কিত জ্ঞানের গুরুত্ব রয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, মৌল মানবিক চাহিদা ও সামাজিক সমস্যার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য বিধায় সমাজকর্মীদের জন্য মৌল মানবিক চাহিদা বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞানার্জন বিশেষ তাৎপর্য  বহন করছে।
বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের বর্তমান অবস্থা
কোন দেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক অবস্থা সে দেশের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল স্বল্পোন্নত দেশ। দুর্বল আর্থ-সামাজিক কাঠামো, অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশ বাংলাদেশের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। দীর্ঘদিনের বিদেশী শাসন ও শোষণের প্রভাবে এদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। তদুপরি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, জনগণের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের অনেক ক্ষেত্রে বিরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করছে।
২০০৯-১০ অর্থ বছরের বাংলাদেশের চলতি মূল্যে মাথাপিছু জিডিপি ছিল মাত্র ৪৭ হাজার ২৮১ টাকা বা ৬৮৪ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ব্যয় জরিপ ২০০৫ এর তথ্যানুযায়ী দেশের শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ লোক এবং পল্লীর ৪৩.৮ এবং শহরের ২৮.৪ ভাগ দারিদ্র সীমার নিচে অবস্থান করছে। বিরাজমান আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের চিত্র বাস্তব তথ্যের আলোকে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
১. খাদ্য: বাংলাদেশে বিরাজমান সমস্যার মধ্যে খাদ্য ঘাটতি অন্যতম। অধিক জনসংখ্যা, অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা, আবাদী জমি হ্রাস, ভূমির অনুর্বরতা ও খন্ড-বিখন্ডতা, ধারাবাহিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্যদ্রব্যের অসম বন্টন ইত্যাদি বাংলাদেশের ধারাবাহিক খাদ্য ঘাটতির প্রধান কারণ। বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও তথ্য পর্যালোচনা করলে, খাদ্যের মতো মৌল মানবিক চাহিদার বাস্তব চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
১৯৮১ সালের আদমশুমারীর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে মাথাপিছু চাষাবাদযোগ্য ভূমির গড় পরিমাণ ০.৩৮ একর এবং ১৯৮৩-৮৪ সালের কৃষিশুমারির তথ্যানুযায়ী মাত্র ০.২৫ একর। ১৯৯১ সালের আদমশুমারীর তথ্যানুযায়ী ০.১৯ একর। কৃষি ভূমির মালিকানা সম্পন্ন পরিবারের সংখ্যা গ্রামীণ এলাকায় ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। ১৯৮১ সালের শুমারী জরিপের তথ্যানুযায়ী গ্রামের শতকরা ৬৫.৮০ ভাগ পরিবারের কৃষি ভূমির মালিকানা ছিল। ২০০১ সালে তা হ্রাস পেয়ে ৫৮.৪৪ ভাগ পরিবারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ গ্রামীণ ৪১.৫৬ ভাগ পরিবারের নিজস্ব কৃষি ভূমির মালিকানা নেই। ২০০৫ সালের কৃষি নমুনা জরিপের তথ্যানুযায়ী মাথাপিছু আবাদী ভূমির পরিমাণ মাত্র ০.১৩ একর এবং ভূমিহীন খানার  সংখ্যা ১৪.০৩ শতাংশ।
মাথাপিছু চাষাবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাওয়ায় খাদ্য উৎপাদন জনসংখ্যার অনুপাতে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ খাদ্য শস্য বিদেশ থেকে আমদানি করে খাদ্য ঘাটতি পূরণ করতে হচ্ছে। ১৯৮১-৮২ অর্থ বছরে মোট ১২ লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য শস্য সাহায্য ও আমদানি করতে হয়। অন্যদিকে ২০০৯ সালে খাদ্য আমদানী ও সাহায্য বাবদ ৩০ লাখ ১৩ হাজার মেট্রিক টন সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশে ধারাবাহিক খাদ্য ঘাটতির প্রভাবে জনগণের খাদ্য চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ হচ্ছে না।

পৃষ্ঠা
খাদ্যের গুণগত মানও বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত নিম্ন পর্যায়ে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে তিন হাজার কিলোক্যালরি খাদ্য শক্তিকে ন্যূনতম দৈনিক মাথাপিছু প্রয়োজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ২০০৫ সালের পরিবারিক আয়-ব্যয় জরিপের  তথ্যানুযায়ী পল্লীর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৩৯.৫ শতাংশ এবং শহরের ৪৩.২ শতাংশ লোক দৈনিক মাথাপিছু ২১২২ কিলোক্যালরী গ্রহণ করে। অন্যদিকে মাথাপিছু দৈনিক ১৮০৫ কিলোক্যালরী গ্রহণ করে গ্রামের ১৭.৯ শতাংশ এবং শহরে ২৪.৪ শতাংশ, যারা চরম দারিদ্র জনগোষ্ঠী। নিচের সারণীতে বাংলাদেশে খাদ্য দ্রব্য গ্রহণের পরিমাণগত ও গুণগত বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হলো।
কয়েকটি নির্দিষ্ট খাদ্য দ্রব্য ভোগের পরিমাণ (২০০৪-২০০৫)
নির্বাচিত খাদ্য দ্রব্য
২০০১-০২
২০০৪-০৫
চাল কেজি
১৮৩.৪
১৮৮.৪
গম কেজি
২১.৫
১৬.৫
খাদ্যশস্য কেজি
২০৪.৯
২০৫.০
আলু কেজি
২৩.৮
৩৫.২
মাংশ কেজি
৬.৬
৮.৫
মাছ কেজি
১৪.৫
১৬.৩
ডিম সংখ্যা
৩৩.৮
৫৮.৬
দুধ, দুগ্ধজাত লিটার
৭.০
৭.৯
ডাল কেজি
৪.০
৩.৬
প্রোটিন (গ্রাম) দৈনিক
৬৩
৬৫
কিলো ক্যালরী
২২৪০
২২৩৮
উংসঃ পরিসংখ্যান পকেট বুক ২০০৮, পৃ-৩৯৩
সুষম খাদ্যের মত মৌল চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা হতে পুষ্টিহীনতা, স্বাস্থ্যহীনতা, উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস, শিল্পায়নের মন্থর গতি ইত্যাদি সমস্যার উদ্ভব হয়।
খাদ্যের মতো মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা হতে পুষ্টিহীনতা, স্বাস্থ্যহীনতা, উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস, শিল্পায়নের মন্থর গতি ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি হয়। খাদ্য ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যাহত হয়। ফলে অন্যান্য মৌল চাহিদা পূরণ সম্ভব হয় না। দেশের জাতীয় উৎপাদনে খাদ্য ঘাটতির চক্রাকার প্রভাব নিচের ছকের মাধ্যমে দেখানো হলো।
খাদ্য ঘাটতির প্রভাব



.বস্ত্র: সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের সামাজিকতা রক্ষা এবং প্রাকৃতিক প্রতিকূল অবস্থা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য বস্ত্রের প্রয়োজন পূরণ অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশে বস্ত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ মৌল মানবিক চাহিদা আর্থিক কারণে সবশ্রেণীর জনগণের পক্ষে যথাযথভাবে পূরণ সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশে দরিদ্র ও নিম্নশ্রেণীর খাদ্যের প্রয়োজন মেটাতে মাথাপিছু আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করা হয় এবং বস্ত্রখাতে ব্যয়ের পরিমাণ অত্যন্ত কম। ১৯৭১

পৃষ্ঠা
সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বস্ত্র শিল্পের অপরিমেয় ক্ষতি, স্বাধীনতা-উত্তর বাস্তবতার আলোকে ত্রুটিপূর্ণ বস্ত্রনীতি এবং বস্ত্র শিল্পের জাতীয়করণের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট অনিয়ম, দুর্নীতি, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন হ্রাস ইত্যাদি বাংলাদেশের বস্ত্র সমস্যাকে তীব্র করে তুলেছে।
মাথাপিছু বার্ষিক গড়ে ১০ মিটার কাপড়ের ব্যবহার ধরা হলে ১৪ কোটি জনসংখ্যার জন্য ১৪০ কোটি মিটার কাপড়ের প্রয়োজন বলে অনুমান করা যায়। ২০০১-২০০২ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী ১৩১.৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা হিসেবে মাথাপিছু বার্ষিক নতুন বস্ত্রের প্রাপ্যতা ছিল ১৫.৭ মিটার এবং পুরাতন কাপড়ের প্রাপ্যতা ছিল ০.০৩ মিটার।
বাংলাদেশের বস্ত্রের চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধান (১৯৯৭-২০০২) (মিলিয়ন)
বস্ত্রের চাহিদা
১৯৯৫-১৯৯৬
২০০১-০২ (প্রক্ষেপিত)
অভ্যন্তরীণ ভোগের জন্য বস্ত্রের চাহিদা
১,৫২০
২,০৩৭
অভ্যন্তরীণ ভোগের জন্য বস্ত্রের যোগান
৯২৯
১,০৮০
বস্ত্রের চাহিদা ও যোগাযোগের ব্যবধান অভ্যন্তরীণ ভোগের ক্ষেত্রে
৫৯১
৯৫৭
উৎসঃ পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাংলা ভার্সন, পৃ-২৯৩ (সংকলিত)
উপর্যুক্ত তথ্য হতে বাংলাদেশে বস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধির বাস্তব চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এটি একটি সমষ্টিগত অবস্থার ব্যাখ্যা। যদি ব্যাষ্টিক পর্যায়ে বস্ত্রের বাস্তব অবস্থা ব্যাখ্যা করা যায়, তাহলে আরো হতাশাজনক চিত্র পাওয়া যাবে। বস্ত্রের চাহিদা পূরণের জন্য প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ পুরাতন কাপড় বিদেশ থেকে আমাদানি করা হচ্ছে। যদিও এসব পুরাতন কাপড় জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকির সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশে বস্ত্রের অভাবে একদিকে অসংখ্য দরিদ্র ও দুঃস্থ মানুষ শীত এবং গ্রীষ্মকালে প্রতিকূল পরিবেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে, অন্যদিকে বস্ত্রের চাহিদা পূরণের জন্য বিদেশী পুরাতন কাপড় আমদানি করে জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করা হচ্ছে।
৩. বাসস্থান : বাসস্থান মানুষের আদিম ও অকৃত্রিম মৌল চাহিদা। বাংলাদেশে বাসস্থান সমস্যা অত্যন্ত প্রকট। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ জনগণের শহরমুখী প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রাম ও শহর এলাকায় বাসস্থান সমস্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৫ সালের কৃষি নমুনা জরিপের তথ্যানুযায়ী মোট খানার ১৪.০৩ শতাংশ অর্থাৎ সাড়ে ঊনচল্লিশ লাখ খানা ভূমিহীন।
১৯৯১ সালের আদমশুমারির চূড়ান্ত রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে ৯ কোটি ৩৫ লাখ লোক নিজস্ব ভিটেবাড়িতে বাস করে। আশ্রিত লোকের সংখ্যা ৪৫ লাখ। আদমশুমারির তথ্যানুযায়ী মোট জনসংখ্যার ০.৪৯ ভাগ অর্থাৎ পাঁচ লাখ ২৫ হাজার লোক গৃহহীন ও ভাসমান অবস্থায় জীবনযাপন করছে।
২০০০ সালের খানা আয় ব্যয় জরিপের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের ৬২.৩৩ ভাগ গৃহ কাঁচা, ২১.৯৫ ভাগ টিন ও কাঠের তৈরি। গ্রামীণ ৬৯ ভাগ গৃহ কাঁচা এবং মাত্র ২৩.৮৪ ভাগ টিনের তৈরি। গ্রামের ১৮.৭ ভাগ পরিবার বিদ্যুত সুবিধা পাচ্ছে। গ্রামীণ ৭৯.৪১ ভাগ পরিবার অস্থায়ী এবং খোলা জায়গায় পায়খানা পয়ঃনিষ্কাশন করছে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে বসত ভিটাহীন পরিবারের সংখ্যা ১৪ লাখ ৯১ হাজার ৮৫৫টি; শুধু বসতভিটা রয়েছে এরূপ পরিবারের সংখ্যা ২১ লাখ ৬২ হাজার ৮০৩টি। বসতভিটাসহ ৫ শতাংশের কম ভূমি রয়েছে এরূপ পরিবারের সংখ্যা ৪০ লাখ ৬ হাজার ১৩৭টি।
আদমশুমারী ২০০১ এর তথ্যের আলোকে বাংলাদেশে বাসস্থানের চিত্র নিচের টেবিলে উপস্থাপন করা হলো
বাংলাদেশে গড় খানার আকার (১৯৭৩-২০০১)

১৯৭৩
১৯৮১
১৯৯১
২০০১
বাংলাদেশ
৫.৬
৫.৭
৫০৫
৪.৯
গ্রাম
৫.৬
৫.৭
৫.৫
৪.৯
শহর
৫.৯
৫.৯
৫.৫
৪.৮
উৎসঃ লোকশুমারী রিপোর্ট ২০০১ প্রকাশ জুলাই ২০০৩, পৃ-৯৭
গৃহ নির্মাণ কাঠামো (২০০১)
গৃহের কাঠামোর ধরন
মোট
ঝুপড়ী
কাঁচা
সেমি পাকা
পাকা
বাংলাদেশ
১০০.০
৮.৮
৭৪.৪
১০.১
৬.৭
শহর
১০০.০
৭.৬
৪৭.২
২৩.৩
২২.০
গ্রাম
১০০.০
৯.২
৮২.২
৬.৩
২.৩
উৎস : লোকশুমারী রিপোর্ট, ২০০১,পৃ-৯৯।

পৃষ্ঠা
উপর্যুক্ত বাস্তব তথ্যসমূহ হতে বাংলাদেশে বাসস্থানের মতো মৌল মানবিক চাহিদার করুণ চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রতি বছর ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাস, নদীর ভাঙ্গন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশে বাসস্থান সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে।
৪. শিক্ষাঃ বাংলাদেশে শিক্ষার মতো মৌল চাহিদা উন্নত বিশ্বের সমপর্যায়ে থেকে অনেক নিচে। ১৯৯১ সালের লোকশুমারীর তথ্যানুয়ায়ী পাঁচ বছর বয়সের উপরের জনসংখ্যার শতকরা ২৪.৮২ ভাগ শিক্ষিত ছিল। আর সাত বছর বয়সের উপরের জনসংখ্যার ৩২.৪ ভাগ শিক্ষিত দেখানো হয়েছে। যার মধ্যে পুরুষ শতকরা ৪০ ভাগ এবং মহিলা ২৫ ভাগ। শহরে ৫৭ ভাগ এবং গ্রামে ২৮ ভাগ শিক্ষিত দেখানো হয়েছে।
বিগত ১৯৬১ হতে ২০০১ সালের লোকশুমারীর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধির প্রবণতা নিচের টেবিলে দেখানো হলো :
বাংলাদেশে শিক্ষার হার (সব বয়সের) ১৯৬১-২০০১
শুমারী বছর
উভয় লিঙ্গ
পুরুষ
মহিলা
পল্লী
শহর
১৯৬১
১৭.৬
২৬.০
৮.৬
১৬.৫
৩৮.৭
১৯৭৪
২০.২
২৭.৬
১২.২
১৮.৫
৩৭.৭
১৯৮১
১৯.৭
২৫.৮
১৩.২
১৭.০
৩৪.৮
১৯৯১
২৪.৯
৩০.০
১৯.৫
২১.২
৪০.৩
২০০১
৩৭.০
৪০.৩
৩৩.৪
৩২.৭
৫১.২
উৎসঃ লোকশুমারী রিপোর্ট ২০০১, প্রকাশিত জুলাই ২০০৩।
বাংলাদেশে ২০০৬ এর বয়সভিত্তিক জনসংখ্যার মধ্যে শিক্ষার হারের তথ্যাদি নিচে দেওয়া হলো।
বয়সভিত্তিক শিক্ষার হার (২০০৬)

বাংলাদেশ
শহর
পল্লী
উভয়
পুরুষ
মহিলা
উভয়
পুরুষ
মহিলা
উভয়
পুরুষ
মহিলা
৫ বছর + জনসংখ্যার শিক্ষার হার
৫৫.৬৯
৫৩.৭২
৪৭.৫৬
৬১.৮৮
৬৫.১৭
৫৮.৫৫
৪৬.৯৯
৪৯.৯৯
৪৩.৮৭
৭ বছর + জনসংখ্যার শিক্ষার হার
৫২.৪৯
৫৫.৭৭
৪৯.১১
৬০.০১
৬৭.৫৩
৬০.৪৭
৪৮.৬৬
৫১.৯৯
৪৫.২৭
বয়স্ক (১৫ বছর +)
শিক্ষার হার
৫৩.৬৮
৫৮.৪৮
৪৮.৮২
৬৩.৩৬
৭২.২৫
৬২.৪৯
৪৮.৯৩
৪৩.৭৬
৪৪.০০
উৎসঃ পরিসংখ্যান পকেট বুক-২০০৮, পৃ-৩৬৮।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির সীমাবদ্ধতার কারণে নিরক্ষরতার সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। নিরক্ষর, অজ্ঞ, অদক্ষ জনশক্তি জাতীয় উন্নয়নে সক্রিয় অয়ংশগ্রহণে সক্ষম হচ্ছে না। ব্যক্তিগত জীবনেও এসব নিরক্ষর লোক প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। বর্তমানে সরকারি পর্যায়ে শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে গৃহীত সরকারি বেসরকারি কার্যক্রমের প্রভাবে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৫. স্বাস্থ্যঃ স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম। স্বাস্থ্য মানুষের যেমন ব্যক্তিগত সম্পদ, তেমনি জাতীয় সম্পদও বটে। স্বাস্থ্যহীনতার প্রভাবে মানুষ জীবন ধারণের অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য অর্জনে সক্ষম হয় না। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্বাস্থ্য রক্ষার সুযোগ-সুবিধা এবং স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি না পাওয়ায় স্বাস্থ্যহীনতা প্রসারিত হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ২০০৯ এবং ২০১০ সালের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী নিচের সারণীতে স্বাস্থ্যসেবা খাতের প্রধান কয়েকটি তথ্য উল্লেখ করা হলো :
সন
সরকারি ডিসপেনসারী
ডিসপেনসারী এবং হাসপাতাল শয্যা
রেজিঃ ডাক্তার
রেজিঃ নার্স
রেজিঃ ধাত্রী
যক্ষ্মা ক্লিনিক
থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
২০০৭-২০০৮
১,৩৬২টি
৪১.১০৭
৪৯.৬০৮
২৩.২৬৬
২১.৯৩৬
৪৪টি
৪২১টি
উৎসঃ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৯, পৃ-২৩৯।

পৃষ্ঠা ১০
এছাড়া সরকার অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত প্রতি ছয় হাজার পল্লীর জনগোষ্ঠীর জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। মোট ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
স্বাস্থসেবা সংশ্লিষ্ট মৌলিক তথ্য :
১. হাসপাতাল শয্যা প্রতি রোগী (ডিসপেনসারীসহ) ১: ৩৫০৮ (২০০৮-০৯);
২. রেজিষ্টার্ড ডাক্তার প্রতি জনসংখ্যা ১: ২৭৭৩ জন (২০০৮-০৯);
৩. নার্স প্রতি জনসংখ্যা ১: ৮,৮৭৯ (২০০০);
৪. প্রতি হাজারে স্থুল  শিশু জন্মের হার ২০.৫ (২০০৮);
৫. প্রতি হাজারে স্থূল শিশু মৃত্যুর হার ৬.০ (২০০৮);
৬. প্রতি হাজার প্রসবে মাতৃমৃত্যুর হার ; শহরে ২.৪ এবং পল্লী ৩.৯ জন (২০০৮);
৭. প্রতি হাজার শিশু মৃত্যুর হার (১ বছরের নিচে প্রতি হাজার জীবিত জন্মে) ৪১ জন (২০০৮);
৮. নিরাপদ খাবার পানি লভ্যতা (%) পল্লী ৮৫ এবং শহর ৬০.০ (২০০৮);
৯. সেনিটারী ল্যাট্রিন সুবিধা (ব্যবহারকারী) ৮৭.০ ভাগ (২০০৮)।
সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবস্থা : স্বাস্থ্য সর্বজনীন মৌলিক মানবিক চাহিদা। স্বাস্থ্য রক্ষার মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সুপেয় বিশুদ্ধ পানি এবং স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবস্থা। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ এবং জীবন ধারণের প্রধান উপাদান হলো পানি ও টয়লেট ব্যবস্থা। এখানে পানি ও টয়লেট ব্যবস্থার তথ্য দেয়া হল :
পরিবারের খাবারের পানির উৎস (শতকরা হার)
লোকশুমারী বছর
টেপের পানি
টিউব ওয়েল
গভীর নলকূপ
পুকুর
অন্যান্য উৎস
২০০১
জাতীয়
৫.৯৬
৭৯.৭৭
৪.৯০
৩.৪৪
৫.৯৩
শহর
২৫.৫৪
৬৫.১৫
৪.৭৭
১.২০
৩.৩৪
গ্রাম
০.৩৪
৮৩.০৬
৪.৯৩
৪.০৯
৬.৬৮
১৯৯১
জাতীয়
৪.৩০
৭৫.৭৩
৯.৪৬
৭.৮৮
২.৬২
শহর
২২.৪৯
৬৭.৭৫
৪.৬৯
৩.৮৭
১.২০
গ্রাম
০.১৪
৭৭.৫৬
১০.৫৬
৮.৮০
২.৯৫
উৎসঃ আদমশুমারী রিপোর্টঃ ২০০১, জুলাই ২০০৩।
তবে ২০০৮ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী পল্লীর শতকরা ৮৫ ভাগ এবং শহরের শতকরা ৬০ ভাগ লোক সুপেয় পানি গ্রহণ করছে। সরকার ২০১১ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।[1]
খানার টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ (১৯৯১ - ২০০১) (শতকরা)
লোকশুমারী

স্যানেটারী
অন্যান্য টয়লেট
নির্দিষ্ট স্থান নেই
২০০১
জাতীয়
৩৬.৮৭
৪১.৫৩
২১.৫৯

শহর
৬৭.৩০
২৫.৩৪
৭.৩৬

গ্রাম
২৮.১৫
৪৬.১৮
২৫.৬৭
১৯৯১
জাতীয়
১২.৪৬
৫৩.৩৪
৩৪.২০

শহর
৪০.২৪
৪৩.৬৮
১৬.০৮

গ্রাম
৬.০৯
৫৫.৫৬
৩৮.৩৫
উৎসঃ আদমশুমারী রিপোর্ট ২০০১, প্রকাশ ২০০৩, পৃ-৯৯।
সুস্থ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত গৃহ পরিবেশের অপরিহার্য উপাদান হলো নিরাপদ টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ। সরকার স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন। যার ফলে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পল্লী ও শহরের শতকরা ৮৭ ভাগ লোক স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে। আগামী ২০১৩ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনগণের অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
পৃষ্ঠা ১১
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য ঘাটতি, ভোজাল খাদ্যদ্রব্য, খাদ্য গ্রহণের নিম্নমান ও স্বল্পতা, চিকিৎসা সুবিধা ও স্বাস্থ্যসেবার স্বল্পতা, নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা ইত্যাদি কারণে স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যা বিরাজ করছে।
৬. চিত্তবিনোদন : বাংলাদেশে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি চাহিদা যথাযথ পূরণ না হওয়ায় চিত্তবিনোদনের মতো মৌল প্রয়োজন তেমন গুরুত্ব বহন করছে না। বাংলাদেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ  চিত্তবিনোদনের সুযোগ অনেকটা সীমিত। গঠনমূলক চিত্তবিনোদনের সুযোগ সুবিধার অভাবে দেশের যুব সমাজের আচরণের বিচ্যুতি ঘটছে। স্যাটেলাইট প্রযুক্তির মাধ্যমে  টেলিভিশনে শহর ও গ্রামে প্রচারিত বিদেশী চিত্তবিনোদমূলক আচার-অনুষ্ঠান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে। যুব অসন্তোষ, অপরাধ প্রবণতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদির অন্যতম প্রধান কারণ টিভি-ভিসিআর, সিনেমা ইত্যাদিতে প্রদর্শিত দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন বিদেশী অনুষ্ঠানমালা।
৭. সামাজিক নিরাপত্তা : বাংলাদেশে সম্পদ ও সুযোগ সুবিধার অভাবে সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে দরিদ্র ও নিম্ন শ্রেণীর লোক সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে বিপর্যয়কালীন সময়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বাংলাদেশে বিশেষ কতগুলো কারখানার শ্রমিক কর্মচারী, সরকারি আধাসরকারি সংস্থার কর্মচারী কর্মকর্তারা সামাজিক নিরাপত্তার সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকেন। শ্রমিক ক্ষতিপূরণ, দলীয় বীমা, মাতৃত্ব সুবিধা, পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, কল্যাণ তহবিল, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর ভাতা এবং কল্যাণ সুবিধা ইত্যাদি সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাংলাদেশে বিদ্যমানএছাড়া সামাজিক সাহায্য হিসেবে প্রবীন ভাতা, গৃহায়ন তহবিল, দুঃস্থ মহিলা ভাতা, নিরাপত্তা কর্মবেষ্টনী  ইত্যাদি দরিদ্র ও দুঃস্থদের সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা প্রদান করছে। সীমিত হলেও এসব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সংশ্লিষ্টদের মৌল চাহিদা পূরণে বিশেষ তাৎপর্য  বহন করছে।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে সম্পদশালী শ্রেণী মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের সুযোগ পেলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ধারাবাহিকভাবে যথাযথ ও মানসম্মত পর্যায়ে মৌল চাহিদা পূরণে সক্ষম হচ্ছে না। ফলে তারা মানবিক চাহিদা যথাযথভাবে পূরণে ব্যর্থ হয়ে অনেক সময় মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়।


পৃষ্ঠা ১২
বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা অপূরণজনিত সমস্যা
যে কোন দেশের সামাজিক সমস্যা উদ্ভবের অন্যতম প্রধান কারণ হলো মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা। মৌল মানবিক চাহিদা যথাযথ পরিপূরণ না হলে যেমন সমস্যার সৃষ্টি হয়, তেমনি স্বাভাবিক উপায়ে মৌল চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে অস্বাভাবিক উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে এগুলো পূরণের প্রচেষ্টা হতেও বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয়। এজন্য সমাজবিজ্ঞানীরা মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতাকে সামাজিক সমস্যার মৌলিক উৎস হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন।
বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা অপূরণজনিত কারণে উদ্ভূত প্রধান সমস্যাগুলো নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
১. স্বাস্থ্যহীনতা :
.  বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা হতে সৃষ্ট অন্যতম সমস্যা হল স্বাস্থ্যহীনতা। খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিত্তবিনোদন প্রভৃতি মৌল মানবিক চাহিদা যথাযথ পূরণের ব্যর্থতা স্বাস্থ্যহীনতার প্রধান কারণ। যেমন
বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০০৫ এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে চরম দারিদ্র রেখার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার শতকরা হার জাতীয় ১৯.৫, শহরে ২৪.৪ ভাগ, গ্রামে ১৭.৯ ভাগ এবং দারিদ্র রেখার নিচে অবস্থানকারী জাতীয় ৪০.৪ ভাগ, শহরে ৪৩.২ এবং গ্রামে ৩৯.৫ ভাগ। এরা দৈনিক মাথাপিছু যথাক্রমে ১৮০৫ হতে ২১২২ কিলোক্যালরী খাদ্যশক্তি গ্রহণ করে। স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সুষম খাদ্যের অভাবে দেশের বৃহত্তর দরিদ্র মানুষ প্রত্যাশিত স্বাস্থ্যমান অর্জনে সক্ষম হচ্ছে না।      
খ.  স্বাস্থ্য রক্ষার অপরিহার্য  উপাদান স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান এবং বস্ত্রের ব্যবহার। ২০০৮ সালের তথ্যানুযায়ী সুপেয় পানি গ্রহণকারী পল্লীর শতকরা ৮৫ ভাগ এবং শহরের ৬০ ভাগ। অন্যদিকে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা সুবিধাভোগীর শতকরা ৮৭ ভাগ। বস্ত্রের চাহিদা পূরণের জন্য বিদেশ হতে আমদানীকৃত পুরাতন কাপড় জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকির সৃষ্টি করছে। এছাড়া বাসস্থানের অভাবে বাংলাদেশে বস্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বস্তির নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সংক্রামক ব্যধির উর্বর ক্ষেত্র। জরাজীর্ণ  অস্বাস্থ্যকর গৃহ ও বস্তির নোংরা পরিবেশ স্বাস্থ্যহীনতার প্রধান কারণ হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
. চিকিৎসা সুযোগ-সুবিধার অভাবে গ্রামবাংলার বৃহত্তর দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যহীনতার শিকার। শহরকেন্দ্রিক ব্যয়বহুল চিকিৎসার সুযোগ থেকে দেশের বৃহত্তর দরিদ্র জনগোষ্ঠী বঞ্চিত।
.       বাংলাদেশে জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিরক্ষর। ২০০৮ এর তথ্যানুযায়ী সাক্ষরতার হার (১১ + বছর) মাত্র ৫৯.১ ভাগ। নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতার প্রভাবে প্রধানত মানুষ স্বাস্থ্যহীনতার শিকার হয়।
ঙ. নির্মল ও গঠনমূলক চিত্তবিনোদনের অভাবে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে মানসিক অবসাদগ্রস্ততা, হতাশা, দৈহিক দুর্বলতা প্রভৃতি রোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
সুতরাং দেখা যায়, বাংলাদেশে মৌল চাহিদা মানবিক চাহিদাগুলো প্রত্যাশিত মান অনুযায়ী পূরণ না হওয়ায় স্বাস্থ্য সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাস্থ্যহীনতার প্রভাবে মানুষের অন্যান্য মৌল চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে না।
২. পুষ্টিহীনতা : মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা হতে সৃষ্ট সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মানবিক সমস্যা হলো পুষ্টিহীনতা। যে প্রক্রিয়ায় জীবদেহের অভ্যন্তরে খাদ্যদ্রব্য পরিপাক ও পরিশোধিত হয়ে সমস্ত দেহের কোষে কোষে ছড়িয়ে দেহের বৃদ্ধিসাধন, রক্ষণাবেক্ষণ ও শক্তি উৎপাদনে সাহায্য  করে, সে প্রক্রিয়াকে পুষ্টি বলা হয়। খাবারের ছটি উপাদানের (আমিষ, শর্করা, স্নেহ পদার্থ, খনিজ পদার্থ, ভিটামিন ও পানি) যে কোন একটি খাদ্য তালিকায়  পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকলে বা অনুপস্থিত থাকলে পুষ্টি প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ফলে দেহে সে উপাদানের ঘাটতিজনিত রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। এরূপ অবস্থাকে পুষ্টিহীনতা বলা হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত বিভিন্ন শিশু পুষ্টি জরিপের তথ্য হতে পুষ্টিহীনতার চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিচের ছকে বাংলাদেশে পুষ্টিহীনতার ব্যাপকতা দেখানো হলো।









পৃষ্ঠা

শিশুদের পুষ্টির মান (৬-৭১ মাস বয়স)

সাল
শ্রেণী
জাতীয়
ছেলে
মেয়ে

১৯৯২
স্বাভাবিক
৬.২
৬.২
৬.২
ক্ষীণ অপুষ্টি (প্রথম ডিগ্রি)
৩৯.৮
৪০.৬
৩৮.৯
মাঝারী অপুষ্টি (দ্বিতীয় ডিগ্রি)
৪৭.২
৪৬.৯
৪৭.৪
চরম অপুষ্টি (তৃতীয় ডিগ্রি)
৬.৮
৬.৩
৭.৪

১৯৯৬
স্বাভাবিক
১০.৩
১১.৫
৯.১
ক্ষীণ অপুষ্টি (প্রথম ডিগ্রি)
৪৭.০
৪৬.৬
৪৭.৪
মাঝারী অপুষ্টি (দ্বিতীয় ডিগ্রি)
৩৮.৪
৩৮.৬
৩৮.১
চরম অপুষ্টি (তৃতীয় ডিগ্রি)
৪.৩
৩.৩
৫.৪

২০০০
স্বাভাবিক
১১.৫
১১.০
১২.১
ক্ষীণ অপুষ্টি (প্রথম ডিগ্রি)
৫০.৭
৫৭.৬
৪৯.৮
মাঝারী অপুষ্টি (দ্বিতীয় ডিগ্রি)
৩৪.৭
৩৪.৩
৩৫.১
চরম অপুষ্টি (তৃতীয় ডিগ্রি)
২.৪
২.৪
২.৫
উৎস : পরিসংখ্যান পকেট বুক ২০০৮, পৃ-৪০৪।
পুষ্টিহীনতার প্রভাবে শিশু মৃত্যুর হার বৃদ্ধি, অন্ধত্ব, ক্ষীণমেধা, বিকলাঙ্গতা, স্বাস্থ্যহীনতা প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়। সুষম খাদ্যের অভাব, নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পুষ্টিজ্ঞানের অভাব প্রভৃতি পুষ্টিহীনতা প্রধান কারণ।
৩. নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা : শিক্ষার মত মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা হতে নিরক্ষরতা সমস্যা দেখা দেয়। ১৯৯১ সালের লোকশুমারীর তথ্যানুযায়ী সাত বছর বয়সের ওপরের জনসংখ্যার শতকরা ৩২.৪ ভাগ মাত্র শিক্ষিত। ২০০১ সালের লোকশুমারীর তথ্যানুযায়ী এ হার ৪৫.৩ ভাগ, যার মধ্যে পুরুষ ৪৯.৬ ভাগ; মহিলা ৪০.৮ ভাগ। ২০০৬ সালের তথ্যানুযায়ী দেশে ৫+ বছর জনসংখ্যার মধ্যে শিক্ষার হার ৫৫.৬৯ ভাগ। এর মধ্যে পুরুষ ৫৩.৭২ এবং নারী ৪৭.৫৬ ভাগ। শহরে ৬১.৮৮ এবং গ্রামে ৪৬.৯৯ ভাগ শিক্ষিত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না পাওয়ায় নিরক্ষরতা হার হ্রাস পাচ্ছে না। নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতার প্রভাবে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য প্রভৃতি মৌল চাহিদা পূরণের দক্ষতা ও কর্মকুশলতা অর্জনে মানুষ ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে নিরক্ষর জনগোষ্ঠী ন্যূনতম মৌল চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। স্বাস্থ্যহীনতা, পুষ্টিহীনতা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দারিদ্র, অপরাধ প্রবণতা, কুসংস্কার প্রভৃতি সমস্যার মূল কারণ নিরক্ষরতা। নিরক্ষরতা মোকাবেলায় সরকার শিক্ষা খাতে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
৪. বস্তি ও গৃহ সমস্যা : বাংলাদেশে বাসস্থানের মতো মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা হতে বস্তি এবং গৃহ সমস্যা দেখা দেয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ন, শিল্পায়ন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গৃহসমস্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের তথ্যানুযায়ী শুধু ঢাকা শহরে পনেরশ বস্তিতে বিশ লাখ লোক বসবাস করছে। মার্চ  ২০০৫ সালের সরকারি তথ্যানুযায়ী বস্তির সংখ্যা চার হাজার এবং বস্তির লোকসংখ্যা ছিল ৩৫ লাখ, অথচ ১৯৭৩ সালে বস্তির জনসংখ্যা ছিল মাত্র চার লাখ।
মানুষের অন্যতম মৌল মানবিক চাহিদা হচ্ছে আশ্রয়। পুষ্টিকর খাদ্য, ভাল পোশাক, উপর্যুক্ত শিক্ষা থাকা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যকর বাসস্থানের অভাবে মানুষের সামাজিকতা এবং স্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব হয় না। বাসস্থানের অভাবে মানুষ স্বাস্থ্যহীনতার শিক্ষার হয়। গৃহহীন মানুষ সমাজে পরগাছার মতো ভাসমান অবস্থায় জীবন-যাপন করে, সমাজের স্বাভাবিক শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সুষ্ঠু বাসস্থানের অভাবে পারিবারিক গোপনীয়তা বাজায় রাজা যায় না। এতে শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। তাদের সামাজিকীকরণ ব্যাহত হয়। ফলে শিশু-কিশোররা ক্রটিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে গড়ে ওঠে। সুতরাং বলা যায়, বাসস্থানের অভাব সামাজিক সমস্যা উদ্ভবে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।
৫. অপরাধ প্রবণতা : সমাজে বৈধ উপায়ে মানুষ যখন মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়, তখন অবৈধ বা অসামাজিক উপায়ে এগুলো পূরণের চেষ্টা করে। মৌল চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা হতে সমাজে অপরাধ প্রবণতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়। যেমন স্বাস্থ্যহীনতার ফলে মানুষ যখন কর্মক্ষমতা হরিয়ে ফেলে, তখন সে বাধ্য হয়ে অবৈধ উপায়ে (যেমন চুরি, ভিক্ষাবৃত্তি) মৌল চাহিদা পূরণের চেষ্টা করে। ফলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। খাদ্যাভাব, গৃহসমস্যা, নিরক্ষরতা, স্বাস্থ্যহীনতা, গঠনমূলক চিত্তবিনোদনের অভাবে বাংলাদেশে চুরি, ডাকতি, ছিনতাই, ঘুষ, দুর্নীতি, পতিতাবৃত্তি,

পৃষ্ঠা ১৪

ভিক্ষাবৃত্তি, যৌতুক প্রথা, নেশাগ্রস্ততা ইত্যাদি সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ডা. নাজমুল করিম বলেছেন, ‘‘চুরি, ডাকাতি, সম্পত্তি সংক্রান্ত অপরাধ ইত্যাদি বাংলাদেশে প্রধান খাদ্য চালের মূল্যের ওঠা-নামার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত।’’[1] বাংলাদেশের অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে ন্যূনতম মৌল চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের অভাবে সমাজে পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত বহুমুখী আর্থ-সামাজিক ও মানবিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এসব সমস্যাগুলো চক্রাকারে ক্রিয়াশীল থেকে সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশে মৌল চাহিদা পূরণের সমস্যা বা অন্তরায়

বাংলাদেশ পৃথিবীর জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০০৫ সালের তথ্যানুযায়ী দেশের শতকরা ৪০.৪ ভাগ লোক দারিদ্র রেখার নিচে এবং ১৯.৫ ভাগ লোকের জীবনযাত্রার মান চরম দারিদ্র সীমার নিচে। দারিদ্রের দৃষ্টচক্রের প্রভাব বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের প্রধান অন্তরায়। নিচে বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের অন্তরায় ও প্রতিবন্ধকতাগুলো আলোচনা করা হলো।
১. জনসংখ্যাস্ফীতি : বাংলাদেশে মৌল চাহিদা পূরণের প্রধান প্রতিবন্ধক হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি। সীমিত শিল্পায়নের ফলে যা কিছু বাড়তি উৎপাদন হচ্ছে, তা বর্ধিত জনসংখ্যা শেষ করে দিচ্ছে। ফলে জনগণের জীবনমান পূর্বের অবস্থায় রয়ে যাচ্ছে। ১৯৯১ সালে আদমশুমারির তথ্যানুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যা ১১.১৪ কোটি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক শতকরা হার ২.১৭ ভাগ। আর ২০০১ সালের লোকশুমারীর তথ্যানুযায়ী মোট জনসংখ্যা ১৩ কোটির মতো। ২০০৯-১০ সালে প্রক্ষেপিত জনসংখ্যা ১৪৬.১ মিলিয়ন। জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ১.৩২ জন। জনসংখ্যার ঘনত্ব ৯৯০ জন (প্রক্ষেপিত), যা ২০০১ সালের লোকশুমারীর তথ্যানুযায়ী ৮৩৯ জন ছিল। অপরিকল্পিত ও ত্রুটিপূর্ণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি মৌল চাহিদা পূরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবন ধারণের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না পাওয়ায় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বেকার সমস্যা মৌল চাহিদা পূরণে অন্তরায় সৃষ্টি করছে।
২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বাংলাদেশে মৌল চাহিদা পূরণের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে খরা, বন্যা, জলোচ্ছাস, অকাল বৃষ্টি, নদীর ভাঙ্গন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এটি বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের প্রধান ও স্থায়ী অন্তরায়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ধ্বংস এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। যা বাংলাদেশের সামগ্রিক মৌল মানবিক চাহিদা পূরণকে বিশেষভাবে ব্যাহত করছে।
বন্যায় খাদ্য শস্যের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ (২০০২ থেকে ২০০৭)

২০০২
২০০৩
২০০৪
২০০৭

জমির পরিমাণ
জমির পরিমাণ
জমির পরিমাণ
ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ
সর্বমোট
৩.৮৫ লাখ হেক্টর
২,৪৪৭৮৪
১৪,১১৯৫১
১৪৪৭৫৯১ হেক্টর
উৎসঃ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৫, পৃ-৭১ এবং ২০০৮, পৃ-৮৩।
সুতরাং বলা যায় ধারাবাহিক বন্যা, খরা, নদীর ভাঙ্গন, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের ফলে সম্পদের বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি বাংলাদেশের মৌল চাহিদা পূরণের প্রতিকূল অবস্থা বৃষ্টির জন্য একক ভাবে দায়ী।
৩. অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা : বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনের ওপর মৌল চাহিদা পূরণ বিশেষভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশের কৃষি মৌসুমী বায়ুর জুয়া খেলা-এ প্রবাদটি কৃষিতে প্রচলিত। বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি এদেশের কৃষি উৎপাদনকে অস্থিতিশীল করে রাখে। ভূমির খন্ড-বিখন্ডতা, অনুন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি, নতুন নতুন বাসস্থান ও অবকাঠামো নির্মাণের ফলে মাথাপিছু আবাদী ভূমির পরিমাণ হ্রাস, কৃষিঋণের অভাব, ত্রুটিপূর্ণ বাজারজাত ব্যবস্থা ইত্যাদি বহুমুখী সমস্যা বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। কৃষি উন্নয়ন ব্যাহত মানে, মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হওয়া।
৪. বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব : বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে পরিবেশের বিপর্যয় অব্যাহত রয়েছে। প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার প্রভাবে মৌল চাহিদা পূরণের উপকরণাদির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
৫. দারিদ্র : বাংলাদেশ দারিদ্রের দুষ্টচক্রের মধ্যে আটক রয়েছে। দারিদ্রের দুষ্টচক্র চক্রাকারে ক্রিয়াশীল থেকে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০০৫ এর তথ্যানুযায়ী ৫৬ মিলিয়ন অর্থাৎ দেশের শতকরা ৪০.৪ ভাগ (মাথাপিছু দৈনিক ২১২২ কিলো ক্যালরী
পৃষ্ঠা ১৫

গ্রহণকারী) লোকের জীবনযাত্রার মান দারিদ্র সীমার নিচে। গ্রামের শতকরা ৩৯.৫ ভাগ এবং শহরের শতকরা ৪৩.২ ভাগ দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করছে। অন্যদিকে ২৭ মিলিয়ন লোক (জনসংখ্যার ১৯.৫ ভাগ) দৈনিক ১৮০৫ কিলো ক্যালোরি খাদ্য শক্তি গ্রহণে ব্যর্থ হয়ে চরম দারিদ্রাবস্থায় জীবন যাপন করছে।
৬. রাজনৈতিক অস্থিরতা : যে কোন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন অন্যতম পূর্বশর্ত। সরকার স্থিতিশীল না হলে, উন্নয়ন পরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশৃংখলা ও দীর্ঘসময় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুপস্থিতিতে সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিবেশ মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গড়ে না ওঠায়, বাংলাদেশের মৌল চাহিদা পূরণে আদর্শভিত্তিক সুদূর প্রসারী রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা গ্রহণ অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে না।

৭. পরিকল্পিত শিল্পায়নের অভাব : বাংলাদেশের পুঁজি ও লাগসই প্রযুক্তির অভাব এবং বিদেশী সাহায্য ও প্রযুক্তি নির্ভর শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার গতি অত্যন্ত মন্থর। এছাড়া কৃষি নির্ভর শিল্পায়ন প্রক্রিয়া তেমন গড়ে ওঠেনি। শিল্পায়ন প্রক্রিয়া ও শিল্পব্যবস্থা বাংলাদেশের মৌল চাহিদা পূরণে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে সক্ষম হচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের ক্রমাগত লোকসান মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
৮. নির্ভরশীল জনসংখ্যা : বাংলাদেশের জনসংখ্যার ত্রুটিপূর্ণ গঠন কাঠামোর ফলে নির্ভরশীল জনসংখ্যার হার অধিক। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৬.৬ ভাগের বয়স ১০ বছরের নিচে এবং ৬৭.৩ ভাগের বয়স ১০-৫৯ বছরের মধ্যে এবং ৬.১ ভাগের বয়স ৬০ বছররের ওপর। সুতরাং মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩২.১ ভাগ স্বাভাবিক নির্ভরশীল। ২০০১ সালের আদমশুমারীর তথ্যানুযায়ী অর্থনৈতিক দিক হতে কর্মক্ষম ৩৪.২ মিলিয়ন শ্রমশক্তি কার্যে  নিয়োজিত, ১.৭ মিলিয়ন বেকার এবং ৫৮.৮ মিলিয়ন লোক অর্থিকভাবে সক্রিয় নয়। ৭.৬ মিলিয়ন অর্থনৈতিক দিক হতে নিস্ক্রিয় (ওহধপঃরাব)২০০৫ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুযায়ী ৪৯.৫ মিলিয়ন শ্রমশক্তির মধ্যে ২.১ মিলিয়ন বেকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০০৯ এর তথ্যানুযায়ী ১৫ বছরের ঊর্দ্ধে কর্মক্ষম ৫.৩৭ কোটি শ্রমশক্তির মধ্যে ০.২৭ কোটি বেকার। বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক বেকার ও অক্ষম নির্ভরশীল জনসংখ্যা, মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।
৯. বেকারত্ব : বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের অন্যতম প্রধান অন্তরায় বেকারত্ব। ২০০১ সালের লোকশুমারীর তথ্যানুযায়ী অর্থনৈতিক দিক হতে কর্মক্ষম ৩৪.২ মিলিয়ন শ্রমশক্তির মধ্যে ৩২.৫ মিলিয়ন কর্মে নিয়োজিত এবং ১.৭ মিলিয়ন বেকার। ২০০৫-০৬ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুযায়ী ৪৯.৫ মিলিয়ন শ্রমশক্তির মধ্যে ২.১ মিলিয়ন বেকার। বেকারত্বের হার ৪.২ এবং মহিলাদের শতকরা ৭.০ ভাগ বেকার। পরিসংখ্যান ব্যুরোর এমপ্লয়মেন্ট সার্ভে ২০০৯ এর তথ্যানুযায়ী ৫.৩৭ কোটি কর্মক্ষম শ্রমশক্তির মধ্যে ৫.১০ কোটি কর্মে নিয়োজিত এবং ০.২৭ কোটি বেকার। বাংলাদেশে নিম্ন মাথাপিছু আয়ের ফলে সঞ্চয় হচ্ছে না। ফলে বিনিয়োগ হ্রাস পেয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের কৃষি ও শিল্পে সরাসরি যেহেতু ভবিষ্যতে নিয়োগ বৃদ্ধির সুযোগ কম, সেহেতু বেকারত্ব ভবিষ্যত মৌল চাহিদা পূরণে অধিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করাই স্বাভাবিক।
১০.      জীবনযাত্রার ব্যয়ের দ্রুত পরিবর্তন : বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। কৃষিক্ষেত্রে ধারাবাহিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আমদানি দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি, জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত মুদ্রা অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়, ভোগ্যপণ্য আমদানি, টাকার অবমূল্যায়ন, ঋণ বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে বিপুল পরিমাণ অর্থ অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হয়। যার প্রভাবে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতির কারণে দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতি জনগণের মৌল চাহিদা পূরণে অন্তরায় সৃষ্টি করছে।
১১.      বিদেশী দায় পরিশোধের প্রভাব : বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিদেশী ঋণের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু বিদেশী ঋণের দায় বৃদ্ধি পেলেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রত্যাশা অনুযায়ী হচ্ছে না। প্রতি বছর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশী দায় পরিশোধে ব্যয় করতে হয়। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিদেশী দায় পরিশোধের (সুদ+আসল) পরিমাণ ছিল ৮৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। দায়ের স্থিতি ছিল ২১৮০৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৭-০৮ অর্থ বছরে দায় পরিশোধ ৭৭০ মিলিয়ন ডলার এবং দায়ের স্থিতি ছিল ২১২.৯৪ মিলিয়ন ডলার। যা মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের শতকরা ৩.৬ ভাগ। অথচ ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরের মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী ঋণের সুদ ও আসল দায় পরিশোধ করা হয় ১৮ মিলিয়ন ডলার, যা রপ্তানি আয়ের শতকরা ৪.৭ ভাগ মাত্র। বিদেশী সাহায্যের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা দেশের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রভাব বয়ে আনছে।
১২.      প্রাপ্ত সম্পদের অসম বন্টন : বাংলাদেশে মৌল চাহিদা পূরণের অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে প্রাপ্ত সম্পদের অসম বন্টন। বাংলাদেশে সম্পদের সীমাবদ্ধতা মৌল চাহিদা পূরণের অন্যতম প্রতিবন্ধক হলেও একমাত্র প্রতিবন্ধক নয়। সম্পদ বন্টনের দিকটি এক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ও ব্যয় নির্ধারণ জরিপ ২০০০ সালের তথ্যানুযায়ী জাতীয় পর্যায়ে সর্বনিম্ন শ্রেণীর ৫ শতাংশ পরিবারগুলোর আয় জাতীয় আয়ের ০.৯৩ শতাংশ, যা ২০০৫ সালে তা কমে ০.৭৭ শতাংশে দাঁড়ায়। আর উচ্চ পর্যায়ের শতকরা ৫ শতাংশ পরিবারের আয় ২০০০ সালে ছিল ২৮.৩৪ শতাংশ। ২০০৫ সালে দাঁড়ায় ২৬.৯৩ শতাংশে। এসব তথ্যাদি সমাজে বৈষম্য সৃষ্টির ইঙ্গিত বহন করছে।
পৃষ্ঠা ১৬
১৩.      সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অভাব : বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অভাব ও সীমাবদ্ধতার ফলে আকস্মিক দুর্যোগকালীন সময়ে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ ব্যাহত হয়। এছাড়া স্বাভাবিক অবস্থায় সমাজের নিম্ন, দুঃস্থ, অসহায় শ্রেণী সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে মৌল চাহিদা পূরণের যথাযথ মান অর্জনে সক্ষম হয় না।
১৪.      জনগণের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি : বাংলাদেশের জীবনবিমুখ দৃষ্টিভঙ্গি ও অদৃষ্টবাদিতা অর্থনৈতিক অবস্থাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করছে। জনগণ উন্নয়মূলক কার্যক্রমে স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত এবং সহজে পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে চায় না। যেমন- জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, কৃষি আধুনিকীকরণ ইত্যাদি উন্নয়নমূলক কার্যক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হবার কারণ প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধের নেতিবাচক প্রভাব, যা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণকে ব্যাহত করছে।
বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের উপায়
বাংলাদেশে বিরাজমান আর্থ-সামাজিক ও প্রাকৃতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের অন্তরায়সমূহ একক ও স্বল্পমেয়াদী কর্মসূচির মাধ্যমে দূর করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট বাস্তবমুখী সামাজিক নীতি ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। বাংলাদেশে বিরাজমান মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের অন্তরায় মোকাবেলার লক্ষ্যে কতগুলো সুপারিশ এখানে আলোচনা করা হলো।
১. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের প্রধান সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে জনসংখ্যাস্ফীতি। ২০০১ এর লোকশুমারীর তথ্যানুযায়ী মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ কোটি এবং বৃদ্ধির হার ১.৪৮ ভাগ। আর ২০০৯-১০ সালে প্রক্ষেপিত জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৬১ লাখ এবং বৃদ্ধির হার ১.৩২ আর জনসংখ্যার ঘনত্ব ৯৯০ জন।এ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে দু’হাজার বিশ সাল নাগাদ জনসংখ্যা ১৮ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। সুতরাং বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পিত পরিবার গঠনে নিয়োজিত সরকারি-বেসরকারি কার্যক্রমকে জোরদার করা প্রয়োজন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ছাড়া বাংলাদেশে মৌল চাহিদা পূরণের ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি সম্ভব নয়।
২. কৃষি উন্নয়ন : বাংলাদেশের সার্বিক মৌল চাহিদা পূরণের পর্যায় ও মান, কৃষি উৎপাদন হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে মৌল চাহিদা পূরণের প্রকৃতি পরিবর্তন সম্ভব। কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষিক্ষেত্রে বিরাজমান ভূমির খন্ড-বিখন্ডতা ও ভূমি-স্বত্ব প্রথার সংস্কার, ভূমিহীনদের মাঝে খাস জমি বন্টনের সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন এবং সেচ, বীজ ও সার বিতরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক। বাংলাদেশে শস্য নিবিড়তা এবং কৃষির উপ-সেক্টর মৎস্য, বনজ সম্পদ ও পশু সম্পদের যথাযথ উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মৌল চাহিদা পূরণের ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি সম্ভব। জাতীয় ভূমি ব্যবস্থার নীতি বাসত্মবায়নের প্রতি গুরুত্বারোপ।
৩. শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করা : বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশগুলোর মূল সমস্যা হচ্ছে, সীমিত শিল্পায়নের ফলে যে বাড়তি উৎপাদন হয়, তা বাড়তি জনসংখ্যা নিঃশেষ করে ফেলে। ফলে জনগণের জীবনমান আগের মতো রয়ে যায়। দ্রুত শিল্পায়নের মাধ্যমে এ সমস্যা মোকাবেলা সম্ভব। দেশী পুঁজি ও লাগসই প্রযুক্তি আমদানীর মাধ্যমে দ্রুত শিল্পায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে রপ্তানিমুখী শিল্পস্থাপন প্রচেষ্টা জোরদার করা প্রয়োজন।
৪. কুটির শিল্পের প্রসার : বাংলাদেশে কৃষিতে নিয়োজিত শ্রমিক বছরে গড়ে আনুমানিক ছ’মাস কাজ করে। জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী সমাজ বেকার। সুতরাং কর্মক্ষম শ্রমিক ও জনসংখ্যার বৃহৎ অংশকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থেকে দূরে রেখে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন আশা করা যায় না। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং গ্রামীণ নিম্নশ্রেণীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থানীয় কাঁচামাল-নির্ভর কুটির শিল্প স্থাপনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বাংলদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা এবং কর্মরত এনজিওসমূহ যৌথভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে। উল্লেখ্য বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের অন্যতম প্রধান খাত কুটির শিল্প। যেমন ডিসেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত বিসিক-এর আওতায় রেজিষ্ট্রীকৃত ৫৪২৬টি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ইউনিটে নিয়োজিত জনবলের সংখ্যা ২৫ লাখ এক হাজার ৩২০ জন। সুতরাং বলা যায় কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসার মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের সহায়ক।
৫. কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ : বাংলাদেশে প্রচলিত কর্মবিমুখ সাধারণ শিক্ষা বাস্তব সমস্যা সমাধানে তেমন ভূমিকা পালনে সক্ষম হচ্ছে না। স্বকর্ম লাভে প্রচলিত সাধারণ শিক্ষার গুরুত্ব তেমন নেই। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় চাহিদার ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। কারিগরি বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে মানব সম্পদের উন্নয়ন প্রয়োজন। বাস্তব কর্মমুখী শিক্ষার প্রচলন করে বাংলাদেশের জনগণের মৌল চাহিদা পূরণের পরিবেশ সৃষ্টি সম্ভব।
৬. নারী শিক্ষার প্রসার ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি : বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। ২০০১ সালের লোকশুমারীর রিপোর্ট অনুযায়ী দশ বছর এবং তার ওপরের বয়সের ৪৪.২ মিলিয়ন মহিলার মধ্যে ৪.১ মিলিয়ন মাত্র অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং ৪০.১ মিলিয়ন নিষ্ক্রিয়। ২০০৫-০৬ শ্রম শক্তি জরিপের তথ্যানুযায়ী ১২.১ মিলিয়ন বেসামরিক নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ০.৯ মিলিয়ন বেকার। ২৩.৮ মিলিয়ন গৃহকর্মে নিয়োজিত। আর ৫.৬



পৃষ্ঠা ১৭
মিলিয়ন নিষ্ক্রিয় (ছাত্রীসহ)।[2] মহিলাদের শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করে একদিকে যেমন নির্ভরশীল জনসংখ্যার হার হ্রাস করা সম্ভব, তেমনি মৌল চাহিদা পূরণে নারীদের ভূমিকাকে অর্থবহ করে তোলা যায়। 
৭. জনসংখ্যার পুনঃবন্টনের ব্যবস্থা গ্রহণ : সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে মোট খাস জমির বেশির ভাগ চরাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায়। সুতরাং জনবহুল এলাকা হতে জনবিরল পার্বত্য ও চর অঞ্চলে জনসংখ্যার পুনঃবন্টন এবং খাস জমি বিতরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে, মৌল চাহিদা পূরণে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই, বাংলাদেশ সরকার খাস জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণের অধ্যাদেশ জারি করেছেন। যার লক্ষ্য হচ্ছে দেশের সমস্ত অনাবাদী ভূমি ও জলাশয় উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার এবং ভূমিহীনদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি।
৮. প্রাপ্ত সম্পদ ও সুযোগের সুষম বন্টন : দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেই দেশের সর্বস্তরের জনগণের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ হয় না। এর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু বন্টন ব্যবস্থা। বাংলাদেশের ত্রুটিপূর্ণ বন্টন ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানী গিলীন সম্পদের অসম বন্টন এবং
মানুষের অসম উপার্জনের সুযোগ সুবিধাকে দরিদ্রতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং বাংলাদেশের মৌল চাহিদা পূরণের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা সম্পদের অসম বন্টনের পরিবর্তে, সুষম বন্টন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়ন আবশ্যক।
৯. সামাজিক নিরাপত্তা : বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুযোগ সীমিত এবং শহরকেন্দ্রিক। গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জন্য পরিকল্পিত ও প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নেই। মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের স্বার্থে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সুষ্ঠু নীতির ভিত্তিতে গড়ে তোলা, যাতে আকস্মিক দুর্যোগকালীন সময়ে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা বিধান করা যায়। শুধু কর্মসূচিভিত্তিক নিরাপত্তা বেষ্টনী  দিয়ে স্থায়ী ও ধারাবাহিকভাবে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মৌল চাহিদা পূরণ নিশ্চিত সম্ভব নয়।
১০.      জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন : গ্রামীণ পর্যায়ে কর্মরত পরিবার পরিকল্পনা ও পরিবারকল্যাণ কর্মসূচির অধীনে রোগ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনগণকে উৎসাহিত করা, যাতে দেশীয় উৎস হতে প্রয়োজনীয় পুষ্টিমান অর্জন এবং খাদ্যমান রক্ষা করে খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা যায়।
১১.      বাসস্থান নির্মাণে সাহায্য দান : বাংলাদেশে গৃহ সমস্যা প্রকট। দরিদ্রতার প্রভাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের সিংহভাগ অন্ন-বস্ত্রের জন্য ব্যয় করা হয়। গ্রামীণ পর্যায়ে কর্মরত বিভিন্ন দেশি-বিদেশী সংস্থার (এনজিও) সহায়তায় গৃহনির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ এবং সহজ ঋণদানের মাধ্যমে এ সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব। উল্লেখ্য গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, রেডক্রিসেন্ট সমিতি ইত্যাদি বেসরকারি সংস্থা ইউনিয়ন পর্যায়ে গৃহনির্মাণ কর্মসূচির আওতায় দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প গ্রহণ করেছে। উল্লেখ্য সারা দেশে ৪৬৪টি এনজিও ৪৩০টি উপজেলায় গৃহায়ন ঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
১২.      সমবায় কর্মসূচি উন্নয়ন : বাংলাদেশে উন্নয়নের শ্লোগান হচ্ছে ‘‘উন্নয়নে সমবায়ের বিকল্প নেই’’। সমবায়কে দরিদ্রদের নিজস্ব কর্মসূচি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ডিসেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত বাংলাদেশ সমবায় অধিদপ্তরে সমবায় সমিতির সংখ্যা ১,৬৭,৮৫৫টি এবং সদস্য সংখ্যা ৮৬ লাখ। কিন্তু প্রচলিত সমবায় কর্মসূচি দরিদ্রদের উন্নয়নে প্রত্যাশা অনুযায়ী ভূমিকা পালনে সক্ষম হচ্ছে না। প্রচলিত সমবায় কর্মসূচিকে অধিক গণমুখী করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যাতে উন্নয়ন কর্মসূচি হিসেবে জনগণ সমবায়কে গ্রহণ করতে পারে।
১৩.      দরিদ্রদের ক্ষমতায়ন : বাংলাদেশে দারিদ্রের অন্যতম কারণ হচ্ছে, সম্পদের ওপর দরিদ্রতর জনসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সক্ষমতার অভাব। বাংলাদেশের দরিদ্রতম শ্রেণীর প্রাপ্তিযোগ্য সম্পদের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়নে তাদের অধিক কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এছাড়া বিচ্ছিন্ন মানুষ ভার স্বরূপ এবং সংগঠিত জনতাই শক্তি। সুতরাং ছোট ছোট উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে দরিদ্র শ্রেণীর জনগোষ্ঠীকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি ও তাদেরকে সংগঠিত করে মৌল চাহিদা পূরণের ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়।
১৪.      সনাতন সাহায্য পদ্ধতির পরিকল্পিত বিনিয়োগ : বাংলাদেশের জনগণ প্রতিবছর স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে যাকাত, ফেতরা, দান ইত্যাদি খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিগতভাবে বিতরণ করে। বিচ্ছিন্ন ও অসংগঠিত দান স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করে, উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে, দুঃস্থ ও অসহায়দের মৌল চাহিদা পূরণে পরিবর্তন আনা সম্ভব।
১৫.      এনজিও এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর কার্যক্রম জোরদার : বাংলাদেশে দারিদ্র বিমোচন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকারি প্রচেষ্টার সম্পূরক হিসেবে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং এনজিও কর্মরত রয়েছে। দারিদ্র বিমোচন, শিক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ, নারী ও শিশুকল্যাণ ইত্যাদি খাতের উন্নয়নে এনজিওগুলো কাজ করে যাচ্ছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর নিবন্ধিত ৫৫,৯৪৫টি, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে নিবন্ধিত ১৫৩৯৮টি, নিবন্ধন অধিদপ্তরে ৯১৭০টি, এনজিও ব্যুরোর প্রায় আড়াই হাজার এনজিও এবং ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অধীনে ১৩৮০টি এনজিও সংস্থা কর্মরত রয়েছে। এসব সংস্থার মাধ্যমে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী সুনির্দিষ্ট গ্রুপভিত্তিক আয়বর্ধক কর্মকান্ড প্রসারিত করে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপেক্ষাকৃত সহজ।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে দারিদ্র হলো মৌল চাহিদা পূরণের প্রধান প্রতিবন্ধক। দারিদ্র বিমোচনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি সহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন আবশ্যক। দারিদ্র লাঘব ও টেকসই উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সঙ্গে মাথাপিছু আয় ও সঞ্চয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা ছাড়া মৌল চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়।


পৃষ্ঠা ১৮
মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে সমাজকর্মীর ভূমিকা
সমাজকর্ম একটি সাহায্যকারী পেশা। যার লক্ষ্য মানুষকে এমনভাবে পেশাগত সেবা প্রদান করা, যাতে তারা তাদের নিজস্ব সম্পদ ও ক্ষমতার সম্ভাব্য সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে সামগ্রিক চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়। বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে বিরাজমান প্রতিবন্ধকতাগুলো মোকাবেলায় সমাজকর্মীগণ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। বাং
অনুশীলনী
রচনামূলক প্রশ্ন
১. মৌল মানবিক চাহিদার সংজ্ঞা দাও। মৌল মানবিক চাহিদাগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
২. মৌল মানবিক চাহিদারগুলোর নাম লিখ। মানব জীবনে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের প্রয়োজনীয়তা বা তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।
৩. মৌল মানবিক চাহিদার সংজ্ঞা দাও। বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদাগুলো পরিপূরণের বর্তমান অবস্থা বর্ণনা কর।
৪. বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদাগুলো কী যথাযথভাবে পূরণ হচ্ছে? তোমার উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি দেখাও।
৫. বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা থেকে সৃষ্ট সমস্যাগুলো সংক্ষেপে আলোচনা কর।
৬. বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে অন্তরায়গুলো আলোচনা কর।
৭. বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে সমাজকর্মীর ভূমিকা ব্যাখ্যা কর।
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. মৌল মানবিক চাহিদা ধারণাটি ব্যাখ্যা কর।
২. মৌল মানবিক চাহিদাগুলোর ধরন উল্লে­খ কর।
৩. মৌল মানবিক চাহিদার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো কী?
৪. মৌল মানবিক চাহিদা হিসেবে খাদ্যের তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।
৫. মৌল মানবিক চাহিদা হিসেবে বস্ত্রের গুরুত্ব সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
৬. শিক্ষাকে কি মৌল মানবিক চাহিদা বলা যায়?
৭. মৌল মানবিক চাহিদা হিসেবে শিক্ষার গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর।
৮. ‘‘স্বাস্থ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌল চাহিদা’’ উক্তিটির যথার্থতা ব্যাখ্যা কর।
৯. শিক্ষা কিভাবে অন্যান্য মৌল চাহিদা থেকে ব্যতিক্রম?
১০.      মৌল চাহিদা হিসেবে চিত্ত বিনোদনের তাৎপর্য বর্ণনা কর।
১১.      সামাজিক নিরাপত্তা কোন অর্থে মৌল চাহিদা।
১২.      বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলো উল্লে­খ কর।





[1].    অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০০০।

View Foundation Digital Talking Library is developed and maintained by Sigma Enterprise.
Theme designed by Imtiaz
All rights are reserved. Any kind of reproduction of any mp3 files and text files is prohibited. If any organization or any person is found copying or reproducing any of the material will be punished under copy right law.