পৃষ্ঠা ১
প্রথম অধ্যায়
সমাজকল্যাণ ও সংশিষ্ট প্রত্যয়সমূহ
ক. সমাজকল্যাণের ধারণা, সংজ্ঞা, লক্ষ্য, গুরুত্ব ও পরিধি |
ভূমিকা
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বন্য জন্তুর আক্রমণ থেকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং বিভিন্ন চাহিদা পূরণের তাগিদে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে শিখেছে। সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের ফলে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মতো মানবিক অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে। কালক্রমে এসব মানবিক অনুভূতি সমাজ গঠনে যেমন মানুষকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে; তেমনি পরস্পরের বিপদে-আপদে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। সুতরাং আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত সমাজকল্যাণের ধারণা সাম্প্রতিককালের হলেও সমাজসেবার ধারণা মানব ইতিহাসের মতই প্রাচীন।
প্রাক-শিল্পযুগে মানবিকতাবোধ এবং ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ আর্তমানবতার সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করত। ধর্মীয় অনুশাসনই ছিল তখন সমাজসেবার মূল চালিকাশক্তি। দানশীলতা, সদকাহ্, যাকাত, ওয়াকফ, দেবোত্তর প্রথা ইত্যাদি প্রাকশিল্প যুগের সমাজসেবার দৃষ্টান্ত। সমাজসেবার এরূপ সনাতন ধারা দীর্ঘদিন ধরে সমাজে বিদ্যমান ছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দির শেষার্ধ থেকে শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সমাজ জীবনে সুদূরপ্রসারী বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। প্রাকশিল্প যুগের সহজ সরল সমাজ ব্যবস্থা জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রসারের ফলে দ্রুত শিল্পায়ন ও শহরায়ন প্রক্রিয়ার সূচনা হয়। ফলে সামাজিক সমস্যার গতি-প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে। প্রাক-শিল্প যুগের অর্থকেন্দ্রিক সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয় জটিল মানসিক ও সামাজিক সমস্যা। শিল্প-বিপ্লবোত্তর সমাজের জটিল ও বহুমুখী সমস্যা মোকাবেলায় প্রাকশিল্প যুগের ধর্মীয় অনুশাসন এবং মানবিকতা বোধের ভিত্তিতে পরিচালিত সনাতন সমাজসেবা কার্যক্রম অপর্যাপ্ত বলে প্রতীয়মান হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে মানবহিতৈষী সমাজ চিন্তাবিদগণ সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত সমাজসেবা কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। যার ফলস্বরূপ আধুনিক সমাজকল্যাণের বিকাশ ঘটে। আধুনিক সমাজকল্যাণ কতকগুলো বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে শিল্প সমাজের বহুমুখী জটিল সমস্যাবলী মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
সুতরাং বলা যায়, সদা পরিবর্তনশীল জীবনধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মানবকল্যাণের সনাতন কর্মধারা ও প্রথাগুলোকে যুগোপযোগী করে তোলার প্রচেষ্টা হতে আধুনিক সমাজকল্যাণের বিকাশ ঘটে।
সমাজকল্যাণের সংজ্ঞা
বিষয় হিসেবে আধুনিক সমাজকল্যাণ সামাজিক বিজ্ঞানগুলোর ফলিতরূপ হলেও ‘সমাজকল্যাণ’ প্রত্যয়টি সমাজের দুঃস্থ, অসহায় মানুষের মঙ্গল সাধনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সনাতন দৃষ্টিকোণ হতে সমাজকল্যাণ বলতে সমাজের দুঃস্থ, অসহায় ও অসুবিধাগ্রস্ত শ্রেণীর কল্যাণের লক্ষ্যে গৃহীত সব ধরনের প্রচেষ্টাকেই বুঝানো হয়। যেমন অন্নহীনে অন্নদান, আশ্রয়হীনকে আশ্রয়দান, আর্তের সেবা করা ইত্যাদিকে সমাজকল্যাণ নামে আখ্যায়িত করা হয়। আধুনিক দৃষ্টিতে যেসব কল্যাণকর ব্যবস্থা মানুষকে পরনির্ভরশীল করে এবং সমস্যার স্থায়ী সমাধানে অক্ষম, সেসব ব্যবস্থাকে সমাজকল্যাণ বলা হয় না। আধুনিক অর্থে “সমাজকল্যাণ বলতে কতকগুলো পদ্ধতিনির্ভর সুসংগঠিত প্রাতিষ্ঠানিক সেবা কার্যক্রমকে বুঝায়, যেগুলো মানুষকে তার পরিবেশের সার্বিক অবস্থার মোকাবেলা করতে সক্ষম করে তুলে” ।
পৃষ্ঠা ২
মানব কল্যাণের লক্ষ্যে বৈজ্ঞানিক ও পদ্ধতিগত উপায়ে কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের আওতায় মানুষকে নিজের প্রচেষ্টায় নিজের সমস্যা সমাধানের উপযোগী করে গড়ে তোলার পরিকল্পিত ব্যবস্থাই আধুনিক সমাজকল্যাণ
প্ত্যয় হিসেবে সমাজকল্যাণকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। সমাজকল্যাণের সঙ্গে মানুষের আত্মিক অর্থাৎ মানসিক কল্যাণের অনুভূতি সম্পৃক্ত। মনীষী জেমস মিজ্ল, মন্তব্য করেছেন ‘‘সমাজকল্যাণ প্রত্যয়টির আত্মিক এবং বস্তুনিষ্ঠ দিক রয়েছে। সুতরাং সমাজকল্যাণ প্রত্যয়টিকে হয় বর্ণাত্মক, গুণাত্মক অথবা বাস্তব পরিমাপ ও মূল্যায়নের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করতে হবে’’।
সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে সমাজকল্যাণকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে সমাজকল্যাণের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা দেয়া হলো
সমাজকর্ম অভিধানের সোস্যাল ওয়ার্ড অভিধানের সংজ্ঞানুযায়ী ‘‘সমাজকল্যাণ হলো কোন দেশের সেসব সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যগত চাহিদা পূরণে মানুষকে সাহায্য করার কর্মসূচি, সুযোগ সুবিধা ও সেবা প্রদানের সুসংগঠিত ব্যবস্থা, যেগুলো সামাজিক ব্যবস্থাপনা এবং সামাজিক শৃংখলা সংরক্ষণের জন্য অপরিহার্য।’’
আলোচ্য সংজ্ঞায় সমাজকল্যাণকে পরস্পর নির্ভরশীল এবং সম্পর্কযুক্ত মানবকল্যাণের বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত ব্যবস্থা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সমাজকল্যাণ অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক চাহিদা পূরণে গৃহীত বিভিন্ন সুযোগসুবিধা, কর্মসূচি ও সেবার সমন্বয়ে গঠিত কোন দেশ বা জাতির একটি ব্যবস্থা সমাজের যা সমাজের শৃংখলা ও কল্যাণের জন্য অপরিহার্য আর্থিক, সামাজিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যগত চাহিদা পূরণে মানুষকে সাহায্য করে। সমাজকল্যাণ হলো একটি দেশের বা জাতির সামাজিক শৃংঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনার জন্য অপরিহার্য চাহিদাগুলো পূরণের লক্ষ্যে গৃহীত কার্যাবলীর সুসংগঠিত ব্যবস্থা।
সমাজকর্ম অভিধানের অন্য একটি সংক্ষিপ্ত অথচ ব্যাপক অর্থবোধক সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “সমাজকল্যাণ হলো কোন জনসমষ্টির বা সমাজের যৌথ কল্যাণকর অবস্থা”।
সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখ্যা হতে স্পষ্ট হয়ে উঠে, সমাজকল্যাণ বিচ্ছিন্ন বা স্বতন্ত্র একক কার্যক্রম নয়। সমাজকল্যাণ হলো সমষ্টিগত কল্যাণের একটা সামগ্রিক ব্যবস্থা। যেসব সামাজিক, আর্থিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট চাহিদা পূরণের সুযোগ সুবিধা সৃষ্টিতে সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা নিয়োজিত, সেগুলো পূরণ ব্যক্তিগত ও সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য অপরিহার্য।
সমাজকল্যাণের সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞায় সমাজবিজ্ঞানী জাট্রুড উইলসন বলেছেন, “সমাজকল্যাণ হলো সকল মানুষের কল্যাণে সকল মানুষের সংগঠিত প্রচেষ্টা” । সংজ্ঞাটিতে সমাজকল্যাণের দুটি বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সমাজকল্যাণের সংগঠিতরূপ এবং সকল মানুষের কল্যাণ এ দুটি দিক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ সংজ্ঞাতে সমাজকল্যাণের ব্যাপক পরিধির পরিচয় পাওয়া গেলেও সমাজকল্যাণের পেশাগত পরিচয় পাওয়া কঠিন। আলোচ্য সংজ্ঞায় সমাজকল্যাণকে সংগঠিত সাধারণ কর্মসূচি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আধুনিক সমাজকল্যাণের পেশাগত দিকটি আলোচ্য সংজ্ঞায় অনুপস্থিত।
সমাজকর্ম বিশ্বকোষ এর সংজ্ঞানুযায়ী, “সমাজকল্যাণ বলতে সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সংঘটিত সে সব কার্যাবলির সমষ্টিকে বুঝায়, যেগুলো স্বীকৃত সামাজিক সমস্যাদির সমাধান, প্রতিরোধ বা লাঘবে অথবা ব্যক্তি, দল বা সমষ্টির কল্যাণের উন্নতি সাধনে নিয়োজিত” ।
সমাজকর্ম বিশ্বকোষের উপর্যুক্ত সংজ্ঞায় আধুনিক সমাজকল্যাণের কতগুলো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমত, আধুনিক সমাজকল্যাণের মূল দর্শন হলো, “সরকার ও জনগণের যৌথ প্রচেষ্টায় সমাজের সার্বিক কল্যাণ বিধান সম্ভব”আলোচ্য সংজ্ঞায় আধুনিক সমাজকল্যাণের এ দার্শনিক দিকটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সমাজের সার্বিক কল্যাণে সরকারি-বেসরকারি উভয় ধরনের কার্যাবলির প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমানে সারাবিশ্বে সমাজকল্যাণ ব্যবস্থায় সরকারি-বেসরকারি এ দু’টি ধারা প্রচলিত রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আলোচ্য সংজ্ঞায় আধুনিক সমাজকল্যাণের প্রাতিষ্ঠানিক ও সংগঠিত রূপ তুলে ধরা হয়েছে। যা আধুনিক সমাজকল্যাণের পেশাগত বৈশিষ্ট্য ও পৃথক সত্তার ইঙ্গিত বহন করছে। তৃতীয়ত, এতে আধুনিক সমাজকল্যাণের প্রতিকার, প্রতিরোধ ও উন্নয়নমূলক । এ ত্রিমুখী ভূমিকার সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। চতুর্থত, আলোচ্য সংজ্ঞাটিতে ব্যক্তি, দল ও জনসমষ্টির কল্যাণ ও উন্নয়নের কথা উল্লেখ থাকায়
পৃষ্ঠা ৩
আধুনিক সমাজকল্যাণের পদ্ধতিগত দিক পরোক্ষভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সুতরাং আধুনিক সমাজকল্যাণের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতিগত দিক সমাজকর্ম বিশ্বকোষ প্রদত্ত সংজ্ঞায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তবে আধুনিক সমাজকল্যাণ যে মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের
প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে, সেদিকটি এ সংজ্ঞায় উল্লেখ করা হয়নি। তবুও সংজ্ঞাটি আধুনিক সমাজকল্যাণের সম্যক ধারণা দিতে সক্ষম।
সমাজকল্যাণের বহুল প্রচলিত সংজ্ঞা প্রদান করেছেন ডব্লিউ.এ. ফ্রিডল্যান্ডার। তাঁর মতে, “সমাজকল্যাণ হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সমাজসেবা প্রদানের এমন এক সুসংগঠিত কর্মপদ্ধতি, যার উদ্দেশ্য ব্যক্তি ও দলকে সন্তোষজনক জীবন ও স্বাস্থ্যমান অর্জনে সহায়তা করা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্ক উন্নত করে তাদের অন্তর্নিহিত সত্তার পূর্ণ বিকাশ সাধন এবং পরিবার ও সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তাদের কল্যাণের পথকে উন্নততর করা” ।
১৯৬৩ সালের দিকে প্রদত্ত মনীষী ফ্রিড্ল্যান্ডারের উল্লিখিত সংজ্ঞায় সমাজকল্যাণের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যগুলো প্রত্যক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত সমাজকর্ম অভিধানের সংজ্ঞায় ফ্রিডল্যান্ডারের সংজ্ঞার প্রতিফলন ঘটেছে। উভয় সংজ্ঞাতে সমাজকল্যাণকে ব্যবস্থা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আলোচ্য সংজ্ঞায় প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো হলো :
১. সামাজিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সুসংগঠিত কর্মব্যবস্থা হিসেবে সমাজকল্যাণকে সংজ্ঞায়িত করায় সমাজকল্যাণের বিজ্ঞানসম্মত ও সুপরিকল্পিত সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়াটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
২. উন্নত জীবন, স্বাস্থ্য, ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্ক ইত্যাদি উল্লেখ করায়, সমাজকল্যাণের বৃহত্তর পরিধি ও সামগ্রিক কল্যাণের দিকটি আলোচ্য সংজ্ঞায় তুলে ধরা হয়েছে।
৩. সমাজকল্যাণ মানুষের সুপ্ত প্রতিভা ও অন্তর্নিহিত সত্তার পূর্ণ বিকাশের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ফ্রিড্ল্যান্ডারের সংজ্ঞায় মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার পূর্ণ বিকাশের সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, যা আধুনিক সমাজকল্যাণের নীতি ও মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সমাজকল্যাণ যে একটি সক্ষমকারী প্রক্রিয়া তার প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত এতে পাওয়া যায়।
৪. সমাজকল্যাণকে সামাজিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সমাজসেবা প্রদানের সুসংগঠিত কর্মপদ্ধতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করায় সমাজকল্যাণের প্রাতিষ্ঠানিক এবং পেশাগত বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মানব কল্যাণের প্রকৃত লক্ষ্যে বৈজ্ঞানিক ও পদ্ধতিগত উপায়ে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের আওতায় মানুষকে নিজের প্রচেষ্টায় নিজের সমস্যা সমাধানের উপযোগী করে তোলার ব্যবস্থা যে সমাজকল্যাণ,এ ধারণাটি ফ্রিডল্যান্ডের সংজ্ঞার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
৫. সমাজকল্যাণ বলতে ব্যক্তিগত বা বিচ্ছিন্ন কোন অবস্থাকে বুঝায় না, বরং সামাজিক ও দলীয় কল্যাণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যক্তিগত কল্যাণের সমন্বিত রূপ হলো সমাজকল্যাণ।
পরিশেষে বিভিন্ন সংজ্ঞার আলোকে বলা যায়, “সমাজকল্যাণ হলো কতগুলো সুসংগঠিত সমাজসেবা কার্যক্রমের সমন্বয়ে গঠিত একটা সামগ্রিক ব্যবস্থা যা ব্যক্তি, দল ও জনসমষ্টিকে এমনভাবে সাহায্য করে যাতে তারা তাদের আওতাধীন সম্পদের বিকল্প ব্যবহার এবং অন্তর্নিহিত সত্তার পূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে পরির্তনশীল পরিবেশের সার্বিক অবস্থা কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়”। ব্যক্তিগত, দলীয় এবং সমষ্টিগত পর্যায়ে আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং মানসিক সমস্যা পরিকল্পিত ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সুখী ও সমৃদ্ধশালী সমাজ গঠনে মানুষকে সহায়তা করা সমাজকল্যাণের লক্ষ্য।
সমাজকল্যাণের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য
সমাজকল্যাণ সকল মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ আনয়নে প্রয়াসী। সমাজের কোন বিশেষ দিকের বা বিশেষ শ্রেণীর সমস্যা নিয়ে সমাজকল্যাণের লক্ষ্য ব্যাপৃত নয়। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের ব্যক্তিগত, দলীয় ও সমষ্টিগত সমস্যার সমাধান করে সমস্যামুক্ত, সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে সমাজকল্যাণ বিশ্বাসী।
সমাজকাঠামো এবং সামাজিক অবস্থার বিভিন্নতার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণের লক্ষ্যসমূহ বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী হয়ে থাকে। আধুনিক সমাজকল্যাণের বহুমুখী ও সুদুরপ্রসারী লক্ষ্যসমূহ বর্ণনা প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন।
পৃষ্ঠা ৪
ওয়াল্টার এ. ফ্রিডল্যান্ডার বলেছেন, ‘সমাজকল্যাণের লক্ষ্য হলো সমাজের প্রতিটি মানুষের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ, সুস্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার উন্নতমান অর্জন, সকল নাগরিকের সমান অধিকার, সম্ভাব্য সর্বোচ্চ আত্মমর্যাদা এবং অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ না করে চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা’ ।
সমাজবিজ্ঞানী ওয়েন ভেসী তাঁর “গভর্মেন্ট এন্ড সোস্যাল ওয়েলফেয়ার” গ্রন্থে ফ্রিড্ল্যান্ডারের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে সমাজকল্যাণের দুটি মৌলিক লক্ষ্য চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, সমাজের মৌলিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারের সামগ্রিক কল্যাণ আনয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তির সুপ্ত ক্ষমতা বিকাশের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ যাতে সে তার জীবনের সার্বিক অবস্থা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়।
আধুনিক সমাজকল্যাণের বিভিন্ন সংজ্ঞা এবং মনীষীদের মতামতের আলোকে সমাজকল্যাণের লক্ষ্যগুলো নিচে আলোচনা করা হলো:
১. সকল মানুষের কল্যাণ : আধুনিক সমাজকল্যাণের লক্ষ্য হলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের ব্যক্তিগত, দলীয় ও সমষ্টিগত সমস্যা সমাধানে সহায়তা করা। সুসংগঠিত পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের আর্থ-সামাজিক ও মনোঃদৈহিক সমস্যা এবং পারিবারিক সামঞ্জস্যহীনতা দূরীকরণে সহায়তা করা সমাজকল্যাণের অন্যতম লক্ষ্য। সমাজবিজ্ঞানী চার্লস জাস্ট্র সমাজকল্যাণের লক্ষ্য প্রসঙ্গে বলেছেন, “সমাজকল্যাণের লক্ষ্য সমাজের সকল মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য এবং চিত্তবিনোদনের চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণ করা” ।
২. সামগ্রিক কল্যাণ : অতীতের মতো বর্তমানে সমাজকল্যাণ শুধু দুঃস্থ, অসহায় ও দরিদ্রদের আর্থিক সাহায্য দানের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসী নয়। সামাজিক প্রতিষ্ঠানের আওতায় সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে সার্বিক সমস্যা সমাধানে মানুষকে সহায়তা করা সমাজকল্যাণের প্রধান লক্ষ্য। সমাজকল্যাণ সমাজের কোন দিককে উপেক্ষা না করে সবদিকের ভারসাম্যপূর্ণ কল্যাণ আনয়নে প্রয়াসী। মানুষের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানসিক, দৈহিক ইত্যাদি সকল দিকের সুষম কল্যাণের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো সমাজকল্যাণের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখ্যায় সামাজিক, আর্থিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে পরিচালিত কর্মসূচির সুসংগঠিত ব্যবস্থা হিসেবে সমাজকল্যাণকে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সমাজকল্যাণের সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করার দিকটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
৩. সামাজিক ভূমিকা পালনে সহায়তা দান : সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্দিষ্ট পরিচিতি ও মর্যাদা অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষকে বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয় যেগুলো তার সামাজিক ভূমিকা হিসেবে পরিচিত। পরিবর্তনশীল আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সামাজিক ভূমিকা পালনের ব্যর্থতার কারণে মানুষ সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে মনীষী রোনাল্ড সি. ফেডারিকো তাঁর সোস্যাল ওয়েলফার ইন টুডেস ওয়ার্ল্ড গ্রন্থে বলেছেন, সমাজকল্যাণের লক্ষ্য হলো সামাজিক পরিবেশে কার্যকর ভূমিকা পালনে মানুষকে সাহায্য করা। সামাজিক মর্যাদা ও পরিচিতি অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষ যাতে সুষ্ঠুভাবে সামাজিক ভূমিকা পালন করতে পারে, সেজন্য সাহায্য করে সমাজকল্যাণ। সামাজিক ভূমিকা পালনের প্রতিবন্ধকতা দূর করে মানুষের সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতা পুনরুদ্ধার, উন্নয়ন, শক্তিশালীকরণ এবং সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ আধুনিক সমাজকল্যাণের লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত।
৪. মানব সম্পদ উন্নয়ন : সমাজকল্যাণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো মানব সম্পদের উন্নয়ন। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, সচেতনতা সৃষ্টি এবং উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের সুপ্ত ক্ষমতা এবং অন্তর্নিহিত সত্তার বিকাশ সাধনে সমাজকল্যাণ সদা সচেষ্ট। সমাজকল্যাণের লক্ষ্য হলো মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করা। আধুনিক সমাজকল্যাণে বিশ্বাস করা হয় যে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে কোন না
পৃষ্ঠা ৫
কোন ধরনের সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে, যা বিকাশের ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতার উন্নয়ন সম্ভব। সুপ্ত প্রতিভা ও অন্তর্নিহিত সত্তার পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং মানুষকে সমস্যার কার্যকর মোকাবেলার সামর্থ্য অর্জনে সহায়তা করা সমাজকল্যাণের বহুমুখী লক্ষ্যগুলোর অন্তর্ভুক্ত।
৫. পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে সহায়তা করা : সমাজ সদা পরিবর্তনশীল একটি জীবন্ত সত্তা। পরিবর্তিত সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে মানুষ যখন সামঞ্জস্য বিধানে ব্যর্থ হয়, তখন সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানী ওগবার্ন বলেছেন, “নিয়ত পরিবর্তনশীল মানব সংস্কৃতি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মানুষের আদিম প্রকৃতির সামঞ্জস্য বিধান না হবার ফলেই সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়”, পরিবর্তনশীল সামাজিক পরিবেশের সার্বিক অবস্থার সঙ্গে কার্যকর সামঞ্জস্য বিধানে মানুষকে সহায়তা করে সমাজকল্যাণ।
৬. পরিকল্পিত পরিবর্তন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলা : সামাজিক পরিবর্তন পরিকল্পিত এবং অপরিকল্পিত এ দুই ধরনের হয়। অপরিকল্পিত পরিবর্তন সমাজের জন্য মঙ্গলজনক না-ও হতে পারে। আধুনিক সমাজকল্যাণের লক্ষ্য হলো পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাজে বাঞ্ছিত পরিবর্তন আনয়নে মানুষকে সচেতন করে তোলা যাতে পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে মানুষ সহজে সামঞ্জস্য বিধানে সক্ষম হয়। সমাজকল্যাণের লক্ষ্য হলো সমাজ বহির্ভূত কারণে সৃষ্ট অবাঞ্ছিত পরিবর্তন প্রতিরোধ এবং অবাঞ্ছিত পরিবর্তনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মানুষকে সচেতন করে তোলা।
৭. পারস্পরিক ও সামাজিক সম্পর্কের উন্নয়ন : মানুষের সামাজিক সম্পর্কের সমন্বিত রূপ হলো সমাজ। আধুনিক বিশ্বের দ্রুত শিল্পায়ন ও শহরায়ণের প্রভাবে বহুমুখী আর্থ-সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব সমস্যার চাপে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মনোভাব ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে এবং যার প্রভাবে সামাজিক শৃংখলা, ঐক্য ও সংহতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এজন্য আধুনিক সমাজকল্যাণ মানুষের পারস্পরিক ও সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
৮. সামাজিক সাম্য ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা : সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের অপরিহার্য পূর্বশর্ত হলো সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। সমাজকল্যাণ মানুষের সমমর্যাদা দান, দরিদ্র-অসহায় শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ এবং সম্পদ ও প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার সুষম বন্টনের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের প্রচেষ্টা চালায় যাতে সমাজে সব ধরনের শোষণ ও বঞ্চনা অবসানের ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
৯. বিশেষ জনগোষ্ঠীর কল্যাণ : সমাজে বসবাসরত প্রবীণ, শিশু, প্রতিবন্ধী, অভিবাসী, সংখ্যালঘু ইত্যাদি শ্রেণীর জনগোষ্ঠীকে বিশেষ জনগোষ্ঠী বলা হয়। কারণ এসব জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও প্রয়োজন সাধারণ মানুষ থেকে পৃথক এবং স্বতন্ত্র। সমাজকল্যাণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো সমাজের বিশেষ শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে প্রয়োজনীয় সাহায্য করা, যাতে তারা আত্মনির্ভরশীল সদস্য হিসেবে সম্মানজনক জীবন যাপনের সুযোগ লাভ করে। সমাজের শিশু, প্রবীণ, প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসিত করে স্বাভাবিক জীবন যাপনের সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমাজকল্যাণ বিশেষ বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণে সহায়তা করে থাকে।
১০. সম্পদ সরবরাহকরণ : সমস্যাগ্রস্ত সাহায্যার্থীদের উপদেশ ও নির্দেশনা দানের মধ্যে সমাজকল্যাণের লক্ষ্য সীমাবদ্ধ নয়। সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় সম্পদের ব্যবস্থা করাও সমাজকল্যাণের অন্যতম লক্ষ্য। সমাজকল্যাণ সমস্যা সমাধানের জন্য মানুষকে তার সামর্থ্য ও সম্পদ সম্পর্কে সচেতন করে তুলে। সমস্যা সমাধানে ব্যক্তি, দল ও জনসমষ্টির নিজস্ব সম্পদ অপ্রতুল প্রতীয়মান হলে সমাজের বিভিন্ন উৎস হতে প্রয়োজনীয় সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে
পৃষ্ঠা ৬
প্রচেষ্টা চালায়। আমেরিকার মনীষী সি. ম্যারে মন্তব্য করেছেন, সমাজের মূল্যবান সম্পদ যেমন অর্থ, কর্মসংস্থান, গৃহায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সমাজসেবার মতো মূল্যবান সম্পদ বন্টনের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা হলো সমাজকল্যাণ।
১১. সমাজসংস্কারের পরিবেশ সৃষ্টি করা : সমাজ উন্নয়ন ও কল্যাণের পরিপন্থী ক্ষতিকর সামাজিক রীতি-নীতি, প্রথা-প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন ও সংশোধনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ সমাজকল্যাণের বৃহত্তর লক্ষ্যের পরিধিভুক্ত। আধুনিক সমাজকল্যাণ পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারা গ্রহণে মানুষকে সাহায্য করে। কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, অদৃষ্টবাদিতা ইত্যাদি দূর করে প্রগতিশীল তথা বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সাহায্য করে। ক্ষতিকর প্রথা-প্রতিষ্ঠানের প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে এগুলো দূরীকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে মানুষকে সাহায্য করে সমাজকল্যাণ।
১২. গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সমুন্নত রাখা : আধুনিক সমাজকল্যাণের সার্বিক কার্যক্রম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে পরিচালিত। এতে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করা হয়। সমাজকল্যাণের লক্ষ্য হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণে মানুষের পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দান যাতে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সকলে নিজেদের জ্ঞান, ক্ষমতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী অংশগ্রহণ করতে পারে। এভাবে আধুনিক সমাজকল্যাণ সমাজের সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রয়োগের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সমুন্নত রাখার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সচেষ্ট।
১৩. মানুষকে অধিকার ও দায়িত্ব সচেতন করা : মানুষের অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। সমাজে একজনের যা অধিকার, অন্যজনের তা কর্তব্য। সুষ্ঠুভাবে কর্তব্য পালনের মাধ্যমেই অধিকার ভোগ করা যায়। কর্তব্যবিহীন অধিকার স্বেচ্ছাচারে পরিণত হয়। সমাজকল্যাণের উদ্দেশ্য হলো মানুষকে তার অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলা, যাতে প্রত্যেক মানুষ অন্যের অধিকার খর্ব না করে নিজ নিজ অধিকার ভোগ করার সুযোগ পায়।
১৪. মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ : মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা সামাজিক সমস্যার প্রধান উৎস। স্বাস্থ্যহীনতা, পুষ্টিহীনতা, অপরাধপ্রবণতা, দারিদ্র, নিরক্ষরতা, অজ্ঞতা ইত্যাদি বহুমুখী সমস্যার প্রধান কারণ হলো মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের অক্ষমতা। আধুনিক সমাজকল্যাণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো প্রত্যেক মানুষের সার্বিক মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের প্রয়োজনীয় সুযোগ সৃষ্টি করা। কারণ মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা বিধান ছাড়া সমাজের সার্বিক কল্যাণ আনয়ন সম্ভব নয়।
১৫. দরিদ্র ও দুঃস্থ শ্রেণীর ক্ষমতায়ন : আধুনিক সমাজকল্যাণের অন্যতম লক্ষ্য হলো সমাজের দরিদ্র ও দুঃস্থ শ্রেণীর ক্ষমতায়নে সাহায্য করা, যাতে তারা নিজেদের উন্নয়নে গৃহীত কার্যাবলীকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করতে পারে। অর্থাৎ দরিদ্র ও নিম্নশ্রেণীর ক্ষমতাহীনদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করে সমাজকল্যাণ। সমাজকল্যাণ উৎপাদনমুখী সমাজের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণদানের মাধ্যমে তাদের কারিগরি দক্ষতা, ব্যবস্থাপনা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, যাতে সমাজের অসুবিধাগ্রস্ত শ্রেণী নিজেরা তাদের কল্যাণে গৃহীত উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হয়।
পরিশেষে বলা যায়, সুসংগঠিত কার্যক্রম ও সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণের সুসংগঠিত ব্যবস্থা হিসেবে সমাজকল্যাণের লক্ষ্যগুলো পরিবর্তনশীল। সমাজ ব্যবস্থার বিভিন্নতার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারিত হয়। সুসংগঠিত ও সুপরিকল্পিত উপায় মানুষের সমস্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির জন্য সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে সহায়তা করা আধুনিক সমাজকল্যাণের মূল লক্ষ্য।
পৃষ্ঠা ৭
বাংলাদেশে সমাজকল্যাণের লক্ষ্য
যে কোন সমাজের বিশেষ চাহিদা, সমস্যা, সম্পদ এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারিত হয়। এজন্য অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সমাজকল্যাণের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যের সঙ্গে উন্নত দেশের সমাজকল্যাণের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে দরিদ্র ও অবহেলিত পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা দান সমাজকল্যাণের প্রধান লক্ষ্য। বাংলাদেশে গৃহীত তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক (১৯৯৭-২০০২) পরিকল্পনার আলোকে সমাজকল্যাণের লক্ষ্যসমূহ নিচে উলেখ করা হলোঃ
১. উপার্জনমুখী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি : দরিদ্র ও দুঃস্থ শ্রেণীর নারী পুরুষের জন্য উপার্জনমুখী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং তাদের উৎপাদন ও উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা বিধান সমাজকল্যাণের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য, যাতে লক্ষ্যভুক্ত দলের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পায়। দারিদ্র বিমোচন ও মানব সম্পদ উন্নয়নই এ কর্মসূচির লক্ষ্য।
২. এতিম ও অসহায় শিশুদের কল্যাণ : সরকারি শিশু সদনকে শিশু পরিবারে রূপান্তর করে প্রাতিষ্ঠানিক ও পরিবারকেন্দ্রিক কর্মসূচির মাধ্যমে এতিম, দুঃস্থ এবং আশ্রয়হীন শিশুদের সমাজে স্বনির্ভর ও সম্পদশালী নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা, যাতে সংশ্লিষ্ট শিশুরা পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে উঠার সুযোগ লাভ করে। প্রাতিষ্ঠানিক সেবার মাধ্যমে এসব শিশুদের পুনর্বাসনের সুযোগ সৃষ্টি করা।
৩. অপরাধ সংশোধন : প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে কিশোর অপরাধী, বয়স্ক অপরাধী এবং মাদকাসক্তদের সংশোধন, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা; সমষ্টি সংগঠন এবং বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদীদের পরামর্শ, নির্দেশনা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা; অক্ষম কিশোর অপরাধী এবং মাদকাসক্তদের জন্য চিকিৎসা, সেবাযত্ন ও পুনর্বাসনের সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কমিউনিটি ভিত্তিক প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম গঠন।
৪. প্রতিবন্ধীদের কল্যাণ : সমন্বিত শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানসিক প্রতিবন্ধী, মুক-বধির এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের সমাজের সম্পদশালী স্বনির্ভর নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।
৫. শহর জনসমষ্টি উন্নয়ন : প্রাতিষ্ঠানিক এবং সমষ্টিকেন্দ্রিক কার্যক্রমের মাধ্যমে শহরের স্বল্প আয়ের লোকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা।
৬. গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন : সমষ্টিকেন্দ্রিক কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষক, বেকার যুবক, দুঃস্থ মহিলা ইত্যাদি পশ্চাৎপদ শ্রেণীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন সাধন।
৭. সম্পদশালীদের জনসেবায় উদ্বুদ্ধ করা : সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে সমাজের এতিম, ভিক্ষুক ও অক্ষমদের দায়িত্ব গ্রহণে সম্পদশালী জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করা।
৮. রোগী কল্যাণ : দরিদ্র-অসহায় যেসব রোগী দেশে চিকিৎসার প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত তাদের যথাযথ চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
৯. দরিদ্রদের ব্যবস্থাপনা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা বৃদ্ধি : সংশ্লিষ্ট গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচিতে দরিদ্রদের অংশগ্রহণ এবং দল গঠনের মাধ্যমে দরিদ্র মহিলা ও পুরুষ দলগুলোর ব্যবস্থাপনা এবং সাংগঠনিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
১০. স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন : সরকারি অনুদান প্রদানের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম জোরদার করা, যাতে এগুলো সমাজকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
পৃষ্ঠা ৮
১১. পতিতাবৃত্তি প্রতিরোধ : দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ এবং স্ব-কর্মসংস্থানের মাধ্যমে পুনর্বাসনের সুযোগ সৃষ্টি করে পতিতাবৃত্তি প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণ।
১২. মহিলা-প্রধান দরিদ্র পরিবারের উন্নয়ন : বিধবা, তালাকপ্রাপ্তা ও পরিত্যাক্তা ইত্যাদি শ্রেণীর নারীপ্রধান দুঃস্থ পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ।
১৩. সামাজিক নিরাপত্তা : বৃদ্ধ, আশ্রয়হীন, বেকার, অক্ষম, বিধবা, নির্যাতিতা ইত্যাদি কারণে দুর্দশাগ্রস্তদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ।
১৪. নারী পুরুষের বৈষম্য হ্রাস : দরিদ্র মহিলাদের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং সকল উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণে উৎসাহিতকরণ, যাতে নারী পুরুষের বৈষম্য হ্রাস পায়।
১৫. অংশীদারিত্বমূলক উন্নয়ন : জনগণের অংশগ্রহণ, স্থানীয় সম্পদের সুষ্ঠূ, সর্বাধিক ও সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণ, বিশেষ করে দরিদ্রদের আর্থ-সামাজিক ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন।
পরিশেষে বলা যায়, জনসমষ্টি উন্নয়নভিত্তিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমাজসেবা কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজের অনগ্রসর ও অসুবিধাগ্রস্ত শ্রেণীর সার্বিক কল্যাণ এবং উন্নয়ন সাধন বাংলাদেশে সমাজকল্যাণের মূল লক্ষ্য। পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণের সুযোগ সৃষ্টি এবং তাদেরকে সমাজের উৎপাদনশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা বাংলাদেশে সমাজকল্যাণের চরম লক্ষ্য।
সমাজকল্যাণের বৈশিষ্ট্য
সমাজকল্যাণ সমস্যা মোকাবেলায় বৈজ্ঞানিক ও সুসংগঠিত ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত। সমস্যা সমাধানের পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত ব্যবস্থা হিসেবে সমাজকল্যাণের এমন কতগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলো সনাতন সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা হতে একে পৃথক সত্তা দান করেছে। বিভিন্ন সংজ্ঞার আলোকে সমাজকল্যাণের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে আলোচনা করা হলো ।
১. সুসংগঠিত ব্যবস্থা : সমাজকল্যাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, মানব কল্যাণের বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত একটি সুসংগঠিত ও সুপরিকল্পিত সাহায্যদান ব্যবস্থা সংগঠিত ও পরিকল্পিত বৈশিষ্ট্যই সমাজকল্যাণকে সনাতন সমাজসেবা কার্যক্রম হতে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করেছে। ডব্লিউ.এ. ফ্রিডল্যান্ডার, জাট্রুড উইলসন, সমাজকর্ম অভিধান, সমাজকর্মের বিশ্বকোষ প্রদত্ত প্রতিটি সংজ্ঞাতে সমাজকল্যাণের সংগঠিত দিকটির উল্লেখ রয়েছে।
২. সক্ষমকারী প্রক্রিয়া : সমাজকল্যাণ একটি সক্ষমকারী প্রক্রিয়া। এতে মানুষকে এমনভাবে সাহায্য করা হয়, যাতে তারা আওতাধীন সম্পদ ও সামর্থ্যের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের সমস্যা মোকাবেলা ও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। সমাজকল্যাণের লক্ষ্যভুক্ত জনগোষ্ঠীর সুপ্ত ক্ষমতা ও অন্তর্নিহিত সত্তার বিকাশ সাধনের মাধ্যমে জীবনের সার্বিক অবস্থা মোকাবেলায় সক্ষম করে তুলতে সমাজকল্যাণ সচেষ্ট।
৩. সকলের কল্যাণের প্রতি সমান গুরুত্বারোপ : ঐতিহ্যগত সমাজসেবার মতো সমাজকল্যাণ বিশেষ ব্যক্তি, দল বা শ্রেণীর কল্যাণে নিয়োজিত নয়। জাত, ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্র, নির্বিশেষে সকল সমস্যাগ্রস্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে সমাজকল্যাণ। এরূপ সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক সমাজকল্যাণকে সনাতন সমাজসেবা থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্য দান করেছে।
৪. সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি : সমাজকল্যাণ মানুষের সার্বিক কল্যাণে বিশ্বাসী বিধায় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে, যাতে একদিকের উন্নয়ন করতে গিয়ে অন্যদিকে সমস্যার সৃষ্টি না হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞায় সমাজকল্যাণের আলোচ্য বৈশিষ্ট্যটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এতে বলা হয়েছে, ‘সমাজকল্যাণ বলতে শুধু বিশেষ জীবনের মঙ্গলকেই বুঝায় না, বরং দৈহিক, মানসিক এবং সার্বিক সামাজিক মঙ্গলকে বুঝায়’ ।
পৃষ্ঠা ৯
৫. সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রচেষ্টা : সমাজকল্যাণ হলো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানাদির সংগঠিত কার্যাবলীর সমন্বিত রূপ। অতীতের মতো সমাজকল্যাণ শুধু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংগঠিত হয় না। এতে বিশ্বাস করা হয় যে, প্রাক-শিল্প যুগের মতো স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে বর্তমান শিল্প সমাজের জটিল ও বহুমুখী সমস্যার সমাধান দেয়া সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ প্রচেষ্টা। সমাজকর্ম বিশ্বকোষের সংজ্ঞায় এ বৈশিষ্ট্যের সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। এতে সমাজকল্যাণকে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংগঠিত কার্যক্রম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
৬. স্বাবলম্বন নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত সাহায্য কার্যক্রম : সমাজকল্যাণ হলো স্বাবলম্বন নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সমাজসেবা কার্যক্রম। সমাজকল্যাণ বাহ্যিক সাহায্যদানের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসী নয়। সমাজকল্যাণ সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির আওতায় মানুষকে এমনভাবে সাহায্য করে, যাতে তারা নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করে স্বনির্ভরতা অর্জনে সক্ষম হয়।
৭. পরিবর্তশীল সাহায্যদান প্রক্রিয়া : সমাজকল্যাণ স্থবির বা অপরিবর্তনীয় নয়। সামাজিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের চাহিদা, প্রয়োজন ও সমস্যার পরিবর্তন হয়। পরিবর্তিত সমস্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমাজকল্যাণের সাহায্যদান প্রক্রিয়াতেও পরিবর্তন সাধন করা হয়।
৮. সমস্যার স্থিতিশীল ও টেকসই নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা : সনাতন সমাজসেবা কার্যক্রমের সঙ্গে আধুনিক সমাজকল্যাণের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য হলো এতে সমস্যার টেকসই সমাধানের প্রচেষ্টা চালানো হয়। সাময়িক আর্থিক সাহায্যদানের মধ্যে সমাজকল্যাণের কার্যপরিধি সীমিত নয়।
৯. পদ্ধতিগত সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া : সমাজকল্যাণের সাহায্যদানের অন্যতম একটি পেশাগত দিক হলো সমাজকর্ম। এতে সুনির্দিষ্ট কতগুলো পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তি, দল ও জনসমষ্টির সমস্যা সমাধানে মানুষকে সাহায্য করা হয়। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ওপর ভিত্তিশীল পদ্ধতিনির্ভর সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া সমাজকল্যাণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকৃত।
১০. প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্যদান প্রক্রিয়া : সমাজকল্যাণ অনেক ক্ষেত্রে একটি পেশাদারী সমাজসেবা কার্যক্রম। পেশাদারী সমাজসেবা হিসেবে সমাজকল্যাণের সার্বিক কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও নীতিমালার আওতায় বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।
১১. প্রতিকার, প্রতিরোধ ও উন্নয়নমূলক ভূমিকা : সমাজকল্যাণ বর্তমান সমস্যার সমাধান, ভবিষ্যতে সমস্যা প্রতিরোধ এবং সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজকর্ম বিশ্বকোষের সংজ্ঞায় সমাজকল্যাণের আলোচ্য বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সামাজিক সমস্যাদির সমাধান, প্রতিরোধ ও লাঘব এবং ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির উন্নয়নের সংগঠিত কার্যক্রম হিসেবে সমাজকল্যাণকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
১২. ব্যক্তি ও পরিবেশের প্রতি গুরুত্বারোপ : সমাজকল্যাণ ব্যক্তি ও পরিবেশের মিথষ্ক্রিয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করে। ব্যক্তি ও পরিবেশের উন্নয়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ সমাজকল্যাণের প্রতিপাদ্য বিষয়।
১৩. সুবিধাগ্রহীতাদের ক্ষমতায়নের প্রতি গুরুত্বারোপ : আধুনিক সমাজকল্যাণ সেবাগ্রহীতাদের নিষ্ক্রিয় সেবাগ্রহীতা হিসেবে সাহায্যদানে বিশ্বাসী নয়। আধুনিক সমাজকল্যাণ লক্ষ্যভুক্ত জনগোষ্ঠীকে এমনভাবে সাহায্য করে, যাতে তারা নিজেদের উন্নয়নে গৃহীত সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে সক্ষম হয়। উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য অর্জনে সাহায্য করে সমাজকল্যাণ। নিষ্ক্রিয় সেবাগ্রহীতাকে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, সচেতনতা ইত্যাদি কৌশলের মাধ্যমে সক্রিয় সেবাগ্রহীতায় পরিণত করার প্রচেষ্টা চালায় সমাজকল্যাণ।
পৃষ্ঠা ১০
১৪. সামাজিক সম্পর্ক ও মিথষ্ক্রিয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ : সামাজিক ভূমিকার প্রধান উপাদান হলো সামাজিক সম্পর্ক এবং মিথষ্ক্রিয়া। সামাজিক সম্পর্ক ও সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া শক্তিশালীকরণে সমাজকল্যাণ সাহায্য করে।
সমাজকল্যাণের গুরুত্ব
সমাজকল্যাণ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ওপর ভিত্তিশীল একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা। বর্তমান জটিল ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বহুমুখী আর্থ-সামাজিক সমস্যা, যেমন নিরক্ষরতা,অজ্ঞতা, দারিদ্র, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বেকারত্ব, অপরাধ, কিশোর অপরাধ, মাদকাসক্তি ইত্যাদি সামাজিক উন্নতি ও কল্যাণের প্রতিবনধক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। এসব জটিল সমস্যার প্রতিকার, প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে আধুনিক সমাজকল্যাণ শিক্ষা ও তার প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে আর.এ. স্কিডমোর এবং এম.জি. থ্যাকারী বলেছেন, ‘সমাজকল্যাণ এবং সমাজকর্ম আধুনিক সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়েছে, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিটি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। সমাজকল্যাণ এবং সমাজকর্ম সাধারণ শিক্ষার যেমন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, তেমনি সাহায্যকারী পেশার প্রস্তুতি গ্রহণেরও অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে’ ।
আধুনিক সমাজের জটিল সামাজিক সমস্যাবলীর নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক উন্নয়নে সমাজকল্যাণ কিভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, তার কতগুলো দিক নিচে আলোচনা করা হলো :
১. সামাজিক নীতি প্রণয়ন : সমাজকল্যাণের গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন ক্ষেত্র হলো সামাজিক নীতি প্রণয়ন, সামাজিক নীতির উন্নয়ন এবং সামাজিক নীতিকে সমাজসেবায় পরিণত করার উপযোগী সামাজিক পরিকল্পনা ও কর্মসূচির উন্নয়ন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সামাজিক নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফল সুষমভাবে বন্টন নিশ্চিত করতে আধুনিক সমাজকল্যাণের জ্ঞান প্রয়োগ করা যায়। মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ এবং দরিদ্র শ্রেণীর ক্ষমতা ও সামর্থ্য উন্নয়নের প্রয়োজনীয় সামাজিক নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে সমাজকল্যাণের গরুত্ব রয়েছে।
২. সামাজিক জরিপ ও গবেষণা : সমাজকল্যাণের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পেশাদার সমাজকর্ম। পেশাদার সমাজকর্মের অন্যতম কৌশল হলো গবেষণা পদ্ধতি অনুশীলনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সামগ্রিক তথ্যানুসন্ধান করা। সমাজে বিরাজমান সামাজিক সমস্যা এবং সেগুলো নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সমাজকল্যাণে গবেষণা ও জরিপ পরিচালনা করা হয়। সুতরাং বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সামাজিক সমস্যা মোকাবেলা ও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সমাজকল্যাণ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
৩. সামাজিক উন্নয়ন : যে কোন দেশ বা সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ও সামাজিক উন্নতির ওপর নির্ভরশীল। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে যেমন সার্বিক সামাজিক উন্নয়ন আশা করা যায় না, তেমনি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়া সামাজিক উন্নয়ন অর্থহীন। সমাজকল্যাণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পরিপন্থী শক্তিসমূহ দূরীকরণ এবং মানুষকে তার প্রতিভা ও সামর্থ্য বিকাশে সহায়তা দানের মাধ্যমে কর্মক্ষম করে তুলে। ফলে সমাজে একটি উন্নত ধরনের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি হয়। এতে জনগণের সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায় এবং জীবন মান উন্নত হয়।
৪. কার্যকরী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন : উন্নয়ন হলো একটি সামগ্রিক প্রচেষ্টার ফল। আর সামগ্রিক প্রচেষ্টা পরিচালনার সমন্বিত রূপ হলো উন্নয়ন পরিকল্পনা। উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে জনগণের আশা-আকাঙ্খা প্রতিফলিত হয়। উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজকল্যাণের জ্ঞান ও কৌশল প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। পেশাগত দক্ষতা ও নৈপুণ্যসম্পন্ন সমাজকর্মীগণ পরিকল্পনাবিদ হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে উন্নয়ন কৌশল নির্ণয়, লক্ষ্যদল চিহ্নিতকরণ এবং দেশীয় প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়ন কর্মসূচি পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দরিদ্র ও দুঃস্থ শ্রেণীর জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের জীবনমান উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং উন্নয়ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করার যথাযথ উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণে আধুনিক সমাজকল্যাণের জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম।
পৃষ্ঠা ১১
সমাজকল্যাণের পরিধি
সমাজকল্যাণের পরিধি বলতে এর ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক দিককে বুঝানো হয়ে থাকে। সমাজ ও সামাজিক সমস্যার তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জনের পর সুপরিকল্পিত উপায়ে সমস্যা নিয়ন্ত্রণ ও সমাধানের মাধ্যমে সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে সমাজকল্যাণ প্রয়াসী। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ আনয়নে সহায়তা করা সমাজকল্যাণের মূল লক্ষ্য। সুতরাং সমাজের কোন বিশেষ দিক বা বিশেষ শ্রেণীর কল্যাণের মধ্যে এর পরিধি সীমিত নয়। সংগঠিত প্রাতিষ্ঠানিক সেবাকর্ম যেমন আধুনিক সমাজকল্যাণের পরিধিভূক্ত; তেমনি মানবিক ও ধর্মীয় দর্শনের ভিত্তিতে পরিচালিত অসংগঠিত সেবাকর্মও এর বৃহত্তর পরিধির অন্তর্ভুক্ত।
এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী আর.এ. স্কিড্মোর এবং এম.জি. থ্যাকারী বলেছেন, “বৃহৎ দৃষ্টিকোণ হতে সমাজের অধিকসংখ্যক লোকের দৈহিক, মানসিক, আবেগীয়, আধ্যাত্মিক ও আর্থিক প্রয়োজন পূরণ এবং কল্যাণ সাধনই সমাজকল্যাণের অন্তর্ভুক্ত” ।
সমাজকল্যাণের ব্যাপক পরিধি এবং বিস্তৃত ক্ষেত্রের বিশেষ দিকগুলো এখানে আলোচনা করা হলোঃ
১. মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ : বিশ্বের দরিদ্র ও অনুন্নত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী নেতিবাচক আর্থ-সামাজিক পরিবেশে চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা হতে এসব দেশে বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের সুযোগ সৃষ্টি করে জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করা সমাজকল্যাণের ব্যাপক পরিধির অন্তর্ভুক্ত। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘সমাজকল্যাণের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সেসব সুসংগঠিত কার্যক্রম, যেগুলোর লক্ষ্য হলো ব্যক্তি বা সমষ্টিকে তাদের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে এবং পরিবার ও সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উন্নয়নে সাহায্য করা।
২. জনগণকে সংগঠিত করা : বিচ্ছিন্ন এবং অসংগঠিত জনগোষ্ঠী যে কোন সমাজের বোঝা স্বরূপ। অজ্ঞ ও নিরক্ষর অসংগঠিত জনগণ তাদের সমস্যা, সম্পদ, সামর্থ্য ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। সামাজিক সচেতনতার অভাবে উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণে তারা সক্ষম হয় না। আবার তাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণী ন্যায্য অধিকার হতে দরিদ্রদের বঞ্চিত করছে। সুতরাং দরিদ্র ও অনুন্নত সমাজে বিচ্ছিন্ন এবং অসংগঠিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সচেতন করে সংগঠিত শক্তিতে পরিণত করা সমাজকল্যাণের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ ক্ষেত্র।
৩. মানব সম্পদ উন্নয়ন : সমাজকল্যাণের অন্যতম লক্ষ্য হলো মানুষের সুপ্ত প্রতিভা ও অন্তর্নিহিত সত্তার বিকাশ সাধনের মাধ্যমে তাদের সচেতন এবং স্বাবলম্বী করে তোলা, যাতে নিজের এবং সমাজের উন্নয়নে প্রতিটি মানুষ সক্রিয় অংশগ্রহণে সক্ষম হয়। সমাজকল্যাণ মানবীয় সম্পদের সর্বোত্তম বিকাশ সাধন এবং যথাযথভাবে তা কাজে লাগাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সুতরাং মানবসম্পদ উন্নয়নের এবং সদ্ব্যবহারের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ সমাজকল্যাণের ব্যাপক পরিধির অন্তর্ভুক্ত।
৪. প্রতিকারমূলক সমাজকল্যাণ কার্যক্রম : মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে গৃহীত ব্যবস্থাবলী প্রতিকারমূলক সমাজকল্যাণের পরিধিভুক্ত। বিরাজমান সমস্যা দূরীকরণ বা এর প্রভাব হ্রাসকরণের প্রচেষ্টাই হলো প্রতিকারমূলক সমাজকল্যাণের মূল লক্ষ্য। প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন, ভিক্ষুক পুনর্বাসন, অপরাধ সংশোধন এবং দারিদ্র, বেকারত্ব, জনসংখ্যাস্ফীতি, নিরক্ষরতা ইত্যাদি সমস্যা মোকাবেলা করার লক্ষ্যে বাস্তবায়িত কার্যক্রম প্রতিকারমূলক সমাজকল্যাণের পরিধিভুক্ত।
৫. প্রতিরোধমূলক সমাজকল্যাণ কার্যক্রম : সমস্যা সৃষ্টির উৎস এবং সমাজ ব্যবস্থার অবক্ষয় রোধের মাধ্যমে ভবিষ্যত বিপর্যয় মোকাবেলা করার লক্ষ্যে গৃহীত কার্যাবলি প্রতিরোধমূলক সমাজকল্যাণের পরিধিভুক্ত। প্রতিরোধমূলক সমাজকল্যাণ হলো
পৃষ্ঠা ১২
মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে মানসিক শক্তি ও বিশ্বাসকে এমন এক পর্যায়ে উন্নীতকরণ যাতে তারা ভবিষ্যতে সমস্যা মোকাবেলা করতে অথবা এড়িয়ে চলতে সক্ষম হয়। এতে মানুষকে সমস্যা সমাধানকারী হিসেবে শক্তিশালী করে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হয়। সামাজিক শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, গ্রামীণ সমাজসেবা, পরিবার-কল্যাণ, শিশুকল্যাণ, যুবকল্যাণ, প্রবীণ কল্যাণ, শ্রম কল্যাণ, দুঃস্থ মহিলাদের বৃত্তিমূলক শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন, প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসন ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদি প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম সমাজকল্যাণের পরিধিভুক্ত।
৬. উন্নয়নমূলক সমাজকল্যাণ কার্যক্রম : যে সব গঠনমূলক ও পরিকল্পিত কর্মসূচি মানুষের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং সামঞ্জস্য বিধানে শিক্ষাদানের মাধ্যমে সমাজে কাঠামোগত পরিবর্তন আনয়নে নিয়োজিত, সেগুলো উন্নয়নমূলক সমাজকল্যাণের পরিধিভুক্ত। সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী উন্নয়নমূলক সমাজকল্যাণ হলো সমাজকল্যাণের একটি পদ্ধতি যা তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের অন্যান্য সাধারণ চাহিদা ও সম্পদের পরিপ্রেক্ষিতে দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গতিপূর্ণ সমাজসেবা প্রদানের পরিকল্পনা প্রণয়নে উৎসাহিত করে। শহর সমষ্টি উন্নয়ন, গ্রামীণ উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা, সমাজকল্যাণ কার্যাবলির মধ্যে সমন্বয় সাধন ইত্যাদি উন্নয়নমূলক সমাজকল্যাণের পরিধিভুক্ত।
৭. রাষ্ট্রীয় সমাজকল্যাণ নীতি ও পরিকল্পনা : আধুনিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের সার্বিক সমাজকল্যাণ কার্যক্রম রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় নীতি ও পরিকল্পনা সমাজকল্যাণের ব্যাপক পরিধির অন্তর্ভুক্ত। সরকারের জনকল্যাণমুখী নীতি এবং এগুলোর ভিত্তিতে প্রণীত পরিকল্পনা সমাজকল্যাণের প্রায়োগিক দিকের অন্তর্ভুক্ত।
৮. পল্লী উন্নয়ন : বিশ্বের দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশে সমাজকল্যাণের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো পল্লী উন্নয়ন। পল্লীর দরিদ্র ও দুঃস্থ অসহায় শ্রেণীর সার্বিক উন্নয়নে আধুনিক সমাজকল্যাণের কৌশল প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। গ্রামীণ জনগণের নিজস্ব সম্পদ ও সামর্থ্যের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রামীণ পর্যায়ে সমস্যা সমাধানের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে সমাজকল্যাণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পরিকল্পিত পরিবর্তন আনয়নের উপায় হিসেবে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের পল্লী উন্নয়নে সমাজকল্যাণের জ্ঞান ও কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে, যাতে সীমিত সম্পদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে পল্লীর সর্বস্তরের মানুষের সুষম উন্নয়ন ও কল্যাণ সাধনের সঙ্গে মানব সম্পদের উন্নয়ন ঘটে।
৯. সুবিধাভোগী শ্রেণীর ক্ষমতায়ন : আধুনিক সমাজকল্যাণ অনুশীলনের নতুন ধারা হলো সুবিধাভোগী ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন। আধুনিক সমাজকল্যাণ সুবিধাভোগী শ্রেণীকে এমনভাবে সাহায্য করে, যাতে তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা লাভের মাধ্যমে নিজেদের উন্নয়নে গৃহীত সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমকে প্রভাবিত করতে পারে। কারণ ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি ছাড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর টেকসই ও স্থিতিশীল উন্নয়ন আশা করা যায় না।
১০. বিশেষ জনগোষ্ঠীর কল্যাণ : সমাজের প্রবীণ, প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু, শিশু ইত্যাদি বিশেষ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে গৃহীত কার্যক্রম সমাজকল্যাণের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। বিশেষ জনগোষ্ঠী যাতে সমাজের স্বাভাবিক সদস্য হিসেবে জীবনযাপন করতে পারে, সেজন্য প্রচেষ্টা চালায় সমাজকল্যাণ।
পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক সমাজকল্যাণ একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা। মানব কল্যাণের সামগ্রিক উপাদান সমাজকল্যাণের বিষয়বস্তুর পরিধিভুক্ত। যেহেতু সমাজকল্যাণের লক্ষ্য সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ বিধানের প্রচেষ্টা চালানো, সেহেতু সমাজের সামগ্রিক দিক সমাজকল্যাণের বৃহত্তর পরিধিভুক্ত। বর্তমান সমস্যার সমাধান, ভবিষ্যত সমস্যার প্রতিরোধ এবং সামাজিক উন্নয়নের সার্থে বাস্তবায়িত প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাদার সেবাকর্ম যেমন এর পরিধিভুক্ত; তেমনি মানবিক ও ধর্মীয় দর্শনের ভিত্তিতে পরিচালিত বিচ্ছিন্ন এবং ব্যক্তিগত সেবাকর্মও সমাজকল্যাণের আওতাভুক্ত। এলিজাবেথ উইকেনডেন বলেছেন, “সমাজকল্যাণের পরিধিভুক্ত হলো সেসব আইন, কর্মসূচি, সুযোগ-সুবিধা এবং সেবামূলক কার্যক্রম, যেগুলো মানুষের মৌল সামাজিক চাহিদা হিসেবে স্বীকৃত প্রয়োজনাদি পূরণের নিশ্চয়তা বিধান বা জোরদার ও উত্তম সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত” ।
পৃষ্ঠা ১৩
বাংলাদেশে সমাজকল্যাণের পরিধি
যে কোন সমাজের পরিবর্তন, বিবর্তন ও পরিবর্ধনের সাথে সমাজকল্যাণের পরিধি ও বিষয়বস্ত্ত ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়। সমাজের বিশেষ চাহিদা, সমস্যা এবং সম্পদের প্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণের প্রয়োগ ক্ষেত্র ও পরিধি নির্ধারিত হয়ে থাকে। এজন্য অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সমস্যা, সম্পদ ও চাহিদার সঙ্গে উন্নত সমাজের পার্থক্য থাকায় সমাজকল্যাণের পরিধি ও বিষয়বস্ত্তর মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্র ও অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী দারিদ্রতা, স্বাস্থ্যহীনতা, পুষ্টিহীনতা, নিরক্ষরতা, অজ্ঞতা, অদৃষ্টবাদিতা, বেকারত্ব ইত্যাদি বহুমুখী সমস্যার শিকার। প্রাকৃতিক ও আর্থ-সামাজিক প্রতিকূল অবস্থার প্রেক্ষিতে এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ন্যূনতম মৌল চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বহুমুখী ও পরস্পর নির্ভরশীল আর্থ-সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় সমাজকল্যাণের পরিধি বাংলাদেশে অত্যন্ত ব্যাপক।
বাংলাদেশে সমাজকল্যাণের ব্যাপক পরিধির বিশেষ কতগুলো দিক এখানে আলোচনা করা হলো:
১. মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের সুযোগ বৃদ্ধি : বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান দারিদ্র সীমার নিচে। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ন্যূনতম মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা থেকে ভিক্ষাবৃত্তি, পুষ্টিহীনতা, স্বাস্থ্যহীনতা, অপরাধ প্রবণতা, নিরক্ষরতা, অজ্ঞতা ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এক কথায় অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল মৌল মানবিক প্রয়োজন অপূরণজনিত সমস্যা বাংলাদেশে অত্যন্ত ব্যাপক। সুতরাং মানুষের ন্যূনতম মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের সুযোগ সৃষ্টি এবং দরিদ্রতার গতিরোধ করার উপায় ও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা বাংলাদেশের সমাজকল্যাণের পরিধির অন্যতম দিক।
২. পরিকল্পিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি : বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় সমস্যা হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিজে যেমন সমস্যা, তেমনি অন্যান্য সমস্যার কারণও বটে। বাংলাদেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে অপরিকল্পিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি। পরিকল্পিত পরিবার গঠনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করা সমাজকল্যাণের অন্যতম প্রয়োগক্ষেত্র।
৩. সমস্যার প্রতিকার ও প্রতিরোধ করা : বাংলাদেশে বিরাজমান পরস্পর নির্ভরশীল বহুমুখী সমস্যার স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধান, প্রতিকার এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা চালায়। বাংলাদেশে প্রতিরোধমূলক সমাজকল্যাণের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। এ ব্যাপক পরিধির অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ভিক্ষুক পুনর্বাসন, বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী কল্যাণ, অপরাধী ও কিশোর অপরাধ সংশোধন, মুক্ত কয়েদী পুনর্বাসন, মহিলা ও শিশু কল্যাণ এবং শ্রম কল্যাণ ইত্যাদি।
৪. তথ্য সংগ্রহ : বাংলাদেশের বহুমুখী জটিল সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজন সমস্যার কারণ, প্রকৃতি, প্রভাব, পারস্পরিক সম্পর্ক, প্রতিক্রিয়া এবং সমস্যা সমাধানে প্রাপ্ত সম্পদ বা সম্পদ প্রাপ্তির সম্ভাবনা ইত্যাদি সামগ্রিক দিক সম্পর্কে বাস্তব তথ্য সংগ্রহ করা। সমস্যা ও সম্পদ সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ ব্যতীত সমস্যার পরিকল্পিত সমাধান আশা করা যায় না।
৫. দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি : ১৯৮৫ সালে প্যারিস কনসোর্টিয়ামে (বাংলাদেশের সাহায্যদাতা দেশগুলোর বৈঠক, যার বর্তমান নাম উন্নয়ন সহযোগী) কানাডার প্রতিনিধিদলের নেতা আর্থার আর. রাইট বলেছেন, বাংলাদেশের গণদারিদ্র্যের মূল কারণ সম্পদের সীমাবদ্ধতা নয় বরং সম্পদের ওপর দরিদ্র জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার অভাব। বাংলাদেশের ১৯৯১ সালের
পৃষ্ঠা ১৪
লোকগণনার তথ্যানুযায়ী শতকরা ২৪.৯ ভাগ শিক্ষিত এবং ২০০১ সালের লোকগণনার তথ্যানুযায়ী ৩৭ ভাগ শিক্ষিত। অন্যদিকে ১৯৯১ সালের লোকগণনার তথ্যানুযায়ী মহিলাদের শতকরা ১৯.৫ ভাগ এবং ২০০১ সালের লোকগণনার তথ্যানুযায়ী ৩৩.৪ ভাগ শিক্ষিত। বাংলাদেশের প্রায় ৬৮ ভাগ মহিলা নিরক্ষর। নিরক্ষরতা এবং অজ্ঞতার প্রভাবে জনগণ তাদের সমস্যা, সম্পদ এবং সামর্থ্য সম্পর্কে সচেতন নয়। সামাজিক সচেতনতার অভাবে উন্নয়ন কর্মকান্ডে তারা অংশগ্রহণে সক্ষম হয় না। আবার তাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে মুষ্টিমেয় প্রভাবশালী লোক ন্যায্য অধিকার হতে তাদেরকে বঞ্চিত করছে। সুতরাং বাংলাদেশের সমাজকল্যাণের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হচ্ছে জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত শক্তিতে পরিণত করে তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, যাতে তারা প্রাপ্ত সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার ওপর স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়।
৬. মানব সম্পদ উন্নয়ন : যে কোন দেশ ও জাতির উন্নয়নের মৌলিক উপাদান হলো মানবসম্পদ। দক্ষ মানবসম্পদ ছাড়া ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত উন্নয়ন সম্ভব নয়। সমাজকল্যাণের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের সুপ্ত ক্ষমতার বিকাশ সাধনের মাধ্যমে তাদের সচেতন ও স্বাবলম্বী করে তোলা। বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করতে এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সক্রিয় অংশগ্রহণে সক্ষম করে তোলা সমাজকল্যাণের ব্যাপক পরিধির অন্তর্ভুক্ত।
৭. সমবায় ও কর্মসংস্থান : বাংলাদেশে দরিদ্রদের ভাগ্যোন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হিসেবে সমবায়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির উন্নয়নে সমবায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সরকারি তথ্যানুযায়ী দেশে নিবন্ধীকৃত সমবায় সমিতির সংখ্যা এক লাখ চল্লিশ হাজার পঁচিশটি। জনগণের অজ্ঞতা, অশিক্ষা, অন্যান্য প্রতিকূল আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এদেশে গণমুখী সমবায় আন্দোলন গড়ে উঠেনি। গণমুখী সমবায় গঠনের মাধ্যমে বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে সমাজকল্যাণ কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে।
৮. শিল্পায়ন ও শহরায়নজনিত সমস্যা মোকাবেলা : বাংলাদেশে শহরায়ন প্রক্রিয়া দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। শিল্পায়ন ও শহরায়নজনিত সমস্যা সমাজকল্যাণের পরিধিকে সম্প্রসারিত করছে। এসব সমস্যা মোকাবেলার জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র, শিশুসদন, চিকিৎসা সমাজকর্ম, পরিবারকল্যাণ, শহর সমষ্টি উন্নয়ন, শ্রমকল্যাণ ইত্যাদি কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। এ ধরনের কর্মসূচি সমাজকল্যাণের বিস্তৃত পরিধির অন্তর্ভুক্ত।
৯. পল্লী উন্নয়ন : বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা গ্রামীণ। ২০০১ সালের আদম শুমারী তথ্যানুযায়ী জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৭৭ জন গ্রামে বাস করে। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার তথ্য অনুযায়ী গ্রামীণ উন্নয়নকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের উন্নয়ন আশা করা যায় না। এজন্য গ্রামীণ উন্নয়নকে সমাজকল্যাণের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করে সমাজকল্যাণ কার্যক্রমকে গ্রামীণ পর্যায়ে প্রসারিত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গ্রামীণ সমাজসেবা প্রকল্পের নাম উল্লেখ করা যায়।
১০. বেসরকারি সমাজসেবা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা : সমাজকল্যাণের ব্যাপক পরিধিতে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের কার্যক্রমের পূর্ণ স্বীকৃতি রয়েছে। বাংলাদেশে শহর ও গ্রামীণ পর্যায়ে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান দুঃস্থ ও দরিদ্রদের কল্যাণে নিয়োজিত রয়েছে। ২০০১-২০০২ সাল পর্যন্ত ১৬৭১টি বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত প্রকল্পের সংখ্যা ছিল ৭৪৬টি। ২০০৪ সালের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে কর্মরত এনজিও-র সংখ্যা ছিল ১৮৮২টি এবং জুন ২০০৩ পর্যন্ত ১৭৯১টি এনজিওর পুঞ্জীভুত অনুমোদিত প্রকল্প ছিল ৯১৮৯টি। এসব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলির সুষ্ঠু সমন্বয়, পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সমাজকল্যাণের ব্যাপক পরিধির আওতাভুক্ত।
উপরিউক্ত আলোচনা হতে স্পষ্ট হয়ে উঠে, বাংলাদেশে সমাজকল্যাণের পরিধি ব্যাপক। সমাজকল্যাণের পরিধি প্রসারের পরিপ্রেক্ষিতে এদেশে পৃথক সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর স্থাপন করা হয়েছে। শহর ও গ্রামীণ পর্যায়ে প্রতিকার, প্রতিরোধ ও উন্নয়নমূলক সমাজকল্যাণ কার্যক্রম ব্যাপ্তি লাভ করছে।
পৃষ্ঠা ১৬
বাংলাদেশে সমাজকল্যাণের গুরুত্ব
বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্র ও অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বহুমুখী ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত আর্থ-সামাজিক সমস্যার শিকার বৃহৎ জনগোষ্ঠী ন্যূনতম মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। প্রতিকূল প্রাকৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার প্রভাবে দারিদ্রক্লিষ্ট জনসংখ্যার হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাধীনতাত্তোর আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সম্পদ লাভের অসম প্রতিযোগিতা থেকে সৃষ্ট ব্যর্থতা, হতাশা, মানসিক ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি সমস্যা বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণের জ্ঞান, কৌশল ও দক্ষতা প্রয়োগের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো নিচে আলোচনা করা হলো :
১. সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশে বিরাজমান আর্থ-সামাজিক সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজন প্রতিকার, প্রতিরোধ এবং উন্নয়নধর্মী কার্যক্রমের সমন্বয়ে গঠিত ভারসাম্যমূলক পদ্ধতি গ্রহণ। এ তিনটি কার্যক্রমের সমন্বিত রূপ হচ্ছে সমাজকল্যাণ। সুতরাং বাংলাদেশের বহুমুখী ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত সামাজিক সমস্যার প্রতিকার ও প্রতিরোধকল্পে সমাজকল্যাণের প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক দিকের গুরুত্ব অপরিসীম। আবার বাংলাদেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ন্যূনতম মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা হতে যেহেতু অধিকাংশ সমস্যার সৃষ্টি, সেহেতু প্রতিকারমূলক সমাজকল্যাণ কার্যক্রমের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন হচ্ছে উন্নয়নমূলক সমাজকল্যাণ কার্যক্রমের। কারণ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম ব্যতীত জনগণের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি সম্ভব নয়।
২. সামাজিক উন্নয়ন : সমাজকল্যাণের এপ্রোচ একটি হলো সামাজিক উন্নয়ন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের অপরিহার্য দিক হলেও সামগ্রিক কল্যাণ বৃদ্ধির একমাত্র উপকরণ নয়। বাংলাদেশের মত অনেক অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃব্ধি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও সুষ্ঠু বণ্টন নীতির অভাবে ব্যাপক গণদারিদ্র হ্রাস পায়নি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জনসংখ্যা, শিক্ষা, খাদ্য, পুষ্টি, পরিবেশ ইত্যাদি সামাজিক খাতের উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণের গুরুত্ব অপরিসীম। সুতরাং সামাজিক উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতাগুলোকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সমাজকল্যাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে মোকবেলা করার গুরুত্ব বাংলাদেশে অপরিসীম।
৩. তথ্যনির্ভর উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন : উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে পরিকল্পনা। বাস্তব ও কার্যকরী পরিকল্পনা প্রণয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে তথ্য-নির্ভর পরিকল্পনা প্রণয়ন। বাস্তব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা প্রণীত না হলে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না। পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় দেশের সার্বিক সমস্যা, সম্পদ, জনশক্তি ইত্যাদি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ও যথার্থ তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। এক্ষেত্রে সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজকল্যাণের জ্ঞান ও কৌশল প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। পেশাগত দক্ষতা ও নৈপুণ্যসম্পন্ন সমাজকর্মীগণ পরিকল্পনাবিদ হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে সমাজকল্যাণ ক্ষেত্রে উন্নয়ন কৌশল নির্ণয়, লক্ষ্যদল চিহ্নিতকরণ, লাগসই সমাজকল্যাণ কর্মসূচি পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। যেমন- বাংলাদেশের দরিদ্র, দুঃস্থ, অসহায় ও বঞ্চিত শ্রেণীর জনগণকে চিহ্নিত করে তাদের জীবনমান উন্নয়নের
পৃষ্ঠা ১৭
সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং এসব দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির যথাযথ উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণে আধুনিক সমাজকল্যাণের জ্ঞান ও দক্ষতার গুরুত্ব অপরিসীম।
৪. পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি : জাতীয় পরিকল্পনা প্রধানত জাতিগঠনমূলক বিভাগগুলোর মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে এলাকাভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। উন্নয়ন পরিকল্পনা নীতি ও কৌশল অনুসরণ করে স্থানীয় সম্পদ, সমস্যার সরকারি সাহায্য ও সুবিধার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কর্মসূচি প্রণয়নে আধুনিক সমাজকল্যাণের বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করা যায়। এতে পরিকল্পনা বাহন কর্মসূচি প্রণয়ন ও সুষ্ঠু বাস্তবায়নের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সুতরাং আধুনিক সমাজকল্যাণের জ্ঞান, দক্ষতা,পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করে বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন এবং পরিকল্পনার ফলাফল জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো সম্ভব।
৫. সামাজিক বৈষম্যরোধ ও বঞ্চিত শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণঃ বাংলাদেশের পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সাথে তিন শ্রেণীর লোক জড়িত। ক. পরিকল্পনা প্রণয়নবিদ খ. পরিকল্পনা বাস্তবায়নবিদ গ. যাদের উন্নয়নে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় সে লক্ষ্যভুক্ত শ্রেণী। এ তিন শ্রেণীর মধ্যে সুষ্ঠু প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সুযোগ না থাকায়, পরিকল্পনার ফলে সৃষ্ট আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের ফলাফল সম্পর্কে প্রথমোক্ত শ্রেণী অনেক সময় যথাযথ তথ্য থেকে বঞ্চিত থাকে। আধুনিক সমাজকল্যাণের জ্ঞান, দক্ষতা ও কৌশল প্রয়োগ করে সমাজকর্মীগণ উন্নয়ন পরিকল্পনার ফলে আর্থ-সামাজিক পরবর্তনের ফলাফল সম্পর্কে পরিকল্পনাবিদদের বাস্তব তথ্য সরবরাহ করে উন্নয়নকে কল্যাণকামী রূপ দিতে সাহায্য করতে পারেন। এতে সমাজের বঞ্চিত ও অবহেলিত শ্রেণীর কল্যাণ এবং স্বার্থরক্ষার সাথে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি রোধ করা সম্ভব হয়।
৬. উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি : বাংলাদেশের অধিকাংশ কল্যাণমূলক কর্মসূচির কম সাফল্যের প্রধান কারণ হচ্ছে কর্মসূচি বাস্তবায়নে জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের অভাব। নিরক্ষরতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, পরনির্ভরশীল মানসিকতা ইত্যাদি কারণে উন্নয়নমূলক কার্যক্রমকে সরকারি দায়িত্ব বলে জনগণ চিহ্নিত করে। আধুনিক সমাজকল্যাণের বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে জনগণকে তাদের সমস্যা ও সম্পদ সম্পর্কে সচেতন করে কর্মসূচি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে সক্রিয় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা যায়।
৭. স্বাবলম্বন অর্জন : আধুনিক সমাজকল্যাণের সুসংগঠিত কার্যক্রম স্বাবলম্বন নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত। সমাজকল্যাণে বিশ্বাস করা হয়, বাইরের সাহায্য ও সহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান আশা করা যায় না। বরং এতে মানুষের মধ্যে পরনির্ভরশীল মানসিকতা বোধের প্রকাশ পায়, প্রকৃত উন্নয়ন অর্জন সম্ভব হয় না। দেশীয় সম্পদের সম্ভাব্য সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জনের যুগোপযোগী প্রক্রিয়া হচ্ছে আধুনিক সমাজকল্যাণ।
৮. দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে তাদের ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি : বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন ও অসংগঠিত বিপুল জনগোষ্ঠী ব্যক্তিগত উন্নয়ন এবং জাতীয় উন্নয়নে অর্থবহ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। প্রাপ্ত সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার ওপর দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার অক্ষমতা এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে তাদের কার্যকরী ভূমিকা পালনের
পৃষ্ঠা ১৮
অভাবে বাংলাদেশে দারিদ্র বৃদ্ধি পাচ্ছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত জনশক্তিতে পরিণত এবং তাদের ক্ষমতায়ন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আধুনিক সমাজকল্যাণের বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
৯. শিল্পায়ন ও নগরায়ন সমস্যা নিয়ন্ত্রণ : স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের শিল্পায়ন ও নগরায়ন প্রক্রিয়া অপেক্ষাকৃত দ্রুত হওয়ার কারণে সামাজিক সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামীণ জনগণের শহরমুখী প্রবণতার কারণে গ্রামীণ সমস্যাগুলো শহরে স্থানান্তরিত হচ্ছে। দাম্পত্য কলহ, শিশু ও প্রবীণদের নিরাপত্তার অভাব, বস্তির মানবেতর জীবন ব্যবস্থা, নৈতিক অধঃপতন, অপরাধ ও কিশোর অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, নেশাগ্রস্ততা ইত্যাদি সমস্যা শিল্পায়ন ও নগরায়নের সামাজিক ফসল। এসব সমস্যা মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশে নতুন নতুন সমাজকল্যাণ কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রমে আধুনিক সমাজকল্যাণের জ্ঞান ও কৌশল প্রয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম।
১০. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিঃ সামাজিক সচেনতা বৃদ্ধি ছাড়া নিরক্ষর, অজ্ঞ ও জীবনবিমুখ অদৃষ্টবাদী জনগণের কল্যাণ সাধন সম্ভব নয়। এদেশের জনগণের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত সমাজকল্যাণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পদ্ধতিগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে সামাজিক কার্যক্রম কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে এদেশের জনগণের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়।
১১. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কার্যকারিতা বৃদ্ধি : বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সীমিত এবং বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। কৃষি-নির্ভর বাংলাদেশের বৃহৎ কৃষক এবং কৃষি শ্রমিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হতে বঞ্চিত। শিশু, প্রবীণ, মহিলা, দৈহিক প্রতিবন্ধী, বুদ্ধি ও সামাজিক প্রতিবন্ধী ইত্যাদি সমস্যাগ্রস্তদের বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশে সমাজকল্যাণের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সমাজকল্যাণের জ্ঞান প্রয়োগ করা যায়।
১২. মানব সম্পদ উন্নয়ন : সমাজকল্যাণের প্রধান খাত হলো, মানব সম্পদ উন্নয়ন। বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার ক্ষেত্রে সমাজকল্যাণের প্রায়োগিক উপযোগিতা অধিক। সমাজকল্যাণের পেশাগত দিক সমাজকর্মের বিভিন্ন কৌশল ও পদ্ধতি মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতে প্রয়োগ করা যায়।
উপসংহারে বলা যায়, বাংলাদেশে সামঞ্জস্যপূর্ণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যুগোপযোগী কর্মসূচি হচ্ছে সমাজকল্যাণ। সমাজের চাহিদা পূরণ, সামাজিক নিরাপত্তা বিধান, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ, পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের সমাজ জীবনকে সমৃদ্ধ করতে সুসংগঠিত সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
বাংলাদেশে সমাজকল্যাণ পাঠের গুরুত্ব
বাংলাদেশে বিরাজমান প্রতিকূল আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক অবস্থার মোকাবেলা করার জন্য মানবজ্ঞানের বিশেষ ব্যবহারিক শাখা সমাজকল্যাণ পাঠের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বাংলাদেশের পরস্পর
পৃষ্ঠা ১৯
সম্পর্কযুক্ত বহুমুখী সামাজিক সমস্যা সমাধান ও প্রতিরোধকল্পে সমাজকল্যাণের জ্ঞান ও কৌশল প্রয়োগের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
আর্থ-সামাজিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশে সমাজকল্যাণ পাঠের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার প্রধান কতগুলো দিক এখানে আলোচনা করা হলো :
১. সামাজিক চাহিদা ও সমস্যা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ : বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক সমস্যার সমাধান এবং সামাজিক চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের পূর্বশর্ত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সমস্যা ও চাহিদা সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান লাভ করা। সমাজকল্যাণের বিভিন্ন পদ্ধতির সাহায্যে ব্যক্তি, দল ও সমাজের চাহিদা, সমস্যা, কারণ, প্রভাব ইত্যাদি সম্পর্কে বাস্তব ও তথ্যনিষ্ঠ জ্ঞানার্জন করা যায়। সুতরাং সমাজকল্যাণ পাঠে আমরা সমস্যা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি।
২. পরিকল্পিত উপায়ে সমস্যা নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশে বিরাজমান আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলো পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। কোন সমস্যাই একক ও বিচ্ছিন্নভাবে বিরাজ করছে না। একটি অপরটির কারণ হিসেবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক জীবনে ক্রমাগত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। পরিকল্পিত ও সমন্বিত উপায়ে বিরাজমান সামাজিক সমস্যাগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও সমাধানের স্বার্থে বাংলাদেশে পেশাদার সমাজকল্যাণ পাঠের প্রয়োজন রয়েছে।
৩. প্রাপ্ত সম্পদের ব্যবহার : বাংলাদেশের গণদারিদ্র্যের অন্যতম কারণ সম্পদের সীমাবদ্ধতা হলেও এটি একমাত্র কারণ নয়। সম্পদ ব্যবহারের গুণগত দিকটিও গণদারিদ্র্যের জন্য অনেকাংশে দায়ী। সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তার উন্নয়ন, সংগঠন , যথাযথ ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা করে স্থানীয়ভাবে সমস্যা সমাধানে সমাজকল্যাণ সাহায্য করতে পারে। সমাজকল্যাণ পাঠে আমরা মানুষের সুপ্ত ক্ষমতার বিকাশ ও সুপ্ত সম্পদের সঠিক এবং সর্বোত্তম ব্যবহার সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতে পারি।
৪. সমাজকল্যাণ কার্যক্রমকে বাস্তব উপযোগী করে তোলা : বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমাজকল্যাণের জ্ঞান ও কৌশল প্রয়োগ করে প্রচলিত কল্যাণমূলক কার্যক্রমকে বাস্তব উপযোগী করে তোলার গুরুত্ব অপরিসীম। সমাজকল্যাণের বিশেষ দিক সমাজকর্ম অধ্যয়নের মাধ্যমে এটি করা সম্ভব।
৫. উন্নয়ন কর্মকান্ডে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ : কোন পরিকল্পনাই জনগণের সহযোগিতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতীত লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না। জনগণ যখন কোন উন্নয়নের প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন হয়, তখনই তারা সেটি বাস্তবায়নে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে থাকে। সমাজকল্যাণ মানুষকে তাদের প্রয়োজন, সমস্যা, সম্পদ ও ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন এবং উন্নয়ন কর্মকান্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। বাংলাদেশের অজ্ঞ, অশিক্ষিত জনগণকে উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেশাদার সমাজকল্যাণ অধ্যয়নের প্রয়োজন রয়েছে।
৬. পেশাদার সমাজকর্মী তৈরি : বাংলাদেশের জটিল ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বহুমুখী সমস্যা সমাধানের জন্য দক্ষতাসম্পন্ন সমাজকর্মীর প্রয়োজন অত্যধিক। দক্ষতাসম্পন্ন সমাজকর্মীর অভাবে বাস্তবায়িত সমাজকল্যাণ
পৃষ্ঠা ২০
কার্যক্রমের সাফল্য আশানুরূপ হচ্ছে না। দক্ষ এবং পেশাদার সমাজকর্মী তৈরির জন্য এদেশে সমাজকর্ম শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
৭. সমাজসংস্কার ও সামাজিক কু-প্রথা দূরীকরণ : বাল্য বিবাহ, যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতন ইত্যাদি সামাজিক কু-প্রথা ও কুসংস্কার বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম প্রতিবন্ধক এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির
প্রধান উৎস। এসব কু-প্রথার ফলে পারিবারিক কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নারী নির্যাতন, শিশুদের নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব কু-প্রথা থেকে সমাজকে মুক্ত করার জন্য সমাজকল্যাণের সহায়ক পদ্ধতি সামাজিক কার্যক্রম প্রয়োগ করে আধুনিক সমাজকল্যাণ অর্থাৎ সমাজকর্ম পাঠের মাধ্যমে সামাজিক গঠন ও পরিচালনা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা যায়।
৮. পেশাগত বিশেষ সাহায্য পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত হওয়া : আধুনিক সমাজকল্যাণের সমস্যা সমাধানের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হচ্ছে সমাজকর্ম। সমাজকর্ম ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যা সমাধানে বিশেষ কতগুলো পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকে। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য যেমন এসব পদ্ধতি সম্পর্কিত জ্ঞানার্জন প্রয়োজন, তেমনি ব্যক্তিগত, দলগত ও সমষ্টিগত উন্নয়নের জন্যও এগুলো অধ্যয়ন অত্যাবশ্যক।
৯. মানব সম্পদ উন্নয়ন : বাংলাদেশে বিপুল জনসংখ্যাকে মানব সম্পদে পরিণত করার উপায় উদ্ভাবনে সমাজকল্যাণের জ্ঞান ও দক্ষতা সহায়তা করতে পারে। সমাজকল্যাণের জ্ঞান ও কৌশল প্রয়োগ করে মানব সম্পদ উন্নয়ন সম্ভব। এদিক থেকেও বাংলাদেশে সমাজকল্যাণ অধ্যয়নের গুরুত্ব রয়েছে।
১০. সমাজকল্যাণ সম্পর্কে সনাতন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন : বাংলাদেশে আধুনিক পেশাদার সমাজকল্যাণ ধারণার তেমন প্রসার ঘটেনি। সমাজকল্যাণ বলতে এখনো সমাজের অসহায় শ্রেণীর কল্যাণে গৃহীত স্বেচ্ছাসেবীদের কার্যাবলীকেই নির্দেশ করা হয়। সমস্যা সমাধানের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া হিসেবে সমাজকল্যাণ ধারণা প্রসারের জন্য সমাজকল্যাণ শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, পরিকল্পিত ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান, জনসম্পদের সদ্ব্যবহার, জনগণের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিদ্ধ, স্বনির্ভর মানসিকতা গঠন এবং পরিকল্পিত পরিবর্তন আনয়নের জন্য সমাজকল্যাণের বিশেষ ধারা সমাজকর্ম পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম।
অনুশীলনী
রচনামূলক প্রশ্ন
১. আধুনিক সমাজকল্যাণের সংজ্ঞা দাও। সমাজকল্যাণের লক্ষ্যসমূহ আলোচনা কর।
২. সমাজকল্যাণ বলতে কি বুঝ? বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সমাজকল্যাণের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যসমূহ আলোচনা কর।
৩. সমাজকল্যাণের সংজ্ঞা দাও। সমাজকল্যাণের পরিধি আলোচনা কর।
৪. আধুনিক সমাজকল্যাণের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
৫. সমাজকল্যাণ কাকে বলে? বর্তমান সমাজে আধুনিক সমাজকল্যাণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।
৬. সমাজকল্যাণ ধারণাটি আলোচনা কর। বাংলাদেশে এর গুরুত্ব বর্ণনা কর।
৭. সমাজকল্যাণ বলতে কি বুঝ? বাংলাদেশে সমাজকল্যাণের পরিধি আলোচনা কর।
৮. সমাজকল্যাণ বলতে কি বুঝ? বাংলাদেশে সমাজকল্যাণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা নির্ণয় কর।
৯. সমাজকল্যাণের সংজ্ঞা দাও। বাংলাদেশে এর পরিধি আলোচনা কর।
১০. সমাজকল্যাণের ধারণা ব্যাখ্যা কর। সমাজকল্যাণ পাঠের গুরুত্ব আলোচনা কর।
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. সমাজকল্যাণ বলতে কি বুঝ?
২. বাংলাদেশের সমাজকল্যাণের যে কোন পাঁচটি লক্ষ্য উল্লেখ কর।
৩. সমাজকল্যাণের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর।
৪. পেশাদার সমাজকর্মীর ভূমিকা কি?
৫. সমাজকর্মের তিনটি মৌলিক পদ্ধতির নাম লিখ।
পৃষ্ঠা ২১
খ. সমাজকল্যাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্যয়সমূহ |
ভূমিকা
সমাজকল্যাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষ কতগুলো প্রত্যয় রয়েছে, যেগুলোর জ্ঞান আধুনিক সমাজকল্যাণের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও পৃথক সত্তা অনুধাবনে সহায়তা করে। সংশ্লিষ্ট প্রত্যয়সমূহের তুলনামূলক আলোচনা হতে একদিকে সমাজকল্যাণের স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট হয়ে উঠে; অন্যদিকে এসব প্রত্যয়ের সঙ্গে সমাজকল্যাণের সম্পর্ক উপলব্ধি করা সহজ হয়। সুতরাং প্রত্যয়গুলো সমাজকল্যাণের পরিচয় বহন না করলেও একে সুনির্দিষ্টভাবে বুঝতে এবং সমাজকল্যাণের বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
প্রত্যয় কি ?
ধারণা বা প্রত্যয় হলো পর্যবেক্ষণকৃত ঘটনা, বস্তু বা অভিজ্ঞতার বিমূর্তরূপ। প্রত্যয় বা ধারণা হলো বহুমুখী বিভিন্ন ঘটনার সংক্ষিপ্ত প্রতিনিধি। প্রত্যয়ের উদ্দেশ্য অনেকগুলো ঘটনাকে একটি শিরোনামে সংগঠিত করে চিন্তা ও প্রত্যক্ষণ ক্রিয়াকে সহজ করা। যখন কোন ঘটনা ব্যাখ্যা বা তথ্যের বিবরণ অথবা কোন জটিল বৈজ্ঞানিক গবেষণা বিমূর্তভাবে প্রকাশ করতে হয়, তখন প্রত্যয় বা ধারণার ব্যবহার করা হয়।
মানবজ্ঞানের সবদিকই কোন না কোন ধারণা বা প্রত্যয়ের মাধ্যমে সংগঠিত করা হয়। যেমন ফল একটি বিমূর্ত ধারণা। ফল শিরোনামের আওতায় আপেল, কমলা, কলা ইত্যাদি ফলকে আনয়ন করা যায়। বিভিন্ন তথ্যের ব্যাখ্যা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে ধারণা ব্যবহার করতে হয়। ধারণা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপাদান। গবেষকগণ বিভিন্ন তথ্য সংগঠিত করে, তথ্যগুলোর মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক অনুধাবনযোগ্য করে তুলতে ধারণা ব্যবহার করে থাকেন।
প্রত্যয় হলো : সম্পূর্ণ বিমূর্ত অবস্থা বা ঘটনা, যা বাস্তব উপাদানের ইঙ্গিত প্রদান করে। সহজভাবে বলা যায় ধারণা হলো বিভিন্ন ও বহুবিধ ঘটনার সুসংক্ষিপ্ত বিমূর্ত উপস্থাপন। যার উদ্দেশ্য অনেকগুলো ঘটনা বা বিষয়কে একটি সাধারণ শিরোনামের আওতায় এনে সংক্ষিপ্তকরণের মাধ্যমে চিন্তাকে সহজ করা। উল্লেখ্য দৃশ্যমান ও পর্যবেক্ষণযোগ্য উপাদান সংশ্লিষ্ট প্রত্যয় বা ধারণাগুলো মানুষ সহজে অনুধাবন ও প্রত্যক্ষণ করতে পারেন। অন্যদিকে, গুণগত ও মানসিক উপাদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ধারণাগুলো সহজে বোধগম্য হয় না।
সমাজসেবা |
সমাজকল্যাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্যয়গুলোর মধ্যে সমাজসেবা অন্যতম। অনেক সময় সমাজকল্যাণ ও সমাজসেবাকে অভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়। যদিও উভয়ের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। প্রাক-শিল্প যুগে সমাজসেবাকে সাধারণ অর্থে ব্যবহার করা হত তখন আর্ত-মানবতার সেবায় পরিচালিত যে কোন কার্যক্রমকেই সমাজসেবা হিসেবে বুঝানো হত। বর্তমানে সমাজসেবামূলক খাতে ব্যয়কে মানব মূলধন বিনিয়োগ হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। মনীষী জেমস মিজ্লের ভাষায়, সমাজসেবা খাতে ব্যয় করাকে বর্তমানে মানব মূলধনে বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সমাজসেবার সংজ্ঞা : অক্সফোর্ড অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী সমাজসেবা বলতে জনসমষ্টিকে বিশেষ করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং গৃহায়নে সরকার প্রদত্ত সুসংগঠিত সাহায্য ও পরামর্শ সেবাকে বুঝায়। অন্যদিকে জেরি এবং জেরি সম্পাদিত কলিন্স সমাজবিজ্ঞান অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী ‘সমাজসেবা হলো রাষ্ট্র প্রদত্ত যেকোন ধরনের সেবা, যা সব মানুষের জীবনমান উন্নয়নে নিবেদিত’ ।
সনাতন এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ হতে সমাজের অসুবিধাগ্রস্ত, দুঃস্থ, অসহায় শ্রেণীর কল্যাণে গৃহীত যাবতীয় কার্যাবলিকেই সমাজসেবা বলা হয়। কিন্তু আধুনিক ধারণা মতে সমাজসেবা হলো মানব সম্পদ উন্নয়ন ও সংরক্ষণে নিয়োজিত সংগঠিত কার্যক্রমের সমষ্টি। বর্তমানে সমাজসেবাকে সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি হিসেবে অনেক সময় বিবেচনা করা হয়।
সমাজকর্ম অভিধানের সংজ্ঞানুযায়ী, “সমাজসেবা হলো সমাজকর্মী এবং অন্যান্য পেশাদার ব্যক্তিদের পরিচালিত সুসংগঠিত কার্যক্রম, যা মানুষের কল্যাণ ও স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনে নিয়োজিত। এসব কার্যক্রম মানুষকে অধিক স্বনির্ভর হতে সাহায্য করে;
পৃষ্ঠা ২২
পরনির্ভরশীলতা প্রতিরোধ করে, পারিবারিক সম্পর্ক শক্তিশালী এবং ব্যক্তি, পরিবার, দল বা জনসমষ্টির সদস্যদের সফল সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে” ।
সমাজকর্ম অভিধানে চিহ্নিত সমাজসেবার পরিধিভুক্ত সুনির্দিষ্ট কিছু কার্যক্রম হলো:
ক. মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ পেতে সাহায্য করা।
খ. সন্তান এবং পোষ্যদের সেবাযত্ন করার ক্ষমতা মূল্যায়ন।
গ. স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ সুবিধার উন্নতি।
ঘ. সুবিধাভোগী এবং সম্পদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের সংজ্ঞানুযায়ী, “ব্যক্তি এবং তার পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে সাহায্য করার লক্ষ্যে সংগঠিত কার্যক্রমের সমষ্টিই হলো সমাজসেবা” ।
সমাজবিজ্ঞানী হ্যারী এম. ক্যাসিডি -এর মতে, সমাজসেবা বলতে সেসব সংগঠিত কার্যাবলির সমষ্টিকে বুঝায়, যেগুলো প্রাথমিক এবং প্রত্যক্ষভাবে মানব সম্পদ উন্নয়ন, সংরক্ষণ এবং প্রতিরোধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
হ্যারী এম. ক্যাসিডি যেসব কর্মসূচিকে সমাজসেবার পরিধিভুক্ত করেছেন সেগুলো হলো:
ক. সামাজিক সাহায্য
খ. সামাজিক বীমা
গ. শিশু কল্যাণ
ঘ. সংশোধনমূলক কার্যক্রম
ঙ. মানসিক স্বাস্থ্য
চ. জনস্বাস্থ্য
ছ. শিক্ষা
জ. চিত্তবিনোদন
ঝ. শ্রমিক সংরক্ষণ এবং
ঞ. গৃহসংস্থান
সুতরাং আধুনিক দৃষ্টিকোণ হতে সমাজসেবা হলো, রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত সে সব সংগঠিত কার্যক্রমের সমষ্টি, যেগুলো মানব সম্পদ সংরক্ষণ এবং উন্নয়নে প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত। মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ এবং পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে মানুষকে সহায়তা করা সমাজসেবার লক্ষ্য।
সমাজসেবা কর্মসূচির শ্রেণীবিভাগ
সামাজিক সমস্যা মোকাবেলা এবং সামাজিক ভূমিকা পালনের সামর্থ্য শক্তিশালীকরণে সাহায্য করার লক্ষ্যে সমাজসেবা কর্মসূচি পরিকল্পিত ও বাস্তবায়িত হয়। উদ্দেশ্য এবং প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ হতে সমাজসেবা কর্মসূচিগুলোকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
১. সামাজিকীকরণ এবং মানব বিকাশের জন্য গৃহীত সমাজসেবা কর্মসূচি : এ ধরনের সমাজসেবা কর্মসূচিগুলো শিশু ও কিশোর, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী, অক্ষম ইত্যাদি শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর সামাজিকীকরণ ও বিকাশে সাহায্য করে। এ ধরনের কর্মসূচিগুলো সামাজিক ও সমষ্টির মূল্যবোধ আত্মস্থকরণ থেকে ব্যক্তিগত বিকাশে সাহায্য করে। পরিবার কল্যাণ, শিশু কল্যাণ, যুবকল্যাণ, দিবাযত্ন কেন্দ্র ইত্যাদি এশ্রেণীর সমাজসেবা কর্মসূচি।
পৃষ্ঠা ২৩
২. প্রতিকার, সাহায্য, পুনর্বাসন এবং সামাজিক প্রতিরক্ষণের জন্য গৃহীত সমাজসেবা কর্মসূচি : বিভিন্ন শ্রেণীর এবং বিভিন্ন পর্যায়ে সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সমাজসেবা কর্মসূচি এর পরিধিভুক্ত। এ ধরনের সমাজসেবা কর্মসূচি
দীর্ঘমেয়াদী এবং স্বল্পমেয়াদী উভয় ধরনের হয়। পারিবারিক সেবা প্রতিষ্ঠান, মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, প্রবেশন ও প্যারোল কার্যক্রম, শিশু কল্যাণ কর্মসূচি, হাসপাতাল, স্কুল, প্রবীণ সেবা প্রতিষ্ঠান এ ধরনের সমাজসেবা কর্মসূচির উদাহরণ।
৩. মানুষের প্রয়োজন পূরণের জন্য সম্পদ সরবরাহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমাজসেবা কর্মসূচিসমূহ : যেসব প্রতিবন্ধকতা ও অন্তরায় সৃষ্টিকারি উপাদানের প্রভাবে সমাজে প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধা ও সম্পদের যথাযথ ব্যবহার হয় না, সেসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সাহায্যদানের জন্য সমাজসেবা কর্মসূচি গৃহীত হয়। তথ্যসেবা, উপদেশ, আইনগত সেবা, গোষ্ঠীভিত্তিক আইনগত সহায়তা ইত্যাদি এ ধরনের সমাজসেবার উদাহরণ।
সমাজকল্যাণ ও সমাজসেবা
আধুনিক সমাজকল্যাণ ও সমাজসেবার বিভিন্ন সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে উভয়ের কতগুলো অভিন্ন ও সাদৃশ্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে উঠে। যেমন-
ক. সমাজকল্যাণ ও সমাজসেবা উভয়ে প্রাতিষ্ঠানিক এবং সংগঠিত কার্যক্রম।
খ. সমাজকল্যাণ ও সমাজসেবা উভয়ে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে সংগঠিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে।
গ. মানব সম্পদ উন্নয়ন ও সংরক্ষণের প্রতি সমাজকল্যাণ এবং সমাজসেবা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে।
ঘ. মানুষকে তার পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে সহায়তা করা সমাজকল্যাণ ও সমাজসেবার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
ঙ. সমাজকল্যাণ ও সমাজসেবা উভয়ের লক্ষ্য হলো মানুষের কল্যাণ সাধনে সহায়তা করা।
সমাজকল্যাণ ও সমাজসেবার পার্থক্য : সমাজকল্যাণ ও সমাজসেবার মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে সাদৃশ্য থাকলেও উভয়ের মধ্যে বিশেষ কতগুলো পার্থক্য বিদ্যমান। উল্লেখযোগ্য পার্থক্যগুলো হলো :
ক. সমাজকল্যাণ ও সমাজসেবার পার্থক্য নিরূপণ করতে গিয়ে ভারতীয় সমাজকল্যাণ বোর্ডের সাবেক সভানেত্রী মিসেস দুর্গাভাই দেশমুখের মতে, মানবকল্যাণ ও মানব সম্পদ উন্নয়নের সাধারণ কার্যক্রম হলো সমাজসেবা। যেমন- শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি। আর সমাজের অসুবিধাগ্রস্ত ও দুর্বল শ্রেণীর সাহায্যার্থে গৃহীত বিশেষ কর্মসূচি হলো সমাজকল্যাণ। যেমন শিশু কল্যাণ, প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন ইত্যাদি। সমাজকল্যাণ প্রত্যয়টি সাধারণ সমাজসেবা যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি হতে পৃথক। সমাজকল্যাণ সমাজের দুর্বল ও অসুবিধাগ্রস্ত শ্রেণীর স্বার্থে পরিচালিত বিশেষ কার্যক্রম। সমাজকল্যাণের অন্তর্ভূক্ত হলো মহিলা, শিশু, দৈহিক প্রতিবন্ধী, মানসিক প্রতিবন্ধী এবং বিশেষ ধরনের প্রতিবন্ধীদের জন্য গৃহীত সমাজসেবা কার্যক্রম।
খ. সমাজকল্যাণকে ডব্লিউ.এ. ফ্রিডল্যান্ডার সামাজিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সমাজসেবা প্রদানের সুসংগঠিত পদ্ধতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করায় সমাজসেবার চেয়ে সমাজকল্যাণের পরিধির ব্যাপকতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এতে সমাজসেবাকে, সমাজকল্যাণের বৃহত্তর লক্ষ্যার্জনের সুসংগঠিত কার্যক্রম হিসেবে দেখানো হয়েছে।
গ. সমাজকল্যাণ সুসংগঠিত কার্যক্রম হিসেবে সমাজের সার্বিক কল্যাণ নিয়ে ব্যাপৃত। অন্যদিকে, সমাজসেবা সুসংগঠিত কার্যক্রম হিসেবে সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মানব সম্পদ উন্নয়নে নিয়োজিত।
ঘ. সমাজকল্যাণ প্রতিকার, প্রতিরোধ ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের সমন্বয়ে পরিচালিত সুসংগঠিত কার্যক্রম। আর সমাজসেবা উন্নয়ন ও প্রতিরোধমূলক সুসংগঠিত কার্যক্রম নিয়ে ব্যাপৃত।
ঙ. সমাজকল্যাণ হলো সামাজিক, আর্থিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক চাহিদা পূরণে পরিচালিত কর্মসূচি ও সুযোগ সুবিধার সুসংগঠিত ব্যবস্থা। আর সুসংগঠিত ব্যবস্থার বিশেষ দিক হলো সমাজসেবা। সমাজকল্যাণ হলো ব্যবস্থা, আর সমাজসেবা হলো, সমাজকল্যাণ ব্যবস্থার একটি বিশেষ উপাদান। যা মানব সম্পদ উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালায়।
পৃষ্ঠা ২৪
পরিশেষে বলা যায়, যে কোন সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ আনয়নের অপরিহার্য উপাদান হলো মানব সম্পদ। মানব সম্পদ উন্নয়ন ও সংরক্ষণের সঙ্গে সমাজসেবা প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত। সমাজকল্যাণের অন্যতম লক্ষ্য মানব সম্পদ উন্নয়ন। আর মানব সম্পদ
উন্নয়নে সমাজসেবা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে, সমাজসেবা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে আধুনিক সমাজকল্যাণ পরিপূরক এবং সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
সমাজসংস্কার |
পেশাদার সমাজকল্যাণের বিকাশে যেসব উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সেগুলোর মধ্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের সমাজসংস্কার আন্দোলন অন্যতম। পেশাদার সমাজকল্যাণের অনেক কিছুই অতীতের সমাজসংস্কারকদের সাধনা ও প্রচেষ্টার ফল। এজন্য সমাজকল্যাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হিসেবে সমাজসংস্কার চিহ্নিত।
সমাজসংস্কারের সংজ্ঞা
মানুষের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ এবং বহুমুখী প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে প্রত্যেক সমাজে বিভিন্ন ধরনের প্রথা- প্রতিষ্ঠান, রীতি-নীতি প্রচলিত থাকে। সামাজিক অনুমোদনের মাধ্যমে এগুলো সমাজে স্থায়ী রূপ লাভ করে। অনেক সময় শ্রেণী স্বার্থের প্রভাবে অথবা সমাজ পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে প্রচলিত সামাজিক প্রথা-প্রতিষ্ঠান, মূল্যবোধ, রীতি-নীতি প্রভৃতি মানুষের কল্যাণ ও উন্নয়নকে ব্যাহত করে। ফলে এসব ক্ষতিকর প্রথা-প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দেয়। সমাজ ব্যবস্থা বা সমাজকাঠামো হতে অবাঞ্ছিত ও ক্ষতিকর প্রথা-প্রতিষ্ঠান, রীতি-নীতি, মূল্যবোধ প্রভৃতি দূর করার লক্ষ্যে পরিচালিত আন্দোলনকে সমাজসংস্কার আন্দোলন বলা হয়। আর এরূপ আন্দোলনের ফল হলো সমাজসংস্কার।
সোস্যাল ওয়ার্ড ডিকশোনারীর সংজ্ঞা অনুযায়ী, “সমাজসংস্কার হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন অথবা বৃহত্তর সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা বা যে কোন প্রত্যাশিত পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত কার্যক্রম”। সাধারণত সামাজিক দুর্নীতি, অনাচার, সামাজিক অবিচার ও বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে সমাজসংস্কার প্রত্যয়টি ব্যবহার করা হয়।
নিউ স্টান্ডার্ড এনসাইক্লোপিডিয়া এর ব্যাখ্যানুযায়ী, ‘সমাজসংস্কার হলো এমন এক কার্যক্রম, যা সামাজিক মূল্যবোধ, সামাজিক আইন এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সামাজিক শ্রেণী অথবা সমগ্র সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত’। এই বিশ্বকোষের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, সমাজসংস্কার হলো, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, মূল্যবোধ, আইন ও প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন দ্বারা গোটা সমাজ অথবা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর অবস্থা উন্নয়নে পরিচালিত কার্যক্রম। এ সকল অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী এবং সংশ্লিষ্ট সকলের বিবেচ্য, যেমন দারিদ্র। অন্যান্য এমন অবস্থা রয়েছে যেগুলো জনগোষ্ঠীর অংশ বিশেষ সামাজিক ব্যাধি বলে চিহ্নিত করে, যেমন- মাদকাসক্তি।
এনসাইক্লোপিডিয়া অফ সোস্যাল ওয়ার্ক ইন ইন্ডিয়া (১৯৮৭) গ্রন্থে সমাজসংস্কারকে, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নির্ধারিত ভূমিকা, সামাজিক আচার-আচরণের ধরন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাঞ্ছিত পরিবর্তনের সুচিন্তিত ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত কার্যক্রম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ গ্রন্থের ব্যাখ্যানুযায়ী, সমাজসংস্কার হলো উদ্দেশ্য প্রণোদিত সুচিন্তিত কার্যক্রম, যাতে জনশিক্ষা ও প্রভাবিত করার মত প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে মানুষের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, সাংস্কৃতিকভাবে সংজ্ঞায়িত প্রত্যাশিত ভূমিকা এবং আচার-আচরণের ধরন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো হয়।
সমাজ বিজ্ঞানীদের প্রদত্ত সংজ্ঞানুযায়ী সমাজ ব্যবস্থা বা তার কোন অংশের ত্রুটিপূর্ণ ক্রিয়া দূরীকরণ বা মূল উৎপাটনের লক্ষ্যে পরিচালিত সাধারণ আন্দোলন অথবা ঐ আন্দোলনের নির্দিষ্ট ফলকে সমাজসংস্কার বলা হয়।’’
উদাহরণ স্বরূপ ১৮২৯ সালের সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আইনের উল্লেখ করা যায়। রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে ও নেতৃত্বে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদের লক্ষ্যে যে আন্দোলন গড়ে উঠে, তা হলো সমাজসংস্কার আন্দোলন। আর ঐ আন্দোলনের ফলে প্রণীত সতীদাহ উচ্ছেদ আইন-১৮২৯ হলো সমাজসংস্কার। কারণ, এর ফলে সতীদাহের মতো অমানবিক প্রথা সমাজকাঠামো হতে উচ্ছেদ করা হয়।
পৃষ্ঠা ২৫
আধুনিক শিল্প সমাজে সমাজসংস্কার
আধুনিক শিল্প সমাজে এবং প্রাচীন সনাতন সমাজের সমাজসংস্কারের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য রয়েছে। ডেভিড জেরী এবং জুলিয়া জেরীর ব্যাখ্যানুযায়ী, “সামাজিক সমস্যা দূরীকরণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক নীতি বাস্তবায়ন হলো সমাজসংস্কার। সমাজসংস্কার আন্দোলন এবং আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামো এরূপ সমাজসংস্কারের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর এটি হলো আধুনিক শিল্প সমাজের এবং প্রাচীন সনাতন সমাজের সমাজসংস্কারের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য। অতীতে শুধু সমাজসংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজসংস্কারের চেষ্টা করা হতো। কিন্তু আধুনিক শিল্প সমাজে সমাজসংস্কার আন্দোলন এবং আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সমাজসংস্কার করা হয়। যেমন রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সমাজসংস্কার আন্দোলন গড়ে তুলেন, অন্যদিকে বৃটিশ সরকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা হিসেবে সতীদাহ উচ্ছেদ আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করেন।
১৮৮৪ সালে ইংল্যান্ডে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ফ্যাবিয়ান সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ফ্যাবিয়ান সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা মনীষী সিড্নী এবং ব্যাট্রিক ওয়েব এর মতে, সমাজসংস্কার হলো সামাজিক প্রকৌশলগত একটি পদ্ধতি, যা বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের পরিবর্তে সামাজিক সেবা ও বস্ত্তগত দ্রব্যাদির ক্রমোন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করে।
সমাজবিজ্ঞানী ওগবার্ণ এবং নিমকফ-এর মতে, “সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্য হলো সমাজের সংশোধন বা দোষ ত্রুটির অপসারণ”। সমাজ ব্যবস্থা হতে ক্ষতিকর প্রথা-প্রতিষ্ঠান, রীতিনীতি সংশোধন এবং পরিবর্তনের মাধ্যমে বাঞ্ছিত আর্থ-সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করা সমাজসংস্কারের লক্ষ্য। সমাজের সব মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত এবং সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা সমাজসংস্কারের প্রধান লক্ষ্য।
সমাজসংস্কারের লক্ষ্যার্জনে সমাজসংস্কার আন্দোলন দু’ভাবে পরিচালিত হয়।
১. গঠনমূলক জনমত সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষতিকর সামাজিক প্রথা-প্রতিষ্ঠান ও রীতি-নীতির অবসান ঘটানো। প্রাচীন ও মধ্যযুগে জনমত গঠনের মাধ্যমে সমাজসংস্কারের প্রচেষ্টা চালানো হতো। সাধারণত ধর্ম প্রচারকগণ এজাতীয় সংস্কারমূলক আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজসংস্কারের প্রচেষ্টা চালান। যেমন হাজী শরীয়তউল্লাহ পরিচালিত ফরায়েজী আন্দোলন।
২. বর্তমানে প্রয়োজনীয় আইন ও প্রশাসনিক কাঠামো প্রণয়নের মাধ্যমে ক্ষতিকর সামাজিক প্রথা প্রতিষ্ঠানের অবসান বা নিয়ন্ত্রণের দ্বারা সমাজসংস্কার করা হয়। ক্ষতিকর সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে গঠনমূলক জনমত গঠন করে আইন প্রণেতাদের ওপর সামাজিক চাপ প্রয়োগ করে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নে বাধ্য করা হয়। যেমন ১৮২৯ সালের সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধকরণ আইন। আইনগত সমর্থন ব্যতীত সমাজসংস্কার দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
কিভাবে সমাজসংস্কার আন্দোলন গড়ে উঠে?
সমাজসংস্কার আন্দোলন নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সমাজকাঠামোর পরিবর্তন আনয়নে প্রয়াসী। তিনটি পর্যায়ের মাধ্যমে সমাজসংস্কার আন্দোলন বাঞ্ছিত লক্ষ্যে উপনীত হয়।
প্রথম পর্যায় : সমাজসংস্কারের সূচনা পর্বে সমাজ চিন্তাবিদ বা সমাজহিতৈষী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ প্রচলিত ক্ষতিকর সামাজিক প্রথার প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করেন। সভা-সমিতি, দলীয় আলোচনা, সংবাদপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে নির্দিষ্ট প্রথার ক্ষতিকর প্রভাব যুক্তি সহকারে জনসমক্ষে তুলে ধরা হয়। বর্তমানে গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত বস্তুনিষ্ঠ তথ্যাদির ভিত্তিতে জনমত গঠনের প্রচেষ্টা চালানো হয়। গণমাধ্যম এবং গবেষণা সমাজসংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে। এভাবে সমাজসংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়।
দ্বিতীয় পর্যায় । এ পর্যায়ে সমাজসংস্কার আন্দোলন একটি সামগ্রিক রূপ লাভ করে এবং প্রত্যাশিত লক্ষ্যের দিকে সংগঠিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে চলে এবং সংশ্লিষ্ট সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে গঠনমূলক জনমত গড়ে উঠে। এরূপ গঠনমূলক জনমত প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের জন্য আইন প্রণেতাদের ওপর সামাজিক চাপ সৃষ্টি করে।
পৃষ্ঠা ২৬
তৃতীয় পর্যায় : সমাজসংস্কার আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে জনমতের চাপে এবং সমাজের যৌক্তিক প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক কাঠামো অর্থাৎ আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা হয়। আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সমাজসংস্কার আন্দোলন চূড়ান্ত লক্ষ্যার্জনে সক্ষম হয়।
সমাজকল্যাণ ও সমাজসংস্কার
সমাজসংস্কার এবং সমাজকল্যাণের উদ্দেশ্য হলো সমাজের উন্নয়ন ও কল্যাণের ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি। তবে প্রকৃতি ও পদ্ধতিগত দৃষ্টিকোণ হতে উভয়ের মধ্যে কতগুলো পার্থক্য রয়েছে। উভয়ের মধ্যকার পার্থক্য নিম্নের দৃষ্টিকোণ হতে চিহ্নিত করা যায়।
১. সমাজকল্যাণের লক্ষ্য হলো সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ। সমাজের মঙ্গলের জন্য গৃহীত সকল সংগঠিত প্রচেষ্টাই সমাজকল্যাণের পরিধিভুক্ত। অন্যদিকে, সমাজসংস্কারের লক্ষ্য ক্ষতিকর সামাজিক প্রথা-প্রতিষ্ঠানের উচ্ছেদ সাধন। সুতরাং সমাজকল্যাণের বৃহত্তর লক্ষ্যার্জনের একটি সহায়ক কর্মসূচি হলো সমাজসংস্কার।
২. সমাজকল্যাণ যতটুকু সম্ভব প্রচলিত সমাজকাঠামোর আওতায় মানুষের কল্যাণ আনয়নে সচেষ্ট। পক্ষান্তরে, সমাজসংস্কার প্রচলিত সমাজকাঠামো বা সমাজ ব্যবস্থার ক্ষতিকর অংশের পরিবর্তন আনয়নে প্রয়াসী।
৩. সমাজসংস্কারের ফলে সমাজ ব্যবস্থার নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আসে, তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এরূপ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া মোকাবেলা করার কোন ব্যবস্থা সমাজসংস্কারে থাকে না। যেমন সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হিসেবে হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ সমস্যা দেখা দেয়। সমাজকল্যাণ পরিকল্পিত পরিবর্তন আনয়নে এবং পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে মানুষকে সাহায্য করে। ফলে এরূপ সমস্যা সৃষ্টির সম্ভাবনা কম থাকে।
৪. সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে আইনগত সমর্থন অপরিহার্য। কারণ আইনগত সমর্থন ছাড়া সমাজসংস্কারের ফলে যে পরিবর্তন আসে তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। কিন্তু সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে এরূপ আইনগত সমর্থন সবসময় অপরিহার্য নয়।
৫. সমাজকল্যাণের বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনের মধ্যবিন্দু হলো সমাজসংস্কার। সমাজের প্রচলিত ক্ষতিকর প্রথা-প্রতিষ্ঠান, রীতি-নীতি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে পেশাদার সমাজকর্মের সহায়ক পদ্ধতি সামাজিক কার্যক্রম প্রয়োগ করা হয়। আবার সমাজসংস্কারের ফলে সমাজের মধ্যে যে পরিবর্তন আসে তার ফল হলো সমাজকল্যাণ। যেমন যৌতুক প্রথার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলা সমাজকল্যাণের পরিধিভুক্ত। এরূপ সচেতনতার ফলে গড়ে উঠা যৌতুক বিরোধী আন্দোলন সমাজসংস্কারের পরিধিভুক্ত। আর যৌতুক বিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রণীত যৌতুক বিরোধী আইনের ফল হলো সমাজকল্যাণ।
আধুনিক সমাজকল্যাণ ও সমাজসংস্কারের সম্পর্ক
সমাজসংস্কার ও সমাজকল্যাণের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও উভয়ের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। আধুনিক সমাজকল্যাণের লক্ষ্য, সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থে সমাজকাঠামোর মধ্যে পরিকল্পিত পরিবর্তন এবং পরিবর্তিত অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য বিধানে মানুষকে সহায়তা দান। আধুনিক সমাজকল্যাণের সহায়ক পদ্ধতি সামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গে সমাজসংস্কারের সাদৃশ্য থাকায় উভয়ের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে। আধুনিক সমাজকল্যাণের বিকাশে সমাজসংস্কারকদের অনেক কিছু পথ নির্দেশিকা হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে যা কিছু দেখতে পাওয়া যায়, তার অনেক কিছুই অতীতের সমাজসংস্কারকদের সাধনা ও চেষ্টার ফল।
পরিশেষে বলা যায় সমাজকল্যাণ হলো পরস্পর নির্ভরশীল ও সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন উপদানের সমন্বয়ে গঠিত বৃহত্তর ব্যবস্থা। সমাজকল্যাণ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সমাজসংস্কার। সমাজকল্যাণের অপরিহার্য উপাদান পরিবর্তন, যা ছাড়া সমাজের কল্যাণ সম্ভব নয়। আর পরিবর্তনের বিশেষ প্রক্রিয়া হলো সমাজসংস্কার। সমাজসংস্কারের মাধ্যামে অর্জিত পরিবর্তনের ইতিবাচক ফল হলো সমাজকল্যাণ।
পৃষ্ঠা ২৭
সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ |
সমাজকাঠামোর অপরিহার্য উপাদান হলো মূল্যবোধ। মানুষের সামাজিক সম্পর্ক ও আচার-আচরণ প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য সব সমাজে বিভিন্ন ধরনের বিধি নিষেধ থাকে। তবে এসব বিধি নিষেধ ছাড়াও প্রতিটি সমাজের স্বতন্ত্র মূল্যবোধ থাকে যেগুলো মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচার-আচরণ পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন ধরনের মূল্যবোধকে আশ্রয় করেই মানুষকে সমাজে বাস করতে হয়। মূল্যবোধ নিরপেক্ষ থাকা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আভিধানিক অর্থে মূল্যবোধ হলো, আচরণের নৈতিক অথবা পেশাগত মান। মানব জীবনে মূল্যবোধের অপরিসীম প্রভাবের জন্যই সমাজকল্যাণের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হিসেবে এটি বিবেচিত। পেশাদার সমাজকর্ম অনুশীলনের মৌলিক প্রত্যয় হলো মূল্যবোধ।
সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সংজ্ঞা
মূল্যবোধ আপেক্ষিক ধারণা। সমাজভেদে মূল্যবোধ বিভিন্ন ধরনের হয়। বৃহত্তর সামাজিক মূল্যবোধ, দলীয় মূল্যবোধ, পেশাগত মূল্যবোধ, প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ ইত্যাদি পর্যায়ে মূল্যবোধ বিস্তৃত।
সামাজিক মূল্যবোধ : সাধারণভাবে যেসব নীতিমালা, বিশ্বাস, আদর্শ, ধ্যান-ধারণা, সংকল্প, মানুষের সামাজিক সম্পর্ক ও আচার-আচরণ পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলোর সমষ্টিগত রূপ হলো সামাজিক মূল্যবোধ। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজ মনোবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে সামাজিক মূল্যবোধের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
সমাজকর্ম অভিধানের সংজ্ঞানুযায়ী, “মূল্যবোধ হলো সেসব প্রথা, আচরণগত মান ও নীতিমালা যেগুলো কোন সংস্কৃতির লোক, শ্রেণী অথবা ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রত্যাশিত বলে বিবেচিত হয়” ।
সমাজ বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ই. মেরীল এর মতে, “সামাজিক মূল্যবোধ হলো মানুষের ধ্যান-ধারণা এবং বিশ্বাসের এমন একটি ধরন, যেগুলো দলীয় কল্যাণের জন্য সংরক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ বলে মানুষ বিবেচনা করে” মেটা স্পেন্সার এর মতে, “মূল্যবোধ হলো মানদন্ড, যা আচরণ মূল্যায়নের এবং বিভিন্ন সম্ভাব্য লক্ষ্য হতে লক্ষ্য পছন্দ করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়” সমাজবিজ্ঞানী আর.এম. উইলিয়ামের এর মতে, “মূল্যবোধ মানুষের ইচ্ছার একটি প্রধান মানদন্ড, যার আদর্শে মানুষের আচার-ব্যবহার ও রীতি-নীতি পরিচালিত এবং যার মানদন্ডে সমাজস্থ মানুষের কার্যাবলির ভালমন্দ বিচার করা হয়” ।
মনীষী মিলটন “দ্যা নেচার অফ হিউম্যান ভেলুজ” গ্রন্থে (১৯৭৩) সুনির্দিষ্টভাবে মূল্যবোধের ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, “মূল্যবোধ হলো এক ধরনের বিশ্বাস; যা ব্যক্তি মানুষের সার্বিক বিশ্বাস ব্যবস্থার কেন্দ্রে অবস্থান করে একজনের কিরূপ আচরণ করা উচিত এবং কিরূপ করা উচিত নয় সে সম্পর্কে অথবা মর্যাদা অর্জন করা বা না করা সম্পর্কে বিশ্বাসবোধের জন্ম দেয়। মূল্যবোধগুলো প্রত্যেক মানুষের অন্তরে থেকে জীবন কিরূপ হওয়া উচিত এবং ব্যক্তি জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছার কার্যাবলীর নির্দেশনা হিসেবে ভূমিকা পালন করে” । তাঁর ভাষায়, সমাজের প্রত্যেক মানুষের কিভাবে জীবনযাপন করা উচিত তার একটি নির্দেশনা দান করে মূল্যবোধ।
সমাজে প্রচলিত রীতি-নীতি, মনোভাব এবং সমাজ অনুমোদিত অন্যান্য ব্যবহারের সমন্বয়ে সামাজিক মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়। সামাজিক মূল্যবোধ সদস্যদের মনে এমন একটি প্রেক্ষিত তৈরি করে, যা যে কোন পরিস্থিতিতে তাদের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে। শ্রমের মর্যাদা, সহযোগিতা, সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ, সামাজিক দায়িত্ববোধ, সামাজিক সাম্য, আইনের শাসন ইত্যাদি সামাজিক মূল্যবোধের ভিত্তি।
ধর্মীয় মূল্যবোধঃ সমাজ রূপায়নে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানগুলোর মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ অন্যতম। মানুষের সামাজিক ধ্যান-ধারণা, চিন্তা ও চেতনা, পরিবর্তন ও বিকাশ ইত্যাদিতে ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রভাব সুস্পষ্ট।
ধর্মীয় অনুশাসন ও নির্দেশনার ভিত্তিতে গড়ে উঠা যেসব বিশ্বাস, দর্শন, চিন্তাধারা মানব আচরণের ভাল মন্দ এবং উচিত-অনুচিতের মূল্য আরোপ করে, সেগুলোকেই ধর্মীয় মূল্যবোধ বলা হয়। ধর্মীয় মূল্যবোধ হলো ধর্মীয় অনুশাসন ও নির্দেশের ভিত্তিতে গড়ে উঠা সামগ্রিক বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি, যা মানুষের আচার-আচরণ পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। মূলতঃ যে সব ধর্মীয় নীতি ও নির্দেশনা সামাজিক মূল্যবোধ হিসেবে মানব আচরণের নমুনা দান, সামাজিক শৃঙ্খলা বিধান এবং সামাজিক সংহতিকে টিকিয়ে রাখে সেগুলোকেই ধর্মীয় মূল্যবোধ নামে আখ্যায়িত করা হয়। মূল্যবোধ হিসেবে ক্রিয়াশীল ধর্মীয় নীতি, নির্দেশনাগুলো সকল ধর্মেই প্রায়
পৃষ্ঠা ২৮
অভিন্ন প্রকৃতির। সকল ধর্মের অভিন্ন মূল্যবোধ হিসেবে সাম্য, মানবীয় মর্যাদার স্বীকৃতি, সামাজিক দায়িত্ব, সম-অধিকার, পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতা, শ্রমের মর্যাদা, আর্তের সেবা, ভাতৃত্ব ইত্যাদি স্বীকৃত। এসব মূল্যবোধগুলো ব্যক্তি ও সমাজ জীবনকে কল্যাণময়ী রূপদানের নির্দেশিকা হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় মূল্যবোধের পার্থক্য
ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক মূল্যবোধ অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত হলেও উভয়ের মধ্যে কতগুলো মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। নিচে উভয়ের মধ্যকার প্রধান পার্থক্যগুলো তুলে ধরা হলো :
১. ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো ধর্মীয় বিশ্বাস, অনুশাসন, নীতি ও নির্দেশনার ভিত্তিতে গড়ে উঠে। ফলে ধর্মীয় মূল্যবোধ অপরিবর্তনীয় ও শাশ্বত মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচিত হয়। এজন্য দেখা যায় একই ধর্মের অনুসারীরা সর্বজনীনভাবে অভিন্ন মূল্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত হয়। পক্ষান্তরে, সামাজিক মূল্যবোধ নির্দিষ্ট সমাজের রীতি-নীতি, আদর্শ এবং অনুমোদিত ব্যবহারের মাধ্যমে গড়ে উঠে। ফলে সমাজভেদে সামাজিক মূল্যবোধ বিভিন্ন ধরনের হয়। এমনকি একই সমাজের বিভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন মূল্যবোধের উপস্থিতি দেখা যায়।
২. ধর্মীয় মূল্যবোধ অপেক্ষাকৃত চিরন্তন এবং সর্বজনীন। অন্যদিকে, সামাজিক মূল্যবোধ পরিবর্তনশীল। সামাজিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটে।
৩. ধর্মীয় মূল্যবোধ গঠনে সামাজিক নীতি ও নির্দেশনা প্রভাব বিস্তার করে না। ধর্মগ্রন্থ, ধর্ম প্রচারকদের বাণী এবং নির্দেশনাই ধর্মীয় মূল্যবোধের মূল ভিত্তি। পক্ষান্তরে, সামাজিক মূল্যবোধ গঠনে ধর্মীয় নীতি, নির্দেশনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধর্মীয় নীতি নির্দেশনা সামাজিক মূল্যবোধ হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে। অর্থাৎ ধর্মীয় অনুশাসন ও নীতি নির্দেশনা সামাজিক মূল্যবোধ গঠনের ভিত্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
মূলতঃ বিভিন্ন ধর্মের সর্বজনীন ও শাশ্বত মূল্যবোধগুলো সমাজের অনুমোদিত আচার আচরণের মাধ্যমে সামাজিক মূল্যবোধের রূপ গ্রহণ করে। ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো যখন পরোক্ষভাবে মানুষের সামাজিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে, তখন সেগুলো সামাজিক মূল্যবোধের রূপ লাভ করে।
সামাজিক মূল্যবোধের বৈশিষ্ট্য
সামাজিক মূল্যবোধের লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো
১. আপেক্ষিক : সামাজিক মূল্যবোধ একটি আপেক্ষিক প্রত্যয়। সমাজভেদে এটি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। আবার একই মূল্যবোধ সমাজভেদে ইতিবাচক ও নেতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন আমাদের দেশে অতিথিদের মদ পরিবেশন করা নেতিবাচক মূল্যবোধ। কিন্তু পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে অতিথি আপ্যায়নে মদ পরিবেশন গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচিত। অনেক সময় একই সমাজের বিভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন মূল্যবোধের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
২. অলিখিত সামাজিক বিধান : সামাজিক মূল্যবোধ কোন সমাজেই লিখিত থাকে না। সমাজস্থ মানুষের স্থায়ী কতগুলো মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্বাসের মাধ্যমে মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। তবে সামাজিক মূল্যবোধ সমাজের লিখিত বিধান না হলেও এগুলো উপেক্ষা করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। তবে অনেক ক্ষেত্রে লিখিত আকারে আইনের মধ্যে হতে পারে।
৩. মূল্যবোধের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পাদিত আচরণ পরিমাপযোগ্য : সামাজিক মূল্যবোধ মানবিক অনুভূতিসম্পন্ন সুশৃঙ্খল আদর্শ ভিত্তিক প্রত্যয়। এটি সরাসরি পরিমাপযোগ্য নয়। তবে মূল্যবোধের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের আচার-আচরণ পরিমাপ করা যায়। মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করে সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে আমরা ধারণা লাভ করতে পারি। মূল্যবোধ একটি বিমূর্ত অবস্থা কিন্তু তা অবশ্যই পরিমাপযোগ্য। কেননা, যা পরিমাপ করা যায় না তা বাস্তব নয়। অথচ মূল্যবোধ বাস্তব। মূল্যবোধের অবস্থান ও ব্যবহার পরিমাপযোগ্য।
পৃষ্ঠা ২৯
৪. পরিবর্তনশীল : সামাজিক মূল্যবোধ পরিবর্তনশীল। সামাজিক পরিবর্তন ও সমাজস্থ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক মূল্যবোধও পরিবর্তিত হয়। ফলে বর্তমানে যা ইতিবাচক মূল্যবোধ, ভবিষ্যতে তা নেতিবাচক মূল্যবোধের রূপ গ্রহণ করতে পারে।
৫. সামাজিক মানদন্ড : সমাজস্থ মানুষের আচার-আচরণ ও কর্মকান্ডের ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিত, ন্যায়-অন্যায় বিচারের মাপকাঠি হলো সামাজিক মূল্যবোধ। মূল্যবোধ সামাজিক মানদন্ড স্বরূপ। যেমন আর্তের সেবা করা প্রশংসনীয় কাজ। কিন্তু না করা দন্ডনীয় অপরাধ না হলেও সামাজিক দিক হতে নিন্দনীয় কাজ বলে বিবেচিত।
৬. সামাজিক মূল্যবোধ হলো নৈতিকতা : সামাজিক মূল্যবোধ আইন নয়, বরং সামাজিক নৈতিকতা। সামাজিক মূল্যবোধের বিরোধিতা আইন লঙ্ঘন নয়, তবে নীতিবোধের পরিপন্থী। যেমন বয়োজ্যেষ্ঠদের শ্রদ্ধা করার আইনগত ভিত্তি না থাকলেও নৈতিক ভিত্তি রয়েছে।
৭. জাতীয় সত্তার দর্পণ : ইতিবাচক সামাজিক মূল্যবোধ জাতীয় সত্তার বিকাশ ও পরিপূর্ণতা আনয়নের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। সামাজিক মূল্যবোধের প্রভাবে মানুষের মধ্যে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ জাগরিত হয়। ইতিবাচক সামাজিক মূল্যবোধ ছাড়া কোন জাতির সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মর্যাদা বিকশিত হতে পারে না। এজন্য সামাজিক মূল্যবোধকে জাতীয় সত্তার দর্পণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।