Logo Sponsored by Chowdhury and Hossain, Advanced Publications

Somaj Kollan 1st Part 1st Chapter more


পৃষ্ঠা ৩০

সমাজকর্ম অনুশীলনে মূল্যবোধের শ্রেণী বিভাগ
সমাজকর্ম অনুশীলনের পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যবোধকে মনীষীরা বিভিন্ন দিক হতে শ্রেণী বিভাগ করেছেন। সমাজকর্ম অনুশীলনে অনুসৃত মূল্যবোধগুলোকে তিনটি দিক হতে আলোচনা করা যায়।
১. পরম মূল্যবোধ : যেসব মূল্যবোধ সামাজিক দল বা গোষ্ঠীর দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্যে পৌঁছার সাধারণ নির্দেশনা দান করে, সেসব মূল্যবোধকে পরম মূল্যবোধ বলা হয়। এনসাইক্লোপিডিয়া অফ সোস্যাল ওয়ার্ক এর ব্যাখ্যানুযায়ী, এগুলো বৃহত্তর পরিসরে অনুসৃত চূড়ান্ত মূল্যবোধ। সমাজ কর্মে পরম মূল্য বোধের উদাহরণ হলো মানব মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শন, সাম্য, মানুষের মধ্যে বৈষম্য না করা ইত্যাদি।
২. সুনির্দিষ্ট মূল্যবোধ : যেসব মূল্যবোধ অধিক সুনির্দিষ্ট এবং স্বল্পকালীন লক্ষ্য নির্দেশ করে, সেগুলো সুনির্দষ্ট মূল্যবোধ। এনসাইক্লোপিডিয়া অফ সোস্যাল ওয়ার্ক গ্রন্থের ব্যাখ্যানুযায়ী সমাজকর্মে এসব মূল্যবোধগুলো সেবাগ্রহীতার স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্যকর গৃহায়নের অধিকার সংশ্লিষ্ট নীতি, মানসিক চিকিৎসাধীন রোগীর বিশেষ ধরনের চিকিৎসা গ্রহণ না করার অধিকার প্রভৃতি এজাতীয় মূল্যবোধ।
৩.     কর্ম সম্পাদনের উপায় হিসেবে মূল্যবোধ বা ইন্সট্রুমেন্টাল ভেলুয : যেসব মূল্যবোধ নির্দিষ্ট লক্ষ্যার্জনের উপায় বা হাতিয়ার হিসেবে অনুসরণ করা হয়, সেগুলোকে ইন্সট্রুমেন্টাল ভেলুয বলা হয়। এনসাইক্লোপিডিয়া অফ সোস্যাল ওয়ার্ক এর ব্যাখ্যানুযায়ী, প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছার প্রত্যাশিত উপায় নির্ধারণ করা ইন্সট্রুমেন্টাল ভেলুয। সমাজকর্মে এরূপ মূল্যবোধের উদাহরণ হলো, সেবাগ্রহীতার গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার এবং সম্মতি বা মতামত প্রদানের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন।
সমাজকল্যাণ ও সামাজিক মূল্যবোধ
সমাজকল্যাণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হলো সামাজিক মূল্যবোধ। সমাজকল্যাণ প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ ব্যবস্থার আওতায় সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা চালায়। একেবারে মূল্যবোধ নিরপেক্ষ হওয়া সমাজকর্মীদের পক্ষে সম্ভব নয়। অধিকন্তু সমাজকর্মীরা সামাজিক মানুষ। সামাজিক মানুষের কল্যাণেই তারা নিয়োজিত। আর যেখানে সামাজিক মানুষ থাকবে, সেখানে তাদের মূল্যবোধও থাকবে। যে সমাজের মানুষ সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে যতবেশি সচেতন, সে সমাজ তত বেশি উন্নত ও প্রগতিশীল।
সমাজকল্যাণের উদ্দেশ্য হলো মানুষের সুপ্ত প্রতিভা ও ব্যক্তিসত্তার বিকাশ সাধনে সহায়তা করা। সামাজিক মূল্যবোধ ছাড়া ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। এটি সমাজ জীবন বিকাশের অপরিহার্য শর্ত।
সমাজকল্যাণ পরিকল্পিত পরিবর্তন এবং পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে মানুষকে সাহায্য করে। এজন্য সমাজকর্মীদের যেমন প্রচলিত মূল্যবোধের প্রতি সচেতন থাকতে হয়, তেমনি প্রচলিত ক্ষতিকর ও নেতিবাচক মূল্যবোধগুলোর পরিবর্তন সাধনের প্রচেষ্টা চালাতে হয়।
সমাজকল্যাণ পরিকল্পনা ও কর্মসূচির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন তথা সাফল্য নির্ভর করে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং সক্রিয় সহযোগিতার ওপর। প্রচলিত মূল্যবোধের পরিপন্থী কোন কল্যাণধর্মী কর্মসূচি গ্রহণ করা হলে জনগণ তা বাস্তবায়নে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে না। যেমন প্রথম পর্যায়ে গ্রাম বাংলায় পরিবার-পরিকল্পনা কর্মসূচি সামাজিক মূল্যবোধের প্রভাবে সর্বস্তরের জনগণ কর্তৃক সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয়নি। সুতরাং সমাজের সঠিক কল্যাণে যেমন
ঊনিশ শতকে সতীদাহের মতো অমানবিক প্রথার উচ্ছেদ সাধনের লক্ষ্যে রাজা রামমোহন রায় তাঁর সহযোগীদের নিয়ে এক আন্দোলন শুরু করেন। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কার ইতিহাসে সতীদাহ উচ্ছেদ আন্দোলন নামে পরিচিত। তাঁর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট জনমত এবং সতীদাহ প্রথা সম্পর্কে বাস্তব প্রত্যক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে তদানীন্তন বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আইন পাশ করেন। এতে সতীদাহ প্রথাকে দোষনীয় এবং কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়। এ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সতীদাহ প্রথার মতো অমানবিক নিষ্ঠুর প্রথার বিলোপ ঘটে। প্রাচীনপন্থী হিন্দুরা বিলেতের প্রিভি কাউন্সিলের নিকট আপীল করলে তা অগ্রাহ্য হয়। এ আইনে সতীদাহকে ‘নিন্দনীয় নরহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। যারা ঔষুধ সহযোগে সতীকে অজ্ঞান করে জীবন্ত দগ্ধ করতো, তাদের সরাসরি খুনী হিসেবে এবং যারা সহযোগিতা করতো তাদেরকে আত্মহত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্তের অপরাধে অপরাধী করা হয়।
সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আইন সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে বিশেষ করে নারীকল্যাণ ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন-১৮৫৬
১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আইন পাশ হওয়ার ফলে হিন্দু বিধবা অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেও তাদের অভিশপ্ত জীবন ধারার মোটেও উন্নতি হয়নি। হিন্দু সমাজে বিধবাদের দ্বিতীয় বিবাহের সুযোগ না থাকায় তাদের অসহনীয় ও মানবেতর জীবন-যাপন করতে হতো। আজীবন তাদের মৃত্যুযন্ত্রণা, সামাজিক লাঞ্ছনা এবং অপবাদ সইতে হতো।
প্রগতিবাদী ও মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন সমাজসংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দু বিধবাদের অসহনীয় দূরাবস্থা এবং দুর্বিষহ জীবন-যন্ত্রণা অনুধাবন করেন। তিনি হিন্দু বিধবা বিবাহ প্রচলনের লক্ষ্যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেন। সামাজিক, মানবিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ হতে তার আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। তাঁর আন্দোলনের পক্ষে ব্যাপক


পৃষ্ঠা ৫১

জনসমর্থন সৃষ্টি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৫৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের নিকট হিন্দু বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের বাস্তব তথ্য ও যুক্তি সম্বলিত আবেদন পত্র পেশ করেন। ১৮৫৫ সালের ১৭ নভেম্বর বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায়, বিধবা বিবাহ আইনের খসড়া পেশ করা হয়। সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ আইন প্রণয়নের ২৭ বছর পর তদানীন্তন বড়লাট লর্ড ডালহৌসীর আমলে ১৮৫৬ সালে ২৬ জুলাই হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়। এটি একটি নারী কল্যাণধর্মী সমাজসংস্কারমূলক আইন।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-১৯২৯
সমাজসংস্কার ও শিশুকল্যাণে প্রণীত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আইন হলো ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন। বাংলাদেশের সর্বত্র এ আইন বলবৎ রয়েছে। আলোচ্য আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলোঃ
ক.     এ আইনের বিধান অনুযায়ী শিশু বলতে পুরুষের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের কম বয়সের এবং নারীর ক্ষেত্রে ১৬ বছরের কম বয়সের ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে।
খ.     শিশু বিবাহ বলতে এমন বিবাহকে বুঝানো হয়েছে, যাতে পাত্র বা পাত্রী শিশু অর্থাৎ পাত্রের বয়স ১৮ বছরের কম অথবা পাত্রীর বয়স ১৬ বছরের কম।
গ.     যদি ২১ বছর অপেক্ষা বেশি বয়সের কোন পুরুষ যিনি কোন শিশুকে বিবাহ করেন, তাহলে তিনি, একমাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড অথবা উভয়দন্ডে দন্ডনীয় হবেন। (ধারা-৪)
ঘ.     ১৮ বছর অপেক্ষা বেশি কিন্তু ২১ বছর অপেক্ষা কম বয়সের কোন পুরুষ, যিনি কোন শিশুকে বিবাহ করেন, তবে তিনি এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। (ধারা-৩)
ঙ.     যিনি কোন শিশু বা বাল্য বিবাহ অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেন বা পিতা-মাতা বা অভিভাবক বিবাহ সম্পন্নের জন্য কোন কাজ করেন বা সম্পন্ন করার অনুমতি দেন বা বাল্যবিবাহ সম্পন্ন হতে নিবারণ করতে, অবহেলার জন্য ব্যর্থ হন; তাহলে একমাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হবেন। (ধারা-৫)
বঙ্গীয় অনৈতিক পাচার নিরোধ আইন-১৯৩৩
পতিতাবৃত্তির মতো পাপ ব্যবসা হতে নারী সমাজকে নিরাপত্তা দানের লক্ষ্যে ১৯৩৩ সালের বঙ্গীয় অনৈতিক পাচার নিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়। এটি একটি সামাজিক অনাচার নিরোধমূলক এবং নারী কল্যাণধর্মী সামাজিক আইন। আলোচ্য আইনটি মহিলাদের বিশেষ করে কিশোরীদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আইনগত পদক্ষেপ। ১৯৩৩ সালের বঙ্গীয় পাপ ব্যবসা নিরোধ আইনের গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো ‍
ক.     আইনের বিধান মোতাবেক মেয়েদের বলপূর্বক বা প্রলোভন দেখিয়ে অথবা ফুসলিয়ে বা অপহরণ ও ছিনতাই করে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত করা দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।
খ.     প্রকাশ্য স্থানে নারী পুরুষের আপত্তিকর আচরণ, পতিতাদের উপার্জনের ওপর নির্ভরশীলতা এবং পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে মেয়ে সংগ্রহ করা দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
গ.     পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে বাড়ি ভাড়া দেয়া এবং নেয়ার জন্য এ আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
ঘ.     শিশু অপহরণ, অবৈধ যৌন সম্পর্ক এবং কিশোরী ও অপ্রাপ্ত বয়ষ্কদের পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজত করা কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে।


পৃষ্ঠা ৫২
মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ-১৯৬১
মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ আইনগত পদক্ষেপ। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, বিবাহ, তালাক, ভরণ-পোষণ, উত্তরাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে কতিপয় আইনগত পদক্ষেপ এতে নেয়া হয়েছে। এ আইনটি
একাধারে শিশুকল্যাণ, নারীকল্যাণ ও নিরাপত্তামূলক সামাজিক আইন। শিশু ও মহিলাদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ এবং স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণে ১৯৬১ সালের পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ প্রণীত হয়।
আলোচ্য আইনের প্রধান ধারাগুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো
১.     প্রতিটি বিবাহ রেজিস্ট্রী হতে হবে।
২. প্রথম স্ত্রী বেঁচে থাকতে অর্থাৎ একটি বিয়ে বলবৎ থাকতে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না। তবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে স্বামী-স্ত্রীদের মনোনীত প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত সালিশ পরিষদের অনুমতি ক্রমে দ্বিতীয় বিবাহ করা যাবে। সালিশ পরিষদ দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতিদানের সময় বিবেচ্য বিষয়গুলো হলো প্রথম স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব, শারীরিক বা মানসিক অসুস্থ্যতা দাম্পত্য সম্পর্ক রক্ষা প্রভৃতি।
৩.     সালিশ পরিষদের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিবাহ করলে স্ত্রীর দেনমোহরের টাকা পরিশোধে স্বামী বাধ্য থাকবে। অভিযুক্ত হলে স্বামীকে একবছর কারাদন্ড অথবা এক হাজার টাকা অর্থ দন্ড অথবা উভয় প্রকার দন্ডে দন্ডিত হবে। প্রথম স্ত্রী তালাক দাবি করতে পারবে এবং সমস্ত দেনমোহর পরিশোধে স্বামী বাধ্য থাকবে।
৪.     এ আইন অনুযায়ী মৌখিকভাবে তালাক উচ্চারণ করলেই তালাক সম্পন্ন হয় না। কোন স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে, যেকোন পদ্ধতিতে তালাক ঘোষণার পর স্বামীকে যথাশীঘ্র ইউনিয়ন পরিষদের অথবা পৌর চেয়ারম্যানের নিকট লিখিত নোটিশ দিতে হবে। অনুরূপ কপি স্ত্রীকেও দিতে হবে। এ ধারা ভঙ্গ করলে স্বামীকে সর্বাধিক একবছর কারাভোগ অথবা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় ধরনের সাজা ভোগ করতে হবে।
বাংলাদেশে নারী ও শিশুকল্যাণে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। নারী ও শিশুদের সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনগত পদক্ষেপ।
যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০
সমাজের যৌতুক প্রথা এমনভাবে প্রসার লাভ করেছে যে, এটি নিরোধকল্পে বিশেষ আইন প্রণয়নের প্রয়োজন দেখা দেয়। যৌতুকের মতো অসহনীয় এবং অমানবিক প্রথা নিরোধকল্পে সরকার ‘‘যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০’’ নামে বিশেষ আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়েছেন। অবহেলিত ও নির্যাতিত নারী সমাজের অধিকার ও কল্যাণের লক্ষ্যে যেসব আইন প্রণীত হয়েছে যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। যেকোন ধরনের যৌতুক আদান-প্রদান শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে এতে গণ্য করা হয়।
যৌতুক বিরোধী আইন ১৯৮০-এর বিধান মোতাবেক যৌতুক বলতে বিবাহের এক পক্ষের দ্বারা, অপর পক্ষের প্রতি অথবা বিবাহের সময় বা পূর্বে যেকোন সময় উক্ত পক্ষগণের বিবাহের প্রতিদান হিসেবে, বিবাহের যেকোন পক্ষের পিতা-মাতা দ্বারা অপরপক্ষকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দিতে সম্মত হওয়া সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানতকে বুঝানো হয়েছে।
তবে মোহরানা এবং বিবাহের কোন পক্ষ ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি জিনিসের মাধ্যমে যার মূল্য পাঁচশত টাকার অধিক নয়, এরূপ উপহার উক্ত আইন অনুযায়ী যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে না।
যৌতুক নিরোধ আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো


পৃষ্ঠা ৫৩
ক.     যৌতুক প্রদান বা গ্রহণের দন্ড ‍: এ আইনের বিধান অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ করলে, অথবা প্রদান বা গ্রহণে সহায়তা করলে, সে পাঁচ বছর পর্যন্ত মেয়াদী কারাদন্ড, যা এক বছরের কম হবে না বা জরিমানা অথবা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডনীয় হবে।
খ.     যৌতুক দাবির শাস্তি ‍: যদি কোন ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কনে বা বরের পিতা অথবা অবিভাবকের নিকট হতে যৌতুক দাবি করে তাহলে সে পাঁচ বছর মেয়াদ পর্যন্ত এবং এক বছর মেয়াদের কম নয় অথবা অর্থদন্ডে অথবা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডনীয় হবে।
গ.     যৌতুক প্রদান বা গ্রহণের চুক্তি বাতিল ‍: এ আইন বলবৎ হবার ফলে, যৌতুক প্রদান বা গ্রহণের যেকোন চুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে।
বাংলাদেশে যৌতুক প্রথা ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হয়ে মারাত্মক সামাজিক সমস্যারূপে বিস্তার লাভ করেছে। অসংখ্য কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা এবং নারী যৌতুক প্রথার স্বীকার হয়ে অভিশপ্ত জীবন যাপন এবং অকালে মৃত্যুবরণ করছে। নারী নির্যাতনের প্রধান কারণরূপে যৌতুক প্রথা বিরাজ করছে। এমতাবস্থায় ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি যেমন নারী সমাজের নিরাপত্তা ও কল্যাণে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে; তেমনি পারিবারিক সংহতি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার সহায়ক হচ্ছে।
শিশু আইন-১৯৭৪
শিশুদের রক্ষণ, হেফাজত ও তাদের সাথে ব্যবহার এবং কিশোর অপরাধের বিচার ও শাস্তি সম্পর্কিত আইন একীভূত এবং সংশোধন করার জন্য ‘‘১৯৭৪ সালে শিশু আইন’’ প্রণয়ন করা হয়। এটি শিশুদের সার্বিক কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে প্রণীত। এ আইন ১৯৭৬ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর তারিখে ঢাকায় এবং ১৯৮০ সালের ১লা জুন তারিখে বাংলাদেশের সর্বত্র বলবৎ  হবার পর ১৯২২ সালের বঙ্গীয় শিশু আইন এবং ১৯২২ সালের রিফরমেটরী স্কুল আইন রহিত করা হয়। শিশু আইনে মোট ৭৮টি ধারা রয়েছে।
বাংলাদেশে শিশুদের হেফাজত, সংরক্ষণ, তাদের সঙ্গে ব্যবহার এবং কিশোর অপরাধীদের বিচার, শাস্তি ও অপরাধপ্রবণতা সংশোধনের বিশেষ ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালের শিশু আইনটি প্রণীত হয়। বাংলাদেশে শিশু নির্যাতন এবং কিশোর অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আলোচ্য আইনটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। আলোচ্য আইনটি শিশু কিশোর অপরাধীদের অপরাধ প্রবণতা সংশোধনের ক্ষেত্রে নব দিগন্তের সূচনা করে। ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে ১৯৭৪ সালের শিশু আইনের আওতায় জাতীয় কিশোর সংশোধনী ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অনুরূপ দ্বিতীয় কিশোর সংশোধনী প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। গাজীপুর জেলার কোনাবাড়িতে একটি কিশোরী সংশোধনী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে। কিশোর আদালত, কিশোর হাজত এবং সংশোধন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে এটি গঠিত।
বাংলাদশে যে হারে কিশোর অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে অনুপাতে ১৯৭৪ সালের শিশু আইনের বাস্তবায়ন হচ্ছে না। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শিশু আইন কার্যকরীভাবে প্রয়োগের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া কিশোর অপরাধ সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। বাস্তবায়নের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অভাবে সময়োপযোগী এবং বাস্তবমুখী আইন হওয়া সত্ত্বেও এটি কিশোর অপরাধ সংশোধনে বৃহত্তর পরিবেশে তেমন কার্যকরী ভূমিকা পালনে সক্ষম হচ্ছে না।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০
নারী ও শিশু নির্যাতনমূলক অপরাধসমূহ কঠোরভাবে দমনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বিধান প্রণয়নকল্পে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ প্রণীত হয়। ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন অসহনীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কঠোরতম আইন ও কঠোরতম শাস্তির বিধান সম্বলিত আলোচ্য আইনটি প্রণীত হয়। এতে মিথ্যা মামলা দায়েরের অনধিক শাস্তি সাত বছর সশ্রম কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
পৃষ্ঠা ৫৪
দেশের ভবিষ্যত নাগরিক শিশুদের প্রতি সংঘটিত অমানবিক নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে আলোচ্য আইনে কঠোর বিধান রাখা হয়েছে। শিশু ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এটি একটি কঠোর নিবর্তন আইন। এ আইনের ৩৪টি ধারা রয়েছে। আলোচ্য আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন-১৯৯৫ রহিত করা হয়।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর আওতায় অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডসহ অতিরিক্ত একলাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।[i]
সমাজকর্ম
সুসংগঠিত সমাজকল্যাণ ব্যবস্থার বৈজ্ঞানিক ও পেশাগত প্রক্রিয়া হলো সমাজকর্ম। সাহায্যকারী পেশা হিসেবে সমাজকর্ম বিশ্বে স্বীকৃত। শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজের জটিল ও বহুমুখী আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানে মানুষকে সহায়তাদানের পরিপ্রেক্ষিতে সাহায্যকারী পেশা হিসেবে সমাজকর্মের বিকাশ।
সমাজকর্মের সংজ্ঞা
বিভিন্ন লেখক বিভিন্নভাবে সমাজকর্মের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। প্রায় সব সংজ্ঞাতেই সমাজকর্মকে একটি সাহায্যকারী পেশা ও ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে উলেলখ করা হয়েছে।
সমাজকর্ম অভিধানের সংজ্ঞানুযায়ী, ‘‘সমাজকর্ম হলো একটি ব্যবহারিক বিজ্ঞান, যা মানুষকে মনোঃসামাজিক ভূমিকা পালনের একটা কার্যকর পর্যায়ে উপনীত হতে এবং সকল মানুষের কল্যাণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে অর্থবহ সামাজিক পরিবর্তন আনয়নে সাহায্য করে।’’
ডবিলউ.এ. ফ্রিডল্যান্ডারের মতে, ‘‘সমাজকর্ম হলো বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং মানবিক সম্পর্ক বিষয়ক দক্ষতাসম্পন্ন এমন একটি পেশাদারী সেবাকর্ম, যা ব্যক্তিগত ও সামাজিক সন্তুষ্টি এবং স্বাধীনতা লাভে কোন ব্যক্তিকে একক বা দলীয়ভাবে সাহায্য করে।’’
ওয়ার্নার ডবিলউ. বোহেম-এর মতে, ‘‘সমাজকর্ম এমন একটি কার্যক্রম, যা মানুষ এবং তার পরিবেশের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে সৃষ্ট সামাজিক সম্পর্ক ও কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনার মাধ্যমে সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতার উন্নয়নে মানুষকে একক ও দলীয়ভাবে সাহায্য করে।’’
সমাজকর্মের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য তুলে ধরে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন রেক্স এ, স্কিডমোর এবং এম. জি. থ্যাকারী। তাঁদের মতে, ‘‘সমাজকর্ম এমন একটি কলা, বিজ্ঞান ও পেশা, যা মানুষকে কতগুলো বিশেষ পদ্ধতি যে পদ্ধতিগুলোর অন্তর্ভুক্ত হলো ব্যক্তি সমাজকর্ম, দল সমাজকর্ম, সমষ্টি সংগঠন, প্রশাসন এবং গবেষণা প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তিগত, দলীয় (বিশেষ করে পারিবারিক) ও সমষ্টিগত সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে, যাতে তারা সন্তোষজনক ব্যক্তিগত, দলীয় ও সামাজিক সম্পর্ক লাভে সক্ষম হয়।
বিভিন্ন সংজ্ঞার আলোকে বলা যায়, সমাজকর্ম বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, মানবহিতৈষী দর্শন এবং পেশাগত দক্ষতা ও নৈপুণ্যভিত্তিক এমন একটি সাহায্যকারী পেশা, যা কতগুলো বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তিগত, দলগত ও সমষ্টিগত সমস্যা সমাধানে মানুষকে সাহায্য করে, যাতে তারা সন্তোষজনক ব্যক্তিগত, দলীয় ও সামাজিক সম্পর্ক লাভে এবং পরিবেশের সার্বিক কার্যকর অবস্থা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়।
পেশাগত সমাজকর্মের আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা
আধুনিক শিল্প সমাজের ক্রমবিকাশমান জটিলতার ফল হলো সমাজকর্ম। এজন্য বলা হয়, “সোস্যাল ওয়ার্ক হেজ বিন এ প্রোডাক্ট অফ এন ইনক্রেয়েজিং কমপ্লেক্স মডার্ন ইনডাষ্ট্রিয়েল সোসাইটি” শিল্পোন্নত সমাজে পেশা হিসেবে সমাজকর্ম স্বীকৃতি পেলেও সমাজকর্মের পেশাগত সংজ্ঞা দীর্ঘদিন যাবত নিরূপণ সম্ভব হয়নি। ফলে সমাজকর্ম সম্পর্কে কার্যকর ধারণা গড়ে উঠেনি। ১৯৫৫ সালে আমেরিকায় জাতীয় সমাজকর্মী সমিতি গঠিত হয়। ১৯৫৮ সালে সমিতি সমাজকর্মের একটি সাধারণ কার্যকরী সংজ্ঞা

পৃষ্ঠা ৫৫
নিরূপণের চেষ্টা করে। তবে সমাজকর্ম অনুশীলনের মূল ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত হলেও সমাজকর্মের সাধারণ সংজ্ঞা তখন নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।
অবশেষে ১৯৭৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সমাজকর্মী সমিতির পরিচালনা বোর্ড সমাজকর্মের একটি আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন। আলোচ্য সংজ্ঞাটি তিনটি বাক্যের সমন্বয়ে প্রণীত হলেও সমাজকর্ম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ও সার্বিক ধারণা উপস্থাপনে সক্ষম।
সংজ্ঞাটি তিনটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে সমাজকর্মের সাধারণ সংজ্ঞা, দ্বিতীয় অংশে সমাজকর্মের অনুশীলন এবং তৃতীয় অংশে সমাজকর্ম অনুশীলনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
আমেরিকার জাতীয় সমাজকর্মী সমিতি প্রদত্ত সমাজকর্মের সংজ্ঞা তিনটি পর্যায়ে উলেলখ করা হলো

১. সমাজকর্মের সাধারণ সংজ্ঞা ‍: সমাজকর্ম হলো ব্যক্তি, দল বা জনসমষ্টিকে সাহায্য করার এমন একটি পেশাগত কার্যক্রম, যার লক্ষ্য তাদের সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতা পুনরুদ্ধার বা শক্তিশালীকরণ এবং সামাজিক ভূমিকা পালনের অনুকূল সামাজিক পরিবেশ গঠন।
২. সমাজকর্ম অনুশীলন ‍: সমাজকর্মের অনুশীলন নিচের এক বা একাধিক লক্ষ্যার্জনের জন্য সমাজকর্ম মূল্যবোধ, নীতি ও কৌশলের পেশাগত প্রয়োগের সমন্বয়ে গঠিত-
·         জনগণকে বাস্তবসম্মত সেবা লাভে সাহায্য করা।
·         ব্যক্তি, পরিবার ও দলের জন্য উপদেশ এবং মনোচিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
·         সামাজিক ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সেবার মানোন্নয়নে দল ও জনসমষ্টিকে সাহায্য করা।
·         সংশিলষ্ট আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ।
৩. সমাজকর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ‍: সমাজকর্ম অনুশীলনের জন্য যেসব ক্ষেত্রের জ্ঞানার্জন করা প্রয়োজন সেগুলো হলো ‍:
·         মানব বিকাশ এবং আচরণ সম্পর্কিত জ্ঞান।
·         আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত জ্ঞান এবং
·         এসব উপাদানের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কিত জ্ঞান।
উপর্যুক্ত সংজ্ঞা হতে স্পষ্ট হয়ে উঠে, সমাজকর্ম হলো একটা পেশাগত কার্যক্রম, যার জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট বিশেষ জ্ঞান, মূল্যবোধ, দক্ষতা এবং সুচিন্তিত ও বাস্ত-বসম্মত লক্ষ্য। এগুলো সমাজকর্মীর পেশাগত কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। এরূপ পেশাগত কার্যক্রমের প্রতি সমাজের স্বীকৃতি বা অনুমোদন থাকতে হয়। সমাজকর্মের প্রতি সমাজের স্বীকৃতি, পেশাগত সেবার মান সম্পর্কে জনগণের নিকট জবাবদিহিতার সুযোগ এনে দেয়। এতে সমাজকর্মের অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য ও পৃথক সত্তা ফুটে উঠেছে।

পৃষ্ঠা ৫৬
সমাজকর্মের লক্ষ্য
সমাজকর্ম একটি মানবসেবা প্রদানকারী পেশা। সাহায্যকারী পেশা হিসেবে সমাজকর্ম বহুমুখী লক্ষ্যার্জনে অনুশীলন করা হয়। সমাজকর্ম অনুশীলনের প্রধান লক্ষ্যগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো ‍:
১. সকল মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ ‍: সমাজকর্ম একটি প্রায়োগিক বিজ্ঞান, যা মানুষকে এমনভাবে সাহায্য করে, যাতে প্রত্যেক মানুষ আর্থ-সামাজিক ও মনোঃদৈহিক কল্যাণের অধিকারী হতে পারে। সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখায় বলা হয়েছে সমাজকর্ম একটি ব্যবহারিক বিজ্ঞান, যা সকল মানুষের কল্যাণকে শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে কার্যকর সামাজিক পরিবর্তন আনয়নে সাহায্য করে। সমাজকর্মের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মনীষী গর্ডন হ্যামিলটন বলেছেন, সমাজকর্মের উদ্দেশ্য শুধু ব্যক্তি, পরিবার ও দলীয় সদস্যদের সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নে সাহায্য করা নয়। সমাজকর্ম স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক মান বৃদ্ধি, উন্নততর গৃহায়ন ও কর্মপরিবেশ এবং সামাজিক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সমাজের সাধারণ অবস্থা উন্নয়নে সাহায্য করে।
২. সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতা উন্নয়ন ‍: সমাজকর্মের মূল লক্ষ্য হলো সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতা শক্তিশালীকরণ। আমেরিকার জাতীয় সমাজকর্মী সমিতি প্রকাশিত এনসাইক্লোপিডিয়া অফ সোস্যাল ওয়ার্ক গ্রন্থে বলা হয়েছে সমাজকর্মের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তি, পরিবার, দল, সংগঠন এবং সমষ্টিকে কর্মসম্পাদন, দারিদ্র বিমোচন, প্রতিরোধ ও সম্পদ ব্যবহারে সাহায্য করার মাধ্যমে, তাদের সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতার উন্নয়ন, পুনরুদ্ধার, সংরক্ষণ এবং শক্তিশালীকরণ। সামাজিক ভূমিকা বিপর্যয়ের জন্য যেসব উপাদান দায়ী সেগুলো দূর এবং মানুষের পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার ধরন পুনর্গঠনে সাহায্য করার মাধ্যমে ভূমিকা পালন ক্ষমতা উন্নয়নে সাহায্য করে সমাজকর্ম।
৩.     মৌল চাহিদা পূরণে সাহায্য করা ‍: সমাজকল্যাণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও শক্তিশালীকরণ, যাতে সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা মানুষের মৌল চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়। আমেরিকার জাতীয় সমাজকর্মী সমতি প্রকাশিত এনসাইক্লোপিডিয়া অফ সোস্যাল ওয়ার্ক (১৯৯৫) গ্রন্থে সমাজকর্মের যেসব উদ্দেশ্য চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো মৌল চাহিদা পূরণে মানুষকে সাহায্য করা। এতে বলা হয়েছে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ এবং মানুষের সামর্থ্য উন্নয়নের সমর্থনে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা, সামাজিক নীতি, সেবা, সম্পদ ও কর্মসূচি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন সমাজকর্মের অন্যতম লক্ষ্য।
৪. ব্যক্তি ও পরিবেশের মধ্যে কার্যকর মিথষ্ক্রিয়ায় সাহায্য করা ‍: সমাজের প্রত্যেক মানুষের জীবন মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যেকার পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার শক্তিশালীকরণ সমাজকর্ম অনুশীলনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। সমাজকর্মের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলোর মূল ভিত্তি হলো মানুষ এবং তার পরিবেশের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক। সমাজকর্মের লক্ষ্যগুলো মানুষ এবং পরিবেশের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে নির্ধারিত হয়েছে। মনীষী এনি এন মিনহান -এর ভাষায়, সমাজের প্রত্যেক মানুষের জীবন মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যেকার বহুমুখী ও জটিল পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার উন্নয়ন অথবা পুনরুদ্ধার সমাজকর্মের মূল লক্ষ্য।
মানুষ ও পরিবেশের মিথষ্ক্রিয়া যেসব সামাজিক সম্পর্ক দ্বারা গঠিত, সেসব সামাজিক সম্পর্কের প্রতি সমাজকর্ম অনুশীলন বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
পৃষ্ঠা ৫৭
৫. ঝুঁকিপূর্ণ মানব গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি ‍: সমাজকর্ম অনুশীলনের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো সমাজের দুঃস্থ ও অসহায় শ্রেণীর ঝুঁকিপূর্ণ মানব গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন, যাতে করে তারা নিজেদের উন্নয়নে গৃহীত সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। এনসাইক্লোপিডিয়া অফ সোস্যাল ওয়ার্ক গ্রন্থে বলা হয়েছে, সমাজকর্ম অনুশীলনের উদ্দেশ্য হলো সাংগঠনিক বা প্রশাসনিক পরামর্শ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে নীতি, সেবা, সম্পদ এবং কর্মসূচি প্রণয়ন ও অনুসরণ করা; যাতে ঝুঁকিপূর্ণ মানব গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পায়। সমাজকর্ম অনুশীলনের নতুন ধারা হলো সুবিধাভোগী শ্রেণীর ক্ষমতায়ন।
৬. সমাজকর্মের পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার উন্নয়ন ‍: সমাজকর্মের বহুমুখী উদ্দেশ্য অর্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত পেশাগত জ্ঞান এবং দক্ষতার উন্নয়ন সমাজকর্মের অন্যতম লক্ষ্য। পরিবর্তিত পরিবেশের উপযোগী জ্ঞান ও দক্ষতার উন্নয়ন সমাজকর্মের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। কারণ সমাজকর্ম অনুশীলনের উদ্দেশ্যগুলো অর্জনের জন্য যথাযথ জ্ঞান ও দক্ষতার বিকল্প নেই।
৭. পরিকল্পিত সামাজিক পরিবর্তন ‍: সামাজিক পরিবর্তন আনয়নের মাধ্যমে সকল মানুষের কল্যাণকে শক্তিশালীকরণের প্রচেষ্ঠা চালায় সমাজকর্ম। সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী সমাজকর্ম একটি প্রায়োগিক বিজ্ঞান, যা মানুষকে মনোসামাজিক ভূমিকা পালনের কার্যকর পর্যায়ে উপনীত হতে এবং সকল মানুষের কল্যাণকে শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে অর্থবহ সামাজিক পরিবর্তন আনয়নে সাহায্য করে।
৮. সামাজিক আইন প্রণয়নে সাহায্য করা ‍: সমাজের কল্যাণ আনয়নে সামাজিক আইন গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। ব্যক্তি, দল ও জনসমষ্টির স্বার্থে সামাজিক আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় জনগণ যাতে অংশগ্রহণ করতে পারে, সেজন্য সাহায্য করা সমাজকর্ম অনুশীলনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সমাজকল্যাণের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য সামাজিক আইনের বিকল্প নেই।
৯. সমাজসেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন ‍: সমাজকর্মের অন্যতম উদ্দেশ্য প্রচলিত সমাজসেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং শক্তিশালী করণে সাহায্য করা, যাতে সমাজসেবা ব্যবস্থা মানুষের মৌল চাহিদা পূরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। সমাজকর্মের লক্ষ্য হলো সমাজে বিদ্যমান সম্পদ, সেবা এবং সুযোগ সুবিধা প্রদান ব্যবস্থার সঙ্গে মানুষকে সংযুক্তকরণ এবং যোগাযোগ স্থাপনে সাহায্য করা, যাতে এগুলোর সুবিধা গ্রহণ হতে মানুষ বঞ্চিত না হয়।
১০.    সামাজিক নীতিকে প্রভাবিত করা ‍: সমাজকর্ম অনুশীলনের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো সামাজিক নীতি পরিবর্তন, সংশোধন ও উন্নয়নে অবদান রাখা। সামাজিক উন্নয়ন ও পরিকল্পিত সামাজিক পরিবর্তনের নির্দেশক হলো সামাজিক নীতি। এজন্য সামাজিক নীতির উন্নয়নে অবদান রাখা সমাজকর্ম অনুশীলনের লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত। সমাজের দুঃস্থ অসহায় মানব গোষ্ঠী, যারা আর্থ-সামাজিক দিক হতে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় জীবন যাপন করছে এবং সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের কল্যাণ সমাজকর্মের অন্যতম লক্ষ্য। যথাযথ সামাজিক নীতি, পরিকল্পনা, কর্মসূচি প্রণয়ন ও সেবা প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করে দরিদ্র শ্রেণীর উন্নয়ন সমাজকর্মের বৃহত্তর লক্ষ্যের পরিধিভুক্ত।



পৃষ্ঠা ৫৮
সমাজকর্মের বৈশিষ্ট্য
মানবসেবা প্রদানকারী অন্যান্য পেশার মতো সমাজকর্মের কতগুলো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেগুলো সামজকর্মকে অন্যান্য পেশা হতে পৃথক সত্তা দান করেছে। মনীষী রেক্স এ. স্কিডমোর, এম.জি. থ্যাকারী, উইলিয়াম ফেয়ারলী প্রমুখ মনীষী সমাজকর্মের ষোলটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। নিচে পেশাগত সমাজকর্মের বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করা হলো:
১. সামাজিক সম্পর্ক ও সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ ‍: সমাজকর্ম ব্যক্তিগত অথবা সামাজিকভাবে যেখানে যেরূপ প্রয়োজন মানুষকে তাদের সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতা শক্তিশালীকরণে সাহায্য করে। মানুষের সামাজিক সম্পর্ক এবং সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার ফল হলো বিভিন্ন সামাজিক ভূমিকা। আর সামাজিক ভূমিকা হলো সমাজকর্মের পেশাগত মূল বিবেচ্য বিষয়। সামাজিক সম্পর্ক এবং সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ সমাজকর্মের অন্যতম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।
২. একটি বহুমাত্রিক পেশা ‍: বস্ত্তত সমাজকর্ম একটি বহুমুখী অর্থাৎ বহুখাতভিত্তিক মানবিক পেশা। সমাজকর্মীরা বিস্তৃত পরিবেশে বিচিত্র ধরনের মানবিক সমস্যা এবং সামাজিক পরিবর্তনমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সমাজকর্ম সামাজিক ভূমিকা পালনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবজীবনের প্রতিটি দিক এবং উপাদান নিয়ে ব্যাপৃত। মনীষী আরমানডো মুরালেস যৌক্তিক কারণেই বলেছেন, সমাজকর্ম বহুমুখী পেশা, যা জীবনের প্রায় সবদিক এবং জনগণের সকল উপাদান নিয়ে ব্যাপৃত।
৩.     ব্যক্তি এবং পরিবেশের প্রতি গুরুত্বারোপ ‍: সমাজকর্ম অন্যান্য সাহায্যকারী পেশা হতে অনন্য সাধারণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কারণ এতে ব্যক্তি এবং পরিবেশ এদ্বিমুখী ভূমিকার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। ব্যক্তি এবং পরিবেশের মধ্যেকার কার্যকর মিথষ্ক্রিয়াকে শক্তিশালীকরণে সমাজকর্ম সেবা প্রদান করে। ব্যক্তিকে পরিবেশের সঙ্গে কার্যকর মিথষ্ক্রিয়ায় এবং পরিবেশকে মানুষের কার্যকর মিথষ্ক্রিয়ার উপযোগী করে গড়ে তুলতে সাহায্য করে সমাজকর্ম।
৪. মূল্যবোধ নির্দেশিত পেশা ‍: সমাজকর্ম হলো একটি মূল্যবোধ নির্দেশিত এবং মূল্যবোধ প্রভাবিত মানব সেবাদানকারী পেশা। সমাজকর্ম মূল্যবোধ নিরপেক্ষ পেশা নয়। সমাজকর্ম অনুশীলনে যেমন পেশাগত মূল্যবোধের প্রভাব থাকে, তেমনি অপেশাগত মূল্যবোধও প্রভাব বিস্তার করে। আন্তর্জাতিক সমাজকর্ম ফেডারেশন এর মন্তব্য এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। এতে বলা হয়েছে, সমাজকর্ম হলো মূল্যবোধ, তত্ত্ব এবং অনুশীলন-এতিনটির আন্তঃসম্পর্কিত একটি ব্যবস্থা। (সূত্রঃ ইন্টারনেট)
৫. একাধারে কলা, বিজ্ঞান ও পেশা ‍: সমাজকর্ম একটি কলা, বিজ্ঞান ও পেশা, যা বিভিন্ন বিজ্ঞান হতে অর্জিত জ্ঞানকে কতগুলো বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নে মানুষকে সাহায্য করে। সমাজকর্মের অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য মনীষী স্কিডমোর তুলে ধরে বলেছেন, ‘‘সমাজকর্ম একটি কলা; এটি একটি বিকাশমান বিজ্ঞান, একটি পেশা; কারণ পেশার সবগুলো বৈশিষ্ট্যই সমাজকর্ম পূরণ করেছে।’’
৬. সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ হতে মানুষকে বিচার করা ‍: সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ হতে মানুষকে বিচার করা সমাজকর্মের অনন্য বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তি এবং তার আচার-আচরণ ও পরিবেশকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ হতে সমাজকর্মে বিবেচনা করা হয়। সংক্ষেপে বলা যায়, “সোস্যাল ওয়ার্ক স্ট্রেসেস দ্যা টোটাল পারসোন ইন দ্যা ইনভায়রনম্যান্ট”।

পৃষ্ঠা ৫৯
৭. পরিবারের প্রতি গুরুত্বারোপ ‍: ব্যক্তির সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতার উন্নয়ন এবং আচরণ গঠনের মৌলিক উপাদান হিসেবে পরিবারের ভূমিকার প্রতি সমাজকর্মে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। পরিবারকে সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতা উন্নয়নের মৌলিক একক হিসেবে সমাজকর্মে বিবেচনা করা হয়।
৮. বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম ‍: সমাজকর্ম পেশার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানার্জন এবং পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতা লাভের জন্য সুশৃঙ্খল শিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে। মনীষী রেক্স এ স্কাইডমোড় এবং অন্যান্যদের ভাষায়, “সোস্যাল ওয়ার্ক হেজ এ ইউনিক এডুক্যাশনাল প্রোগ্রাম ইনভলভিং ক্লাশ ওয়ার্ক এন্ড পার্টিকেল ফিল্ড ওয়ার্ক এক্সপেরিয়েন্স, উইচ গো হেন্ড ইন হেড।”
৯. পদ্ধতিগত সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া ‍: সমাজকর্ম কতগুলো নির্দিষ্ট পদ্ধতির আওতায় ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যা সমাধানের প্রয়াস চালায়। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভিত্তিতে গড়ে উঠা পদ্ধতিগুলোই সমাজকর্মকে পেশাগত পর্যায়ে উপণীত করেছে।
১০.    পেশাগত সংগঠন ‍ঃ সমাজকর্ম পেশার মান উন্নয়ন, পেশাগত প্রশিক্ষণদান, অনুশীলন, পেশাদার সমাজকর্মীদের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য স্বতন্ত্র পেশাগত সংগঠন রয়েছে। সমাজকর্ম শিক্ষা পরিষদ, সমাজকর্ম স্কুলসমূহের আন্তর্জাতিক পরিষদ, আন্তর্জাতিক সমাজকর্মী ফেডারেশন প্রভৃতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পেশাগত সংগঠন বিশ্বব্যাপী সমাজকর্ম পেশার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে।
১১.    সক্ষমকারী প্রক্রিয়া ‍: সমাজকর্ম একটি সক্ষমকারী প্রক্রিয়া। এতে সমস্যাগ্রস্ত সেবাপ্রার্থী ব্যক্তি, দল ও সমষ্টিকে এমনভাবে সাহায্য করা হয়, যাতে তারা ক্ষমতা ও সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের সমস্যা নিজেরা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। সমাজকর্ম সমস্যাগ্রস্ত সেবাপ্রার্থীর পক্ষে কাজ করে না; বরং তার সঙ্গে কাজ করে।
১২.    সুপ্ত ক্ষমতার প্রতি গুরুত্বারোপ ‍: সমাজকর্মে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির সুপ্ত প্রতিভা ও অন্তর্নিহিত সত্তার বিকাশের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। এতে বিশ্বাস করা হয়, মানুষের সুপ্ত প্রতিভা ও অন্তর্নিহিত সত্তার যথাযথ বিকাশের মাধ্যমে তার সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতা উন্নয়ন সম্ভব।
১৩.    পারিশ্রমিকভিত্তিক সেবা ‍: সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পেশাদার প্রতিনিধি হিসেবে সমাজকর্মীরা নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হতে পারিশ্রমিক পেয়ে থাকে। সুতরাং সেবাগ্রহীতা প্রদত্ত ফি সমাজকর্মীরা ব্যক্তিগত আয় হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না। তবে প্রাইভেট অনুশীলনে নিয়োজিত সমাজকর্মীরা পেশাগত সংগঠন নির্ধারিত পারিশ্রমিক গ্রহণ করে থাকে।
পরিশেষে সমাজকর্মের পৃথক সত্তা ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এইচ. এম. বার্টল্যাট এর উক্তি উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন, ‘‘সমাজকর্ম হলো এমন কতগুলো উপাদানের সমষ্টি, যেগুলোর কোনটিই অসাধারণ নয়। কিন্তু এগুলোর সমবেত অবদান সমাজকর্মকে অন্যান্য যেকোন পেশা হতে স্বতন্ত্র সত্তা দান করেছে।’’


পৃষ্ঠা ৬০
সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্মের সম্পর্ক
সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্মের পারস্পরিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। উভয়ের লক্ষ্য হলো সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ আনয়নে মানুষকে সহায়তা করা। তবে লক্ষ্যার্জনের পদ্ধতি ও কৌশলগত দিক হতে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সনাতন এবং বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ বিধানের সমন্বিত রূপ হলো সমাজকল্যাণ। আর সমাজকল্যাণ করার পেশাগত ও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া হলো সমাজকর্ম। মানবিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যতীত বর্তমান সমাজের জটিল সমস্যাবলির মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সমাজকল্যাণের বৃহত্তর লক্ষ্যার্জনে সমাজকর্ম মূল ভূমিকা পালন করে। সমাজকর্মের সহায়তা ছাড়া পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত উপায়ে সমস্যা সমাধানে মানুষকে সাহায্য করা সম্ভব নয়। সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ আনয়নের মাধ্যমে উন্নত সমাজ গঠনে সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্ম উভয়ে অভিন্ন ভূমিকা পালন করে।
সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্মের পার্থক্য
সমাজকল্যাণ এবং সমাজকর্ম উভয়ে সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে নিয়োজিত। এজন্য অনেক সময় উভয়কে একই অর্থে ব্যবহার করা হয়। সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্মের মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, সমাজকর্ম অভিধানের সংজ্ঞায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সমাজকর্ম অভিধানে সমাজকল্যাণকে মানুষকে সাহায্য দানের সুসংগঠিত কর্মসূচি, সুযোগ সুবিধা ও সেবা ব্যবস্থা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে সমাজকর্মকে মানুষকে সাহায্য করার ব্যবহারিক বিজ্ঞান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্মের বিভিন্ন সংজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে উভয়ের মধ্যকার পার্থক্যগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো
১. সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্মের মূল পার্থক্য হচ্ছে, সমাজকল্যাণ সুসংগঠিত সাহায্য এবং সেবামূলক ব্যবস্থা হলেও সবক্ষেত্রে এটি পেশা নয়। এর জন্য বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, পেশাগত দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের বাধ্যবাধকতা নেই। পক্ষান্তরে, সমাজকর্ম একটি স্বীকৃত পেশা। সমাজকর্মের জন্য বিশেষ জ্ঞান, দক্ষতা ও পেশাগত নৈপুণ্য অর্জন অপরিহার্য।
২. একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা হিসেবে সমাজকল্যাণ সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনে সচেষ্ট। সমাজের সামগ্রিক কল্যাণে নিয়োজিত যাবতীয় পেশাদারঅপেশাদার সেবাকর্ম সমাজকল্যাণ ব্যবস্থার বৃহত্তর পরিধির অন্তর্ভুক্ত। এ প্রসঙ্গে মনীষী আর.এ. স্কিডমোর ও অন্যান্যদের বক্তব্য হলো, “সোস্যাল ওয়লফেয়ার ইন্ক্লুড নট অনলি কোয়ালিফাইড সোস্যাল ওয়ার্কার্স, বাট অলসো আনট্রেইন্ড পার্সোনাল ইমপ্লোয়েড ইন পাবলিক ওয়লফেয়ার প্রোবিশন এন্ড আদার এরিয়া” পক্ষান্তরে, সমাজকর্ম একটি স্বীকৃত পেশা বলে এতে পেশাদার সমাজকর্মীদের কাজের স্বীকৃতি রয়েছে। এজন্য সমাজকর্মের পরিধি সমাজকল্যাণের তুলনায় সীমিত।
৩.     সমাজকর্ম যেহেতু একটি পেশা সেহেতু সমাজকর্মীদের পেশাগত মূল্যবোধ ও মানদন্ডের প্রতি সদা সচেতন থাকতে হয়। কিন্তু সমাজকল্যাণের বৃহত্তর ক্ষেত্রে সবসময় পেশাগত মূল্যবোধ ও মানদন্ড অনুসরণ না করেও সমাজের কল্যাণ সাধন করা যায়।


পৃষ্ঠা ৬১
৪. সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ আনয়নে মানুষকে সাহায্য করাই সমাজকল্যাণের লক্ষ্য। আর এ লক্ষ্যার্জনের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া হচ্ছে সমাজকর্ম। অর্থাৎ সমাজকল্যাণের বৃহত্তর লক্ষ্যার্জনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হচ্ছে সমাজকর্ম।
৫. সমাজকর্ম কতগুলো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যা মোকাবেলায় নিয়োজিত। পক্ষান্তরে, সমাজকল্যাণের বৃহত্তর পরিধিতে এসব পদ্ধতি প্রয়োগ না করেও বিভিন্ন উপায়ে সমাজের কল্যাণ করা যায়।
৬. সমাজকর্ম হচ্ছে একটি পেশাদার সেবাকর্ম। এজন্য সমাজকর্মীরা কোন না কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে সমাজের কল্যাণ সাধনে নিয়োজিত থাকে। পক্ষান্তরে, সমাজকল্যাণের বৃহত্তর পরিধিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক সেবাকর্মকেও স্বীকার করে নেয়া হয়।
পরিশেষে সংক্ষেপে বলা যায়, সমাজকল্যাণ হলো একটি ব্যবস্থা, যার লক্ষ্য সকল মানুষের কল্যাণ; এবং সমাজকর্ম হলো সমাজকল্যাণ ব্যবস্থার লক্ষ্যার্জনের বিশেষ পেশাগত প্রক্রিয়া বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।

অনুশীলনী
রচনামূলক প্রশ্ন
১.     সমাজসেবা বলতে কি বুঝ ? সমাজকর্মের সঙ্গে সমাজ সেবার পার্থক্য কি ?
২.     সমাজসংস্কার কাকে বলে? সমাজসংস্কারের উদাহরণ দাও।
৩.     সামাজিক মূল্যবোধ কাকে বলে ? সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের পার্থক্য কি?
৪.     সামাজিক পরিবর্তন কাকে বলে ? সামাজিক পরিবর্তনের কারণগুলো আলোচনা কর।
৫.     ‘‘সামাজিক পরিবর্তন সব সময় মঙ্গলজনক নয়’’উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
৬.     সামাজিক নিরাপত্তা কাকে বলে ? সামাজিক নিরাপত্তার গুরুত্ব কি ?
৭.     সামাজিক আইন বলতে কি বুঝ ? সামাজিক আইনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।
৮.     সমাজকর্ম বলতে কি বুঝ? সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্মের পার্থক্য কি ?
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১.     সামাজিক উন্নয়ন কি ?
২.     সামাজিক বীমা ও সামাজিক সাহায্য বলতে কি বুঝায় ?
৩.     সমাজকর্মের বৈশিষ্ট্য কি ?
৪.     সামাজিক আইনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যসমূহ কি ?
৫.     সমাজসেবা ও সমাজকল্যাণের পার্থক্য কি ?
৬.     সমাজসেবা কি ?
৭.     সমাজসেবা ও সমাজকর্মের পার্থক্য কি ?
৮.     সামাজিক নিরাপত্তা কি ?
৯.     সামাজিক পরিবর্তনের কারণ কি ?
১০. সমাজকর্ম কি ?
১১. সামাজিক পরিবর্তন কি ?
১২. সামাজিক আইন কি ?
১৩. সামাজিক মূল্যবোধ কি ?
১৪.    লো এবং লেজিসলেশন এর পার্থক্য কি?







View Foundation Digital Talking Library is developed and maintained by Sigma Enterprise.
Theme designed by Imtiaz
All rights are reserved. Any kind of reproduction of any mp3 files and text files is prohibited. If any organization or any person is found copying or reproducing any of the material will be punished under copy right law.