Logo Sponsored by Chowdhury and Hossain, Advanced Publications

Ekti Photograph read




একটি ফটোগ্রাফ
শামসুর রাহমান
কবি-পরিচিতি
বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের কবিতা দেশপ্রেম ও সামাজিক সচেতনায় সতেজ ও দীপ্ত। নাগরিক জীবন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণ-আন্দোলন তাঁর কবিতায় রূপায়িত হয়েছে বিচিত্র সংবেদনশীলতায়।
কর্মজীবনে শামসুর রাহমান ছিলেন সাংবাদিক। বিভিন্ন সময়ে তিনি ‘মর্নিং নিউজ', ‘দৈনিক বাংলা' ইত্যাদিতে সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রায় এক দশক ধরে তিনি ছিলেন ‘দৈনিক বাংলা'র সম্পাদক।
এ পর্যন্ত তাঁর চল্লিশটিরও বেশি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা অনুবাদেও তিনি সিদ্ধহস্ত। ছোটদের জন্য কবিতা ও ছড়া রচনাতেও তাঁর সাফল্য উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তিনি উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথাও লিখেছেন। কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে: ‘এ ফোঁটা কেমন অনল', ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে', ‘রৌদ্র করোটিতে', ‘বিধ্বস্ত নীলিমা', ‘নিজ বাসভূমে', ‘বন্দী শিবির থেকে', ‘দুঃসময়ের মুখোমুখি', ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা', ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে', ‘উদ্ভট উঠে পিঠে চলেছে স্বদেশ', ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়', ‘শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা' ইত্যাদি।
শামসুর রাহমানের পৈতৃক নিবাস নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে। তাঁর জন্ম ঢাকায় ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৭ আগস্ট ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে।

‘এই যে আসুন, তারপর কী খবর?
আছেন তো ভালো? ছেলেমেয়ে?' কিছু আলাপের পর
দেখিয়ে সফেদ দেয়ালের শান্ত ফটোগ্রাফটিকে
বললাম জিজ্ঞাসু অতিথিকে-
‘এ আমার ছোট ছেলে, যে নেই এখন,
পাথরের টুকরোর মতন
ডুবে গেছে, আমাদের গ্রামের পুকুরে
বছর-তিনেক আগে কাক-ডাকা গ্রীষ্মের দুপুরে।'

কী সহজে হয়ে গেল বলা,
কাঁপলো না গলা
এতটুকু, বুক চিরে বেরুলো না দীর্ঘশ্বাস, চোখ ছলছল
করলো না এবং নিজের কণ্ঠস্বর শুনে
নিজেই চমকে উঠি, কী নিস্পৃহ, কেমন শীতল।
তিনটি বছর মাত্র তিনটি বছর
কত ঊর্ণাজাল বুনে
কেটেছে, অথচ এরই মধ্যে বাজখাঁই
কেউ যেন আমার শোকের নদীটিকে কত দ্রুত রুক্ষ চর
করে দিলো। অতিথি বিদায় নিলে আবার দাঁড়াই
এসে ফটোগ্রাফটির মুখোমুখি প্রশ্নাকুল চোখে,
ক্ষীয়মাণ শোকে।

ফ্রেমের ভেতর থেকে আমার সন্তান
চেয়ে থাকে নিষ্পলক, তার চোখে নেই রাগ কিংবা অভিমান।
 

শব্দার্থ ও টীকা
সফেদ                                    - সাদা।
ফটোগ্রাফ                                - আলোকচিত্র।
জিজ্ঞাসু                                   - জানতে চায় এমন, কৌতূহলী।
নিস্পৃহ                                    - অনাসক্ত।
তিনছি বছর
মাত্র তিনটি বছর                        - পুত্রের মৃত্যুর পর অতিক্রান্ত তিনটি বছরের স্মৃতির বেদনাময় আর্তি এখানে আবেগময় হয়ে উঠেছে।
ঊর্ণাজাল                                 - মাকড়াসার সুতোয় তৈরি জাল। এখানে পুঞ্জীভুত স্মৃতি অর্থে।
কত ঊর্ণাজাল বুনে
কেটেছে                                  - অজস্র স্মৃতি মন্থন করে কাল কাটিয়েঠেছন।
বাজখাঁই                                  - উচ্চ ও কর্কশ। গায়ক বাজ খাঁ বা বাজ বাহাদুরের কণ্ঠের অনুরূপ। এখানে রুক্ষকঠিন অর্থে ব্যবহৃত।
শোকের নদীটিকে কত
দ্রুত রুক্ষ চর করে দিল                  - এ চিত্রকল্প ব্যবহৃত হয়েছে শোকের অবসান হওয়া বোঝাতে।
প্রশ্নাকুল চোখে                          - কাতর ও অধীর জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে।
ক্ষয়মান                                  - হ্রাস পাচ্ছে এমন, ক্ষয়িষ্ণু।
ফ্রেমের ভেতর                           - যে সন্তান ছিল সজীব ও প্রাণবন্ত, সে নেই। অন্তরে তার স্মৃতি ক্ষীয়মাণ। কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটিই তার অস্তিত্বের স্মৃতি।
নিষ্পলক                                  - পলকহীন, চোখের পাতা না ফেলে।
উৎস ও পরিচিতি
শামসুর রাহমানের ‘একটি ফটোগ্রাফ' কবিতাটি নেওয়া হয়েছে তাঁর ‘এক ফোঁটা কেমন অনল' কাব্যগ্রন্থ থেকে। এ কবিতায় মানুষের হৃদয়বৃত্তিকে অনুভব করা হয়েছে সময়ের পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে।
একদা পুত্রশোকে কাতর পিতা তিন বছর পর হঠাৎ অনুভব করলেন ঘরের সাদা দেওয়ালে ঝোলানো মৃত পুত্রের ফটোগ্রাফটি দেখিয়ে নিরাবেগ নিরাসক্ত কণ্ঠে অবলীলায় তিনি অতিথি বন্ধুকে বলে যেতে পারলেন পুত্রের মৃত্যুর ঘটনাটি, কিন্তু নিস্পৃহ শীতল কণ্ঠে সংবাদের মত করে কথাটি বলার পরই তাঁর বুক আবার মোচড় দিয়ে ওঠে। তিনি অবাক হন কীভাবে মাত্র তিনটি বছরের ব্যবধানে তার হৃদয়ের শোকের ও বেদনার নদী শুকিয়ে যেতে পারল।
কীভাবে পুত্রশোক ভুলে যেতে পারলেন- এই বেদনাময় জিজ্ঞাসা নিয়ে দেওয়ালে ঝোলানো ফটোগ্রাফটির দিকে তাকান তিনি। কিন্তু দেওয়ালে পুত্রের ছবিতে কেবল নিরভিমান নিষ্পলক দৃষ্টি।
যে প্রিয়জন একদা ছিল সজীব ও প্রাণবন্ত, মৃত্যুতে তার জীবন্ত অস্তিত্ব হারিয়ে যায়। দেয়ালের ছবিতে থাকে তার নিরাবেগ অস্তিত্ব। কিন্তু তার সজীব স্মৃতি থাকে অন্তর জুড়ে। কালের নিষ্ঠুরতা প্রিয়জনের শোকময় স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে চায়, কিন্তু সংবেদনশীল মন থেকে তা কিছুতেই মুছে দেওয়া যায় না।
ছন্দ
কবিতাটি মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত। চরণ ৮, ১০ ও ৬ মাত্রার। পর্ব বিন্যাসে বৈচিত্র্য আছে। সর্বত্র চরণান্তিক মিল রক্ষিত হয়নি। ছন্দের প্রবাহমানতাও লক্ষণীয়।
অনুশীলনমূলক কাজ
কবিতা উপলব্ধি
১.         প্রথম স্তবক সংলাপধর্মী এবং কথোপকথনে প্রকাশ পেয়েছে তথ্য।
২.         দ্বিতীয় স্তবকে আত্মজিজ্ঞাসার সূত্রে পিতৃহৃদয়ের হাহাকার ধ্বনিত হয়েছে। পিতা যদিও অনুভব করছেন শোক ক্ষীয়মান এবং আপাতত এ শোক ভুলে থাকা যায় বলে মনে হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ শোক ভোলা যায় না।
৩.      শেষ স্তবকে ফ্রেমে বাঁধা পুত্রের ছবির নির্বিকারত্ব নিষ্ঠুর ও কঠিন বাস্তবকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে সজীব প্রাণবন্ত পুত্র যে ছিল সে আর নেই। কিন্তু এ বাস্তবতার কাঠিন্যের বিপরীতে কবির অন্তরের হাহাকার যেন আরও রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে।
উপমা
১.             পাথরের টুকরোর মতন
                ডুবে গেছে
চিত্রকল্প
১.             পাথরের টুকরোর মতন
                ডুবে গেছে আমাদের গ্রামের পুকুরে।
২.             কত ঊর্ণাজাল বুনে
                কেটেছে।
৩.             এরই মধ্যে বাজখাঁই
                কেউ যেন আমার শোকের নদীটিকে কত দ্রুত রুক্ষ চর করে দিলো।
৪.             ফ্রেমের ভেতর থেকে আমার সন্তান
                চেয়ে থাকে নিষ্পলক,
ভাষা অনুশীলন
বিশেষণবাচক-‘কী’
কী-শব্দটির একটি লক্ষণীয় দিক হচ্ছে বিশেষণ হিসেবে এর ব্যবহার।
যেমন, ‘এটি ফটোগ্রাফ' কবিতায় :
১.         এই যে আসুন, তারপর কী খবর?
২.         নিজেই চমকে উঠি, কী নিস্পৃহ, কেমন শীতল।
            ‘কী' বিশেষণের বিশেষণ কিংবা ক্রিয়াবিশেষণের বিশেষণ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন, একই কবিতায়: কী সহজে হয়ে গেল বলা।
বিশেষণ শব্দ:

সফেদ দেয়াল
শান্ত ফটোগ্রাফ
জিজ্ঞাসু অতিথি
ছোট ছেলে
নিস্পৃহ কণ্ঠস্বর
তিনটি বছর
রুক্ষ চর
প্রশ্নাকুল চোখ
ক্ষীয়মাণ শোক


বিশেষণ সম্বন্ধ:

পাথরের টুকরো
আমাদের গ্রামের পুকুর
গ্রীষ্মের দপুর
শোকের নদী
আমার সন্তান


ক্রিয়া বিশেষণ :
সহজে হয়ে গেল বলা।

দীর্ঘ-উত্তর প্রশ্ন
১.     ‘একটি ফটোগ্রাফ’ কবিতার ভাববস্ত্ত নিজের ভাষায় লেখ।
২.     সময়ের ব্যবধানে শোকের বেদনা কি বিলীন হয়ে যায়? এ সম্পর্কে একজন পিতার যে অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে ‘একটি ফটোগ্রাফ’ কবিতা অবলম্বনে তার স্বরূপ তুলে ধর।
বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১.     জিজ্ঞাসু, অতিথিকে পিতা কী সংবাদ জানান? সংবাদটি জানানোর পর তার কী প্রতিক্রিয়া হয়? কেন?
২.     ‘আবার দাঁড়াই/এসে ফটোগ্রাফটির মুখোমুখি প্রশ্নাকুল চোখে’- পিতার চোখে কী প্রশ্ন ছিল? ফটোগ্রাফের দিকে তাকিয়ে তিনি কী দেখতে পেলেন?
৩.     ফটোগ্রাফের নিষ্পলক ছবি কোন বাস্তবতার ইঙ্গিত দিচ্ছে? পিতার শোকের সঙ্গে এ বাস্তবতার সম্পর্ক কী?

ভাষাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১.     বিশেষণ বেছে নাও এবং বাক্যে সেগুলোর প্রয়োগ দেখাও :
        ক) কিছু আলাপের পর
        দেখিয়ে সফেদ দেয়ালের শান্ত ফটোগ্রাফটিকে
        বললাম জিজ্ঞাসু অতিথিকে-
        খ) অতিথি বিদায় নিলে আবার দাঁড়াই
        এসে ফটোগ্রাফটির মুখোমুখি প্রশ্নাকুল চোখে,
        ক্ষীয়মান শোকে।
২.     নিম্নলিখিত বিশেষণ সম্বন্ধগুলোর সাহায্যে সরল বাক্য রচনা কর :
        পাথরের টুকরো, গ্রামের পুকুর, গ্রীষ্মের দুপুর, নিজের কণ্ঠস্বর, শোকের নদী, আমার সন্তান।

ব্যাখ্যা
সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা লেখ :
১.     নিজের কণ্ঠস্বর শুনে ...... কেমন শীতল।
২.     কেউ যেন ..... চর করে দিলো।
৩.             ফ্রেমের ভেতর ....... কিংবা অভিমান।

View Foundation Digital Talking Library is developed and maintained by Sigma Enterprise.
Theme designed by Imtiaz
All rights are reserved. Any kind of reproduction of any mp3 files and text files is prohibited. If any organization or any person is found copying or reproducing any of the material will be punished under copy right law.