পৃষ্ঠা ২৬২
সপ্তম অধ্যায়
সামাজিক সমস্যা সমাধানে সমাজকর্মের পদ্ধতিসমূহ

সমাজকর্ম বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, মানবহিতৈষী দর্শন এবং পেশাগত দক্ষতা ও নৈপুণ্যের ওপর ভিত্তিশীল একটি মানবসেবা প্রদানকারী পেশা। কতগুলো বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তি, দল ও সমাজের সমস্যা সমাধানে মানুষকে সেবাদান করা সমাজকর্মের মূল লক্ষ্য। ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যা, সম্পদ এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজকর্মে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হয়। পদ্ধতিগত সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়াই সমাজকর্মকে সনাতন সমাজসেবা কার্যক্রম হতে পৃথক সত্তা ও স্বতন্ত্র পেশার মর্যাদা দান করেছে।
পদ্ধতি কি?
সমাজকর্ম পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য ‘পদ্ধতি’ প্রত্যয়টি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। ইংরেজি ‘মেথড' এর বাংলা পরিভাষা হলো পদ্ধতি। 'মেথড' শব্দটি গ্রীক 'মেটা' এবং হুডস থেকে উদ্ভূত। মেটা শব্দের অর্থ উয়িথ এবং হুডস এর অর্থ হলো ওয়ে। সুতরাং উৎপত্তিগত অর্থে কোন কাজ সুশৃঙ্খল উপায়ে সম্পন্ন করতে যে পন্থার সাহায্য নিতে হয়, তাই হলো পদ্ধতি। অর্থাৎ সুশৃঙ্খল ও সুপরিকল্পিত উপায়ে কোন কাজ সম্পাদনের উপায় হলো পদ্ধতি। উল্লেখ্য, পদ্ধতি এবং কৌশল এক নয়। পদ্ধতি হলো সম্পূর্ণ কাজটি কি উপায়ে করা হবে, তার সার্বিক পন্থা। আর কৌশল হলো পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে কি কি উপায় অবলম্বন করতে হবে তার উপায়।[1]
মনীষী এইচ বি ট্রেকার বলেছেন, ‘‘পদ্ধতি হলো কোন লক্ষ্যার্জনের একটি সচেতন প্রক্রিয়া এবং সুপরিকল্পিত উপায়। বাহ্যিক দিক হতে এটি একটি কর্ম সম্পাদন প্রক্রিয়া বা উপায় প্রতীয়মান হলেও এর অন্তরালে রয়েছে সুসমন্বিত জ্ঞান, উপলব্ধি এবং সুনির্দিষ্ট কর্মনীতি।’’ সুতরাং বলা যায়, সুশৃঙ্খল জ্ঞান, উপলব্ধি এবং সুনির্দিষ্ট কর্মনীতির ওপর ভিত্তিশীল কর্মসম্পাদনের সুপরিকল্পিত উপায় হলো পদ্ধতি। পদ্ধতিই বলে দেয় কিভাবে নির্দিষ্ট কাজটি করা সম্ভব।
সমাজকর্ম পদ্ধতির ধারণা
সমাজকর্মে পদ্ধতি পরিভাষাটি নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। স্থান-কাল-অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যা সমাধানে সাহায্য করার জন্য পেশাদার সমাজকর্মে যেসব সুশৃঙ্খল উপায় বা পন্থা প্রয়োগ করা হয়, সেসব পন্থা বা উপায়গুলোর সমষ্টিই সমাজকর্ম অনুশীলন পদ্ধতি। অন্যভাবে বলা যায়, যেসব কর্ম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজকর্মের জ্ঞান, দক্ষতা এবং নীতিমালা সমস্যা সমাধানে সাহায্য করার ক্ষেত্রে সমাজকর্মীরা প্রয়োগ করে থাকেন, সেসব সুশৃঙ্খল কর্ম প্রক্রিয়ার সমষ্টিই সমাজকর্ম পদ্ধতি। সমাজকর্মের তাত্ত্বিক জ্ঞান বাস্তব ক্ষেত্রে অনুশীলনের বাহন হচ্ছে সমাজকর্ম পদ্ধতি। সমাজকর্মের জ্ঞান, দর্শন, দক্ষতা ও নৈপুণ্য অনুশীলনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে মানুষকে সাহায্য করার লক্ষ্যেই সমাজকর্ম পদ্ধতিগুলোর উদ্ভব। পেশাদার সমাজকর্মের জ্ঞান, নীতি, মূল্যবোধ ও দর্শন এসব পদ্ধতিগুলোর মূল ভিত্তি।
সমাজকর্ম পদ্ধতির শ্রেণী বিভাগ
সমাজকর্মের লক্ষ্য হচ্ছে সমস্যাগ্রস্ত সেবাপ্রার্থীর সামাজিক ভূমিকা পালন, ক্ষমতার উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে সাহায্য করা। যাতে সে নিজেই নিজের সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয়। সমাজের মানুষের সমস্যা, সম্পদ, চাহিদা প্রভৃতির মধ্যে পার্থক্য থাকায়, সমাজকর্মে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় মৌলিক পদ্ধতি এবং সহায়ক পদ্ধতি এ দু’ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।
ক. মৌলিক পদ্ধতিঃ সমাজকর্মের মৌলিক পদ্ধতি বলতে সেসব কর্ম প্রক্রিয়াগুলোকে বুঝায়, যেগুলো সমস্যা সমাধানে সরাসরি এবং প্রত্যক্ষভাবে প্রয়োগ করা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার সামগ্রিক কার্যক্রম এসব পদ্ধতিগুলোকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় বিধায় এগুলোকে মৌলিক পদ্ধতি বলা হয়। মৌলিক পদ্ধতি তিনভাবে বিভক্ত। যেমন
১. ব্যক্তি সমাজকর্ম
২. দল সমাজকর্ম
৩. জনসমষ্টি সংগঠন ও জনসমষ্টি উন্নয়ন
খ. সহায়ক পদ্ধতিঃ সমাজকর্মের সহায়ক পদ্ধতি বলতে সেসব সুশৃঙ্খল কর্ম প্রক্রিয়াগুলোকে বুঝায়, যেগুলো সমস্যা সমাধানে সরাসরি প্রয়োগ না করে পরোক্ষভাবে প্রয়োগ করা হয়। মৌলিক পদ্ধতিগুলোর সফল প্রয়োগে সহায়তা দান করে বিধায় এগুলোকে সহায়ক পদ্ধতি বলা হয়। সহায়ক পদ্ধতিগুলো তিনভাবে বিভক্ত। যেমন
১. সমাজকল্যাণ প্রশাসন
২. সমাজকর্ম গবেষণা
৩. সামাজিক কার্যক্রম
পৃষ্ঠা ২৬৩
সমাজকর্মের মৌলিক এবং সহায়ক পদ্ধতিগুলো পৃথকভাবে আলোচনা করা হলেও এগুলো পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। বাস্তবক্ষেত্রে একটি পদ্ধতি প্রয়োগ করতে গিয়ে অন্যান্য পদ্ধতির সহায়তা গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এজন্য সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় মৌলিক ও সহায়ক পদ্ধতিগুলো সমন্বিতভাবে প্রয়োগ করা হয়। সমস্যা সমাধানে সমাজকর্মে সমন্বিত পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়।
সমাজকর্ম অনুশীলনে সমন্বিত পদ্ধতির সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের পেশাগত জ্ঞান এবং দক্ষতা সংশ্লিষ্ট। যে জ্ঞান ও দক্ষতা ব্যক্তি, দল ও সমষ্টিকে সেবা প্রদানে ব্যবহৃত কৌশলগুলোকে সমন্বিত উপায়ে প্রয়োগে সক্ষম করে তুলে। বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের সমাজকর্মীদের দ্বারা এরূপ সমন্বিত অনুশীলন করা হয়।
সমাজকর্ম পদ্ধতি
মৌলিক পদ্ধতি | সহায়ক পদ্ধতি |
১। ব্যক্তি সমাজকর্ম | ১। সমাজকল্যাণ প্রশাসন |
২। দল সমাজকর্ম | ২। সমাজকর্ম গবেষণা |
৩। সমষ্টি সংগঠন ও সমষ্টি উন্নয়ন | ৩। সামাজিক কার্যক্রম। |
ব্যক্তি সমাজকর্ম
পেশাদার সমাজকর্মের তিনটি মৌলিক পদ্ধতির মধ্যে ব্যক্তি সমাজকর্ম অন্যতম। সমাজ গঠনের মূল অণু ব্যক্তির সমস্যাকে কেন্দ্র করে ব্যক্তি সমাজকর্ম আবর্তিত। দল ও জনসমষ্টির সমস্যা সমাধান দিতে গেলে ব্যক্তিগত সমস্যার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে হয়। কারণ ব্যক্তিকে উপেক্ষা করে দল বা সমষ্টির সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এজন্য সমাজকর্মের পদ্ধতি হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্ম বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
ব্যক্তি সমাজকর্মের সংজ্ঞা
ব্যক্তি সমাজকর্ম এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে সমস্যাগ্রস্ত সেবাপ্রার্থীর সুপ্ত প্রতিভা ও সম্ভাবনার বিকাশ সাধনের দ্বারা তার সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতা পুনরুদ্ধার, উন্নয়ন ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টা চালানো হয়। মনীষীরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে ব্যক্তি সমাজকর্মের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিচে কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো
সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী, ‘‘ব্যক্তি সমাজকর্ম হলো পেশাদার সমাজকর্মীদের দ্বারা ব্যবহৃত এমন একটি পদ্ধতি, মূল্যবোধ ব্যবস্থা, অনুশীলনের ধরন যাতে মনোঃসামাজিক, আচরণগত এবং বিভিন্ন ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট প্রত্যয়গুলোকে অনুশীলন দক্ষতায় রূপান্তরিত করে ব্যক্তি ও পরিবারকে আন্তঃব্যক্তিক, আর্থ-সামাজিক এবং পরিবেশগত সমস্যা সমাধানে সরাসরি সাহায্য করা হয়।’’[2] বিজ্ঞানসম্মত ব্যক্তি সমাজকর্মের অগ্রদূত হিসেবে খ্যাত ম্যারি রিচমন্ড এর মতে, ‘‘ব্যক্তি সমাজকর্ম সেসব প্রক্রিয়ার সমষ্টি, যেগুলো মানুষকে তার সামাজিক পরিবেশ এবং সমাজের অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সচেতন ও কার্যকর সামঞ্জস্য বিধানের মাধ্যমে ব্যক্তিত্ব বিকাশে সাহায্য করে থাকে।’’
আলোচ্য সংজ্ঞাটিতে ব্যক্তি সমাজকর্মকে মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশ এবং পরিবর্তিত সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে সহায়তা করার প্রক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সামাজিক পরিবেশে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সামঞ্জস্য বিধানের ব্যর্থতা হতে মানুষ সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং সুষ্ঠু ও কার্যকর সামাজিক সম্পর্ক বজায় রেখে মানুষ যাতে সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারে, সেজন্য সহায়তা করে ব্যক্তি সমাজকর্ম। মানুষের ব্যক্তিত্বের অসামঞ্জস্যতা দূরীকরণের উপায় হলো ব্যক্তি সমাজকর্ম। ব্যক্তি ও পরিবেশের মধ্যে কার্যকর মিথষ্ক্রিয়ায় সাহায্য করাই ব্যক্তি সমাজকর্মের লক্ষ্য।
ডব্লিউএ ফ্রিডল্যান্ডার এর মতে, ‘‘ব্যক্তি সমাজকর্ম হলো এমন একটি পদ্ধতি, যা সমস্যাগ্রস্ত সেবাপ্রার্থীকে এমনভাবে সাহায্য করে, যাতে সে উন্নততর সামাজিক সম্পর্ক ও সামঞ্জস্য বিধানে সক্ষম হয়ে সুখী এবং অর্থবহ জীবন যাপন করতে পারে।’’ মনীষী ওয়ার্নার বোহেম এর মতে, ‘‘ব্যক্তি সমাজকর্ম হলো সমাজকর্মের এমন একটি পদ্ধতি, যা কোন ব্যক্তির সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতার উন্নয়ন, পুনরুদ্ধার বা সংরক্ষণের জন্য ব্যক্তির জীবনের মনস্তাত্বিক দিকে হস্তক্ষেপ করে।’’
ব্যক্তি সমাজকর্মের বৈশিষ্ট্য
ব্যক্তি এবং তার সমস্যাকে কেন্দ্র করে ব্যক্তি সমাজকর্ম আবর্তিত। ব্যক্তি সমাজকর্মের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো হলো
- ব্যক্তি সমাজকর্ম বিভিন্ন বিজ্ঞানের জ্ঞান এবং পেশাগত নৈপুণ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি সমস্যা সমাধান পদ্ধতি।
- এতে সমস্যাগ্রস্ত সেবাপ্রার্থীর সুপ্ত প্রতিভা ও অন্তর্নিহিত সত্তার পূর্ণ বিকাশের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়।
- এতে সমস্যা সমাধানের একক হিসেবে ব্যক্তিকে গ্রহণ করা হয়। ব্যক্তি সমাজকর্মের কেন্দ্রবিন্দু হলো সমস্যাগ্রস্ত সেবাপ্রার্থী ব্যক্তি
- ব্যক্তি সমাজকর্ম মনস্তাত্বিক, আর্থিক ও সামাজিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত একটি সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া।
পৃষ্ঠা ২৬৪
- এতে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব এবং বাহ্যিক পরিবেশের প্রতি সমান গুরুত্ব দেয়া হয়।
- এটি একটি সক্ষমকারী প্রক্রিয়া। সেবাপ্রার্থীকে সমস্যা সমাধানে সক্ষম করে তোলার লক্ষ্যে ব্যক্তি সমাজকর্ম প্রক্রিয়া পরিচালিত।
ব্যক্তি সমাজকর্মের নিজস্ব দর্শন, পদ্ধতি ও পৃথক সত্তা রয়েছে। যেগুলো একে অন্যান্য মৌলিক পদ্ধতি হতে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করেছে।
ব্যক্তি সমাজকর্মের উদ্দেশ্য
ব্যক্তি সমাজকর্মের মূল লক্ষ্য হলো সেবাপ্রার্থীকে এমনভাবে সাহায্য করা, যাতে সে জীবনের সার্বিক অবস্থা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। ব্যক্তি ও তার পরিবেশের মধ্যে কার্যকর মিথষ্ক্রিয়ার সাহায্য করাই এর মূল লক্ষ্য।
ব্যক্তি সমাজকর্মের বিভিন্ন সংজ্ঞার আলোকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যগুলো এখানে উল্লেখ করা হলো
১. সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতার উন্নয়নঃ সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির (সেবাপ্রার্থীর) সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতার পুনরুদ্ধার, উন্নয়ন এবং জোরদার করতে সহায়তা দান। যাতে ব্যক্তি কার্যকরভাবে স্বীয় সমস্যা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়।
২. সুপ্ত ক্ষমতা ও অন্তর্নিহিত প্রতিভার বিকাশ : সমস্যাগ্রস্ত সেবাপ্রার্থীর সমস্যা সমাধানের অপরিহার্য দিক হচ্ছে তার সুপ্ত ক্ষমতা ও প্রতিভার বিকাশ সাধন। যাতে সে স্বীয় ক্ষমতা এবং প্রতিভার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়ে উঠে। ব্যক্তি সমাজকর্মের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সেবাপ্রার্থীর সুপ্ত ক্ষমতা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা।
৩. সামঞ্জস্য বিধানে সাহায্য করা : সদা পরিবর্তনশীল আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সেবাপ্রার্থী যাতে সুষ্ঠু ও কার্যকর সামঞ্জস্য বিধানে সক্ষম হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদান ব্যক্তি সমাজকর্মের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম।
৪. সমস্যা সমাধানে সক্ষম করে তোলাঃ ব্যক্তি সমাজকর্মে সেবাপ্রার্থীকে এমনভাবে সাহায্য করা হয়, যাতে সে নিজস্ব সম্পদ ও সামর্থ্যের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেই সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয়ে উঠে। সমস্যাগ্রস্ত সেবাপ্রার্থীকে সমস্যা সমাধানে সক্ষম করে তোলা ব্যক্তি সমাজকর্মের মূল লক্ষ্য।
৫. অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি : ব্যক্তির সমস্যার পেছনে বাহ্যিক এবং মানসিক এ দু’ধরনের কারণ বিদ্যমান থাকে। ব্যক্তিত্বের দুর্বলতা ও ক্রুটিপূর্ণ বিকাশের ফলে যেমন সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, তেমনি পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাবেও সমস্যা সৃষ্টি হয়। ব্যক্তি সমাজকর্মে অনুকূল আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়।
৬. সামাজিক ভূমিকা নির্ধারণে সহায়তা দান : সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যক্তি যখন স্বীয় ভূমিকা নির্ধারণ এবং যথাযথ পালনে ব্যর্থ হয়, তখন সে সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ব্যক্তি সমাজকর্ম সেবাপ্রার্থীর সামাজিক ভূমিকা নির্ধারণে সহায়তা করে। যাতে সে সামাজিক পরিচিতি, মর্যাদা ও সম্পর্কের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বীয় ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়।
৭. আর্থ-সামাজিক পুনর্বাসন : অনুকূল পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে সেবাপ্রার্থীকে পুনর্বাসিত করা ব্যক্তি সমাজকর্মের লক্ষ্যগুলোর অন্তর্ভুক্ত।
ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদান
ব্যক্তি সমাজকর্ম কতগুলো অপরিহার্য বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত। এসব অপরিহার্য বিষয়গুলোকে ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদানগুলো কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে নিহিত। প্রশ্নগুলো হলো- কাকে সাহায্য করা হবে? কেন সাহায্য করা হবে? কোথায় এবং কার মাধ্যমে সাহায্য করা হবে? কিভাবে সাহায্য করা হবে? যেসব উপাদানের সমন্বয়ে ব্যক্তি সমাজকর্ম গঠিত, সেসব উপাদান চিহ্নিত করতে গিয়ে হ্যালেন পার্লম্যান বলেছেন, সমস্যাসহ যখন কোন ব্যক্তি এমন কোন স্থানে আগমন করে, যেখানে কোন পেশাদার প্রতিনিধি বিশেষ প্রক্রিয়ায় তাকে সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে থাকে।[3] উক্তিটি বিশ্লেষণ করলে ব্যক্তি সমাজকর্মের নিচের উল্লিখিত পাঁচটি উপাদান পাওয়া যায়।
১. ব্যক্তি ২. সমস্যা ৩. স্থান বা প্রতিষ্ঠান ৪. পেশাদার প্রতিনিধি ৫. প্রক্রিয়া
নিচে ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদনগুলোর বিবরণ দেয়া হলো
১. ব্যক্তি : ব্যক্তি সমাজকর্মের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ব্যক্তি। ব্যক্তি বলতে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিকে বুঝায়, যিনি সমস্যা সমাধানের জন্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা পেশাদার সমাজকর্মীর নিকট সেবাপ্রার্থী। সমাজকর্মের পরিভাষায় তাকে ক্লায়েন্ট বলা হয়। সমাজের অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে তার পার্থক্য হচ্ছে, সমস্যাজনিত কারণে সে স্বাভাবিক সামাজিক ভূমিকা পালনে অক্ষম। ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদান হিসেবে ব্যক্তি নিচের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
ক. সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি যে কোন শ্রেণীর, বয়সের, লিঙ্গের বা বর্ণের হতে পারে।
পৃষ্ঠা ২৬৫
খ. সে প্রতিকূল আর্থ-সামাজিক ও মনোদৈহিক অবস্থার শিকার।
গ. সে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
ঘ. সে অস্বাভাবিক আচরণকারী।
ঙ. নিজ ক্ষমতা ও সামর্থ্যের দ্বারা সে তার সমস্যা সমাধানে অক্ষম।
চ. ব্যক্তি তার সমস্যার সমাধান চায়।
ছ. সমস্যা সমাধানের জন্য সে পেশাগত সেবাপ্রার্থী।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি নিজে বা তার পরিবারের কোন সদস্য অথবা শুভাকাঙ্খী সমস্যা সমাধানের জন্য সমাজকর্মী বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিকট পেশাগত সেবা প্রার্থনা করলেই তাকে ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। এজন্য পেশাদার সমাজকর্মে ব্যক্তিকে বর্তমানে সেবাপ্রার্থী, সুবিধাভোগী, সেবা ব্যবহারকারী প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়।
২. সমস্যা : যেসব আর্থ-সামাজিক মনোঃদৈহিক অবস্থা ব্যক্তির সামাজিক ভূমিকা পালনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে, সেগুলোকেই ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদানের দৃষ্টিকোণ হতে সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সমস্যা হলো একটি যন্ত্রণাদায়ক অস্বাভাবিক অবস্থা, যার প্রভাবে ব্যক্তি সামাজিক ভূমিকা পালনে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। ব্যক্তির সমস্যার উৎসগুলোকে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ এ দু’টো শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
বাহ্যিক উৎসগুলো হচ্ছে
ক. অর্থনৈতিক বিচ্যুতি
খ. সামাজিক বিচ্যুতি
গ. সামাজিক ভারসাম্যহীনতা
অভ্যন্তরীণ বা মনস্তাত্ত্বিক উৎস হচ্ছে
ক. আন্তঃব্যক্তিক দ্বন্দ্ব
খ. আন্তঃপারিবারিক দ্বন্দ্ব
গ. মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের সামঞ্জস্যহীনতা
ঘ. ব্যক্তিত্বের বিচ্যুতি বা আচরণগত সামঞ্জস্যহীনতা
ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদান হিসেবে শুধু সেসব সমস্যাকেই চিহ্নিত করা হয়, যেগুলো সামাজিক ভূমিকা পালনে বাঁধার সৃষ্টি এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে। বৃহৎ কোন সমস্যাকে ব্যক্তি সমাজকর্মের উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।
৩. স্থান বা প্রতিষ্ঠান : ব্যক্তি সমাজকর্মের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো স্থান বা এজেন্সী। যে প্রতিষ্ঠান বা এজেন্সীর মাধ্যমে ব্যক্তি সমাজকর্ম পদ্ধতির আওতায় সেবাপ্রার্থীর সমস্যা সমাধানে সহায়তা করা হয়, তাকেই স্থান বা প্রতিষ্ঠান বলা হয়। ব্যক্তি সমাজকর্ম পদ্ধতির বাস্তব প্রয়োগের বাহন হচ্ছে প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্মীগণ সমস্যাগ্রস্ত সেবাপ্রার্থীকে সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে থাকেন। প্রতিষ্ঠানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো গতিশীলতা। আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যক্তি সমাজকর্ম এজেন্সী বা প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলীও পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ সময়, সম্পদ, চাহিদা এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কার্যাবলীর পরিবর্তন ঘটে। প্রতিষ্ঠান সরকারি এবং বেসরকারি এ দু’ধরনের হয়ে থাকে।
৪. পেশাদার প্রতিনিধি : পেশাদার প্রতিনিধি বলতে ব্যক্তি সমাজকর্মীকেই বুঝানো হয়। যিনি সমাজকর্মের দক্ষতা ও নৈপুণ্যের অধিকারী এবং সমাজকর্মকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। পেশাদার প্রতিনিধি ব্যক্তি সমাজকর্মের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর মাধ্যমে ব্যক্তি সমাজকর্ম পদ্ধতি বাস্তবায়িত হয়। তাঁর প্রধান ভূমিকা হচ্ছে সমাজকর্মের জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও কৌশল অনুশীলন করে সেবাপ্রার্থীকে সমস্যা সমাধানে সক্ষম করে তোলা। পেশাদার প্রতিনিধি হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্মীকে কতগুলো বিশেষ জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং গুণাবলীর অধিকারী হতে হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে
ক. সমাজকর্ম পেশার মৌলিক দর্শন, নীতি ও মূল্যবোধ বজায় রেখে দায়িত্ব পালনে ব্রতী হওয়া।
খ. সেবাপ্রার্থীর সঙ্গে পেশাগত সম্পর্ক স্থাপনের দক্ষতা।
গ. প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য, আদর্শ, নীতি, কর্মসূচি এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ধারণা ও জ্ঞান লাভ।
ঘ. প্রতিষ্ঠানের নীতি, আদর্শ ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে একাত্ব হয়ে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালনের মানসিক প্রস্তুতি এবং দক্ষতা অর্জন।
ঙ. মৌলিক মানবিক আচরণ সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন।
পৃষ্ঠা ২৬৬
প্রতিষ্ঠান বা এজেন্সীর সেবাদানের প্রকৃতি অনুযায়ী ব্যক্তি সমাজকর্মীদের পদবী বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন- চিকিৎসা সমাজকর্মী, স্কুল সমাজকর্মী, প্রবেশন অফিসার ইত্যাদি।
৫. প্রক্রিয়া : সাধারণভাবে প্রক্রিয়া বলতে ধারাবাহিক কার্যপ্রণালীকে বুঝানো হয়। ব্যক্তি সমাজকর্মে সেবাপ্রার্থীর সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে গৃহীত ধারাবাহিক কর্ম প্রণালীকে বুঝায়। ব্যক্তি সমাজকর্ম প্রক্রিয়া হচ্ছে ধারাবাহিক এবং গতিশীল কর্মপ্রবাহ। সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিষ্ঠান বা সমাজকর্মীর নিকট প্রথম পেশাগত সেবা প্রার্থনা হতে এ প্রক্রিয়া আরম্ভ হয় এবং সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। ব্যক্তি সমাজকর্ম প্রক্রিয়ার সুনির্দিষ্ট কতকগুলো স্তর বা পর্যায় রয়েছে। এগুলো হচ্ছে অনুধ্যান, সমস্যা নির্ণয়, সমস্যা সমাধান পরিকল্পনা এবং মূল্যায়ন । এসব স্তরগুলো অনুসরণ করে ব্যক্তি সমাজকর্ম প্রক্রিয়া চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে। উল্লেখ্য, সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া হিসেবে সেবাপ্রার্থী কর্তৃক উপস্থাপিত সব সমস্যার সমাধানই ব্যক্তি সমাজকর্মের পরিধিভুক্ত নয়। সেবাপ্রার্থীর সুপ্ত প্রতিভা ও অন্তর্নিহিত সত্তার বিকাশ এবং হৃতক্ষমতা পুনরুদ্ধার, সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতার উন্নয়ন ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে সহায়তা দান ব্যক্তি সমাজকর্ম প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত।
উপরিউক্ত পাঁচটি উপাদানের সমন্বয়ে ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া পরিচালিত। এগুলোর কোন একটি উপাদানকে বাদ দিয়ে, ব্যক্তি সমাজকর্ম পদ্ধতি বাস্তবায়িত হতে পারে না।